‘ঘোষণা দিয়ে ঋণ আমানতে সুদহার নয়-ছয় সম্ভব নয়’

সরকারের পক্ষ থেকে আমানত এবং ঋণের সুদহার যথাক্রমে ছয় এবং নয় শতাংশ হার করার বিষয়ে চাপ থাকলেও শুধু ঘোষণা দিয়ে এটি সম্ভব নয় বলে মনে করছেন ব্যাংকাররা। বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করতে হবে। এছাড়া নয় শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণ করতে হলে ৬ শতাংশ আমানতের দাবি করছেন ব্যাংকের এমডিরা। তবে এটি বাস্তবায়নের চেষ্টা করছেন বলেও তারা জানিয়েছেন।

গতকাল এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের এক বৈঠক শেষে তারা এসব কথা বলেন। এটি ছিল ধারাবাহিক ত্রৈমাসিক বৈঠক। এতে সভাপতিত্ব করেন গভর্নর ফজলে কাবির। এছাড়া বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীরা ছাড়াও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। গতকালের সভায় আলোচ্যসূচির মধ্যে ছিল সামষ্টিক অর্থনীতি পর্যালোচনা, শীর্ষ ঋণগ্রহীতাদের মনিটরিং ও আদায় কার্যক্রম, অবলোপন নীতিমালা পর্যালোচনা, এসএমই খাতে ঋণ প্রদান। বিবিধ বিষয় হিসেবে ঋণ সিংগেল ডিজিট সুদহার নির্ধারণ নিয়ে পর্যালোচনা হয়।

জানা গেছে, ব্যাংকের মালিকরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সুদ কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা বাস্তবায়ন করেননি। বছরজুড়ে নানা অজুহাত দেখিয়েছেন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা (এমডি)। সম্প্রতি সরকারি সংস্থার আমানত পেতে হলে নয়-ছয় কার্যকর বাধ্যতামূলক করেছে অর্থমন্ত্রণালয়। এখন ব্যাংকের এমডিরা দাবি করেছেন ৯ শতাংশ ঋণ বিতরণ করতে হলে তার আগে ৬ শতাংশ আমানত প্রয়োজন।

গত বছরের জুলাই থেকে ব্যাংকের মালিকরা ঋণ সর্বোচ্চ ৯ এবং আমানতে সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ (নয়Ñছয়) কার্যকরের ঘোষণা দেন। প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে সুদহার কমানোর প্রতিশ্রুতি দেন ব্যাংকের মালিকরা। এজন্য নীতিগত অন্তত ৪টি সুবিধা হাতিয়ে নেয়া হয়। এরমধ্যে রয়েছে নগদ জমা সংরক্ষণ (সিআরআর) কমানো, রেপো রেট কমানো ও মেয়াদ বৃদ্ধি, সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখা এবং মুনাফার ওপর কর কমানো। এরপর বিভিন্ন ব্যাংক বোর্ড সভায় নয়-ছয় সুদহার নির্ধারণ করা হয়েছে বলে ঘোষণা দেয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সরকারি ব্যাংক ছাড়া আর কোন ব্যাংকই এটি কার্যকর করেনি। বরং তারল্য সংকটের অজুহাতে চলতি বছরের শুরু থেকে আমানত ও ঋণের বিপরীতে সুদহার ক্রমশ বাড়ছে।

এদিকে ৬ শতাংশ সুদে সরকারি সংস্থার আমানত পেতে হলে ঋণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদহার কার্যকর বাধ্যতামূলক করেছে অর্থমন্ত্রণালয়। যেসব ব্যাংক সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদহার কার্যকর করেনি সেসব ব্যাংকে সরকারি আমানত না রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রণালয় এসব ব্যাংকের তালিকা চেয়ে পাঠিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে।

ব্যাংকার্স সভায় ব্যাংকের এমডিরা জানান, বিভিন্ন কারণে গ্রাহকপর্যায়ে ৬ শতাংশ সুদে আমানত পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি সরকারি সংস্থার আমানতও পাওয়া যাচ্ছে না। ৬ শতাংশ সুদে আমানত না পেলে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়া সম্ভব নয় বলে জানান এমডিরা।

