বিদেশিদের বেতন-ভাতার নামে পাচার ২৬ হাজার কোটি টাকা

কর ফাঁকি বছরে ১২ হাজার কোটি টাকা সুশাসন নিশ্চিতে ৯ দফা সুপারিশ

বিদেশি কর্মীদের বেতন-ভাতার নামে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ২৬ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। কম করে ধরলেও বাংলাদেশে আড়াই লাখ বিদেশি কর্মী কাজ করেন। এর মধ্যে পর্যটক ভিসায় এসে কাজ করেন ১ লাখ ৬০ হাজার কর্মী। এসব বিদেশি কর্মী প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেন। ‘বাংলাদেশে বিদেশিদের কর্মসংস্থান : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এক গবেষণার পর্যবেক্ষণে এই প্রাক্কলন তুলে ধরা হয়। রাজধানীর ধানমন্ডির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বুধবার এ পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে বৈধ বিদেশি কর্মীরা কীভাবে বেতন কম দেখিয়ে রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে তার একটি হিসাবও দিয়েছে টিআইবি। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও গণমাধ্যমকর্মীদের সাক্ষাৎকার এবং আইনি নথি-নীতিমালা, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তথ্য, গবেষণা প্রতিবেদন ও গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে এ গবেষণা হয়েছে। ২০১৮ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে করা গুণগত এ গবেষণায় কোন জরিপ চালানো হয়নি, শুধু তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে বলে টিআইবি জানিয়েছে।

এসব অনিয়ম দূর করে সুশাসন নিশ্চিত করতে নয় দফা সুপারিশ দিয়েছে টিআইবি। টিআইবি বলছে, বাংলাদেশে বৈধ ও অবৈধভাবে কর্মরত বিদেশি কর্মীর প্রকৃত সংখ্যা ও পাচার করা অর্থের পরিমাণ নিয়ে নির্ভরযোগ্য প্রাতিষ্ঠানিক কোন তথ্য না থাকলেও গবেষণার সার্বিক পর্যবেক্ষণে অর্থ পাচার ও রাজস্ব ক্ষতির যে পরিমাণ উঠে এসেছে তা উদ্বেগজনক। পর্যবেক্ষণে বলা হয় ‘বাংলাদেশে বিদেশি কর্মী নিয়োগে কোন সমন্বিত ও কার্যকর কৌশলগত নীতিমালা নেই। বিদেশি কর্মী নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বপ্রাপ্ত সুনির্দিষ্ট কোন কর্তৃপক্ষ নেই। ফলে এসব বিদেশি কর্মী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের মধ্যে কার্যকর সমন্বয়হীনতা লক্ষণীয়।

বছরে পাচার ২৬ হাজার কোটি টাকা

গবেষণার প্রাক্কলন অনুযায়ী, বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি কর্মীর ন্যূনতম সংখ্যা ধরা হয়েছে আড়াই লাখ, যারা বছরে ন্যূনতম ২৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা পাচার করে। এর মধ্যে বাংলাদেশ বছরে ন্যূনতম ১২ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। আড়াই লাখ বিদেশির সংখ্যা নির্ধারণ ও রাজস্ব ফাঁকির একটি অনুমিত ব্যাখ্যাও দিয়েছে টিআইবি।

২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন জানান, দেশে বৈধভাবে কর্মরত বিদেশির সংখ্যা ৮৫ হাজার ৪৮৬ জন। পর্যটন করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, ওই বছর ৮ লাখ পর্যটক ভিসা নিয়েছে। টিআইবি বলছে, পর্যটক ভিসায় কাজ করা নিষিদ্ধ হলেও এই ভিসায় বিদেশিরা অবৈধভাবে দেশের বিভিন্ন খাতে কাজ করছেন। ৮ লাখ পর্যটকের অন্তত ৫০ শতাংশ বা চার লাখ ভিসা কাজের উদ্দেশ্যে ব্যবহার হয়।

