ভূমধ্যসাগরের রত্নময়ী আলেকজান্দ্রিয়ায়

ফজল হাসান

ভ্রমণ : পাঁচ

(পূর্ব প্রকাশের পর)

অ্যাম্ফিথিয়েটার ছেড়ে আমরা সোজা হাঁটতে থাকি। বাম পাশে উত্তর-দক্ষিণে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে মার্বেল পথের মোটা থাম। তার পাশেই অডিটোরিয়া। সেখানে বাইশটি লেকচার হল, যা আয়তনে ভিন্ন, কিন্তু একই স্থাপত্যে নির্মিত। বসার জন্য পাথরের বেঞ্চ। এসব লেকচার হল পঞ্চম থেকে সপ্তম শতাব্দি পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়েছে।

একসময় অ্যাম্ফিথিয়েটারের খানিকটা পেছনে ছিল স্নানাগার। এখন ধ্বংসস্তুপ ছাড়া আর কিছুই নেই। তবে দেখলে বোঝা যায় যে, স্থাপত্য শৈলীর দিক থেকে স্নানাগারটি ছিল পুরো এলাকার মধ্যে অন্যতম স্থাপনা। ভবনের কেন্দ্রীয় অংশ লাল ইটের তৈরি ছিল এবং তার মধ্যে বেশ কয়েকটি উত্তপ্ত কক্ষ ছিল। সেসব কক্ষের মূল উদ্দেশ্য ছিল উষ্ণ বাষ্পে গরম স্নান করা। স্নানাগারের পূর্ব অংশে ঠাণ্ডা পানিতে স্নান করার জন্য বেশ কিছু ছোট পুল সুবিধামতো জায়গায় বারান্দার ছায়ায় অবস্থিত ছিল।

রোমান অ্যাম্ফিথিয়েটারের পেছন দিকে এক কোণে রয়েছে মোজাইক করা বাসস্থানের ধ্বংসাবশেষ। পুরাতত্ত্ববিদ যিনি এই বাসস্থান আবিষ্কার করেছিলেন, তিনি নাম দিয়েছেন ‘ভিলা অব দ্য বার্ডস্’। কেননা মেঝেতে ছিল মোজাইক করা কবুতর, ময়ূর, কোয়েল, টিয়া এবং জলজ পাখির ছবি। এই বাসস্থানটি রোমান সম্রাট হাড্রিয়ানের রাজত্বকালে (১১৭ থেকে ১৩৮ খ্রিস্টাব্দ) নির্মাণ করা হয়। ঘুরতে ঘুরতে একসময় আমরা সেখানে নিজেদের আবিষ্কার করি। অতীতে হয়তো সেখানে জৌলুস ছিল, ছিল আভিজাত্য, কিন্তু বর্তমানে জায়গাটা নীরব, রীতিমতো ভুতুড়ে। ভর দুপুরেও গা ছমছম করে। যাহোক, ঘরে ঢোকার দরোজা ভেজানো ছিল। বাইরে থেকে দেখার চেষ্টা করি। ভেতরে কেউ নেই। সিস্টার মাই দরোজার পাল্লা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে। তাকে অনুসরণ করে মেহেরুন এবং আমি অনুসরণ করি মেহেরুনকে। ভেতরে ডানপাশে কাঠের পাটাতন দিয়ে তৈরি হাঁটার পথ এবং কক্ষের শেষদিকে একপাশ থেকে অন্যপাশে যাওয়ার জন্য রয়েছে সাঁকোর মতো পথ। আমরা সেই সাঁকো পেরিয়ে উল্টো পাশে যাই। সেখানে উৎসাহী দর্শক এবং পর্যটকদের জন্য রয়েছে বাসস্থান সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বিবরণ। যদিও ভূমিকম্পে বাসস্থান ধ্বংস হয়ে গেছে, তবুও আশেপাশের দেওয়ালে এবং মেঝেতে এখনো রঙিন মার্বেল পাথরের ভাঙাচোরা কারুকাজ টিকে আছে। তবে বাসস্থান দেখলে সহজেই অনুমান করা যায় যে, একসময় জায়গাটি ছিল বিত্তশালীদের। নোটিশ বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী অগ্নিতে ক্ষতি হওয়ার আগে অন্তত কমপক্ষে চারবার বাসস্থানের অভ্যন্তরে মোজাইকের কারুকাজ করা হয়। এখনো মেঝেতে মোজাইক করা কবুতর, ময়ূর, কোয়েল, টিয়া এবং জলজ পাখির ছবি দেখা যায়। এছাড়া সেখানে রয়েছে চিতাবাঘ ও নানান রঙের ফুলের ছবি।

বলা হয়, নির্মাণের পর থেকে সপ্তম শতাব্দি পর্যন্ত আলাদা তিন রাজত্বকালে (রোমান, বাইজেনটাইন এবং ইসলামের প্রাথমিক যুগ) অ্যাম্ফিথিয়েটারকে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। রোমানদের রাজত্বের সময় Odeum [রোমান আমলের নাট্যমঞ্চ] হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, যেখানে বিভিন্ন ধরনের সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। অন্যদিকে বাইজেনটাইন আমলে অ্যাম্ফিথিয়েটারকে কনফারেন্স হল হিসেবে, বিশেষ করে জনসভা এবং সরকারি সম্মেলনের জন্য, ব্যবহার করা হতো। সম্ভবত ইসলামের প্রাথমিক যুগে অ্যাম্ফিথিয়েটারকে কোনো নির্দিষ্ট কাজে ব্যবহার করা হয়নি, বরং বলা হয় তখন রীতিমতো অবজ্ঞা করা হয়েছে।

আমি আগে কখনো রোমানদের তৈরি কোনো নাট্যশালা দেখিনি। সোজা কথায় বলতে হয়, দেখার সৌভাগ্য হয়নি। তাই অ্যাম্ফিথিয়েটার এবং আশেপাশের স্থাপনা দেখার সময় আমার মধ্যে দারুণ উত্তেজনার নহর বয়ে গিয়েছিল। এখন ভাবি, আলেকজান্দ্রিয়া শহরের অনেক কিছুই খনন করা হয়নি । হয়তো আরো অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনা লুকিয়ে আছে মাটির তলায়। তাই ভবিষ্যতে আরো কি সব চোখ ধাধানো এবং মন জুড়ানো নিদর্শন আবিষ্কৃত হবে, দেখার জন্য আমরা এবং ভবিষ্যত প্রজন্ম অপেক্ষায় আছি, থাকবো।

