জীবন-আনন্দের কবি

সোনালী ঘোষ

স্বাধীনতা উত্তরকালে তথা আধুনিক যুগে দাঁড়িয়ে যিনি প্রকৃত মিথ তৈরি করেছিলেন তিনি জীবনানন্দ দাশ। জীবদ্দশায় মানুষটিকে কেউ ছুঁয়ে দেখবার প্রয়াস করেন নি, অথচ তাকে ছুঁয়ে দেখলে প্রত্যক্ষত হতো, কত সম্ভবনাময় ও পরিণত বীজ ধারণ করেছিলেন তিনি। আজও সচেতন ও অচেতনভাবে আমাদের কাছে আলোচিত হন নৈরাশ্যবাদী, মৃত্যু চেতনার দ্রবণে সম্পৃক্ত এক কবি হিসেবে। তবে এই ধ্যানধারণা থেকে একটু বেরিয়ে এলে বোধ হয় তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির সম?্যক জ্ঞান পাওয়া সম্ভব।

কবি নির্জনতায় অবগাহন করেছেন অহরহ, সেখান থেকেই সেচ করে এনেছেন অরূপ রত্নরাজি। তাকে নিয়ে সমালোচকগন surrealism এবং existentialism নিয়ে হাজারো মাথা ঘামালে তিনি নিশ্চুপ থেকে জীবনের সিন্ধুতটে ঢেউ দেখেছেন। এসব বুঝি প্রগাঢ় মাত্রায় একাকিত্বে থাকার ফল। জীবনবোধ, দর্শনতত্ত্বকে তিনি অন্যমাত্রায় বুঝেছিলেন। যা সাধারণের বোধগম্যতার বাইরে, অথচ একেবারে ধরাছোঁয়া পৃথিবীতেই তার নিত্য আনাগোনা।

কবি, তাঁর সকল সত্তাকে উজার করে দিয়েছেন, যেখানে জগৎ জীবন এক সূত্রে গ্রথিত, এই জগৎ জীবনকে খুঁজতে গিয়ে তিনি কোথাও কোথাও হারিয়ে গিয়েছেন আবার দেশ কালে নিজেকে ব?্যাপৃত করেছেন, এক অজানা নিরুদ্দেশের পথের পথিক হয়ে চলে গেছেন:

“হাজার বছর ধ’রে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,

সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে

অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে

সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;

আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,”

আমাদের বাকরূদ্ধ হতে হয়।

তাঁর কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, একটি ছবির সমাহার। অসাধারণ রঙের প্রয়োগ ক্ষমতা।

“আকাশের রং ঘাসফড়িঙের দেহের মতো কোমল নীল:

চারিদিকের পেয়ারা ও নোনার গাছ টিয়ার পালকের মতো সবুজ।”

চিত্রকরের মতোই তিনি নিভৃতে চিত্রাঙ্কন করে গিয়েছেন, বুদ্ধদেব বসু এপ্রসঙ্গে জানিয়েছেন তাঁর কাব্য বর্ণনাবহুল, “তাঁর বর্ণনা চিত্রকল্প”- এই মন্তব্যে জীবনানন্দের চেতনা আরো বৈচিত্র্যময় হয়ে ওঠে।

তিনি নির্জনতায় বসে গাঁথতেন একের পর এক কাব্যের লাইন, যেখানে মৃত্যু চেতনা আছে কিন্তু তাকে মৃত ভাবা বুঝি তাঁর প্রতি অবিচার করা। তিনি বারবার ফিরে আসতে চেয়েছেন “ধানসিড়িটির তীরে এই বাংলায়” এখানে মৃত্যু চেতনা কোথায়, আছে ফেরার আকুল আর্তি।

কবি যখন লেখেন “এখানে বনের কাছে ক?্যাম্প আমি ফেলিয়াছি” অর্থাৎ কবি ধরা দেন প্রকৃতির কাছে তাকে আত্মস্থ করতে চান, কিন্তু পরমুহূর্তেই যখন বলেন “কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার/বনের ভিতর আজ শিকারীরা আসিয়াছে” তিনি কার কাছে কিভাবে আশ্রয় খুঁজেছেন, যেখানে অরণ্যানীসূত সুরক্ষিত নয় অরণ্যের ভিতর কারা ছড়িয়ে রাখে ষড়যন্ত্রের গন্ধ, তারপরই প্রেক্ষিতে রচিত হয় অস্তিত্ববাদের অথবা অস্তিত্ব হননের।

আধুনিক মানুষের জীবন যন্ত্রণা আফশোস নৈরাশ্য বোধ বুঝি জীবনানন্দই প্রথম স্পর্শ করেছেন, তাই তিনি অভিনব ভঙ্গীতে জানান দেন

“কোন এক বিপন্ন বিস্ময়

আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে”

এই খেলা শব্দটি অদ্ভুতভাবেই আমাদের স্নায়ুতন্ত্রকে প্রভাবিত করে। দীর্ঘস্থায়ী তরঙ্গের মতো আশৈশব স্বতন্ত্র ধারায় ধমনীতে বয়ে যায়। বৈপরীত্য মনভাবকে বিস্ফোরিত করে, তাই জীবনানন্দের পেতে যাওয়া আসনে আমরা অজান্তেই নতজানু হই। এইভাবে মনের মধ্যে প্রেম অবহেলা সহাবস্থান করে। বৃত্তগুলোর পরিধি ক্রমাগত বাড়তে বাড়তে অদৃশ্য হয়ে যায় তখন সেই অসীমতা বোধ হয় টের পায় “ঐ প্রান্তরের শঙ্খচিল; তাহাদের কাছে যেনো এ জন্মের নয়...”

খুব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যে, এই আপাত শান্ত সমাহিত মানুষটির ভেতর অসংখ্য অনু পরমাণু বিষ্ফোরণ ঘটেছিল তা বাইরের থেকে বোঝা অসম্ভব। অসীম স্নিগ্ধতায় থেকেও তিনি একবৃহৎ পৃথিবীর সান্নিধ্যে এসেছিলেন। যাকে উপলব্ধি সকলে করতে পারেন নি। তাই তো বিরুদ্ধে মনোভাব সৃষ্টি হয়েছিল, কিন্তু অদ্ভুতভাবে তিনি নিরাসক্ত হয়ে ছিলেন। এ যেনো “সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে।/ কে থামিতে পারে এই আলোয় আঁধারে/ সহজ লোকের মতো; তাদের মতন ভাষা কথা / কে বলিতে পারে আর; কোনো নিশ্চয়তা/ কে জানিতে পারে আর? শরীরের স্বাদ / কে বুঝিতে চায় আর? প্রাণের আহ্লাদ/ সকল লোকের মতো কে পাবে আবার।” অত্যাশ্চর্য দর্শন।

তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলির নামেও বিশেষ বিশেষত্ব আছে। ঝরা পালক, ধূসর পাণ্ডুলিপি- নাম শুনলেই মনে হয় বেদনার সিন্ধুতটে কবির বিচরণ ক্ষেত্র। কিন্তু তিনি উত্তরণের পথ নির্দেশ করেছেন এর জন্য প্রয়োজন তার কবিতার গভীরে পৌঁছে যাওয়া।

যখন তিনি বনলতা সেন, সুচেতনা, অরুণিমা সান্যাল, শঙ্খমালার কাছে আশ্রয় চান তখন মনে হয়, তিনি কবি নন, বরং আমাদের মতই সাধারণ জটিল বাস্তবতার সংঘর্ষে যুঝেছেন, আর “হাজার পথ” পরিভ্রমণ করতে করতে বড় ক্লান্ত।

শব্দ বিন্যাসে, বাকবিন্যাসে তিনি নব ধারার সংযোজন করেন। ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতায় যখন দেখি-

“বধূ শুয়েছিল পাশে / শিশুটিও ছিলো; / প্রেম ছিলো, আশা ছিল”- কবি স্পষ্ট করেন এভাবেই “হয় নি ঘুম বহু কাল”। আর “উটের গ্রীবার মতো কোনো এক নিস্তব্ধতা” আমাদের পাশে বসে থাকে সারাক্ষণ। কিন্তু “অদ্ভুত আঁধার”-এর পর “আরেকটি প্রভাতের ইশারায়”- হৃদয় তখন লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়।

কাব্যগ্রন্থগুলিরর বাকবিন্যাসে হপকিন্সের মতোই গভীর ব্যঞ্জনা বহন করে তবে সর্বদা তাঁর ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয় নি। জগৎ জীবনে তিনি কেবল ইন্দ্রিয়গতভাবেই নন ইন্দ্রিয়াতীতভাবেও অবাধ বিচরণ করেছেন। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জগৎ যাকে আমরা এড়িয়ে যাই বা তুচ্ছ বলে জ্ঞান করি সেখানেই কবি অশরীরী ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে চলেছেন, দিকচক্রবালের দিকে।

জীবনানন্দ দাশ কোথাও নৈরাশ্যবাদে নিমজ্জিত নন বরং এগুলো নিয়ে তিনি খেলেছেন।

তাই তো সব লেনদেন সাঙ্গ করে ‘লাশকাটা’ টেবিলে শুয়েও তার চেতনায় উঠে আসে ‘আবার আসিব ফিরে’র মতো আশাবাদ। কারণ রূপসীর ‘অজস্র চুলের চুমো’য় তিনি বিভোর। তাই মনে হয় তিনি আধুনিক মনকেই প্রাধান্য দিয়ে জানিয়েছেন, ‘তিমির হননের গান’ মানে অন্ধকার আবর্তে ডোবা নয় বরং তাকে জীবনের সাথে সম্পৃক্ত করেও ফিরে আসার গান রচনা করা যায়। তাই তো তিনি জীবন-আনন্দের কবি।

বৃহস্পতিবার, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ১৩ মহররম ১৪৪২, ১৭ ভাদ্র ১৪২৭

জীবন-আনন্দের কবি

সোনালী ঘোষ

image

স্বাধীনতা উত্তরকালে তথা আধুনিক যুগে দাঁড়িয়ে যিনি প্রকৃত মিথ তৈরি করেছিলেন তিনি জীবনানন্দ দাশ। জীবদ্দশায় মানুষটিকে কেউ ছুঁয়ে দেখবার প্রয়াস করেন নি, অথচ তাকে ছুঁয়ে দেখলে প্রত্যক্ষত হতো, কত সম্ভবনাময় ও পরিণত বীজ ধারণ করেছিলেন তিনি। আজও সচেতন ও অচেতনভাবে আমাদের কাছে আলোচিত হন নৈরাশ্যবাদী, মৃত্যু চেতনার দ্রবণে সম্পৃক্ত এক কবি হিসেবে। তবে এই ধ্যানধারণা থেকে একটু বেরিয়ে এলে বোধ হয় তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির সম?্যক জ্ঞান পাওয়া সম্ভব।

কবি নির্জনতায় অবগাহন করেছেন অহরহ, সেখান থেকেই সেচ করে এনেছেন অরূপ রত্নরাজি। তাকে নিয়ে সমালোচকগন surrealism এবং existentialism নিয়ে হাজারো মাথা ঘামালে তিনি নিশ্চুপ থেকে জীবনের সিন্ধুতটে ঢেউ দেখেছেন। এসব বুঝি প্রগাঢ় মাত্রায় একাকিত্বে থাকার ফল। জীবনবোধ, দর্শনতত্ত্বকে তিনি অন্যমাত্রায় বুঝেছিলেন। যা সাধারণের বোধগম্যতার বাইরে, অথচ একেবারে ধরাছোঁয়া পৃথিবীতেই তার নিত্য আনাগোনা।

কবি, তাঁর সকল সত্তাকে উজার করে দিয়েছেন, যেখানে জগৎ জীবন এক সূত্রে গ্রথিত, এই জগৎ জীবনকে খুঁজতে গিয়ে তিনি কোথাও কোথাও হারিয়ে গিয়েছেন আবার দেশ কালে নিজেকে ব?্যাপৃত করেছেন, এক অজানা নিরুদ্দেশের পথের পথিক হয়ে চলে গেছেন:

“হাজার বছর ধ’রে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,

সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে

অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে

সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;

আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,”

আমাদের বাকরূদ্ধ হতে হয়।

তাঁর কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, একটি ছবির সমাহার। অসাধারণ রঙের প্রয়োগ ক্ষমতা।

“আকাশের রং ঘাসফড়িঙের দেহের মতো কোমল নীল:

চারিদিকের পেয়ারা ও নোনার গাছ টিয়ার পালকের মতো সবুজ।”

চিত্রকরের মতোই তিনি নিভৃতে চিত্রাঙ্কন করে গিয়েছেন, বুদ্ধদেব বসু এপ্রসঙ্গে জানিয়েছেন তাঁর কাব্য বর্ণনাবহুল, “তাঁর বর্ণনা চিত্রকল্প”- এই মন্তব্যে জীবনানন্দের চেতনা আরো বৈচিত্র্যময় হয়ে ওঠে।

তিনি নির্জনতায় বসে গাঁথতেন একের পর এক কাব্যের লাইন, যেখানে মৃত্যু চেতনা আছে কিন্তু তাকে মৃত ভাবা বুঝি তাঁর প্রতি অবিচার করা। তিনি বারবার ফিরে আসতে চেয়েছেন “ধানসিড়িটির তীরে এই বাংলায়” এখানে মৃত্যু চেতনা কোথায়, আছে ফেরার আকুল আর্তি।

কবি যখন লেখেন “এখানে বনের কাছে ক?্যাম্প আমি ফেলিয়াছি” অর্থাৎ কবি ধরা দেন প্রকৃতির কাছে তাকে আত্মস্থ করতে চান, কিন্তু পরমুহূর্তেই যখন বলেন “কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার/বনের ভিতর আজ শিকারীরা আসিয়াছে” তিনি কার কাছে কিভাবে আশ্রয় খুঁজেছেন, যেখানে অরণ্যানীসূত সুরক্ষিত নয় অরণ্যের ভিতর কারা ছড়িয়ে রাখে ষড়যন্ত্রের গন্ধ, তারপরই প্রেক্ষিতে রচিত হয় অস্তিত্ববাদের অথবা অস্তিত্ব হননের।

আধুনিক মানুষের জীবন যন্ত্রণা আফশোস নৈরাশ্য বোধ বুঝি জীবনানন্দই প্রথম স্পর্শ করেছেন, তাই তিনি অভিনব ভঙ্গীতে জানান দেন

“কোন এক বিপন্ন বিস্ময়

আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে”

এই খেলা শব্দটি অদ্ভুতভাবেই আমাদের স্নায়ুতন্ত্রকে প্রভাবিত করে। দীর্ঘস্থায়ী তরঙ্গের মতো আশৈশব স্বতন্ত্র ধারায় ধমনীতে বয়ে যায়। বৈপরীত্য মনভাবকে বিস্ফোরিত করে, তাই জীবনানন্দের পেতে যাওয়া আসনে আমরা অজান্তেই নতজানু হই। এইভাবে মনের মধ্যে প্রেম অবহেলা সহাবস্থান করে। বৃত্তগুলোর পরিধি ক্রমাগত বাড়তে বাড়তে অদৃশ্য হয়ে যায় তখন সেই অসীমতা বোধ হয় টের পায় “ঐ প্রান্তরের শঙ্খচিল; তাহাদের কাছে যেনো এ জন্মের নয়...”

খুব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যে, এই আপাত শান্ত সমাহিত মানুষটির ভেতর অসংখ্য অনু পরমাণু বিষ্ফোরণ ঘটেছিল তা বাইরের থেকে বোঝা অসম্ভব। অসীম স্নিগ্ধতায় থেকেও তিনি একবৃহৎ পৃথিবীর সান্নিধ্যে এসেছিলেন। যাকে উপলব্ধি সকলে করতে পারেন নি। তাই তো বিরুদ্ধে মনোভাব সৃষ্টি হয়েছিল, কিন্তু অদ্ভুতভাবে তিনি নিরাসক্ত হয়ে ছিলেন। এ যেনো “সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে।/ কে থামিতে পারে এই আলোয় আঁধারে/ সহজ লোকের মতো; তাদের মতন ভাষা কথা / কে বলিতে পারে আর; কোনো নিশ্চয়তা/ কে জানিতে পারে আর? শরীরের স্বাদ / কে বুঝিতে চায় আর? প্রাণের আহ্লাদ/ সকল লোকের মতো কে পাবে আবার।” অত্যাশ্চর্য দর্শন।

তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলির নামেও বিশেষ বিশেষত্ব আছে। ঝরা পালক, ধূসর পাণ্ডুলিপি- নাম শুনলেই মনে হয় বেদনার সিন্ধুতটে কবির বিচরণ ক্ষেত্র। কিন্তু তিনি উত্তরণের পথ নির্দেশ করেছেন এর জন্য প্রয়োজন তার কবিতার গভীরে পৌঁছে যাওয়া।

যখন তিনি বনলতা সেন, সুচেতনা, অরুণিমা সান্যাল, শঙ্খমালার কাছে আশ্রয় চান তখন মনে হয়, তিনি কবি নন, বরং আমাদের মতই সাধারণ জটিল বাস্তবতার সংঘর্ষে যুঝেছেন, আর “হাজার পথ” পরিভ্রমণ করতে করতে বড় ক্লান্ত।

শব্দ বিন্যাসে, বাকবিন্যাসে তিনি নব ধারার সংযোজন করেন। ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতায় যখন দেখি-

“বধূ শুয়েছিল পাশে / শিশুটিও ছিলো; / প্রেম ছিলো, আশা ছিল”- কবি স্পষ্ট করেন এভাবেই “হয় নি ঘুম বহু কাল”। আর “উটের গ্রীবার মতো কোনো এক নিস্তব্ধতা” আমাদের পাশে বসে থাকে সারাক্ষণ। কিন্তু “অদ্ভুত আঁধার”-এর পর “আরেকটি প্রভাতের ইশারায়”- হৃদয় তখন লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়।

কাব্যগ্রন্থগুলিরর বাকবিন্যাসে হপকিন্সের মতোই গভীর ব্যঞ্জনা বহন করে তবে সর্বদা তাঁর ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয় নি। জগৎ জীবনে তিনি কেবল ইন্দ্রিয়গতভাবেই নন ইন্দ্রিয়াতীতভাবেও অবাধ বিচরণ করেছেন। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জগৎ যাকে আমরা এড়িয়ে যাই বা তুচ্ছ বলে জ্ঞান করি সেখানেই কবি অশরীরী ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে চলেছেন, দিকচক্রবালের দিকে।

জীবনানন্দ দাশ কোথাও নৈরাশ্যবাদে নিমজ্জিত নন বরং এগুলো নিয়ে তিনি খেলেছেন।

তাই তো সব লেনদেন সাঙ্গ করে ‘লাশকাটা’ টেবিলে শুয়েও তার চেতনায় উঠে আসে ‘আবার আসিব ফিরে’র মতো আশাবাদ। কারণ রূপসীর ‘অজস্র চুলের চুমো’য় তিনি বিভোর। তাই মনে হয় তিনি আধুনিক মনকেই প্রাধান্য দিয়ে জানিয়েছেন, ‘তিমির হননের গান’ মানে অন্ধকার আবর্তে ডোবা নয় বরং তাকে জীবনের সাথে সম্পৃক্ত করেও ফিরে আসার গান রচনা করা যায়। তাই তো তিনি জীবন-আনন্দের কবি।