বিএনপি কি একা হয়ে যাচ্ছে?

একাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) দুই জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের কার্যক্রম কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছে। এমন অবস্থায় শরিক দলগুলোর মধ্যে বিরাজ করছে অস্থিরতা। দুই জোটের শরিকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, অবিশ্বাস ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। ইতিমধ্যেই উভয় জোটের শরিক দলগুলোর মধ্যে টানাপোড়েনে ভাঙন দেখা দিয়েছে। জোটের অস্তিত্ব নেইÑ এমন অভিযোগ করে সম্প্রতি ঐক্যফ্রন্ট ছেড়ে দিয়েছেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। এর আগেই ২০ দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে গেছেন বিজেপি চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ। এখনও যারা জোটে টিকে রয়েছে তারাও নিজেদের মতো করে কার্যক্রম পরিচালনা করার চেষ্টা করছে। কেউ কেউ নতুন ফোরাম গঠন করে পৃথক অবস্থান তৈরি করারও চেষ্টা চালাচ্ছে। জোটের অনিশ্চয়তায় আবার কোন কোন শরিক দল জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চিন্তাভাবনাও করছে। এমন প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠছে, বিএনপি কি একা হয়ে যাচ্ছে? তবে দুই জোট ও শরিক দলগুলোর সঙ্গে টানাপোড়েনে ভাঙন দেখা দিলেও বিএনপি চিন্তিত নয় বলে দায়িত্বশীল নেতারা দাবি করেছেন।

ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটে আর আগ্রহ নেই দলটির। উভয় জোটের কার্যক্রম থেকে ক্রমেই গুটিয়ে নিচ্ছে বিএনপি। দীর্ঘদিন ধরে জোটের কোন বৈঠকও হচ্ছে না। দলের নেতাকর্মীদের বড় একটি অংশ চান, জোট থেকে বেরিয়ে বিএনপিকে এককভাবে কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকতে। বিগত সময়ে জোটভিত্তিক রাজনীতিতে সুফল না পাওয়ায় নেতাকর্মীরা জোটের নির্ভরতা কমাতে চায় বলেও বিএনপির দায়িত্বশীল একটি সূত্রের দাবি। তবে দুই জোটকেই নতুনভাবে গড়ার চিন্তাভাবনা চলছে বলেও অপর একটি সূত্রের দাবি। সূত্রটি বলছে, এক্ষেত্রে জোট দুটির নেতৃত্বের কাঠামোতে পরিবর্তন আনা হবে। বিএনপির সূত্রগুলো বলছে, বিগত দিনের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজ শক্তিতে আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষ্যেই এগোতে চায় দলটি। এক্ষেত্রে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে কারামুক্ত করা এবং মূল দলসহ অন্যান্য অঙ্গসংগঠনগুলো পুনর্গঠন করে সাংগঠনিক কার্যক্রম চাঙ্গা করাই তাদের এখন মূল লক্ষ্য। তবে আপাতত বড় কোন আন্দোলন কর্মসূচিতে যেতে চায় না বিএনপি। যদিও খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে আইনি প্রক্রিয়ার পাশাপাশি ছোট ছোট কর্মসূচি দিয়েই সামনে থাকতে চায় দলটি। বিএনপির নেতাদের মতে, জনসমর্থনের ভিত্তিতে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে টক্কর দিতে পারে একমাত্র তারাই। তৃণমূলে তাদের বিপুল সমর্থক, নেতাকর্মী রয়েছেন কিন্তু সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে সেটি সম্ভব হচ্ছে না। আবার জোটভিত্তিক রাজনীতির গুরুত্ব দিয়েও লাভ হয়নি। তাই আপাতত সাংঠনিক কার্যক্রম গতিশীল করাই তাদের প্রধান লক্ষ্য। এক্ষেত্রে পরীক্ষিত নেতাদের দায়িত্বে এনে বিএনপি সংগঠনকে চাঙ্গা করার পরিকল্পনায় গুরুত্ব দেয়া দিচ্ছে। এর পাশাপাশি ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, কৃষক দল, মহিলা দলসহ বিভিন্ন ইউনিটে আমূল পরিবর্তনের উদ্যোগ নিচ্ছে। এ জন্য নানা জটিলতা দেখা দিলেও সময়ের সঙ্গে মিটে যাবে বলেও প্রত্যাশা করছে বিএনপির হাইকমান্ড।

দুর্নীতি মামলায় দন্ড নিয়ে দেড় বছর ধরে কারাবন্দী হয়ে রয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। দলের চেয়ারপারসন কারাগারে যাওয়ার পর বিএনপির ‘চেইন অব কমান্ড’ অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়ে। লন্ডনে অবস্থানরত দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হলেও তার সিদ্ধান্তে জটিলতা দেখা দেয়। দেখা দেয় সাংগঠনিক স্থবিরতা। বিগত সময়ে বিভিন্ন ইস্যুতে দলের সিদ্ধান্তহীনতাও পরিলক্ষিত হয়। অভ্যান্তরীণ কোন্দলও দেখা দেয়। ওই সময় দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে ভোট করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। এমন প্রেক্ষাপটে একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে নতুন জোট গঠন করে সামনে আসে বিএনপি। যদিও নতুন জোট গঠন করায় দীর্ঘদিনের সঙ্গী ২০ দলীয় জোটের শরিকরা চরম ক্ষুব্ধ হয়। ক্ষোভে তখনই জোট ছেড়ে চলে যান বাংলাদেশ ন্যাপের চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি। জোটের অন্যদের শরিক দলের সঙ্গেও টানাপোড়েন দেখা দেয় কিন্তু জাতীয় নির্বাচন নিকটবর্তী হওয়ায় তা প্রকাশ্যে আসেনি। এমন নানা অস্থিরতার মধ্যে দুই জোটকে নিয়ে একাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপির ব্যাপক ভরাডুবি হয়।

নির্বাচন-পরবর্তী দুই জোট ও শরিক দলগুলোর সঙ্গে টানাপোড়েনের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। বিশেষ করে একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী সংসদ সদস্যদের শপথ নেয়ার সিদ্ধান্তে টানাপোড়েন এখন নতুন রূপ পায়। মূলত নির্বাচনে চরম ব্যর্থতার পর থেকেই শরিক দলের নেতারা মুখ খুলতে শুরু করে। শরিকদের গুরুত্ব না দেয়ার কারণ দেখিয়ে গত ৬ মে বিজেপি চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ জোট ছেড়ে দেন। এলডিপি চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদসহ আরও কয়েকটি দলের সঙ্গেও টানাপোড়েন দৃশ্যমান। শেষ পর্যন্ত জোট ছেড়ে না দিলেও সম্প্রতি ‘জাতীয় মুক্তি মঞ্চ’ গঠন করছেন ২০ দলীয় জোটের সমন্বয়ক কর্নেল (অব.) অলি আহমদ। তার নতুন জোটকে বিএনপি স্বাগত জানালেও গুঞ্জন রয়েছে। অলি আহমদকে সামনে রেখে যুদ্ধাপরাধীর দল হিসেবে তকমা পাওয়া জামায়াত সক্রিয় হচ্ছে।

এদিকে অলি আহমদ সক্রিয় হওয়ায় চাপে রয়েছে বিএনপি। আর এই চাপ প্রভাব ফেলছে ২০ দলীয় জোটে। জামায়াত ছাড়াও জাগপাসহ ২০ দলীয় জোটের কয়েকটি দল এ জোটে যোগ দিচ্ছে বলে একাদিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। তাদের সম্মতি ও সহযোগিতায় নতুন মঞ্চ গঠনে অলি আহমদ উদ্যোগী হোন বলেও দাবি সূত্রের। এছাড়া বিএনপির দীর্ঘদিনের সঙ্গী জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনের আগে যতটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল নির্বাচনের পর তা অবনতি হওয়ার বিষয়টি দৃশ্যমান। বিশেষ করে একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী সংসদ সদস্যদের শপথ নেয়ার সিদ্ধান্তে বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে বলে একাদিক সূত্র বলছে। বিএনপির দায়িত্বশীল একজন নেতা দাবি করেন, জামায়াত সম্পর্কে তাদের মনোভাবে পরিবর্তন হয়েছে। জামায়াতকে আগের মতো গুরুত্ব দিতে তারা নারাজ। এছাড়া নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কোন কিছুই বিবেচনায় আনতে চায় না বলেও জানান তিনি।

অন্যদিকে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অস্তিত্ব ও কোন কর্মকান্ড নেই দাবি করে সম্প্রতি (৮ জুলাই) ঐক্যফ্রন্ট থেকে বের হয়ে গেছেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। অন্যান্য শরিক দলগুলোর পাশাপাশি ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শরিক গণফোরাম সভাপতি ড. কামালের সঙ্গেও বিএনপির সম্পর্ক দিন দিন শীতল হচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে ড. কামাল হোসেন শারীরিকভাবে অসুস্থ এবং নেতৃত্ব নিয়ে তার নিজেরও আগ্রহ কম বলে জানা গেছে। এছাড়া নাগরিক ঐক্য ও জেএসপির সঙ্গেও বিএনপির সম্পর্কেও স্থবিরতা বিরাজ করছে। হচ্ছে না নিয়মিত জোটের বৈঠকও। এতে জোটের কার্যক্রম নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে জোটের সঙ্গে দূরত্ব কমানোর দৃশ্যমান কোন উদ্যোগ নেই বিএনপির। এসব কারণেই বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।

তবে দুই জোটের শরিকদের মধ্যে দৃশ্যমান দ্বন্দ্ব, অবিশ্বাসে ভাঙন দেখা দিলেও চিন্তিত নয়। এমনটি দলের নেতাদের বক্তব্যেও স্পষ্ট। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে কাদের সিদ্দিকীর বেরিয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক অনুষ্ঠানে বলছিলেন, ‘এই দু-একটা লোক বেরিয়ে যাচ্ছে, আসছে, যাবেই। এটা বরাবরই হচ্ছে, হবেই। সবাই তো আর চিরস্থায়ী হয় না।’ তবে বিএনপির একজন নেতা দাবি করেছেন, তারা ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে আলোচনা করেই ফ্রন্ট গঠন করেন। পরবর্তীতে জোটের শরিকদের মধ্যে মনোমালিন্য হতে পারে। কারও কারও ক্ষোভ থাকতে পারে। তবে সবাই ঐক্যবদ্ধই আছেন।

আবার জোটের নির্ভরতার সম্পর্কে একাধিক বিএনপির নেতারা মনে করেন, পারস্পরিক স্বার্থের ভিত্তিতে রাজনৈতিক জোট গড়ে উঠলেও আবার নানা কারণে তা ভেঙে যাওয়া স্বাভাবিক। এছাড়া জোট শরিক দলগুলোর জনভিত্তি মূলত এক ব্যক্তিনির্ভর। তাদের সমর্থন ছাড়া কারও পক্ষেই এককভাবে জিতে আসা সম্ভব নয়। তবে শরিকদের খাটো করে দেখছেন বলেও তাদের মত। বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, পরনির্ভরতা কমিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আবারও সংগঠনকে চাঙ্গা করার পরিকল্পনা করছেন তারা। জনসমর্থনকে ভিত্তি করে বিএনপি নতুন ধারার রাজনীতির পথে এগোতে চাইছে বলেও জানান দলটির একাধিক নেতা।

এ লক্ষ্যে ইতিমধ্যেই মূল দলকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগের কথা জানিয়েছে বিএনপি। এ জন্য দ্রুত জাতীয় কাউন্সিল করার আগ্রহের কথাও জানানো হয়েছে। ইতিমধ্যেই বিএনপির ছাত্রসংগঠন ছাত্রদলকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এনিয়ে নানা জটিলতা দেখা দিলেও কাউন্সিল প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এছাড়া যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, কৃষক দল, মহিলা দলসহ বিভিন্ন ইউনিট পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এর পাশাপাশি খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে আইনি প্রক্রিয়ার পাশাপাশি তার কারামুক্তির দাবিতে ছোট ছোট কর্মসূচি পালন করছে। খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি ও সাংগঠনিকভাবে দলকে চাঙ্গা করতে বিভাগীয় পর্যায়ে সমাবেশ করছে। ইতিমধ্যে গত বৃহস্পতিবার বরিশালের মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।