‘একজন সৈনিক, যে অস্ত্রের চেয়ে ধর্মীয় বিশ্বাসে বেশি সুরক্ষিত ছিল, দু’পাশে ধারালো কুঠার হাতে তুলে নেয় এবং শক্ত হয়ে দাঁড়ায়। শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে সে কল্পিত ঈশ্বরের আদলে তৈরি প্রাচীন মূর্তির চোয়ালে কোপ দেয়। তারপর সে ঘুণে ধরা কাঠ, যা পোড়া ধোঁয়ায় কালো হয়ে গেছে, অনেক বার আঘাত করে। টুকরো কাঠ তুলে সে জ্বলন্ত আগুনে ছোড়ে, যে আগুন কেউ একজন আগেই জ্বালিয়ে রেখেছে। আগুনের প্রজ¦লিত শিখায়। শুকনো কাঠের টুকরোগুলো পুড়ে ছাই হয়ে যায়। একসময় ভাঙা মূর্তির মাথা হেলে পড়ে। তারপর সে ফালি ফালি করে মূর্তির পা কাটে। সবশেষে দড়ি বেঁধে কল্পিত ঈশ্বরের মুণ্ডহীন মূর্তির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ টেনে আলাদা করে নিচে ফেলে দেয়। আর তাই ঘটনা এভাবেই ঘটেছে। তবে সবকিছু ঘটেছে একটার পর একটা করে। তারপর হাস্যকর মূর্তির বাকি অংশ পূজারী আলেকজান্ডারের সম্মুখে আগুনে পোড়ানো হয়। [...]

আমাদের প্রভু ঈশ্বরের নামে ভবনটির ইট এক এক করে খুলে নেওয়া হয়। ভবনের স্তম্ভ ভেঙে যায় এবং দেওয়াল ধ্বসে পড়ে। শয়তান মূর্তির দেহে জড়িয়ে থাকা স্বর্ণ, কাপড় এবং মূল্যবান মার্বেল পাথর সরানো হয়। [...]

অবশেষে মন্দির ধ্বংস করা হয়েছে এবং পুরোহিত ও দুষ্ট অপরাধীরা পরাজিত হয়ে নরকের অগ্নিতে পুড়ে ভষ্ম হচ্ছে, যেমন ভাবে বৃথা কুসংস্কার (পৌত্তলিক) এবং প্রাচীন রাক্ষস সেরাপিস ধ্বংস হয়ে গেছে।’

এই ছিল আলেকজান্দ্রিয়ার সেরাপিয়াম মন্দির ধ্বংস হওয়ার বর্ণনার একাংশ, যা রোমান ধর্মযাজক, লেখক, ইতিহাসবিদ, ধর্মতাত্ত্বিক এবং গ্রিক ধর্মতত্ত্বের অনুবাদক Tyrannius Rufinu [জন্ম ৩৪৫ খ্রিস্টাব্দ, মৃত্যু ৪১০ খ্রিস্টাব্দ] তার লেখা Historia Ecclesiastica (২:২৩) গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। আরবিতে সেরাপিয়ামের নাম ‘আমুদ এল-সাওয়ারি’ বা ‘অশ্বারোহীদের স্তম্ভ’।

অ্যাম্ফিথিয়েটার থেকে ট্যাক্সি করে আমরা যখন সেরাপিয়াম মন্দির ও পম্পাইয়ের পিলারে পৌঁছি, তখন দুপুরের সূর্য মাথার উপর ঝুলে আছে। সিস্টার মাই বলেছে, পুরোটা দেখতে ঘণ্টা দুয়েক সময় লাগবে এবং তারপরে আমরা হাঁটা পথে গিয়ে ধীরসুস্থে লাঞ্চ করবো।

আলেকজান্দ্রিয়ার সেরাপিয়াম মন্দির ও পম্পাইয়ের পিলার দর্শনের জন্য যথারীতি টিকেট কেটে ভেতরে ঢোকার পরই দৃষ্টি আটকে যায় সামনে, সেরাপিয়াম মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের উপর। কিছুক্ষণ হা করে তাকিয়ে থেকে ভাবতে থাকি। একসময় সেই ধ্বংসস্তুপের উপর সগৌরবে দাঁড়িয়ে ছিল মন্দির, যা একসময় সেরাপিস মন্দির নামে পরিচিত ছিল। তখন মানুষের পায়ের শব্দে মুখরিত হতো মন্দিরের আঙিনা। মন্দিরের ভেতরে রাজা এবং উজির-নাজিরের উপস্থিতিতে ধ্যানমগ্ন হয়ে পুরোহিত পূজা-অর্চনা করতেন এবং অর্ঘ্য দিতেন দেবতাকে। এছাড়া প্রতœতত্ত্ববিদদের ধারণা থেকে জানা যায় যে, মন্দিরের অভ্যন্তরে সুস্বাস্থ্য, বিয়ে এবং প্রজ্ঞার দেবতা আইসিস [ওংরং]-এর পূজা করা হতো।

ইতিহাস থেকে জানা জানা যায় যে, আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট-এর বাল্যবন্ধু এবং সামরিক বাহিনীর বিশ্বস্ত জেনারেল ছিলেন Ptolemy I Soter [জন্ম খ্রিস্টপূর্ব ৩৬৭, মৃত্যু খ্রিস্টপূর্ব ২৮৩]। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পরে তিনি মিশরের সম্রাট হিসেবে শাসনভার গ্রহণ করেন। মিশরীয় এবং গ্রিকদের মাঝে ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক ব্যবধান কমানোর জন্য তিনি নতুন এক ঈশ্বর সৃষ্টি করেন এবং তার নাম রাখেন গ্রেকো-ইজিপশিয়ান দেবতা ‘সেরাপিস’ [Serapis]। তিনি Sinope থেকে একটা মূর্তি আলেকজান্দ্রিয়ায় নিয়ে আসেন এবং জনগণের মাঝে প্রচার করেন যে, তিনি স্বপ্নে ঈশ্বরকে দর্শন করেছেন। তখন দু’জন ধর্ম বিশেষজ্ঞ ঘোষণার মাধ্যমে মূর্তির নাম রাখে সেরাপিস। মূর্তিটি আদল ছিল মিশরের ঐতিহ্যবাহী দুই দেবতা Osiris এবং Apis-এর মিশ্রণ। তারপরও সেই মূর্তির সঙ্গে হেলেনেস্টিক ধর্মের দেবতাদের গুণাবলী যুক্ত করা হয়। এরা ছিল সূর্যের দেবতা তবঁং এবং Zeus, উর্বরতার দেবতা Helios, এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবনের দেবতা Dionysus এবং Hades Ges Asklepius। তাই তাদের বিশ্বাস ছিল যে, সেরাপিসই মহা পরাক্রমশালী সর্ব শক্তিমান দেবতা।

