ডেঙ্গুর প্রকোপ অপ্রতিরোধ্য

ভেঙে পড়ছে হাসপাতালের সেবা ব্যবস্থাপনা

ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়েছে। প্রতিদিনই ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীর ভিড়ে রাজধানীর প্রায় সব হাসপাতালে সেবা ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়ছে। রোগী সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক ও নার্সরা। শিশু-কিশোর, বৃদ্ধ ও নারী-পুরুষসহ সব বয়সের মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছে। গত দু’দিন রাজধানীর ৬টি হাপাতাল ঘুরে এমন চিত্রই পাওয়া যায়।

ঢামেকে হিমশিম অবস্থা : ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীদের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) ও হাসপাতালের চিকিৎসকরা। রোববার সরেজমিনে ঢামেক হাসপাতালে দেখা গেছে, ডেঙ্গুজ্বরের চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত ওয়ার্ড ও বেডগুলো (বিছানা) রোগীতে ভর্তি। রোগীর স্বজনদের ভিড়ে হাঁটারও জায়গা মিলছে না। বেড খালি না থাকায় হাসপাতালগুলোর ফ্লোরে রোগীদের জরুরি চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। রোগী ও স্বজনদের ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক ও নার্সরা।

রোববার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে ঢামেক হাসপাতালের নতুন ভবনের ছয় ও সাততলায় দেখা গেছে, পুরো ওয়ার্ডেই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা চলছে। একটি বেডও খালি নেই। সব কক্ষের সামনের হাঁটার জায়গায় অতিরিক্ত বেড রেখে ও ফ্লোরে রোগীদের চিকিৎসা চলছে। ঢামেকের জরুরি বিভাগেও ডেঙ্গু রোগীদের ভিড় দেখা গেছে। রোগীর স্বজনরা এদিক-সেদিক ছুটছেন চিকিৎসকদের খোঁজে। নতুন ভবনে চিকিৎসকদের এক সহকারী (অ্যাটেনডেন্ট) বলেন, ‘গড়ে একটি ওয়ার্ডে দুই শতাধিক ব্যক্তি এখানে ডেঙ্গুজ¦রের চিকিৎসা নিচ্ছেন। একদিকে চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে অনেক রোগী বাড়ি ফিরছেন, আরেকদিকে স্রোতের মতো ডেঙ্গু আক্রান্তরা চিকিৎসা নিতে আসছেন। কিন্তু বেড না থাকায় সব রোগীকে ভর্তি নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। রোগীর অবস্থা অনুযায়ী চিকিৎসা দিয়ে বাড়ি ফেরত পাঠানো হচ্ছে।’ ঢামকের ৬০৩ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছেন রাজধানীর বনানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষিকা। তিনি বলেন, ‘আমি ডেঙ্গুজ¦রে আক্রান্ত। পুরো শরীর ব্যথায় কাবু। চার দিন আগে এখানে ভর্তি হয়েছি। ডাক্তাররা নিয়মিত আসছেন। চিকিৎসাও ভালো হচ্ছে। কিন্তু জ¦র পুরোপুরি ছাড়ছে না। ব্যথার যন্ত্রণায় কাতর।’

একই ওয়ার্ডের ফ্লোরে অতিরিক্ত বিছানায় প্রায় ৭০ বছরের এক বৃদ্ধাকে স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে। পাশে বসা তার ছেলে জামাল মিয়া বলেন, ‘কুমিল্লায় চিকিৎসা না পেয়ে গত ১৯ জুলাই মাকে এখানে ভর্তি করিয়েছি। ডেঙ্গুজ¦র ৮ দিন গেল। ভালো-খারাপ তেমন কিছু জানাননি ডাক্তাররা। মাঝে মধ্যে মায়ের অবস্থা খারাপ হলে নার্সদের কাছে দৌড়াদৌড়ি করি। তখন তারা এসে স্যালাইন লাগান।’

ঢামেক সূত্র জানায়, ঢামেক হাসপাতালে ২৬ জুলাই সকাল ১০টা থেকে ২৭ জুলাই সকাল ১০টা পর্যন্ত একদিনে ২৩৩ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হন। তা এই হাসপাতালে রেকর্ড। ২৮ জুলাই এই সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পায়। তবে আগের দিনের তুলনায় গতকাল ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর ভিড় কিছুটা কম থাকলেও বেড খালি না থাকায় সবাইকে ভর্তি নেয়া সম্ভব হচ্ছে না।

মুগদা জেনারেল হাসপাতাল : ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় হিমশিম খাচ্ছে রাজধানীর ‘৫০০ শয্যার মুগদা জেনারেল হাসপাতাল’। হাসপাতালটির প্রায় সব বিছানায় নারী, পুরুষ ও শিশুতে পরিপূর্ণ। রোগীর চাপ বাড়তে থাকায় কয়েকদিন ধরেই বিভিন্ন ফ্লোরে রোগী ভর্তি নেয়া হচ্ছে। হাসপাতালের নবম তলায় সারি সারি বিছানায় প্রায় দু’শতাধিক ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছেন।

গতকাল দুপুর দেড়টার দিকে মুগদা জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগে দেখা গেছে, রোগী ও তাদের স্বজনদের ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক ও নার্সরা। যত রোগী আসছেন, তাদের প্রায় অর্ধেকই ডেঙ্গু বা সাধারণ জ¦রে আক্রান্ত। এ জন্য চিকিৎসকরা জ্বরে আক্রান্ত প্রায় সব রোগীকে ডেঙ্গু আক্রান্ত কিনা টেস্ট (সিভিসি) করার পরামর্শ দিচ্ছেন।

কর্তব্যরত এক চিকিৎসক বলেন, ‘বর্তমানে এই হাসপাতালে রোগীর ধারণক্ষমতার চেয়ে প্রায় দিগুণ বেশি ভর্তি রয়েছেন। একটি বেডও খালি নেই। এরপরও গুরুত্বর অসুস্থ, বিশেষ করে জ¦রে আক্রান্ত রোগীদের বিভিন্ন ওয়ার্ডের ফ্লোরে ভর্তির সুপারিশ করা হচ্ছে।’

হাসপাতালের অষ্টম তলায় শিশু বিভাগে দেখা গেছে একই অবস্থা দেখা যায়। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত কোমলমতি শিশুরা কাতরাচ্ছে। তাদের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন শিশুদের স্বজন, নার্স ও চিকিৎসরা।

