মিথ, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি দায়বদ্ধতা

ওবায়েদ আকাশ

প্রতিটি নৃগোষ্ঠীর সমাজ ও সভ্যতার গড় মানুষের জীবনই প্রবহমান প্রকৃত জীবন। সামান্য যা কিছু ব্যতিক্রম সমাজের ফাঁকফোঁকড় গলে বেরিয়ে আসতে দেখা যায় তাকে সেভাবেই মর্যাদায় আসীন করা হয়। তা উদাহরণ হিসেবে আমরা মেনে নিই না। তবে তাকে আমরা বিশেষভাবে মূল্যায়িত করি। আমাদের স্বাভাবিকতার ভেতর থেকে কিছুটা বাইরে নিয়ে তাকে বিশেষভাবে আমাদের চিন্তায় ঠাঁই করে দিই। তবে ভাবুক কিংবা চিন্তাশীল মানুষের মূল আলোটা প্রক্ষিপ্ত হয় সবকিছুরই উৎস থেকে ধারাবাহিকতায়। কারণ উৎস অনাবিষ্কৃত থেকে গেলে প্রকৃত সত্যের হেরফের ঘটাটাই অনিবার্য। সে কারণে চিন্তাশীল থেকে সৃজনশীল প্রতিটি মানুষই সৃষ্টির উৎস ও শেকড়ের অন্বেষা থেকে তার ধারাবাহিকতার শিক্ষায় নিজেকে নিজের মতো করে নির্মাণ করে নিতে চায়। এবং নিজের নির্মাণের আলোয় আলোকিত করে তুলতে চায় তার চারপাশ ও জনমানুষেরও স্ব স্ব নির্মাণকে। তাই মানুষ বার বার ফিরে যায় তার ইতিহাসের কাছে, চিরায়ত লোকজীবনের কাছে, ঐতিহ্যের কাছে। যে কোনো জাতি-ধর্ম-বর্ণ তথা বিশ্বাসের প্রকৃত জীবনই হচ্ছে লোকজীবন। আর প্রতিটি লোকজীবনকে আবেষ্টন করে আছে- হাজারো গাথা, আচার, উপকথা, রূপকথা, প্রাচীন ধর্মবিশ্বাস, মিথ বা পৌরাণিক বিশ্বাসসহ বিচিত্র সংস্কার।

এই যে সৃষ্টির শুরু থেকে ক্রমবিকশিত মানুষের জীবনাচার, এবং ক্রমউজ্জ্বল মানুষের নতুন নতুন আবিষ্কারে সমৃদ্ধ নতুন নতুন সভ্যতা- স্বাভাবিকভাবেই এর আছে একটা নিগূঢ়, নিরেট ইতিহাসগাথা। তাকে জেনে-বুঝেই সার্থক মানুষেরা নিজেকে নির্মাণ-বিনির্মাণ করেছে। কথায় বলে- লাফ দিয়ে চাঁদে যাওয়া যায় না। সুতরাং সব কিছুরই একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে সাফল্য নিহিত থাকে। সে কারণে সৃষ্টির ইতিহাস, সভ্যতার ইতিহাস থেকে মানুষের ইতিহাস, নিজের ইতিহাসের কাছে বারবার মানুষকেই ফিরে আসতে হয়। আবার ফিরে আসতে হয় এই ইতিহাসের লালিত ঐতিহ্যের কাছে। ঐতিহ্যের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে গড়িয়ে চলে ইতিহাস। আবার ঐতিহ্যেরও থাকে চমৎকার ঐতিহাসিক বর্ণনা। আর এ দুইয়ের ভেতর নিহিত মানুষের লোককথা, পুরাণ কাহিনী, উপকথা, লোকবিশ্বাসের ভিতকে মানুষ সহজে এড়াতে পারে না।

আদিম যুগের মানুষ পশু শিকার করে আগুনে ঝলসে খাওয়ার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিল; আবার গাছের পাতা বা ছাল দিয়ে নিজের লজ্জা নিবারণের উপায় বের করেছিল। এটা একদিকে যেমন আমাদের ইতিহাসের অংশ, আবার আমাদের ঐতিহ্যও বটে; কারণ সেই ঐতিহ্য লালন করে আমরা এখনো খাবার আগুনে সিদ্ধ করে খাই, লজ্জা নিবারণের জন্য পোশাক পরে থাকি। আবার সেই প্রাচীন কালের মানুষের যে ‘টোটেম’ ‘ট্যাবু’তে বিশ্বাস জন্মেছিল, এখনো তা আমাদের সমাজে প্রবলভাবেই আছে। কোনো কোনো পশু হত্যা করে যেমন সবাই উল্লাস করে খেত, আবার কোনো কোনো পশুকে দেখে তারা শ্রদ্ধায় তার কাছে আনত হতো। তাকে তারা তাদের দেবতা কিংবা শক্তির উৎস কিংবা জ্ঞানের উৎস বলে বিবেচনা করে তাকে অর্ঘ্য দিত। এই যে ‘টোটেম’ ‘ট্যাবু’তে বিশ্বাস স্থাপন, এটাও শুধু প্রাচীন ইতিহাস নয়, এটা আমাদের পৌরাণিক ইতিহাসও। এর ভেতর থেকে আমরা আমাদের প্রাচীন মিথ বা পুরাণকে চিনে নিয়েছি। ‘টোটেম’ ‘ট্যাবু’তে আদিম মানুষের বিশ্বাস স্থাপনের ঐতিহাসিক সত্যতা ও বাস্তবতা থাকলেও এগুলোকে যে শক্তির আধাররূপে কল্পনা করা হয়েছে তার কোনো সত্যতা বা বাস্তব ভিত্তি নেই; সে কারণে এই লোকবিশ্বাসকে আমরা মিথ বলে গণ্য করি। কারণ আমরা জানি, মিথ পুরোপুরি সত্য নয়, আবার পুরোপুরি মিথ্যাও নয়। এই আধাবাস্তব আধামিথ্যার লোকবিশ্বাস কিন্তু আমাদের মধ্যে এখনো প্রবলভাবেই আছে। কারণ সকল ক্ষেত্রে মিথের শক্তি প্রবল। আমরা এখনো বিশ্বাস করি ‘শনিবার’ কিংবা ‘১৩’ তারিখে কোনো যাত্রা শুভ হয় না; কিংবা হাত থেকে চিরুণি খসে পড়লে বুঝে নিই বাড়িতে মেহমান আসবে, কিংবা হাত থেকে গ্লাস পড়ে ভেঙ্গে গেলে মনে করি অমঙ্গল আসন্ন জাতীয় হাজারো সংস্কার। এটাই আমাদের লোকবিশ্বাস, কিংবা পৌরাণিক লোকবিশ্বাস। কারণ মানুষের বিশ্বাস করার ব্যাপারটা সত্য হলেও এর কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। আবার বিন্দুমাত্র সত্যতা না থাকলে শত শত বছর ধরে এসব বিশ্বাস টিকে থাকে কী করেÑ খুবই যৌক্তিক কারণে এমন প্রশ্ন ওঠে সবার মনে।

পৃথিবীর যে কোনো নৃগোষ্ঠীর এ আদ্যোপান্ত ইতিহাস অন্বেষায় তাই তাদের মিথ, ঐতিহ্য ও ইতিহাসের ভেতর একটা গভীর পারম্পর্য লক্ষ্য করা যায়। এই পারম্পর্য অনিবার্য কারণে তৈরি হয়। যেমন লোকবিশ্বাসের ভিতরে নিহিত থাকে মিথ, আবার লোকবিশ্বাস আমাদের ঐতিহ্য। আর এসব কিছুকে ধারণ করে তৈরি হয় ইতিহাস।

এক একটি গোষ্ঠী জাতি কিংবা সম্প্রদায়ের বসবাস এক একটি দেশে, এক একটি প্রাকৃতিক পরিবেশে, কিংবা কারো উঁচু, কারো সমতল, আবার কারো নিচু ভূমিতে। সুতরাং প্রত্যেকের আচার রীতি লোকবিশ্বাস সংস্কৃতিতে দুস্তর পার্থক্য থাকবেÑ এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মানুষের হাসি-কান্না সুখ-দুঃখ বিচ্ছেদ-ভালোবাসা আনন্দ-বিষাদকে কখনো আলাদা করা যায় না। এর পাশাপাশি মানুষের মধ্যে থাকে হিংসা-দ্বেষ প্রতিশোধপরায়ণতা। যা কখনো মানুষের মধ্যে ভৌগোলিক পরিবেশ বিবেচনায় সংক্রমিত হয় না। যে কোনো ভূখ-ের যে কোনো মানুষের মধ্যে তা সমানভাবে ক্রিয়াশীল।

সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের ভেতর দিয়ে আজকের সভ্য মানুষে পরিণত হওয়া থেকে শুরু করে আমাদের বাঙালি জাতির আরো নানা ইতিহাস আছে। যেমন আমাদের ধর্মীয় ইতিহাসÑ পৌত্তলিকতা থেকে অদৃশ্য শক্তিতে বিশ্বাস স্থাপন। আবার রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে রচিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস। আবার নানা চড়াই-উতরাইয়ের ভেতর দিয়ে হেঁটে চলেছে আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাস। আবার খাঁটি বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধারণ করে সাড়ম্বরে আমরা পালন করি আমাদের নববর্ষ বা বৈশাখী মেলা, হালখাতা, পৌষ মেলা, নবান্ন উৎসব ইত্যাদি। একইভাবে পৃথিবীর প্রতিটি জাতি সম্প্রদায় নির্বিশেষে ভৌগোলিক অবস্থানের প্রতিটি মানুষের আলাদা আলাদা ইতিহাস, ঐতিহ্য, পুরাকাহিনী রয়েছে। স্ব স্ব ভাবে প্রতিটি জাতিই তা লালন করে ও বিশ্বাস স্থাপন করে। কিন্তু যে ব্যাপারগুলো প্রতিটি জাতি-সম্প্রদায়ের মধ্যে একইভাবে ক্রিয়াশীল তা সার্বজনীন ও শাশ্বত। যেমন সব জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যÑ নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়া। ধর্মীয় ঐতিহ্য বিশেষ দিনে প্রার্থনায় মশগুল হওয়া। আবার প্রতিটি ধর্মবিশ্বাসের মানুষ নিজস্ব রীতি অনুযায়ী মৃতের সৎকার করে থাকে। বিয়ে সাদী লগন মাঙন- প্রতিটি ক্ষেত্রেই সম্প্রদায়গুলো তাদের ঐতিহ্যিক প্রথা অনুযায়ী উৎসবগুলো উদযাপন করে।

আবার বাঙালির আর একটি বড় ঐতিহ্য মানবিক উদারতা দিয়ে সকল ধর্ম সম্প্রদায় মিলে সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করা। সাম্প্রদায়িক উগ্রতা পরিহার করে একে অন্যের প্রতি সহনশীল আচরণ করা। আমাদের এ উদারনৈতিক ধারাবাহিকতা সবসময় রাজনীতিকে ঊর্ধ্বে রেখে মানুষে মানুষে বন্ধন সৃষ্টির ভেতর দিয়ে তৈরি হয়েছে। রাজনীতি ও সাম্প্রদায়িক উগ্রতামুক্ত বিশ্বও মনে হয় এই বন্ধনকে স্বর্গের মতো শান্তিপূর্ণ বিবেচনা করে থাকে। একের ঐতিহ্যিক বিশ্বাসকে অন্যের দ্বারা শ্রদ্ধা ও সম্মানের চোখে দেখানোর ভেতর দিয়ে আমরা নিজেকেই মহিমান্বিত করেছি। অন্যদিকে পৃথিবীর অন্য সব জাতিরই আছে যুদ্ধের ইতিহাস, বিজয়ের ইতিহাস। সব জাতির আলাদা আলাদাভাবে পোশাক পরা ও খাবারের ঐতিহ্য থাকে। যেমন আছে আমাদের ইলিশ-পান্তা কিংবা শীতের পিঠা খাজা বাতাসা মুড়িমুড়কি খাবার ঐতিহ্য। এ ইতিহাস সবারই থাকে। ধূতি ফতুয়া পাজামা পাঞ্জাবি কিংবা লুঙ্গি গামছা শাড়িতে আমাদের দেশীয় ফ্যাশনের ঐতিহ্য যেমন ফুটে ওঠে, তেমনি ইংরেজদের ঐতিহ্যিক পোশাক প্যান্ট শার্ট কোট টাই বুট পরে স্যুটেড-বুটেড হওয়ার ভেতর দিয়ে তাদের পোশাকের ঐতিহ্য ফুটে ওঠে। কিন্তু একে অন্যকে নিন্দা না করার ঐতিহ্য প্রতিটি জাতির শেকড়ের সঙ্গেই নিহিত ছিল। যা এখনো বহাল আছে। কতিপয় উগ্র-উচ্ছৃঙ্খল মানুষের আচরণ দিয়ে কোনো জাতির সামগ্রিক চেহারা আন্দাজ করা যায় না। একে অন্যকে জানার অন্যতম কৌশল হলো প্রান্তিক মানুষের জীবনাচার থেকে তাদের সংস্কৃতির রসাস্বাদন করা। প্রান্তিক জীবনেই সোঁদা মাটির ঘ্রাণের মতো লোকজীবনের নানা সংস্কৃতির ঘ্রাণ নিহিত থাকে। আর লোকজীবন মাত্রই গড়ে ওঠে তাদের নিজস্ব মিথ, অলৌকিক বিশ্বাস, প্রবাদ-প্রবচন, লোকাচার, ধর্মবিশ্বাসে ভর করে। তাই অনুসন্ধানী মানুষের অন্যতম ঔৎসুক্যের বিষয়Ñ প্রাচীন জীবন প্রাচীন সংস্কৃতির ভেতর থেকে কীভাবে সভ্যতার এ বিকাশমান সংস্কৃতির সৃষ্টি হলো তার অনুসন্ধান করা। শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে প্রতিটি জাতি সম্প্রদায়ের সংস্কৃতির উৎস ঐ একই বিন্দুকে গিয়ে মিলেছে।

আগুন জল মাটি ঝড় জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রকৃতির প্রতিটি উপাদান-আচরণের সঙ্গে ভয়াবহ অসহনীয় সংগ্রাম করে আজকের অবস্থানে পৌঁছেছে মানুষ। এ সংগ্রাম আরো বেগবান হয়েছে কোথাও কোথাও। গণমাধ্যমে প্রায়ই দেখা যায়Ñ আফ্রিকার কিছু কিছু অঞ্চলের মানুষ এখনো পোকামাকড়, শিকার করা পশু আগুনে ঝলসে আহার করে। পরিচ্ছদ হিসেবে গাছের পাতা, ছাল ব্যবহার করে। শিক্ষার আলো এখনো পৌঁছেনি। ধর্ম বলতে লোকবিশ্বাস, মুদ্রিত কোনো ধর্মগ্রন্থই তাদের নেই। সেই আদিম কালের সংগ্রাম এখনো করে চলেছে মানুষ।

অন্যদিকে সারা পৃথিবীতে এখনো পর্যন্ত নারীরা বঞ্চিত হয়ে আসছে। মায়েরাই হলো সকল কষ্ট সহিষ্ণুতার প্রতীক। স্নেহমমতার প্রতীক। নির্যাতিতার প্রতীক। আমাদের মায়েরা বোনেরা যেন তাই মেনে নিয়ে তাদের জীবনকে পুরুষের পদতলে সঁপে দিয়েছে। আবার যুগে যুগে কালে কালে এর ভেতর থেকেও নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে জয়ী হওয়ার ইতিহাস আমাদেরই রয়েছে। তবে বলতে গেলে পৃথিবীব্যাপী কিছু কিছু মৌলিক ক্ষেত্রে এখনো পর্যন্ত প্রায় একই অবস্থা বিরাজ করছে।

আমাদের মহুয়া মলুয়া বেহুলার মতো নিবেদিতপ্রাণ নারী সারা পৃথিবীর সর্বত্র বিরাজিত। আবার আলেকজান্ডারের মতো বীর কিংবা ক্লিওপেট্রার মতো আবেদনময়ী রমণী সব জাতি ও সমাজের মধ্যে বসবাস করে। প্রতিটি সমাজে একজন নার্সিসাস কিংবা আফ্রোদিতিকে খুঁজে পেতে আমাদের খুব বেশি শ্রম দিতে হয় না। লাইলী-মজনু, শিরীন-ফরহাদের মতো নিবেদিত যুবক-যুবতী তো পৃথিবীর প্রতিটি আনাচে-কানাচে হাঁটে। আবার সিমার কিংবা চেঙ্গিস খান হালাকু খানের মতো নির্মম খুনী-শাসক আজকের ইরাক-আমেরিকা যুদ্ধের খলনায়কের প্রতিচ্ছবিতে ফুটে ওঠে। যে কারণে সার্বজনীন মিথ, লোকাচার, লোকবিশ্বাস ও ঐতিহ্যের আবেদন কখনো শেষ হয় না।

সমাজে শিল্পী বা স্রষ্টা বলে যারা পরিচিতÑ তারা তাদের দায়বদ্ধতা থেকে ইতিহাসের এই ক্রমবিবর্তন, সভ্যতার বিকাশ, যুদ্ধের ইতিহাস, বিজয়ের ইতিহাস, ধর্মীয় ইতিহাস, রাজনৈতিক ইতিহাস, ঐতিহ্যিক ইতিহাস খুব গভীরভাবে নিজের আমলে নেন। তাকে নির্মাণ বিনির্মাণ করেন। সমাজের প্রাচীন চরিত্র, মিথিক্যাল চরিত্র, আদর্শিক চরিত্রের ভেতর থেকে নতুন নতুন আদর্শ বেরিয়ে আসে। শিল্পী-সাহিত্যিক-স্রষ্টা তাই তাদের সাহিত্য সৃষ্টির বর্ণনায় এসবের আশ্রয় নেন। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাহিত্য ও শিল্পকর্মে তাই মিথ, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ব্যাপক উপাদান ব্যবহার করতে দেখা যায়। আমাদের রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে মাইকেল, নজরুল, জীবনানন্দ কিংবা বিশ্বসাহিত্যে শেক্সপিয়ার থেকে জেমস জয়েস, টি এস এলিঅট কিংবা ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকাসহ পৃথিবীর বিখ্যাত লেখক মাত্রই তাদের সাহিত্যে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রচুর উপাদান যেমন ব্যবহার করেছেন, তেমনি মিথ কিংবা পুরাণকে ভেঙে নির্মাণ-পুনর্নির্মাণ করেছেন।

আবার সাম্প্রতিক সময়ের ল্যাটিন আমেরিকা ও আফ্রিকার সাহিত্য অধিক মাত্রায় তাদের মাটি ও ঐতিহ্যঘেঁষা হওয়ায় বিশ্বব্যাপী একটা অন্যরকম ইতিবাচক আবহ তৈরি করেছে। বিপরীতে একসময়ের খ্যাতির শীর্ষে থাকা ফরাসি সাহিত্য ও চিত্রকলা আজ যেন তাদের ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। সাম্প্রতিক সময়ের ফরাসি কবিতা পাঠ করলে সহজে চিনে নেবার উপায় নেই যে, এগুলো ফরাসি কবিতা। কারণ তারা তাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, লোকজীবনের প্রতি আগের মতো কমিটমেন্ট রক্ষা করতে পারছে না। এভাবে যে কোনো জাতি তাদের প্রাচীন জীবনাচার, ইতিহাস, ঐতিহ্য, মিথ, লোককথা, রূপকথা, উপকথা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে তাদের সাহিত্য শিল্প চিত্রকলা অসাড় জড় বস্তুতে পরিণত হয়।

অন্যদিকে বাউল ফকির সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের আধ্যাত্মবোধ ও মরমীচেতনা সংস্কৃতিতে নতুন মাত্রার সংযোজন করে। যেমন আমাদের রক্তের সঙ্গে মিশে থাকা আধ্যাত্মবোধ, মরমীবোধকে ধারণ করে লালন, হাসনের মতো মহামানবেরা চিরকালের আদর্শ হয়ে টিকে আছেন।

আমাদের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সৃষ্টিতে ভারতীয় পুরাণ তথা রামায়ণ, মহাভারতের ব্যাপক ও বিশাল প্রভাব রয়েছে। অন্যদিকে আমাদের গ্রামীণ জীবনের লোকগান, পুঁথিপাঠ, পালাকীর্তনের প্রভাব আমাদের সাহিত্যিক ঐতিহ্যের প্রাণশক্তি। বাংলা সাহিত্য যাদের অসামান্য সৃষ্টি ও অবদানে প্রতিষ্ঠিত-বিকশিত হয়েছেÑ তাদের রচনার পরতে পরতে এ ধারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

এই ধারাবাহিকতা এখনো যেমন চলছে, চলবে নিরন্তর। সমাজ সভ্যতা ও মানুষের সত্যিকার জীবনচিত্র অঙ্কনে চিন্তাশীল ও সৃজনশীল মানুষের বিশেষ করে কবি-লেখক-শিল্পীদের বারবার ইতিহাস, ঐতিহ্য, পুরাণের কাছে ফিরে যাওয়া ছাড়া কোনো গত্যন্তর থাকে না। পুরাণ ইতিহাস ঐতিহ্য থেকে নিরন্তর শিক্ষা নেয়া ছাড়া বিকল্প নেই। কারণ এর ভেতরই নিহিত মানুষের সংস্কৃতির ইতিহাস, সৌন্দর্য আবিষ্কারের ইতিহাস। আর তাই এগুলোর প্রতি দায়বদ্ধতা মানুষ হিসেবে আমাদের চিরকালের।

বৃহস্পতিবার, ০৬ অক্টোবর ২০২২ , ২০ আশ্বিন ১৪২৯ ০৮ সফর ১৪৪৪

মিথ, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি দায়বদ্ধতা

ওবায়েদ আকাশ

image

প্রতিটি নৃগোষ্ঠীর সমাজ ও সভ্যতার গড় মানুষের জীবনই প্রবহমান প্রকৃত জীবন। সামান্য যা কিছু ব্যতিক্রম সমাজের ফাঁকফোঁকড় গলে বেরিয়ে আসতে দেখা যায় তাকে সেভাবেই মর্যাদায় আসীন করা হয়। তা উদাহরণ হিসেবে আমরা মেনে নিই না। তবে তাকে আমরা বিশেষভাবে মূল্যায়িত করি। আমাদের স্বাভাবিকতার ভেতর থেকে কিছুটা বাইরে নিয়ে তাকে বিশেষভাবে আমাদের চিন্তায় ঠাঁই করে দিই। তবে ভাবুক কিংবা চিন্তাশীল মানুষের মূল আলোটা প্রক্ষিপ্ত হয় সবকিছুরই উৎস থেকে ধারাবাহিকতায়। কারণ উৎস অনাবিষ্কৃত থেকে গেলে প্রকৃত সত্যের হেরফের ঘটাটাই অনিবার্য। সে কারণে চিন্তাশীল থেকে সৃজনশীল প্রতিটি মানুষই সৃষ্টির উৎস ও শেকড়ের অন্বেষা থেকে তার ধারাবাহিকতার শিক্ষায় নিজেকে নিজের মতো করে নির্মাণ করে নিতে চায়। এবং নিজের নির্মাণের আলোয় আলোকিত করে তুলতে চায় তার চারপাশ ও জনমানুষেরও স্ব স্ব নির্মাণকে। তাই মানুষ বার বার ফিরে যায় তার ইতিহাসের কাছে, চিরায়ত লোকজীবনের কাছে, ঐতিহ্যের কাছে। যে কোনো জাতি-ধর্ম-বর্ণ তথা বিশ্বাসের প্রকৃত জীবনই হচ্ছে লোকজীবন। আর প্রতিটি লোকজীবনকে আবেষ্টন করে আছে- হাজারো গাথা, আচার, উপকথা, রূপকথা, প্রাচীন ধর্মবিশ্বাস, মিথ বা পৌরাণিক বিশ্বাসসহ বিচিত্র সংস্কার।

এই যে সৃষ্টির শুরু থেকে ক্রমবিকশিত মানুষের জীবনাচার, এবং ক্রমউজ্জ্বল মানুষের নতুন নতুন আবিষ্কারে সমৃদ্ধ নতুন নতুন সভ্যতা- স্বাভাবিকভাবেই এর আছে একটা নিগূঢ়, নিরেট ইতিহাসগাথা। তাকে জেনে-বুঝেই সার্থক মানুষেরা নিজেকে নির্মাণ-বিনির্মাণ করেছে। কথায় বলে- লাফ দিয়ে চাঁদে যাওয়া যায় না। সুতরাং সব কিছুরই একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে সাফল্য নিহিত থাকে। সে কারণে সৃষ্টির ইতিহাস, সভ্যতার ইতিহাস থেকে মানুষের ইতিহাস, নিজের ইতিহাসের কাছে বারবার মানুষকেই ফিরে আসতে হয়। আবার ফিরে আসতে হয় এই ইতিহাসের লালিত ঐতিহ্যের কাছে। ঐতিহ্যের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে গড়িয়ে চলে ইতিহাস। আবার ঐতিহ্যেরও থাকে চমৎকার ঐতিহাসিক বর্ণনা। আর এ দুইয়ের ভেতর নিহিত মানুষের লোককথা, পুরাণ কাহিনী, উপকথা, লোকবিশ্বাসের ভিতকে মানুষ সহজে এড়াতে পারে না।

আদিম যুগের মানুষ পশু শিকার করে আগুনে ঝলসে খাওয়ার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিল; আবার গাছের পাতা বা ছাল দিয়ে নিজের লজ্জা নিবারণের উপায় বের করেছিল। এটা একদিকে যেমন আমাদের ইতিহাসের অংশ, আবার আমাদের ঐতিহ্যও বটে; কারণ সেই ঐতিহ্য লালন করে আমরা এখনো খাবার আগুনে সিদ্ধ করে খাই, লজ্জা নিবারণের জন্য পোশাক পরে থাকি। আবার সেই প্রাচীন কালের মানুষের যে ‘টোটেম’ ‘ট্যাবু’তে বিশ্বাস জন্মেছিল, এখনো তা আমাদের সমাজে প্রবলভাবেই আছে। কোনো কোনো পশু হত্যা করে যেমন সবাই উল্লাস করে খেত, আবার কোনো কোনো পশুকে দেখে তারা শ্রদ্ধায় তার কাছে আনত হতো। তাকে তারা তাদের দেবতা কিংবা শক্তির উৎস কিংবা জ্ঞানের উৎস বলে বিবেচনা করে তাকে অর্ঘ্য দিত। এই যে ‘টোটেম’ ‘ট্যাবু’তে বিশ্বাস স্থাপন, এটাও শুধু প্রাচীন ইতিহাস নয়, এটা আমাদের পৌরাণিক ইতিহাসও। এর ভেতর থেকে আমরা আমাদের প্রাচীন মিথ বা পুরাণকে চিনে নিয়েছি। ‘টোটেম’ ‘ট্যাবু’তে আদিম মানুষের বিশ্বাস স্থাপনের ঐতিহাসিক সত্যতা ও বাস্তবতা থাকলেও এগুলোকে যে শক্তির আধাররূপে কল্পনা করা হয়েছে তার কোনো সত্যতা বা বাস্তব ভিত্তি নেই; সে কারণে এই লোকবিশ্বাসকে আমরা মিথ বলে গণ্য করি। কারণ আমরা জানি, মিথ পুরোপুরি সত্য নয়, আবার পুরোপুরি মিথ্যাও নয়। এই আধাবাস্তব আধামিথ্যার লোকবিশ্বাস কিন্তু আমাদের মধ্যে এখনো প্রবলভাবেই আছে। কারণ সকল ক্ষেত্রে মিথের শক্তি প্রবল। আমরা এখনো বিশ্বাস করি ‘শনিবার’ কিংবা ‘১৩’ তারিখে কোনো যাত্রা শুভ হয় না; কিংবা হাত থেকে চিরুণি খসে পড়লে বুঝে নিই বাড়িতে মেহমান আসবে, কিংবা হাত থেকে গ্লাস পড়ে ভেঙ্গে গেলে মনে করি অমঙ্গল আসন্ন জাতীয় হাজারো সংস্কার। এটাই আমাদের লোকবিশ্বাস, কিংবা পৌরাণিক লোকবিশ্বাস। কারণ মানুষের বিশ্বাস করার ব্যাপারটা সত্য হলেও এর কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। আবার বিন্দুমাত্র সত্যতা না থাকলে শত শত বছর ধরে এসব বিশ্বাস টিকে থাকে কী করেÑ খুবই যৌক্তিক কারণে এমন প্রশ্ন ওঠে সবার মনে।

পৃথিবীর যে কোনো নৃগোষ্ঠীর এ আদ্যোপান্ত ইতিহাস অন্বেষায় তাই তাদের মিথ, ঐতিহ্য ও ইতিহাসের ভেতর একটা গভীর পারম্পর্য লক্ষ্য করা যায়। এই পারম্পর্য অনিবার্য কারণে তৈরি হয়। যেমন লোকবিশ্বাসের ভিতরে নিহিত থাকে মিথ, আবার লোকবিশ্বাস আমাদের ঐতিহ্য। আর এসব কিছুকে ধারণ করে তৈরি হয় ইতিহাস।

এক একটি গোষ্ঠী জাতি কিংবা সম্প্রদায়ের বসবাস এক একটি দেশে, এক একটি প্রাকৃতিক পরিবেশে, কিংবা কারো উঁচু, কারো সমতল, আবার কারো নিচু ভূমিতে। সুতরাং প্রত্যেকের আচার রীতি লোকবিশ্বাস সংস্কৃতিতে দুস্তর পার্থক্য থাকবেÑ এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মানুষের হাসি-কান্না সুখ-দুঃখ বিচ্ছেদ-ভালোবাসা আনন্দ-বিষাদকে কখনো আলাদা করা যায় না। এর পাশাপাশি মানুষের মধ্যে থাকে হিংসা-দ্বেষ প্রতিশোধপরায়ণতা। যা কখনো মানুষের মধ্যে ভৌগোলিক পরিবেশ বিবেচনায় সংক্রমিত হয় না। যে কোনো ভূখ-ের যে কোনো মানুষের মধ্যে তা সমানভাবে ক্রিয়াশীল।

সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের ভেতর দিয়ে আজকের সভ্য মানুষে পরিণত হওয়া থেকে শুরু করে আমাদের বাঙালি জাতির আরো নানা ইতিহাস আছে। যেমন আমাদের ধর্মীয় ইতিহাসÑ পৌত্তলিকতা থেকে অদৃশ্য শক্তিতে বিশ্বাস স্থাপন। আবার রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে রচিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস। আবার নানা চড়াই-উতরাইয়ের ভেতর দিয়ে হেঁটে চলেছে আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাস। আবার খাঁটি বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধারণ করে সাড়ম্বরে আমরা পালন করি আমাদের নববর্ষ বা বৈশাখী মেলা, হালখাতা, পৌষ মেলা, নবান্ন উৎসব ইত্যাদি। একইভাবে পৃথিবীর প্রতিটি জাতি সম্প্রদায় নির্বিশেষে ভৌগোলিক অবস্থানের প্রতিটি মানুষের আলাদা আলাদা ইতিহাস, ঐতিহ্য, পুরাকাহিনী রয়েছে। স্ব স্ব ভাবে প্রতিটি জাতিই তা লালন করে ও বিশ্বাস স্থাপন করে। কিন্তু যে ব্যাপারগুলো প্রতিটি জাতি-সম্প্রদায়ের মধ্যে একইভাবে ক্রিয়াশীল তা সার্বজনীন ও শাশ্বত। যেমন সব জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যÑ নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়া। ধর্মীয় ঐতিহ্য বিশেষ দিনে প্রার্থনায় মশগুল হওয়া। আবার প্রতিটি ধর্মবিশ্বাসের মানুষ নিজস্ব রীতি অনুযায়ী মৃতের সৎকার করে থাকে। বিয়ে সাদী লগন মাঙন- প্রতিটি ক্ষেত্রেই সম্প্রদায়গুলো তাদের ঐতিহ্যিক প্রথা অনুযায়ী উৎসবগুলো উদযাপন করে।

আবার বাঙালির আর একটি বড় ঐতিহ্য মানবিক উদারতা দিয়ে সকল ধর্ম সম্প্রদায় মিলে সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করা। সাম্প্রদায়িক উগ্রতা পরিহার করে একে অন্যের প্রতি সহনশীল আচরণ করা। আমাদের এ উদারনৈতিক ধারাবাহিকতা সবসময় রাজনীতিকে ঊর্ধ্বে রেখে মানুষে মানুষে বন্ধন সৃষ্টির ভেতর দিয়ে তৈরি হয়েছে। রাজনীতি ও সাম্প্রদায়িক উগ্রতামুক্ত বিশ্বও মনে হয় এই বন্ধনকে স্বর্গের মতো শান্তিপূর্ণ বিবেচনা করে থাকে। একের ঐতিহ্যিক বিশ্বাসকে অন্যের দ্বারা শ্রদ্ধা ও সম্মানের চোখে দেখানোর ভেতর দিয়ে আমরা নিজেকেই মহিমান্বিত করেছি। অন্যদিকে পৃথিবীর অন্য সব জাতিরই আছে যুদ্ধের ইতিহাস, বিজয়ের ইতিহাস। সব জাতির আলাদা আলাদাভাবে পোশাক পরা ও খাবারের ঐতিহ্য থাকে। যেমন আছে আমাদের ইলিশ-পান্তা কিংবা শীতের পিঠা খাজা বাতাসা মুড়িমুড়কি খাবার ঐতিহ্য। এ ইতিহাস সবারই থাকে। ধূতি ফতুয়া পাজামা পাঞ্জাবি কিংবা লুঙ্গি গামছা শাড়িতে আমাদের দেশীয় ফ্যাশনের ঐতিহ্য যেমন ফুটে ওঠে, তেমনি ইংরেজদের ঐতিহ্যিক পোশাক প্যান্ট শার্ট কোট টাই বুট পরে স্যুটেড-বুটেড হওয়ার ভেতর দিয়ে তাদের পোশাকের ঐতিহ্য ফুটে ওঠে। কিন্তু একে অন্যকে নিন্দা না করার ঐতিহ্য প্রতিটি জাতির শেকড়ের সঙ্গেই নিহিত ছিল। যা এখনো বহাল আছে। কতিপয় উগ্র-উচ্ছৃঙ্খল মানুষের আচরণ দিয়ে কোনো জাতির সামগ্রিক চেহারা আন্দাজ করা যায় না। একে অন্যকে জানার অন্যতম কৌশল হলো প্রান্তিক মানুষের জীবনাচার থেকে তাদের সংস্কৃতির রসাস্বাদন করা। প্রান্তিক জীবনেই সোঁদা মাটির ঘ্রাণের মতো লোকজীবনের নানা সংস্কৃতির ঘ্রাণ নিহিত থাকে। আর লোকজীবন মাত্রই গড়ে ওঠে তাদের নিজস্ব মিথ, অলৌকিক বিশ্বাস, প্রবাদ-প্রবচন, লোকাচার, ধর্মবিশ্বাসে ভর করে। তাই অনুসন্ধানী মানুষের অন্যতম ঔৎসুক্যের বিষয়Ñ প্রাচীন জীবন প্রাচীন সংস্কৃতির ভেতর থেকে কীভাবে সভ্যতার এ বিকাশমান সংস্কৃতির সৃষ্টি হলো তার অনুসন্ধান করা। শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে প্রতিটি জাতি সম্প্রদায়ের সংস্কৃতির উৎস ঐ একই বিন্দুকে গিয়ে মিলেছে।

আগুন জল মাটি ঝড় জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রকৃতির প্রতিটি উপাদান-আচরণের সঙ্গে ভয়াবহ অসহনীয় সংগ্রাম করে আজকের অবস্থানে পৌঁছেছে মানুষ। এ সংগ্রাম আরো বেগবান হয়েছে কোথাও কোথাও। গণমাধ্যমে প্রায়ই দেখা যায়Ñ আফ্রিকার কিছু কিছু অঞ্চলের মানুষ এখনো পোকামাকড়, শিকার করা পশু আগুনে ঝলসে আহার করে। পরিচ্ছদ হিসেবে গাছের পাতা, ছাল ব্যবহার করে। শিক্ষার আলো এখনো পৌঁছেনি। ধর্ম বলতে লোকবিশ্বাস, মুদ্রিত কোনো ধর্মগ্রন্থই তাদের নেই। সেই আদিম কালের সংগ্রাম এখনো করে চলেছে মানুষ।

অন্যদিকে সারা পৃথিবীতে এখনো পর্যন্ত নারীরা বঞ্চিত হয়ে আসছে। মায়েরাই হলো সকল কষ্ট সহিষ্ণুতার প্রতীক। স্নেহমমতার প্রতীক। নির্যাতিতার প্রতীক। আমাদের মায়েরা বোনেরা যেন তাই মেনে নিয়ে তাদের জীবনকে পুরুষের পদতলে সঁপে দিয়েছে। আবার যুগে যুগে কালে কালে এর ভেতর থেকেও নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে জয়ী হওয়ার ইতিহাস আমাদেরই রয়েছে। তবে বলতে গেলে পৃথিবীব্যাপী কিছু কিছু মৌলিক ক্ষেত্রে এখনো পর্যন্ত প্রায় একই অবস্থা বিরাজ করছে।