এসব ভিসার সর্বোচ্চ মেয়াদ ৩ মাস হওয়ায় তারা তিন মাস পর পর দেশে গিয়ে আবার ভিসা নিয়ে ফিরে আসে। অর্থাৎ একজনকে বছরে গড়ে আড়াইবার ভিসা নিতে হয়। সে হিসেবে পর্যটক ভিসায় প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার (৪ লাখ/২.৫) বিদেশি কাজ করেন। এর সঙ্গে বৈধ বিদেশি কর্মী প্রায় ৯০ হাজার যোগ করে মোট বিদেশি কর্মীর সংখ্যা ন্যূনতম আড়াই লাখ ধরা হয়েছে। জনপ্রতি ন্যূনতম গড় মাসিক বেতন দেড় হাজার ডলার ধরে বিদেশি কর্মীদের মোট বার্ষিক আয় ৪৫০ কোটি ডলার হিসাব করা হয়েছে। সেখান থেকে ৩০ স্থানীয় ব্যয় বাদ দিলে মোট পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩১৫ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা (১ ডলার = ৮৫ টাকা)। বিদেশিদের ৩০ শতাংশ করহার ধরে ন্যূনতম রাজস্ব ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩৫ কোটি ডলার বা প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা।

টিআইবি বলছে, বাংলাদেশে কর্মরত বৈধ বিদেশির হিসাবে নিয়ে সরকারি সংস্থার মধ্যেই মিল নেই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দেশে বিদেশি কর্মীর সংখ্যা ৮৫ হাজার ৪৮৬ জন বলেছেন। কিন্তু ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের হিসাবে কর্মোপযোগী ভিসার সংখ্যা ৩৩ হাজার ৪০৫টি। আর বিডা, বেপজা ও এনজিও ব্যুরো- তিন সংস্থার দেয়া কর্মানুমতির সংখ্যার ১১ হাজার ১৮০টি। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, তথ্যের অভাব আছে এবং বিভিন্ন দফতরের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব আছে। সরকারের কতটুকু সদিচ্ছা আছে সেটাও দেখতে হবে। যারা রিটার্ন দিচ্ছেন, তারা সঠিকভাবে দিচ্ছেন কিনা সেটাও দেখার বিষয় আছে। অনেক সময় হয়, টুরিস্ট ভিসা নিয়ে কাজ করছে, ভিসার মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে, কারণ সেখানে অবৈধ লেনদেন আছে।

রাজস্ব ফাঁকি

টিআইবির দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে কর অঞ্চল-১১তে আয়কর রিটার্ন জমা দিয়েছেন সাড়ে ৯ হাজার বিদেশি, যাদের বার্ষিক আয় ৬০৩ কোটি টাকা। যাতে মোট কর পাওয়া গেছে ১৮১ কোটি টাকা। তৈরি পোশাক খাতে কর্মরত বিদেশিদের আয়ের হিসাব তুলে ধরে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ খাতের একটি প্রতিষ্ঠানের বিদেশি প্রধান নির্বাহীর মাসিক বেতন ১০ থেকে ১২ হাজার মার্কিন ডলার। কিন্তু দেখানো হয়েছে ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার ডলার। আর একজন ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারের মাসিক বেতন ৩-৬ হাজার ডলার হলেও দেখানো হয় ১-২ হাজার ডলার। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, এখানে পরিষ্কারভাবে একটি যোগসাজস। আয় যা তা দেখাতে হলে রিটার্নে দেখাতে হবে- এটা নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান যেমন চায় না, তেমনি কর্মী চায় না। ফাঁকি দেয়া সম্ভব বলে তারা এটি করছে। এই অবৈধ কাজ চলছে। এটা সম্পর্কে সরকারের বিভিন্ন মহলে বিক্ষিপ্ত ধারণা ছিল। তাদের কাছে সেভাবে তথ্য নেই।

