ঢাবিতে মারাত্মক শব্দদূষণ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি জসীমউদদীন হলের খেলার মাঠের অবস্থান চারটি আবাসিক হলের কেন্দ্রবিন্দুতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক-অনাবাসিক শিক্ষার্থীরা সকাল-সন্ধ্যা, এমনকি মধ্য রাত পর্যন্ত মাঠকে ঘিরে বিভিন্ন কর্মকা-ে অংশ নেয়। সকালের সূর্য উদয়ের পর ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে শুরু হয় ফুটবল কিংবা ক্রিকেট খেলা। এ সময় দর্শনার্থী, খেলোয়াড়দের চিৎকার ও মাইকে উচ্চস্বরে গান-বাজনার কারণে এখানে থাকা হলগুলোর মধ্যে বিশেষ করে কবি জসীমউদদীন শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। কোন ধরনের বিধি-নিষেধের তোয়াক্কা না থাকায় গভীর রাতেও চলে সাউন্ডবক্স বাজিয়ে গান-বাজনা।

শুধু এ অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের নয়, টিএসসি রাজু ভাস্কর্যে নানা আয়োজনে সাউন্ড বক্স ও মাইক ব্যবহারের কারণে রোকেয়া ও শামসুন নাহার হলের ছাত্রীদেরও অবর্ণনীয় দুর্ভোগ সয়ে নিতে হচ্ছে। ছাত্রীরা দীর্ঘদিন এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানালেও নেয়া হয়নি কোন কার্যকর পদক্ষেপ। ক্লাস চলাকালীন ছাত্রসংগঠনগুলোর মিছিল-মিটিংয়ের কারণে কলা ভবন ও কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের একই যন্ত্রণা পোহাতে হয়। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট অধিবেশনে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন বেশ কয়েকজন শিক্ষক।

সিনেট সদস্য ও উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মিহির লাল সাহা তার বক্তব্যে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু হল, জগন্নাথ হল, শামসুন্নাহার হল এবং রোকেয়া হলের শিক্ষার্থীরা শব্দদূষণের কারণে মারাত্মক ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। এখানে থাকার এবং পড়ালেখার কোন পরিবেশ নেই’ এ বিষয়ে তিনি সংবাদকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় হলো লেখাপড়ার জায়গা। ছাত্র-ছাত্রীরা হলে থাকবে, ঘুমাবে এবং পড়ালেখা করবে। এখানে পরিবেশটা যদি সবসময় নয়েজ থাকে তাহলে শিক্ষার্থীদের মাথার ওপর চাপ সৃষ্টি হয়। পড়ালেখায় মন বসে না। আমরা নিজেরাও ক্লাস নেয়ার সময় এমনকি বাংলোয়-কোয়ার্টারে থাকা শিক্ষকরাও শব্দদূষণের শিকার হচ্ছেন।’

তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সময়ে কনসার্ট হয়। কনসার্ট হওয়া ভালো। কিন্তু এর সাউন্ড সিস্টেমটা কন্ট্রোল করা উচিত। আবার খেলাধুলা হবে ঠিক আছে। কিন্তু এর সঙ্গে সাউন্ড বক্সে উচ্চস্বরে গান-বাজনা, হৈ-হুল্লোড় এটা নিষিদ্ধ করতে হবে। অন্য শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার বিঘœ ঘটানোর অধিকার তো কারো নেই।’ ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নাজনীন আফরোজ হক বলেন, ‘শব্দদূষণের কারণে আমাদের ক্লাস নিতে খুবই অসুবিধা হয়। এই সমস্যা সমাধানে কোন পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না। এ সমস্যার সমাধানে যারা অভিজ্ঞ বা পরামর্শ দিতে পারে তাদের কাছ থেকেও পরামর্শ নেয়া হয় না।’

বিষয়টি নিয়ে বেশ কয়েকদিন পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতারা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নেই দাবি করলেও তারাই আবার শব্দদূষণের মাধ্যমে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল নিয়মানুযায়ী ক্লাস চলাকালীন কলা ভবন এলাকায় মাইক ব্যবহারে বিধি থাকলেও সেটি তারা মানছেন না।

সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সাবেক সভাপতি সালমান সিদ্দিকী বলেন, ‘এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ঐতিহাসিকভাবেই শিক্ষার্থীদের স্বার্থে এবং বিভিন্ন জাতীয় স্বার্থে মিছিল-মিটিং-সংগ্রাম হয়ে আসছে। এটা তো স্বাভাবিক বিষয়। আমরা ছাত্রদের বিভিন্ন অধিকার এবং দাবি-দাওয়া নিয়েই আন্দোলন সংগ্রাম করি।’

অন্যদিকে টিএসসি এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট নয় এমন কর্মসূচিও পালিত হচ্ছে নিয়মিত। নানা উপলক্ষে অনুষ্ঠিত হচ্ছে কনসার্ট। এতে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার প্রস্তুতি, ঘুমসহ নিত্যদিনে ব্যাপকভাবে সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

রোকেয়া হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ফাতেহা শারমিন এ্যানি সংবাদকে বলেন, ‘টিএসসির পাশেই মেয়েদের দুটি হল। অথচ টিএসসি এলাকায় বিশেষ করে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ও টিএসসির সুইমিং পুলে প্রায় প্রতিদিনই কনসার্টসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয়। যেখানে অনেক রাত পর্যন্ত লাউড স্পিকারে গান-বাজনা চলে। আমাদের সবারই সকালে ক্লাস-পরীক্ষা থাকে। আবার অনেকরই শব্দ ফোবিয়ার, মাথাব্যথার মতো সমস্যা আছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষের এ ব্যাপারে কোন ভ্রƒক্ষেপ নেই।’

রোকেয়া হলের অন্য এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমার পরীক্ষার রাতে টিএসসিতে গভীর রাত পর্যন্ত সাউন্ড বক্সে গান-বাজনা হচ্ছিল। আমি একটুও পড়তে পারিনি। আমি সেদিন রাতে অনেক্ষণ কান্না করেছিলাম।’

বাংলাদেশের ‘শব্দদূষণ বিধিমালা ২০০৬’ অনুযায়ী- ‘আবাসিক এলাকা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল বা একই জাতীয় অন্য কোন প্রতিষ্ঠান বা তার চতুর্দিকে ১০০ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় ভোর ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত অর্থাৎ দিবাকালীন সময়ে ৫৫ ডেসিবল এবং রাত ৯টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত অর্থাৎ রাত্রীকালীন সময়ে শব্দের মাত্রা ৪৫ ডেসিমেল নির্ধারণ করা হয়েছে। যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসে শব্দের মাত্রা গড়ে ৮৫ ডেসিমেলের বেশি।’

এ ব্যাপারে রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুস সালাম বলেন, অডিওমিটার মেশিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শব্দের মাত্রা বেশিরভাগ সময়ে ৭০ ডেসিমেল এর ওপরে থাকে। তবে মাইকে যখন বিভিন্ন প্রোগ্রাম করা হয় বা লাউড স্পিকারে গান-বাজনা করা হয় তখন এটি ১০০ ডেসিমেলকেও ছাড়িয়ে যায়। অর্থাৎ গড়ে ক্যাম্পাসের শব্দের মাত্রা ৮৫ ডেসিমেল এর বেশি।

প্রতিনিয়ত এ ধরনের উচ্চশব্দের পরিবেশে বাস করলে উচ্চ রক্তচাপ, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন, মাথা ধরা, বদহজম, পেপটিক আলসার, অনিদ্রাসহ বধির হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, লাউড স্পিকারের অতিরিক্ত গান-বাজনায় আমরা শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। আমরা রিডিং রুমে পড়তে পারি না। রাতে ঘুমাতে পারি না। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে আমাদের পড়ালেখার ওপর। অনেকেরই সকালে একাডেমিক পরীক্ষাসহ গুরুত্বপূর্ণ চাকরি পরীক্ষা-ভাইবা থাকে। কিন্তু এ শব্দদূষণের কারণে রাতে ভালো ঘুম না হলে এর প্রভাব পড়ে পরীক্ষা-ভাইবায়।

