প্রিয়া সাহার বক্তব্যে দেশব্যাপী তোলপাড়

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে প্রিয়া সাহার দেয়া বক্তব্যে বিভিন্ন মহলে প্রতিক্রিয়া হয়েছে। তার শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ হয়েছে দেশের বিভিন্ন জায়গায়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন প্রিয়া সাহার অভিযোগ একেবারেই মিথ্যা, বিশেষ মতলবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে উল্লেখ করেছেন। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রিয়া সাহার বক্তব্যকে অসত্য উদ্দেশ্যমূলক এবং দেশদ্রোহী হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেই হবে এবং সেই প্রক্রিয়া চলছে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত যুক্তরাষ্ট্রে সপরিবারে নাগরিকত্ব পেতেই এই ধরনের দেশবিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন তিনি। বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্যপরিষদের সভাপতি রানা দাশগুপ্ত বলেছেন, প্রিয়া সাহা বাংলাদেশে ‘সংখ্যালঘু নিপীড়নের’ যে অভিযোগ করেছেন তা একান্তই তার নিজস্ব বক্তব্য, সংগঠনের নয়। এ বিষয়ে এক প্রতিক্রিয়ায় ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত রবার্ট মিলার বলেছেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায় একে-অপরকে শ্রদ্ধা করে এবং শান্তিতে তাদের ধর্ম পালন করে।

প্রিয়া সাহার গ্রামের বাড়ি পিরোজপুর জেলার চরবানিরীর মাটিভাঙা নাজিরপুরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্যপরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সাংগঠনিক সম্পাদক। এছাড়াও বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) ‘শারি’-এর নির্বাহী পরিচালক হিসেবেও দায়িত্বরত রয়েছেন। বর্তমানে ‘শারি’ এনজিও সংস্থার মাধ্যমে প্রিয়া নিজ এলাকার দলিত সম্প্রদায়কে নিয়ে কাজ করেন। তিনি ‘মহিলা ঐক্য পরিষদ’-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বিতর্কিত কর্মকান্ডের জন্য গতবছর তাকে মহিলা ঐক্যপরিষদের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। তার স্বামী মলয় সাহা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপ-পরিচালক। কয়েক বছর ধরেই যুক্তরাষ্ট্রে প্রিয়া সাহার দুই মেয়ে বসবাস করছেন। কিছুদিন পূর্বে সেখানে যান প্রিয়া সাহা।

গত ১৬ জুলাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সহিষ্ণুতা বিষয়ে বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মীয় নেতা ও প্রতিনিধিদের সঙ্গে হোয়াইট হাউজে কথা বলেন। এতে বাংলাদেশি পরিচয়ে প্রিয়া সাহা উপস্থিত হয়ে ট্রাম্পের কাছে অভিযোগ করেন, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। বাংলাদেশে ৩ কোটি ৭০ লাখ হিন্দু বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান নিখোঁজ রয়েছেন। দয়া করে আমাদের লোকজনকে সহায়তা করুন। আমরা আমাদের দেশে থাকতে চাই। এরপর তিনি বলেন, এখন সেখানে ১ কোটি ৮০ লাখ সংখ্যালঘু রয়েছে। আমরা আমাদের বাড়িঘর খুইয়েছি। তারা আমাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে, তারা আমাদের ভূমি দখল করে নিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন বিচার পাইনি। এক পর্যায়ে ট্রাম্প নিজেই সহানুভূতিশীলতাস্বরূপ এই নারীর সঙ্গে হাত মেলান। এ সময় ট্রাম্প প্রশ্ন করেন, ‘কারা জমি দখল করেছে, কারা বাড়িঘর দখল করেছে?’ ট্রাম্পের প্রশ্নের উত্তরে প্রিয়া সাহা বলেন, ‘তারা মুসলিম মৌলবাদি গ্রুপ এবং তারা সব সময় রাজনৈতিক আশ্রয় পায়। সব সময়ই পায়।’ মার্কিন টিভি চ্যানেল এবিসি নেটওয়ার্কের চ্যানেল এবিসি ফোর ইউটাহ ট্রাম্পের সঙ্গে প্রিয়া সাহার সেই সাক্ষাৎকারের ভিডিও প্রকাশ করে। এর পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে সেটি। যার তীব্র নিন্দা জানিয়ে দেশ-বিদেশে বাংলাদেশিরা নানা ধরনের মন্তব্য করছেন।