অবৈধ লেনদেনে

টিআইবি বলছে, বাংলাদেশে বৈধ প্রক্রিয়ায় বিদেশি কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম পেয়েছে টিআইবি। নিয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পদে যোগ্য দেশি কর্মী খোঁজা হয় না এবং বিদেশি কর্মী নিয়োগের প্রক্রিয়া নিয়ম রক্ষার তাগিদে আনুষ্ঠানিকভাবে সারা হয়। এসব কর্মী নিয়োগে ভিসার সুপারিশপত্রে জন্য ৫-৭ হাজার টাকা অবৈধ লেনদেনে হয়। বিদেশে বাংলাদেশ মিশন থেকে ভিসা নিতে ৪ থেকে সাড়ে ৮ হাজার টাকা, কাজের অনুমতি নিতে ৫-৭ হাজার টাকা, পুলিশের বিশেষ শাখার ছাড়পত্র পেতে ৫-৭ হাজার টাকা, জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) ছাড়পত্রের জন্য ৩-৫ হাজার টাকা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ছাড়ের জন্য ২-৩ হাজার টাকা এবং ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর জন্য ৩-৫ হাজার টাকা নিয়ম বহির্ভূতভাবে দিতে হয়। এসব নিয়মবহির্ভূত অর্থ লেনদেনে একটি শ্রেণী লাভবান হচ্ছে জানিয়ে টিআইবি মনে করছে, এজন্য এ খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যাচ্ছে না।

নয় দফা সুপারিশ

এই গবেষণায় প্রাপ্ত পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশে বিদেশিদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ থেকে উত্তরণে টিআইবি ৯ দফা সুপারিশ উত্থাপন করে। উল্লেখযোগ্য সুপারিশগুলো হলো- বাংলাদেশে বিদেশি কর্মীর নিয়োগে সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য একটি সমন্বিত কৌশলগত নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে; বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশি নাগরিকদের সব তথ্য কার্যকর উপায়ে সংরক্ষণ ও ব্যবহারের সুবিধার্থে সকল আগমন ও প্রত্যাগমন পথে সমন্বিত তথ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি চালু করা এবং সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষের মধ্যে তথ্য বিনিময়ের সুযোগ থাকতে হবে। এক্ষেত্রে বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোকে প্রতি মাসেই ইস্যুকৃত ভিসার শ্রেণী অনুযায়ী বিবরণী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো, বাংলাদেশের ‘পোর্ট অব এন্ট্রি’ যেমন- বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরে অবস্থিত ইমিগ্রেশন অফিসকে বিদেশিদের আগমন ও নির্গমন তালিকা প্রতি মাসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা, ‘ভিসা অন অ্যারাইভাল’ সংখ্যা সমন্বয়ের জন্য দূতাবাস প্রেরিত তালিকা এবং বিমান বা স্থলবন্দরে ইমিগ্রেশন অফিস প্রেরিত তালিকার সমন্বয় করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখা কর্তৃক আগত সব বিদেশির একটি চূড়ান্ত তালিকা প্রণয়ন ও নিয়মিত হালনাগাদ করতে হবে; বিদেশি কর্মীদের ভিসা সুপারিশপত্র, নিরাপত্তা ছাড়পত্র, কর্মানুমতি এবং ভিসার মেয়াদ বৃদ্ধি সংক্রান্ত সেবা প্রদানে ওয়ানস্টপ সার্ভিস প্রতিষ্ঠা করতে হবে; বিদেশি কর্মীদের ন্যূনতম বেতন সীমা হালনাগাদ করতে হবে; বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি মিশনে ভিসা প্রদানে অনিয়ম বন্ধ করতে হবে- মেশিন রিডেবল ভিসা ব্যতীত অন্যান্য প্রক্রিয়ায় ভিসা (সিল) প্রদান বন্ধ করা; বিদেশি কর্মীদের তথ্যানুসন্ধানে বিভিন্ন অফিস/কারখানায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বিডা ও পুলিশের বিশেষ শাখার সমন্বয়ে যৌথ টাস্ক ফোর্স কর্তৃক অভিযান পরিচালনা করা; খাতভিত্তিক বিদেশি কর্মীর চাহিদা নিরূপণ করতে হবে, এক্ষেত্রে বিদেশি কর্মী নিয়োগের পূর্ব শর্তসমূহ যথাযথভাবে মেনে চলা নিশ্চিত করা; শিল্পখাতের বিকাশের সুফল গ্রহণে স্থানীয় কর্মসংস্থানের সুযোগ নিশ্চিত করা এবং অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত শিল্পখাতভিত্তিক স্থানীয় মানবসম্পদের দক্ষতা ও যোগ্যতার উন্নয়নে নীতিগত উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা ইত্যাদি।