কবি জসীমউদ্দিন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী রেজাউল হক বলেন, এটা একটা আজব বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিদিন এখানে শিক্ষার্থীদের মাথার ওপর উচ্চস্বরে গানবাজনা চলবে, চিৎকার চেঁচামেচি চলবে। এটা একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। শিক্ষার্থীরা এরকম একটা সমস্যার সম্মুখীন, অথচ কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে উদাসীন। এভাবে একটা বিশ্ববিদ্যালয় চলতে পারে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই হলের কর্মকর্তারা জানান, এই হলের মাঠ ব্যবহারে আবেদন করতে হয়। কর্তৃপক্ষ আবেদন গ্রহণ করলে তাদের খেলার অনুমতি দেয়া হয়। শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির কথা চিন্তা করে অনেক সময় কর্তৃপক্ষ অনুমতি দিতে না চাইলেও কিন্তু ছাত্রনেতারা প্রভাব খাটিয়ে অনুমতি নিয়ে নেয়। আবার অনেকে অনুমতি না নিয়েই মাঠে নেমে পড়েন।

এ বিষয়ে কবি জসীমউদ্দিন হলের প্রভোস্ট বলেন, আমরা কাউকে হলের মাঠে লাউড স্পিকারে গান বাজানোর অনুমতি দেই না। এটা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কিন্তু কেউ আমাদের কথা শুনে না। আমাদের নেতারাই এগুলা করে। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে উপাচার্য অধ্যাপক ড মো. আখতারুজ্জামান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মসূচি পালন করবে সেটি স্বাভাবিক এবং আমরা এতে উৎসাহ দেই। তবে লাউড স্পিকার এবং মাইক ব্যবহারে শব্দের মাত্রা এবং তীব্রতা কতটুকু নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় সে বিষয়ে সবার সচেতন ও যতœশীল হওয়া দরকার।

বৃহস্পতিবার, ৩০ জুন ২০২২ , ১৬ আষাড় ১৪২৮ ২৮ জিলকদ ১৪৪৩

ঢাবিতে মারাত্মক শব্দদূষণ

প্রতিনিধি, ঢাবি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি জসীমউদদীন হলের খেলার মাঠের অবস্থান চারটি আবাসিক হলের কেন্দ্রবিন্দুতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক-অনাবাসিক শিক্ষার্থীরা সকাল-সন্ধ্যা, এমনকি মধ্য রাত পর্যন্ত মাঠকে ঘিরে বিভিন্ন কর্মকা-ে অংশ নেয়। সকালের সূর্য উদয়ের পর ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে শুরু হয় ফুটবল কিংবা ক্রিকেট খেলা। এ সময় দর্শনার্থী, খেলোয়াড়দের চিৎকার ও মাইকে উচ্চস্বরে গান-বাজনার কারণে এখানে থাকা হলগুলোর মধ্যে বিশেষ করে কবি জসীমউদদীন শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। কোন ধরনের বিধি-নিষেধের তোয়াক্কা না থাকায় গভীর রাতেও চলে সাউন্ডবক্স বাজিয়ে গান-বাজনা।

শুধু এ অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের নয়, টিএসসি রাজু ভাস্কর্যে নানা আয়োজনে সাউন্ড বক্স ও মাইক ব্যবহারের কারণে রোকেয়া ও শামসুন নাহার হলের ছাত্রীদেরও অবর্ণনীয় দুর্ভোগ সয়ে নিতে হচ্ছে। ছাত্রীরা দীর্ঘদিন এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানালেও নেয়া হয়নি কোন কার্যকর পদক্ষেপ। ক্লাস চলাকালীন ছাত্রসংগঠনগুলোর মিছিল-মিটিংয়ের কারণে কলা ভবন ও কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের একই যন্ত্রণা পোহাতে হয়। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট অধিবেশনে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন বেশ কয়েকজন শিক্ষক।

