হরিশংকরের বাড়ি ও চিহ্নিত ব্যথার রক্তাক্ষর

জোবায়ের মিলন

কিছু সময় আগেও নামটি জানতাম না। নামটি জানলাম মুখে মুখে ‘পলাশ মজুমদার’; গল্পকার। সম্মুখ পরিচিত হবার সুযোগ নেই। খোঁজ পেলাম দৈনিকের পাতায়। খুঁজে খুঁজে দেখা মিললো কয়েকটি গল্পের। কয়েকদিন হাতে নিয়ে ‘উত্তরাধিকার’, ‘সংবাদ সাময়িকী’সহ প্রথম সারির কয়েকটি সাহিত্য-সাময়িকীতে পড়ে নিলাম তাঁর ‘সোনার মানুষ, উদ্বাস্তু, মহানগরী, র‌্যাডক্লিফ লাইন, বিধর্মী, যাযাবরসহ কয়েকটি গল্প। ব্যক্তি ‘পলাশ মজুমদার’কে নয়, তাঁর পরিপক্ব গল্পকে না জানার অপরাধ বোধ করলাম। তারপর লেগে থাকা। পড়া হলো ‘হরিশংকরের বাড়ি, মঙ্গলদ্বীপ, সহোদর, সহযোদ্ধা, চক্রান্ত; গল্পের ভেতর যেন জীবনের উত্তাপ, আলোর ও আঁধারীর দাবা খেলা। জীবন যেমন হয়। গ্রন্থমেলা-২০-এ মলাটবদ্ধাকারে পাওয়া গেল গল্পগুলো। গ্রন্থের নাম ‘‘হরিশংকরের বাড়ি’’। ‘‘হরিশংকরের বাড়ি’’ গল্পগ্রন্থটিতে ঠাঁই পাওয়া বারোটি গল্পের পটভূমিই দেশভাগের এবং ভাগোত্তর দুই দেশের বাঙালির যাপিত সমাজ ও নির্মম জীবন-চিত্রের। জাতীয়তাবাদ আর দাঙ্গাও সুস্পষ্ট। গল্পগুলোতে ফুটে উঠেছে ওই সময়ের মানুষের বাস্তুচ্যুতি, সমাজিক অস্থিতিশীলতা ও মানবিক বিপর্যয় আর ওই ঐতিহাসিক ঘটনার প্রতিফলন, যার প্রভাব সমকালেও স্থিতো। অবশ্যই বলার অপক্ষো রাখে না যে, অতীত ও বর্তমানের যোগসূত্র স্থাপনের কাজ শ্রমলব্ধ ও গভীর চিন্তার সাথে সম্পৃক্ত। গল্পকার ‘পলাশ মজুমদার’ এই শ্রমলব্ধ ও চিন্তার কাজটি করেছেন গল্পের চরিত্র ও ঘটনাবিন্যাসের মধ্যে বিভিন্নভাবে সেই সময়কে প্রতিস্থাপন করে। এ সময় তিনি গল্পের ধারাবাহিক পরিণতি-রূপায়নে আশ্রয় নিয়েছেন শিল্পীত শৈলীর। এখানে প্রতিটি গল্প নিখুঁতভাবে ধারণ করে আছে একটি দেশ দুটিভাগে ভাগ হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে সবকিছু দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার তিক্ত বিচ্ছেদ, বেদনা ও দীর্ঘশ্বাস। এখানে প্রসঙ্গক্রমে এসেছে মহান মুক্তিযুদ্ধ, অবাঙালি চরিত্র। গল্পগুলোতে ঢাকা-কলকাতা-আগরতলা, পশ্চিম বাংলা, পূর্ব বাংলা, আসাম, ত্রিপুরা অর্থাৎ বাংলাভাষা-ভাষী অঞ্চলের রেখাভেদ ঘুচে হয়েছে একাকার, যেন পুরোটা নিয়েই বাঙালির ভুবন; কেবল মাঝখানে রক্তগন্ধা হয়ে রয়ে গেছে কাঁটাতারের বেড়া। গ্রন্থে আশ্রিত গল্পগুলো শুধু দেশভাগ নিয়েই কেন? গল্পকারের প্রাক্কথন থেকে জানা যায়, দেশভাগ তাঁর আগ্রহের বিষয়। ভাষার সূত্রে তিনি বাঙালির ঐক্যে বিশ্বাসী, সে যে-দেশের বা যে-ধর্মেরই হোক না কেন। ১৯৪৭ সালে মানচিত্র খণ্ডিত হয়েছে রাজনৈতিক কারণে, যার ফল ভোগ করছি এখনো। হয়ত করতে হবে আরও অনেক দিন পর্যন্ত। দেশহীন মানুষের বুকের ভেতরের হাহাকার, যন্ত্রণা ও কষ্ট তিনি দেখেছেন। বাস্তুচ্যুত অনেক মানুষের দেখা তিনি পেয়েছেন সিকিমে, মেঘালয়ে, দিল্লিতে, পশ্চিমবঙ্গে এমনকি ঢাকাতেও। তাদের হৃদয়ে ভাঙ্গা-গড়ার, ব্যথা-বেদনার কথাগুলোই বিভিন্ন আঙ্গিকে গল্পাকারে তুলে ধরতে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। আঁকতে চেয়েছেন বিভিন্ন রকম ক্যানভাস।

ইতিহাসের এ অংশটি ‘পলাশ মজুমদার’কে কৈশোরেই নাড়া দিয়েছিল- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘পূর্ব-পশ্চিম’ পড়ার পর। পর্যায়ক্রমে বিষয়ভিত্তিক পাঠোপর চারপাশের হিন্দু-মুসলমানের মধ্যকার ব্যবধান, বৈষম্য ও বাংলাদেশের বিন্দুধর্মাবলম্বীদের দেশত্যাগ তাঁর বুকে রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে ভীষণভাবে। তিনি বন্ধুকে ভারতে চলে যেতে দেখেছেন নবম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই। দেখেছেন আরও পরশিকে; যে বাড়িতে একসময় মানুষে গমগম করতো, তা ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছে জনশূন্য বিরানভূমি। পাড়ার পনেরোটি পরিবার সবশেষে এসে ঠেকেছে একটিতে! তাদেরও চলে যেতে হয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালীর কাছে বিশাল বাড়িটি নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে। একই ঘটনা আছে ওপারেও। গল্পকার জেনেছেন, শুনেছেন, বুঝেছেন সেই নীরব প্রস্থানের নিশ্চিত কারণ। তাই তিনি ইতিহাসের এই ভুলকে মেনে নিতে পারেন না; ক্ষমা করতে পারেন না দেশভাগের কুশীলবদের। সেই দেখা আর শ্রুতিফলে গল্পকারের ভেতরে জন্ম নেয়া হাজার প্রশ্ন, জিজ্ঞাসার উষ্ণতায় ইতিহাসকে ছুঁয়ে যাওয়া দেশভাগ, দাঙ্গার শিকার কিছু মানুষের জীবন আর তাদের জীবনের ঘটনাকে অবলম্বন করে গল্পগুলো নির্মিত হয়েছে চিন্তিত চেষ্টায়; যেখানে অতীত আর বর্তমান মিলেমিশে একাকা। গল্পের বর্ণনায়, গল্পকারের মুন্সিয়ানায় পাঠে পাঠককে ধন্দে পড়ে যেতে হয় যে, এই সময়ের গল্প পড়ছি, না পঞ্চাশের দশকের! পরক্ষণেই অতীতের অভিঘাত টের পাওয়া যায় সমকালেও; তাঁর নিপুন উপস্থাপন ও সাবলীল পরিবেশনায়। একটি চরম সময়ের পার্শ্ব-পার্শ্বিকতা, দুটি ধর্মাবলম্বিদের দ্বন্দ্বকে উজিয়ে ধরে সাহিত্য তৈরি করতে যেয়ে ধর্মকে ‘পলাশ মজুমদার’ খাটো করেননি কোথাও। ধর্মীয় মুখোশের আড়ালে ভণ্ডামিকে আঘাত করে, মানুষে মানুষে বিদ্যমান বিদ্বেষ, ভেদাভেদকে এঁকে তিনি এগিয়েছেন গল্পরস সমুন্নত রেখে। গল্পগুলো এগিয়েছে স্বতন্ত্র ভঙ্গিতে। মনে হতে পারে ‘‘হরিশংকরের বাড়ি’’ একটি সময়ের দলিল। তবে এটি দলিল নয়; গল্পের বই। পাঠজ্ঞান থেকে বলছি, গ্রন্থের গল্পগুলো পাঠকমাত্রকেই যেমন কিছু প্রকৃত গল্প পাঠের স্বাদ দেবে তেমনি একটি সময়ের অভিঘাতে কিছু জীবনের উন্মুক্ত বুক দেখতে সহায়তা করবে, যা কালের পিঠে চিহ্নিত-ব্যথার রক্তাক্ষর।

বৃহস্পতিবার, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ১৩ মহররম ১৪৪২, ১৭ ভাদ্র ১৪২৭

হরিশংকরের বাড়ি ও চিহ্নিত ব্যথার রক্তাক্ষর

জোবায়ের মিলন

image

কিছু সময় আগেও নামটি জানতাম না। নামটি জানলাম মুখে মুখে ‘পলাশ মজুমদার’; গল্পকার। সম্মুখ পরিচিত হবার সুযোগ নেই। খোঁজ পেলাম দৈনিকের পাতায়। খুঁজে খুঁজে দেখা মিললো কয়েকটি গল্পের। কয়েকদিন হাতে নিয়ে ‘উত্তরাধিকার’, ‘সংবাদ সাময়িকী’সহ প্রথম সারির কয়েকটি সাহিত্য-সাময়িকীতে পড়ে নিলাম তাঁর ‘সোনার মানুষ, উদ্বাস্তু, মহানগরী, র‌্যাডক্লিফ লাইন, বিধর্মী, যাযাবরসহ কয়েকটি গল্প। ব্যক্তি ‘পলাশ মজুমদার’কে নয়, তাঁর পরিপক্ব গল্পকে না জানার অপরাধ বোধ করলাম। তারপর লেগে থাকা। পড়া হলো ‘হরিশংকরের বাড়ি, মঙ্গলদ্বীপ, সহোদর, সহযোদ্ধা, চক্রান্ত; গল্পের ভেতর যেন জীবনের উত্তাপ, আলোর ও আঁধারীর দাবা খেলা। জীবন যেমন হয়। গ্রন্থমেলা-২০-এ মলাটবদ্ধাকারে পাওয়া গেল গল্পগুলো। গ্রন্থের নাম ‘‘হরিশংকরের বাড়ি’’। ‘‘হরিশংকরের বাড়ি’’ গল্পগ্রন্থটিতে ঠাঁই পাওয়া বারোটি গল্পের পটভূমিই দেশভাগের এবং ভাগোত্তর দুই দেশের বাঙালির যাপিত সমাজ ও নির্মম জীবন-চিত্রের। জাতীয়তাবাদ আর দাঙ্গাও সুস্পষ্ট। গল্পগুলোতে ফুটে উঠেছে ওই সময়ের মানুষের বাস্তুচ্যুতি, সমাজিক অস্থিতিশীলতা ও মানবিক বিপর্যয় আর ওই ঐতিহাসিক ঘটনার প্রতিফলন, যার প্রভাব সমকালেও স্থিতো। অবশ্যই বলার অপক্ষো রাখে না যে, অতীত ও বর্তমানের যোগসূত্র স্থাপনের কাজ শ্রমলব্ধ ও গভীর চিন্তার সাথে সম্পৃক্ত। গল্পকার ‘পলাশ মজুমদার’ এই শ্রমলব্ধ ও চিন্তার কাজটি করেছেন গল্পের চরিত্র ও ঘটনাবিন্যাসের মধ্যে বিভিন্নভাবে সেই সময়কে প্রতিস্থাপন করে। এ সময় তিনি গল্পের ধারাবাহিক পরিণতি-রূপায়নে আশ্রয় নিয়েছেন শিল্পীত শৈলীর। এখানে প্রতিটি গল্প নিখুঁতভাবে ধারণ করে আছে একটি দেশ দুটিভাগে ভাগ হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে সবকিছু দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার তিক্ত বিচ্ছেদ, বেদনা ও দীর্ঘশ্বাস। এখানে প্রসঙ্গক্রমে এসেছে মহান মুক্তিযুদ্ধ, অবাঙালি চরিত্র। গল্পগুলোতে ঢাকা-কলকাতা-আগরতলা, পশ্চিম বাংলা, পূর্ব বাংলা, আসাম, ত্রিপুরা অর্থাৎ বাংলাভাষা-ভাষী অঞ্চলের রেখাভেদ ঘুচে হয়েছে একাকার, যেন পুরোটা নিয়েই বাঙালির ভুবন; কেবল মাঝখানে রক্তগন্ধা হয়ে রয়ে গেছে কাঁটাতারের বেড়া। গ্রন্থে আশ্রিত গল্পগুলো শুধু দেশভাগ নিয়েই কেন? গল্পকারের প্রাক্কথন থেকে জানা যায়, দেশভাগ তাঁর আগ্রহের বিষয়। ভাষার সূত্রে তিনি বাঙালির ঐক্যে বিশ্বাসী, সে যে-দেশের বা যে-ধর্মেরই হোক না কেন। ১৯৪৭ সালে মানচিত্র খণ্ডিত হয়েছে রাজনৈতিক কারণে, যার ফল ভোগ করছি এখনো। হয়ত করতে হবে আরও অনেক দিন পর্যন্ত। দেশহীন মানুষের বুকের ভেতরের হাহাকার, যন্ত্রণা ও কষ্ট তিনি দেখেছেন। বাস্তুচ্যুত অনেক মানুষের দেখা তিনি পেয়েছেন সিকিমে, মেঘালয়ে, দিল্লিতে, পশ্চিমবঙ্গে এমনকি ঢাকাতেও। তাদের হৃদয়ে ভাঙ্গা-গড়ার, ব্যথা-বেদনার কথাগুলোই বিভিন্ন আঙ্গিকে গল্পাকারে তুলে ধরতে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। আঁকতে চেয়েছেন বিভিন্ন রকম ক্যানভাস।

ইতিহাসের এ অংশটি ‘পলাশ মজুমদার’কে কৈশোরেই নাড়া দিয়েছিল- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘পূর্ব-পশ্চিম’ পড়ার পর। পর্যায়ক্রমে বিষয়ভিত্তিক পাঠোপর চারপাশের হিন্দু-মুসলমানের মধ্যকার ব্যবধান, বৈষম্য ও বাংলাদেশের বিন্দুধর্মাবলম্বীদের দেশত্যাগ তাঁর বুকে রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে ভীষণভাবে। তিনি বন্ধুকে ভারতে চলে যেতে দেখেছেন নবম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই। দেখেছেন আরও পরশিকে; যে বাড়িতে একসময় মানুষে গমগম করতো, তা ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছে জনশূন্য বিরানভূমি। পাড়ার পনেরোটি পরিবার সবশেষে এসে ঠেকেছে একটিতে! তাদেরও চলে যেতে হয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালীর কাছে বিশাল বাড়িটি নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে। একই ঘটনা আছে ওপারেও। গল্পকার জেনেছেন, শুনেছেন, বুঝেছেন সেই নীরব প্রস্থানের নিশ্চিত কারণ। তাই তিনি ইতিহাসের এই ভুলকে মেনে নিতে পারেন না; ক্ষমা করতে পারেন না দেশভাগের কুশীলবদের। সেই দেখা আর শ্রুতিফলে গল্পকারের ভেতরে জন্ম নেয়া হাজার প্রশ্ন, জিজ্ঞাসার উষ্ণতায় ইতিহাসকে ছুঁয়ে যাওয়া দেশভাগ, দাঙ্গার শিকার কিছু মানুষের জীবন আর তাদের জীবনের ঘটনাকে অবলম্বন করে গল্পগুলো নির্মিত হয়েছে চিন্তিত চেষ্টায়; যেখানে অতীত আর বর্তমান মিলেমিশে একাকা। গল্পের বর্ণনায়, গল্পকারের মুন্সিয়ানায় পাঠে পাঠককে ধন্দে পড়ে যেতে হয় যে, এই সময়ের গল্প পড়ছি, না পঞ্চাশের দশকের! পরক্ষণেই অতীতের অভিঘাত টের পাওয়া যায় সমকালেও; তাঁর নিপুন উপস্থাপন ও সাবলীল পরিবেশনায়। একটি চরম সময়ের পার্শ্ব-পার্শ্বিকতা, দুটি ধর্মাবলম্বিদের দ্বন্দ্বকে উজিয়ে ধরে সাহিত্য তৈরি করতে যেয়ে ধর্মকে ‘পলাশ মজুমদার’ খাটো করেননি কোথাও। ধর্মীয় মুখোশের আড়ালে ভণ্ডামিকে আঘাত করে, মানুষে মানুষে বিদ্যমান বিদ্বেষ, ভেদাভেদকে এঁকে তিনি এগিয়েছেন গল্পরস সমুন্নত রেখে। গল্পগুলো এগিয়েছে স্বতন্ত্র ভঙ্গিতে। মনে হতে পারে ‘‘হরিশংকরের বাড়ি’’ একটি সময়ের দলিল। তবে এটি দলিল নয়; গল্পের বই। পাঠজ্ঞান থেকে বলছি, গ্রন্থের গল্পগুলো পাঠকমাত্রকেই যেমন কিছু প্রকৃত গল্প পাঠের স্বাদ দেবে তেমনি একটি সময়ের অভিঘাতে কিছু জীবনের উন্মুক্ত বুক দেখতে সহায়তা করবে, যা কালের পিঠে চিহ্নিত-ব্যথার রক্তাক্ষর।