প্রিয়া সাহার দেয়া বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। একই সঙ্গে তার বক্তব্যকে ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যা দিয়ে তাকে দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন তারা। গতকাল বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয় রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে এ মানববন্ধন পালিত হয়। এছাড়াও প্রিয়া সাহার ঢাকার বাড়ির সামনে শনিবার বিক্ষোভ করে কিছু যুবক। গতকাল দুপুরে ধানমন্ডিতে প্রিয়া সাহার বাড়ির সামনে ‘সচেতন ছাত্র সমাজ’ ব্যানারে ২০-২৫ জন প্রথমে মানববন্ধন করেন। মানববন্ধনের পর তারা প্রিয়া সাহার বাসায় তালা দেয়ার প্রস্তুতি নিলেও পরে তা আর করেননি।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন গত শুক্রবার হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে এক সমাবেশে যোগ দিতে লন্ডন রওনা হওয়ার আগে গণমাধ্যমের এক প্রশ্নে তিনি বলেন, আমি এমন আচরণের নিন্দা এবং প্রতিবাদ জানাচ্ছি। প্রিয়া সাহা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে যে অভিযোগ করেছেন, তা একেবারেই মিথ্যা। বিশেষ মতলবে এমন উদ্ভট কথা বলেছেন তিনি। মোমেন বলেন, এ ধরনের অভিযোগে প্রকারান্তরে শান্তিপূর্ণ সমাজে বিশৃঙ্খলা উসকে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ তা কখনও হতে দেবে না।

অন্যদিকে গতকাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে প্রিয়া সাহার এই ভয়ংকর মিথ্যা অভিযোগের কঠোর প্রতিবাদ জানাচ্ছে এবং তার বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে। কড়া ভাষায় প্রিয়া সাহার বক্তব্যের নিন্দা জানিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, প্রিয়া সাহার এই চরম মিথ্যাচার এবং সাজানো গল্পের পেছনে অশুভ উদ্দেশ্য রয়েছে। তার এই বক্তব্যের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করা।

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, এই বক্তব্যটি সম্পূর্ণ অসত্য ও কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটি একটি নিন্দনীয় অপরাধই শুধু নয়, এই ধরনের উস্কানিমূলক বক্তব্য দেশের অভ্যন্তরে লুক্কায়িত মতলববাজ ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে সহায়তা করবে। “আমি দৃঢ়ভাবে বলতে পারি, বাংলাদেশের কোন বিবেকবান দেশপ্রেমিক হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সদস্য প্রিয়া সাহার বক্তব্যের সঙ্গে কোনভাবেই একমত হবে না। আমি পারসোনালি অনেকের সঙ্গে আলাপ করেছি, তারা এই বক্তব্যের তীব্র নিন্দা করেছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রিয়া সাহার সম্পর্কের বিষয়ে প্রশ্নে কাদের বলেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার কোন সাংগঠনিক সম্পর্ক নেই। আমাদের কোন সংগঠনের প্রাথমিক সদস্যও নয়। “অনেক অনুষ্ঠানে আমরা যাই, সেখানে অনেককে চিনিও না। অনেকে এসে ছবি তোলে। ছবি তুললেই তো সে আমাদের লোক হয়ে গেল না।” এটা কোন ষড়যন্ত্র মনে করছেন কিনা- প্রশ্নে কাদের বলেন, ‘ষড়যন্ত্র হতে পারে’।

আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, তিনি (প্রিয়া সাহা) যে অভিযোগ করেছেন, তেমন কিছু ঘটছে বলে আমার জানা নেই। এটা নিশ্চয়ই কোন চক্রান্ত; এটা উদ্দেশ্যমূলক বলেই আমার মনে হয়। ‘কথা হচ্ছে যে, এই ধরনের অভিযোগ (সংখ্যালঘু নির্যাতন) বাংলাদেশের কোন মানুষই বিশ্বাস করবে না; করেও না। কারণ, এদেশ অসাম্প্রদায়িক চেতনার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘তাকে (প্রিয়া সাহা) এখনও বলবো, এ ধরনের কোন ঘটনা যদি ঘটে থাকে, তবে তিনি যেন আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আমরা এ ধরনের অভিযোগের কোন সত্যতা এখনপর্যন্ত খুঁজে পাইনি।’

