ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহত ৩

ছেলেধরা সন্দেহে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় গণপিটুনিতে ৩ জন প্রাণ হারিয়েছে। আহত হয়েছে কয়েকজন। নিহতদের মধ্যে ঢাকার উত্তর বাড্ডায় এক নারীকে পিটিয়ে হত্যা করেছে বিক্ষুব্ধ জনতা। এছাড়া না’গঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ও কেরানীগঞ্জে গণপিটুনিতে আরও ২ জন প্রাণহারান। আমাদের নিজস্ব বার্তা পরিবেশক ও স্থানীয় প্রতিনিধির পাঠানো খবরে এ তথ্য জানা গেছে।

রাজধানীর উত্তর বাড্ডায় ছেলেধরা সন্দেহে এক নারীকে পিটিয়ে হত্যা করেছে বিক্ষুব্ধ জনতা। গতকাল সকাল পৌনে ৯টার দিকে উত্তর বাড্ডা কাঁচাবাজারের সড়কে এ ঘটনা ঘটে। প্রাথমিকভাবে তার নাম পরিচয় জানা যায়নি। গুরুতর আহত অবস্থায় ওই নারীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পাঠানো হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

বাড্ডা থানার ওসি রফিকুল ইসলাম জানান, ছেলেধরা সন্দেহে এক নারী গণপিটুনির শিকার হয়েছেন। খবর পাওয়ার পর পুলিশ তাকে উদ্ধার করে গুরুতর আহত অবস্থায় ঢামেক হাসপাতালে পাঠায়। তার পরিচয় জানা যায়নি। স্থানীয়দের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, উত্তর বাড্ডায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি মাদ্রাসা পাশাপাশি। সেখানে শনিবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে তিনজন বোরকা পরা নারী যান। তারা স্কুলের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেন। বাধার মুখে দুইজন পালিয়ে গেলেও এই নারী গণপিটুনির শিকার হন। তবে বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে।

এদিকে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) মো. সোহেল রানা জানান, পদ্মা সেতু নির্মাণে মানুষের মাথা লাগবে বলে একটি গুজব ছড়ানোকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে মর্মান্তিকভাবে কয়েকজনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। গুজব ছড়িয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করা রাষ্ট্রবিরোধী কাজের শামিল এবং গণপিটুনি দিয়ে মৃত্যু ঘটানো ফৌজদারি অপরাধ। ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনির শিকার হয়ে এ পর্যন্ত যতগুলো নিহতের ঘটনা ঘটেছে পুলিশ প্রত্যেকটি ঘটনা আমলে নিয়ে তদন্তে নেমেছে। এসব ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। গুজবে বিভ্রান্ত হয়ে ছেলেধরা সন্দেহে কাউকে গণপিটুনি দিয়ে আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়ার জন্য সকলের প্রতি অনুরোধ জানানো হচ্ছে। গুজব ছড়ানো এবং গুজবে কান দেয়া থেকে বিরত থাকুন। কাউকে ছেলেধরা সন্দেহ হলে গণপিটুনি না দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিন।

সিদ্ধিরগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, সিদ্ধিরগঞ্জে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে অজ্ঞাত (১৮) যুবক নিহত হয়েছে। গুরুতর আহত হয়েছে রেশমা (৩৫) নামে এক নারী। গতকাল সকাল ৯টায় মিজমিজি পূর্বপাড়া পাগলাবাড়ি রোড এলাকায়ও একই দিন সকাল ১১টায় আধা কিলোমিটার দূরত্বে পাইনাদী শাপলা চত্বর এলাকায় এ ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ নিহত যুবককে উদ্ধার করে নারায়ণগঞ্জ হাসপাতালে ও আহত অবস্থায় মহিলাকে উদ্ধার করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে গেছে।