টলেমি রাজতন্ত্রের তৃতীয় রাজা Ptolemy III Euergetes [রাজত্বকাল: খ্রিস্টপূর্ব ২৪৬ থেকে ২২২] সেরাপিয়াম মন্দির নির্মাণ কাজ শেষ করেন। কাহিনীতে আছে, আলেকজান্দ্রিয়াকে বালা-মুছিবত থেকে রক্ষা করার জন্য দেবতা ‘সেরাপিস’কে মন্দিরটি উৎসর্গ করা হয়েছিল। তবে সেরাপিয়াম মন্দিরের চতুর্দিকে ঘেরা দেওয়ালের ভিত্তি প্রস্তর থেকে জানা যায় যে, পরবর্তীতে Ptolemy IV Philopator-এর (জন্ম খ্রিস্টপূর্ব ২৩৮, মৃত্যু খ্রিস্টপূর্ব ২০৪] রাজত্বকালে [খ্রিস্টপূর্ব ২২১ থেকে ২০৪] পুনরায় গ্রিকদের হেলেনিস্টিক ধর্মের সূর্য দেবতা Harpocrates-কে উৎসর্গ করা হয়। এছাড়া টলেমী আমলে Harpocrates-কে মৌনতা, গোপনীয়তা এবং মঙ্গলের দেবতা হিসেবে গণ্য করা হতো। যাহোক, প্রাচীনকালে আলেকজান্দ্রিয়ায় নির্মিত সব মন্দিরের মধ্যে সেরাপিয়াম মন্দির ছিল আয়তনে বিশাল এবং সবচেয়ে সুন্দর ও স্থাপত্য শৈলীতে অসাধারণ। সেরাপিয়াম মন্দিরটি ছিল একের ভেতর তিন, অর্থাৎ মন্দিরের একাংশে সেরাপিস ধর্মের অনুসারীরা পূজা করতো, দ্বিতীয়াংশ ছিল আইসিস ধর্মাবলম্বীদের জন্য পূজার স্থান এবং তৃতীয়াংশ ছিল Harpocrates-এর বিশ্বাসীদের পূজার জায়গা। আকৃতির দিক থেকে সেরাপিয়াম মন্দিরটি ছিল আয়তাকার এবং মূল প্রবেশ পথ ছিল প্রশস্ত। চারদিকের স্তম্ভ ছিল হীরক, রূপা, ব্রোঞ্জ ও মহামূল্যবান রত্ব দিয়ে অলংকৃত এবং মেঝে ছিল মার্বেল পাথর দিয়ে মোড়ানো।

যাহোক, একসময় সেরাপিস ধর্মের অনুসারীদের মূল ঘাটি ছিল আলেকজান্দ্রিয়া এবং সেখান থেকে রোমান সাম্রাজ্যের সব জায়গায়, এমনকি বৃটেন পর্যন্ত, ছড়িয়ে পড়ে। তখন সেরাপিস ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান ছিল আলেকজান্দ্রিয়ার সেরাপিয়াম। এছাড়া আলেকজান্দ্রিয়া ছিল খ্রিস্টান ধর্মের সূচনালগ্নে অন্যতম প্রধান জায়গা। সেই সময় সেরাপিয়ামকে কেন্দ্র করে দুই ধর্মের মধ্যে বিরোধ বাঁধে। অবশেষে খ্রিস্টানরা সেরাপিয়াম ধ্বংস করে এবং সেখান থেকে সেরাপিস ধর্মের অনুসারীদের বিতাড়িত করে।

সেরাপিয়াম মন্দিরের উপর দিয়ে অনেক ঝড়-ঝাপটা গেছে। কথিত আছে, আনুমানিক ৬৮ খ্রিস্টাব্দে আলেকজান্দ্রয়ার পৌত্তলিকরা সেইন্ট মার্ককে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায় সেরাপিয়াম মন্দিরের অভ্যন্তরে এবং সেখানেই তাকে হত্যা করে। ইতিহাস থেকে আরো জানা যায় যে, রোমান সাম্রাজ্যের শেষ দিকে ৩২৫ খ্রিস্টাব্দে পৌত্তলিকদের অত্যাচারের সময় তৎকালীন খ্রিস্টান সম্রাট কন্সট্যান্টাইন-এর আদেশে মন্দিরটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ৩৯১ খ্রিস্টাব্দে ধর্মীয় দাঙ্গার সময় বিশপ থেওফিলাসের নেতৃত্বে খ্রিস্টান জনগোষ্ঠী এবং রোমান সৈন্যরা সেরাপিয়াম আক্রমণ করে পৌত্তলিকদের শক্ত ঘাঁটি সেরাপিয়াম মন্দির ধ্বংস করে ভেতরের জিনিসপত্র রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে। আক্রমণের সময় পৌত্তলিকরা দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করে এবং খ্রিস্টানদের পাকড়াও করে সেরাপিয়াম মন্দিরের ভেতরে অবস্থান নেয় এবং ব্যারিকেড তৈরি করে। কিন্তু রোমান সৈন্যরা সেই ব্যারিকেড ভেঙে ভেতর প্রবেশ করে এবং পৌত্তলিকদের বন্দি করে। বিশপ থেওফিলাস বন্দিদের হত্যা না করে ছেড়ে দেন। তবে মন্দিরটি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করেন। উত্তেজিত খ্রিস্টান জনগণ সেরাপিসের মূর্তি ভাঙতে দ্বিধাবোধ করে। কেননা তাদের মধ্যে ভয় ঢুকেছিল যে, সেরাপিসের মূর্তি ভাঙলে হয়তো তাদের উপর আকাশ ভেঙে পড়বে। অবশেষে একজন সাহসী সৈনিক এগিয়ে এসে কুড়াল দিয়ে সেরাপিসের মূর্তিতে প্রথম আঘাত হানে [যার বর্ণনা এই লেখার শুরুতে আছে]। সেরাপিসের মূর্তি ভাঙার পরে যখন খ্রিস্টান জনগণ দেখলো যে, মূর্তির ভেতরের ফাঁকা জায়গা থেকে ভয়ার্ত ইঁদুরেরা বেরিয়ে আসছে এবং আকাশও ভেঙে পড়েনি, তখন তাদের বুঝতে বাকি ছিল না যে সেরাপিস আসলে মানুষের গড়া মূর্তি ছাড়া অন্য কিছু নয়। পরবর্তীতে বিজয়া খ্রিস্টানরাা আশেপাশের জায়গা থেকে

পৌত্তলিকদের বিতারিত করে। বর্তমানে সেরাপিয়াম মন্দিরের কিছুই অবশিষ্ট নেই। তবে এখনো মাটির নিচে ধর্মীয় অঙ্কন চিত্র এবং লাইব্রেরি র ভগ্নাবশেষ দেখা যায়। বলা হয়, সেরাপিয়াম মন্দিরের অভ্যন্তরের লাইব্রেরি নাকি তৎকালীন আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরির অংশ ছিল।

কয়েকবার সেরাপিয়াম মন্দিরের সংস্কার করা হয়, যেমন ১১৬ খ্রিস্টাব্দে কিটোস যুদ্ধের সময় ধ্বংস হলে মন্দিরটি রোমান সম্রাট Hadrian-এর আমলে [১১৭-১৩৮ খ্রিস্টাব্দ] পুনরায় নির্মাণ করা হয়। এছাড়া খনন কাজের সময় মন্দির চত্বরে আবিস্কৃত গ্রানাইট পাথরের স্তম্ভ দেখে ধারণা করা হয়েছে যে, পরবর্তীতে রোমানরা ১৮১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ২১৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পুনরায় নির্মাণ করেছিল এবং পরিধি বাড়িয়েছিল। সেরাপিয়ামের পাশেই আছে ডায়োক্লেসিয়ান পিলার বা পম্পাইয়ের স্তম্ভ এবং বর্তমানে সেই স্তম্ভের আশেপাশে ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে আছে সেরাপিয়ামের ধ্বংসাবশেষ।

একসময় সিস্টার মাই বললো, ‘চলো, আগে পেছনের দিকে যাই। তারপর আমরা পম্পাইয়ের স্তম্ভে যাবো।’ মেহেরুন এবং আমি দু’জনেই রাজি হই এবং সিস্টার মাইকে অনুসরণ করি। মন্দির থেকে বাম দিকে খানিকটা পথ যাওয়ার পরই চোখে পড়ে নির্দিষ্ট একটা জায়গা। ইচ্ছে হচ্ছিল জায়গাটি সম্পর্কে সিস্টার মাইকে জিজ্ঞাসা করি। পরক্ষণেই কেন জানি মনে হলো উত্তরটা হয়তো তার জানা নেই এবং না থাকারই সম্ভাবনা প্রচুর। তাই প্রশ্ন করা থেকে নিজের ইচ্ছের লাগাম টেনে ধরি। পরে নেট ঘেঁটে জেনেছি, জায়গাটি ছিল সম্রাটের উপাসনার স্থান। সেখান থেকেই গত শতাব্দীর চলি্লশের দশকে উদ্ধার করা হয়েছিল ‘বুল-গড সেরাপিস’-এর মূর্তি। বলা হয়, সেই মূর্তির সম্মুখে আলেকজান্দ্রিয়ার লোকজন রোমান সম্রাট হ্যাডরিয়াকে উপাসনা করতো।

সবশেষে আমাদের দর্শনীয় মূল জায়গা ছিল সেরাপিয়াম মন্দিরের পাশে খোলা আকাশের দিকে মাথা উঁচু করে নিঃসঙ্গ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা পম্পাইয়ের স্তম্ভ। পম্পাইয়ের স্তম্ভকে ডায়োক্লেসিয়ান স্তম্ভ বা পিলার হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, এমনকি বিজয় স্তম্ভও বলা হয়। তৎকালীন রোমান স¤্রাট ডায়োক্লেসিয়ান ২৯৭ খ্রিস্টাব্দে আলেকজান্দ্রিয়ার জনগণের বিদ্রোহ কঠিন হাতে দমন করেন এবং তার নামানুসারে স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীতে স্তম্ভটি পম্পাইয়ের স্তম্ভ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। পম্পাইয়ের স্তম্ভ নাম কেন রাখা হয়েছে, তার কোনো সঠিক ব্যাখ্যা জানা নেই। তবে কাহিনীতে আছে, ক্রুসেডাররা ভুল করে অথবা সজ্ঞানে বিশ্বাস করতো যে স্তম্ভের উপরে পাত্রের মধ্যে ভস্ম অথবা ভস্মজাতীয় যে জিনিস পাওয়া গেছে, তাতে অনুমান করা হয় যে সেই ভস্ম ক্লিওপেট্রার ভাইয়ের হাতে নিহত রোমান সেনাপ্রধান পম্পাইয়ের। তাই পরবর্তীতে ডায়োক্লেসিয়ান বা বিজয় স্তম্ভটি পম্পাইয়ের স্তম্ভ হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। বলা হয়, রোমান সা¤্রাজ্যের রাজধানী রোম এবং কনস্ট্যান্টিনোপলের বাইরে পম্পাইয়ের স্তম্ভই উচ্চতায় সেরা, এমনকি একক ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা একমাত্র বিশাল প্রাচীন স্থাপনা। লাল আসওয়ান পাথরের তৈরি স্তম্ভটি মাটি থেকে প্রায় সাতাশ মিটার উঁচু ও গোড়ার দিকের বৃত্তাকার দৈর্ঘ্য আনুমানিক নয় মিটার। ঐতিহাসকদের মতে স্তম্ভটির ওজন দু’শ’ পঁচাশি টন। ক্রমশ...

বৃহস্পতিবার, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ১৩ মহররম ১৪৪২, ১৭ ভাদ্র ১৪২৭

ভূমধ্যসাগরের রত্নময়ী আলেকজান্দ্রিয়ায়

ফজল হাসান

image

ভ্রমণ : পাঁচ

(পূর্ব প্রকাশের পর)

অ্যাম্ফিথিয়েটার ছেড়ে আমরা সোজা হাঁটতে থাকি। বাম পাশে উত্তর-দক্ষিণে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে মার্বেল পথের মোটা থাম। তার পাশেই অডিটোরিয়া। সেখানে বাইশটি লেকচার হল, যা আয়তনে ভিন্ন, কিন্তু একই স্থাপত্যে নির্মিত। বসার জন্য পাথরের বেঞ্চ। এসব লেকচার হল পঞ্চম থেকে সপ্তম শতাব্দি পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়েছে।

একসময় অ্যাম্ফিথিয়েটারের খানিকটা পেছনে ছিল স্নানাগার। এখন ধ্বংসস্তুপ ছাড়া আর কিছুই নেই। তবে দেখলে বোঝা যায় যে, স্থাপত্য শৈলীর দিক থেকে স্নানাগারটি ছিল পুরো এলাকার মধ্যে অন্যতম স্থাপনা। ভবনের কেন্দ্রীয় অংশ লাল ইটের তৈরি ছিল এবং তার মধ্যে বেশ কয়েকটি উত্তপ্ত কক্ষ ছিল। সেসব কক্ষের মূল উদ্দেশ্য ছিল উষ্ণ বাষ্পে গরম স্নান করা। স্নানাগারের পূর্ব অংশে ঠাণ্ডা পানিতে স্নান করার জন্য বেশ কিছু ছোট পুল সুবিধামতো জায়গায় বারান্দার ছায়ায় অবস্থিত ছিল।

রোমান অ্যাম্ফিথিয়েটারের পেছন দিকে এক কোণে রয়েছে মোজাইক করা বাসস্থানের ধ্বংসাবশেষ। পুরাতত্ত্ববিদ যিনি এই বাসস্থান আবিষ্কার করেছিলেন, তিনি নাম দিয়েছেন ‘ভিলা অব দ্য বার্ডস্’। কেননা মেঝেতে ছিল মোজাইক করা কবুতর, ময়ূর, কোয়েল, টিয়া এবং জলজ পাখির ছবি। এই বাসস্থানটি রোমান সম্রাট হাড্রিয়ানের রাজত্বকালে (১১৭ থেকে ১৩৮ খ্রিস্টাব্দ) নির্মাণ করা হয়। ঘুরতে ঘুরতে একসময় আমরা সেখানে নিজেদের আবিষ্কার করি। অতীতে হয়তো সেখানে জৌলুস ছিল, ছিল আভিজাত্য, কিন্তু বর্তমানে জায়গাটা নীরব, রীতিমতো ভুতুড়ে। ভর দুপুরেও গা ছমছম করে। যাহোক, ঘরে ঢোকার দরোজা ভেজানো ছিল। বাইরে থেকে দেখার চেষ্টা করি। ভেতরে কেউ নেই। সিস্টার মাই দরোজার পাল্লা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে। তাকে অনুসরণ করে মেহেরুন এবং আমি অনুসরণ করি মেহেরুনকে। ভেতরে ডানপাশে কাঠের পাটাতন দিয়ে তৈরি হাঁটার পথ এবং কক্ষের শেষদিকে একপাশ থেকে অন্যপাশে যাওয়ার জন্য রয়েছে সাঁকোর মতো পথ। আমরা সেই সাঁকো পেরিয়ে উল্টো পাশে যাই। সেখানে উৎসাহী দর্শক এবং পর্যটকদের জন্য রয়েছে বাসস্থান সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বিবরণ। যদিও ভূমিকম্পে বাসস্থান ধ্বংস হয়ে গেছে, তবুও আশেপাশের দেওয়ালে এবং মেঝেতে এখনো রঙিন মার্বেল পাথরের ভাঙাচোরা কারুকাজ টিকে আছে। তবে বাসস্থান দেখলে সহজেই অনুমান করা যায় যে, একসময় জায়গাটি ছিল বিত্তশালীদের। নোটিশ বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী অগ্নিতে ক্ষতি হওয়ার আগে অন্তত কমপক্ষে চারবার বাসস্থানের অভ্যন্তরে মোজাইকের কারুকাজ করা হয়। এখনো মেঝেতে মোজাইক করা কবুতর, ময়ূর, কোয়েল, টিয়া এবং জলজ পাখির ছবি দেখা যায়। এছাড়া সেখানে রয়েছে চিতাবাঘ ও নানান রঙের ফুলের ছবি।

বলা হয়, নির্মাণের পর থেকে সপ্তম শতাব্দি পর্যন্ত আলাদা তিন রাজত্বকালে (রোমান, বাইজেনটাইন এবং ইসলামের প্রাথমিক যুগ) অ্যাম্ফিথিয়েটারকে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। রোমানদের রাজত্বের সময় Odeum [রোমান আমলের নাট্যমঞ্চ] হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, যেখানে বিভিন্ন ধরনের সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। অন্যদিকে বাইজেনটাইন আমলে অ্যাম্ফিথিয়েটারকে কনফারেন্স হল হিসেবে, বিশেষ করে জনসভা এবং সরকারি সম্মেলনের জন্য, ব্যবহার করা হতো। সম্ভবত ইসলামের প্রাথমিক যুগে অ্যাম্ফিথিয়েটারকে কোনো নির্দিষ্ট কাজে ব্যবহার করা হয়নি, বরং বলা হয় তখন রীতিমতো অবজ্ঞা করা হয়েছে।

আমি আগে কখনো রোমানদের তৈরি কোনো নাট্যশালা দেখিনি। সোজা কথায় বলতে হয়, দেখার সৌভাগ্য হয়নি। তাই অ্যাম্ফিথিয়েটার এবং আশেপাশের স্থাপনা দেখার সময় আমার মধ্যে দারুণ উত্তেজনার নহর বয়ে গিয়েছিল। এখন ভাবি, আলেকজান্দ্রিয়া শহরের অনেক কিছুই খনন করা হয়নি । হয়তো আরো অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনা লুকিয়ে আছে মাটির তলায়। তাই ভবিষ্যতে আরো কি সব চোখ ধাধানো এবং মন জুড়ানো নিদর্শন আবিষ্কৃত হবে, দেখার জন্য আমরা এবং ভবিষ্যত প্রজন্ম অপেক্ষায় আছি, থাকবো।

‘একজন সৈনিক, যে অস্ত্রের চেয়ে ধর্মীয় বিশ্বাসে বেশি সুরক্ষিত ছিল, দু’পাশে ধারালো কুঠার হাতে তুলে নেয় এবং শক্ত হয়ে দাঁড়ায়। শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে সে কল্পিত ঈশ্বরের আদলে তৈরি প্রাচীন মূর্তির চোয়ালে কোপ দেয়। তারপর সে ঘুণে ধরা কাঠ, যা পোড়া ধোঁয়ায় কালো হয়ে গেছে, অনেক বার আঘাত করে। টুকরো কাঠ তুলে সে জ্বলন্ত আগুনে ছোড়ে, যে আগুন কেউ একজন আগেই জ্বালিয়ে রেখেছে। আগুনের প্রজ¦লিত শিখায়। শুকনো কাঠের টুকরোগুলো পুড়ে ছাই হয়ে যায়। একসময় ভাঙা মূর্তির মাথা হেলে পড়ে। তারপর সে ফালি ফালি করে মূর্তির পা কাটে। সবশেষে দড়ি বেঁধে কল্পিত ঈশ্বরের মুণ্ডহীন মূর্তির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ টেনে আলাদা করে নিচে ফেলে দেয়। আর তাই ঘটনা এভাবেই ঘটেছে। তবে সবকিছু ঘটেছে একটার পর একটা করে। তারপর হাস্যকর মূর্তির বাকি অংশ পূজারী আলেকজান্ডারের সম্মুখে আগুনে পোড়ানো হয়। [...]

আমাদের প্রভু ঈশ্বরের নামে ভবনটির ইট এক এক করে খুলে নেওয়া হয়। ভবনের স্তম্ভ ভেঙে যায় এবং দেওয়াল ধ্বসে পড়ে। শয়তান মূর্তির দেহে জড়িয়ে থাকা স্বর্ণ, কাপড় এবং মূল্যবান মার্বেল পাথর সরানো হয়। [...]

অবশেষে মন্দির ধ্বংস করা হয়েছে এবং পুরোহিত ও দুষ্ট অপরাধীরা পরাজিত হয়ে নরকের অগ্নিতে পুড়ে ভষ্ম হচ্ছে, যেমন ভাবে বৃথা কুসংস্কার (পৌত্তলিক) এবং প্রাচীন রাক্ষস সেরাপিস ধ্বংস হয়ে গেছে।’

এই ছিল আলেকজান্দ্রিয়ার সেরাপিয়াম মন্দির ধ্বংস হওয়ার বর্ণনার একাংশ, যা রোমান ধর্মযাজক, লেখক, ইতিহাসবিদ, ধর্মতাত্ত্বিক এবং গ্রিক ধর্মতত্ত্বের অনুবাদক Tyrannius Rufinu [জন্ম ৩৪৫ খ্রিস্টাব্দ, মৃত্যু ৪১০ খ্রিস্টাব্দ] তার লেখা Historia Ecclesiastica (২:২৩) গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। আরবিতে সেরাপিয়ামের নাম ‘আমুদ এল-সাওয়ারি’ বা ‘অশ্বারোহীদের স্তম্ভ’।

অ্যাম্ফিথিয়েটার থেকে ট্যাক্সি করে আমরা যখন সেরাপিয়াম মন্দির ও পম্পাইয়ের পিলারে পৌঁছি, তখন দুপুরের সূর্য মাথার উপর ঝুলে আছে। সিস্টার মাই বলেছে, পুরোটা দেখতে ঘণ্টা দুয়েক সময় লাগবে এবং তারপরে আমরা হাঁটা পথে গিয়ে ধীরসুস্থে লাঞ্চ করবো।

আলেকজান্দ্রিয়ার সেরাপিয়াম মন্দির ও পম্পাইয়ের পিলার দর্শনের জন্য যথারীতি টিকেট কেটে ভেতরে ঢোকার পরই দৃষ্টি আটকে যায় সামনে, সেরাপিয়াম মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের উপর। কিছুক্ষণ হা করে তাকিয়ে থেকে ভাবতে থাকি। একসময় সেই ধ্বংসস্তুপের উপর সগৌরবে দাঁড়িয়ে ছিল মন্দির, যা একসময় সেরাপিস মন্দির নামে পরিচিত ছিল। তখন মানুষের পায়ের শব্দে মুখরিত হতো মন্দিরের আঙিনা। মন্দিরের ভেতরে রাজা এবং উজির-নাজিরের উপস্থিতিতে ধ্যানমগ্ন হয়ে পুরোহিত পূজা-অর্চনা করতেন এবং অর্ঘ্য দিতেন দেবতাকে। এছাড়া প্রতœতত্ত্ববিদদের ধারণা থেকে জানা যায় যে, মন্দিরের অভ্যন্তরে সুস্বাস্থ্য, বিয়ে এবং প্রজ্ঞার দেবতা আইসিস [ওংরং]-এর পূজা করা হতো।

ইতিহাস থেকে জানা জানা যায় যে, আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট-এর বাল্যবন্ধু এবং সামরিক বাহিনীর বিশ্বস্ত জেনারেল ছিলেন Ptolemy I Soter [জন্ম খ্রিস্টপূর্ব ৩৬৭, মৃত্যু খ্রিস্টপূর্ব ২৮৩]। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পরে তিনি মিশরের সম্রাট হিসেবে শাসনভার গ্রহণ করেন। মিশরীয় এবং গ্রিকদের মাঝে ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক ব্যবধান কমানোর জন্য তিনি নতুন এক ঈশ্বর সৃষ্টি করেন এবং তার নাম রাখেন গ্রেকো-ইজিপশিয়ান দেবতা ‘সেরাপিস’ [Serapis]। তিনি Sinope থেকে একটা মূর্তি আলেকজান্দ্রিয়ায় নিয়ে আসেন এবং জনগণের মাঝে প্রচার করেন যে, তিনি স্বপ্নে ঈশ্বরকে দর্শন করেছেন। তখন দু’জন ধর্ম বিশেষজ্ঞ ঘোষণার মাধ্যমে মূর্তির নাম রাখে সেরাপিস। মূর্তিটি আদল ছিল মিশরের ঐতিহ্যবাহী দুই দেবতা Osiris এবং Apis-এর মিশ্রণ। তারপরও সেই মূর্তির সঙ্গে হেলেনেস্টিক ধর্মের দেবতাদের গুণাবলী যুক্ত করা হয়। এরা ছিল সূর্যের দেবতা তবঁং এবং Zeus, উর্বরতার দেবতা Helios, এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবনের দেবতা Dionysus এবং Hades Ges Asklepius। তাই তাদের বিশ্বাস ছিল যে, সেরাপিসই মহা পরাক্রমশালী সর্ব শক্তিমান দেবতা।

টলেমি রাজতন্ত্রের তৃতীয় রাজা Ptolemy III Euergetes [রাজত্বকাল: খ্রিস্টপূর্ব ২৪৬ থেকে ২২২] সেরাপিয়াম মন্দির নির্মাণ কাজ শেষ করেন। কাহিনীতে আছে, আলেকজান্দ্রিয়াকে বালা-মুছিবত থেকে রক্ষা করার জন্য দেবতা ‘সেরাপিস’কে মন্দিরটি উৎসর্গ করা হয়েছিল। তবে সেরাপিয়াম মন্দিরের চতুর্দিকে ঘেরা দেওয়ালের ভিত্তি প্রস্তর থেকে জানা যায় যে, পরবর্তীতে Ptolemy IV Philopator-এর (জন্ম খ্রিস্টপূর্ব ২৩৮, মৃত্যু খ্রিস্টপূর্ব ২০৪] রাজত্বকালে [খ্রিস্টপূর্ব ২২১ থেকে ২০৪] পুনরায় গ্রিকদের হেলেনিস্টিক ধর্মের সূর্য দেবতা Harpocrates-কে উৎসর্গ করা হয়। এছাড়া টলেমী আমলে Harpocrates-কে মৌনতা, গোপনীয়তা এবং মঙ্গলের দেবতা হিসেবে গণ্য করা হতো। যাহোক, প্রাচীনকালে আলেকজান্দ্রিয়ায় নির্মিত সব মন্দিরের মধ্যে সেরাপিয়াম মন্দির ছিল আয়তনে বিশাল এবং সবচেয়ে সুন্দর ও স্থাপত্য শৈলীতে অসাধারণ। সেরাপিয়াম মন্দিরটি ছিল একের ভেতর তিন, অর্থাৎ মন্দিরের একাংশে সেরাপিস ধর্মের অনুসারীরা পূজা করতো, দ্বিতীয়াংশ ছিল আইসিস ধর্মাবলম্বীদের জন্য পূজার স্থান এবং তৃতীয়াংশ ছিল Harpocrates-এর বিশ্বাসীদের পূজার জায়গা। আকৃতির দিক থেকে সেরাপিয়াম মন্দিরটি ছিল আয়তাকার এবং মূল প্রবেশ পথ ছিল প্রশস্ত। চারদিকের স্তম্ভ ছিল হীরক, রূপা, ব্রোঞ্জ ও মহামূল্যবান রত্ব দিয়ে অলংকৃত এবং মেঝে ছিল মার্বেল পাথর দিয়ে মোড়ানো।

যাহোক, একসময় সেরাপিস ধর্মের অনুসারীদের মূল ঘাটি ছিল আলেকজান্দ্রিয়া এবং সেখান থেকে রোমান সাম্রাজ্যের সব জায়গায়, এমনকি বৃটেন পর্যন্ত, ছড়িয়ে পড়ে। তখন সেরাপিস ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান ছিল আলেকজান্দ্রিয়ার সেরাপিয়াম। এছাড়া আলেকজান্দ্রিয়া ছিল খ্রিস্টান ধর্মের সূচনালগ্নে অন্যতম প্রধান জায়গা। সেই সময় সেরাপিয়ামকে কেন্দ্র করে দুই ধর্মের মধ্যে বিরোধ বাঁধে। অবশেষে খ্রিস্টানরা সেরাপিয়াম ধ্বংস করে এবং সেখান থেকে সেরাপিস ধর্মের অনুসারীদের বিতাড়িত করে।

সেরাপিয়াম মন্দিরের উপর দিয়ে অনেক ঝড়-ঝাপটা গেছে। কথিত আছে, আনুমানিক ৬৮ খ্রিস্টাব্দে আলেকজান্দ্রয়ার পৌত্তলিকরা সেইন্ট মার্ককে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায় সেরাপিয়াম মন্দিরের অভ্যন্তরে এবং সেখানেই তাকে হত্যা করে। ইতিহাস থেকে আরো জানা যায় যে, রোমান সাম্রাজ্যের শেষ দিকে ৩২৫ খ্রিস্টাব্দে পৌত্তলিকদের অত্যাচারের সময় তৎকালীন খ্রিস্টান সম্রাট কন্সট্যান্টাইন-এর আদেশে মন্দিরটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ৩৯১ খ্রিস্টাব্দে ধর্মীয় দাঙ্গার সময় বিশপ থেওফিলাসের নেতৃত্বে খ্রিস্টান জনগোষ্ঠী এবং রোমান সৈন্যরা সেরাপিয়াম আক্রমণ করে পৌত্তলিকদের শক্ত ঘাঁটি সেরাপিয়াম মন্দির ধ্বংস করে ভেতরের জিনিসপত্র রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে। আক্রমণের সময় পৌত্তলিকরা দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করে এবং খ্রিস্টানদের পাকড়াও করে সেরাপিয়াম মন্দিরের ভেতরে অবস্থান নেয় এবং ব্যারিকেড তৈরি করে। কিন্তু রোমান সৈন্যরা সেই ব্যারিকেড ভেঙে ভেতর প্রবেশ করে এবং পৌত্তলিকদের বন্দি করে। বিশপ থেওফিলাস বন্দিদের হত্যা না করে ছেড়ে দেন। তবে মন্দিরটি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করেন। উত্তেজিত খ্রিস্টান জনগণ সেরাপিসের মূর্তি ভাঙতে দ্বিধাবোধ করে। কেননা তাদের মধ্যে ভয় ঢুকেছিল যে, সেরাপিসের মূর্তি ভাঙলে হয়তো তাদের উপর আকাশ ভেঙে পড়বে। অবশেষে একজন সাহসী সৈনিক এগিয়ে এসে কুড়াল দিয়ে সেরাপিসের মূর্তিতে প্রথম আঘাত হানে [যার বর্ণনা এই লেখার শুরুতে আছে]। সেরাপিসের মূর্তি ভাঙার পরে যখন খ্রিস্টান জনগণ দেখলো যে, মূর্তির ভেতরের ফাঁকা জায়গা থেকে ভয়ার্ত ইঁদুরেরা বেরিয়ে আসছে এবং আকাশও ভেঙে পড়েনি, তখন তাদের বুঝতে বাকি ছিল না যে সেরাপিস আসলে মানুষের গড়া মূর্তি ছাড়া অন্য কিছু নয়। পরবর্তীতে বিজয়া খ্রিস্টানরাা আশেপাশের জায়গা থেকে

পৌত্তলিকদের বিতারিত করে। বর্তমানে সেরাপিয়াম মন্দিরের কিছুই অবশিষ্ট নেই। তবে এখনো মাটির নিচে ধর্মীয় অঙ্কন চিত্র এবং লাইব্রেরি র ভগ্নাবশেষ দেখা যায়। বলা হয়, সেরাপিয়াম মন্দিরের অভ্যন্তরের লাইব্রেরি নাকি তৎকালীন আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরির অংশ ছিল।

কয়েকবার সেরাপিয়াম মন্দিরের সংস্কার করা হয়, যেমন ১১৬ খ্রিস্টাব্দে কিটোস যুদ্ধের সময় ধ্বংস হলে মন্দিরটি রোমান সম্রাট Hadrian-এর আমলে [১১৭-১৩৮ খ্রিস্টাব্দ] পুনরায় নির্মাণ করা হয়। এছাড়া খনন কাজের সময় মন্দির চত্বরে আবিস্কৃত গ্রানাইট পাথরের স্তম্ভ দেখে ধারণা করা হয়েছে যে, পরবর্তীতে রোমানরা ১৮১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ২১৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পুনরায় নির্মাণ করেছিল এবং পরিধি বাড়িয়েছিল। সেরাপিয়ামের পাশেই আছে ডায়োক্লেসিয়ান পিলার বা পম্পাইয়ের স্তম্ভ এবং বর্তমানে সেই স্তম্ভের আশেপাশে ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে আছে সেরাপিয়ামের ধ্বংসাবশেষ।

একসময় সিস্টার মাই বললো, ‘চলো, আগে পেছনের দিকে যাই। তারপর আমরা পম্পাইয়ের স্তম্ভে যাবো।’ মেহেরুন এবং আমি দু’জনেই রাজি হই এবং সিস্টার মাইকে অনুসরণ করি। মন্দির থেকে বাম দিকে খানিকটা পথ যাওয়ার পরই চোখে পড়ে নির্দিষ্ট একটা জায়গা। ইচ্ছে হচ্ছিল জায়গাটি সম্পর্কে সিস্টার মাইকে জিজ্ঞাসা করি। পরক্ষণেই কেন জানি মনে হলো উত্তরটা হয়তো তার জানা নেই এবং না থাকারই সম্ভাবনা প্রচুর। তাই প্রশ্ন করা থেকে নিজের ইচ্ছের লাগাম টেনে ধরি। পরে নেট ঘেঁটে জেনেছি, জায়গাটি ছিল সম্রাটের উপাসনার স্থান। সেখান থেকেই গত শতাব্দীর চলি্লশের দশকে উদ্ধার করা হয়েছিল ‘বুল-গড সেরাপিস’-এর মূর্তি। বলা হয়, সেই মূর্তির সম্মুখে আলেকজান্দ্রিয়ার লোকজন রোমান সম্রাট হ্যাডরিয়াকে উপাসনা করতো।

সবশেষে আমাদের দর্শনীয় মূল জায়গা ছিল সেরাপিয়াম মন্দিরের পাশে খোলা আকাশের দিকে মাথা উঁচু করে নিঃসঙ্গ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা পম্পাইয়ের স্তম্ভ। পম্পাইয়ের স্তম্ভকে ডায়োক্লেসিয়ান স্তম্ভ বা পিলার হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, এমনকি বিজয় স্তম্ভও বলা হয়। তৎকালীন রোমান স¤্রাট ডায়োক্লেসিয়ান ২৯৭ খ্রিস্টাব্দে আলেকজান্দ্রিয়ার জনগণের বিদ্রোহ কঠিন হাতে দমন করেন এবং তার নামানুসারে স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীতে স্তম্ভটি পম্পাইয়ের স্তম্ভ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। পম্পাইয়ের স্তম্ভ নাম কেন রাখা হয়েছে, তার কোনো সঠিক ব্যাখ্যা জানা নেই। তবে কাহিনীতে আছে, ক্রুসেডাররা ভুল করে অথবা সজ্ঞানে বিশ্বাস করতো যে স্তম্ভের উপরে পাত্রের মধ্যে ভস্ম অথবা ভস্মজাতীয় যে জিনিস পাওয়া গেছে, তাতে অনুমান করা হয় যে সেই ভস্ম ক্লিওপেট্রার ভাইয়ের হাতে নিহত রোমান সেনাপ্রধান পম্পাইয়ের। তাই পরবর্তীতে ডায়োক্লেসিয়ান বা বিজয় স্তম্ভটি পম্পাইয়ের স্তম্ভ হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। বলা হয়, রোমান সা¤্রাজ্যের রাজধানী রোম এবং কনস্ট্যান্টিনোপলের বাইরে পম্পাইয়ের স্তম্ভই উচ্চতায় সেরা, এমনকি একক ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা একমাত্র বিশাল প্রাচীন স্থাপনা। লাল আসওয়ান পাথরের তৈরি স্তম্ভটি মাটি থেকে প্রায় সাতাশ মিটার উঁচু ও গোড়ার দিকের বৃত্তাকার দৈর্ঘ্য আনুমানিক নয় মিটার। ঐতিহাসকদের মতে স্তম্ভটির ওজন দু’শ’ পঁচাশি টন। ক্রমশ...