লোডশেডিং ঢাকায় নেই, কমেছে গ্রামেও

সম্প্রতি রাজধানীতে লোডশেডিং হচ্ছে না, গ্রামাঞ্চলেও লোডশেডিং কমে গেছে। বিভিন্ন এলাকার গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত এক সপ্তাহে রাজধানীর বেশিরভাগ এলাকায় লোডশেডিং হয়নি বললেই চলে। কিছু এলাকায় হঠাৎ কোন একদিন বিদ্যুৎ চলে গেলেও খানিক বিরতিতে আবার ফিরে এসেছে। জানা গেছে, গ্রামাঞ্চলেও আগের মতো লোডশেডিং নেই।

বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো বলছে, চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে বলে গ্রাহক পর্যায়ে লোডশেডিং করতে হচ্ছে না।

লোডশেডিংয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী বিকাশ দেওয়ান গতকাল রাতে সংবাদকে বলেন, গত পনের-বিশ দিন যাবাৎ আমরা চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ পাচ্ছি। তাই লোডশেডিং নেই। আজ (গতকাল) সন্ধ্যায় আমাদের চাহিদা ছিল প্রায় সাড়ে তেরশ’ মেগাওয়াট। আমরা পিডিবি থেকে পুরোটাই পাচ্ছি। তাই লোডশেডিং করতে হচ্ছে না।’ অনুসন্ধানে জানা গেছে, হেমন্তের আগমনে গরম কমে যাওয়ায় বিদ্যুতের চাহিদা কমে গেছে। নাতিশীতোষ্ণ এই আবহাওয়া বাসাবাড়িতে শীততাপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের (এসি) ব্যবহার বন্ধ করেছেন অনেকেই। এছাড়া বৈদ্যুতিক পাখা, রেফ্রিজারেটরের ব্যবহারও কমেছে।

গত ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির মূল্য বাড়তে থাকে এবং এ খাতে সংকট তৈরি হয়। উন্নত অনেক দেশের পাশপাশি এর নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশেও পড়ে।

দেশে চলমান গ্যাস সংকটের কারণে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো অলস বসে থাকে। বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ করতে ডিজেল, ফার্নেস তেল এবং এলএনজি আমদানি করা হয়। তবে যুদ্ধের কারণে জ্বালানির দাম অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় ডলার বাঁচাতে সাশ্রয়ে গুরুত্ব দিয়ে জ্বালানি আমদানি কমিয়ে দেয় শেখ হাসিনার সরকার। ফলে দেশে ফিরে আসে লোডশেডিং, যা দিনে দিনে বাড়তে থাকে।

গত জুলাই, আগস্টে দেশে গড়ে দৈনিক বিদ্যুৎ চাহিদা ছিল প্রায় সাড়ে তেরো থেকে চৌদ্দ হাজার মেগাওয়াট। ওই সময় ডিজেল ও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি হ্রাস করায় জ্বালানি সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদন নেমে এসেছিল ১১ হাজার মেগাওয়াটে। এতে প্রতিদিনই সাড়ে তিন থেকে চার হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হতো ওই সময়। তখন সরকারি নির্দেশে গ্রাহকদের সুবিধার্থে লোডশেডিংয়ের আগাম তথ্যসূচি প্রতিদিনই প্রকাশ করা শুরু করে বিতরণ কোম্পানিগুলো।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দিনে ৫ থেকে ৭ ঘণ্টা, কিছু জায়গায় ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হবে বলে সূচিতে জানায় ঢাকা ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডডিসি) ও ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো)।

রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে বিভিন্ন এলাকার জন্য প্রকাশিত সূচিতে এরচেয়ে বেশি লোডশেডিংয়ের ঘোষণা দেয় পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি), বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি), ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো) এবং নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো)।

শতভাগ বিদ্যুতায়নের সফলতার মধ্যে দেশে লোডশেডিং ছিল না বললেই চলে। কোথাও হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যাওয়াকে বিতরণ বা সঞ্চালন ত্রুটি হিসেবে দেখা হতো। জ্বালানি সংকটের কারণে সম্প্রতি ব্যাপক লোডশেডিংয়ে অস্থির হয়ে পড়েন গ্রাহকরা। বিদ্যুৎ খাতের সরকারের বিশাল অর্জনের পর কেন এত লোডশেডিং, এমন প্রশ্ন উঠতে থাকে।

এমন পরিস্থিতিতে দেশবাসীকে ধৈর্য ধারণের আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু সেপ্টেম্বরে লোডশেডিং কমে আসবে বলে জানান। প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীও একই বার্তা দেন।

তবে সেপ্টেম্বরে লোডশেডিং চলতে থাকে। এরপর অক্টোবরে লোডশেডিং কমে আসবে আশা প্রকাশ করেন সংশ্লিষ্টরা। দেখা যায়, অক্টোবর পেরিয়ে নভেম্বরের শুরুতে এসে কমতে থাকে লোডশেডিং। যা গত এক সপ্তাহে একেবারেই কমে আসে।

পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) সূত্রে জানা যায়, গতকাল ভোর ৬টায় সারদেশে বিদ্যুতের মোট চাহিদা ছিল ৬৯৪৬ মেগাওয়াট। ওই সময় চাহিদার পুরো বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়েছে। দুপুর ১২টায় চাহিদা বেড়ে দাঁড়ায় ৯০১২ মেগাওয়াট। সে সময়ও চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়েছে।

গত শনিবার ভোর ৬টায় দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৬৫৭২ মেগাওয়াট। ওইদিন দুপুর ১২টায় চাহিদা ছিল ৮৩১৫ মেগাওয়াট, সন্ধ্যা ৬টায় ১০১৩১ মেগাওয়াট এবং রাত ১২টায় চাহিদা ছিল ৮২৭৪ মেগাওয়াট। চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

গত শুক্রবার সন্ধ্যায় সাবস্টেশন প্রান্তে বিদ্যুতের মোট চাহিদা ছিল ৮৭৫১ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ঢাকা জোনে চাহিদা ছিল ৩৩৮৫ মেগাওয়াট, চট্টগ্রাম জোনে ৯০৮ মেগাওয়াট, খুলনা জোনে ১০২১ মেগাওয়াট, রাজশাহী জোনে ৮৪৭ মেগাওয়াট, কুমিল্লা জোনে ৭৮১ মেগাওয়াট, ময়মনসিংহ জোনে ৭০৩ মেগাওয়াট, সিলেট জোনে ৩৩৪ মেগাওয়াট, বরিশাল জোনে ২৫০ মেগাওয়াট এবং রংপুর জোনে চাহিদা ছিল ৫২৩ মেগাওয়াট। চাহিদার পুরোটাই সরবরাহ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সাবস্টেশন প্রান্তে বিদ্যুতের মোট চাহিদা ছিল ১০৩৭৩ মেগাওয়াট, ১৬ নভেম্বর বুধবার ১০২৩৩ মেগাওয়াট, ১৫ নভেম্বর মঙ্গলবার ১০৪১২ মেগাওয়াট, ১৪ নভেম্বর সোমবার ১০২৫৬ মেগাওয়াট এবং ১৩ নভেম্বর রোববার চাহিদা ছিল ১০১৮৩ মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, উল্লিখিত দিনগুলোতে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়েছে।

দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি ৩৭ লাখ। রাষ্ট্রীয় ছয়টি বিদ্যুৎ বিতরণ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এসব গ্রাহককে বিদ্যুৎ বিতরণ করা হয়। এর মধ্যে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) ৮০টি সমিতির মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলসহ অধিকাংশ জেলায় বিদ্যুৎ বিতরণ করে। আরইবির গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ৩৮ লাখ ৫৩ হাজার ৫০০।

ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো) ঢাকা উত্তরে এবং ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) ঢাকা দক্ষিণ ও নারায়ণগঞ্জ শহরে বিদ্যুৎ বিতরণ করে। এছাড়া, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) দেশের বেশকিছু জেলা শহরে, ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো) খুলনা ও বরিশাল অঞ্চলে এবং নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো) রংপুর ও রাজশাহী অঞ্চলে বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে আছে।

দেশে বর্তমানে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ধরা হয় ২৫ হাজার ৭৩০ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ২৮০০ মেগাওয়াট ক্যাপটিভ, ৪১৮ মেগাওয়াড অফ-গ্রিড নবায়ণযোগ্য জ্বালানি এবং ১১৬০ মেগাওয়াট আমদানি বাদ দিলে মূল সক্ষমতা দাঁড়ায় ২১ হাজার ৩৫২ মেগাওয়াট; যা সরকারি-বেসরকরি পর্যায়ে স্থাপিত ১৫৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা। এর মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক ২০৮৬৩ মেগাওয়াট, হাইড্রো ২৩০ মেগাওয়াট এবং অন-গ্রিড সৌরভিত্তিক ২৫৯ মেগাওয়াট।

২১ হাজার ৩৫২ মেগাওয়াট সক্ষমতার মধ্যে শতকরা হিসাবে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ সক্ষমতা ৫২ শতাংশ, ফার্নেস তেলভিত্তিক ২৭ শতাংশ, ডিজেলভিত্তিক ৬ শতাংশ, কয়লাভিত্তিক ৮ শতাংশ, হাইড্রো ১ শতাংশ এবং অন-গ্রিড সৌরভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ১ শতাংশ এবং আমদানি হয় ৫ শতাংশ।

এই সক্ষমতার শতভাগ বিদ্যুৎ কোন কেন্দ্রই উৎপাদন করতে পারে না। প্লান্ট ফ্যাক্টর অনুযায়ী, নতুন কেন্দ্রগুলো বেশি এবং পুরনো কেন্দ্রগুলো থেকে অনেক কম বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। আবার রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত, গ্যাস সংকট, জ্বালানি সংকটসহ নানা কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হয়। গত ১৬ এপ্রিল আমদানিসহ দেশে সর্বোচ্চ ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড হয়।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক জ্বালানি সংকট কতদিন থাকে তা নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। তবে এটা দীর্ঘস্থায়ী হলে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত ঝুঁকিতে পড়বে বলে মনে করেন এ খাতের বিশ্লেষকরা।

এ বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, শীঘ্রই বাগেরহাটের রামপাল থেকে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী কোম্পানির বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে। এছাড়া ঝড়খন্ড থেকে আদানির বিদ্যুৎ আমদানিও দ্রুতই শুরু হবে। তখন ডিজেল ও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে সংকট হলেও গ্রাহক চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহে ঘাটতি হবে না।

সোমবার, ২১ নভেম্বর ২০২২ , ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪২৯, ২৫ রবিউস সানি ১৪৪৪

লোডশেডিং ঢাকায় নেই, কমেছে গ্রামেও

ফয়েজ আহমেদ তুষার

সম্প্রতি রাজধানীতে লোডশেডিং হচ্ছে না, গ্রামাঞ্চলেও লোডশেডিং কমে গেছে। বিভিন্ন এলাকার গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত এক সপ্তাহে রাজধানীর বেশিরভাগ এলাকায় লোডশেডিং হয়নি বললেই চলে। কিছু এলাকায় হঠাৎ কোন একদিন বিদ্যুৎ চলে গেলেও খানিক বিরতিতে আবার ফিরে এসেছে। জানা গেছে, গ্রামাঞ্চলেও আগের মতো লোডশেডিং নেই।

বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো বলছে, চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে বলে গ্রাহক পর্যায়ে লোডশেডিং করতে হচ্ছে না।

লোডশেডিংয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী বিকাশ দেওয়ান গতকাল রাতে সংবাদকে বলেন, গত পনের-বিশ দিন যাবাৎ আমরা চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ পাচ্ছি। তাই লোডশেডিং নেই। আজ (গতকাল) সন্ধ্যায় আমাদের চাহিদা ছিল প্রায় সাড়ে তেরশ’ মেগাওয়াট। আমরা পিডিবি থেকে পুরোটাই পাচ্ছি। তাই লোডশেডিং করতে হচ্ছে না।’ অনুসন্ধানে জানা গেছে, হেমন্তের আগমনে গরম কমে যাওয়ায় বিদ্যুতের চাহিদা কমে গেছে। নাতিশীতোষ্ণ এই আবহাওয়া বাসাবাড়িতে শীততাপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের (এসি) ব্যবহার বন্ধ করেছেন অনেকেই। এছাড়া বৈদ্যুতিক পাখা, রেফ্রিজারেটরের ব্যবহারও কমেছে।

গত ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির মূল্য বাড়তে থাকে এবং এ খাতে সংকট তৈরি হয়। উন্নত অনেক দেশের পাশপাশি এর নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশেও পড়ে।

দেশে চলমান গ্যাস সংকটের কারণে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো অলস বসে থাকে। বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ করতে ডিজেল, ফার্নেস তেল এবং এলএনজি আমদানি করা হয়। তবে যুদ্ধের কারণে জ্বালানির দাম অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় ডলার বাঁচাতে সাশ্রয়ে গুরুত্ব দিয়ে জ্বালানি আমদানি কমিয়ে দেয় শেখ হাসিনার সরকার। ফলে দেশে ফিরে আসে লোডশেডিং, যা দিনে দিনে বাড়তে থাকে।

গত জুলাই, আগস্টে দেশে গড়ে দৈনিক বিদ্যুৎ চাহিদা ছিল প্রায় সাড়ে তেরো থেকে চৌদ্দ হাজার মেগাওয়াট। ওই সময় ডিজেল ও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি হ্রাস করায় জ্বালানি সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদন নেমে এসেছিল ১১ হাজার মেগাওয়াটে। এতে প্রতিদিনই সাড়ে তিন থেকে চার হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হতো ওই সময়। তখন সরকারি নির্দেশে গ্রাহকদের সুবিধার্থে লোডশেডিংয়ের আগাম তথ্যসূচি প্রতিদিনই প্রকাশ করা শুরু করে বিতরণ কোম্পানিগুলো।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দিনে ৫ থেকে ৭ ঘণ্টা, কিছু জায়গায় ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হবে বলে সূচিতে জানায় ঢাকা ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডডিসি) ও ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো)।

রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে বিভিন্ন এলাকার জন্য প্রকাশিত সূচিতে এরচেয়ে বেশি লোডশেডিংয়ের ঘোষণা দেয় পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি), বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি), ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো) এবং নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো)।

শতভাগ বিদ্যুতায়নের সফলতার মধ্যে দেশে লোডশেডিং ছিল না বললেই চলে। কোথাও হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যাওয়াকে বিতরণ বা সঞ্চালন ত্রুটি হিসেবে দেখা হতো। জ্বালানি সংকটের কারণে সম্প্রতি ব্যাপক লোডশেডিংয়ে অস্থির হয়ে পড়েন গ্রাহকরা। বিদ্যুৎ খাতের সরকারের বিশাল অর্জনের পর কেন এত লোডশেডিং, এমন প্রশ্ন উঠতে থাকে।

এমন পরিস্থিতিতে দেশবাসীকে ধৈর্য ধারণের আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু সেপ্টেম্বরে লোডশেডিং কমে আসবে বলে জানান। প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীও একই বার্তা দেন।

তবে সেপ্টেম্বরে লোডশেডিং চলতে থাকে। এরপর অক্টোবরে লোডশেডিং কমে আসবে আশা প্রকাশ করেন সংশ্লিষ্টরা। দেখা যায়, অক্টোবর পেরিয়ে নভেম্বরের শুরুতে এসে কমতে থাকে লোডশেডিং। যা গত এক সপ্তাহে একেবারেই কমে আসে।

পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) সূত্রে জানা যায়, গতকাল ভোর ৬টায় সারদেশে বিদ্যুতের মোট চাহিদা ছিল ৬৯৪৬ মেগাওয়াট। ওই সময় চাহিদার পুরো বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়েছে। দুপুর ১২টায় চাহিদা বেড়ে দাঁড়ায় ৯০১২ মেগাওয়াট। সে সময়ও চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়েছে।

গত শনিবার ভোর ৬টায় দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৬৫৭২ মেগাওয়াট। ওইদিন দুপুর ১২টায় চাহিদা ছিল ৮৩১৫ মেগাওয়াট, সন্ধ্যা ৬টায় ১০১৩১ মেগাওয়াট এবং রাত ১২টায় চাহিদা ছিল ৮২৭৪ মেগাওয়াট। চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

গত শুক্রবার সন্ধ্যায় সাবস্টেশন প্রান্তে বিদ্যুতের মোট চাহিদা ছিল ৮৭৫১ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ঢাকা জোনে চাহিদা ছিল ৩৩৮৫ মেগাওয়াট, চট্টগ্রাম জোনে ৯০৮ মেগাওয়াট, খুলনা জোনে ১০২১ মেগাওয়াট, রাজশাহী জোনে ৮৪৭ মেগাওয়াট, কুমিল্লা জোনে ৭৮১ মেগাওয়াট, ময়মনসিংহ জোনে ৭০৩ মেগাওয়াট, সিলেট জোনে ৩৩৪ মেগাওয়াট, বরিশাল জোনে ২৫০ মেগাওয়াট এবং রংপুর জোনে চাহিদা ছিল ৫২৩ মেগাওয়াট। চাহিদার পুরোটাই সরবরাহ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সাবস্টেশন প্রান্তে বিদ্যুতের মোট চাহিদা ছিল ১০৩৭৩ মেগাওয়াট, ১৬ নভেম্বর বুধবার ১০২৩৩ মেগাওয়াট, ১৫ নভেম্বর মঙ্গলবার ১০৪১২ মেগাওয়াট, ১৪ নভেম্বর সোমবার ১০২৫৬ মেগাওয়াট এবং ১৩ নভেম্বর রোববার চাহিদা ছিল ১০১৮৩ মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, উল্লিখিত দিনগুলোতে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়েছে।

দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি ৩৭ লাখ। রাষ্ট্রীয় ছয়টি বিদ্যুৎ বিতরণ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এসব গ্রাহককে বিদ্যুৎ বিতরণ করা হয়। এর মধ্যে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) ৮০টি সমিতির মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলসহ অধিকাংশ জেলায় বিদ্যুৎ বিতরণ করে। আরইবির গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ৩৮ লাখ ৫৩ হাজার ৫০০।

ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো) ঢাকা উত্তরে এবং ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) ঢাকা দক্ষিণ ও নারায়ণগঞ্জ শহরে বিদ্যুৎ বিতরণ করে। এছাড়া, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) দেশের বেশকিছু জেলা শহরে, ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো) খুলনা ও বরিশাল অঞ্চলে এবং নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো) রংপুর ও রাজশাহী অঞ্চলে বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে আছে।

দেশে বর্তমানে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ধরা হয় ২৫ হাজার ৭৩০ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ২৮০০ মেগাওয়াট ক্যাপটিভ, ৪১৮ মেগাওয়াড অফ-গ্রিড নবায়ণযোগ্য জ্বালানি এবং ১১৬০ মেগাওয়াট আমদানি বাদ দিলে মূল সক্ষমতা দাঁড়ায় ২১ হাজার ৩৫২ মেগাওয়াট; যা সরকারি-বেসরকরি পর্যায়ে স্থাপিত ১৫৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা। এর মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক ২০৮৬৩ মেগাওয়াট, হাইড্রো ২৩০ মেগাওয়াট এবং অন-গ্রিড সৌরভিত্তিক ২৫৯ মেগাওয়াট।

২১ হাজার ৩৫২ মেগাওয়াট সক্ষমতার মধ্যে শতকরা হিসাবে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ সক্ষমতা ৫২ শতাংশ, ফার্নেস তেলভিত্তিক ২৭ শতাংশ, ডিজেলভিত্তিক ৬ শতাংশ, কয়লাভিত্তিক ৮ শতাংশ, হাইড্রো ১ শতাংশ এবং অন-গ্রিড সৌরভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ১ শতাংশ এবং আমদানি হয় ৫ শতাংশ।

এই সক্ষমতার শতভাগ বিদ্যুৎ কোন কেন্দ্রই উৎপাদন করতে পারে না। প্লান্ট ফ্যাক্টর অনুযায়ী, নতুন কেন্দ্রগুলো বেশি এবং পুরনো কেন্দ্রগুলো থেকে অনেক কম বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। আবার রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত, গ্যাস সংকট, জ্বালানি সংকটসহ নানা কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হয়। গত ১৬ এপ্রিল আমদানিসহ দেশে সর্বোচ্চ ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড হয়।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক জ্বালানি সংকট কতদিন থাকে তা নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। তবে এটা দীর্ঘস্থায়ী হলে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত ঝুঁকিতে পড়বে বলে মনে করেন এ খাতের বিশ্লেষকরা।

এ বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, শীঘ্রই বাগেরহাটের রামপাল থেকে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী কোম্পানির বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে। এছাড়া ঝড়খন্ড থেকে আদানির বিদ্যুৎ আমদানিও দ্রুতই শুরু হবে। তখন ডিজেল ও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে সংকট হলেও গ্রাহক চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহে ঘাটতি হবে না।