বেলা ২টার দিকে ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে হাসপাতালের নিচতলায় জরুরি বিভাগে চিকিৎসার জন্য আসেন ৮-১০ রোগী। তাদের অর্ধেকই জ্বরে আক্রান্ত। এ সময় কর্তৃব্যরত চিকিৎসককে রোগী সামলাতে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করতে দেখা গেছে। কারণ এ সময় জরুরি বিভাগের বিছানা ও চিকিৎসকের কক্ষে প্রায় ২৫-৩০ রোগী ছিলেন। আবার অনেক রোগীকে হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেয়ার পরাপর্শ দিয়ে ফেরত পাঠাচ্ছেন চিকিৎসাপত্র বিতরণকারী কর্মীরা।

শিশু রিয়াদুলকে কোলে নিয়ে জরুরি বিভাগে যান তার বাবা, সঙ্গে ছিলেন মাসহ দুই স্বজন। এ শিশু তিন দিন ধরে জ¦রে ভুগছে। চিকিৎসক ওই শিশুকে জরুরি ওষুধপত্র লিখে দেয়ার পাশাপাশি ‘সিভিসি’ টেস্ট করানোর পরারমর্শ দেন। এ সময় শিশুর মা-বাবাকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে বেড খালি নেই, ভর্তি নেয়া যাচ্ছে না। বাসায় নিয়ে টেক কেয়ার করেন। ডেঙ্গু মহামারী রূপ নিচ্ছে। এ জন্য কারও জ্বর হলে গাফিলতি করবেন না, ডেঙ্গু কিনা পরীক্ষা করান।’ এ সময় শিশুর বাবা বলেন, ‘আমি বাসাবো এলাকায় থাকি। বাসাবো ও খিলগাঁও এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালেও ছেলেকে ভর্তি করাতে পারিনি। কেউ জ¦রের রোগীকে ভর্তি নিতে চান না।’

ক্ষুদে ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে নবম তলার ফ্লোরে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘আমি ২ দিন জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার পর ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরামর্শ দেন। পরীক্ষায় আমার ডেঙ্গু ধরা পড়ে। মাঝে মধ্যে বমি, শরীর ব্যথা করছে। খাবারও খেতে পারছি না। তবে ডাক্তাররা চিকিৎসা ভালো দিচ্ছেন। জ্বর কমছে।’

সোহরাওয়ার্দী ও শিশু হাসপাতাল : রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং ঢাকা শিশু হাসপাতালে পর্যাপ্ত আসন না থাকায় ফ্লোরে রাখা হয়েছে বেশিরভাগ ডেঙ্গু রোগীকে। তিন থেকে চার দিন ভর্তি থেকেও আসন পাচ্ছেন না অনেক রোগী। হাসপাতালের পরিবেশও রোগীদের জন্য উপযুক্ত নয় বলে জানিয়েছেন রোগী ও তাদের স্বজনরা। অনেকে অভিযোগ করেছেন, অন্য সুযোগ-সুবিধা তো দূরের কথা, ডেঙ্গু রোগের প্রাথমিক চিকিৎসায় ব্যবহৃত স্যালাইন ও মশারিও ঠিকমতো দিচ্ছে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। গত রোববার হাসপাতাল দুটি ঘুরে এমন চিত্র উঠে এসেছে।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে দেখা গেছে, হাসপাতালের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার ফ্লোরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত অনেক রোগীকে রাখা হয়েছে। বেশিরভাগই কয়েকদিন হাসপাতালে ভর্তি থাকলেও আসন মেলেনি। প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে ডেঙ্গু রোগীকে স্যালাইন খাওয়াতে বলা হলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পর্যাপ্ত স্যালাইন সরবরাহ করছে না।

এক রোগী আবদুল রাকিব সংবাদকে জানান, জ্বরে আক্রান্ত হয়ে তিন দিন আগে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন তিনি। ডেঙ্গু টেস্ট রিপোর্ট হাতে পেয়েছেন রোববার। অর্থাৎ টেস্ট রিপোর্ট পেতেই সময় লেগেছে তিন দিন। রিপোর্ট পাওয়ার পরও আসন না পাওয়ায় এখন তিনি নিচতলার ফ্লোরে অবস্থান করছেন। কবে আসন পাবেন, তা জানা নেই তার।

হাসপাতালের পরিচালক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া সংবাদকে বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালের মোট আসন সংখ্যা ৮৫০। বর্তমানে রোগী ভর্তি রয়েছেন মোট ১ হাজার ৫০০ জন। অর্থাৎ যে পরিমাণ আসন রয়েছে, এর চেয়ে অনেক রোগী অলরেডি ভর্তি আছে। এর মধ্যে ডেঙ্গু রোগী রয়েছেন ২১৭ জন। বর্তমানে যে পরিমাণ রোগী আসছেন, এতে সবাইকে আসন দেয়া সম্ভব নয়। আমরা ঢাকার রোগী সামাল দিতেই পারছি না। এর মধ্যে ঢাকার বাইরে থেকেও রোগী আসা শুরু করেছে।’

অনেক রোগী ও তাদের স্বজনদের অভিযোগ, হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর কারণে অনেক সুস্থ মানুষও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রাতে ঘুমানোর জন্য মশারি দিচ্ছে না। এই অভিযোগ অস্বীকার করে পরিচালক বলেন, ‘রোগীদের মশারি দেয়া হচ্ছে না এমন অভিযোগ সঠিক নয়। আমরা প্রত্যেক রোগীকে মশারি দিয়েছি। ডেঙ্গু রোগ বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও রোগী সবাইকে সচেতন হতে হবে।’

একই অবস্থা এর পাশে অবস্থিত ঢাকা শিশু হাসপাতালের। সেখানে দেখা গেছে, হাসপাতালের জরুরি বিভাগে উপচেপড়া ভিড়। পর্যাপ্ত আসন না থাকায় অনেকেই আসন পাচ্ছে না। প্রতিদিনই নতুন রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এ জন্য হাসপাতালটিতে ডেঙ্গু সেল নামে আলাদা একটি সেল চালু করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. সাফি আহম্মেদ সংবাদকে বলেন, ‘প্রতিদিন নতুন রোগীর সংখ্যা বাড়ায় খুবই সমস্যায় রয়েছি। আসন সংখ্যা কম থাকায় সবাইকে আসন দিতে পারছি না। হাসপাতালের আসন সংখ্যা ৬৭০টি। আগেই এই আসন পূর্ণ রয়েছে। অন্য রোগীর রিলিজ অনুসারে নতুন রোগীদের আসন দিচ্ছি। গত শনিবারই ২৪ নতুন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। বর্তমানে আমাদের হাসপাতালে মোট ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ৯৬। তাদের মধ্যে ১২ জনের অবস্থা খুবই আশঙ্কাজনক। তাদের আইসিইউয়ে রাখা হয়েছে।’ শিশু হাসপাতালের সব ডাক্তারই ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শিশু হাসপাতাল এমন একটি হাসপাতালÑ যেখানে সব ডাক্তারই ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তাই আমাদের এখানে ডেঙ্গু রোগের টেস্ট রিপোর্ট ৩০ থেকে ৪০ মিনিটেই প্রদান করি। এতে সুবিধা হয়, যারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত নয়Ñ তাদের রিলিজ দিয়ে নতুন রোগী ভর্তি করা যায়।’ তবে রোগীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পেলেও ডেঙ্গুকে মহামারী বলতে নারাজ তিনি। তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গু প্রতিরোধে আমাদের সচেতন হতে হবে। আমাদের বাসাবাড়ির আশপাশে বদ্ধপানির উৎসগুলো ধংস করতে হবে। ডেঙ্গু এখনও মহামারী আকার ধারণ করেনি। বর্তমানে ডেঙ্গুতে যে পরিমাণ রোগী মারা গেছেন, এর চেয়ে বেশি মানুষ টাইফয়েডেই মারা যান। তাই ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কিন্তু সচেতনতা বাড়াতেই হবে। নয়তো মহামারী আকার ধারণ করতে পারে।’

হাসপাতালটির নার্সরা জানান, বর্তমানে ৮৪টি বেডে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। আইসিইউয়ে চিকিৎসাধীন ডেঙ্গু জ্বরেআক্রান্ত ১২ শিশু। এছাড়া গত রোববার থেকে হাসপাতালের বহির্বিভাগে ‘ডেঙ্গু ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার’ খোলা হয়েছে। এই সেন্টার থেকে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত শিশুর অভিভাবকরা সহজেই ভর্তি সংক্রান্ত সব তথ্য পাচ্ছেন।

বেসরকারি হাসপাতালেও ঠাই নেই : অ্যাডিশ মশার কামড়ে আক্রান্ত হয়ে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীদের ঠাঁই হচ্ছে না বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং ক্লিনিকগুলোয়। সরকারি হাসপাতালে বেড না পেয়ে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীদের নিয়ে বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় ছুটছে স্বজনরা। সেখানেও বেড মিলছে না। ঢাকায় হাসপাতালগুলোয় ভর্তি হতে না পেরে অনেকেই ছুটে যাচ্ছেন বিভাগীয় শহরের সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালগুলোয়। বেসরকারি ছোট হাসপাতালেও রোগীর চাপ বাড়তে শুরু করেছে। অনেকেই আবার অর্থের অভাবে স্বল্প খরচে চিকিৎসা নিতে নামহীন হাসপাতালগুলোতেও ছুটছেন। রোববার পর্যন্ত সারাদেশে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে ৩৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত ১০ হাজারেরও বেশি ছাড়িয়ে গেছে।

ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলায় জ্বরে আক্রান্ত হন স্বর্ণ ব্যবসায়ী উত্তম কুমার বণিক। এরপর স্থানীয় হাসপাতালে রক্ষ পরীক্ষায় জানতে পারেন তিনি ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত। দ্রুত মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে আসেন চিকিৎসা নিতে। সিট না পেয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালসহ রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে সকাল থেকে শুরু করে রাত পর্যন্ত ভর্তি হওয়ার জন্য ছোটাছুটি করেন। কোথাও সিট না পেয়ে শেষ পর্যন্ত পপুলার মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ২৭ জুলাই রাত ১০টায় ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। বেসরকারি ওই মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হতে তাকে কত টাকা গুনতে হবে, এ হিসাব কষছেন না এ স্বর্ণ ব্যবসায়ী। সিট পেয়ে চিকিৎসা করাতে পারছেনÑ এতেই তার সন্তুষ্টিÍ।

ধানমন্ডি, পান্থপথ এলাকায় কয়েকটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং ক্লিনিক ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। প্রতিটি মেডিকেল কলেজ ও হাপসপাতাল এবং ক্লিনিকে ডেঙ্গু রোগীদের উপচেপড়া ভিড়।

রোববার সরেজিমনে পরিদর্শন করা হয় পপুলার মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ল্যাবএইড হাসপাতাল, গণস্বাস্থ্য মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, আনোয়ার খান মর্ডান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ধানমন্ডি সেন্ট্রাল হাসপাতাল, শমরিতা হাসপাতাল, বিএবি হাসপাতাল ও স্কয়ার হাসপাতাল। এসব মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং ক্লিনিকগুলোয় প্রতিদিন রোগীরা ছুটছেন ভর্তি হওয়ার জন্য। তাদের মধ্যে অনেকেই সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা অথবা সিট না পেয়ে আসছেন আবার অনেকেই ভালো চিকিৎসার আশায় আসছেন।

দুপুরে পপুলার মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে দেখা গেছে, ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত ১০ থেকে ১২ রোগীর স্বজনরা অপেক্ষায় আছেন ভর্তি হওয়ার জন্য। কিন্তু বেড খালি না থাকায় তাদের ভর্তি দিতে পারছে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

পপুলার মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ডিএম সুকুমার চন্দ্র সাহা জানান, তাদের হাসপাতালে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দিতে চরম হিমশিম পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে চিকিৎসকদের। দিনে দিনে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। হাসপাতালে পর্যাপ্ত বেড না থাকায় তারা অনেক রোগী ভর্তি নিতে পারছেন না। তবে তাদের আন্তরিকার কোন অভাব নেই।

ল্যাবএইড হাসপাতালেও ডেঙ্গু রোগীর ব্যাপক চাপ বাড়ছে। রোববার ৯ রোগী অপেক্ষায় ছিলেন ভর্তি হওয়ার জন্য। দুপুর পর্যন্ত বেড খালি না থাকায় ৯ রোগীকে ভর্তি নিতে পারেননি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

ল্যাবএইডের কো-অর্ডিনেটর ডা. এমডি মাহমুদুল হাসান জানান, ১ জুলাই থেকে রোববার পর্যন্তু তারা ১০৩ রোগীকে চিকিৎসা দিয়েছেন। বর্তমানে নারী পুরুষ ও শিশুসহ ৭৪ জন ভর্তি রয়েছেন। ২৭ জন চিকিৎসা শেষে ছাড়পত্র নিয়েছে।

গণস্বাস্থ্য মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে হাসপাতালে ৮০ শতাংশ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি। নারী-পুরুষ ও শিশু ওয়ার্ডে ডেঙ্গু রোগীতে পূর্ণ। ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত মীর গ্রুপের কর্মকর্তা আশরাফ আলীর শুক্রবার বিকেলে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। এ হাসপাতালে রক্ত পরীক্ষা করে ডেঙ্গুজ্বর থাকার বিষয়টি ধরা পড়ার পর সঙ্গে সঙ্গে তিনি ভর্তি হন। একই অবস্থা ময়মনসিংহের শেরপুর উপজেলা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র ইকবাল হোসেনের। ১৫ দিন আগে ভুতেরগলির বাসিন্দা বড় ভাই খোরশেদ আলমের বাসায় বেড়াতে আসেন তিনি। গত বুধবার ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হওয়ার পর তিনি এ হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

ধানমন্ডি সেন্ট্রাল হাসপাতালে দেখা গেছে, ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীদের ভিড় চরমে। বেড সংখ্যা বাড়িয়েও রোগী ভর্তি নেয়া যাচ্ছে না। হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. একেএম মাজাহার হোসাইন জানান, ডেঙ্গুর প্রাদর্ভাব বাড়ায় তারা আরও ১৪টি বেড বাড়িয়েছেন। এতেও রোগীর চাপ সামলানো যাচ্ছে না। আরও বেড সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করছেন তারা।

স্কয়ার হাসপাতালে রোববার পর্যন্ত ৬৭ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হয়েছেন ১৭ জন। এ পর্যন্ত ৩৬৯ জন ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন।

গ্রিন রোডে গ্রিন লাইফ হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিদিন গড়ে ১২০ জন ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য আসেন।

পান্থপথে শমরিতা ও বিআরবি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের বিষয়ে তথ্য দিতে অপরাগতা প্রকাশ করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। পরিচালক না থাকার অজুহাতে আনোয়ার খান মর্ডান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ডেঙ্গু রোগীর তথ্য দেয়নি। তবে এসব হাসপাতালে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীদের অধিকাংশই বিত্তবান। কারণ এসব হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যয় অনেক বেশি।

বাড়ছে রোগী : শুক্রবার সকাল ৭টা থেকে গত শনিবার ২৪ ঘণ্টায় ঢামেক হাসপাতালে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি আছেন ৬৫৮, মিটফোর্ড হাসপাতালে ২০০, ঢাকা শিশু হাসপাতালে ৮৭, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ২০৭, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ১৭২, বারডেম হাসপাতালে ৩৩, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ১০১, মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ১৯৪ এবং বিজিবি হাসপাতালে ১৯৯ রোগী ভর্তি আছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে গত ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হয়েছেন ২০৬ জন।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন্স সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী ২০০০ সালে ডেঙ্গু রোগী ছিলেন ৫ হাজার ৫৫১, ২০০১ সালে ২ হাজার ৪৩০, ২০০২ সালে ৬ হাজার ২৩২, ২০০৩ সালে ৪৮৬, ২০০৪ সালে ৩ হাজার ৪৩৪, ২০০৫ সালে ১ হাজার ৪৮, ২০০৬ সালে ২ হাজার ২০০, ২০০৭ সালে ৪৬৬, ২০০৮ সালে ১ হাজার ১৫৩, ২০০৯ সালে ৪৭৪, ২০১০ সালে ৪০৯, ২০১১ সালে ১ হাজার ৩৫৯, ২০১২ সালে ৬৭১, ২০১৩ সালে ১ হাজার ৭৪৯, ২০১৪ সালে ৩৭৫, ২০১৫ সালে ৩ হাজার ১৬২, ২০১৬ সালে ৩ হাজার ৬০, ২০১৭ সালে ২ হাজার ৭৬৯ ও গত বছর ২০১৮ সালে ১০ হাজার ১৪৮ জন। এছাড়া ঢাকার জেলার বাইরেও এবারে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা গেছে। এ পর্যন্ত ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বিভাগ, জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে ৩৭৩ ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন্স সেন্টার ও কন্ট্রোল ররুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়শা আক্তার বলেন, ‘২০১৮ সালে বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হন ১০ হাজার ১৩৮ রোগী। সেটি ছিল এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ। কিন্তু এ বছর ওই সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে।’ ২০০০ সালে মারা গিয়েছিলেন ৯৩, ২০০১ সালে ৪৪, ২০০২ সালে ৫৮, ২০০৩ সালে ১০, ২০০৪ সালে ১৩, ২০০৫ সালে ৪, ২০০৬ সালে ১১, ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত এবং ২০১৪ সালে কেউ মারা যাননি। আবার ২০১১ সালে ৬, ২০১২ সালে ১, ২০১৩ সালে ২, ২০১৫ সালে ৬, ২০১৬ সালে ১৪, ২০১৭ সালে ৮ ও ২০১৮ সালে ২৬ জন মারা যান।

image

ডেঙ্গু আক্রান্তদের ভিড় রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে। বেড না পেয়ে মেঝেতে শুয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন রোগীরা -সংবাদ

আরও খবর
সমন্বিত প্রচেষ্টায় ডেঙ্গু ও বন্যার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা হবে : কাদের
মায়ানমারকে ২৫ হাজার রোহিঙ্গার নতুন তালিকা দিল বাংলাদেশ
‘ভুল মশার ওপর পরীক্ষায় ওষুধ কার্যকর হচ্ছে না’
বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের প্রথম অধিনায়ক শামিম কবির আর নেই
বিভিন্ন সংগঠনের শোক
স্কয়ারসহ তিন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে তলব
মিল্কভিটা দুধ বিপণনে বাধা নেই
পানির দরে দুধ খামারিরা বিপাকে
বাংলাদেশে সবচেয়ে কম মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত
ডেঙ্গুর ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিতে পদক্ষেপ
২৪ ঘণ্টায় আরও ১০৯৬ জন আক্রান্ত মৃত্যু ৩ মৃত্যু ৩
বিদেশি গুঁড়োদুধ যেন বাজার দখল করতে না পারে
আসেনি শৃঙ্খলা কমেনি দুর্ঘটনা
দুই আসামির যাবজ্জীবন
ট্রেনের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু
মামলা হয়নি হেলমেটধারী হামলাকারীদের বিরুদ্ধে

মঙ্গলবার, ৩০ জুলাই ২০১৯ , ১৫ শ্রাবন ১৪২৫, ২৬ জিলকদ ১৪৪০

ডেঙ্গুর প্রকোপ অপ্রতিরোধ্য

ভেঙে পড়ছে হাসপাতালের সেবা ব্যবস্থাপনা

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

image

ডেঙ্গু আক্রান্তদের ভিড় রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে। বেড না পেয়ে মেঝেতে শুয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন রোগীরা -সংবাদ

ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়েছে। প্রতিদিনই ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীর ভিড়ে রাজধানীর প্রায় সব হাসপাতালে সেবা ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়ছে। রোগী সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক ও নার্সরা। শিশু-কিশোর, বৃদ্ধ ও নারী-পুরুষসহ সব বয়সের মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছে। গত দু’দিন রাজধানীর ৬টি হাপাতাল ঘুরে এমন চিত্রই পাওয়া যায়।

ঢামেকে হিমশিম অবস্থা : ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীদের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) ও হাসপাতালের চিকিৎসকরা। রোববার সরেজমিনে ঢামেক হাসপাতালে দেখা গেছে, ডেঙ্গুজ্বরের চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত ওয়ার্ড ও বেডগুলো (বিছানা) রোগীতে ভর্তি। রোগীর স্বজনদের ভিড়ে হাঁটারও জায়গা মিলছে না। বেড খালি না থাকায় হাসপাতালগুলোর ফ্লোরে রোগীদের জরুরি চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। রোগী ও স্বজনদের ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক ও নার্সরা।

রোববার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে ঢামেক হাসপাতালের নতুন ভবনের ছয় ও সাততলায় দেখা গেছে, পুরো ওয়ার্ডেই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা চলছে। একটি বেডও খালি নেই। সব কক্ষের সামনের হাঁটার জায়গায় অতিরিক্ত বেড রেখে ও ফ্লোরে রোগীদের চিকিৎসা চলছে। ঢামেকের জরুরি বিভাগেও ডেঙ্গু রোগীদের ভিড় দেখা গেছে। রোগীর স্বজনরা এদিক-সেদিক ছুটছেন চিকিৎসকদের খোঁজে। নতুন ভবনে চিকিৎসকদের এক সহকারী (অ্যাটেনডেন্ট) বলেন, ‘গড়ে একটি ওয়ার্ডে দুই শতাধিক ব্যক্তি এখানে ডেঙ্গুজ¦রের চিকিৎসা নিচ্ছেন। একদিকে চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে অনেক রোগী বাড়ি ফিরছেন, আরেকদিকে স্রোতের মতো ডেঙ্গু আক্রান্তরা চিকিৎসা নিতে আসছেন। কিন্তু বেড না থাকায় সব রোগীকে ভর্তি নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। রোগীর অবস্থা অনুযায়ী চিকিৎসা দিয়ে বাড়ি ফেরত পাঠানো হচ্ছে।’ ঢামকের ৬০৩ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছেন রাজধানীর বনানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষিকা। তিনি বলেন, ‘আমি ডেঙ্গুজ¦রে আক্রান্ত। পুরো শরীর ব্যথায় কাবু। চার দিন আগে এখানে ভর্তি হয়েছি। ডাক্তাররা নিয়মিত আসছেন। চিকিৎসাও ভালো হচ্ছে। কিন্তু জ¦র পুরোপুরি ছাড়ছে না। ব্যথার যন্ত্রণায় কাতর।’

একই ওয়ার্ডের ফ্লোরে অতিরিক্ত বিছানায় প্রায় ৭০ বছরের এক বৃদ্ধাকে স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে। পাশে বসা তার ছেলে জামাল মিয়া বলেন, ‘কুমিল্লায় চিকিৎসা না পেয়ে গত ১৯ জুলাই মাকে এখানে ভর্তি করিয়েছি। ডেঙ্গুজ¦র ৮ দিন গেল। ভালো-খারাপ তেমন কিছু জানাননি ডাক্তাররা। মাঝে মধ্যে মায়ের অবস্থা খারাপ হলে নার্সদের কাছে দৌড়াদৌড়ি করি। তখন তারা এসে স্যালাইন লাগান।’

ঢামেক সূত্র জানায়, ঢামেক হাসপাতালে ২৬ জুলাই সকাল ১০টা থেকে ২৭ জুলাই সকাল ১০টা পর্যন্ত একদিনে ২৩৩ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হন। তা এই হাসপাতালে রেকর্ড। ২৮ জুলাই এই সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পায়। তবে আগের দিনের তুলনায় গতকাল ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর ভিড় কিছুটা কম থাকলেও বেড খালি না থাকায় সবাইকে ভর্তি নেয়া সম্ভব হচ্ছে না।

মুগদা জেনারেল হাসপাতাল : ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় হিমশিম খাচ্ছে রাজধানীর ‘৫০০ শয্যার মুগদা জেনারেল হাসপাতাল’। হাসপাতালটির প্রায় সব বিছানায় নারী, পুরুষ ও শিশুতে পরিপূর্ণ। রোগীর চাপ বাড়তে থাকায় কয়েকদিন ধরেই বিভিন্ন ফ্লোরে রোগী ভর্তি নেয়া হচ্ছে। হাসপাতালের নবম তলায় সারি সারি বিছানায় প্রায় দু’শতাধিক ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছেন।

গতকাল দুপুর দেড়টার দিকে মুগদা জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগে দেখা গেছে, রোগী ও তাদের স্বজনদের ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক ও নার্সরা। যত রোগী আসছেন, তাদের প্রায় অর্ধেকই ডেঙ্গু বা সাধারণ জ¦রে আক্রান্ত। এ জন্য চিকিৎসকরা জ্বরে আক্রান্ত প্রায় সব রোগীকে ডেঙ্গু আক্রান্ত কিনা টেস্ট (সিভিসি) করার পরামর্শ দিচ্ছেন।

কর্তব্যরত এক চিকিৎসক বলেন, ‘বর্তমানে এই হাসপাতালে রোগীর ধারণক্ষমতার চেয়ে প্রায় দিগুণ বেশি ভর্তি রয়েছেন। একটি বেডও খালি নেই। এরপরও গুরুত্বর অসুস্থ, বিশেষ করে জ¦রে আক্রান্ত রোগীদের বিভিন্ন ওয়ার্ডের ফ্লোরে ভর্তির সুপারিশ করা হচ্ছে।’

হাসপাতালের অষ্টম তলায় শিশু বিভাগে দেখা গেছে একই অবস্থা দেখা যায়। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত কোমলমতি শিশুরা কাতরাচ্ছে। তাদের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন শিশুদের স্বজন, নার্স ও চিকিৎসরা।

বেলা ২টার দিকে ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে হাসপাতালের নিচতলায় জরুরি বিভাগে চিকিৎসার জন্য আসেন ৮-১০ রোগী। তাদের অর্ধেকই জ্বরে আক্রান্ত। এ সময় কর্তৃব্যরত চিকিৎসককে রোগী সামলাতে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করতে দেখা গেছে। কারণ এ সময় জরুরি বিভাগের বিছানা ও চিকিৎসকের কক্ষে প্রায় ২৫-৩০ রোগী ছিলেন। আবার অনেক রোগীকে হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেয়ার পরাপর্শ দিয়ে ফেরত পাঠাচ্ছেন চিকিৎসাপত্র বিতরণকারী কর্মীরা।

শিশু রিয়াদুলকে কোলে নিয়ে জরুরি বিভাগে যান তার বাবা, সঙ্গে ছিলেন মাসহ দুই স্বজন। এ শিশু তিন দিন ধরে জ¦রে ভুগছে। চিকিৎসক ওই শিশুকে জরুরি ওষুধপত্র লিখে দেয়ার পাশাপাশি ‘সিভিসি’ টেস্ট করানোর পরারমর্শ দেন। এ সময় শিশুর মা-বাবাকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে বেড খালি নেই, ভর্তি নেয়া যাচ্ছে না। বাসায় নিয়ে টেক কেয়ার করেন। ডেঙ্গু মহামারী রূপ নিচ্ছে। এ জন্য কারও জ্বর হলে গাফিলতি করবেন না, ডেঙ্গু কিনা পরীক্ষা করান।’ এ সময় শিশুর বাবা বলেন, ‘আমি বাসাবো এলাকায় থাকি। বাসাবো ও খিলগাঁও এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালেও ছেলেকে ভর্তি করাতে পারিনি। কেউ জ¦রের রোগীকে ভর্তি নিতে চান না।’

ক্ষুদে ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে নবম তলার ফ্লোরে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘আমি ২ দিন জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার পর ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরামর্শ দেন। পরীক্ষায় আমার ডেঙ্গু ধরা পড়ে। মাঝে মধ্যে বমি, শরীর ব্যথা করছে। খাবারও খেতে পারছি না। তবে ডাক্তাররা চিকিৎসা ভালো দিচ্ছেন। জ্বর কমছে।’

সোহরাওয়ার্দী ও শিশু হাসপাতাল : রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং ঢাকা শিশু হাসপাতালে পর্যাপ্ত আসন না থাকায় ফ্লোরে রাখা হয়েছে বেশিরভাগ ডেঙ্গু রোগীকে। তিন থেকে চার দিন ভর্তি থেকেও আসন পাচ্ছেন না অনেক রোগী। হাসপাতালের পরিবেশও রোগীদের জন্য উপযুক্ত নয় বলে জানিয়েছেন রোগী ও তাদের স্বজনরা। অনেকে অভিযোগ করেছেন, অন্য সুযোগ-সুবিধা তো দূরের কথা, ডেঙ্গু রোগের প্রাথমিক চিকিৎসায় ব্যবহৃত স্যালাইন ও মশারিও ঠিকমতো দিচ্ছে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। গত রোববার হাসপাতাল দুটি ঘুরে এমন চিত্র উঠে এসেছে।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে দেখা গেছে, হাসপাতালের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার ফ্লোরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত অনেক রোগীকে রাখা হয়েছে। বেশিরভাগই কয়েকদিন হাসপাতালে ভর্তি থাকলেও আসন মেলেনি। প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে ডেঙ্গু রোগীকে স্যালাইন খাওয়াতে বলা হলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পর্যাপ্ত স্যালাইন সরবরাহ করছে না।

এক রোগী আবদুল রাকিব সংবাদকে জানান, জ্বরে আক্রান্ত হয়ে তিন দিন আগে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন তিনি। ডেঙ্গু টেস্ট রিপোর্ট হাতে পেয়েছেন রোববার। অর্থাৎ টেস্ট রিপোর্ট পেতেই সময় লেগেছে তিন দিন। রিপোর্ট পাওয়ার পরও আসন না পাওয়ায় এখন তিনি নিচতলার ফ্লোরে অবস্থান করছেন। কবে আসন পাবেন, তা জানা নেই তার।

হাসপাতালের পরিচালক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া সংবাদকে বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালের মোট আসন সংখ্যা ৮৫০। বর্তমানে রোগী ভর্তি রয়েছেন মোট ১ হাজার ৫০০ জন। অর্থাৎ যে পরিমাণ আসন রয়েছে, এর চেয়ে অনেক রোগী অলরেডি ভর্তি আছে। এর মধ্যে ডেঙ্গু রোগী রয়েছেন ২১৭ জন। বর্তমানে যে পরিমাণ রোগী আসছেন, এতে সবাইকে আসন দেয়া সম্ভব নয়। আমরা ঢাকার রোগী সামাল দিতেই পারছি না। এর মধ্যে ঢাকার বাইরে থেকেও রোগী আসা শুরু করেছে।’

অনেক রোগী ও তাদের স্বজনদের অভিযোগ, হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর কারণে অনেক সুস্থ মানুষও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রাতে ঘুমানোর জন্য মশারি দিচ্ছে না। এই অভিযোগ অস্বীকার করে পরিচালক বলেন, ‘রোগীদের মশারি দেয়া হচ্ছে না এমন অভিযোগ সঠিক নয়। আমরা প্রত্যেক রোগীকে মশারি দিয়েছি। ডেঙ্গু রোগ বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও রোগী সবাইকে সচেতন হতে হবে।’

একই অবস্থা এর পাশে অবস্থিত ঢাকা শিশু হাসপাতালের। সেখানে দেখা গেছে, হাসপাতালের জরুরি বিভাগে উপচেপড়া ভিড়। পর্যাপ্ত আসন না থাকায় অনেকেই আসন পাচ্ছে না। প্রতিদিনই নতুন রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এ জন্য হাসপাতালটিতে ডেঙ্গু সেল নামে আলাদা একটি সেল চালু করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. সাফি আহম্মেদ সংবাদকে বলেন, ‘প্রতিদিন নতুন রোগীর সংখ্যা বাড়ায় খুবই সমস্যায় রয়েছি। আসন সংখ্যা কম থাকায় সবাইকে আসন দিতে পারছি না। হাসপাতালের আসন সংখ্যা ৬৭০টি। আগেই এই আসন পূর্ণ রয়েছে। অন্য রোগীর রিলিজ অনুসারে নতুন রোগীদের আসন দিচ্ছি। গত শনিবারই ২৪ নতুন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। বর্তমানে আমাদের হাসপাতালে মোট ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ৯৬। তাদের মধ্যে ১২ জনের অবস্থা খুবই আশঙ্কাজনক। তাদের আইসিইউয়ে রাখা হয়েছে।’ শিশু হাসপাতালের সব ডাক্তারই ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শিশু হাসপাতাল এমন একটি হাসপাতালÑ যেখানে সব ডাক্তারই ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তাই আমাদের এখানে ডেঙ্গু রোগের টেস্ট রিপোর্ট ৩০ থেকে ৪০ মিনিটেই প্রদান করি। এতে সুবিধা হয়, যারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত নয়Ñ তাদের রিলিজ দিয়ে নতুন রোগী ভর্তি করা যায়।’ তবে রোগীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পেলেও ডেঙ্গুকে মহামারী বলতে নারাজ তিনি। তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গু প্রতিরোধে আমাদের সচেতন হতে হবে। আমাদের বাসাবাড়ির আশপাশে বদ্ধপানির উৎসগুলো ধংস করতে হবে। ডেঙ্গু এখনও মহামারী আকার ধারণ করেনি। বর্তমানে ডেঙ্গুতে যে পরিমাণ রোগী মারা গেছেন, এর চেয়ে বেশি মানুষ টাইফয়েডেই মারা যান। তাই ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কিন্তু সচেতনতা বাড়াতেই হবে। নয়তো মহামারী আকার ধারণ করতে পারে।’

হাসপাতালটির নার্সরা জানান, বর্তমানে ৮৪টি বেডে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। আইসিইউয়ে চিকিৎসাধীন ডেঙ্গু জ্বরেআক্রান্ত ১২ শিশু। এছাড়া গত রোববার থেকে হাসপাতালের বহির্বিভাগে ‘ডেঙ্গু ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার’ খোলা হয়েছে। এই সেন্টার থেকে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত শিশুর অভিভাবকরা সহজেই ভর্তি সংক্রান্ত সব তথ্য পাচ্ছেন।

বেসরকারি হাসপাতালেও ঠাই নেই : অ্যাডিশ মশার কামড়ে আক্রান্ত হয়ে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীদের ঠাঁই হচ্ছে না বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং ক্লিনিকগুলোয়। সরকারি হাসপাতালে বেড না পেয়ে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীদের নিয়ে বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় ছুটছে স্বজনরা। সেখানেও বেড মিলছে না। ঢাকায় হাসপাতালগুলোয় ভর্তি হতে না পেরে অনেকেই ছুটে যাচ্ছেন বিভাগীয় শহরের সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালগুলোয়। বেসরকারি ছোট হাসপাতালেও রোগীর চাপ বাড়তে শুরু করেছে। অনেকেই আবার অর্থের অভাবে স্বল্প খরচে চিকিৎসা নিতে নামহীন হাসপাতালগুলোতেও ছুটছেন। রোববার পর্যন্ত সারাদেশে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে ৩৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত ১০ হাজারেরও বেশি ছাড়িয়ে গেছে।

ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলায় জ্বরে আক্রান্ত হন স্বর্ণ ব্যবসায়ী উত্তম কুমার বণিক। এরপর স্থানীয় হাসপাতালে রক্ষ পরীক্ষায় জানতে পারেন তিনি ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত। দ্রুত মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে আসেন চিকিৎসা নিতে। সিট না পেয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালসহ রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে সকাল থেকে শুরু করে রাত পর্যন্ত ভর্তি হওয়ার জন্য ছোটাছুটি করেন। কোথাও সিট না পেয়ে শেষ পর্যন্ত পপুলার মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ২৭ জুলাই রাত ১০টায় ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। বেসরকারি ওই মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হতে তাকে কত টাকা গুনতে হবে, এ হিসাব কষছেন না এ স্বর্ণ ব্যবসায়ী। সিট পেয়ে চিকিৎসা করাতে পারছেনÑ এতেই তার সন্তুষ্টিÍ।

ধানমন্ডি, পান্থপথ এলাকায় কয়েকটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং ক্লিনিক ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। প্রতিটি মেডিকেল কলেজ ও হাপসপাতাল এবং ক্লিনিকে ডেঙ্গু রোগীদের উপচেপড়া ভিড়।

রোববার সরেজিমনে পরিদর্শন করা হয় পপুলার মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ল্যাবএইড হাসপাতাল, গণস্বাস্থ্য মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, আনোয়ার খান মর্ডান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ধানমন্ডি সেন্ট্রাল হাসপাতাল, শমরিতা হাসপাতাল, বিএবি হাসপাতাল ও স্কয়ার হাসপাতাল। এসব মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং ক্লিনিকগুলোয় প্রতিদিন রোগীরা ছুটছেন ভর্তি হওয়ার জন্য। তাদের মধ্যে অনেকেই সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা অথবা সিট না পেয়ে আসছেন আবার অনেকেই ভালো চিকিৎসার আশায় আসছেন।

দুপুরে পপুলার মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে দেখা গেছে, ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত ১০ থেকে ১২ রোগীর স্বজনরা অপেক্ষায় আছেন ভর্তি হওয়ার জন্য। কিন্তু বেড খালি না থাকায় তাদের ভর্তি দিতে পারছে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