কোন দেশের কর্মী বেশি

প্রায় ৪৪টি দেশ থেকে আসা বিদেশিরা বাংলাদেশে বিভিন্ন কাতে কর্মরত বলে টিআইবি বলেছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভারত, চীন, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, তুরস্ক, নরওয়ে ও নাইজেরিয়া। কোন দেশের মানুষ বেশি আছে জানতে চাইলে টিআইবির গবেষক মনজুর ই খোদা বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে যে তথ্য দিয়েছেন সেখানেই বলা আছে, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি কর্মী আসে ভারত থেকে। সরকারি প্রকল্পে কর্মরত বিদেশিদের ক্ষেত্রে অনিয়ম হয় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে যারা কাজ করেন তারা অনেকেই ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া কাজ করছেন। তারাও সঠিক বেতন কত সেটা জানায় না। বিদেশি কর্মীদের ভিসার সুপারিশপত্র, নিরাপত্তা ছাড়, কর্মানুমতি ও ভিসার মেয়াদ বৃদ্ধি সংক্রান্ত সেবা ওয়ানস্টপ সার্ভিস করার সুপারিশ করেছে টিআইবি। বিদেশি কর্মীদের ন্যূনতম বেতন সীমা হালনাগাদ, তথ্য অনুসন্ধানে বিভিন্ন অফিস/কারখানায় এনবিআর বিডা, এসবি সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠন করে অভিযান ও স্থানীয় কর্মসংস্থানের সুযোগ নিশ্চিত করার সুপারিশও রয়েছে।

বৃহস্পতিবার, ০৬ ফেব্রুয়ারী ২০২০ , ২৩ মাঘ ১৪২৬, ১১ জমাদিউল সানি ১৪৪১

বিদেশিদের বেতন-ভাতার নামে পাচার ২৬ হাজার কোটি টাকা

কর ফাঁকি বছরে ১২ হাজার কোটি টাকা সুশাসন নিশ্চিতে ৯ দফা সুপারিশ

অর্থনৈতিক বার্তা পরিবেশক |

image

বিদেশি কর্মীদের বেতন-ভাতার নামে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ২৬ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। কম করে ধরলেও বাংলাদেশে আড়াই লাখ বিদেশি কর্মী কাজ করেন। এর মধ্যে পর্যটক ভিসায় এসে কাজ করেন ১ লাখ ৬০ হাজার কর্মী। এসব বিদেশি কর্মী প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেন। ‘বাংলাদেশে বিদেশিদের কর্মসংস্থান : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এক গবেষণার পর্যবেক্ষণে এই প্রাক্কলন তুলে ধরা হয়। রাজধানীর ধানমন্ডির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বুধবার এ পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে বৈধ বিদেশি কর্মীরা কীভাবে বেতন কম দেখিয়ে রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে তার একটি হিসাবও দিয়েছে টিআইবি। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও গণমাধ্যমকর্মীদের সাক্ষাৎকার এবং আইনি নথি-নীতিমালা, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তথ্য, গবেষণা প্রতিবেদন ও গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে এ গবেষণা হয়েছে। ২০১৮ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে করা গুণগত এ গবেষণায় কোন জরিপ চালানো হয়নি, শুধু তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে বলে টিআইবি জানিয়েছে।

এসব অনিয়ম দূর করে সুশাসন নিশ্চিত করতে নয় দফা সুপারিশ দিয়েছে টিআইবি। টিআইবি বলছে, বাংলাদেশে বৈধ ও অবৈধভাবে কর্মরত বিদেশি কর্মীর প্রকৃত সংখ্যা ও পাচার করা অর্থের পরিমাণ নিয়ে নির্ভরযোগ্য প্রাতিষ্ঠানিক কোন তথ্য না থাকলেও গবেষণার সার্বিক পর্যবেক্ষণে অর্থ পাচার ও রাজস্ব ক্ষতির যে পরিমাণ উঠে এসেছে তা উদ্বেগজনক। পর্যবেক্ষণে বলা হয় ‘বাংলাদেশে বিদেশি কর্মী নিয়োগে কোন সমন্বিত ও কার্যকর কৌশলগত নীতিমালা নেই। বিদেশি কর্মী নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বপ্রাপ্ত সুনির্দিষ্ট কোন কর্তৃপক্ষ নেই। ফলে এসব বিদেশি কর্মী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের মধ্যে কার্যকর সমন্বয়হীনতা লক্ষণীয়।

বছরে পাচার ২৬ হাজার কোটি টাকা

গবেষণার প্রাক্কলন অনুযায়ী, বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি কর্মীর ন্যূনতম সংখ্যা ধরা হয়েছে আড়াই লাখ, যারা বছরে ন্যূনতম ২৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা পাচার করে। এর মধ্যে বাংলাদেশ বছরে ন্যূনতম ১২ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। আড়াই লাখ বিদেশির সংখ্যা নির্ধারণ ও রাজস্ব ফাঁকির একটি অনুমিত ব্যাখ্যাও দিয়েছে টিআইবি।

২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন জানান, দেশে বৈধভাবে কর্মরত বিদেশির সংখ্যা ৮৫ হাজার ৪৮৬ জন। পর্যটন করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, ওই বছর ৮ লাখ পর্যটক ভিসা নিয়েছে। টিআইবি বলছে, পর্যটক ভিসায় কাজ করা নিষিদ্ধ হলেও এই ভিসায় বিদেশিরা অবৈধভাবে দেশের বিভিন্ন খাতে কাজ করছেন। ৮ লাখ পর্যটকের অন্তত ৫০ শতাংশ বা চার লাখ ভিসা কাজের উদ্দেশ্যে ব্যবহার হয়।

এসব ভিসার সর্বোচ্চ মেয়াদ ৩ মাস হওয়ায় তারা তিন মাস পর পর দেশে গিয়ে আবার ভিসা নিয়ে ফিরে আসে। অর্থাৎ একজনকে বছরে গড়ে আড়াইবার ভিসা নিতে হয়। সে হিসেবে পর্যটক ভিসায় প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার (৪ লাখ/২.৫) বিদেশি কাজ করেন। এর সঙ্গে বৈধ বিদেশি কর্মী প্রায় ৯০ হাজার যোগ করে মোট বিদেশি কর্মীর সংখ্যা ন্যূনতম আড়াই লাখ ধরা হয়েছে। জনপ্রতি ন্যূনতম গড় মাসিক বেতন দেড় হাজার ডলার ধরে বিদেশি কর্মীদের মোট বার্ষিক আয় ৪৫০ কোটি ডলার হিসাব করা হয়েছে। সেখান থেকে ৩০ স্থানীয় ব্যয় বাদ দিলে মোট পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩১৫ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা (১ ডলার = ৮৫ টাকা)। বিদেশিদের ৩০ শতাংশ করহার ধরে ন্যূনতম রাজস্ব ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩৫ কোটি ডলার বা প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা।

টিআইবি বলছে, বাংলাদেশে কর্মরত বৈধ বিদেশির হিসাবে নিয়ে সরকারি সংস্থার মধ্যেই মিল নেই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দেশে বিদেশি কর্মীর সংখ্যা ৮৫ হাজার ৪৮৬ জন বলেছেন। কিন্তু ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের হিসাবে কর্মোপযোগী ভিসার সংখ্যা ৩৩ হাজার ৪০৫টি। আর বিডা, বেপজা ও এনজিও ব্যুরো- তিন সংস্থার দেয়া কর্মানুমতির সংখ্যার ১১ হাজার ১৮০টি। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, তথ্যের অভাব আছে এবং বিভিন্ন দফতরের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব আছে। সরকারের কতটুকু সদিচ্ছা আছে সেটাও দেখতে হবে। যারা রিটার্ন দিচ্ছেন, তারা সঠিকভাবে দিচ্ছেন কিনা সেটাও দেখার বিষয় আছে। অনেক সময় হয়, টুরিস্ট ভিসা নিয়ে কাজ করছে, ভিসার মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে, কারণ সেখানে অবৈধ লেনদেন আছে।

রাজস্ব ফাঁকি

টিআইবির দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে কর অঞ্চল-১১তে আয়কর রিটার্ন জমা দিয়েছেন সাড়ে ৯ হাজার বিদেশি, যাদের বার্ষিক আয় ৬০৩ কোটি টাকা। যাতে মোট কর পাওয়া গেছে ১৮১ কোটি টাকা। তৈরি পোশাক খাতে কর্মরত বিদেশিদের আয়ের হিসাব তুলে ধরে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ খাতের একটি প্রতিষ্ঠানের বিদেশি প্রধান নির্বাহীর মাসিক বেতন ১০ থেকে ১২ হাজার মার্কিন ডলার। কিন্তু দেখানো হয়েছে ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার ডলার। আর একজন ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারের মাসিক বেতন ৩-৬ হাজার ডলার হলেও দেখানো হয় ১-২ হাজার ডলার। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, এখানে পরিষ্কারভাবে একটি যোগসাজস। আয় যা তা দেখাতে হলে রিটার্নে দেখাতে হবে- এটা নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান যেমন চায় না, তেমনি কর্মী চায় না। ফাঁকি দেয়া সম্ভব বলে তারা এটি করছে। এই অবৈধ কাজ চলছে। এটা সম্পর্কে সরকারের বিভিন্ন মহলে বিক্ষিপ্ত ধারণা ছিল। তাদের কাছে সেভাবে তথ্য নেই।

অবৈধ লেনদেনে

টিআইবি বলছে, বাংলাদেশে বৈধ প্রক্রিয়ায় বিদেশি কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম পেয়েছে টিআইবি। নিয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পদে যোগ্য দেশি কর্মী খোঁজা হয় না এবং বিদেশি কর্মী নিয়োগের প্রক্রিয়া নিয়ম রক্ষার তাগিদে আনুষ্ঠানিকভাবে সারা হয়। এসব কর্মী নিয়োগে ভিসার সুপারিশপত্রে জন্য ৫-৭ হাজার টাকা অবৈধ লেনদেনে হয়। বিদেশে বাংলাদেশ মিশন থেকে ভিসা নিতে ৪ থেকে সাড়ে ৮ হাজার টাকা, কাজের অনুমতি নিতে ৫-৭ হাজার টাকা, পুলিশের বিশেষ শাখার ছাড়পত্র পেতে ৫-৭ হাজার টাকা, জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) ছাড়পত্রের জন্য ৩-৫ হাজার টাকা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ছাড়ের জন্য ২-৩ হাজার টাকা এবং ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর জন্য ৩-৫ হাজার টাকা নিয়ম বহির্ভূতভাবে দিতে হয়। এসব নিয়মবহির্ভূত অর্থ লেনদেনে একটি শ্রেণী লাভবান হচ্ছে জানিয়ে টিআইবি মনে করছে, এজন্য এ খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যাচ্ছে না।

নয় দফা সুপারিশ

এই গবেষণায় প্রাপ্ত পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশে বিদেশিদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ থেকে উত্তরণে টিআইবি ৯ দফা সুপারিশ উত্থাপন করে। উল্লেখযোগ্য সুপারিশগুলো হলো- বাংলাদেশে বিদেশি কর্মীর নিয়োগে সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য একটি সমন্বিত কৌশলগত নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে; বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশি নাগরিকদের সব তথ্য কার্যকর উপায়ে সংরক্ষণ ও ব্যবহারের সুবিধার্থে সকল আগমন ও প্রত্যাগমন পথে সমন্বিত তথ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি চালু করা এবং সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষের মধ্যে তথ্য বিনিময়ের সুযোগ থাকতে হবে। এক্ষেত্রে বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোকে প্রতি মাসেই ইস্যুকৃত ভিসার শ্রেণী অনুযায়ী বিবরণী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো, বাংলাদেশের ‘পোর্ট অব এন্ট্রি’ যেমন- বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরে অবস্থিত ইমিগ্রেশন অফিসকে বিদেশিদের আগমন ও নির্গমন তালিকা প্রতি মাসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা, ‘ভিসা অন অ্যারাইভাল’ সংখ্যা সমন্বয়ের জন্য দূতাবাস প্রেরিত তালিকা এবং বিমান বা স্থলবন্দরে ইমিগ্রেশন অফিস প্রেরিত তালিকার সমন্বয় করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখা কর্তৃক আগত সব বিদেশির একটি চূড়ান্ত তালিকা প্রণয়ন ও নিয়মিত হালনাগাদ করতে হবে; বিদেশি কর্মীদের ভিসা সুপারিশপত্র, নিরাপত্তা ছাড়পত্র, কর্মানুমতি এবং ভিসার মেয়াদ বৃদ্ধি সংক্রান্ত সেবা প্রদানে ওয়ানস্টপ সার্ভিস প্রতিষ্ঠা করতে হবে; বিদেশি কর্মীদের ন্যূনতম বেতন সীমা হালনাগাদ করতে হবে; বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি মিশনে ভিসা প্রদানে অনিয়ম বন্ধ করতে হবে- মেশিন রিডেবল ভিসা ব্যতীত অন্যান্য প্রক্রিয়ায় ভিসা (সিল) প্রদান বন্ধ করা; বিদেশি কর্মীদের তথ্যানুসন্ধানে বিভিন্ন অফিস/কারখানায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বিডা ও পুলিশের বিশেষ শাখার সমন্বয়ে যৌথ টাস্ক ফোর্স কর্তৃক অভিযান পরিচালনা করা; খাতভিত্তিক বিদেশি কর্মীর চাহিদা নিরূপণ করতে হবে, এক্ষেত্রে বিদেশি কর্মী নিয়োগের পূর্ব শর্তসমূহ যথাযথভাবে মেনে চলা নিশ্চিত করা; শিল্পখাতের বিকাশের সুফল গ্রহণে স্থানীয় কর্মসংস্থানের সুযোগ নিশ্চিত করা এবং অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত শিল্পখাতভিত্তিক স্থানীয় মানবসম্পদের দক্ষতা ও যোগ্যতার উন্নয়নে নীতিগত উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা ইত্যাদি।

কোন দেশের কর্মী বেশি

প্রায় ৪৪টি দেশ থেকে আসা বিদেশিরা বাংলাদেশে বিভিন্ন কাতে কর্মরত বলে টিআইবি বলেছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভারত, চীন, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, তুরস্ক, নরওয়ে ও নাইজেরিয়া। কোন দেশের মানুষ বেশি আছে জানতে চাইলে টিআইবির গবেষক মনজুর ই খোদা বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে যে তথ্য দিয়েছেন সেখানেই বলা আছে, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি কর্মী আসে ভারত থেকে। সরকারি প্রকল্পে কর্মরত বিদেশিদের ক্ষেত্রে অনিয়ম হয় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে যারা কাজ করেন তারা অনেকেই ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া কাজ করছেন। তারাও সঠিক বেতন কত সেটা জানায় না। বিদেশি কর্মীদের ভিসার সুপারিশপত্র, নিরাপত্তা ছাড়, কর্মানুমতি ও ভিসার মেয়াদ বৃদ্ধি সংক্রান্ত সেবা ওয়ানস্টপ সার্ভিস করার সুপারিশ করেছে টিআইবি। বিদেশি কর্মীদের ন্যূনতম বেতন সীমা হালনাগাদ, তথ্য অনুসন্ধানে বিভিন্ন অফিস/কারখানায় এনবিআর বিডা, এসবি সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠন করে অভিযান ও স্থানীয় কর্মসংস্থানের সুযোগ নিশ্চিত করার সুপারিশও রয়েছে।