রাহাত খান : শোক ও শ্রদ্ধাঞ্জলি

স্বনির্মিত রাহাত খান এবং ভাবনার বিশিষ্টতা

ওবায়েদ আকাশ

লেখক হিসেবে স্বীকৃতি পাবার চেয়ে বড় কথা হলো, কোনো না কোনো একটা সময় স্রষ্টার সৃষ্টির ঐশ্বর্য দিয়ে মানুষের হৃদয়ে স্পর্শ করে যাবার ক্ষমতা। এই শক্তি যে লেখক সৃষ্টি করতে পারেন, তিনি পাঠকের মনে থেকে যান, এবং ভাষার স্থায়িত্বেও তিনি মূল্যায়িত হন। আমরা যারা পাঠক, বই পড়ে মনের ক্ষুধা মেটাই, অনেক সময় স্বীকৃতিপ্রাপ্ত আবার কখনো অনালোচিত ভালো লেখকের লেখা পড়েও আনন্দ পাই। আবার কোনো কোনো সময় ভাবি, এই লেখকের লেখা সবার পড়া উচিত, তাঁকে তাঁর মেধা ও ক্ষমতার মূল্য দেয়া উচিত। কিন্তু সমাজ তার স্বনির্মিত কিংবা প্রভাবিত চোখে তাঁকে দেখতে ভুল করে। দেখে রাজনীতি অথবা অবজ্ঞার চোখে। লেখক জীবনে এ এক করুণ নিয়তি হলেও, ভালো লেখা কোনো দিন চাপা পড়ে থাকে নি। একটা না একটা সময় তা আলোর মুখ দেখেছে। পাঠক এমনকি প্রতিষ্ঠানও তাঁকে নিয়ে নেচেছে। যদিও কথাসাহিত্যিক রাহাত খান অনালোচিত লেখক ছিলেন না, অবহেলিতও ছিলেন না। নিভৃত হলেও তিনি নিজেই সরাসরি মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অনেক বড় মিডিয়ায় সর্বোচ্চ পদেও চাকরি করেছেন। যদিও তাঁর কাজের মূল্যায়ন চোখে পড়ার মতো ছিলো না। বড় কথা হলো, রাহাত খান সেদিকে ভ্রুক্ষেপও করেননি। তিনি সারাজীবন নির্লিপ্ত থেকে লিখে গেছেন।

কথাটা বলছি, পাঠাভ্যাস এবং এতে সংযুক্ত লেখক বিষয়ে। লেখক তিনি স্বীকৃতিপ্রাপ্ত কিংবা অনালোচিত মেধাবী লেখক- যাই হোন না কেন, তাঁর লেখা পড়ে পাঠকের মনে একটি মানচিত্র তৈরি হয়। সেই মানচিত্রে তিনি অনেক কিছু খুঁজে পান। এবং একটি মানচিত্রে যেমন অনেক পর্যটনস্পট কিংবা গুরুত্বপূর্ণ কিংবা আলোচিত স্থান থাকে, তেমনি লেখকের লেখার ভিতরও সেসব আলোচিত স্থান থাকে। পড়তে পড়তে একেকজনের একেকটা বিষয় থেকে আলোড়িত হই। যেমন কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক সদ্যপ্রয়াত রাহাত খানের খুব বেশি লেখা না পড়লেও তাঁর কিছু গল্প এবং উপন্যাসের পাঠউপভোগ্যতা লক্ষ্যযোগ্য। বিশেষ করে তাঁর গল্পগুলো বহুমাত্রিক আবেদনময়। অধিক আবেদন সৃষ্টিকারী তাঁর দুটি গল্পের দুটি সংলাপ আমাকে আলোড়িত করেছিল। তার একটি হলো তাঁর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গল্প “দীর্ঘ অশ্রুপাত”-এ “আমার আব্বু আসবে না?” সংলাপটি এবং “ঈমান আলীর মৃত্যু” গল্পে “আমি কার কাছে থাকতাম?” সংলাপটি রাহাত খানের কথা ভাবলেই মনে হয়। কী পাওয়ারফুল দুটি বাক্য যে, একজন মানুষের কথা মনে হলেই তারা মনে উঁকি দেয়!

প্রচলিত আছে যে, রাহাত খান একজন ব্যতিক্রমী কথাসাহিত্যিক। সে বিষয়ে সম্পূর্ণ একমত না হলেও, তাঁর অনেকখানি স্বকীয়তা অবশ্যস্বীকার্য। যেমন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর লেখালেখিতে নতুনত্ব বিশেষভাবে শনাক্তযোগ্য মনে না হলেও বিশিষ্টতা লক্ষণীয়। তাছাড়া একই ঘটনা নিয়ে ভিন্ন কিছু উপস্থাপন খুব বিরল ব্যাপার। প্রতিটি মুক্তিযুদ্ধেই বড় ঘটনা হলো প্রতিপক্ষের নির্যাতন এবং সেই নির্যাতনের বিভিন্ন প্রকার বা ধরন। আর একটি বড় বিষয় হলো, সেই যুদ্ধকে ঘিরে বিশ্বব্যাপী ¯স্নায়ুযুদ্ধ। স্নায়ুযুদ্ধের দিকটি খতিয়ে দেখলেই আসল কারণ বেরিয়ে আসে, এবং যুদ্ধের পূর্বাপর ঘটনাবলী চাক্ষুষ হয়। যেমন আমরা যদি সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশের একটি ইস্যুতে স্নায়ুযুদ্ধের কথা বলি, সেটা হচ্ছে রোহিঙ্গা ইস্যু। এর পেছনে বিশ্বের বড় কোনো কোনো দেশের রাজনীতি কাজ না করলে রোহিঙ্গারা এভাবে এদেশে ঢুকতে পারে না, কিংবা এতোদিন স্থায়ী হতে পারে না। এবং এই রোহিঙ্গারা কোনোদিন এদেশ থেকে ফিরবে বলেও মনে হয় না।

রাহাত খানের মুক্তিযুদ্ধের গল্পের কথা বলতে গিয়ে স্নায়ুযুদ্ধের প্রসঙ্গ এলো। এবং প্রতিপক্ষের নির্যাতনের কথা এলো। আর এর পরিণতিতে আমরা প্রতিনিয়ত স্বজন হারানোর বেদনা অনুভব করি। তাই মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক লেখালেখিতে নতুন কিছু অনায়াসলভ্য নয়। তবু এ নিবন্ধে রাহাত খানের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গল্পের গভীরতা সুদূরপ্রসারী। বিশেষভাবে শনাক্তযোগ্য। এ গল্পে আমরা একজন প্রখর দৃষ্টিবান রাহাত খানকে পাই আবার জাতীয় জীবনে সবচেয়ে বড় ঘটনা মুক্তিযুদ্ধও বিশেষভাবে জাজ্বল্য হয়ে রেখাপাত করে।

তার আগে কেন রাহাত খান ভিন্ন ধারার লেখকÑ এ বিষয়ে একটি ব্যক্তিগত মূল্যায়ন তুলে ধরবো। রাহাত খান সম্পর্কে আরো বলা যায় যে, আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের লেখক তিনি। মধ্যবিত্তিক টানাপোড়েনেরও তিনি নিপুণ বিশ্লেষক, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায়ও তাঁর কলম সদাসোচ্চার। কিন্তু রাহাত খানের যে বিষয়টি তৃতীয় নয়নে দেখা, সেটি তাঁর সম্পূর্ণ নিজস্ব, এবং গভীর চিন্তাজাত। “আমি কার কাছে থাকতাম?” সংলাপটি সে কারণে কখনো মন থেকে মুছে যায় না। আমরা সাধারণত দেখি যে, শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বেই, সন্তান বড় হয়ে গেলে অনেকেই পিতামাতার প্রতি অনুগত না হয়ে উল্টো অবহেলা প্রদর্শন করে। বিপরীতে বাবা-মা এতটাই সন্তানাসক্ত যে, তারা এ নিয়ে কোনো বাদানুবাদ করেন না। নিশ্চুপে সব মেনে নেন। এবং তাঁদের ভাগ্যলিপিতে আস্থা স্থাপন করে দুর্ভোগ পোহাতে থাকেন। অবহেলা অনাদরে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে চলে ঢলে পড়লেও তাতে কখনো সন্তানকে অভিসম্পাত করেন না। তবে এর ব্যতিক্রম যে নাই, তাও বলা যাবে না। বিশেষ করে যারা একাধিক বিয়ে করেন, এবং সংসারে প্রত্যেক স্ত্রীর আলাদা আলাদা সন্তানসন্ততি বা সংসার থাকে; তখন পরিবারের কর্তাব্যক্তিটি আর নিরপেক্ষ থাকতে পারে না। সে যতবার বিয়ে করবে অপেক্ষাকৃত নতুন স্ত্রী এবং তার সন্তানসন্ততির প্রতি বেশি দুর্বলতা প্রদর্শন করে থাকে। এই ব্যতিক্রম ছাড়া পিতামাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানো থেকে অবহেলা-উপেক্ষা যতোই করা হোক না কেন, তারা সাধারণত কোনোই উচ্চবাচ্য করেন না; কিছু দাবিও করেন না। কিন্তু রাহাত খানের “ঈমান আলীর মৃত্যু” গল্পে দেখা যায় এক ভিন্ন চিত্র। বন্যাকবলিত পরিবারের সন্তানেরা অভাবের তাড়নায় বাবা ঈমান আলীকে ফেলে গ্রামের বাড়ি ফিরে যেতে চাইলে, ঈমান আলী চিরাচরিত বাবার ভূমিকা থেকে ব্যতিক্রমী বাবার ভূমিকায় আবির্ভূত হন। তিনি তাঁর সন্তানদের বলেন, “আমি কার কাছে থাকতাম?” এখানে মধ্যবিত্তিক টানাপোড়েনের ভিতরে একজন প্রতিবাদী বাবাকে আবিষ্কার করা যায়। এই ধরনের ছোট ছোট অথচ ব্যাপক গভীরতা বিস্তারী সংলাপগুলো আবিষ্কারের ক্ষমতা রাহাত খানকে ভিন্ন ধারার লেখকের মর্যাদা দেয় বলে ধারণা করা সমীচিন।

তাঁর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গল্প “দীর্ঘ অশ্রুপাত”-এর কলেবর দীর্ঘ না হলেও তিনি অল্প কথায় এর ব্যাপ্তিকে এতোদূর পর্যন্ত নিয়ে গেছেন যে, যুদ্ধকালীন একটি দীর্ঘ ভ্রমণের ভিতর একজন নিরীহ মুসলমানের মৃত্যুর কথা ঘুরপাক খায়। এবং ঘুরপাক খেতে খেতে তা প্রভাবিত করে আর একটি প্রজন্মকে এবং বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ভিতর দিয়ে শেষ হয়। ঘটনার নির্মমতা উত্তর প্রজন্মকে বহন করতে হয় আমৃত্যু।

এ গল্পে যেমন পাকিস্তানী বর্বরতা,

সাম্প্রদায়িকতা স্পষ্ট, তেমনি প্রাণ বাঁচানোর আকুতিতে একজন বাঙালি মুসলমানের নানা পথ অবলম্বনের বিষয়টিও গুরুত্ব পেয়েছে।

ঘটনা ২৫ মার্চ কালরাতে। নিরীহ মুসল্লি গোছের অল্প বয়সী বাড়িওয়ালা ঘটনার সতর্কতায় একটি পাকিস্তানি পতাকা তার ছাদে লাগাতে গেলে, সিঁড়ি গেটের সামনে দুই পাকিস্তানি সৈনিকের মুখোমুখি হন। তারা তাকে জেরা করে ও কলেমা পড়তে পারে কিনা জিগ্যেস করে। কিন্তু বাড়িওয়ালা কলেমা পড়তে পেরেও ওই দুই সৈনিকের জীঘাংসার শিকার হয়ে মারা যান। ভয়ঙ্কর এ মৃত্যুর সময় বাড়িওয়ালা তার চার বছর বয়সী কন্যার নাম ধরে চিৎকার করতে থাকে।

এরপর দেশে স্বাধীনতা আসে। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরার দিন। বিমান বন্দরে গিয়েছিল সেই চার বছর বয়সী শিশু কন্যা (তখন বয়স পাঁচ বছর) ভাড়াটিয়ার কোলে চড়ে। এবং সেদিন বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে লন্ডন হয়ে দেশে ফিরে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর একা ফিরে আসা দেশে ওই শিশু কন্যাটি ভাড়াটিয়াকে জিগ্যেস করেছিলÑ “আমার বাবা আসবে না?”

রাহাত খানের শক্তিমত্তা এখানেই যে, তিনি এই বাবার ফিরে আসাকে প্রতীকী অর্থে ব্যবহার করেছেন। তিনি আসলে বোঝাতে চেয়েছেন যে, এই শিশুকন্যার পিতার মতো অনেক পিতাই নির্যাতিত হয়ে শহীদ হয়েছেন, কিন্তু যিনি ফিরে এসেছেন তিনি জাতির পিতা। তিনি সমগ্র বাঙালির পিতার অভাব ঘুচাতে এসেছেন একটি শৃঙ্খলিত জাতিকে মুক্তির স্বাদ দিয়ে, স্বাধীনতার স্বাদ দিয়ে। এখন আর কোনো বহির্শত্রুর হাতে কোনো বাঙালিকে চার বছরের কন্যার সামনে প্রাণ দিতে হবে না। কারো কথায় উঠতে বসতে হবে না। যার নেতৃত্বে এই জাতির মুক্তি ঘটল, তিনি চিরশত্রু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন। ফিরে এসেছেন মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে বাঙালি জাতির পিতা।

রাহাত খানের এই গল্পের ব্যাপ্তি বিস্মিত করে। লেখকের অসামান্যতা প্রমাণ করে।

বিশিষ্ট এই কথাশিল্পী ১৯৪০ সালে কিশোরগঞ্জ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৬৯ সালে দৈনিক সংবাদে চাকরির ভিতর দিয়ে সাংবাদিকতায় প্রবেশ করেন। তাঁর দীর্ঘ ক্যারিয়ার তৈরি হয় দৈনিক ইত্তেফাকে। তিনি ইত্তেফাকের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকরে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭২ সালে তিনি “অনিশ্চিত লোকালয়” নামে প্রথম গ্রন্থ প্রকাশ করেন। ছায়াদম্পতি, শহর, অমল ধবল চাকরি, হে শূন্যতা, হে অনন্তের পাখি, মধ্যমাঠের খেলোয়াড়সহ আরো বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেন।

একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ অনেক সম্মাননা লাভ করেছেন। বন্ধু কাজী আনোয়ার হোসেন রচিত মাসুদ রানা সিরিজের সেই রাহাত খানের ৮০ বছরের জীবন এক বর্ণাঢ্য আখ্যান।

বাংলা, বাঙালি, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুপ্রেমি অসাম্প্রদায়িক এই লেখকের প্রয়াণে গভীর শোক ও শ্রদ্ধা জানাই।

বৃহস্পতিবার, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ১৩ মহররম ১৪৪২, ১৭ ভাদ্র ১৪২৭

রাহাত খান : শোক ও শ্রদ্ধাঞ্জলি

স্বনির্মিত রাহাত খান এবং ভাবনার বিশিষ্টতা

ওবায়েদ আকাশ

image

রাহাত খান / জন্ম : ১৮ ডিসেম্বর ১৯৪০; মৃত্যু : ২৮ আগস্ট ২০২০

লেখক হিসেবে স্বীকৃতি পাবার চেয়ে বড় কথা হলো, কোনো না কোনো একটা সময় স্রষ্টার সৃষ্টির ঐশ্বর্য দিয়ে মানুষের হৃদয়ে স্পর্শ করে যাবার ক্ষমতা। এই শক্তি যে লেখক সৃষ্টি করতে পারেন, তিনি পাঠকের মনে থেকে যান, এবং ভাষার স্থায়িত্বেও তিনি মূল্যায়িত হন। আমরা যারা পাঠক, বই পড়ে মনের ক্ষুধা মেটাই, অনেক সময় স্বীকৃতিপ্রাপ্ত আবার কখনো অনালোচিত ভালো লেখকের লেখা পড়েও আনন্দ পাই। আবার কোনো কোনো সময় ভাবি, এই লেখকের লেখা সবার পড়া উচিত, তাঁকে তাঁর মেধা ও ক্ষমতার মূল্য দেয়া উচিত। কিন্তু সমাজ তার স্বনির্মিত কিংবা প্রভাবিত চোখে তাঁকে দেখতে ভুল করে। দেখে রাজনীতি অথবা অবজ্ঞার চোখে। লেখক জীবনে এ এক করুণ নিয়তি হলেও, ভালো লেখা কোনো দিন চাপা পড়ে থাকে নি। একটা না একটা সময় তা আলোর মুখ দেখেছে। পাঠক এমনকি প্রতিষ্ঠানও তাঁকে নিয়ে নেচেছে। যদিও কথাসাহিত্যিক রাহাত খান অনালোচিত লেখক ছিলেন না, অবহেলিতও ছিলেন না। নিভৃত হলেও তিনি নিজেই সরাসরি মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অনেক বড় মিডিয়ায় সর্বোচ্চ পদেও চাকরি করেছেন। যদিও তাঁর কাজের মূল্যায়ন চোখে পড়ার মতো ছিলো না। বড় কথা হলো, রাহাত খান সেদিকে ভ্রুক্ষেপও করেননি। তিনি সারাজীবন নির্লিপ্ত থেকে লিখে গেছেন।

কথাটা বলছি, পাঠাভ্যাস এবং এতে সংযুক্ত লেখক বিষয়ে। লেখক তিনি স্বীকৃতিপ্রাপ্ত কিংবা অনালোচিত মেধাবী লেখক- যাই হোন না কেন, তাঁর লেখা পড়ে পাঠকের মনে একটি মানচিত্র তৈরি হয়। সেই মানচিত্রে তিনি অনেক কিছু খুঁজে পান। এবং একটি মানচিত্রে যেমন অনেক পর্যটনস্পট কিংবা গুরুত্বপূর্ণ কিংবা আলোচিত স্থান থাকে, তেমনি লেখকের লেখার ভিতরও সেসব আলোচিত স্থান থাকে। পড়তে পড়তে একেকজনের একেকটা বিষয় থেকে আলোড়িত হই। যেমন কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক সদ্যপ্রয়াত রাহাত খানের খুব বেশি লেখা না পড়লেও তাঁর কিছু গল্প এবং উপন্যাসের পাঠউপভোগ্যতা লক্ষ্যযোগ্য। বিশেষ করে তাঁর গল্পগুলো বহুমাত্রিক আবেদনময়। অধিক আবেদন সৃষ্টিকারী তাঁর দুটি গল্পের দুটি সংলাপ আমাকে আলোড়িত করেছিল। তার একটি হলো তাঁর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গল্প “দীর্ঘ অশ্রুপাত”-এ “আমার আব্বু আসবে না?” সংলাপটি এবং “ঈমান আলীর মৃত্যু” গল্পে “আমি কার কাছে থাকতাম?” সংলাপটি রাহাত খানের কথা ভাবলেই মনে হয়। কী পাওয়ারফুল দুটি বাক্য যে, একজন মানুষের কথা মনে হলেই তারা মনে উঁকি দেয়!

প্রচলিত আছে যে, রাহাত খান একজন ব্যতিক্রমী কথাসাহিত্যিক। সে বিষয়ে সম্পূর্ণ একমত না হলেও, তাঁর অনেকখানি স্বকীয়তা অবশ্যস্বীকার্য। যেমন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর লেখালেখিতে নতুনত্ব বিশেষভাবে শনাক্তযোগ্য মনে না হলেও বিশিষ্টতা লক্ষণীয়। তাছাড়া একই ঘটনা নিয়ে ভিন্ন কিছু উপস্থাপন খুব বিরল ব্যাপার। প্রতিটি মুক্তিযুদ্ধেই বড় ঘটনা হলো প্রতিপক্ষের নির্যাতন এবং সেই নির্যাতনের বিভিন্ন প্রকার বা ধরন। আর একটি বড় বিষয় হলো, সেই যুদ্ধকে ঘিরে বিশ্বব্যাপী ¯স্নায়ুযুদ্ধ। স্নায়ুযুদ্ধের দিকটি খতিয়ে দেখলেই আসল কারণ বেরিয়ে আসে, এবং যুদ্ধের পূর্বাপর ঘটনাবলী চাক্ষুষ হয়। যেমন আমরা যদি সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশের একটি ইস্যুতে স্নায়ুযুদ্ধের কথা বলি, সেটা হচ্ছে রোহিঙ্গা ইস্যু। এর পেছনে বিশ্বের বড় কোনো কোনো দেশের রাজনীতি কাজ না করলে রোহিঙ্গারা এভাবে এদেশে ঢুকতে পারে না, কিংবা এতোদিন স্থায়ী হতে পারে না। এবং এই রোহিঙ্গারা কোনোদিন এদেশ থেকে ফিরবে বলেও মনে হয় না।

রাহাত খানের মুক্তিযুদ্ধের গল্পের কথা বলতে গিয়ে স্নায়ুযুদ্ধের প্রসঙ্গ এলো। এবং প্রতিপক্ষের নির্যাতনের কথা এলো। আর এর পরিণতিতে আমরা প্রতিনিয়ত স্বজন হারানোর বেদনা অনুভব করি। তাই মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক লেখালেখিতে নতুন কিছু অনায়াসলভ্য নয়। তবু এ নিবন্ধে রাহাত খানের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গল্পের গভীরতা সুদূরপ্রসারী। বিশেষভাবে শনাক্তযোগ্য। এ গল্পে আমরা একজন প্রখর দৃষ্টিবান রাহাত খানকে পাই আবার জাতীয় জীবনে সবচেয়ে বড় ঘটনা মুক্তিযুদ্ধও বিশেষভাবে জাজ্বল্য হয়ে রেখাপাত করে।

তার আগে কেন রাহাত খান ভিন্ন ধারার লেখকÑ এ বিষয়ে একটি ব্যক্তিগত মূল্যায়ন তুলে ধরবো। রাহাত খান সম্পর্কে আরো বলা যায় যে, আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের লেখক তিনি। মধ্যবিত্তিক টানাপোড়েনেরও তিনি নিপুণ বিশ্লেষক, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায়ও তাঁর কলম সদাসোচ্চার। কিন্তু রাহাত খানের যে বিষয়টি তৃতীয় নয়নে দেখা, সেটি তাঁর সম্পূর্ণ নিজস্ব, এবং গভীর চিন্তাজাত। “আমি কার কাছে থাকতাম?” সংলাপটি সে কারণে কখনো মন থেকে মুছে যায় না। আমরা সাধারণত দেখি যে, শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বেই, সন্তান বড় হয়ে গেলে অনেকেই পিতামাতার প্রতি অনুগত না হয়ে উল্টো অবহেলা প্রদর্শন করে। বিপরীতে বাবা-মা এতটাই সন্তানাসক্ত যে, তারা এ নিয়ে কোনো বাদানুবাদ করেন না। নিশ্চুপে সব মেনে নেন। এবং তাঁদের ভাগ্যলিপিতে আস্থা স্থাপন করে দুর্ভোগ পোহাতে থাকেন। অবহেলা অনাদরে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে চলে ঢলে পড়লেও তাতে কখনো সন্তানকে অভিসম্পাত করেন না। তবে এর ব্যতিক্রম যে নাই, তাও বলা যাবে না। বিশেষ করে যারা একাধিক বিয়ে করেন, এবং সংসারে প্রত্যেক স্ত্রীর আলাদা আলাদা সন্তানসন্ততি বা সংসার থাকে; তখন পরিবারের কর্তাব্যক্তিটি আর নিরপেক্ষ থাকতে পারে না। সে যতবার বিয়ে করবে অপেক্ষাকৃত নতুন স্ত্রী এবং তার সন্তানসন্ততির প্রতি বেশি দুর্বলতা প্রদর্শন করে থাকে। এই ব্যতিক্রম ছাড়া পিতামাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানো থেকে অবহেলা-উপেক্ষা যতোই করা হোক না কেন, তারা সাধারণত কোনোই উচ্চবাচ্য করেন না; কিছু দাবিও করেন না। কিন্তু রাহাত খানের “ঈমান আলীর মৃত্যু” গল্পে দেখা যায় এক ভিন্ন চিত্র। বন্যাকবলিত পরিবারের সন্তানেরা অভাবের তাড়নায় বাবা ঈমান আলীকে ফেলে গ্রামের বাড়ি ফিরে যেতে চাইলে, ঈমান আলী চিরাচরিত বাবার ভূমিকা থেকে ব্যতিক্রমী বাবার ভূমিকায় আবির্ভূত হন। তিনি তাঁর সন্তানদের বলেন, “আমি কার কাছে থাকতাম?” এখানে মধ্যবিত্তিক টানাপোড়েনের ভিতরে একজন প্রতিবাদী বাবাকে আবিষ্কার করা যায়। এই ধরনের ছোট ছোট অথচ ব্যাপক গভীরতা বিস্তারী সংলাপগুলো আবিষ্কারের ক্ষমতা রাহাত খানকে ভিন্ন ধারার লেখকের মর্যাদা দেয় বলে ধারণা করা সমীচিন।

তাঁর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গল্প “দীর্ঘ অশ্রুপাত”-এর কলেবর দীর্ঘ না হলেও তিনি অল্প কথায় এর ব্যাপ্তিকে এতোদূর পর্যন্ত নিয়ে গেছেন যে, যুদ্ধকালীন একটি দীর্ঘ ভ্রমণের ভিতর একজন নিরীহ মুসলমানের মৃত্যুর কথা ঘুরপাক খায়। এবং ঘুরপাক খেতে খেতে তা প্রভাবিত করে আর একটি প্রজন্মকে এবং বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ভিতর দিয়ে শেষ হয়। ঘটনার নির্মমতা উত্তর প্রজন্মকে বহন করতে হয় আমৃত্যু।

এ গল্পে যেমন পাকিস্তানী বর্বরতা,

সাম্প্রদায়িকতা স্পষ্ট, তেমনি প্রাণ বাঁচানোর আকুতিতে একজন বাঙালি মুসলমানের নানা পথ অবলম্বনের বিষয়টিও গুরুত্ব পেয়েছে।

ঘটনা ২৫ মার্চ কালরাতে। নিরীহ মুসল্লি গোছের অল্প বয়সী বাড়িওয়ালা ঘটনার সতর্কতায় একটি পাকিস্তানি পতাকা তার ছাদে লাগাতে গেলে, সিঁড়ি গেটের সামনে দুই পাকিস্তানি সৈনিকের মুখোমুখি হন। তারা তাকে জেরা করে ও কলেমা পড়তে পারে কিনা জিগ্যেস করে। কিন্তু বাড়িওয়ালা কলেমা পড়তে পেরেও ওই দুই সৈনিকের জীঘাংসার শিকার হয়ে মারা যান। ভয়ঙ্কর এ মৃত্যুর সময় বাড়িওয়ালা তার চার বছর বয়সী কন্যার নাম ধরে চিৎকার করতে থাকে।

এরপর দেশে স্বাধীনতা আসে। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরার দিন। বিমান বন্দরে গিয়েছিল সেই চার বছর বয়সী শিশু কন্যা (তখন বয়স পাঁচ বছর) ভাড়াটিয়ার কোলে চড়ে। এবং সেদিন বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে লন্ডন হয়ে দেশে ফিরে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর একা ফিরে আসা দেশে ওই শিশু কন্যাটি ভাড়াটিয়াকে জিগ্যেস করেছিলÑ “আমার বাবা আসবে না?”

রাহাত খানের শক্তিমত্তা এখানেই যে, তিনি এই বাবার ফিরে আসাকে প্রতীকী অর্থে ব্যবহার করেছেন। তিনি আসলে বোঝাতে চেয়েছেন যে, এই শিশুকন্যার পিতার মতো অনেক পিতাই নির্যাতিত হয়ে শহীদ হয়েছেন, কিন্তু যিনি ফিরে এসেছেন তিনি জাতির পিতা। তিনি সমগ্র বাঙালির পিতার অভাব ঘুচাতে এসেছেন একটি শৃঙ্খলিত জাতিকে মুক্তির স্বাদ দিয়ে, স্বাধীনতার স্বাদ দিয়ে। এখন আর কোনো বহির্শত্রুর হাতে কোনো বাঙালিকে চার বছরের কন্যার সামনে প্রাণ দিতে হবে না। কারো কথায় উঠতে বসতে হবে না। যার নেতৃত্বে এই জাতির মুক্তি ঘটল, তিনি চিরশত্রু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন। ফিরে এসেছেন মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে বাঙালি জাতির পিতা।

রাহাত খানের এই গল্পের ব্যাপ্তি বিস্মিত করে। লেখকের অসামান্যতা প্রমাণ করে।

বিশিষ্ট এই কথাশিল্পী ১৯৪০ সালে কিশোরগঞ্জ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৬৯ সালে দৈনিক সংবাদে চাকরির ভিতর দিয়ে সাংবাদিকতায় প্রবেশ করেন। তাঁর দীর্ঘ ক্যারিয়ার তৈরি হয় দৈনিক ইত্তেফাকে। তিনি ইত্তেফাকের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকরে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭২ সালে তিনি “অনিশ্চিত লোকালয়” নামে প্রথম গ্রন্থ প্রকাশ করেন। ছায়াদম্পতি, শহর, অমল ধবল চাকরি, হে শূন্যতা, হে অনন্তের পাখি, মধ্যমাঠের খেলোয়াড়সহ আরো বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেন।

একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ অনেক সম্মাননা লাভ করেছেন। বন্ধু কাজী আনোয়ার হোসেন রচিত মাসুদ রানা সিরিজের সেই রাহাত খানের ৮০ বছরের জীবন এক বর্ণাঢ্য আখ্যান।

বাংলা, বাঙালি, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুপ্রেমি অসাম্প্রদায়িক এই লেখকের প্রয়াণে গভীর শোক ও শ্রদ্ধা জানাই।