জানা যায়, সিদ্ধিরগঞ্জের পাগলাবাড়ি রোড এলাকায় সকাল ৯টার দিকে ৫/৬ বছরের এক মেয়ে শিশুর হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছিল এক যুবক। এ সময় শিশুটি কান্নাকাটি শুরু করলে স্থানীয় দুই যুবকের সন্দেহ হয়। তারা ওই যুবককে জিজ্ঞাসাবাদ করলে যুবকটি কোন সদুত্তর দিতে না পারায় ছেলেধরা সন্দেহ হয়। এ সময় স্থানীয়রা জড়ো হয়ে তাকে গণপিটুনি দিতে থাকে। খবর পেয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা পুলিশ তাকে উদ্ধার করে নারায়ণগঞ্জ হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

সিদ্ধিরগঞ্জ থানার এসআই সাখাওয়াত জানায়, ছেলেধরা সন্দেহে স্থানীয়রা গণপিটুনি দিলে অজ্ঞাত যুবক মারাত্মক আহত হয়। তাকে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। তার পরিচয় এখনও জানা যায়নি।

অপরদিকে সকাল ১১টায় পাইনাদী শাপলা চত্বর এলাকায় রেশমা (৩৫) নামে এক মহিলা খেলনা ও খাবার দিয়ে এক শিশুকে নিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় এলাকাবাসীর সন্দেহ হলে তারা শিশুটি কার জিজ্ঞেস করলে তিনি কোন সদুত্তর দিতে না পারলে এলাকাবাসী তাকে গণপিটুনি দিয়ে আটকে রেখে পুলিশে খবর দেয়। সিদ্ধিরগঞ্জ থানার এসআই শহিদুল ইসলাম ঘটনাস্থল থেকে তাকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে বলে সাংবাদিকদের জানায়।

একই এলাকায় ২ ঘণ্টার ব্যবধানে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনির ঘটনায় অভিভাবকদের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। গত কয়েকদিন ধরে সিদ্ধিরগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় ছেলেধরার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। শনিবারের ঘটনায় তা সত্য প্রমাণিত হয়।

কেরানীগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, কেরানীগঞ্জে শিশুচোর সন্দেহে অজ্ঞাতপরিচয় ২ যুবককে গণপিটুনি দিয়েছে এলাকাবাসী। এতে ১ জন নিহত হয়েছে অন্যজনকে গুরুতর আহত অবস্থায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স মালঞ্চ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। গতকাল সকালে কেরানীগঞ্জ মডেল থানাধীন হযরতপুর ইউনিয়নের রসুলপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটেছে।

স্থানীয়রা জানান, সকালে ঐ দুই যুবক গ্রামের মধ্যে ঘোরাঘুরি করতে থাকে এবং শিশুদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে। এতে তাদের সন্দেহ হলে এলাকাবাসী ধরে গণপিটুনি দেয়। পরে পুলিশ ঘটনাস্থালে এসে তাদের উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স মালঞ্চ হাসপাতালে নিয়ে গেলে একজনকে সেখানে ভর্তি করা হয় অন্যজনকে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক ঐ যুবককে মৃত ঘোষণা করে। কেরানীগঞ্জ মডেল থানার কলাতিয়া পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক (এসআই) চুন্নু মিয়া জানান, নিহত যুবকের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কিলঘুষির জখম রয়েছে। তার মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। আহত যুবকের অবস্থাও আশঙ্কাজনক বলে জানান তিনি।

গাজীপুর প্রতিনিধি জানান, গাজীপুরে ছেলেধরা সন্দেহে এক নারীকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেছে এলাকাবাসী। শনিবার সকালে নগরীর চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। আহত মমতাজ খাতুন (৪৫) নেত্রকোনার দুর্গাপুর এলাকার আবদুল আলীমের স্ত্রী।

গাজীপুর মেট্রোপলিটন বাসন থানার ওসি একেএম কাউসার জানান, শনিবার সকাল সাড়ে সাতটার দিকে চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় রাস্তায় ওই নারীকে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাঘুরি করতে দেখে। এক পর্যায়ে রাস্তার পাশে ওই নারী এক দম্পতির শিশুকে আদর করতে গেলে তারা তাকে আটক করে। পরে স্থানীয়রা তাকে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করে। গুরুত্বর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ মমতাজ খাতুনকে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ধারণা করা হচ্ছে গণপিটুনির শিকার ওই নারী মানসিক ভারসাম্যহীন।

হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক প্রণয় ভূষন দাস জানান, গণপিটুনির শিকার ওই নারীর শরীরে নীলাফুলা জখম রয়েছে। তবে তিনি শঙ্কামুক্ত।

ভালুকা (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি জানান, গতকাল দুপুরে ভালুকা উপজেলার ধামশুর গ্রামে ছেলেধরা সন্দেহে মালেকা খাতুন (৩৫) নামে এক মহিলাকে গণপিটুনিতে আহত করেছে স্থানীয় জনতা। পরে খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে তাকে উদ্ধার করে ভালুকা উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি করেন। জানা যায় ওই মহিলা ভালুকা উপজেলার উথুরা ইউনিয়নের পাঁচগাঁও গ্রামের শাহ আলমের স্ত্রী। সে স্থানীয় একটি কারখানায় গৃহপরিচারিকার কাজ করেন। আহত মালেকা জানান, শনিবার সকালে শারীরিক অসুস্থতা অনুভব করায় সে কর্মস্থল থেকে ছুটি নিয়ে ভালুকায় হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার জন্য রওনা হন। কিছু দূর আসার পর ক্লান্তবোধ করায় স্থানীয় একটি স্কুলের সামনে বসে বিশ্রাম নেয়ার সময় তার সঙ্গে থাকা বাজারের ব্যাগ দেখে তার কোন কথা না শুনেই স্থানীয়রা ছেলেধরা সন্দেহে মারপিট শুরু করে। এক পর্যায়ে তাকে গাছের সঙ্গে বেঁধে ফেলে। এ সময় এলাকার বহু সংখ্যক নারী পুরুষ ঘটনাস্থলে জমায়েত হয়। ভালুকা মডেল থানা সূত্রে জানা যায়, বেলা ১২টার দিকে ভালুকার ধামশুর গ্রামে ছেলেধরা সন্দেহে ১ নারীকে গণধোলাই দেয়ার খবর পেয়ে তারা ঘটনাস্থল হতে আহত অবস্থায় মালেকা (৩৫) নামের ওই মহিলাকে উদ্ধার করে ভালুকা উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি করেন। এ খবর চারপাশে ছড়িয়ে পড়লে উৎসুুক জনতা উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভিড় জমায়। ওই মহিলা হাসপাতালে পুলিশের হেফাজতে রয়েছে।

লাকসাম প্রতিনিধি জানান, লাকসামে ছেলেধরা সন্দেহে এক ভিক্ষুককে গণপিটুনি দেয়া হয়েছে। এতে ওই ভিক্ষুকের পা ভেঙে যায়। গুরুতর আহতাবস্থায় তাকে উদ্ধার করে লাকসাম সদর হাসপাতালে ভর্তি করেছে পুলিশ। গতকাল সকালে পৌরশহরের পেয়ারাপুর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

জানা গেছে, ওইদিন সকাল সাড়ে ৯টায় পেয়ারাপুর এলাকায় একটি বেগ হাতে নিয়ে বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করছিল রফিকুল ইসলাম (৪৩) নামে ওই ভিক্ষুক। ভিক্ষা শেষে জেলেপাড়া সংলগ্ন চা দোকানের কাছে ঘোরাফেরা করছিল। এ সময় স্থানীয় লোকজন ছেলেধরা সন্দেহে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে অসংলগ্ন কথা বলায় গণপিটুনি দেয়। এতে তার ডান পা ভেঙে যায়। পরে খবর পেয়ে লাকসাম থানার এসআই রফিকুল ইসলাম তাকে উদ্ধার করে সদর হাসপাতালে ভর্তি করে। আহত রফিকুল ইসলাম মনোহরগঞ্জ উপজেলার নাথেরপেটুয়া ইউনিয়নের বিনয়ঘর গ্রামের ইয়াছিন মিয়ার ছেলে।

লাকসাম থানার ওসি নিজাম উদ্দিন ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, তার বাড়িতে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি সে কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন।