এ বিষয়ে কথা বলতে গেলে প্রিয়া সাহার মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া গেলে হিন্দু বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-ঐক্যপরিষদের সভাপতি হিউবার্ট গোমেজের সঙ্গে কথা বলেন গণমাধ্যমকর্মীরা। তবে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘প্রিয়া সাহা যে বক্তব্য প্রদান করেছেন তা তার একান্তই ব্যক্তিগত মতামত। এ বিষয়ে তিনিই ভালো ব্যাখ্যা দিতে পারবেন।’ প্রিয়া সাহা কিভাবে হোয়াইট হাউজের ওই অনুষ্ঠানে যোগ দিলেন এই প্রশ্নে তিনি বলেন, পরিষদের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য অশোক বড়ুয়া ও নির্মল রোজারিও এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্মল চ্যাটার্জী ছিলেন ওই প্রতিনিধি দলে। এর বাইরে আমাদের কোন প্রতিনিধি ছিলেন না। প্রিয়া সাহা আমাদের সংগঠনের ১১ জন সাংগঠনিক সম্পাদকের একজন। তবে তিনি ওই প্রতিনিধি দলে সদস্য ছিলেন না। রানা দাশগুপ্ত বলেন, প্রিয়া যে যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলেছেন, তা তিনি জেনেছেন শুক্রবার গণমাধ্যম থেকে। এর মধ্যে প্রিয়া সাহার সঙ্গে কোন যোগাযোগ হয়নি জানিয়ে সংগঠনের সভাপতি বলেন, ‘তিনি যা বলেছেন, এটা তার একান্ত নিজস্ব বক্তব্য, সাংগঠনিক বক্তব্য বা সিদ্ধান্ত নয়। ৩ কোটি ৭০ লাখ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান নিখোঁজ হয়েছেন বলে প্রিয়া আসলে কী বোঝাতে চেয়েছেন, সেটা তিনিই ভালো বলতে পারবেন বলে মন্তব্য করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এই প্রসিকিউটর। তাকে সংগঠনের পক্ষ থেকে সেখানে পাঠানো হয়নি। ট্রাম্পের সঙ্গে তিনি কিভাবে সাক্ষাৎ করেছেন তা আমি জানি না।’ প্রিয়া সাহার বেসরকারি সংস্থা ‘শারি’-এর কার্যালয়ের অন্যান্য সদস্যরাও এ বিষয়ে মুখ খুলতে চাননি।

মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল মিলার গত শুক্রবার রাজধানীর মেরুল বাড্ডা বৌদ্ধ বিহারে এক অনুষ্ঠানে গেলে সাংবাদিকরা তাকেও এ বিষয়ে প্রশ্ন করেন। তিনি বলেন, মার্কিন দূতাবাস বাংলাদেশ থেকে পাঁচজন প্রতিনিধি এবং দুইজন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে ওয়াশিংটনের ওই সম্মেলনে পাঠিয়েছিল। সেখানে প্রিয়ার বক্তব্য নিয়ে তিনি কোন মন্তব্য করবেন না। তবে মিলার বলেন, রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব নিয়ে আসার পর গত আট মাসে সবগুলো বিভাগ ঘুরে এবং প্রধান চার ধর্মের উপাসনালয়ে গিয়ে তার ধারণা হয়েছে, ধর্মীয় স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ‘উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি’ দেখিয়েছে। আপনি কীভাবে উপাসনা করেন, কীভাবে প্রার্থনা করেন, স্রষ্টাকে আপনি কেমন করে অনুভব করেন- এই সব কিছুর ঊর্ধ্বে থেকে অন্য ধর্মের মানুষকে শ্রদ্ধা করতে পারাটা বিশ্বের জন্যই একটা দৃষ্টান্ত। রাষ্ট্রদূত বলেন, মসজিদ, মন্দির, গির্জা আর প্যাগোডা ঘুরে ইমাম, পুরোহিত আর পাদ্রিদের কাছ থেকে একটি বার্তাই তিনি পেয়েছেন, ঐক্যবদ্ধ না থাকলে কোন দেশের পক্ষেই উন্নতি করা সম্ভব না। এটা আমার দেশের জন্য একটা শিক্ষানীয় বিষয়, পুরো বিশ্বের এখান থেকে শেখার আছে।

রবিবার, ২১ জুলাই ২০১৯ , ৬ শ্রাবন ১৪২৫, ১৭ জিলকদ ১৪৪০

প্রিয়া সাহার বক্তব্যে দেশব্যাপী তোলপাড়

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে প্রিয়া সাহার দেয়া বক্তব্যে বিভিন্ন মহলে প্রতিক্রিয়া হয়েছে। তার শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ হয়েছে দেশের বিভিন্ন জায়গায়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন প্রিয়া সাহার অভিযোগ একেবারেই মিথ্যা, বিশেষ মতলবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে উল্লেখ করেছেন। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রিয়া সাহার বক্তব্যকে অসত্য উদ্দেশ্যমূলক এবং দেশদ্রোহী হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেই হবে এবং সেই প্রক্রিয়া চলছে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত যুক্তরাষ্ট্রে সপরিবারে নাগরিকত্ব পেতেই এই ধরনের দেশবিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন তিনি। বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্যপরিষদের সভাপতি রানা দাশগুপ্ত বলেছেন, প্রিয়া সাহা বাংলাদেশে ‘সংখ্যালঘু নিপীড়নের’ যে অভিযোগ করেছেন তা একান্তই তার নিজস্ব বক্তব্য, সংগঠনের নয়। এ বিষয়ে এক প্রতিক্রিয়ায় ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত রবার্ট মিলার বলেছেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায় একে-অপরকে শ্রদ্ধা করে এবং শান্তিতে তাদের ধর্ম পালন করে।

প্রিয়া সাহার গ্রামের বাড়ি পিরোজপুর জেলার চরবানিরীর মাটিভাঙা নাজিরপুরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্যপরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সাংগঠনিক সম্পাদক। এছাড়াও বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) ‘শারি’-এর নির্বাহী পরিচালক হিসেবেও দায়িত্বরত রয়েছেন। বর্তমানে ‘শারি’ এনজিও সংস্থার মাধ্যমে প্রিয়া নিজ এলাকার দলিত সম্প্রদায়কে নিয়ে কাজ করেন। তিনি ‘মহিলা ঐক্য পরিষদ’-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বিতর্কিত কর্মকান্ডের জন্য গতবছর তাকে মহিলা ঐক্যপরিষদের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। তার স্বামী মলয় সাহা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপ-পরিচালক। কয়েক বছর ধরেই যুক্তরাষ্ট্রে প্রিয়া সাহার দুই মেয়ে বসবাস করছেন। কিছুদিন পূর্বে সেখানে যান প্রিয়া সাহা।

গত ১৬ জুলাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সহিষ্ণুতা বিষয়ে বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মীয় নেতা ও প্রতিনিধিদের সঙ্গে হোয়াইট হাউজে কথা বলেন। এতে বাংলাদেশি পরিচয়ে প্রিয়া সাহা উপস্থিত হয়ে ট্রাম্পের কাছে অভিযোগ করেন, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। বাংলাদেশে ৩ কোটি ৭০ লাখ হিন্দু বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান নিখোঁজ রয়েছেন। দয়া করে আমাদের লোকজনকে সহায়তা করুন। আমরা আমাদের দেশে থাকতে চাই। এরপর তিনি বলেন, এখন সেখানে ১ কোটি ৮০ লাখ সংখ্যালঘু রয়েছে। আমরা আমাদের বাড়িঘর খুইয়েছি। তারা আমাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে, তারা আমাদের ভূমি দখল করে নিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন বিচার পাইনি। এক পর্যায়ে ট্রাম্প নিজেই সহানুভূতিশীলতাস্বরূপ এই নারীর সঙ্গে হাত মেলান। এ সময় ট্রাম্প প্রশ্ন করেন, ‘কারা জমি দখল করেছে, কারা বাড়িঘর দখল করেছে?’ ট্রাম্পের প্রশ্নের উত্তরে প্রিয়া সাহা বলেন, ‘তারা মুসলিম মৌলবাদি গ্রুপ এবং তারা সব সময় রাজনৈতিক আশ্রয় পায়। সব সময়ই পায়।’ মার্কিন টিভি চ্যানেল এবিসি নেটওয়ার্কের চ্যানেল এবিসি ফোর ইউটাহ ট্রাম্পের সঙ্গে প্রিয়া সাহার সেই সাক্ষাৎকারের ভিডিও প্রকাশ করে। এর পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে সেটি। যার তীব্র নিন্দা জানিয়ে দেশ-বিদেশে বাংলাদেশিরা নানা ধরনের মন্তব্য করছেন।

প্রিয়া সাহার দেয়া বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। একই সঙ্গে তার বক্তব্যকে ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যা দিয়ে তাকে দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন তারা। গতকাল বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয় রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে এ মানববন্ধন পালিত হয়। এছাড়াও প্রিয়া সাহার ঢাকার বাড়ির সামনে শনিবার বিক্ষোভ করে কিছু যুবক। গতকাল দুপুরে ধানমন্ডিতে প্রিয়া সাহার বাড়ির সামনে ‘সচেতন ছাত্র সমাজ’ ব্যানারে ২০-২৫ জন প্রথমে মানববন্ধন করেন। মানববন্ধনের পর তারা প্রিয়া সাহার বাসায় তালা দেয়ার প্রস্তুতি নিলেও পরে তা আর করেননি।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন গত শুক্রবার হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে এক সমাবেশে যোগ দিতে লন্ডন রওনা হওয়ার আগে গণমাধ্যমের এক প্রশ্নে তিনি বলেন, আমি এমন আচরণের নিন্দা এবং প্রতিবাদ জানাচ্ছি। প্রিয়া সাহা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে যে অভিযোগ করেছেন, তা একেবারেই মিথ্যা। বিশেষ মতলবে এমন উদ্ভট কথা বলেছেন তিনি। মোমেন বলেন, এ ধরনের অভিযোগে প্রকারান্তরে শান্তিপূর্ণ সমাজে বিশৃঙ্খলা উসকে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ তা কখনও হতে দেবে না।

অন্যদিকে গতকাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে প্রিয়া সাহার এই ভয়ংকর মিথ্যা অভিযোগের কঠোর প্রতিবাদ জানাচ্ছে এবং তার বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে। কড়া ভাষায় প্রিয়া সাহার বক্তব্যের নিন্দা জানিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, প্রিয়া সাহার এই চরম মিথ্যাচার এবং সাজানো গল্পের পেছনে অশুভ উদ্দেশ্য রয়েছে। তার এই বক্তব্যের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করা।

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, এই বক্তব্যটি সম্পূর্ণ অসত্য ও কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটি একটি নিন্দনীয় অপরাধই শুধু নয়, এই ধরনের উস্কানিমূলক বক্তব্য দেশের অভ্যন্তরে লুক্কায়িত মতলববাজ ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে সহায়তা করবে। “আমি দৃঢ়ভাবে বলতে পারি, বাংলাদেশের কোন বিবেকবান দেশপ্রেমিক হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সদস্য প্রিয়া সাহার বক্তব্যের সঙ্গে কোনভাবেই একমত হবে না। আমি পারসোনালি অনেকের সঙ্গে আলাপ করেছি, তারা এই বক্তব্যের তীব্র নিন্দা করেছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রিয়া সাহার সম্পর্কের বিষয়ে প্রশ্নে কাদের বলেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার কোন সাংগঠনিক সম্পর্ক নেই। আমাদের কোন সংগঠনের প্রাথমিক সদস্যও নয়। “অনেক অনুষ্ঠানে আমরা যাই, সেখানে অনেককে চিনিও না। অনেকে এসে ছবি তোলে। ছবি তুললেই তো সে আমাদের লোক হয়ে গেল না।” এটা কোন ষড়যন্ত্র মনে করছেন কিনা- প্রশ্নে কাদের বলেন, ‘ষড়যন্ত্র হতে পারে’।

আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, তিনি (প্রিয়া সাহা) যে অভিযোগ করেছেন, তেমন কিছু ঘটছে বলে আমার জানা নেই। এটা নিশ্চয়ই কোন চক্রান্ত; এটা উদ্দেশ্যমূলক বলেই আমার মনে হয়। ‘কথা হচ্ছে যে, এই ধরনের অভিযোগ (সংখ্যালঘু নির্যাতন) বাংলাদেশের কোন মানুষই বিশ্বাস করবে না; করেও না। কারণ, এদেশ অসাম্প্রদায়িক চেতনার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘তাকে (প্রিয়া সাহা) এখনও বলবো, এ ধরনের কোন ঘটনা যদি ঘটে থাকে, তবে তিনি যেন আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আমরা এ ধরনের অভিযোগের কোন সত্যতা এখনপর্যন্ত খুঁজে পাইনি।’

এ বিষয়ে কথা বলতে গেলে প্রিয়া সাহার মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া গেলে হিন্দু বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-ঐক্যপরিষদের সভাপতি হিউবার্ট গোমেজের সঙ্গে কথা বলেন গণমাধ্যমকর্মীরা। তবে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘প্রিয়া সাহা যে বক্তব্য প্রদান করেছেন তা তার একান্তই ব্যক্তিগত মতামত। এ বিষয়ে তিনিই ভালো ব্যাখ্যা দিতে পারবেন।’ প্রিয়া সাহা কিভাবে হোয়াইট হাউজের ওই অনুষ্ঠানে যোগ দিলেন এই প্রশ্নে তিনি বলেন, পরিষদের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য অশোক বড়ুয়া ও নির্মল রোজারিও এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্মল চ্যাটার্জী ছিলেন ওই প্রতিনিধি দলে। এর বাইরে আমাদের কোন প্রতিনিধি ছিলেন না। প্রিয়া সাহা আমাদের সংগঠনের ১১ জন সাংগঠনিক সম্পাদকের একজন। তবে তিনি ওই প্রতিনিধি দলে সদস্য ছিলেন না। রানা দাশগুপ্ত বলেন, প্রিয়া যে যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলেছেন, তা তিনি জেনেছেন শুক্রবার গণমাধ্যম থেকে। এর মধ্যে প্রিয়া সাহার সঙ্গে কোন যোগাযোগ হয়নি জানিয়ে সংগঠনের সভাপতি বলেন, ‘তিনি যা বলেছেন, এটা তার একান্ত নিজস্ব বক্তব্য, সাংগঠনিক বক্তব্য বা সিদ্ধান্ত নয়। ৩ কোটি ৭০ লাখ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান নিখোঁজ হয়েছেন বলে প্রিয়া আসলে কী বোঝাতে চেয়েছেন, সেটা তিনিই ভালো বলতে পারবেন বলে মন্তব্য করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এই প্রসিকিউটর। তাকে সংগঠনের পক্ষ থেকে সেখানে পাঠানো হয়নি। ট্রাম্পের সঙ্গে তিনি কিভাবে সাক্ষাৎ করেছেন তা আমি জানি না।’ প্রিয়া সাহার বেসরকারি সংস্থা ‘শারি’-এর কার্যালয়ের অন্যান্য সদস্যরাও এ বিষয়ে মুখ খুলতে চাননি।

মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল মিলার গত শুক্রবার রাজধানীর মেরুল বাড্ডা বৌদ্ধ বিহারে এক অনুষ্ঠানে গেলে সাংবাদিকরা তাকেও এ বিষয়ে প্রশ্ন করেন। তিনি বলেন, মার্কিন দূতাবাস বাংলাদেশ থেকে পাঁচজন প্রতিনিধি এবং দুইজন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে ওয়াশিংটনের ওই সম্মেলনে পাঠিয়েছিল। সেখানে প্রিয়ার বক্তব্য নিয়ে তিনি কোন মন্তব্য করবেন না। তবে মিলার বলেন, রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব নিয়ে আসার পর গত আট মাসে সবগুলো বিভাগ ঘুরে এবং প্রধান চার ধর্মের উপাসনালয়ে গিয়ে তার ধারণা হয়েছে, ধর্মীয় স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ‘উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি’ দেখিয়েছে। আপনি কীভাবে উপাসনা করেন, কীভাবে প্রার্থনা করেন, স্রষ্টাকে আপনি কেমন করে অনুভব করেন- এই সব কিছুর ঊর্ধ্বে থেকে অন্য ধর্মের মানুষকে শ্রদ্ধা করতে পারাটা বিশ্বের জন্যই একটা দৃষ্টান্ত। রাষ্ট্রদূত বলেন, মসজিদ, মন্দির, গির্জা আর প্যাগোডা ঘুরে ইমাম, পুরোহিত আর পাদ্রিদের কাছ থেকে একটি বার্তাই তিনি পেয়েছেন, ঐক্যবদ্ধ না থাকলে কোন দেশের পক্ষেই উন্নতি করা সম্ভব না। এটা আমার দেশের জন্য একটা শিক্ষানীয় বিষয়, পুরো বিশ্বের এখান থেকে শেখার আছে।