আমাদের মহুয়া মলুয়া বেহুলার মতো নিবেদিতপ্রাণ নারী সারা পৃথিবীর সর্বত্র বিরাজিত। আবার আলেকজান্ডারের মতো বীর কিংবা ক্লিওপেট্রার মতো আবেদনময়ী রমণী সব জাতি ও সমাজের মধ্যে বসবাস করে। প্রতিটি সমাজে একজন নার্সিসাস কিংবা আফ্রোদিতিকে খুঁজে পেতে আমাদের খুব বেশি শ্রম দিতে হয় না। লাইলী-মজনু, শিরীন-ফরহাদের মতো নিবেদিত যুবক-যুবতী তো পৃথিবীর প্রতিটি আনাচে-কানাচে হাঁটে। আবার সিমার কিংবা চেঙ্গিস খান হালাকু খানের মতো নির্মম খুনী-শাসক আজকের ইরাক-আমেরিকা যুদ্ধের খলনায়কের প্রতিচ্ছবিতে ফুটে ওঠে। যে কারণে সার্বজনীন মিথ, লোকাচার, লোকবিশ্বাস ও ঐতিহ্যের আবেদন কখনো শেষ হয় না।

সমাজে শিল্পী বা স্রষ্টা বলে যারা পরিচিতÑ তারা তাদের দায়বদ্ধতা থেকে ইতিহাসের এই ক্রমবিবর্তন, সভ্যতার বিকাশ, যুদ্ধের ইতিহাস, বিজয়ের ইতিহাস, ধর্মীয় ইতিহাস, রাজনৈতিক ইতিহাস, ঐতিহ্যিক ইতিহাস খুব গভীরভাবে নিজের আমলে নেন। তাকে নির্মাণ বিনির্মাণ করেন। সমাজের প্রাচীন চরিত্র, মিথিক্যাল চরিত্র, আদর্শিক চরিত্রের ভেতর থেকে নতুন নতুন আদর্শ বেরিয়ে আসে। শিল্পী-সাহিত্যিক-স্রষ্টা তাই তাদের সাহিত্য সৃষ্টির বর্ণনায় এসবের আশ্রয় নেন। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাহিত্য ও শিল্পকর্মে তাই মিথ, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ব্যাপক উপাদান ব্যবহার করতে দেখা যায়। আমাদের রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে মাইকেল, নজরুল, জীবনানন্দ কিংবা বিশ্বসাহিত্যে শেক্সপিয়ার থেকে জেমস জয়েস, টি এস এলিঅট কিংবা ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকাসহ পৃথিবীর বিখ্যাত লেখক মাত্রই তাদের সাহিত্যে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রচুর উপাদান যেমন ব্যবহার করেছেন, তেমনি মিথ কিংবা পুরাণকে ভেঙে নির্মাণ-পুনর্নির্মাণ করেছেন।

আবার সাম্প্রতিক সময়ের ল্যাটিন আমেরিকা ও আফ্রিকার সাহিত্য অধিক মাত্রায় তাদের মাটি ও ঐতিহ্যঘেঁষা হওয়ায় বিশ্বব্যাপী একটা অন্যরকম ইতিবাচক আবহ তৈরি করেছে। বিপরীতে একসময়ের খ্যাতির শীর্ষে থাকা ফরাসি সাহিত্য ও চিত্রকলা আজ যেন তাদের ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। সাম্প্রতিক সময়ের ফরাসি কবিতা পাঠ করলে সহজে চিনে নেবার উপায় নেই যে, এগুলো ফরাসি কবিতা। কারণ তারা তাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, লোকজীবনের প্রতি আগের মতো কমিটমেন্ট রক্ষা করতে পারছে না। এভাবে যে কোনো জাতি তাদের প্রাচীন জীবনাচার, ইতিহাস, ঐতিহ্য, মিথ, লোককথা, রূপকথা, উপকথা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে তাদের সাহিত্য শিল্প চিত্রকলা অসাড় জড় বস্তুতে পরিণত হয়।

অন্যদিকে বাউল ফকির সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের আধ্যাত্মবোধ ও মরমীচেতনা সংস্কৃতিতে নতুন মাত্রার সংযোজন করে। যেমন আমাদের রক্তের সঙ্গে মিশে থাকা আধ্যাত্মবোধ, মরমীবোধকে ধারণ করে লালন, হাসনের মতো মহামানবেরা চিরকালের আদর্শ হয়ে টিকে আছেন।

আমাদের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সৃষ্টিতে ভারতীয় পুরাণ তথা রামায়ণ, মহাভারতের ব্যাপক ও বিশাল প্রভাব রয়েছে। অন্যদিকে আমাদের গ্রামীণ জীবনের লোকগান, পুঁথিপাঠ, পালাকীর্তনের প্রভাব আমাদের সাহিত্যিক ঐতিহ্যের প্রাণশক্তি। বাংলা সাহিত্য যাদের অসামান্য সৃষ্টি ও অবদানে প্রতিষ্ঠিত-বিকশিত হয়েছেÑ তাদের রচনার পরতে পরতে এ ধারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

এই ধারাবাহিকতা এখনো যেমন চলছে, চলবে নিরন্তর। সমাজ সভ্যতা ও মানুষের সত্যিকার জীবনচিত্র অঙ্কনে চিন্তাশীল ও সৃজনশীল মানুষের বিশেষ করে কবি-লেখক-শিল্পীদের বারবার ইতিহাস, ঐতিহ্য, পুরাণের কাছে ফিরে যাওয়া ছাড়া কোনো গত্যন্তর থাকে না। পুরাণ ইতিহাস ঐতিহ্য থেকে নিরন্তর শিক্ষা নেয়া ছাড়া বিকল্প নেই। কারণ এর ভেতরই নিহিত মানুষের সংস্কৃতির ইতিহাস, সৌন্দর্য আবিষ্কারের ইতিহাস। আর তাই এগুলোর প্রতি দায়বদ্ধতা মানুষ হিসেবে আমাদের চিরকালের।