সিনেট সদস্য ও উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মিহির লাল সাহা তার বক্তব্যে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু হল, জগন্নাথ হল, শামসুন্নাহার হল এবং রোকেয়া হলের শিক্ষার্থীরা শব্দদূষণের কারণে মারাত্মক ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। এখানে থাকার এবং পড়ালেখার কোন পরিবেশ নেই’ এ বিষয়ে তিনি সংবাদকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় হলো লেখাপড়ার জায়গা। ছাত্র-ছাত্রীরা হলে থাকবে, ঘুমাবে এবং পড়ালেখা করবে। এখানে পরিবেশটা যদি সবসময় নয়েজ থাকে তাহলে শিক্ষার্থীদের মাথার ওপর চাপ সৃষ্টি হয়। পড়ালেখায় মন বসে না। আমরা নিজেরাও ক্লাস নেয়ার সময় এমনকি বাংলোয়-কোয়ার্টারে থাকা শিক্ষকরাও শব্দদূষণের শিকার হচ্ছেন।’

তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সময়ে কনসার্ট হয়। কনসার্ট হওয়া ভালো। কিন্তু এর সাউন্ড সিস্টেমটা কন্ট্রোল করা উচিত। আবার খেলাধুলা হবে ঠিক আছে। কিন্তু এর সঙ্গে সাউন্ড বক্সে উচ্চস্বরে গান-বাজনা, হৈ-হুল্লোড় এটা নিষিদ্ধ করতে হবে। অন্য শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার বিঘœ ঘটানোর অধিকার তো কারো নেই।’ ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নাজনীন আফরোজ হক বলেন, ‘শব্দদূষণের কারণে আমাদের ক্লাস নিতে খুবই অসুবিধা হয়। এই সমস্যা সমাধানে কোন পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না। এ সমস্যার সমাধানে যারা অভিজ্ঞ বা পরামর্শ দিতে পারে তাদের কাছ থেকেও পরামর্শ নেয়া হয় না।’

বিষয়টি নিয়ে বেশ কয়েকদিন পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতারা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নেই দাবি করলেও তারাই আবার শব্দদূষণের মাধ্যমে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল নিয়মানুযায়ী ক্লাস চলাকালীন কলা ভবন এলাকায় মাইক ব্যবহারে বিধি থাকলেও সেটি তারা মানছেন না।

সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সাবেক সভাপতি সালমান সিদ্দিকী বলেন, ‘এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ঐতিহাসিকভাবেই শিক্ষার্থীদের স্বার্থে এবং বিভিন্ন জাতীয় স্বার্থে মিছিল-মিটিং-সংগ্রাম হয়ে আসছে। এটা তো স্বাভাবিক বিষয়। আমরা ছাত্রদের বিভিন্ন অধিকার এবং দাবি-দাওয়া নিয়েই আন্দোলন সংগ্রাম করি।’

অন্যদিকে টিএসসি এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট নয় এমন কর্মসূচিও পালিত হচ্ছে নিয়মিত। নানা উপলক্ষে অনুষ্ঠিত হচ্ছে কনসার্ট। এতে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার প্রস্তুতি, ঘুমসহ নিত্যদিনে ব্যাপকভাবে সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

রোকেয়া হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ফাতেহা শারমিন এ্যানি সংবাদকে বলেন, ‘টিএসসির পাশেই মেয়েদের দুটি হল। অথচ টিএসসি এলাকায় বিশেষ করে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ও টিএসসির সুইমিং পুলে প্রায় প্রতিদিনই কনসার্টসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয়। যেখানে অনেক রাত পর্যন্ত লাউড স্পিকারে গান-বাজনা চলে। আমাদের সবারই সকালে ক্লাস-পরীক্ষা থাকে। আবার অনেকরই শব্দ ফোবিয়ার, মাথাব্যথার মতো সমস্যা আছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষের এ ব্যাপারে কোন ভ্রƒক্ষেপ নেই।’

রোকেয়া হলের অন্য এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমার পরীক্ষার রাতে টিএসসিতে গভীর রাত পর্যন্ত সাউন্ড বক্সে গান-বাজনা হচ্ছিল। আমি একটুও পড়তে পারিনি। আমি সেদিন রাতে অনেক্ষণ কান্না করেছিলাম।’

