প্রিয়া সাহার ব্যাখ্যা না শুনে তার বিরুদ্ধে মামলা না করার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

কাদের

মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগের বিষয়ে ‘প্রিয়া সাহার ব্যাখ্যা না শুনে’ তার বিরুদ্ধে ‘মামলা না করার’ নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি) বাস্তবায়নাধীন মেট্রোরেল প্রকল্পের ব্র্যান্ডিং সেমিনার শেষে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এদিকে প্রিয়া সাহার বক্তেব্যের প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রতিবাদ সমাবেশ এবং বিক্ষোভ করেছে বিভিন্ন সংগঠন। অন্যদিকে গত শনিবার প্রিয়া সাহা ইউটিউবে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেন সংখ্যালঘুদের রক্ষায় এই বক্তব্য দিয়েছেন তিনি।

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে প্রিয়া সাহার অভিযোগের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমাকে একটা ‘মেসেজ’ দিয়েছেন, তা হলো প্রিয়া সাহার আত্মপক্ষ সমর্থনের আগে তার বিরুদ্ধে কোন ধরনের মামলা করা যাবে না। সকালে প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী (আ ক ম মোজাম্মেল হক) মামলা করার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। আমি তাকে প্রধানমন্ত্রীর ‘মেসেজ’ জানিয়ে দিয়েছি। প্রিয়া সাহার গ্রামের বাড়ির সবকিছু যেন নিরাপদে থাকে সে জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে বলেও জানান ওবায়দুল কাদের।

প্রিয়া সাহার বক্তব্যের আড়ালে কোন ষড়যন্ত্র চলছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, এই বিষয়ে কোন প্রমাণ পাইনি। প্রিয়া সাহার অভিযোগ প্রসঙ্গে ওবায়দুল কাদের বলেন, প্রিয়া সাহা যে বক্তব্য দিয়েছেন তা ‘সেনসেটিভ’ বিষয়। ট্রাম্পের কাছে তিনি কেন এমন বক্তব্য দিলেন। তার আসল উদ্দেশ্য কী ছিল। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হবে। তার বক্তব্য শোনার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমার বিশ্বাস, তিনি তার স্বদেশে দ্রুতই ফিরে আসবেন। সরকারের এমন অবস্থান হলেও প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নাটোরস বিভিন্ন জায়গায় রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে আদালতে মামলা দায়ের হয়েছে- এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওবায়দুল কাদের বলেন, বিষয়টি নিয়ে আইনমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে। রাষ্ট্র না চাইলে কেউ রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করতে পারে না। মামলাগুলো গ্রহণযোগ্য হবে না। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুর ওপরে নির্যাতনের বিষয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে প্রিয়া সাহার দেয়া বক্তব্য রাষ্ট্রদ্রোহ বলে মনে করেন না আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। গতকাল বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে বিচারকদের প্রশিক্ষণের উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়ে ট্রাম্পকে যে তথ্যগুলো প্রিয়া সাহা দিয়েছেন তা সর্বৈব মিথ্যা, বিএনপি-জামায়াতের সময় ছাড়া বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। এটা তার ব্যক্তিগত ঈর্ষা চরিতার্থের জন্য করেছে। এত ছোট্ট ঘটনায় রাষ্ট্রদ্রোহ হয়ে গেছে, তা মনে করি না।

মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রিয়া সাহার মিথ্যা অভিযোগ সম্পর্কে আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রে কীভাবে গেলেন, কেন এই ধরনের বক্তব্য দিলেন, তাকে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে কে সেখানে পাঠিয়েছেন, এসব বিষয় খতিয়ে দেখা হবে। এ বিষয়ে তার স্বামীর কোন সম্পৃক্ততা আছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখা উচিত। গতকাল সচিবালয়ে সমসাময়িক বিষয় নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে তথ্যমন্ত্রী এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছেন, প্রিয়া সাহার মিথ্যা বক্তব্যকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি আধিপত্য বিস্তারের ষড়যন্ত্র পরিষ্কারভাবেই লক্ষ করা যাচ্ছে। গত শনিবার নিজের ভ্যারিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেয়া এক স্ট্যাটাসে এ কথা বলেছেন তিনি।

জয়ের ফেসবুক স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে দেয়া হলো :

“গত নির্বাচনের পর আমি একটু বিরতি নেই, তাই এই পেজেও কম পোস্ট করা হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার প্রেক্ষিতে আমার কিছু বলা উচিত বলে মনে হলো।

আপনারা হয়তো দেখেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে প্রিয়া সাহার ভয়ংকর ও মিথ্যা দাবি। উনি বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে নাকি ৩ কোটি ৭০ লাখ ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা ‘গায়েব’ বা ‘গুম’ হয়ে গেছেন। প্রায় ৪ কোটির কাছাকাছি যে সংখ্যাটি উনি বলছেন, তা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যার ১০ গুণেরও বেশি, আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহতদের সংখ্যার কাছাকাছি। এত মানুষ গুম হলো সবার অজান্তে? ৩ কোটি ৭০ লাখ মানুষ গায়েব হলো কোন তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই?

প্রিয়া সাহাকে আমেরিকায় পাঠানো হয় বাংলাদেশে মার্কিন দূতাবাসের মনোনয়নে। অনেক সমালোচনার পর আজ তারা একটি বিবৃতি দিয়েছেন। সেখানে তারা বলেছেন, তারা অংশগ্রহণকারীদের কথাবার্তার ওপর কোন বিধিনিষেধ আরোপ করেন না। কিন্তু যখন তাদের একজন মনোনীত অংশগ্রহণকারী তাদেরই রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে কোন ভয়ংকর মিথ্যা বক্তব্য দিলেন, তাদের উচিত ছিল তাৎক্ষণিকভাবে তার প্রতিবাদ জানানো, যা তারা করেননি।

এই বিষয়টি থেকে কিন্তু মার্কিন দূতাবাসেরই দুরভিসন্ধি প্রকাশ পায়। তারা জেনেশুনেই প্রিয়া সাহাকে বাছাই করে, কারণ তারা জানত উনি এই ধরনের ভয়ংকর মিথ্যা মন্তব্য করবেন। এই ধরনের কাজের পেছনে একটাই কারণ চিন্তা করা যায়। মানবিকতার দোহাই দিয়ে আমাদের এই অঞ্চলে সেনা অভিযানের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। মনে রাখা ভালো কয়েক দিন আগেই মার্কিন এক কংগ্রেসম্যান একটি বক্তব্যে বলেছিলেন, বাংলাদেশের মায়ানমারের রাখাইন রাজ্য দখল করা উচিত।

মার্কিন দূতাবাস যে আওয়ামী লীগ বিরোধী তা নতুন কিছু নয়। তাদের সব অনুষ্ঠানেই জামায়াত নেতাকর্মীরা ও যুদ্ধাপরাধীরা নিয়মিত আমন্ত্রিত হতেন। প্রিয়া সাহার মিথ্যা বক্তব্যকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে তাদের সরাসরি আধিপত্য বিস্তারের ষড়যন্ত্র পরিষ্কারভাবেই লক্ষ করা যাচ্ছে। সৌভাগ্যবশত, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার সরকার অন্যান্য দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার নীতিতে বিশ্বাসী নন। তারা এই ধরনের ভয়ংকর মিথ্যা দাবি বিশ্বাস করার মতো বোকাও নন।

অন্যেিদক যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত এক সাংবাদিককে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন প্রিয়া সাহা। সাক্ষাৎকারটি গত শনিবার ইউটিউবে আপলোড করা হয়েছে। সেখানে দেশ ছেড়ে কোথাও যাবেন না বলে মন্তব্য করেছেন প্রিয়া সাহা। সংখ্যালঘু স¤প্রদায়ের ৩৭ মিলিয়ন মানুষের ‘ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স’ সম্পর্কে তিনি বলেন, বাংলাদেশের পরিসংখ্যান বইয়ের (২০০১ সালের) ধর্মীয় সংখ্যালঘু যে চ্যাপ্টার রয়েছে এবং সরকারি জনগণনা (সেনসাস) রিপোর্টে থেকে এ সংখ্যা পাওয়া যায়।

হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক প্রিয়া সাহা সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেন, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের রানা দাস গুপ্তসহ কেউ জানেন না যে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন। নিজের পরিবার ভীষণ সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বলে দাবি করেছেন প্রিয়া সাহা।

সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ৩৭ মিলিয়ন মানুষের ‘ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স’ সম্পর্কে করা এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশের পরিসংখ্যান বইয়ের (২০০১ সালের) ধর্মীয় সংখ্যালঘু যে চ্যাপ্টার রয়েছে এবং সরকারি সেনসাস রিপোর্টে থেকে এ সংখ্যা পাওয়া যায়। দেশভাগের সঙ্গে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ ছিল ২৯ দশমিক ৭ শতাংশ, এখন তা কমে ৯ দশমিক ৭ শতাংশ।

সাক্ষাৎকারে প্রিয়া সাহা দেশের বিরুদ্ধে কোন ধরনের অভিযোগ করেননি বলে দাবি করেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে সংখ্যালঘু নির্যাতনের কথা তুলে ধরার পেছনে তার অভিপ্রায় ছিল মৌলবাদবিরোধী লড়াইকে জোরদার করা। প্রিয়া সাহার মতে, বর্তমান সরকার মৌলবাদের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারও মৌলবাদের বিরুদ্ধে। তিনি চান, দুই দেশের সরকার যৌথভাবে মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়ুক। এ কারণে তিনি ট্রাম্পের কাছে এসব কথা বলেন।

সম্প্রীতি বাংলাদেশ জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে সম্প্রীতি বাংলাদেশ সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, দেশের উন্নয়নের ধারাকে ব্যাহত করে বাংলাদেশকে বন্ধুহীন করতে প্রিয়া সাহা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে অভিযোগ করেছে প্রিয়া সাহা। পিযুষ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ৩৭ মিলিয়ন হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মানুষ নিখোঁজ হয়েছে, যা অবাস্তব ও বানোয়াট বলে ধরে নেয়া যায়। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে এমন কোন তথ্য বা পরিসংখ্যান নেই। প্রিয়া সাহার এমন অভিযোগের বিষয়ে পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ প্রিয়া সাহার এ নির্লজ্জ মিথ্যাচারের তীব্র প্রতিবাদ জানাই। তিনি কাদের প্ররোচনায়, কোন উদ্দেশ্যে এমন মিথ্যাচার করেছেন, সে বিষয়ে একটি সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানাচ্ছি।’ ঘটনাটি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয় উল্লেখ করে পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘সুষ্ঠু তদন্তে অবশ্যই থলের আসল বিড়ালদের চেহারা বেরিয়ে আসবে। তবে প্রিয়া সাহাকে শিখন্ডী বানিয়ে কোনো দুষ্টুচক্র বা স্বার্থন্বেষী মহল ঘোলা পানিতে যেন মাছ শিকার করতে না পারে, সে ব্যাপারে সবাইকে সজাগ ও সংঘবদ্ধ থাকতে হবে।’

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শত্রুদের প্ররোচনায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে প্রিয়া সাহা নামের এক নারী দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের কল্পকাহিনী উপস্থাপন করেছেন বলে জানিয়েছেন ইন্টার রিলিজিয়ন হারমনি সোসাইটির চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা মিঞা মজিবুর রহমান। গতকাল গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবের সোসাইটি আয়োজিত আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। আলোচনা সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন ইন্টার রিলিজিয়ন হারমনি সোসাইটির সেক্রেটারি জেনারেল মুক্তিযোদ্ধা ড. মনোরঞ্জন ঘোষাল প্রমুখ।

সোমবার, ২২ জুলাই ২০১৯ , ৭ শ্রাবন ১৪২৫, ১৮ জিলকদ ১৪৪০

প্রিয়া সাহার ব্যাখ্যা না শুনে তার বিরুদ্ধে মামলা না করার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

কাদের

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগের বিষয়ে ‘প্রিয়া সাহার ব্যাখ্যা না শুনে’ তার বিরুদ্ধে ‘মামলা না করার’ নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি) বাস্তবায়নাধীন মেট্রোরেল প্রকল্পের ব্র্যান্ডিং সেমিনার শেষে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এদিকে প্রিয়া সাহার বক্তেব্যের প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রতিবাদ সমাবেশ এবং বিক্ষোভ করেছে বিভিন্ন সংগঠন। অন্যদিকে গত শনিবার প্রিয়া সাহা ইউটিউবে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেন সংখ্যালঘুদের রক্ষায় এই বক্তব্য দিয়েছেন তিনি।

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে প্রিয়া সাহার অভিযোগের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমাকে একটা ‘মেসেজ’ দিয়েছেন, তা হলো প্রিয়া সাহার আত্মপক্ষ সমর্থনের আগে তার বিরুদ্ধে কোন ধরনের মামলা করা যাবে না। সকালে প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী (আ ক ম মোজাম্মেল হক) মামলা করার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। আমি তাকে প্রধানমন্ত্রীর ‘মেসেজ’ জানিয়ে দিয়েছি। প্রিয়া সাহার গ্রামের বাড়ির সবকিছু যেন নিরাপদে থাকে সে জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে বলেও জানান ওবায়দুল কাদের।

প্রিয়া সাহার বক্তব্যের আড়ালে কোন ষড়যন্ত্র চলছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, এই বিষয়ে কোন প্রমাণ পাইনি। প্রিয়া সাহার অভিযোগ প্রসঙ্গে ওবায়দুল কাদের বলেন, প্রিয়া সাহা যে বক্তব্য দিয়েছেন তা ‘সেনসেটিভ’ বিষয়। ট্রাম্পের কাছে তিনি কেন এমন বক্তব্য দিলেন। তার আসল উদ্দেশ্য কী ছিল। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হবে। তার বক্তব্য শোনার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমার বিশ্বাস, তিনি তার স্বদেশে দ্রুতই ফিরে আসবেন। সরকারের এমন অবস্থান হলেও প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নাটোরস বিভিন্ন জায়গায় রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে আদালতে মামলা দায়ের হয়েছে- এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওবায়দুল কাদের বলেন, বিষয়টি নিয়ে আইনমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে। রাষ্ট্র না চাইলে কেউ রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করতে পারে না। মামলাগুলো গ্রহণযোগ্য হবে না। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুর ওপরে নির্যাতনের বিষয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে প্রিয়া সাহার দেয়া বক্তব্য রাষ্ট্রদ্রোহ বলে মনে করেন না আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। গতকাল বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে বিচারকদের প্রশিক্ষণের উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়ে ট্রাম্পকে যে তথ্যগুলো প্রিয়া সাহা দিয়েছেন তা সর্বৈব মিথ্যা, বিএনপি-জামায়াতের সময় ছাড়া বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। এটা তার ব্যক্তিগত ঈর্ষা চরিতার্থের জন্য করেছে। এত ছোট্ট ঘটনায় রাষ্ট্রদ্রোহ হয়ে গেছে, তা মনে করি না।

মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রিয়া সাহার মিথ্যা অভিযোগ সম্পর্কে আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রে কীভাবে গেলেন, কেন এই ধরনের বক্তব্য দিলেন, তাকে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে কে সেখানে পাঠিয়েছেন, এসব বিষয় খতিয়ে দেখা হবে। এ বিষয়ে তার স্বামীর কোন সম্পৃক্ততা আছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখা উচিত। গতকাল সচিবালয়ে সমসাময়িক বিষয় নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে তথ্যমন্ত্রী এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছেন, প্রিয়া সাহার মিথ্যা বক্তব্যকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি আধিপত্য বিস্তারের ষড়যন্ত্র পরিষ্কারভাবেই লক্ষ করা যাচ্ছে। গত শনিবার নিজের ভ্যারিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেয়া এক স্ট্যাটাসে এ কথা বলেছেন তিনি।

জয়ের ফেসবুক স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে দেয়া হলো :

“গত নির্বাচনের পর আমি একটু বিরতি নেই, তাই এই পেজেও কম পোস্ট করা হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার প্রেক্ষিতে আমার কিছু বলা উচিত বলে মনে হলো।

আপনারা হয়তো দেখেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে প্রিয়া সাহার ভয়ংকর ও মিথ্যা দাবি। উনি বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে নাকি ৩ কোটি ৭০ লাখ ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা ‘গায়েব’ বা ‘গুম’ হয়ে গেছেন। প্রায় ৪ কোটির কাছাকাছি যে সংখ্যাটি উনি বলছেন, তা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যার ১০ গুণেরও বেশি, আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহতদের সংখ্যার কাছাকাছি। এত মানুষ গুম হলো সবার অজান্তে? ৩ কোটি ৭০ লাখ মানুষ গায়েব হলো কোন তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই?

প্রিয়া সাহাকে আমেরিকায় পাঠানো হয় বাংলাদেশে মার্কিন দূতাবাসের মনোনয়নে। অনেক সমালোচনার পর আজ তারা একটি বিবৃতি দিয়েছেন। সেখানে তারা বলেছেন, তারা অংশগ্রহণকারীদের কথাবার্তার ওপর কোন বিধিনিষেধ আরোপ করেন না। কিন্তু যখন তাদের একজন মনোনীত অংশগ্রহণকারী তাদেরই রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে কোন ভয়ংকর মিথ্যা বক্তব্য দিলেন, তাদের উচিত ছিল তাৎক্ষণিকভাবে তার প্রতিবাদ জানানো, যা তারা করেননি।

এই বিষয়টি থেকে কিন্তু মার্কিন দূতাবাসেরই দুরভিসন্ধি প্রকাশ পায়। তারা জেনেশুনেই প্রিয়া সাহাকে বাছাই করে, কারণ তারা জানত উনি এই ধরনের ভয়ংকর মিথ্যা মন্তব্য করবেন। এই ধরনের কাজের পেছনে একটাই কারণ চিন্তা করা যায়। মানবিকতার দোহাই দিয়ে আমাদের এই অঞ্চলে সেনা অভিযানের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। মনে রাখা ভালো কয়েক দিন আগেই মার্কিন এক কংগ্রেসম্যান একটি বক্তব্যে বলেছিলেন, বাংলাদেশের মায়ানমারের রাখাইন রাজ্য দখল করা উচিত।

মার্কিন দূতাবাস যে আওয়ামী লীগ বিরোধী তা নতুন কিছু নয়। তাদের সব অনুষ্ঠানেই জামায়াত নেতাকর্মীরা ও যুদ্ধাপরাধীরা নিয়মিত আমন্ত্রিত হতেন। প্রিয়া সাহার মিথ্যা বক্তব্যকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে তাদের সরাসরি আধিপত্য বিস্তারের ষড়যন্ত্র পরিষ্কারভাবেই লক্ষ করা যাচ্ছে। সৌভাগ্যবশত, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার সরকার অন্যান্য দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার নীতিতে বিশ্বাসী নন। তারা এই ধরনের ভয়ংকর মিথ্যা দাবি বিশ্বাস করার মতো বোকাও নন।

অন্যেিদক যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত এক সাংবাদিককে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন প্রিয়া সাহা। সাক্ষাৎকারটি গত শনিবার ইউটিউবে আপলোড করা হয়েছে। সেখানে দেশ ছেড়ে কোথাও যাবেন না বলে মন্তব্য করেছেন প্রিয়া সাহা। সংখ্যালঘু স¤প্রদায়ের ৩৭ মিলিয়ন মানুষের ‘ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স’ সম্পর্কে তিনি বলেন, বাংলাদেশের পরিসংখ্যান বইয়ের (২০০১ সালের) ধর্মীয় সংখ্যালঘু যে চ্যাপ্টার রয়েছে এবং সরকারি জনগণনা (সেনসাস) রিপোর্টে থেকে এ সংখ্যা পাওয়া যায়।

হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক প্রিয়া সাহা সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেন, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের রানা দাস গুপ্তসহ কেউ জানেন না যে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন। নিজের পরিবার ভীষণ সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বলে দাবি করেছেন প্রিয়া সাহা।

সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ৩৭ মিলিয়ন মানুষের ‘ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স’ সম্পর্কে করা এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশের পরিসংখ্যান বইয়ের (২০০১ সালের) ধর্মীয় সংখ্যালঘু যে চ্যাপ্টার রয়েছে এবং সরকারি সেনসাস রিপোর্টে থেকে এ সংখ্যা পাওয়া যায়। দেশভাগের সঙ্গে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ ছিল ২৯ দশমিক ৭ শতাংশ, এখন তা কমে ৯ দশমিক ৭ শতাংশ।

সাক্ষাৎকারে প্রিয়া সাহা দেশের বিরুদ্ধে কোন ধরনের অভিযোগ করেননি বলে দাবি করেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে সংখ্যালঘু নির্যাতনের কথা তুলে ধরার পেছনে তার অভিপ্রায় ছিল মৌলবাদবিরোধী লড়াইকে জোরদার করা। প্রিয়া সাহার মতে, বর্তমান সরকার মৌলবাদের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারও মৌলবাদের বিরুদ্ধে। তিনি চান, দুই দেশের সরকার যৌথভাবে মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়ুক। এ কারণে তিনি ট্রাম্পের কাছে এসব কথা বলেন।

সম্প্রীতি বাংলাদেশ জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে সম্প্রীতি বাংলাদেশ সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, দেশের উন্নয়নের ধারাকে ব্যাহত করে বাংলাদেশকে বন্ধুহীন করতে প্রিয়া সাহা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে অভিযোগ করেছে প্রিয়া সাহা। পিযুষ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ৩৭ মিলিয়ন হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মানুষ নিখোঁজ হয়েছে, যা অবাস্তব ও বানোয়াট বলে ধরে নেয়া যায়। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে এমন কোন তথ্য বা পরিসংখ্যান নেই। প্রিয়া সাহার এমন অভিযোগের বিষয়ে পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ প্রিয়া সাহার এ নির্লজ্জ মিথ্যাচারের তীব্র প্রতিবাদ জানাই। তিনি কাদের প্ররোচনায়, কোন উদ্দেশ্যে এমন মিথ্যাচার করেছেন, সে বিষয়ে একটি সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানাচ্ছি।’ ঘটনাটি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয় উল্লেখ করে পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘সুষ্ঠু তদন্তে অবশ্যই থলের আসল বিড়ালদের চেহারা বেরিয়ে আসবে। তবে প্রিয়া সাহাকে শিখন্ডী বানিয়ে কোনো দুষ্টুচক্র বা স্বার্থন্বেষী মহল ঘোলা পানিতে যেন মাছ শিকার করতে না পারে, সে ব্যাপারে সবাইকে সজাগ ও সংঘবদ্ধ থাকতে হবে।’

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শত্রুদের প্ররোচনায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে প্রিয়া সাহা নামের এক নারী দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের কল্পকাহিনী উপস্থাপন করেছেন বলে জানিয়েছেন ইন্টার রিলিজিয়ন হারমনি সোসাইটির চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা মিঞা মজিবুর রহমান। গতকাল গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবের সোসাইটি আয়োজিত আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। আলোচনা সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন ইন্টার রিলিজিয়ন হারমনি সোসাইটির সেক্রেটারি জেনারেল মুক্তিযোদ্ধা ড. মনোরঞ্জন ঘোষাল প্রমুখ।