রবিবার, ২১ জুলাই ২০১৯ , ৬ শ্রাবন ১৪২৫, ১৭ জিলকদ ১৪৪০

পৃথক ঘটনায়

ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহত ৩

সংবাদ ডেস্ক

ছেলেধরা সন্দেহে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় গণপিটুনিতে ৩ জন প্রাণ হারিয়েছে। আহত হয়েছে কয়েকজন। নিহতদের মধ্যে ঢাকার উত্তর বাড্ডায় এক নারীকে পিটিয়ে হত্যা করেছে বিক্ষুব্ধ জনতা। এছাড়া না’গঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ও কেরানীগঞ্জে গণপিটুনিতে আরও ২ জন প্রাণহারান। আমাদের নিজস্ব বার্তা পরিবেশক ও স্থানীয় প্রতিনিধির পাঠানো খবরে এ তথ্য জানা গেছে।

রাজধানীর উত্তর বাড্ডায় ছেলেধরা সন্দেহে এক নারীকে পিটিয়ে হত্যা করেছে বিক্ষুব্ধ জনতা। গতকাল সকাল পৌনে ৯টার দিকে উত্তর বাড্ডা কাঁচাবাজারের সড়কে এ ঘটনা ঘটে। প্রাথমিকভাবে তার নাম পরিচয় জানা যায়নি। গুরুতর আহত অবস্থায় ওই নারীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পাঠানো হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

বাড্ডা থানার ওসি রফিকুল ইসলাম জানান, ছেলেধরা সন্দেহে এক নারী গণপিটুনির শিকার হয়েছেন। খবর পাওয়ার পর পুলিশ তাকে উদ্ধার করে গুরুতর আহত অবস্থায় ঢামেক হাসপাতালে পাঠায়। তার পরিচয় জানা যায়নি। স্থানীয়দের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, উত্তর বাড্ডায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি মাদ্রাসা পাশাপাশি। সেখানে শনিবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে তিনজন বোরকা পরা নারী যান। তারা স্কুলের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেন। বাধার মুখে দুইজন পালিয়ে গেলেও এই নারী গণপিটুনির শিকার হন। তবে বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে।

এদিকে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) মো. সোহেল রানা জানান, পদ্মা সেতু নির্মাণে মানুষের মাথা লাগবে বলে একটি গুজব ছড়ানোকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে মর্মান্তিকভাবে কয়েকজনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। গুজব ছড়িয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করা রাষ্ট্রবিরোধী কাজের শামিল এবং গণপিটুনি দিয়ে মৃত্যু ঘটানো ফৌজদারি অপরাধ। ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনির শিকার হয়ে এ পর্যন্ত যতগুলো নিহতের ঘটনা ঘটেছে পুলিশ প্রত্যেকটি ঘটনা আমলে নিয়ে তদন্তে নেমেছে। এসব ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। গুজবে বিভ্রান্ত হয়ে ছেলেধরা সন্দেহে কাউকে গণপিটুনি দিয়ে আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়ার জন্য সকলের প্রতি অনুরোধ জানানো হচ্ছে। গুজব ছড়ানো এবং গুজবে কান দেয়া থেকে বিরত থাকুন। কাউকে ছেলেধরা সন্দেহ হলে গণপিটুনি না দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিন।

সিদ্ধিরগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, সিদ্ধিরগঞ্জে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে অজ্ঞাত (১৮) যুবক নিহত হয়েছে। গুরুতর আহত হয়েছে রেশমা (৩৫) নামে এক নারী। গতকাল সকাল ৯টায় মিজমিজি পূর্বপাড়া পাগলাবাড়ি রোড এলাকায়ও একই দিন সকাল ১১টায় আধা কিলোমিটার দূরত্বে পাইনাদী শাপলা চত্বর এলাকায় এ ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ নিহত যুবককে উদ্ধার করে নারায়ণগঞ্জ হাসপাতালে ও আহত অবস্থায় মহিলাকে উদ্ধার করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে গেছে।