বৈঠকে শেষে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, আমানত সংগ্রহ এবং ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে নয়-ছয় সুদহার বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে চাপ নেই। তবে শুধুমাত্র ঘোষণা দিয়ে নয়-ছয় সুদহার বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। অনেকগুলো বিষয় আছে। তবে আশা করছি ভবিষ্যতে এটি বাস্তবায়ন হবে। মাহবুবুর রহমান বলেন, আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি কমতে শুরু করেছে এবং রপ্তানি বাড়ছে। এক্ষেত্রে কিছুটা সুবিধা পাচ্ছে ব্যাংক। আগামী জুন প্রান্তিকে এই উদ্যোগের আরও কিছুটা বাস্তবায়ন এবং খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের নিচে নেমে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন তিনি।

বৈঠকের আলোচনার বিষয়ে তিনি বলেন, এখানে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। কিভাবে গ্রামীণ পর্যায়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ঋণ বাড়ানো যায় সেই চেষ্টাও করছে ব্যাংক খাত। আমাদের দেশের খেলাপি ঋণ মার্চ প্রান্তিকে অনেকটা বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শ অনুযায়ী আগামী প্রান্তিকে কমিয়ে আনার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি। আমরা আশা করছি এই খেলাপি ঋণ জুন প্রান্তিকে না হলেও ভবিষ্যতে ১০ শতাংশের নিচে নেমে আসবে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং পুরো ব্যাংক খাত মিলে নয়-ছয় বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে। সরকারি ব্যাংকগুলো এটা বাস্তবায়ন করলেও বেসরকারি ব্যাংকগুলো কেন পারছে না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সব বেসরকারি ব্যাংকেই যে ৯ শতাংশের ওপরে সুদ নিচ্ছে তা নয়। কিছু কিছু বেসরকারি ব্যাংকও এটা বাস্তবায়ন করেছে। তবে সবগুলো ব্যাংকের এই সুদহার বাস্তবায়নে কিছুটা সময় প্রয়োজন। আমরা সবাই মিলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি।

সোমবার, ২২ জুলাই ২০১৯ , ৭ শ্রাবন ১৪২৫, ১৮ জিলকদ ১৪৪০

‘ঘোষণা দিয়ে ঋণ আমানতে সুদহার নয়-ছয় সম্ভব নয়’

অর্থনৈতিক বার্তা পরিবেশক

সরকারের পক্ষ থেকে আমানত এবং ঋণের সুদহার যথাক্রমে ছয় এবং নয় শতাংশ হার করার বিষয়ে চাপ থাকলেও শুধু ঘোষণা দিয়ে এটি সম্ভব নয় বলে মনে করছেন ব্যাংকাররা। বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করতে হবে। এছাড়া নয় শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণ করতে হলে ৬ শতাংশ আমানতের দাবি করছেন ব্যাংকের এমডিরা। তবে এটি বাস্তবায়নের চেষ্টা করছেন বলেও তারা জানিয়েছেন।

গতকাল এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের এক বৈঠক শেষে তারা এসব কথা বলেন। এটি ছিল ধারাবাহিক ত্রৈমাসিক বৈঠক। এতে সভাপতিত্ব করেন গভর্নর ফজলে কাবির। এছাড়া বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীরা ছাড়াও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। গতকালের সভায় আলোচ্যসূচির মধ্যে ছিল সামষ্টিক অর্থনীতি পর্যালোচনা, শীর্ষ ঋণগ্রহীতাদের মনিটরিং ও আদায় কার্যক্রম, অবলোপন নীতিমালা পর্যালোচনা, এসএমই খাতে ঋণ প্রদান। বিবিধ বিষয় হিসেবে ঋণ সিংগেল ডিজিট সুদহার নির্ধারণ নিয়ে পর্যালোচনা হয়।

জানা গেছে, ব্যাংকের মালিকরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সুদ কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা বাস্তবায়ন করেননি। বছরজুড়ে নানা অজুহাত দেখিয়েছেন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা (এমডি)। সম্প্রতি সরকারি সংস্থার আমানত পেতে হলে নয়-ছয় কার্যকর বাধ্যতামূলক করেছে অর্থমন্ত্রণালয়। এখন ব্যাংকের এমডিরা দাবি করেছেন ৯ শতাংশ ঋণ বিতরণ করতে হলে তার আগে ৬ শতাংশ আমানত প্রয়োজন।

গত বছরের জুলাই থেকে ব্যাংকের মালিকরা ঋণ সর্বোচ্চ ৯ এবং আমানতে সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ (নয়Ñছয়) কার্যকরের ঘোষণা দেন। প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে সুদহার কমানোর প্রতিশ্রুতি দেন ব্যাংকের মালিকরা। এজন্য নীতিগত অন্তত ৪টি সুবিধা হাতিয়ে নেয়া হয়। এরমধ্যে রয়েছে নগদ জমা সংরক্ষণ (সিআরআর) কমানো, রেপো রেট কমানো ও মেয়াদ বৃদ্ধি, সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখা এবং মুনাফার ওপর কর কমানো। এরপর বিভিন্ন ব্যাংক বোর্ড সভায় নয়-ছয় সুদহার নির্ধারণ করা হয়েছে বলে ঘোষণা দেয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সরকারি ব্যাংক ছাড়া আর কোন ব্যাংকই এটি কার্যকর করেনি। বরং তারল্য সংকটের অজুহাতে চলতি বছরের শুরু থেকে আমানত ও ঋণের বিপরীতে সুদহার ক্রমশ বাড়ছে।

এদিকে ৬ শতাংশ সুদে সরকারি সংস্থার আমানত পেতে হলে ঋণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদহার কার্যকর বাধ্যতামূলক করেছে অর্থমন্ত্রণালয়। যেসব ব্যাংক সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদহার কার্যকর করেনি সেসব ব্যাংকে সরকারি আমানত না রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রণালয় এসব ব্যাংকের তালিকা চেয়ে পাঠিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে।

ব্যাংকার্স সভায় ব্যাংকের এমডিরা জানান, বিভিন্ন কারণে গ্রাহকপর্যায়ে ৬ শতাংশ সুদে আমানত পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি সরকারি সংস্থার আমানতও পাওয়া যাচ্ছে না। ৬ শতাংশ সুদে আমানত না পেলে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়া সম্ভব নয় বলে জানান এমডিরা।

বৈঠকে শেষে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, আমানত সংগ্রহ এবং ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে নয়-ছয় সুদহার বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে চাপ নেই। তবে শুধুমাত্র ঘোষণা দিয়ে নয়-ছয় সুদহার বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। অনেকগুলো বিষয় আছে। তবে আশা করছি ভবিষ্যতে এটি বাস্তবায়ন হবে। মাহবুবুর রহমান বলেন, আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি কমতে শুরু করেছে এবং রপ্তানি বাড়ছে। এক্ষেত্রে কিছুটা সুবিধা পাচ্ছে ব্যাংক। আগামী জুন প্রান্তিকে এই উদ্যোগের আরও কিছুটা বাস্তবায়ন এবং খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের নিচে নেমে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন তিনি।

বৈঠকের আলোচনার বিষয়ে তিনি বলেন, এখানে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। কিভাবে গ্রামীণ পর্যায়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ঋণ বাড়ানো যায় সেই চেষ্টাও করছে ব্যাংক খাত। আমাদের দেশের খেলাপি ঋণ মার্চ প্রান্তিকে অনেকটা বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শ অনুযায়ী আগামী প্রান্তিকে কমিয়ে আনার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি। আমরা আশা করছি এই খেলাপি ঋণ জুন প্রান্তিকে না হলেও ভবিষ্যতে ১০ শতাংশের নিচে নেমে আসবে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং পুরো ব্যাংক খাত মিলে নয়-ছয় বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে। সরকারি ব্যাংকগুলো এটা বাস্তবায়ন করলেও বেসরকারি ব্যাংকগুলো কেন পারছে না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সব বেসরকারি ব্যাংকেই যে ৯ শতাংশের ওপরে সুদ নিচ্ছে তা নয়। কিছু কিছু বেসরকারি ব্যাংকও এটা বাস্তবায়ন করেছে। তবে সবগুলো ব্যাংকের এই সুদহার বাস্তবায়নে কিছুটা সময় প্রয়োজন। আমরা সবাই মিলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি।