হানিফ সাহেব ও টুকটুকি

সানজিদা সিদ্দিকা

সারা বাড়িতে এখানে সেখানে জটলা পাকানো মানুষের ভিড়। বসার ঘরে, খাটে, বারান্দায় ও উঠানে। খুব কাছের আপনজন যারা তাদের চোখে মুখে শীতের পাতাশূন্য বৃক্ষের মতো নিঃসঙ্গতার ছায়া আর অবচেতনে শেকড়ের গহীনে চলছে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার, পরবর্তী বসন্তে পূর্ণ হবার সঞ্জীবনী মায়া। আজ এখানে একজন মানুষকে ঘিরেই উপস্থিত সবাই নিজ নিজ গোপন কক্ষ হতে স্মৃতির ভাঁজ খুলছে। কখনো সে স্মৃতি আনন্দের-দুঃখের, কখনো অভিযোগের অথবা স্বার্থের। এমন সময় হানিফ সাহেব বাহির থেকে এসে বসার ঘরের ইজি চেয়ারে বসলেন। আজ সে দায়মুক্ত, বড় আনন্দের দিন। এ দিনে তার একটি খেলার কথাই বার বার মনে পড়ছে। মাঝে মাঝে তার নাতি-নাতনীদের পয়সা দিয়ে এ খেলাটি খেলতে দেখেছেন। পয়সাটিকে কোনোকিছুর উপর দাঁড় করিয়ে এক আঙ্গুল দিয়ে চেপে অন্য আঙ্গুল দিয়ে টোকা দেয়। এতে পয়সাটি কিছুদূর গিয়ে দাঁড়িয়ে গোল গোল ঘুরতে থাকে। পয়সার এপিঠ ওপিঠ সমানভাবে ঘোরে। দু পিঠের অস্তিত্বই বিদ্যমান। ঘুরতে ঘুরতে একসময় পয়সার গতি দুর্বল হয়ে পড়ে যায়। যার ফলে পয়সার একটি পাশ চাপা পড়ে কিন্তু অন্যপাশ স্থির হয়ে উপুরভাবে পড়ে থাকে। ঠিক সেই খেলার মতো আজ তিনদিন হলো হানিফ সাহেবের অস্তিত্বের একটি অংশ চাপা পড়ে গেছে আর অন্য অংশ এখন বিদ্যমান। কিন্তু বিদ্যমান অংশ সবার অলক্ষ্যে। অলক্ষ্যের অস্তিত্বে আজ তিনি অনেক নতুন কিছু দেখতে পাচ্ছেন, জানতে পাচ্ছেন। কখনো কখনো ভাবছেন এসব না জানলেই ভালো হতো। নিজেকে গুপ্তচর মনে হচ্ছে। তিনি এই গুপ্তচরবৃত্তি কোনো সরকার বা রাষ্ট্রর জন্য নয়, শুধু নিজের অতিবাহিত জীবনের মায়া থেকে করছেন। এখানে সবাই কী সুনিপুণ অভিনেতা অভিনেত্রী! ছেলেমেয়ে আত্মীয়স্বজন সবাই কাঁদছে। কেউ কাঁদছে পুরোনো স্মৃতির অপ্রাপ্তি থেকে অনেক ইচ্ছা পূরণ না হওয়ার কারণে, কেউ কাঁদছে কান্নার তালে যে জোয়ার আসে সে জোয়ারে ডুবে আবার কেউ কাঁদছে শূন্যতা কীভাবে পূরণ হবে এই ভয়ে। তবুও সবাই কাঁদছে...

হঠাৎ কোথা হতে যেনো টুকটুকি দৌড়ে এসে হানিফ সাহেবের কোলের উপর বসলো। হানিফ সাহেবও পরম মমতায় ওর মাথায় হাত বোলাতে লাগলো। টুকটুকি এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেনো না বলা অনেক কথা জমে আছে। হানিফ সাহেব টুকটুকির দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসতে হাসতে বললো, হ্যা রে! তুই আজ অনেক গোশত খেতে পারবি। তোর পছন্দের গরুর গোশত। সারাজীবন সরকারি চাকরি করেছি। ঘুষ নেয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও অভাব আর লোভের সাথে যুদ্ধ করে জিতে গেছি বার বার। দুই ছেলে আর পাঁচ মেয়ে নিয়ে এতো অল্প বেতনে সংসার চলছিলো না তাই অল্প বয়সেই মেয়েদের বিয়ে দিয়েছিলাম। দুটো ছেলে রাহুল, রাতুল পাঁচ বোনের বড় আদরের ভাই এরা। এইচএসসি পাসের পর নিজেরাই চাকরি খুঁজে নিয়েছে। বিয়ে থা করে সংসারী হয়েছে। মাস শেষে রাহুল কিছু টাকা পাঠায়। আর মেয়েরা যে যখন পারে টাকা পাঠায়। চিন্তা ছোটো মেয়েটাকে নিয়ে ওকে তখনো বিয়ে দিতে পারি নাই। আমারও পেনশনের টাকা যা ছিলো তা দিয়ে এই বাড়িটা করলাম। ছেলেরা ভবিষ্যতে কে কতটুকু করতে পারবে তা তে জানা নেই, ওদের মাথা গোঁজার একটা নিশ্চিত আশ্রয় হবে এই ভেবেই বাড়িটা করা। সব টাকা এখানেই শেষ হয়ে গিয়েছিলো আর কিছু টাকা ছোটো মেয়ের বিয়ের জন্য জমিয়ে রেখেছিলাম। টুকটুকি, মনে আছে কি তোর সেদিনের কথা? ছ্টো মেয়েটি নিজের হাত খরচা চালানোর জন্য কলেজে পড়ার পাশাপাশি কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী পড়াতো। একদিন এক ছাত্রীর বাসা থেকে আমাকে মিলাদের অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিয়েছিলো। দাওয়াত পেয়ে মনে মনে সেদিন খুশি হয়েছিলাম। কতো ভালো ভালো খাবারের আয়োজন ছিলো সেখানে। যখন গরুর গোশত ভুনা দিয়ে ভাত মাখাচ্ছিলাম বার বার তোর মুখটা ভেসে উঠছিলো, বিশ্বাস কর সেদিন নিজের মেয়ের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। খাবার গিলতে গিয়ে মনে হয়েছিলো গলার মাঝে কি এক অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। মনে হয়েছিলো তুই তো কোনোদিন চেয়ে খেতে পারিস না। আমি যেটুকু দেই। আর আমিও বা তোকে কতটুকু ভালো খেতে দিতে পেরেছি? তাই তো সেদিন খাওয়া শেষ করে কেউ কিছু দেখার আগেই চুপি চুপি নিজের প্লেট থেকে কয়েক টুকরো গোশত ও হাড় রুমালে পেঁচিয়ে পাঞ্জাবীর পকেটে ভরে বাসায় নিয়ে এসেছিলাম। পকেট থেকে ওগুলো বের করতেই ছোটো মেয়েটি ভেবেছিলো ওর জন্য মিলাদ হতে হয়তো জিলাপি এনেছি কিন্তু যখন দেখলো হাড়-গোশত বের করে তোর প্লেটে রেখেছি তখন রাগ করে মেয়েটি বললো, ‘আব্বা! এ অপনি কী করেছেন? যদি কেউ দেখে ফেলতো তবে মানসম্মান থাকতো? এরপর মুখ দেখাতাম কেমন করে? ওটা আমার ছাত্রীর বাসা, ওখানে আমি পড়াতে যাই, আসলে আপনার কোনো আক্কেল নাই।’ এসব বলতে বলতে মেয়েটির গলা ভারি হয়ে এসেছিলো চোখ দুটো থেকে যেনো একটু নাড়া লাগলেই কচুপাতার মতো পানিটুকু গড়িয়ে পড়বে, ওই পানিটুকু লুকানোর জন্য দ্রুত অন্য রুমে চলে গিয়েছিলো। টুকটুকি জানিস, সব দুঃখ লজ্জা ভুলে গিয়েছিলাম যখন তোর সামনে মাংস দিতেই তুই আনন্দে মিয়াও... মিয়াও... ডেকে আমার পায়ের চারপাশে ঘুরছিলি আর পায়ে মুখ ঘসছিলি। তোর ওই ভালোবাসা প্রকাশের ভঙ্গিটুকুই আমাকে সেদিন প্রশান্তি দিয়েছিলো।

আজ আমার মৃত্যুর তৃতীয় দিন। ছেলেমেয়েরা আমার নামে মিলাদ পড়াচ্ছে। দেখলাম নানা পদের মাঝে গরুর গোশতও আছ্।ে কতোদিন মনে মনে গোশত খেতে ইচ্ছা করেছিলো, বেশি দাম বলে কিনিনি। পাশের বাড়িতে রান্না হলে ভেবেছি ওরা যদি একটু দিয়ে খেতো, তখন মনে পড়তো নবিজীর সেই হাদিসটির কথা। নবীজি বলেছিলেন, তোমরা যখন রান্না করবে তাতে একটু ঝোল বেশি দিও যেনো তোমার প্রতিবেশিকে দিতে পারো।’ কিন্তু এখন সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত প্রতিবেশিকে নিয়ে এতো বেশি ভাববার সময় কোথায় মানুষের! টুকটুকি আজ আমার কোনো চাওয়া পাওয়া নেই। আমি খাওয়ার উর্ধ্বে, তুই খেতে পারলেই আমি খুশি। তাতেই আনন্দ...

দুপুরে যোহরের নামাযের পর মিলাদ শেষে সব আত্মীয়স্বজন খেতে বসেছে তখন হানিফ সাহেব আবিষ্কার করলো একটা ভোজ কী করে মানুষের দুঃখকে ম্যাজিকের মতো প্রশমিত করে। সবাই খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত। ছেলেমেয়েরা যে যার শ্বশুর বাড়ির লোকদের, নিজ সন্তানদের খাওয়াতে ব্যস্ত। আবার কেউ কেউ খাওয়া শেষ করে বক্স ভর্তি করেছে, বাড়ি নিয়ে খাবে অথবা শ্বশুর বাড়ির লোকদের দিবে। গরিব, ইয়াতিম, মিসকিনদের খাওয়ানোর কথা কমই ভাবছে। মিলাদ উপলক্ষে বাড়িতে যখন দূর-দূরান্তের আত্মীয়-স্বজন আসতে লাগলো সে সময় হানিফ সাহেব এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে দেখলো। হানিফ সাহেবের মেঝো মেয়ে রতœা গয়নার বাক্স থেকে গয়না বের করে পড়ছে, অতিথিরা যেনো না বোঝে রতœার কিছু নেই, ও গরিব। হানিফ সাহেব মুচকি হাসলো এই ভেবে, যে সন্তান; পিতার মতো সম্পদ হারিয়ে নিজেকে সম্পদশালী প্রমাণের জন্য গয়না পড়ে সে কি পরিমাণ বোকা! ছেলের বউয়েরা বড় ননদের সাথে জায়গা-জমির ভাগ নিয়ে কথা বলছে। এরপর তাদের মাকে কে দেখাশুনা করবে এ নিয়ে সবাই আলোচনা করছে। মায়ের কপালেও চিন্তার ঢেউ নিজের ভবিষ্যত সংস্থান কোথায় হবে এ নিয়ে। কেউ আর হানিফ সাহেবকে নিয়ে কথা বলছে না। দু দিনের ব্যবধান আর তৃতীয় দিনের ভোজ ভুলিয়ে দিলো সব শোক।

হানিফ সাহেব এবার টুকটুকিকে উদ্দেশ্য করে বললো, তুই ভালো আছিসরে! তোদের সমাজে মৃত্যু উদযাপন নেই, মিথ্যা শোকের চর্চা নেই।

টুকটুকি, এবার তুই খেয়ে নে। আমার যাবার সময় হলো যা দেখার ছিলো পঁচাশি বছরের জীবনে যা শুধু মায়া হয়েই ছিলো সে মায়ার জন্যই আজ এসেছিলাম পরিবারের সবাইকে দেখতে। সবটাই আমার দেখা হয়েছে। এমন সময় হানিফ সাহেবের এক নাতি টুকটুকির সামনে ঝুটা প্লেটে রাখা হাড়-মাংস খেতে দিলো। টুকটুকি দুই বার মিয়াও ডেকে দৌড়ে গেলো হানিফ সাহেবের কবরের কাছে। গভীর রাত পর্যন্ত ওখানেই ছিলো। পরদিন ভোরের আলো ফোটার পর থেকে কেউ কখনো, কোথাও, কোনোদিন আর টুকটুকিকে দেখতে পায়নি।

বৃহস্পতিবার, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ১৩ মহররম ১৪৪২, ১৭ ভাদ্র ১৪২৭

হানিফ সাহেব ও টুকটুকি

সানজিদা সিদ্দিকা

image

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

সারা বাড়িতে এখানে সেখানে জটলা পাকানো মানুষের ভিড়। বসার ঘরে, খাটে, বারান্দায় ও উঠানে। খুব কাছের আপনজন যারা তাদের চোখে মুখে শীতের পাতাশূন্য বৃক্ষের মতো নিঃসঙ্গতার ছায়া আর অবচেতনে শেকড়ের গহীনে চলছে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার, পরবর্তী বসন্তে পূর্ণ হবার সঞ্জীবনী মায়া। আজ এখানে একজন মানুষকে ঘিরেই উপস্থিত সবাই নিজ নিজ গোপন কক্ষ হতে স্মৃতির ভাঁজ খুলছে। কখনো সে স্মৃতি আনন্দের-দুঃখের, কখনো অভিযোগের অথবা স্বার্থের। এমন সময় হানিফ সাহেব বাহির থেকে এসে বসার ঘরের ইজি চেয়ারে বসলেন। আজ সে দায়মুক্ত, বড় আনন্দের দিন। এ দিনে তার একটি খেলার কথাই বার বার মনে পড়ছে। মাঝে মাঝে তার নাতি-নাতনীদের পয়সা দিয়ে এ খেলাটি খেলতে দেখেছেন। পয়সাটিকে কোনোকিছুর উপর দাঁড় করিয়ে এক আঙ্গুল দিয়ে চেপে অন্য আঙ্গুল দিয়ে টোকা দেয়। এতে পয়সাটি কিছুদূর গিয়ে দাঁড়িয়ে গোল গোল ঘুরতে থাকে। পয়সার এপিঠ ওপিঠ সমানভাবে ঘোরে। দু পিঠের অস্তিত্বই বিদ্যমান। ঘুরতে ঘুরতে একসময় পয়সার গতি দুর্বল হয়ে পড়ে যায়। যার ফলে পয়সার একটি পাশ চাপা পড়ে কিন্তু অন্যপাশ স্থির হয়ে উপুরভাবে পড়ে থাকে। ঠিক সেই খেলার মতো আজ তিনদিন হলো হানিফ সাহেবের অস্তিত্বের একটি অংশ চাপা পড়ে গেছে আর অন্য অংশ এখন বিদ্যমান। কিন্তু বিদ্যমান অংশ সবার অলক্ষ্যে। অলক্ষ্যের অস্তিত্বে আজ তিনি অনেক নতুন কিছু দেখতে পাচ্ছেন, জানতে পাচ্ছেন। কখনো কখনো ভাবছেন এসব না জানলেই ভালো হতো। নিজেকে গুপ্তচর মনে হচ্ছে। তিনি এই গুপ্তচরবৃত্তি কোনো সরকার বা রাষ্ট্রর জন্য নয়, শুধু নিজের অতিবাহিত জীবনের মায়া থেকে করছেন। এখানে সবাই কী সুনিপুণ অভিনেতা অভিনেত্রী! ছেলেমেয়ে আত্মীয়স্বজন সবাই কাঁদছে। কেউ কাঁদছে পুরোনো স্মৃতির অপ্রাপ্তি থেকে অনেক ইচ্ছা পূরণ না হওয়ার কারণে, কেউ কাঁদছে কান্নার তালে যে জোয়ার আসে সে জোয়ারে ডুবে আবার কেউ কাঁদছে শূন্যতা কীভাবে পূরণ হবে এই ভয়ে। তবুও সবাই কাঁদছে...

হঠাৎ কোথা হতে যেনো টুকটুকি দৌড়ে এসে হানিফ সাহেবের কোলের উপর বসলো। হানিফ সাহেবও পরম মমতায় ওর মাথায় হাত বোলাতে লাগলো। টুকটুকি এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেনো না বলা অনেক কথা জমে আছে। হানিফ সাহেব টুকটুকির দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসতে হাসতে বললো, হ্যা রে! তুই আজ অনেক গোশত খেতে পারবি। তোর পছন্দের গরুর গোশত। সারাজীবন সরকারি চাকরি করেছি। ঘুষ নেয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও অভাব আর লোভের সাথে যুদ্ধ করে জিতে গেছি বার বার। দুই ছেলে আর পাঁচ মেয়ে নিয়ে এতো অল্প বেতনে সংসার চলছিলো না তাই অল্প বয়সেই মেয়েদের বিয়ে দিয়েছিলাম। দুটো ছেলে রাহুল, রাতুল পাঁচ বোনের বড় আদরের ভাই এরা। এইচএসসি পাসের পর নিজেরাই চাকরি খুঁজে নিয়েছে। বিয়ে থা করে সংসারী হয়েছে। মাস শেষে রাহুল কিছু টাকা পাঠায়। আর মেয়েরা যে যখন পারে টাকা পাঠায়। চিন্তা ছোটো মেয়েটাকে নিয়ে ওকে তখনো বিয়ে দিতে পারি নাই। আমারও পেনশনের টাকা যা ছিলো তা দিয়ে এই বাড়িটা করলাম। ছেলেরা ভবিষ্যতে কে কতটুকু করতে পারবে তা তে জানা নেই, ওদের মাথা গোঁজার একটা নিশ্চিত আশ্রয় হবে এই ভেবেই বাড়িটা করা। সব টাকা এখানেই শেষ হয়ে গিয়েছিলো আর কিছু টাকা ছোটো মেয়ের বিয়ের জন্য জমিয়ে রেখেছিলাম। টুকটুকি, মনে আছে কি তোর সেদিনের কথা? ছ্টো মেয়েটি নিজের হাত খরচা চালানোর জন্য কলেজে পড়ার পাশাপাশি কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী পড়াতো। একদিন এক ছাত্রীর বাসা থেকে আমাকে মিলাদের অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিয়েছিলো। দাওয়াত পেয়ে মনে মনে সেদিন খুশি হয়েছিলাম। কতো ভালো ভালো খাবারের আয়োজন ছিলো সেখানে। যখন গরুর গোশত ভুনা দিয়ে ভাত মাখাচ্ছিলাম বার বার তোর মুখটা ভেসে উঠছিলো, বিশ্বাস কর সেদিন নিজের মেয়ের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। খাবার গিলতে গিয়ে মনে হয়েছিলো গলার মাঝে কি এক অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। মনে হয়েছিলো তুই তো কোনোদিন চেয়ে খেতে পারিস না। আমি যেটুকু দেই। আর আমিও বা তোকে কতটুকু ভালো খেতে দিতে পেরেছি? তাই তো সেদিন খাওয়া শেষ করে কেউ কিছু দেখার আগেই চুপি চুপি নিজের প্লেট থেকে কয়েক টুকরো গোশত ও হাড় রুমালে পেঁচিয়ে পাঞ্জাবীর পকেটে ভরে বাসায় নিয়ে এসেছিলাম। পকেট থেকে ওগুলো বের করতেই ছোটো মেয়েটি ভেবেছিলো ওর জন্য মিলাদ হতে হয়তো জিলাপি এনেছি কিন্তু যখন দেখলো হাড়-গোশত বের করে তোর প্লেটে রেখেছি তখন রাগ করে মেয়েটি বললো, ‘আব্বা! এ অপনি কী করেছেন? যদি কেউ দেখে ফেলতো তবে মানসম্মান থাকতো? এরপর মুখ দেখাতাম কেমন করে? ওটা আমার ছাত্রীর বাসা, ওখানে আমি পড়াতে যাই, আসলে আপনার কোনো আক্কেল নাই।’ এসব বলতে বলতে মেয়েটির গলা ভারি হয়ে এসেছিলো চোখ দুটো থেকে যেনো একটু নাড়া লাগলেই কচুপাতার মতো পানিটুকু গড়িয়ে পড়বে, ওই পানিটুকু লুকানোর জন্য দ্রুত অন্য রুমে চলে গিয়েছিলো। টুকটুকি জানিস, সব দুঃখ লজ্জা ভুলে গিয়েছিলাম যখন তোর সামনে মাংস দিতেই তুই আনন্দে মিয়াও... মিয়াও... ডেকে আমার পায়ের চারপাশে ঘুরছিলি আর পায়ে মুখ ঘসছিলি। তোর ওই ভালোবাসা প্রকাশের ভঙ্গিটুকুই আমাকে সেদিন প্রশান্তি দিয়েছিলো।

আজ আমার মৃত্যুর তৃতীয় দিন। ছেলেমেয়েরা আমার নামে মিলাদ পড়াচ্ছে। দেখলাম নানা পদের মাঝে গরুর গোশতও আছ্।ে কতোদিন মনে মনে গোশত খেতে ইচ্ছা করেছিলো, বেশি দাম বলে কিনিনি। পাশের বাড়িতে রান্না হলে ভেবেছি ওরা যদি একটু দিয়ে খেতো, তখন মনে পড়তো নবিজীর সেই হাদিসটির কথা। নবীজি বলেছিলেন, তোমরা যখন রান্না করবে তাতে একটু ঝোল বেশি দিও যেনো তোমার প্রতিবেশিকে দিতে পারো।’ কিন্তু এখন সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত প্রতিবেশিকে নিয়ে এতো বেশি ভাববার সময় কোথায় মানুষের! টুকটুকি আজ আমার কোনো চাওয়া পাওয়া নেই। আমি খাওয়ার উর্ধ্বে, তুই খেতে পারলেই আমি খুশি। তাতেই আনন্দ...

দুপুরে যোহরের নামাযের পর মিলাদ শেষে সব আত্মীয়স্বজন খেতে বসেছে তখন হানিফ সাহেব আবিষ্কার করলো একটা ভোজ কী করে মানুষের দুঃখকে ম্যাজিকের মতো প্রশমিত করে। সবাই খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত। ছেলেমেয়েরা যে যার শ্বশুর বাড়ির লোকদের, নিজ সন্তানদের খাওয়াতে ব্যস্ত। আবার কেউ কেউ খাওয়া শেষ করে বক্স ভর্তি করেছে, বাড়ি নিয়ে খাবে অথবা শ্বশুর বাড়ির লোকদের দিবে। গরিব, ইয়াতিম, মিসকিনদের খাওয়ানোর কথা কমই ভাবছে। মিলাদ উপলক্ষে বাড়িতে যখন দূর-দূরান্তের আত্মীয়-স্বজন আসতে লাগলো সে সময় হানিফ সাহেব এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে দেখলো। হানিফ সাহেবের মেঝো মেয়ে রতœা গয়নার বাক্স থেকে গয়না বের করে পড়ছে, অতিথিরা যেনো না বোঝে রতœার কিছু নেই, ও গরিব। হানিফ সাহেব মুচকি হাসলো এই ভেবে, যে সন্তান; পিতার মতো সম্পদ হারিয়ে নিজেকে সম্পদশালী প্রমাণের জন্য গয়না পড়ে সে কি পরিমাণ বোকা! ছেলের বউয়েরা বড় ননদের সাথে জায়গা-জমির ভাগ নিয়ে কথা বলছে। এরপর তাদের মাকে কে দেখাশুনা করবে এ নিয়ে সবাই আলোচনা করছে। মায়ের কপালেও চিন্তার ঢেউ নিজের ভবিষ্যত সংস্থান কোথায় হবে এ নিয়ে। কেউ আর হানিফ সাহেবকে নিয়ে কথা বলছে না। দু দিনের ব্যবধান আর তৃতীয় দিনের ভোজ ভুলিয়ে দিলো সব শোক।

হানিফ সাহেব এবার টুকটুকিকে উদ্দেশ্য করে বললো, তুই ভালো আছিসরে! তোদের সমাজে মৃত্যু উদযাপন নেই, মিথ্যা শোকের চর্চা নেই।

টুকটুকি, এবার তুই খেয়ে নে। আমার যাবার সময় হলো যা দেখার ছিলো পঁচাশি বছরের জীবনে যা শুধু মায়া হয়েই ছিলো সে মায়ার জন্যই আজ এসেছিলাম পরিবারের সবাইকে দেখতে। সবটাই আমার দেখা হয়েছে। এমন সময় হানিফ সাহেবের এক নাতি টুকটুকির সামনে ঝুটা প্লেটে রাখা হাড়-মাংস খেতে দিলো। টুকটুকি দুই বার মিয়াও ডেকে দৌড়ে গেলো হানিফ সাহেবের কবরের কাছে। গভীর রাত পর্যন্ত ওখানেই ছিলো। পরদিন ভোরের আলো ফোটার পর থেকে কেউ কখনো, কোথাও, কোনোদিন আর টুকটুকিকে দেখতে পায়নি।