বাংলাদেশের ‘শব্দদূষণ বিধিমালা ২০০৬’ অনুযায়ী- ‘আবাসিক এলাকা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল বা একই জাতীয় অন্য কোন প্রতিষ্ঠান বা তার চতুর্দিকে ১০০ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় ভোর ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত অর্থাৎ দিবাকালীন সময়ে ৫৫ ডেসিবল এবং রাত ৯টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত অর্থাৎ রাত্রীকালীন সময়ে শব্দের মাত্রা ৪৫ ডেসিমেল নির্ধারণ করা হয়েছে। যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসে শব্দের মাত্রা গড়ে ৮৫ ডেসিমেলের বেশি।’

এ ব্যাপারে রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুস সালাম বলেন, অডিওমিটার মেশিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শব্দের মাত্রা বেশিরভাগ সময়ে ৭০ ডেসিমেল এর ওপরে থাকে। তবে মাইকে যখন বিভিন্ন প্রোগ্রাম করা হয় বা লাউড স্পিকারে গান-বাজনা করা হয় তখন এটি ১০০ ডেসিমেলকেও ছাড়িয়ে যায়। অর্থাৎ গড়ে ক্যাম্পাসের শব্দের মাত্রা ৮৫ ডেসিমেল এর বেশি।

প্রতিনিয়ত এ ধরনের উচ্চশব্দের পরিবেশে বাস করলে উচ্চ রক্তচাপ, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন, মাথা ধরা, বদহজম, পেপটিক আলসার, অনিদ্রাসহ বধির হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, লাউড স্পিকারের অতিরিক্ত গান-বাজনায় আমরা শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। আমরা রিডিং রুমে পড়তে পারি না। রাতে ঘুমাতে পারি না। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে আমাদের পড়ালেখার ওপর। অনেকেরই সকালে একাডেমিক পরীক্ষাসহ গুরুত্বপূর্ণ চাকরি পরীক্ষা-ভাইবা থাকে। কিন্তু এ শব্দদূষণের কারণে রাতে ভালো ঘুম না হলে এর প্রভাব পড়ে পরীক্ষা-ভাইবায়।

কবি জসীমউদ্দিন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী রেজাউল হক বলেন, এটা একটা আজব বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিদিন এখানে শিক্ষার্থীদের মাথার ওপর উচ্চস্বরে গানবাজনা চলবে, চিৎকার চেঁচামেচি চলবে। এটা একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। শিক্ষার্থীরা এরকম একটা সমস্যার সম্মুখীন, অথচ কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে উদাসীন। এভাবে একটা বিশ্ববিদ্যালয় চলতে পারে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই হলের কর্মকর্তারা জানান, এই হলের মাঠ ব্যবহারে আবেদন করতে হয়। কর্তৃপক্ষ আবেদন গ্রহণ করলে তাদের খেলার অনুমতি দেয়া হয়। শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির কথা চিন্তা করে অনেক সময় কর্তৃপক্ষ অনুমতি দিতে না চাইলেও কিন্তু ছাত্রনেতারা প্রভাব খাটিয়ে অনুমতি নিয়ে নেয়। আবার অনেকে অনুমতি না নিয়েই মাঠে নেমে পড়েন।

এ বিষয়ে কবি জসীমউদ্দিন হলের প্রভোস্ট বলেন, আমরা কাউকে হলের মাঠে লাউড স্পিকারে গান বাজানোর অনুমতি দেই না। এটা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কিন্তু কেউ আমাদের কথা শুনে না। আমাদের নেতারাই এগুলা করে। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে উপাচার্য অধ্যাপক ড মো. আখতারুজ্জামান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মসূচি পালন করবে সেটি স্বাভাবিক এবং আমরা এতে উৎসাহ দেই। তবে লাউড স্পিকার এবং মাইক ব্যবহারে শব্দের মাত্রা এবং তীব্রতা কতটুকু নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় সে বিষয়ে সবার সচেতন ও যতœশীল হওয়া দরকার।