জানা যায়, সিদ্ধিরগঞ্জের পাগলাবাড়ি রোড এলাকায় সকাল ৯টার দিকে ৫/৬ বছরের এক মেয়ে শিশুর হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছিল এক যুবক। এ সময় শিশুটি কান্নাকাটি শুরু করলে স্থানীয় দুই যুবকের সন্দেহ হয়। তারা ওই যুবককে জিজ্ঞাসাবাদ করলে যুবকটি কোন সদুত্তর দিতে না পারায় ছেলেধরা সন্দেহ হয়। এ সময় স্থানীয়রা জড়ো হয়ে তাকে গণপিটুনি দিতে থাকে। খবর পেয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা পুলিশ তাকে উদ্ধার করে নারায়ণগঞ্জ হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

সিদ্ধিরগঞ্জ থানার এসআই সাখাওয়াত জানায়, ছেলেধরা সন্দেহে স্থানীয়রা গণপিটুনি দিলে অজ্ঞাত যুবক মারাত্মক আহত হয়। তাকে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। তার পরিচয় এখনও জানা যায়নি।

অপরদিকে সকাল ১১টায় পাইনাদী শাপলা চত্বর এলাকায় রেশমা (৩৫) নামে এক মহিলা খেলনা ও খাবার দিয়ে এক শিশুকে নিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় এলাকাবাসীর সন্দেহ হলে তারা শিশুটি কার জিজ্ঞেস করলে তিনি কোন সদুত্তর দিতে না পারলে এলাকাবাসী তাকে গণপিটুনি দিয়ে আটকে রেখে পুলিশে খবর দেয়। সিদ্ধিরগঞ্জ থানার এসআই শহিদুল ইসলাম ঘটনাস্থল থেকে তাকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে বলে সাংবাদিকদের জানায়।

একই এলাকায় ২ ঘণ্টার ব্যবধানে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনির ঘটনায় অভিভাবকদের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। গত কয়েকদিন ধরে সিদ্ধিরগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় ছেলেধরার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। শনিবারের ঘটনায় তা সত্য প্রমাণিত হয়।

কেরানীগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, কেরানীগঞ্জে শিশুচোর সন্দেহে অজ্ঞাতপরিচয় ২ যুবককে গণপিটুনি দিয়েছে এলাকাবাসী। এতে ১ জন নিহত হয়েছে অন্যজনকে গুরুতর আহত অবস্থায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স মালঞ্চ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। গতকাল সকালে কেরানীগঞ্জ মডেল থানাধীন হযরতপুর ইউনিয়নের রসুলপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটেছে।

স্থানীয়রা জানান, সকালে ঐ দুই যুবক গ্রামের মধ্যে ঘোরাঘুরি করতে থাকে এবং শিশুদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে। এতে তাদের সন্দেহ হলে এলাকাবাসী ধরে গণপিটুনি দেয়। পরে পুলিশ ঘটনাস্থালে এসে তাদের উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স মালঞ্চ হাসপাতালে নিয়ে গেলে একজনকে সেখানে ভর্তি করা হয় অন্যজনকে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক ঐ যুবককে মৃত ঘোষণা করে। কেরানীগঞ্জ মডেল থানার কলাতিয়া পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক (এসআই) চুন্নু মিয়া জানান, নিহত যুবকের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কিলঘুষির জখম রয়েছে। তার মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। আহত যুবকের অবস্থাও আশঙ্কাজনক বলে জানান তিনি।

গাজীপুর প্রতিনিধি জানান, গাজীপুরে ছেলেধরা সন্দেহে এক নারীকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেছে এলাকাবাসী। শনিবার সকালে নগরীর চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। আহত মমতাজ খাতুন (৪৫) নেত্রকোনার দুর্গাপুর এলাকার আবদুল আলীমের স্ত্রী।

গাজীপুর মেট্রোপলিটন বাসন থানার ওসি একেএম কাউসার জানান, শনিবার সকাল সাড়ে সাতটার দিকে চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় রাস্তায় ওই নারীকে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাঘুরি করতে দেখে। এক পর্যায়ে রাস্তার পাশে ওই নারী এক দম্পতির শিশুকে আদর করতে গেলে তারা তাকে আটক করে। পরে স্থানীয়রা তাকে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করে। গুরুত্বর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ মমতাজ খাতুনকে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ধারণা করা হচ্ছে গণপিটুনির শিকার ওই নারী মানসিক ভারসাম্যহীন।

হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক প্রণয় ভূষন দাস জানান, গণপিটুনির শিকার ওই নারীর শরীরে নীলাফুলা জখম রয়েছে। তবে তিনি শঙ্কামুক্ত।

ভালুকা (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি জানান, গতকাল দুপুরে ভালুকা উপজেলার ধামশুর গ্রামে ছেলেধরা সন্দেহে মালেকা খাতুন (৩৫) নামে এক মহিলাকে গণপিটুনিতে আহত করেছে স্থানীয় জনতা। পরে খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে তাকে উদ্ধার করে ভালুকা উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি করেন। জানা যায় ওই মহিলা ভালুকা উপজেলার উথুরা ইউনিয়নের পাঁচগাঁও গ্রামের শাহ আলমের স্ত্রী। সে স্থানীয় একটি কারখানায় গৃহপরিচারিকার কাজ করেন। আহত মালেকা জানান, শনিবার সকালে শারীরিক অসুস্থতা অনুভব করায় সে কর্মস্থল থেকে ছুটি নিয়ে ভালুকায় হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার জন্য রওনা হন। কিছু দূর আসার পর ক্লান্তবোধ করায় স্থানীয় একটি স্কুলের সামনে বসে বিশ্রাম নেয়ার সময় তার সঙ্গে থাকা বাজারের ব্যাগ দেখে তার কোন কথা না শুনেই স্থানীয়রা ছেলেধরা সন্দেহে মারপিট শুরু করে। এক পর্যায়ে তাকে গাছের সঙ্গে বেঁধে ফেলে। এ সময় এলাকার বহু সংখ্যক নারী পুরুষ ঘটনাস্থলে জমায়েত হয়। ভালুকা মডেল থানা সূত্রে জানা যায়, বেলা ১২টার দিকে ভালুকার ধামশুর গ্রামে ছেলেধরা সন্দেহে ১ নারীকে গণধোলাই দেয়ার খবর পেয়ে তারা ঘটনাস্থল হতে আহত অবস্থায় মালেকা (৩৫) নামের ওই মহিলাকে উদ্ধার করে ভালুকা উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি করেন। এ খবর চারপাশে ছড়িয়ে পড়লে উৎসুুক জনতা উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভিড় জমায়। ওই মহিলা হাসপাতালে পুলিশের হেফাজতে রয়েছে।

লাকসাম প্রতিনিধি জানান, লাকসামে ছেলেধরা সন্দেহে এক ভিক্ষুককে গণপিটুনি দেয়া হয়েছে। এতে ওই ভিক্ষুকের পা ভেঙে যায়। গুরুতর আহতাবস্থায় তাকে উদ্ধার করে লাকসাম সদর হাসপাতালে ভর্তি করেছে পুলিশ। গতকাল সকালে পৌরশহরের পেয়ারাপুর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

জানা গেছে, ওইদিন সকাল সাড়ে ৯টায় পেয়ারাপুর এলাকায় একটি বেগ হাতে নিয়ে বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করছিল রফিকুল ইসলাম (৪৩) নামে ওই ভিক্ষুক। ভিক্ষা শেষে জেলেপাড়া সংলগ্ন চা দোকানের কাছে ঘোরাফেরা করছিল। এ সময় স্থানীয় লোকজন ছেলেধরা সন্দেহে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে অসংলগ্ন কথা বলায় গণপিটুনি দেয়। এতে তার ডান পা ভেঙে যায়। পরে খবর পেয়ে লাকসাম থানার এসআই রফিকুল ইসলাম তাকে উদ্ধার করে সদর হাসপাতালে ভর্তি করে। আহত রফিকুল ইসলাম মনোহরগঞ্জ উপজেলার নাথেরপেটুয়া ইউনিয়নের বিনয়ঘর গ্রামের ইয়াছিন মিয়ার ছেলে।

লাকসাম থানার ওসি নিজাম উদ্দিন ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, তার বাড়িতে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি সে কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন।