উদাসীন গ্রামের মানুষ, চাপ বেড়েছে হাসপাতাল কবরস্থানে

দেশের মধ্যে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর দিক থেকে কুষ্টিয়া হটস্পটে পরিণত হয়েছে। এমন অবস্থায় মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি ও চলমান লকডাউন মানার প্রবণতা নেই। সব কিছুতেই যেন হ য ব র ল অবস্থা। প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা এর প্রধান কারণ বলে মনে করেন সচেতন নাগরিক মহল। হাটে-বাজারে, সড়কের মোড়ে মোড়ে, চায়ের দোকানে মানুষের অযাচিত চলাচল বন্ধ নেই।

জেলায় যেখানে করোনার সর্বোচ্চ থাবা, ঠিক সেই মুহূর্তে মানুষ অকারণে ঘরের বাইরে নামার ঢল পড়েছে। এদিকে ঈদুল আজহা উপলক্ষে আগামী ১৫ জুলাই থেকে ১ সপ্তাহের জন্য দেশব্যাপী লকডাউন শিথিলে সরকারি প্রজ্ঞাপন জারির সঙ্গে সঙ্গে কুষ্টিয়ায় মানুষের চলাচল আরও বেড়েছে। লকডাউন শুরুর দিকে কিছুটা তৎপরতায় মানুষের চলাচলে প্রতিবন্ধকতা ছিল কিন্তু বর্তমানে কোন প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই জেলার মানুষ ঘরের বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সড়কে নেই পুলিশের বাধা, আর প্রশাসনের তৎপরতা একেবারে খাতা-কলমেই। করোনা সংক্রমণের ভয়াবহতার সময়ে যেখানে প্রশাসনের তৎপরতা বেশি থাকার কথা, সেখানে একেবারেই শূন্যে নেমে গেছে প্রশাসনের নজরদারি। শহর ও শহরতলীর সড়কে জনগণ ও যানবাহনের বাড়তি চাপ অব্যাহত রয়েছে। শহরের ৭টি প্রবেশ মুখে পুলিশের বাঁশের বেরিকেড থাকলেও সেখানে কেউ বাধার মুখে পড়ছেন না। হাতে গোনা দু’চারটা যানবাহন চলতে বাধা দেয়া হচ্ছে।

জুন মাসের শেষের দিকে জেলায় করোনা সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী শুরু হয়। মৃত্যু ও আক্রান্ত আগের সব রেকর্ড একের পর এক ভাঙতে থাকে। হঠাৎ করে হাসপাতালে রোগীর চাপ বাড়তে থাকে। গত এক সপ্তাহে জেলায় নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ৮ হাজার ৯২৬ জনের। করোনা শনাক্ত হয়েছে ১ হাজার ৮৭৪ জন। মারা গেছেন ৯৯ জন। গতকাল পর্যন্ত জেলায় করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ১০ হাজার ৮৭৩ জন, মারা গেছেন ৩৫০ জন। শহরের ৩টি গোরস্তানে আগের চেয়ে চাপ বেড়েছে। প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ জনের দাফন করতে হচ্ছে গোরস্তান খাদেমদের। কুষ্টিয়া পৌর কবরস্থানের খাদেম মধু মিয়া বলেন, আগে দু’তিনটে করে খবর খুঁড়তে হতো। আর এখন প্রতিদিন ৮ থেকে ১০টা কবর খুঁড়তে হচ্ছে। বসে থাকার সময় নেই। সুযোগ পেলে অগ্রিম কবর খুঁড়ে রাখা হচ্ছে। বর্ষা মৌসুম হওয়ায় কবর খুঁড়তে গেলে পানি উঠে যাচ্ছে। ফলে বেশি বেগ পেতে হচ্ছে। একইভাবে চাপ বেড়েছে শ্মশানেও। সেখানেও মৃতদেহ দাহ বেড়েই চলেছে। অন্যদিকে হাসপাতালের বাইরেও অনেক মানুষ বাড়িতেই করোনা চিকিৎসা নিচ্ছেন। তারা বাড়িতে অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে ব্যবহার করছেন। এতে অক্সিজেনের ব্যাপক চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দামও বেড়েছে অক্সিজেন সিলিন্ডারের। অনেক সময় অতিরিক্ত দামেও অনেক সময় অক্সিজেন মিলছে না। এছাড়া অ্যাম্বুলেন্সের চাহিদাও বেড়েছে কয়েকগুণ। কয়েক দিন ধরে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে ঘন ঘন অ্যাম্বুলেন্স ঢুকছে আর বের হচ্ছে। যেসব অ্যাম্বুলেন্স হাসপাতালে প্রবেশ করছে তাতে বহন করা হচ্ছে করোনা আক্রান্ত রোগী। আর বের হচ্ছে করোনায় মারা যাওয়া মৃতদেহ নিয়ে। প্রতিমুহূর্তে কান্নায় ভারি হয়ে উঠছে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতাল চত্বর। অ্যাম্বুলেন্স চালক মোহাম্মদ রফিক বলেন, অ্যাম্বুলেন্স চালকদের এক মিনিটও বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ হচ্ছে না। কখনও করোনা আক্রান্ত রোগীকে নিয়ে হাসপাতালে আসতে হচ্ছে। তাদের মধ্যে কারও অবস্থার অবনতি হলে তাকে নিয়ে ঢাকা বা রাজশাহী মেডিকেলে যেতে হচ্ছে। এর মধ্যে আবার কেউ মারা গেলে তার লাশ নিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিতে হচ্ছে। আগে যেখানে হাসপাতাল চত্বরে শতাধিক অ্যাম্বুলেন্স চালক ভাড়ার আশায় বসে অলস সময় পার করত, আর এখন কারও বসে থাকার ফুরসত নেই।

কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা তাপস কুমার সরকার বলেন, হাসপাতালে এই মুহূর্তে অক্সিজেনের তেমন সংকট নেই। তবে শয্যার তুলনায় রোগী বেশি। সুস্থতার চেয়ে ভর্তি হচ্ছে তার চেয়ে দুই থেকে তিনগুণ। এ কারণেই সংকট বাড়ছে। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আবদুল মোমেন জানান, হাসপাতালে প্রচুর রোগী আসছেন। শয্যা ফাঁকা থাকছে না। আবার মারাও যাচ্ছেন। গত বছর করোনার প্রকোপ শুরু হলে কুষ্টিয়া জেলায় করোনা ওয়ার্ডের জন্য ১৪ জন চিকিৎসককে পদায়ন করা হয়। করোনা ওয়ার্ডের জন্য তাদের বিশেষভাবে নিযুুক্ত করা হয়। তাদের মধ্যে বর্তমানে ৩ জন চিকিৎসক মাতৃকালীন ছুটিতে আছেন। আর একজন ঢাকায় পোস্টিং নিয়েছেন। বাকিরা দায়িত্ব পালন করছেন। এই চিকিৎসকদের বাইরে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকরাও নিয়মিত রোগী দেখছেন। তবে রোস্টারে নাম থাকলেও কিছু চিকিৎসক এক দিনের জন্যও করোনা ওয়ার্ডে যাননি বলে জানা গেছে।

কুষ্টিয়ার সিভিল সার্জন ডা. এএইচএম আনোয়ারুল ইসলাস বলেন, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সবাইকে সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধ মেনে চলতে হবে। নিয়ম মানলে আগামী সপ্তাহ থেকে পরিস্থিতি ভালো হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। গ্রামের মানুষ এখনও সচেতন নয়। এ কারণে গ্রামে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে। তাদের পরীক্ষার আওতায় আনতে হবে। আর উপজেলাগুলো স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে করোনা চিকিৎসা যাতে ভালোভাবে মানুষ পায় সে বিষয়ে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।

বুধবার, ১৪ জুলাই ২০২১ , ৩০ আষাঢ় ১৪২৮ ৩ জিলহজ্জ ১৪৪২

কুষ্টিয়ায় হ-য-ব-র-ল অবস্থা

উদাসীন গ্রামের মানুষ, চাপ বেড়েছে হাসপাতাল কবরস্থানে

জেলা বার্তা পরিবেশক, কুষ্টিয়া

দেশের মধ্যে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর দিক থেকে কুষ্টিয়া হটস্পটে পরিণত হয়েছে। এমন অবস্থায় মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি ও চলমান লকডাউন মানার প্রবণতা নেই। সব কিছুতেই যেন হ য ব র ল অবস্থা। প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা এর প্রধান কারণ বলে মনে করেন সচেতন নাগরিক মহল। হাটে-বাজারে, সড়কের মোড়ে মোড়ে, চায়ের দোকানে মানুষের অযাচিত চলাচল বন্ধ নেই।

জেলায় যেখানে করোনার সর্বোচ্চ থাবা, ঠিক সেই মুহূর্তে মানুষ অকারণে ঘরের বাইরে নামার ঢল পড়েছে। এদিকে ঈদুল আজহা উপলক্ষে আগামী ১৫ জুলাই থেকে ১ সপ্তাহের জন্য দেশব্যাপী লকডাউন শিথিলে সরকারি প্রজ্ঞাপন জারির সঙ্গে সঙ্গে কুষ্টিয়ায় মানুষের চলাচল আরও বেড়েছে। লকডাউন শুরুর দিকে কিছুটা তৎপরতায় মানুষের চলাচলে প্রতিবন্ধকতা ছিল কিন্তু বর্তমানে কোন প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই জেলার মানুষ ঘরের বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সড়কে নেই পুলিশের বাধা, আর প্রশাসনের তৎপরতা একেবারে খাতা-কলমেই। করোনা সংক্রমণের ভয়াবহতার সময়ে যেখানে প্রশাসনের তৎপরতা বেশি থাকার কথা, সেখানে একেবারেই শূন্যে নেমে গেছে প্রশাসনের নজরদারি। শহর ও শহরতলীর সড়কে জনগণ ও যানবাহনের বাড়তি চাপ অব্যাহত রয়েছে। শহরের ৭টি প্রবেশ মুখে পুলিশের বাঁশের বেরিকেড থাকলেও সেখানে কেউ বাধার মুখে পড়ছেন না। হাতে গোনা দু’চারটা যানবাহন চলতে বাধা দেয়া হচ্ছে।

জুন মাসের শেষের দিকে জেলায় করোনা সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী শুরু হয়। মৃত্যু ও আক্রান্ত আগের সব রেকর্ড একের পর এক ভাঙতে থাকে। হঠাৎ করে হাসপাতালে রোগীর চাপ বাড়তে থাকে। গত এক সপ্তাহে জেলায় নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ৮ হাজার ৯২৬ জনের। করোনা শনাক্ত হয়েছে ১ হাজার ৮৭৪ জন। মারা গেছেন ৯৯ জন। গতকাল পর্যন্ত জেলায় করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ১০ হাজার ৮৭৩ জন, মারা গেছেন ৩৫০ জন। শহরের ৩টি গোরস্তানে আগের চেয়ে চাপ বেড়েছে। প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ জনের দাফন করতে হচ্ছে গোরস্তান খাদেমদের। কুষ্টিয়া পৌর কবরস্থানের খাদেম মধু মিয়া বলেন, আগে দু’তিনটে করে খবর খুঁড়তে হতো। আর এখন প্রতিদিন ৮ থেকে ১০টা কবর খুঁড়তে হচ্ছে। বসে থাকার সময় নেই। সুযোগ পেলে অগ্রিম কবর খুঁড়ে রাখা হচ্ছে। বর্ষা মৌসুম হওয়ায় কবর খুঁড়তে গেলে পানি উঠে যাচ্ছে। ফলে বেশি বেগ পেতে হচ্ছে। একইভাবে চাপ বেড়েছে শ্মশানেও। সেখানেও মৃতদেহ দাহ বেড়েই চলেছে। অন্যদিকে হাসপাতালের বাইরেও অনেক মানুষ বাড়িতেই করোনা চিকিৎসা নিচ্ছেন। তারা বাড়িতে অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে ব্যবহার করছেন। এতে অক্সিজেনের ব্যাপক চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দামও বেড়েছে অক্সিজেন সিলিন্ডারের। অনেক সময় অতিরিক্ত দামেও অনেক সময় অক্সিজেন মিলছে না। এছাড়া অ্যাম্বুলেন্সের চাহিদাও বেড়েছে কয়েকগুণ। কয়েক দিন ধরে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে ঘন ঘন অ্যাম্বুলেন্স ঢুকছে আর বের হচ্ছে। যেসব অ্যাম্বুলেন্স হাসপাতালে প্রবেশ করছে তাতে বহন করা হচ্ছে করোনা আক্রান্ত রোগী। আর বের হচ্ছে করোনায় মারা যাওয়া মৃতদেহ নিয়ে। প্রতিমুহূর্তে কান্নায় ভারি হয়ে উঠছে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতাল চত্বর। অ্যাম্বুলেন্স চালক মোহাম্মদ রফিক বলেন, অ্যাম্বুলেন্স চালকদের এক মিনিটও বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ হচ্ছে না। কখনও করোনা আক্রান্ত রোগীকে নিয়ে হাসপাতালে আসতে হচ্ছে। তাদের মধ্যে কারও অবস্থার অবনতি হলে তাকে নিয়ে ঢাকা বা রাজশাহী মেডিকেলে যেতে হচ্ছে। এর মধ্যে আবার কেউ মারা গেলে তার লাশ নিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিতে হচ্ছে। আগে যেখানে হাসপাতাল চত্বরে শতাধিক অ্যাম্বুলেন্স চালক ভাড়ার আশায় বসে অলস সময় পার করত, আর এখন কারও বসে থাকার ফুরসত নেই।

কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা তাপস কুমার সরকার বলেন, হাসপাতালে এই মুহূর্তে অক্সিজেনের তেমন সংকট নেই। তবে শয্যার তুলনায় রোগী বেশি। সুস্থতার চেয়ে ভর্তি হচ্ছে তার চেয়ে দুই থেকে তিনগুণ। এ কারণেই সংকট বাড়ছে। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আবদুল মোমেন জানান, হাসপাতালে প্রচুর রোগী আসছেন। শয্যা ফাঁকা থাকছে না। আবার মারাও যাচ্ছেন। গত বছর করোনার প্রকোপ শুরু হলে কুষ্টিয়া জেলায় করোনা ওয়ার্ডের জন্য ১৪ জন চিকিৎসককে পদায়ন করা হয়। করোনা ওয়ার্ডের জন্য তাদের বিশেষভাবে নিযুুক্ত করা হয়। তাদের মধ্যে বর্তমানে ৩ জন চিকিৎসক মাতৃকালীন ছুটিতে আছেন। আর একজন ঢাকায় পোস্টিং নিয়েছেন। বাকিরা দায়িত্ব পালন করছেন। এই চিকিৎসকদের বাইরে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকরাও নিয়মিত রোগী দেখছেন। তবে রোস্টারে নাম থাকলেও কিছু চিকিৎসক এক দিনের জন্যও করোনা ওয়ার্ডে যাননি বলে জানা গেছে।

কুষ্টিয়ার সিভিল সার্জন ডা. এএইচএম আনোয়ারুল ইসলাস বলেন, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সবাইকে সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধ মেনে চলতে হবে। নিয়ম মানলে আগামী সপ্তাহ থেকে পরিস্থিতি ভালো হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। গ্রামের মানুষ এখনও সচেতন নয়। এ কারণে গ্রামে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে। তাদের পরীক্ষার আওতায় আনতে হবে। আর উপজেলাগুলো স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে করোনা চিকিৎসা যাতে ভালোভাবে মানুষ পায় সে বিষয়ে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।