সূত্রে আরও জানা গেছে, ২০ জুলাই চট্টগ্রামের পর ২৫ জুলাই খুলনায় সমাবেশ হবে। এরপর ২৯ থেকে ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে যেকোন দিন রাজশাহী বিভাগে সমাবেশ। আগস্টের প্রথম সপ্তাহে সিলেট ও রংপুর বিভাগের সমাবেশ করার পরিকল্পনা নিয়ে আগানো হচ্ছে। সর্বশেষ ঢাকায় সমাবেশ করা হবে। তবে ঢাকার সমাবেশে তারিখ এখনও চূড়ান্ত হয়নি। আগামী বৈঠকে বাকি বিভাগীয় শহরগুলোতে সমাবেশ তারিখ চূড়ান্ত হবে। এক্ষেত্রে ঈদের আগে ঢাকায় সমাবেশ করা না গেলে ঈদের পরের সপ্তাহে করা হবে। এসব বিভাগীয় সমাবেশগুলো নেতাকর্মীদের উপস্থিত বাড়ানোর জন্য সংশ্লিষ্ট নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, লন্ডনে অবস্থানরত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনায় এসব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বিএনপি। তবে খালেদা জিয়ার সঙ্গে পরামর্শ করেই বিএনপিতে সব সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বলে জানিয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গত বুধবার এক অনুষ্ঠানে মির্জা ফখরুল বলেন, খালেদা জিয়ার সঙ্গে আলোচনা ছাড়া আমরা কোন সিদ্ধান্তই নেই না। ২০ দল গঠন করেছি তার পরামর্শে, ঐকফ্রন্ট করেছি তার পরামর্শ নিয়ে। নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্তও নিয়েছি তার পরামর্শে।

রবিবার, ২১ জুলাই ২০১৯ , ৬ শ্রাবন ১৪২৫, ১৭ জিলকদ ১৪৪০

বিএনপি কি একা হয়ে যাচ্ছে?

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

একাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) দুই জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের কার্যক্রম কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছে। এমন অবস্থায় শরিক দলগুলোর মধ্যে বিরাজ করছে অস্থিরতা। দুই জোটের শরিকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, অবিশ্বাস ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। ইতিমধ্যেই উভয় জোটের শরিক দলগুলোর মধ্যে টানাপোড়েনে ভাঙন দেখা দিয়েছে। জোটের অস্তিত্ব নেইÑ এমন অভিযোগ করে সম্প্রতি ঐক্যফ্রন্ট ছেড়ে দিয়েছেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। এর আগেই ২০ দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে গেছেন বিজেপি চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ। এখনও যারা জোটে টিকে রয়েছে তারাও নিজেদের মতো করে কার্যক্রম পরিচালনা করার চেষ্টা করছে। কেউ কেউ নতুন ফোরাম গঠন করে পৃথক অবস্থান তৈরি করারও চেষ্টা চালাচ্ছে। জোটের অনিশ্চয়তায় আবার কোন কোন শরিক দল জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চিন্তাভাবনাও করছে। এমন প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠছে, বিএনপি কি একা হয়ে যাচ্ছে? তবে দুই জোট ও শরিক দলগুলোর সঙ্গে টানাপোড়েনে ভাঙন দেখা দিলেও বিএনপি চিন্তিত নয় বলে দায়িত্বশীল নেতারা দাবি করেছেন।

ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটে আর আগ্রহ নেই দলটির। উভয় জোটের কার্যক্রম থেকে ক্রমেই গুটিয়ে নিচ্ছে বিএনপি। দীর্ঘদিন ধরে জোটের কোন বৈঠকও হচ্ছে না। দলের নেতাকর্মীদের বড় একটি অংশ চান, জোট থেকে বেরিয়ে বিএনপিকে এককভাবে কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকতে। বিগত সময়ে জোটভিত্তিক রাজনীতিতে সুফল না পাওয়ায় নেতাকর্মীরা জোটের নির্ভরতা কমাতে চায় বলেও বিএনপির দায়িত্বশীল একটি সূত্রের দাবি। তবে দুই জোটকেই নতুনভাবে গড়ার চিন্তাভাবনা চলছে বলেও অপর একটি সূত্রের দাবি। সূত্রটি বলছে, এক্ষেত্রে জোট দুটির নেতৃত্বের কাঠামোতে পরিবর্তন আনা হবে। বিএনপির সূত্রগুলো বলছে, বিগত দিনের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজ শক্তিতে আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষ্যেই এগোতে চায় দলটি। এক্ষেত্রে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে কারামুক্ত করা এবং মূল দলসহ অন্যান্য অঙ্গসংগঠনগুলো পুনর্গঠন করে সাংগঠনিক কার্যক্রম চাঙ্গা করাই তাদের এখন মূল লক্ষ্য। তবে আপাতত বড় কোন আন্দোলন কর্মসূচিতে যেতে চায় না বিএনপি। যদিও খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে আইনি প্রক্রিয়ার পাশাপাশি ছোট ছোট কর্মসূচি দিয়েই সামনে থাকতে চায় দলটি। বিএনপির নেতাদের মতে, জনসমর্থনের ভিত্তিতে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে টক্কর দিতে পারে একমাত্র তারাই। তৃণমূলে তাদের বিপুল সমর্থক, নেতাকর্মী রয়েছেন কিন্তু সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে সেটি সম্ভব হচ্ছে না। আবার জোটভিত্তিক রাজনীতির গুরুত্ব দিয়েও লাভ হয়নি। তাই আপাতত সাংঠনিক কার্যক্রম গতিশীল করাই তাদের প্রধান লক্ষ্য। এক্ষেত্রে পরীক্ষিত নেতাদের দায়িত্বে এনে বিএনপি সংগঠনকে চাঙ্গা করার পরিকল্পনায় গুরুত্ব দেয়া দিচ্ছে। এর পাশাপাশি ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, কৃষক দল, মহিলা দলসহ বিভিন্ন ইউনিটে আমূল পরিবর্তনের উদ্যোগ নিচ্ছে। এ জন্য নানা জটিলতা দেখা দিলেও সময়ের সঙ্গে মিটে যাবে বলেও প্রত্যাশা করছে বিএনপির হাইকমান্ড।

দুর্নীতি মামলায় দন্ড নিয়ে দেড় বছর ধরে কারাবন্দী হয়ে রয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। দলের চেয়ারপারসন কারাগারে যাওয়ার পর বিএনপির ‘চেইন অব কমান্ড’ অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়ে। লন্ডনে অবস্থানরত দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হলেও তার সিদ্ধান্তে জটিলতা দেখা দেয়। দেখা দেয় সাংগঠনিক স্থবিরতা। বিগত সময়ে বিভিন্ন ইস্যুতে দলের সিদ্ধান্তহীনতাও পরিলক্ষিত হয়। অভ্যান্তরীণ কোন্দলও দেখা দেয়। ওই সময় দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে ভোট করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। এমন প্রেক্ষাপটে একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে নতুন জোট গঠন করে সামনে আসে বিএনপি। যদিও নতুন জোট গঠন করায় দীর্ঘদিনের সঙ্গী ২০ দলীয় জোটের শরিকরা চরম ক্ষুব্ধ হয়। ক্ষোভে তখনই জোট ছেড়ে চলে যান বাংলাদেশ ন্যাপের চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি। জোটের অন্যদের শরিক দলের সঙ্গেও টানাপোড়েন দেখা দেয় কিন্তু জাতীয় নির্বাচন নিকটবর্তী হওয়ায় তা প্রকাশ্যে আসেনি। এমন নানা অস্থিরতার মধ্যে দুই জোটকে নিয়ে একাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপির ব্যাপক ভরাডুবি হয়।

নির্বাচন-পরবর্তী দুই জোট ও শরিক দলগুলোর সঙ্গে টানাপোড়েনের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। বিশেষ করে একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী সংসদ সদস্যদের শপথ নেয়ার সিদ্ধান্তে টানাপোড়েন এখন নতুন রূপ পায়। মূলত নির্বাচনে চরম ব্যর্থতার পর থেকেই শরিক দলের নেতারা মুখ খুলতে শুরু করে। শরিকদের গুরুত্ব না দেয়ার কারণ দেখিয়ে গত ৬ মে বিজেপি চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ জোট ছেড়ে দেন। এলডিপি চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদসহ আরও কয়েকটি দলের সঙ্গেও টানাপোড়েন দৃশ্যমান। শেষ পর্যন্ত জোট ছেড়ে না দিলেও সম্প্রতি ‘জাতীয় মুক্তি মঞ্চ’ গঠন করছেন ২০ দলীয় জোটের সমন্বয়ক কর্নেল (অব.) অলি আহমদ। তার নতুন জোটকে বিএনপি স্বাগত জানালেও গুঞ্জন রয়েছে। অলি আহমদকে সামনে রেখে যুদ্ধাপরাধীর দল হিসেবে তকমা পাওয়া জামায়াত সক্রিয় হচ্ছে।

এদিকে অলি আহমদ সক্রিয় হওয়ায় চাপে রয়েছে বিএনপি। আর এই চাপ প্রভাব ফেলছে ২০ দলীয় জোটে। জামায়াত ছাড়াও জাগপাসহ ২০ দলীয় জোটের কয়েকটি দল এ জোটে যোগ দিচ্ছে বলে একাদিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। তাদের সম্মতি ও সহযোগিতায় নতুন মঞ্চ গঠনে অলি আহমদ উদ্যোগী হোন বলেও দাবি সূত্রের। এছাড়া বিএনপির দীর্ঘদিনের সঙ্গী জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনের আগে যতটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল নির্বাচনের পর তা অবনতি হওয়ার বিষয়টি দৃশ্যমান। বিশেষ করে একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী সংসদ সদস্যদের শপথ নেয়ার সিদ্ধান্তে বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে বলে একাদিক সূত্র বলছে। বিএনপির দায়িত্বশীল একজন নেতা দাবি করেন, জামায়াত সম্পর্কে তাদের মনোভাবে পরিবর্তন হয়েছে। জামায়াতকে আগের মতো গুরুত্ব দিতে তারা নারাজ। এছাড়া নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কোন কিছুই বিবেচনায় আনতে চায় না বলেও জানান তিনি।

অন্যদিকে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অস্তিত্ব ও কোন কর্মকান্ড নেই দাবি করে সম্প্রতি (৮ জুলাই) ঐক্যফ্রন্ট থেকে বের হয়ে গেছেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। অন্যান্য শরিক দলগুলোর পাশাপাশি ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শরিক গণফোরাম সভাপতি ড. কামালের সঙ্গেও বিএনপির সম্পর্ক দিন দিন শীতল হচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে ড. কামাল হোসেন শারীরিকভাবে অসুস্থ এবং নেতৃত্ব নিয়ে তার নিজেরও আগ্রহ কম বলে জানা গেছে। এছাড়া নাগরিক ঐক্য ও জেএসপির সঙ্গেও বিএনপির সম্পর্কেও স্থবিরতা বিরাজ করছে। হচ্ছে না নিয়মিত জোটের বৈঠকও। এতে জোটের কার্যক্রম নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে জোটের সঙ্গে দূরত্ব কমানোর দৃশ্যমান কোন উদ্যোগ নেই বিএনপির। এসব কারণেই বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।

তবে দুই জোটের শরিকদের মধ্যে দৃশ্যমান দ্বন্দ্ব, অবিশ্বাসে ভাঙন দেখা দিলেও চিন্তিত নয়। এমনটি দলের নেতাদের বক্তব্যেও স্পষ্ট। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে কাদের সিদ্দিকীর বেরিয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক অনুষ্ঠানে বলছিলেন, ‘এই দু-একটা লোক বেরিয়ে যাচ্ছে, আসছে, যাবেই। এটা বরাবরই হচ্ছে, হবেই। সবাই তো আর চিরস্থায়ী হয় না।’ তবে বিএনপির একজন নেতা দাবি করেছেন, তারা ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে আলোচনা করেই ফ্রন্ট গঠন করেন। পরবর্তীতে জোটের শরিকদের মধ্যে মনোমালিন্য হতে পারে। কারও কারও ক্ষোভ থাকতে পারে। তবে সবাই ঐক্যবদ্ধই আছেন।

আবার জোটের নির্ভরতার সম্পর্কে একাধিক বিএনপির নেতারা মনে করেন, পারস্পরিক স্বার্থের ভিত্তিতে রাজনৈতিক জোট গড়ে উঠলেও আবার নানা কারণে তা ভেঙে যাওয়া স্বাভাবিক। এছাড়া জোট শরিক দলগুলোর জনভিত্তি মূলত এক ব্যক্তিনির্ভর। তাদের সমর্থন ছাড়া কারও পক্ষেই এককভাবে জিতে আসা সম্ভব নয়। তবে শরিকদের খাটো করে দেখছেন বলেও তাদের মত। বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, পরনির্ভরতা কমিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আবারও সংগঠনকে চাঙ্গা করার পরিকল্পনা করছেন তারা। জনসমর্থনকে ভিত্তি করে বিএনপি নতুন ধারার রাজনীতির পথে এগোতে চাইছে বলেও জানান দলটির একাধিক নেতা।

এ লক্ষ্যে ইতিমধ্যেই মূল দলকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগের কথা জানিয়েছে বিএনপি। এ জন্য দ্রুত জাতীয় কাউন্সিল করার আগ্রহের কথাও জানানো হয়েছে। ইতিমধ্যেই বিএনপির ছাত্রসংগঠন ছাত্রদলকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এনিয়ে নানা জটিলতা দেখা দিলেও কাউন্সিল প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এছাড়া যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, কৃষক দল, মহিলা দলসহ বিভিন্ন ইউনিট পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এর পাশাপাশি খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে আইনি প্রক্রিয়ার পাশাপাশি তার কারামুক্তির দাবিতে ছোট ছোট কর্মসূচি পালন করছে। খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি ও সাংগঠনিকভাবে দলকে চাঙ্গা করতে বিভাগীয় পর্যায়ে সমাবেশ করছে। ইতিমধ্যে গত বৃহস্পতিবার বরিশালের মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।

সূত্রে আরও জানা গেছে, ২০ জুলাই চট্টগ্রামের পর ২৫ জুলাই খুলনায় সমাবেশ হবে। এরপর ২৯ থেকে ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে যেকোন দিন রাজশাহী বিভাগে সমাবেশ। আগস্টের প্রথম সপ্তাহে সিলেট ও রংপুর বিভাগের সমাবেশ করার পরিকল্পনা নিয়ে আগানো হচ্ছে। সর্বশেষ ঢাকায় সমাবেশ করা হবে। তবে ঢাকার সমাবেশে তারিখ এখনও চূড়ান্ত হয়নি। আগামী বৈঠকে বাকি বিভাগীয় শহরগুলোতে সমাবেশ তারিখ চূড়ান্ত হবে। এক্ষেত্রে ঈদের আগে ঢাকায় সমাবেশ করা না গেলে ঈদের পরের সপ্তাহে করা হবে। এসব বিভাগীয় সমাবেশগুলো নেতাকর্মীদের উপস্থিত বাড়ানোর জন্য সংশ্লিষ্ট নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, লন্ডনে অবস্থানরত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনায় এসব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বিএনপি। তবে খালেদা জিয়ার সঙ্গে পরামর্শ করেই বিএনপিতে সব সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বলে জানিয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গত বুধবার এক অনুষ্ঠানে মির্জা ফখরুল বলেন, খালেদা জিয়ার সঙ্গে আলোচনা ছাড়া আমরা কোন সিদ্ধান্তই নেই না। ২০ দল গঠন করেছি তার পরামর্শে, ঐকফ্রন্ট করেছি তার পরামর্শ নিয়ে। নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্তও নিয়েছি তার পরামর্শে।