পপুলার মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ডিএম সুকুমার চন্দ্র সাহা জানান, তাদের হাসপাতালে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দিতে চরম হিমশিম পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে চিকিৎসকদের। দিনে দিনে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। হাসপাতালে পর্যাপ্ত বেড না থাকায় তারা অনেক রোগী ভর্তি নিতে পারছেন না। তবে তাদের আন্তরিকার কোন অভাব নেই।

ল্যাবএইড হাসপাতালেও ডেঙ্গু রোগীর ব্যাপক চাপ বাড়ছে। রোববার ৯ রোগী অপেক্ষায় ছিলেন ভর্তি হওয়ার জন্য। দুপুর পর্যন্ত বেড খালি না থাকায় ৯ রোগীকে ভর্তি নিতে পারেননি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

ল্যাবএইডের কো-অর্ডিনেটর ডা. এমডি মাহমুদুল হাসান জানান, ১ জুলাই থেকে রোববার পর্যন্তু তারা ১০৩ রোগীকে চিকিৎসা দিয়েছেন। বর্তমানে নারী পুরুষ ও শিশুসহ ৭৪ জন ভর্তি রয়েছেন। ২৭ জন চিকিৎসা শেষে ছাড়পত্র নিয়েছে।

গণস্বাস্থ্য মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে হাসপাতালে ৮০ শতাংশ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি। নারী-পুরুষ ও শিশু ওয়ার্ডে ডেঙ্গু রোগীতে পূর্ণ। ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত মীর গ্রুপের কর্মকর্তা আশরাফ আলীর শুক্রবার বিকেলে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। এ হাসপাতালে রক্ত পরীক্ষা করে ডেঙ্গুজ্বর থাকার বিষয়টি ধরা পড়ার পর সঙ্গে সঙ্গে তিনি ভর্তি হন। একই অবস্থা ময়মনসিংহের শেরপুর উপজেলা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র ইকবাল হোসেনের। ১৫ দিন আগে ভুতেরগলির বাসিন্দা বড় ভাই খোরশেদ আলমের বাসায় বেড়াতে আসেন তিনি। গত বুধবার ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হওয়ার পর তিনি এ হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

ধানমন্ডি সেন্ট্রাল হাসপাতালে দেখা গেছে, ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীদের ভিড় চরমে। বেড সংখ্যা বাড়িয়েও রোগী ভর্তি নেয়া যাচ্ছে না। হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. একেএম মাজাহার হোসাইন জানান, ডেঙ্গুর প্রাদর্ভাব বাড়ায় তারা আরও ১৪টি বেড বাড়িয়েছেন। এতেও রোগীর চাপ সামলানো যাচ্ছে না। আরও বেড সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করছেন তারা।

স্কয়ার হাসপাতালে রোববার পর্যন্ত ৬৭ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হয়েছেন ১৭ জন। এ পর্যন্ত ৩৬৯ জন ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন।

গ্রিন রোডে গ্রিন লাইফ হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিদিন গড়ে ১২০ জন ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য আসেন।

পান্থপথে শমরিতা ও বিআরবি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের বিষয়ে তথ্য দিতে অপরাগতা প্রকাশ করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। পরিচালক না থাকার অজুহাতে আনোয়ার খান মর্ডান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ডেঙ্গু রোগীর তথ্য দেয়নি। তবে এসব হাসপাতালে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীদের অধিকাংশই বিত্তবান। কারণ এসব হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যয় অনেক বেশি।

বাড়ছে রোগী : শুক্রবার সকাল ৭টা থেকে গত শনিবার ২৪ ঘণ্টায় ঢামেক হাসপাতালে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি আছেন ৬৫৮, মিটফোর্ড হাসপাতালে ২০০, ঢাকা শিশু হাসপাতালে ৮৭, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ২০৭, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ১৭২, বারডেম হাসপাতালে ৩৩, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ১০১, মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ১৯৪ এবং বিজিবি হাসপাতালে ১৯৯ রোগী ভর্তি আছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে গত ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হয়েছেন ২০৬ জন।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন্স সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী ২০০০ সালে ডেঙ্গু রোগী ছিলেন ৫ হাজার ৫৫১, ২০০১ সালে ২ হাজার ৪৩০, ২০০২ সালে ৬ হাজার ২৩২, ২০০৩ সালে ৪৮৬, ২০০৪ সালে ৩ হাজার ৪৩৪, ২০০৫ সালে ১ হাজার ৪৮, ২০০৬ সালে ২ হাজার ২০০, ২০০৭ সালে ৪৬৬, ২০০৮ সালে ১ হাজার ১৫৩, ২০০৯ সালে ৪৭৪, ২০১০ সালে ৪০৯, ২০১১ সালে ১ হাজার ৩৫৯, ২০১২ সালে ৬৭১, ২০১৩ সালে ১ হাজার ৭৪৯, ২০১৪ সালে ৩৭৫, ২০১৫ সালে ৩ হাজার ১৬২, ২০১৬ সালে ৩ হাজার ৬০, ২০১৭ সালে ২ হাজার ৭৬৯ ও গত বছর ২০১৮ সালে ১০ হাজার ১৪৮ জন। এছাড়া ঢাকার জেলার বাইরেও এবারে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা গেছে। এ পর্যন্ত ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বিভাগ, জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে ৩৭৩ ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন্স সেন্টার ও কন্ট্রোল ররুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়শা আক্তার বলেন, ‘২০১৮ সালে বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হন ১০ হাজার ১৩৮ রোগী। সেটি ছিল এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ। কিন্তু এ বছর ওই সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে।’ ২০০০ সালে মারা গিয়েছিলেন ৯৩, ২০০১ সালে ৪৪, ২০০২ সালে ৫৮, ২০০৩ সালে ১০, ২০০৪ সালে ১৩, ২০০৫ সালে ৪, ২০০৬ সালে ১১, ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত এবং ২০১৪ সালে কেউ মারা যাননি। আবার ২০১১ সালে ৬, ২০১২ সালে ১, ২০১৩ সালে ২, ২০১৫ সালে ৬, ২০১৬ সালে ১৪, ২০১৭ সালে ৮ ও ২০১৮ সালে ২৬ জন মারা যান।