পিঙ্গল আকাশ : আনফিনিশড্ জার্নি

আবু হেনা মোস্তফা এনাম

ব্যক্তি এবং তার সৃজনশীলতা কী সময়ের সৃষ্টি? অথবা বলা যায় কি, ব্যক্তির মনস্তত্ত্ব ও তার সৃষ্টিকর্মের বিচিত্র বিন্যাস সময়ের অনিবার্য অনুবাদ? ফরাসি ঔপন্যাসিক জর্জ সিমেনঁ উপন্যাসকে সময়ের ট্রাজেডি বলেছেন। তিনি একথা বলেছিলেন কাহিনির অন্তর্নিহিত উত্তেজনা পাঠককে কতটা নিবিষ্ট করে রাখতে পারে তার পরিপ্রেক্ষিতে, যদিও উপন্যাস পাঠের রুচি ও অভিজ্ঞতার ভেতর সবসময় সিমেনঁর মত গ্রহণীয় নয়। আমরা তাঁর সময়ের ইঙ্গিতটি অনুধাবনে আগ্রহী। কেননা শওকত আলী এবং বিশেষত তাঁর ‘পিঙ্গল আকাশ’ [রচনাকাল ১৯৫৮, গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯৬৩ সালে] যে কালপঞ্জি উন্মোচন করে, ষাটের দশক, তখন বিশ্ব জুড়ে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতি-অর্থনীতি ক্ষেত্রে ভাঙচুর বিপুল আলোড়ন, চাঞ্চল্য, অভূতপূর্ব ইতিবাচক রূপান্তর অবসম্ভাবী হয়ে উঠেছিল।

ষাটের দশকে, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মতোই, বাংলাদেশের একঝাঁক তরুণ, যাঁরা ছিলেন তুখোড় আড্ডাবাজ, জ্ঞানানুরাগী, সাহিত্যের নতুন স্বরগ্রাম রচনায় উন্মুখ- খালেদ চৌধুরী, শামসুর রাহমান, মাহমুদুল হক, শহীদ কাদরী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, রফিক আজাদ, বেলাল চৌধুরী প্রমুখ আরো অনেকে- তাঁরা প্রায় সকলেই বোদলেয়ারের পাল্লায় পড়েছিলেন, আলোড়িত এবং বলা যায় প্রভাবিতও হয়েছিলেন বোদলেয়ারীয় ভাবনা ও চৈতন্যের উদ্ভাসে। জীবনের অন্তঃশীল চেতনাধারায় শার্ল বোদলেয়ারের মতো নিঃসঙ্গতা ও দুঃখকে অনুভব করেছিলেন নিজের প্রয়োজনের অনুষঙ্গ রূপে। তাছাড়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তীকালে ১৯২২ সালে প্রকাশিত টিএস এলিয়টের দ্য ওয়েস্টল্যান্ড কাব্যের বিষয়ানুষঙ্গের আত্মিক বিনষ্টি বা মৃত্যুর চিত্রকল্পও ত্রিশের দশক থেকে সূচনা করে এখনও পর্যন্ত প্রভাবিত করে চলেছে তরুণ সাহিত্যানুরাগীদের। শওকত আলী অপরাপর সাহিত্যিক বন্ধুবর্গের মতো অতিমাত্রায় আড্ডাবাজ ছিলেন না, কিন্তু তিনিও কি ওই কালের নিঃশ্বাস চৈতন্যের সুপ্তিমগ্ন নির্জ্ঞান স্তরে গ্রহণ করেছিলেন? দেশবিভাজনের অনিবার্য অভিঘাতে উন্মূলিত ও রক্তাক্ত ব্যক্তিমনস্তত্ত্বের যন্ত্রণা ও দীর্ঘশ্বাস রক্তের গভীরে ধারণ করে তিনি হয়ে ওঠেন কি নীলকণ্ঠ? কেননা তাঁর প্রথম উপন্যাস পিঙ্গল আকাশ এবং প্রথম গল্পগ্রন্থ উন্মূল বাসনা- নামকরণে এই শব্দবন্ধ নির্বাচন করে নেওয়ার পরিপ্রেক্ষিত রূপে আমাদের উপরিল্লিখিত চিন্তাসূত্রসমূহ কল্পনা ও অভিজ্ঞতার জগতে উস্কে ওঠে। যদিও কালগ্রন্থি উন্মোচনের এই সৃষ্টিক্ষমপ্রজ্ঞার প্রতিফলন শওকত আলীর প্রথম পর্যায়ের সাহিত্যকর্মে [বিশেষত প্রদোষে প্রকৃতজন, দক্ষিণায়নের দিন, কূলায় কালস্রোত, পূর্বরাত্রি পূর্বদিন, ওয়ারিশ, যাত্রা অথবা গল্পগ্রন্থ উন্মূল বাসনা, লেলিহান সাধ, শুন হে লখিন্দর] পূর্বাপর একটি আন্তর্সঙ্গতি রক্ষার প্রচেষ্টায় নিবেদিত, কিন্তু ব্যাপক অর্থে শিল্পী শওকত আলী অনেকটাই অপচায়িত।

একটি পারিবারিক বন্ধন ও সংস্কৃতি ধীরে ধীরে ছিন্ন হতে হতে সমূলে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। সেখানে মঞ্জুর জীবন হয়ে ওঠে পরিকীর্ণ সভ্যতার ভগ্নস্তূপ। যদিও মানুষের শরীর কলুষিত হতে পারে- এমন গোঁড়ামি মঞ্জুর নেই, তথাপি তার ঘৃণা নিজেরই দুর্বলতার বিরুদ্ধে

কেননা বাংলা ভাষায় উপন্যাস রচনার করণকৌশল অ্যাংলোস্যাকসন অর্থাৎ ইয়োরোপীয় প্রদর্শিত পথে সূচিত হলেও [দুর্গেশনন্দিনী, ১৮৬৫] ক্রমেই বাংলা উপন্যাসশিল্পীরা স্বতন্ত্র এবং নিজস্ব একটি পথবিন্যাসকে এই উপমহাদেশের মাটি-মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে অঙ্গীভূত করতে সমর্থ হয়েছেন। যেমন পথের পাঁচালীর অপুকে বিভূতিভূষণ পৃথিবীর শাশ্বত স্বরূপের সঙ্গে, ক্রমবিকাশশীল ইতিহাসচেতনার সঙ্গে সামনের দিকে অগ্রসর করে দিয়েছেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ময়না দ্বীপে নতুন বসতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যে নতুন সম্ভাবনা ও উপনিবেশবিরোধী বাঙালি জাতিসত্তার নতুন পরিচয় সন্ধান করেছেন, তারই নদীস্রোতে অন্বিত হয় সতীনাথ ভাদুড়ির ঢোঁড়াইয়ের স্বপ্নময়তা, তারাশঙ্করের করালীর দ্রোহচেতনা, অমিয়ভূষণ মজুমদারের গড়শ্রীখণ্ডে জেগে ওঠা পদ্মার চর অথবা মহিষকুড়ার উপকথা উপন্যাসে আকস্মিক বুনো ষাঁড়-মহিষের রূপান্তরকৃত আসফাকের মনস্তত্ত্ব। অথবা দেবেশ রায়ের তিস্তাপারের বৃত্তান্তে মেট্রোপলিটান জাতিরাষ্ট্রের বিপ্রতীপে উপস্থাপন করেন বাঘারুকে, মাহমুদুল হক কালো বরফে রচনা করেন ঔপনিবেশিকতা ও সামরিক শাসনের শৃঙ্খলমুক্তির আকাক্সক্ষায় শৈশবের প্রেমের প্রত্নপ্রতিমার স্মৃতির তরঙ্গে আত্মসমর্পণের চেতনাবিন্দু এবং আখারুজ্জামান ইলিয়াস খোয়াবনামায় তমিজ ও তমিজের বাপের চরিত্রচৈতন্যে যে স্বপ্নদর্শনের বুনন করেন তারই পথচিহ্নে বাংলা উপন্যাসের মুক্তি সম্ভাবিত হয়ে উঠতে পারে। যদিও রীতির মেজাজে ইয়োরোপীয় জানালার কক্ষপথেই চলেছে পরিভ্রমণ, প্রকৃতপক্ষে এই রীতিখচিত পথ পরিভ্রমণ ছেড়ে নতুন পথরেখা আবিষ্কারের সম্ভাবনা কতটুকু সে অন্য প্রসঙ্গ। হয়ত বাংলা উপন্যাসের এই যাত্রা একদিন ছুঁড়ে ফেলতে সক্ষম হয়ে উঠবে তার রক্ত ও মজ্জায় মিশে থাকা ঔপনিবেশিক প্রভুদের জন্মান্ধ ভূত।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয়, যেমন, লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা অথবা ক্যারিবিয়ান কথাসাহিত্যিকরা- আলেহো কার্পেন্তিয়ার, গার্সিয়া মার্কেজ, হুয়ান রুলফো, হোর্হে বোর্হেস, সোয়াইঙ্কা, চিনোয়া আচেবে- প্রায় প্রত্যেকেই ঔপনিবেশিক প্রভুদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে নিজস্ব জাতিসত্তার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য পুনরাবিষ্কারে ব্যাপক ও তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। কার্পেন্তিয়ারের লোস্ পাসোস্ র্পেদিদোস [১৯৫৩] উপন্যাসটি একই সঙ্গে লাতিন আমেরিকান শিল্পীদের আত্মানুসন্ধানের রূপক, যার শেকড় প্রোথিত ছিল কঠিন বাস্তবতার নিষ্ফলা ভূমিতে এবং এরই মধ্যে মিশে ছিল ভবিষ্যতের জন্য উচ্চকিত সাবধানবাণী। এই কাহিনির সংগীত পরিচালক ওরিনোকোর গভীর জঙ্গলে যে আদিবাসী ইন্ডিয়ানদের দেখা পেলেন, যেখানে পূর্বে কোনো নাগরিক মানুষের পদচিহ্ন পড়েনি, আশ্চর্য সুর ও ছন্দের মেলবন্ধনে রূপময় তাদের সংগীত নিয়ে এলেন সভ্য পৃথিবীতে। কিন্তু পরিচালক কিছুতেই অরণ্যজীবন ও সংগীতকে আধুনিক জীবনের সঙ্গে মেলাতে পারলেন না। সমস্তই নতুন করে প্রারম্ভ থেকে সূচনা করতে চাইলেন তিনি, কিন্তু পাহড়ি বন্যায় অরণ্যের সমস্ত পথরেখা নিশ্চিহ্ন হওয়ায় খুঁজে পাওয়া যায়নি হৃত সময়। এভাবে কার্পেন্তিয়ার একটি নতুন স্বর ও রীতির পাঠ নির্মাণ করেন, সেটি হলো- নিজের সংস্কৃতির শেকড়ের অনুসন্ধান না করে শিল্পীর মুক্তি নেই, কিন্তু তার অর্থ অতীতের মধ্যে আকণ্ঠ নিমজ্জন নয়।

শওকত আলীর প্রদোষে প্রাকৃতজন অথবা ত্রয়ী উপন্যাসে আমরা নিজের শেকড় অনুসন্ধানের একটি জার্নি প্রত্যক্ষ করি, পিঙ্গল আকাশ যার সূচনাবিন্দু।

কিন্তু কার্পেন্তিয়ার যে প্রজ্ঞা ও অপরিসীম নিষ্ঠার সঙ্গে আধুনিক সভ্যাতার অগ্রযাত্রায় অগ্নিপ্রজ্বলন করেছেন, সেক্ষেত্রে শওকত আলী অনেকটাই নি®প্রভ। কেননা তিনি ওই জার্নির পথপ্রান্তে পৌঁছবার পূর্বেই নিজেকে ভেঙেচুরে নিংড়ে নিঃস্ব করে ফেলেছেন, প্রচলিত ও সমকালকবলিত সমাজবাস্তবতার উপরিস্তরের সস্তা কাহিনি রচনা করে হয়ে উঠেছেন ক্লিশে।

দুই

পিঙ্গল আকাশ উপন্যাসের গল্পপুঞ্জে অভাবনীয় কোনো অভিনবত্ব নেই। সামন্তকালের একটি প্রায় প্রাচীন বাড়ির ঘেরাটোপে বন্দি তরুণীর দৃষ্টিকোণ থেকে দৈনন্দিন জীবনের ঘটনাস্রোত তুলে আনা হয়েছে। তরুণী মঞ্জুর জীবনের অসঙ্গতি, যন্ত্রণা ও বিবিধ অপ্রাপনীয়তার মধ্য দিয়েও স্বাভাবিকতা, শ্রভ্রতা ও সৌন্দর্যের প্রতি সীমাহীন আকুলতা এবং পরিণামে স্বপ্নভঙ্গের গ্লানি তাকে নিক্ষেপ করে অনির্দেশ্য অতলান্তিক অন্ধকারের পথে। যে আবিলতা ও অন্ধকার থেকে মঞ্জুর আত্মজাগরণ ও আত্মপ্রতিষ্ঠা ঘটেনি, এমনকি তার কোনো পূর্বাভাসও ইঙ্গিতবাহী নয় উপন্যাসের ঘটনাপুঞ্জে। ডায়েরি অর্থাৎ দিনপঞ্জি রচনার খাতায় সে লিপিবদ্ধ করে তার প্রত্যহ যাপনের অভিজ্ঞতা।

উপন্যস্ত ঘটনার প্রতিটি পর্যায়ে পর্যায়ে জড়িয়ে রয়েছে মঞ্জু চরিত্রের দীর্ঘশ্বাস ও উন্মূলিত হবার আতঙ্ক ও যন্ত্রণা। পিতার মৃত্যুর পর মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে এবং মায়ের এই নতুন সংসারে অবহেলা ও করুণার মধ্যে তার বেড়ে ওঠা। সাংসারিক কাজের চাপে স্কুল ত্যাগ করতে হয়েছিল, কিন্তু সৎ বাবার প্রথম পক্ষের সন্তান আনিসের পরামর্শে সে গোপনে পড়ত ইংরেজি গল্পের বই। একদিকে এই পরিবারের সকল সদস্যের প্রচ্ছন্ন অবহেলা অন্যদিকে মা সালেহার দুর্দমনীয় যৌনাকাক্সক্ষা মঞ্জুর জীবনের শুভ্রতাকে ক্রমশ ঢেকে দেয় সীমাহীন এক পিঙ্গল মেঘে। এরই মধ্যে সে আবিষ্কার করে আনিসের প্রতি তার দুর্নিবার আকর্ষণ। দৈনন্দিন যাপনের সমস্ত কষ্ট, যন্ত্রণা, কটাক্ষ এবং তার শরীরী সৌন্দর্যের প্রতি অন্যের লোলুপতার গ্লানির মধ্যে আনিসের প্রেম তার হৃদয়ে প্রস্ফুটিত করেছিল স্নিগ্ধতা ও মুক্তির আনন্দ :

“আনিস ভাই আমার কথা ভাবে। পৃথিবীতে অন্ততঃ একজনও আমার কথা ভাবে। এই একটা ভাবনা আমাকে বিশ্রী রকমের একটা গ্লানি থেকে মুক্তি দিলো। রাহুলকে যেমন ভালোবাসে আনিস ভাই, যেমন মম্ পুতুল ওদেরকে ভালোবাসে, তেমনি আমাকেও ভালোবাসে। আমার মনের ভেতর গতকালের সেই মিষ্টি অনুভূতিটা আবার নতুন করে ছেয়ে গেল। আমি যেন একটা পাখি, আজ বিকেলে অগাধ নীল আকাশে মুক্তি পেয়েছি।” [পৃ ২০]

ভ্লাদিমির নবোকভের ললিতা উপন্যাসের নায়ক হামবার্ট যেমন তার সৎ মেয়ের কুমারীত্ব হরণের অভিসন্ধি ও ক্রমাগত কিশোরীদের সঙ্গে যৌনসম্পর্ক স্থাপনের উন্মাদনা এবং পরিণামে সহসা এক ধ্বংসাত্মক প্রতিশোধ-আকাক্সক্ষায় নিমজ্জিত হয়েছে, পিঙ্গল আকাশে মঞ্জু প্রতিনিয়ত অনভিপ্রেত যৌন-নিপীড়নের আতঙ্কে এবং পরিশেষে অস্তিত্ববিনাশী কামাসক্তির শিকার হয়। কিন্তু সৎ বাবা অথবা সৎ ভাইদের দ্বারা তার কুমারীত্ব হরণের প্রচেষ্টা রূপায়ণ করেননি শওকত আলী। বরং নিজের মা সালেহা যেন মঞ্জুর প্রতিপক্ষ। আর স্নেহ ও সহানুভূতি মিলেছিল সৎ বাবার কাছে। ক্ষয়িষ্ণু জমিদার বংশের সন্তান তিনি, ঔরসজাত সন্তানেরা যাকে মনে করে স্বার্থপর, ব্যক্তিগত সুখের জন্য তিনি বৃদ্ধ বয়সে বিয়ে করেছিলেন সালেহাকে। মঞ্জুর প্রতিও খুব বেশি সদয় ছিলেন এমন উপলব্ধি প্রথম পর্যায়ের কাহিনিবৃত্তে উন্মোচিত হয়নি। ব্যবসায়িক দেনা-পাওনার সম্পর্কে বরকত এলাহীর সঙ্গে মঞ্জুর বিয়েতে মা সালেহা চাপ প্রয়োগ করলে সৎ বাবাই বরং পিতৃবয়সী একজন পুরুষের সঙ্গে এই বিয়েতে আপত্তি তুলেছেন, বাধা দিয়েছেন। সালেহার যৌনলোলুপতা, অর্থমোহ ও স্বার্থপরতার উচ্চ- অন্ধতার মধ্যে পাণ্ডুর জ্যোৎস্নার গভীর রাতে নিঃসঙ্গ একাকী মঞ্জুর পাশে তিনি দাঁড়িয়েছেন সত্যিকার পিতার স্নেহ ও ব্যক্তিত্ববোধের ঔদার্যে :

আমার ভাবনা ছিলো না, না দুঃখ, না কান্না, না ক্ষোভ, না ঘৃণা- কোনো অনুভূতি ছিলো না। শুধু একাকী আর শূন্য একটা নিঃসঙ্গতা নিয়ে বসে ছিলাম। কতক্ষণ যে, কে জানে।

এমন সময় মাথার ওপর যেন কেউ হাত রাখলো।...

মঞ্জু মা, থেমে থেমে বাবার কণ্ঠস্বর ডাকল আমাকে।

যে নামে কোনোদিন আমাকে ডাকেননি বাবা, সেই নামে আজ ডাকলেন। মাথা তুললাম আমি। দেখলাম, বাবা আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। সহানুভূতি আর স্নেহ, করুণা আর বেদনা যেন শরীর ধরে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। [পৃঃ ৩৬]

সংসারের প্রতি মায়ের উদাসীনতা এবং অনেকাংশে বাবার নিষ্ক্রিয়তায় পারিবারিক শৃঙ্খলা ভেঙে যায়। সৎ মায়ের দায়বোধহীনতা এবং বাবার প্রতি অভিমান থেকে আনিস ছোটো আপা, রাহুল প্রত্যেকেই পারিবারিক বন্ধনের আবেগ থেকে ছিটকে বেরিয়ে পড়ে। সমাজ-অস্বীকৃত যৌনাচারে প্রতিনিয়ত অসম্মানিত হতে হতে বাবার মৃত্যু অনিবার্য হয়ে ওঠে। শুভাকাক্সক্ষী ও স্বার্থান্বেষী স্বজনেরা প্রচণ্ড অর্থনৈতিক সঙ্কটের কালে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে। কেবল মঞ্জু ছোটো বোনদের এবং অসুস্থ, প্রায় বিকারগ্রস্ত মায়ের অন্নবস্ত্র ও চিকিৎসার দায়িত্ব পালন করে চলে নীরবে। আর প্রতীক্ষা করে আনিসের ফিরে আসবার। কিন্তু আকস্মিকভাবে একদিন আত্মীয়-বন্ধুদের সাহচর্যে মঞ্জুকে বিসর্জন দিতে হয় তার কৌমার্য। ফলে মঞ্জুর আকৈশোর লালিত স্নিগ্ধতা, শুভ্রতা, পবিত্রতা মুহূর্তে নিপতিত হয় নিকষ কালো মৃত্যুময় আঁধারে। নিজের সর্বস্ব হারানোর বেদনায় সে উপলব্ধি করে : ‘মা বাবাকে হত্যা করেছে আর আমাকে হত্যা করলো এরা সবাই মিলে।’

তিন

পিঙ্গল আকাশ উপন্যাসের এই আপাত সরল কহিনিপুঞ্জে ব্যক্তি মানুষের জীবন ও সমাজবাস্তবতার অন্তর্তলবর্তী স্রোতে সদ্য ঔপনিবেশিক শাসনমুক্তি ও তৎপরবর্তী সাম্প্রদায়িক চৈতন্যের উত্থান-পতনের অষ্টাবক্র ঘূর্ণিপাকে নিমজ্জিত এবং পরিণামে দীর্ঘ সামরিক শাসন-শোষণে পিষ্ট সমাজ ও মানুষের বিনষ্ট মূল্যবোধের রূপালেখ্য উপলব্ধি করা যায়। কেননা পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায়কে উদ্ধৃত করে বলা যায়, ‘অন্তঃসলিলা ইতিহাসের প্রক্রিয়ার উন্মোচন, অভিজ্ঞান সন্ধানে, জনসমাজের নির্মাণ ভাঙনের চেতনায়, এমনকি ধর্মীয় জিজ্ঞাসার বহুমাত্রিক অšে¦ষণেও উপন্যাস হয়ে উঠতে পারে রাজনৈতিক।’ তাছাড়া ছাত্রজীবনেই প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে শওকত আলীর সংশ্লিষ্টতাও তাঁর চিন্তাসূত্র ও অভিজ্ঞানের পরম্পরাটি বুঝে নিতে সহায়ক।

উপন্যাসের সূচনাংশে ঝড় ও বৃষ্টিবিক্ষুব্ধ রাত্রে মঞ্জু অত্যন্ত আকস্মিকভাবে প্রবেশ করে একজন লেখকের ঘরে, যিনি তখন রাজা ঈদিপাস নাটকের কাহিনি পড়ছিলেন। ক্ষণকাল আশ্রয়ের পর মঞ্জু লেখকের অলক্ষে বেরিয়ে পড়ে, কিন্তু ফেলে যায় তার জীবনের সমস্ত কষ্ট যন্ত্রণা ও গ্লানির ইতিবৃত্ত লেখা ডায়েরিটি। ডায়েরি সূত্রেই উপন্যাসে উন্মোচিত হয়েছে শুভ্র, স্নিগ্ধ জীবনের জন্য স্বপ্ন বুনে চলা এবং পরিণামে এক অন্ধকূপে আত্মোৎসর্গিত তরুণীর করুণ গল্পপুঞ্জ। এই করুণ ও পুঞ্জিভূত ঘৃণার উৎস কোথায়? কাহিনির সূচনাংশেই ঔপন্যাসিক ইঙ্গিত দিয়েছেন- সফোক্লিসের রাজা ঈদিপাস নাটকের উল্লেখের মধ্য দিয়ে। ওই নাটকের ট্রাজেডির মতোই এই উপন্যাসের চরিত্রাবলি কালের ব্যাবধানে নির্মম এক রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক বাস্তবতার ঘূর্ণিতে যন্ত্রণাময় পথের অভিযাত্রী, মৃত্যুশীল। এখানে চৌধুরী সাহেব, সালেহা, বেনু, আকরাম, তাজিনা, কাসেম খান, নাসিমা, রাহুল, ছোটোআপা সর্বোপরি মঞ্জু এবং আনিস সকলেই ওই ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের নিষ্ঠুর নিয়তি বহন করে চলেছে রক্তের মধ্যে :

“... যখন প্রথম এসেছিলাম এ বাড়িতে, মার চোখে তখন জীবনের সব তৃপ্তির ছায়া দেখেছিলাম। মনে হয়েছিলো, মার জীবনে বোধ হয় আর কোনো খেদ নেই, দুঃখ নেই। তারপর থেকে ধীরে ধীরে কোন সূত্র থেকে যে এলো এমন তিক্ততা টেরও পেলাম না। কেবল দেখলাম দু’জনের মাঝখানে যেন একটা অদৃশ্য দেয়াল উঠে দাঁড়াচ্ছে। আর দিনের পর দিন অদৃশ্য একটা সম্পর্কের মধ্যে মা, বাবা, আর তাদের ছেলেমেয়েরা। কিন্তু দেখলাম, আসলে তাও নয়। সবাই একাকী। বাবা আর ছোট আপা, ছোট আপা আর আনিস ভাই, রাহুল আর আমি এ বাড়ির সঙ্গে কারো যোগ নেই। এই যে সম্পর্কের বাঁধন দেখি, এ যেন শুধু বাইরের। ভেতরে ভেতরে সবার চোখে সন্দেহের ছায়া। এদের সব সম্পর্কের মূলে কেউ যেন একের থেকে অন্যকে কেটে কেটে বাদ দিয়ে রাখছে।”

ব্যক্তিমানুষের মধ্যে এই পারস্পরিক দূরত্ব, অন্তর্দ্বন্দ্ব ও দ্বিধা কেবল পারিবারিক বিশৃঙ্খলা-প্রসূত নয়, এই বিচ্ছিন্নতার সূচনা ঔপনিবেশিকতার নিপুণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দেশবিভাজন ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্গত দুই প্রান্তের দুটি ভূখণ্ডের আন্তঃসম্পর্কের বিচ্ছিন্নতা। পূর্বপাকিস্তানের উপর পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক শাসকগোষ্ঠীর শোষণ, দমন-পীড়নে পূর্বপাকিস্তানের জনজীবন হয়ে উঠেছিল নিষ্পেষিত, জর্জরিত। অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত। নূন্যতম নাগরিক ও মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। সাংস্কৃতিক নিষেধাজ্ঞার শিকার। ফলে বাধাগ্রস্ত হয় জীবন ও সমাজের সার্বিক অগ্রগতি। ভেঙে পড়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সমস্ত মানদণ্ড। একদিকে ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি অন্যদিকে আন্তরাষ্ট্রীয় নিপীড়নের প্রত্যক্ষ প্রভাব বাংলাদেশের ষাটের দশকের সমাজ ও যৌথ পরিবারকাঠামোর অন্তর্নিহিত সংহতিতে ক্ষয়ের সূচনা করে। একটি সাক্ষাৎকারে শওকত আলী বলেছেন : “’৪৭ সালের পর গত ৪টি দশক জুড়ে আমাদের অস্থির এবং খুব টানটান সময়ের মধ্য দিয়ে দিনযাপন করতে হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। জীবনের বাইরের দিকে যেমন, তেমনি ভিতরের দিকেও এত ভাঙচুর ও দ্রুত ভালোমন্দ পরিবর্তন ঘটেছে যে, ... আমাদের লেখকদের ওপর জীবনবাস্তবতার চাপ খুব বেশি।... বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে জীবন বেশি, বানানো গল্প কম।” [বজলুল করিম বাহার, ‘নিসর্গ’, মার্চ ১৯৯২] ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা, ’৫৪-র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে গ্রামে গ্রামে বক্তৃতা করে বেড়ানো, পরিণামে কারাবরণ এবং আকৈশোর অত্যন্ত নিকট থেকে গ্রামীণ জীবনকে দেখার অভিজ্ঞতার ফলে সময়ের অন্তঃশীল বাস্তবকে শওকত আলী অনুধাবন করেছেন এবং ওই গভীরতর সঙ্কটকে মিলিয়ে দিয়েছেন মঞ্জুর জীবনের কথামালার স্রোতে :

“এ বাড়িকে যে ধ্বংস করেছে, সে রয়েছে সবরকম স্পষ্টতার ওপারে। দূর থেকে নানান ছলে সে এগিয়ে এসে একে একে ভিত্তির ইট খসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। অথচ কেউ টের পাচ্ছে না। চারদিক থেকে কী একটা শক্তি ধীরে ধীরে তার প্রকাণ্ড থাবার মধ্যে চেপে ধরতে চাইছে। একদিন হয়তো দেখবো, এতো বড় বাড়িটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।”

তাহলে কি ১৯৫৮ সালে শওকত আলী উপলব্ধি করেছিলেন পাকিস্তানের অখ-তা থাকবে না? তাই মঞ্জুর আত্মমুক্তির আকাক্সক্ষার স্রোতে তরঙ্গময় করে দিয়েছেন সামষ্টিক জনচেতনার আবেগ? অথবা আলেহো কার্পেন্তিয়ার নিজের শেকড়ের অনুসন্ধানের মধ্যে মুক্তির বার্তা পেয়েছেন, শওকত আলীও কি মঞ্জুর উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতায় ওই মুক্তির ভিন্নতর প্রেক্ষাপট রচনা করেছেন? আত্মপরিচয়ের সন্ধান, আত্মশক্তির উদ্বোধন এবং ওই শক্তির সংহত রূপ অর্থাৎ সংঘশক্তির সম্মিলিত প্রয়াস ব্যতীত যে বিপুল ধ্বংসযজ্ঞের ভেতর থেকে জীবনের সঞ্চার সম্ভব নয় মঞ্জুর মনোকথনময় অভিজ্ঞানে উঠে এসেছে ওই ঐক্যবিন্দু :

“বুঝতে পারি, মাঝে মাঝে শক্তি নিয়ে দাঁড়াতে চেয়েছি আমি, রাহুল, আনিস, বাবা। কিন্তু বিচ্ছিন্নভাবে আমরা তো ক্ষুদ্র। নিজেদেরই যে আমরা ভালো করে চিনি না। যদি সবাইকে ভালোবাসতাম, সংহত করতাম নিজেদের। সহজ হতাম, স্বাভাবিক হতাম- তাহলে হয়তো দাঁড়াতে পারতাম এই ধ্বংসের স্রোতের মাঝখানেও দ্বীপের মতো। কিন্তু নিজেরা পরস্পরকে জানলাম না যে।” [পৃ. ৬৩]

বাঙালির চূড়ান্ত আত্মজাগরণ ঘটেছিল ’৭১-এ। কিন্তু এই ধ্বংসযজ্ঞের নায়ক কি কেবলই ঔপনিবেশিক ও মিলিটারি শাসন-শাসক? কালগ্রন্থির সামূহিক সম্ভাবনাকে বাঙালি জাতির তথাকথিত শিক্ষিত, সংস্কৃতিবান এবং নিঃসন্দেহে বিত্তশালী শ্রেণিটি কি এই ধ্বংসযজ্ঞে ঘৃতাহুতি দেয়নি? বরং শিক্ষিত শ্রেণিটি ঔপনিবেশিক জ্ঞানকাণ্ডের ভূমিকাকে প্রবলভাবে প্রচলন করিয়ে দেয়। মিশেল ফুকো যেটিকে বলেছেন প্রদর্শননির্ভর জ্ঞান, যা প্রকৃতপক্ষে ঔপনিবেশিক বিকৃতিকেই প্রতিষ্ঠা করে এবং জ্ঞানকাণ্ডের কেন্দ্রে ব্যক্তি মুখ্য হয়ে ওঠার কথা, কিন্তু ব্যক্তি সেখানে নিতান্তই গৌণ হয়ে পড়ে। শওকত আলী মঞ্জু চরিত্রের পরিকল্পনায় এই প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। একটি পারিবারিক বন্ধন ও সংস্কৃতি ধীরে ধীরে ছিন্ন হতে হতে সমূলে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। সেখানে মঞ্জুর জীবন হয়ে ওঠে পরিকীর্ণ সভ্যতার ভগ্নস্তুপ। যদিও মানুষের শরীর কলুষিত হতে পারে- এমন গোঁড়ামি মঞ্জুর নেই, তথাপি তার ঘৃণা নিজেরই দুর্বলতার বিরুদ্ধে। কাসেম খানের যৌনপৈশাচিকতার কাছে কৌমার্য হারিয়ে মঞ্জু মানসিকভাবে হয়ে পড়ে নিঃস্ব ও মৃত্যুন্মুখ।

চার

কিন্তু শওকত আলী তাঁর উপন্যাসে একজন নারীকে কেন কেন্দ্রে স্থাপন করলেন? ঔপনিবেশিক সমাজবাস্তবতার সঙ্কট পুরুষ চরিত্রের জীবনাভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েও রূপায়ণ করা সম্ভব ছিল, কেবল পিঙ্গল আকাশ নয়, পরবর্তীকালে তাঁর আরো একাধিক উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র নারী। হতে পারে, অত্যন্ত নিকট থেকে গ্রামীণ জীবন ও পরিবারকাঠামো দেখা, তাছাড়া দেশবিভাগোত্তর কালে কংগ্রেসের সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতাসূত্রে পরিবারে পিতার উপস্থিতির চাইতে অধিক মাত্রায় মায়ের সান্নিধ্য প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে তিনি নারীর জীবনকে প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা লাভ করেন। এ কারণে নারীর জীবন ও দৃষ্টির আলোয় তাঁর কতিপয় উপন্যাসের পটভূমি রূপায়ণ করেছেন। অন্তর্নিহিত কারণ যেটিই হোক না কেন, এ উপন্যাসের মঞ্জু চরিত্র রূপায়ণে ঔপন্যাসিকের নারীবাদী সংবেদনার আবেগ তলিয়ে দেখা আমাদের অভিপ্রায়।

ঊনবিংশ-বিংশ শতাব্দীর নারীবাদী আন্দোলনের প্রবক্তাদের কথা বর্তমানের অনুসন্ধিৎসু পাঠকের জানা রয়েছে, বিধায় তা পুনরুল্লেখের প্রয়োজন বোধ করছি না। তবে প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় ফরাসি নারীবাদী হেলেন সিজো ও জেভিয়ার গোথিয়ারের বরাত দিয়ে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর অধস্তনতাকে ব্যাখ্যা করা যায়। তাঁরা বলেছেন, ইতিহাসের দীর্ঘ অধ্যায় জুড়ে নারী বাধ্য হয়েছিল নীরব থাকতে, নিজের কথা বলতে পারেনি সে, এ কারণে নারীর কোনো ইতিহাস নেই। নারী ইতিহাস রূপে যা রচিত হয়েছে, তা প্রকৃতপক্ষে পুরুষ নির্মিত ও রচিত ভাবমূর্তি, যা পুরুষতন্ত্রের নিজস্ব চিন্তাকাঠামো দ্বারা নারীকে অধস্তন করে রাখা ও নির্যাতন করার নতুন কৌশল মাত্র। নারীকে পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে লিখতে হবে নারীর নিজস্ব ইতিহাস। শওকত আলী ওই ইতিহাসটিই বয়ানের চেষ্টা করেছেন। পিতৃপুরুষের পরিচয় উন্মোচিত হয়েছে বটে, কিন্তু ঔপন্যাসিক অবচেতনেও মঞ্জুর বাবার নাম উল্লেখ করেননি। এমনকি মায়ের ভর্ৎসনায় একটিবারই মাত্র মঞ্জুর মনে বাবার সম্পর্কে শ্রুতি-অভিজ্ঞতা ভেসে উঠেছে- ‘বাবা কেমন দেখিনি। কিন্তু শুনেছি, বাবা আমাকে খুব ভালোবাসতেন।’ অর্থাৎ পিতৃত্বের নাম-পরিচয়হীন, অবয়বশূন্য পরিপ্রেক্ষিতের মধ্যে স্বয়ং নারীর ব্যক্তিঅস্তিত্বের লড়াইটাকে প্রধান করে তুলেছেন। এই রূপায়ণের মধ্য দিয়ে পিতা-স্বামী-সন্তানের উপর নারীর নির্ভরতার চিরায়ত বিশ্বাস-সংস্কার ও পিতৃতন্ত্রকে ঔপন্যাসিক ছুঁড়ে ফেলেছেন আঁস্তাকুড়ে। উন্মোচন করেছেন নারীর প্রতি সমাজের নগ্ন নোংরা দৃষ্টিভঙ্গি। কুমারীত্ব হারিয়ে এক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ রাত্রে মঞ্জু বাড়ি ছেড়ে নিরুদ্দেশ হলে প্রতিবেশীরা ধরেই নেয়, সে বিবাহপূর্ব যৌনসম্পর্কের কারণে গর্ভবতী হয় এবং এই অপকর্ম আড়াল করতে বেছে নেয় আত্মহননের পথ। একজন কুমারী মেয়ের নিরুদ্দেশ হওয়ার কারণ রূপে এর চাইতে সরল ব্যাখ্যা ও মীমাংসা আর কী হতে পারে! তবে এই ব্যাখ্যা ও যুক্তি বিন্যাস করতে গিয়ে ঔপন্যাসিকও কি তাঁর আকৈশোর বেড়ে ওঠা পিতৃতান্ত্রিক জ্ঞানকাঠামো থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি?

মঞ্জুর ডায়েরির সূচনাতেই তাই রয়েছে আনিস-প্রসঙ্গ। আনিস তাকে এ বাড়ি থেকে [দাদার বাড়ি] চলে যেতে বারণ করেছে, আনিস মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করতে বলেছে, ইংরেজি পড়তে বলেছিল আনিস- ‘সেই থেকে রোজ একটু করে পড়তাম।’ অন্ধকারে শাড়ি পরিহিত তাকে আনিস চিনতে না পারলে তার অভিমান, ‘ও কি দেখেনি আমি কতো সুন্দর হয়েছি?’ কুমারীত্ব হারিয়ে মঞ্জুর উপলব্ধি- ‘না, মানুষের দেহ কলুষিত হতে পারে- এমন গোঁড়ামি আমার নেই।’ অতঃপর ক্ষুদ্র একটি প্যারার পরেই ঔপন্যাসিক লিখেছেন- ‘এতোকাল ধরে ভেতরে বাইরে এতো বাধার পাহাড় পার হয়ে এসে শেষ মুহূর্তে আমি আনিসকে হারিয়ে ফেললাম।’ কেননা পুরুষের কাছে কুমারী নারীই গ্রহণযোগ্য। পুরুষের বিবাহপূর্ব যৌনসম্পর্ক সমাজ মেনে নিলেও নারীকে হতে হবে শুভ্র, সুন্দর, পবিত্র। পুরুষই নারীর কুমারীত্ব হরণ করে তাকে কলঙ্কের দায় চাপিয়ে নিক্ষেপ করে অন্ধকূপে। পুরুষের এই ‘শুভ্রতা’ প্রাপ্তির আকাক্সক্ষা অবচেতনে নারীর রক্তের মধ্যে প্রবহমান। শরীর কলুষিত হবার গোঁড়ামি মঞ্জুর নেই- এই ভাবনার পরও সুন্দর শুভ্র আর পবিত্র থাকতে ব্যর্থ হবার গ্লানির চাইতে তার কাছে বড়ো হয়ে দেখা দিয়েছে আনিসের ঘৃণা। অর্থাৎ আনিসের জন্যই তার সমস্ত আয়োজন। আধুনিক শিক্ষিত পুরুষের জন্য চাই শিক্ষিত, একটু-আধটু ইংরেজি জানা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে পারদর্শী নারী। কেননা নিজের কব্জাগত নারীটি ইংরেজি জানলে, গান গাইতে পারলে সমাজে পুরুষের স্ট্যাটাস বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া শিক্ষিত সংস্কৃতিবান নারীর বাজারমূল্যও বেশি। একজন পুরুষের জন্য ‘নারী’ হয়ে ওঠার এই আয়োজন প্রকৃতপক্ষে পুরুষতান্ত্রিক জ্ঞানকাণ্ডের ভেতর থেকে নারীকে আরো অধস্তন করে তুলবার স্বর রচনা।

তথাপি সমাজের সংস্কার, পারিবারিক সংস্কৃতির আলো-হাওয়ায় নারীর ‘মানুষ’ হয়ে ওঠার যে সংকট ও দুর্বিপাক রয়েছে পিঙ্গল আকাশে তার স্ফুরণ প্রকাশে ঔপন্যাসিক অনেকাংশেইসচেতন। বিয়ের জন্য কনে দেখা প্রথার বিরুদ্ধে মঞ্জু ভেবেছে- ‘... কাপড় আর জামার পুঁটুলি হয়ে চলাফেরা করতে হতো। একের পর এক বরপক্ষ থেকে দেখতে আসতো, জিজ্ঞেস করতো নাম কি, হাঁটিয়ে পরখ করতো খোঁড়া কিনা, চুল মাপতো কেউ, মাগো, কি বিচ্ছিরি কা-!’ তদুপরি ছিল খালাতো ভাই বেনুর অনাকাক্সিক্ষত যৌন উৎপীড়নের আতঙ্ক, সংসারে বাঁদীগিরি করার যন্ত্রণা এবং সর্বোপরি নারীরাও যে হতে পারে পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার ধারক-বাহক মায়ের চরিত্রে তার রূপায়ণ ঘটেছে। সংসারের সচ্ছলতার জন্যই কেবল মা মঞ্জুকে বরকত এলাহীর সঙ্গে বিয়ে দিতে চেয়েছে, তা নয়। বরং নারী যে পুরুষের যৌন-সেবাদাসী ঔপন্যাসিক সালেহা চরিত্রে সমাজের এই মনস্তত্ত্বটি তুলে এনেছেন। ষোল বছরের কিশোরী মঞ্জুকে তার সৎ বাবা ব্যবসায়ী বন্ধু বরকত এলাহীর সঙ্গে বিয়ে দিতে আপত্তি জানালে সালেহা বয়স সংশোধন করে দেয়- “ষোল নয়, সতেরো।... এমন তো কত হচ্ছে। আমি যে তোমার বয়সী একটা লোককে বিয়ে করে সুখী হয়েছি- এটাও তো হওয়া উচিত ছিলো না।”

বাইরের পরিবেশের সঙ্গে মঞ্জু খুব বেশি পরিচিত নয়, প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া খুব বেশি করেনি। এমন একজন তরুণীর পক্ষে একাকী অনিশ্চিত গন্তব্যে যাত্রা নিরাপদ নয়। কিন্তু যে পরিবেশে মা ব্যক্তিগত সুখ ও স্বার্থচিন্তায় নিজের মেয়ের সর্বনাশ করতে দ্বিধান্বিত নয় সেই পরিবেশও কি একজন তরুণী নিরাপদ? ফলে নারীর সংস্কার, পরিবারের বৃত্ত ও পুরুষের নোংরা যৌনকাতরত-পরাধিনতা থেকে বেরিয়ে নিজের স্বাধীন চৈতন্যের আকাক্সক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে অস্তিত্বময় হয়ে উঠবে সেই পরিপ্রেক্ষিত রচনা না করেই শওকত আলী মঞ্জুকে নিক্ষেপ করেছেন অনিশ্চিত অন্ধকার গহ্বরে। কেননা শওকত আলী জানেন, যেসমস্ত শর্ত, দায়বদ্ধতা ও অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সমাজে নারী সুস্থ, শুভ্র জীবনযাপন করতে পারে ঔপনিবেশিক ও পণ্যমানসিকতাযুক্ত এবং সামরিক শাসননির্ভর রাষ্ট্রে ওই পরিপ্রেক্ষিত সৃষ্টি সম্ভব নয়। এ কারণে মঞ্জু বারবার নিজেকে প্রশ্ন করেছে- সে কী করবে? কিন্তু উত্তর মেলেনি। ঔপন্যাসিকের পক্ষে উত্তর দেওয়া সম্ভব হয়নি। এমনকি ১৯৭৬, ’৭৭, ’৭৮ সালে ‘বিচিত্রা’র ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত তাঁর ত্রয়ী উপন্যাসের [দক্ষিণায়নের দিন, কুলায় কালস্রোত ও পূর্বরাত্রি পূর্বদিন] কেন্দ্রীয় চরিত্র রাখীও নিজেকে একই প্রশ্ন করেছে- এখন সে কী করবে? তখনও বাংলাদেশে স্বৈর-সামরিক সরকার রাষ্ট্র ক্ষমতায়। যদিও রাখী-চরিত্র নির্মাণে শওকত আলী অনেক বেশি সাহসী ও প্রাগ্রসর চিন্তার পরিচয় দিয়েছেন। রাখী অবৈবাহিক সম্পর্কে সেজানের সন্তান গর্ভে ধারণ করে, কিন্তু এই মাতৃত্ব সে অস্বীকার করেনি, বরং রাখী তার অনাগত সন্তানের উদ্দেশে উচ্চারণ করে, ‘এই রাস্তায় সেজান মিছিল নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল- তুইও এই রাস্তা দিয়ে মিছিল নিয়ে এগিয়ে যাস, হ্যাঁরে, পারবি তো?’ তাহলে বলা যেতে পারে, যে সম্ভাবনা ও সমাজরূপান্তরের অঙ্গীকার শাখায়-প্রশাখায়, পত্রপুষ্পে সমাচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে ত্রয়ী উপন্যাসের রাখী চরিত্রের পরিকল্পনা ও পরিণামে তার সূচনাবিন্দু পিঙ্গল আকাশে, মঞ্জুর আবেগময় কথামালায়।

শওকত আলী জানেন, যেসমস্ত শর্ত, দায়বদ্ধতা ও অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সমাজে নারী সুস্থ, শুভ্র জীবনযাপন করতে পারে ঔপনিবেশিক ও পণ্যমানসিকতাযুক্ত এবং সামরিক শাসননির্ভর রাষ্ট্রে ওই পরিপ্রেক্ষিত সৃষ্টি সম্ভব নয়।

কিন্তু মঞ্জু চরিত্র রূপায়ণে শেষপর্যন্ত ঔপন্যাসিক তাঁর সৃষ্টিক্ষমপ্রজ্ঞার যথাযথ পরিচয় দিতে পারেননি। মঞ্জু বারবার নিজেকে প্রশ্ন করেছে- এখন সে কী করবে? একই প্রশ্ন তাঁর ত্রয়ী উপন্যাসের রাখী চরিত্রের কণ্ঠস্বরে বেজে উঠেছে। এই ত্রয়ী উপন্যাসে লিঙ্গভিত্তিক পুরুষতান্ত্রিক ইচ্ছে-অনিচ্ছের প্রতিফলনকে শওকত আলী অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে রোপন করেছেন শ্রেণিবিভাজনহীন সমাজ নির্মাণের স্বপ্নীল জীবনকোষ। রাখী-সেজানের সমাজঅস্বীকৃত সন্তানের মধ্যে ঔপন্যাসিক যে স্বপ্ন পল্লবিত করেছেন, মঞ্জু চরিত্রটি ওই পরিপ্রেক্ষিতে পরিণামের দিকে অগ্রসর হয়েছে মাত্র, পরিপূর্ণতা পায়নি। শিক্ষাবঞ্চিত হলেও ইংরেজি পড়–য়া, পারিবারিক সংস্কৃতির মধ্যে নিষ্পেষিত, লাঞ্ছিত মঞ্জুর মধ্যে নিজেকে সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে অন্তর্গত শক্তির সাহসি ভূমিকায় রূপান্বিত হয়ে ওঠার সামূহিক পরিপ্রেক্ষিত ছিল। তাছাড়া সেজানের মতো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা অথবা দার্শনিক অবস্থান কোনো কিছুই আনিসের মধ্যে উপ্ত হয়নি। আনিস পিঙ্গল আকাশে নিতান্তই গৌণ ও উপেক্ষিত। ষাটের দশকের সমাজতন্ত্রীদের মতো [যেমন সেজান] আনিস সারাদিন উদ্দেশ্যহীন সময় অতিবাহিত করে, তেলহীন রুক্ষ চুল, জামাকাপড় নোংরা, বিশ্রী গন্ধ এবং সে ঢাকায় চাকরি করে, মাঝেমধ্যে বাড়ি আসে, মঞ্জুকে হঠাৎ চিঠি লেখে- এরকম আকস্মিক দু-একটি তথ্য ব্যতীত উপন্যাসে তার ভূমিকা শূন্য। ফলে নারী-পুরুষের যৌথ সংস্কৃতি ও মানবিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিত্বের বিকাশ অথবা সমাজ নির্মাণের অঙ্গীকারটি পল্লবিত হতে পারে, পিঙ্গল আকাশে তা অনেকটাই ক্লিশে। বরং বলা যায়, আলেহো কার্পেন্তিয়ারের প্রসঙ্গ টেনে যে সংস্কৃতির শেকড় অনুসন্ধানের চিন্তার উন্মেষ এই প্রবন্ধের সূচনায় উল্লিখিত হয়েছে, সেইসূত্রে, শওকত আলীর পরবর্তী উপন্যাসে ওই প্রক্রিয়া ও পরিণাম নির্দেশ করে বস্তুময় সমগ্রতার অভিমুখে, পিঙ্গল আকাশ ওই যাত্রার সূচনাবিন্দু।

বৃহস্পতিবার, ২৭ জানুয়ারী ২০২২ , ১৩ মাঘ ১৪২৮, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৩

পিঙ্গল আকাশ : আনফিনিশড্ জার্নি

আবু হেনা মোস্তফা এনাম

image

শওকত আলী / জন্ম: ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৬; মৃত্যু: ২৫ জানুয়ারি ২০১৮)

ব্যক্তি এবং তার সৃজনশীলতা কী সময়ের সৃষ্টি? অথবা বলা যায় কি, ব্যক্তির মনস্তত্ত্ব ও তার সৃষ্টিকর্মের বিচিত্র বিন্যাস সময়ের অনিবার্য অনুবাদ? ফরাসি ঔপন্যাসিক জর্জ সিমেনঁ উপন্যাসকে সময়ের ট্রাজেডি বলেছেন। তিনি একথা বলেছিলেন কাহিনির অন্তর্নিহিত উত্তেজনা পাঠককে কতটা নিবিষ্ট করে রাখতে পারে তার পরিপ্রেক্ষিতে, যদিও উপন্যাস পাঠের রুচি ও অভিজ্ঞতার ভেতর সবসময় সিমেনঁর মত গ্রহণীয় নয়। আমরা তাঁর সময়ের ইঙ্গিতটি অনুধাবনে আগ্রহী। কেননা শওকত আলী এবং বিশেষত তাঁর ‘পিঙ্গল আকাশ’ [রচনাকাল ১৯৫৮, গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯৬৩ সালে] যে কালপঞ্জি উন্মোচন করে, ষাটের দশক, তখন বিশ্ব জুড়ে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতি-অর্থনীতি ক্ষেত্রে ভাঙচুর বিপুল আলোড়ন, চাঞ্চল্য, অভূতপূর্ব ইতিবাচক রূপান্তর অবসম্ভাবী হয়ে উঠেছিল।

ষাটের দশকে, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মতোই, বাংলাদেশের একঝাঁক তরুণ, যাঁরা ছিলেন তুখোড় আড্ডাবাজ, জ্ঞানানুরাগী, সাহিত্যের নতুন স্বরগ্রাম রচনায় উন্মুখ- খালেদ চৌধুরী, শামসুর রাহমান, মাহমুদুল হক, শহীদ কাদরী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, রফিক আজাদ, বেলাল চৌধুরী প্রমুখ আরো অনেকে- তাঁরা প্রায় সকলেই বোদলেয়ারের পাল্লায় পড়েছিলেন, আলোড়িত এবং বলা যায় প্রভাবিতও হয়েছিলেন বোদলেয়ারীয় ভাবনা ও চৈতন্যের উদ্ভাসে। জীবনের অন্তঃশীল চেতনাধারায় শার্ল বোদলেয়ারের মতো নিঃসঙ্গতা ও দুঃখকে অনুভব করেছিলেন নিজের প্রয়োজনের অনুষঙ্গ রূপে। তাছাড়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তীকালে ১৯২২ সালে প্রকাশিত টিএস এলিয়টের দ্য ওয়েস্টল্যান্ড কাব্যের বিষয়ানুষঙ্গের আত্মিক বিনষ্টি বা মৃত্যুর চিত্রকল্পও ত্রিশের দশক থেকে সূচনা করে এখনও পর্যন্ত প্রভাবিত করে চলেছে তরুণ সাহিত্যানুরাগীদের। শওকত আলী অপরাপর সাহিত্যিক বন্ধুবর্গের মতো অতিমাত্রায় আড্ডাবাজ ছিলেন না, কিন্তু তিনিও কি ওই কালের নিঃশ্বাস চৈতন্যের সুপ্তিমগ্ন নির্জ্ঞান স্তরে গ্রহণ করেছিলেন? দেশবিভাজনের অনিবার্য অভিঘাতে উন্মূলিত ও রক্তাক্ত ব্যক্তিমনস্তত্ত্বের যন্ত্রণা ও দীর্ঘশ্বাস রক্তের গভীরে ধারণ করে তিনি হয়ে ওঠেন কি নীলকণ্ঠ? কেননা তাঁর প্রথম উপন্যাস পিঙ্গল আকাশ এবং প্রথম গল্পগ্রন্থ উন্মূল বাসনা- নামকরণে এই শব্দবন্ধ নির্বাচন করে নেওয়ার পরিপ্রেক্ষিত রূপে আমাদের উপরিল্লিখিত চিন্তাসূত্রসমূহ কল্পনা ও অভিজ্ঞতার জগতে উস্কে ওঠে। যদিও কালগ্রন্থি উন্মোচনের এই সৃষ্টিক্ষমপ্রজ্ঞার প্রতিফলন শওকত আলীর প্রথম পর্যায়ের সাহিত্যকর্মে [বিশেষত প্রদোষে প্রকৃতজন, দক্ষিণায়নের দিন, কূলায় কালস্রোত, পূর্বরাত্রি পূর্বদিন, ওয়ারিশ, যাত্রা অথবা গল্পগ্রন্থ উন্মূল বাসনা, লেলিহান সাধ, শুন হে লখিন্দর] পূর্বাপর একটি আন্তর্সঙ্গতি রক্ষার প্রচেষ্টায় নিবেদিত, কিন্তু ব্যাপক অর্থে শিল্পী শওকত আলী অনেকটাই অপচায়িত।

একটি পারিবারিক বন্ধন ও সংস্কৃতি ধীরে ধীরে ছিন্ন হতে হতে সমূলে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। সেখানে মঞ্জুর জীবন হয়ে ওঠে পরিকীর্ণ সভ্যতার ভগ্নস্তূপ। যদিও মানুষের শরীর কলুষিত হতে পারে- এমন গোঁড়ামি মঞ্জুর নেই, তথাপি তার ঘৃণা নিজেরই দুর্বলতার বিরুদ্ধে

কেননা বাংলা ভাষায় উপন্যাস রচনার করণকৌশল অ্যাংলোস্যাকসন অর্থাৎ ইয়োরোপীয় প্রদর্শিত পথে সূচিত হলেও [দুর্গেশনন্দিনী, ১৮৬৫] ক্রমেই বাংলা উপন্যাসশিল্পীরা স্বতন্ত্র এবং নিজস্ব একটি পথবিন্যাসকে এই উপমহাদেশের মাটি-মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে অঙ্গীভূত করতে সমর্থ হয়েছেন। যেমন পথের পাঁচালীর অপুকে বিভূতিভূষণ পৃথিবীর শাশ্বত স্বরূপের সঙ্গে, ক্রমবিকাশশীল ইতিহাসচেতনার সঙ্গে সামনের দিকে অগ্রসর করে দিয়েছেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ময়না দ্বীপে নতুন বসতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যে নতুন সম্ভাবনা ও উপনিবেশবিরোধী বাঙালি জাতিসত্তার নতুন পরিচয় সন্ধান করেছেন, তারই নদীস্রোতে অন্বিত হয় সতীনাথ ভাদুড়ির ঢোঁড়াইয়ের স্বপ্নময়তা, তারাশঙ্করের করালীর দ্রোহচেতনা, অমিয়ভূষণ মজুমদারের গড়শ্রীখণ্ডে জেগে ওঠা পদ্মার চর অথবা মহিষকুড়ার উপকথা উপন্যাসে আকস্মিক বুনো ষাঁড়-মহিষের রূপান্তরকৃত আসফাকের মনস্তত্ত্ব। অথবা দেবেশ রায়ের তিস্তাপারের বৃত্তান্তে মেট্রোপলিটান জাতিরাষ্ট্রের বিপ্রতীপে উপস্থাপন করেন বাঘারুকে, মাহমুদুল হক কালো বরফে রচনা করেন ঔপনিবেশিকতা ও সামরিক শাসনের শৃঙ্খলমুক্তির আকাক্সক্ষায় শৈশবের প্রেমের প্রত্নপ্রতিমার স্মৃতির তরঙ্গে আত্মসমর্পণের চেতনাবিন্দু এবং আখারুজ্জামান ইলিয়াস খোয়াবনামায় তমিজ ও তমিজের বাপের চরিত্রচৈতন্যে যে স্বপ্নদর্শনের বুনন করেন তারই পথচিহ্নে বাংলা উপন্যাসের মুক্তি সম্ভাবিত হয়ে উঠতে পারে। যদিও রীতির মেজাজে ইয়োরোপীয় জানালার কক্ষপথেই চলেছে পরিভ্রমণ, প্রকৃতপক্ষে এই রীতিখচিত পথ পরিভ্রমণ ছেড়ে নতুন পথরেখা আবিষ্কারের সম্ভাবনা কতটুকু সে অন্য প্রসঙ্গ। হয়ত বাংলা উপন্যাসের এই যাত্রা একদিন ছুঁড়ে ফেলতে সক্ষম হয়ে উঠবে তার রক্ত ও মজ্জায় মিশে থাকা ঔপনিবেশিক প্রভুদের জন্মান্ধ ভূত।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয়, যেমন, লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা অথবা ক্যারিবিয়ান কথাসাহিত্যিকরা- আলেহো কার্পেন্তিয়ার, গার্সিয়া মার্কেজ, হুয়ান রুলফো, হোর্হে বোর্হেস, সোয়াইঙ্কা, চিনোয়া আচেবে- প্রায় প্রত্যেকেই ঔপনিবেশিক প্রভুদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে নিজস্ব জাতিসত্তার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য পুনরাবিষ্কারে ব্যাপক ও তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। কার্পেন্তিয়ারের লোস্ পাসোস্ র্পেদিদোস [১৯৫৩] উপন্যাসটি একই সঙ্গে লাতিন আমেরিকান শিল্পীদের আত্মানুসন্ধানের রূপক, যার শেকড় প্রোথিত ছিল কঠিন বাস্তবতার নিষ্ফলা ভূমিতে এবং এরই মধ্যে মিশে ছিল ভবিষ্যতের জন্য উচ্চকিত সাবধানবাণী। এই কাহিনির সংগীত পরিচালক ওরিনোকোর গভীর জঙ্গলে যে আদিবাসী ইন্ডিয়ানদের দেখা পেলেন, যেখানে পূর্বে কোনো নাগরিক মানুষের পদচিহ্ন পড়েনি, আশ্চর্য সুর ও ছন্দের মেলবন্ধনে রূপময় তাদের সংগীত নিয়ে এলেন সভ্য পৃথিবীতে। কিন্তু পরিচালক কিছুতেই অরণ্যজীবন ও সংগীতকে আধুনিক জীবনের সঙ্গে মেলাতে পারলেন না। সমস্তই নতুন করে প্রারম্ভ থেকে সূচনা করতে চাইলেন তিনি, কিন্তু পাহড়ি বন্যায় অরণ্যের সমস্ত পথরেখা নিশ্চিহ্ন হওয়ায় খুঁজে পাওয়া যায়নি হৃত সময়। এভাবে কার্পেন্তিয়ার একটি নতুন স্বর ও রীতির পাঠ নির্মাণ করেন, সেটি হলো- নিজের সংস্কৃতির শেকড়ের অনুসন্ধান না করে শিল্পীর মুক্তি নেই, কিন্তু তার অর্থ অতীতের মধ্যে আকণ্ঠ নিমজ্জন নয়।

শওকত আলীর প্রদোষে প্রাকৃতজন অথবা ত্রয়ী উপন্যাসে আমরা নিজের শেকড় অনুসন্ধানের একটি জার্নি প্রত্যক্ষ করি, পিঙ্গল আকাশ যার সূচনাবিন্দু।

কিন্তু কার্পেন্তিয়ার যে প্রজ্ঞা ও অপরিসীম নিষ্ঠার সঙ্গে আধুনিক সভ্যাতার অগ্রযাত্রায় অগ্নিপ্রজ্বলন করেছেন, সেক্ষেত্রে শওকত আলী অনেকটাই নি®প্রভ। কেননা তিনি ওই জার্নির পথপ্রান্তে পৌঁছবার পূর্বেই নিজেকে ভেঙেচুরে নিংড়ে নিঃস্ব করে ফেলেছেন, প্রচলিত ও সমকালকবলিত সমাজবাস্তবতার উপরিস্তরের সস্তা কাহিনি রচনা করে হয়ে উঠেছেন ক্লিশে।

দুই

পিঙ্গল আকাশ উপন্যাসের গল্পপুঞ্জে অভাবনীয় কোনো অভিনবত্ব নেই। সামন্তকালের একটি প্রায় প্রাচীন বাড়ির ঘেরাটোপে বন্দি তরুণীর দৃষ্টিকোণ থেকে দৈনন্দিন জীবনের ঘটনাস্রোত তুলে আনা হয়েছে। তরুণী মঞ্জুর জীবনের অসঙ্গতি, যন্ত্রণা ও বিবিধ অপ্রাপনীয়তার মধ্য দিয়েও স্বাভাবিকতা, শ্রভ্রতা ও সৌন্দর্যের প্রতি সীমাহীন আকুলতা এবং পরিণামে স্বপ্নভঙ্গের গ্লানি তাকে নিক্ষেপ করে অনির্দেশ্য অতলান্তিক অন্ধকারের পথে। যে আবিলতা ও অন্ধকার থেকে মঞ্জুর আত্মজাগরণ ও আত্মপ্রতিষ্ঠা ঘটেনি, এমনকি তার কোনো পূর্বাভাসও ইঙ্গিতবাহী নয় উপন্যাসের ঘটনাপুঞ্জে। ডায়েরি অর্থাৎ দিনপঞ্জি রচনার খাতায় সে লিপিবদ্ধ করে তার প্রত্যহ যাপনের অভিজ্ঞতা।

উপন্যস্ত ঘটনার প্রতিটি পর্যায়ে পর্যায়ে জড়িয়ে রয়েছে মঞ্জু চরিত্রের দীর্ঘশ্বাস ও উন্মূলিত হবার আতঙ্ক ও যন্ত্রণা। পিতার মৃত্যুর পর মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে এবং মায়ের এই নতুন সংসারে অবহেলা ও করুণার মধ্যে তার বেড়ে ওঠা। সাংসারিক কাজের চাপে স্কুল ত্যাগ করতে হয়েছিল, কিন্তু সৎ বাবার প্রথম পক্ষের সন্তান আনিসের পরামর্শে সে গোপনে পড়ত ইংরেজি গল্পের বই। একদিকে এই পরিবারের সকল সদস্যের প্রচ্ছন্ন অবহেলা অন্যদিকে মা সালেহার দুর্দমনীয় যৌনাকাক্সক্ষা মঞ্জুর জীবনের শুভ্রতাকে ক্রমশ ঢেকে দেয় সীমাহীন এক পিঙ্গল মেঘে। এরই মধ্যে সে আবিষ্কার করে আনিসের প্রতি তার দুর্নিবার আকর্ষণ। দৈনন্দিন যাপনের সমস্ত কষ্ট, যন্ত্রণা, কটাক্ষ এবং তার শরীরী সৌন্দর্যের প্রতি অন্যের লোলুপতার গ্লানির মধ্যে আনিসের প্রেম তার হৃদয়ে প্রস্ফুটিত করেছিল স্নিগ্ধতা ও মুক্তির আনন্দ :

“আনিস ভাই আমার কথা ভাবে। পৃথিবীতে অন্ততঃ একজনও আমার কথা ভাবে। এই একটা ভাবনা আমাকে বিশ্রী রকমের একটা গ্লানি থেকে মুক্তি দিলো। রাহুলকে যেমন ভালোবাসে আনিস ভাই, যেমন মম্ পুতুল ওদেরকে ভালোবাসে, তেমনি আমাকেও ভালোবাসে। আমার মনের ভেতর গতকালের সেই মিষ্টি অনুভূতিটা আবার নতুন করে ছেয়ে গেল। আমি যেন একটা পাখি, আজ বিকেলে অগাধ নীল আকাশে মুক্তি পেয়েছি।” [পৃ ২০]

ভ্লাদিমির নবোকভের ললিতা উপন্যাসের নায়ক হামবার্ট যেমন তার সৎ মেয়ের কুমারীত্ব হরণের অভিসন্ধি ও ক্রমাগত কিশোরীদের সঙ্গে যৌনসম্পর্ক স্থাপনের উন্মাদনা এবং পরিণামে সহসা এক ধ্বংসাত্মক প্রতিশোধ-আকাক্সক্ষায় নিমজ্জিত হয়েছে, পিঙ্গল আকাশে মঞ্জু প্রতিনিয়ত অনভিপ্রেত যৌন-নিপীড়নের আতঙ্কে এবং পরিশেষে অস্তিত্ববিনাশী কামাসক্তির শিকার হয়। কিন্তু সৎ বাবা অথবা সৎ ভাইদের দ্বারা তার কুমারীত্ব হরণের প্রচেষ্টা রূপায়ণ করেননি শওকত আলী। বরং নিজের মা সালেহা যেন মঞ্জুর প্রতিপক্ষ। আর স্নেহ ও সহানুভূতি মিলেছিল সৎ বাবার কাছে। ক্ষয়িষ্ণু জমিদার বংশের সন্তান তিনি, ঔরসজাত সন্তানেরা যাকে মনে করে স্বার্থপর, ব্যক্তিগত সুখের জন্য তিনি বৃদ্ধ বয়সে বিয়ে করেছিলেন সালেহাকে। মঞ্জুর প্রতিও খুব বেশি সদয় ছিলেন এমন উপলব্ধি প্রথম পর্যায়ের কাহিনিবৃত্তে উন্মোচিত হয়নি। ব্যবসায়িক দেনা-পাওনার সম্পর্কে বরকত এলাহীর সঙ্গে মঞ্জুর বিয়েতে মা সালেহা চাপ প্রয়োগ করলে সৎ বাবাই বরং পিতৃবয়সী একজন পুরুষের সঙ্গে এই বিয়েতে আপত্তি তুলেছেন, বাধা দিয়েছেন। সালেহার যৌনলোলুপতা, অর্থমোহ ও স্বার্থপরতার উচ্চ- অন্ধতার মধ্যে পাণ্ডুর জ্যোৎস্নার গভীর রাতে নিঃসঙ্গ একাকী মঞ্জুর পাশে তিনি দাঁড়িয়েছেন সত্যিকার পিতার স্নেহ ও ব্যক্তিত্ববোধের ঔদার্যে :

আমার ভাবনা ছিলো না, না দুঃখ, না কান্না, না ক্ষোভ, না ঘৃণা- কোনো অনুভূতি ছিলো না। শুধু একাকী আর শূন্য একটা নিঃসঙ্গতা নিয়ে বসে ছিলাম। কতক্ষণ যে, কে জানে।

এমন সময় মাথার ওপর যেন কেউ হাত রাখলো।...

মঞ্জু মা, থেমে থেমে বাবার কণ্ঠস্বর ডাকল আমাকে।

যে নামে কোনোদিন আমাকে ডাকেননি বাবা, সেই নামে আজ ডাকলেন। মাথা তুললাম আমি। দেখলাম, বাবা আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। সহানুভূতি আর স্নেহ, করুণা আর বেদনা যেন শরীর ধরে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। [পৃঃ ৩৬]

সংসারের প্রতি মায়ের উদাসীনতা এবং অনেকাংশে বাবার নিষ্ক্রিয়তায় পারিবারিক শৃঙ্খলা ভেঙে যায়। সৎ মায়ের দায়বোধহীনতা এবং বাবার প্রতি অভিমান থেকে আনিস ছোটো আপা, রাহুল প্রত্যেকেই পারিবারিক বন্ধনের আবেগ থেকে ছিটকে বেরিয়ে পড়ে। সমাজ-অস্বীকৃত যৌনাচারে প্রতিনিয়ত অসম্মানিত হতে হতে বাবার মৃত্যু অনিবার্য হয়ে ওঠে। শুভাকাক্সক্ষী ও স্বার্থান্বেষী স্বজনেরা প্রচণ্ড অর্থনৈতিক সঙ্কটের কালে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে। কেবল মঞ্জু ছোটো বোনদের এবং অসুস্থ, প্রায় বিকারগ্রস্ত মায়ের অন্নবস্ত্র ও চিকিৎসার দায়িত্ব পালন করে চলে নীরবে। আর প্রতীক্ষা করে আনিসের ফিরে আসবার। কিন্তু আকস্মিকভাবে একদিন আত্মীয়-বন্ধুদের সাহচর্যে মঞ্জুকে বিসর্জন দিতে হয় তার কৌমার্য। ফলে মঞ্জুর আকৈশোর লালিত স্নিগ্ধতা, শুভ্রতা, পবিত্রতা মুহূর্তে নিপতিত হয় নিকষ কালো মৃত্যুময় আঁধারে। নিজের সর্বস্ব হারানোর বেদনায় সে উপলব্ধি করে : ‘মা বাবাকে হত্যা করেছে আর আমাকে হত্যা করলো এরা সবাই মিলে।’

তিন

পিঙ্গল আকাশ উপন্যাসের এই আপাত সরল কহিনিপুঞ্জে ব্যক্তি মানুষের জীবন ও সমাজবাস্তবতার অন্তর্তলবর্তী স্রোতে সদ্য ঔপনিবেশিক শাসনমুক্তি ও তৎপরবর্তী সাম্প্রদায়িক চৈতন্যের উত্থান-পতনের অষ্টাবক্র ঘূর্ণিপাকে নিমজ্জিত এবং পরিণামে দীর্ঘ সামরিক শাসন-শোষণে পিষ্ট সমাজ ও মানুষের বিনষ্ট মূল্যবোধের রূপালেখ্য উপলব্ধি করা যায়। কেননা পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায়কে উদ্ধৃত করে বলা যায়, ‘অন্তঃসলিলা ইতিহাসের প্রক্রিয়ার উন্মোচন, অভিজ্ঞান সন্ধানে, জনসমাজের নির্মাণ ভাঙনের চেতনায়, এমনকি ধর্মীয় জিজ্ঞাসার বহুমাত্রিক অšে¦ষণেও উপন্যাস হয়ে উঠতে পারে রাজনৈতিক।’ তাছাড়া ছাত্রজীবনেই প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে শওকত আলীর সংশ্লিষ্টতাও তাঁর চিন্তাসূত্র ও অভিজ্ঞানের পরম্পরাটি বুঝে নিতে সহায়ক।

উপন্যাসের সূচনাংশে ঝড় ও বৃষ্টিবিক্ষুব্ধ রাত্রে মঞ্জু অত্যন্ত আকস্মিকভাবে প্রবেশ করে একজন লেখকের ঘরে, যিনি তখন রাজা ঈদিপাস নাটকের কাহিনি পড়ছিলেন। ক্ষণকাল আশ্রয়ের পর মঞ্জু লেখকের অলক্ষে বেরিয়ে পড়ে, কিন্তু ফেলে যায় তার জীবনের সমস্ত কষ্ট যন্ত্রণা ও গ্লানির ইতিবৃত্ত লেখা ডায়েরিটি। ডায়েরি সূত্রেই উপন্যাসে উন্মোচিত হয়েছে শুভ্র, স্নিগ্ধ জীবনের জন্য স্বপ্ন বুনে চলা এবং পরিণামে এক অন্ধকূপে আত্মোৎসর্গিত তরুণীর করুণ গল্পপুঞ্জ। এই করুণ ও পুঞ্জিভূত ঘৃণার উৎস কোথায়? কাহিনির সূচনাংশেই ঔপন্যাসিক ইঙ্গিত দিয়েছেন- সফোক্লিসের রাজা ঈদিপাস নাটকের উল্লেখের মধ্য দিয়ে। ওই নাটকের ট্রাজেডির মতোই এই উপন্যাসের চরিত্রাবলি কালের ব্যাবধানে নির্মম এক রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক বাস্তবতার ঘূর্ণিতে যন্ত্রণাময় পথের অভিযাত্রী, মৃত্যুশীল। এখানে চৌধুরী সাহেব, সালেহা, বেনু, আকরাম, তাজিনা, কাসেম খান, নাসিমা, রাহুল, ছোটোআপা সর্বোপরি মঞ্জু এবং আনিস সকলেই ওই ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের নিষ্ঠুর নিয়তি বহন করে চলেছে রক্তের মধ্যে :

“... যখন প্রথম এসেছিলাম এ বাড়িতে, মার চোখে তখন জীবনের সব তৃপ্তির ছায়া দেখেছিলাম। মনে হয়েছিলো, মার জীবনে বোধ হয় আর কোনো খেদ নেই, দুঃখ নেই। তারপর থেকে ধীরে ধীরে কোন সূত্র থেকে যে এলো এমন তিক্ততা টেরও পেলাম না। কেবল দেখলাম দু’জনের মাঝখানে যেন একটা অদৃশ্য দেয়াল উঠে দাঁড়াচ্ছে। আর দিনের পর দিন অদৃশ্য একটা সম্পর্কের মধ্যে মা, বাবা, আর তাদের ছেলেমেয়েরা। কিন্তু দেখলাম, আসলে তাও নয়। সবাই একাকী। বাবা আর ছোট আপা, ছোট আপা আর আনিস ভাই, রাহুল আর আমি এ বাড়ির সঙ্গে কারো যোগ নেই। এই যে সম্পর্কের বাঁধন দেখি, এ যেন শুধু বাইরের। ভেতরে ভেতরে সবার চোখে সন্দেহের ছায়া। এদের সব সম্পর্কের মূলে কেউ যেন একের থেকে অন্যকে কেটে কেটে বাদ দিয়ে রাখছে।”

ব্যক্তিমানুষের মধ্যে এই পারস্পরিক দূরত্ব, অন্তর্দ্বন্দ্ব ও দ্বিধা কেবল পারিবারিক বিশৃঙ্খলা-প্রসূত নয়, এই বিচ্ছিন্নতার সূচনা ঔপনিবেশিকতার নিপুণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দেশবিভাজন ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্গত দুই প্রান্তের দুটি ভূখণ্ডের আন্তঃসম্পর্কের বিচ্ছিন্নতা। পূর্বপাকিস্তানের উপর পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক শাসকগোষ্ঠীর শোষণ, দমন-পীড়নে পূর্বপাকিস্তানের জনজীবন হয়ে উঠেছিল নিষ্পেষিত, জর্জরিত। অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত। নূন্যতম নাগরিক ও মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। সাংস্কৃতিক নিষেধাজ্ঞার শিকার। ফলে বাধাগ্রস্ত হয় জীবন ও সমাজের সার্বিক অগ্রগতি। ভেঙে পড়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সমস্ত মানদণ্ড। একদিকে ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি অন্যদিকে আন্তরাষ্ট্রীয় নিপীড়নের প্রত্যক্ষ প্রভাব বাংলাদেশের ষাটের দশকের সমাজ ও যৌথ পরিবারকাঠামোর অন্তর্নিহিত সংহতিতে ক্ষয়ের সূচনা করে। একটি সাক্ষাৎকারে শওকত আলী বলেছেন : “’৪৭ সালের পর গত ৪টি দশক জুড়ে আমাদের অস্থির এবং খুব টানটান সময়ের মধ্য দিয়ে দিনযাপন করতে হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। জীবনের বাইরের দিকে যেমন, তেমনি ভিতরের দিকেও এত ভাঙচুর ও দ্রুত ভালোমন্দ পরিবর্তন ঘটেছে যে, ... আমাদের লেখকদের ওপর জীবনবাস্তবতার চাপ খুব বেশি।... বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে জীবন বেশি, বানানো গল্প কম।” [বজলুল করিম বাহার, ‘নিসর্গ’, মার্চ ১৯৯২] ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা, ’৫৪-র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে গ্রামে গ্রামে বক্তৃতা করে বেড়ানো, পরিণামে কারাবরণ এবং আকৈশোর অত্যন্ত নিকট থেকে গ্রামীণ জীবনকে দেখার অভিজ্ঞতার ফলে সময়ের অন্তঃশীল বাস্তবকে শওকত আলী অনুধাবন করেছেন এবং ওই গভীরতর সঙ্কটকে মিলিয়ে দিয়েছেন মঞ্জুর জীবনের কথামালার স্রোতে :

“এ বাড়িকে যে ধ্বংস করেছে, সে রয়েছে সবরকম স্পষ্টতার ওপারে। দূর থেকে নানান ছলে সে এগিয়ে এসে একে একে ভিত্তির ইট খসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। অথচ কেউ টের পাচ্ছে না। চারদিক থেকে কী একটা শক্তি ধীরে ধীরে তার প্রকাণ্ড থাবার মধ্যে চেপে ধরতে চাইছে। একদিন হয়তো দেখবো, এতো বড় বাড়িটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।”

তাহলে কি ১৯৫৮ সালে শওকত আলী উপলব্ধি করেছিলেন পাকিস্তানের অখ-তা থাকবে না? তাই মঞ্জুর আত্মমুক্তির আকাক্সক্ষার স্রোতে তরঙ্গময় করে দিয়েছেন সামষ্টিক জনচেতনার আবেগ? অথবা আলেহো কার্পেন্তিয়ার নিজের শেকড়ের অনুসন্ধানের মধ্যে মুক্তির বার্তা পেয়েছেন, শওকত আলীও কি মঞ্জুর উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতায় ওই মুক্তির ভিন্নতর প্রেক্ষাপট রচনা করেছেন? আত্মপরিচয়ের সন্ধান, আত্মশক্তির উদ্বোধন এবং ওই শক্তির সংহত রূপ অর্থাৎ সংঘশক্তির সম্মিলিত প্রয়াস ব্যতীত যে বিপুল ধ্বংসযজ্ঞের ভেতর থেকে জীবনের সঞ্চার সম্ভব নয় মঞ্জুর মনোকথনময় অভিজ্ঞানে উঠে এসেছে ওই ঐক্যবিন্দু :

“বুঝতে পারি, মাঝে মাঝে শক্তি নিয়ে দাঁড়াতে চেয়েছি আমি, রাহুল, আনিস, বাবা। কিন্তু বিচ্ছিন্নভাবে আমরা তো ক্ষুদ্র। নিজেদেরই যে আমরা ভালো করে চিনি না। যদি সবাইকে ভালোবাসতাম, সংহত করতাম নিজেদের। সহজ হতাম, স্বাভাবিক হতাম- তাহলে হয়তো দাঁড়াতে পারতাম এই ধ্বংসের স্রোতের মাঝখানেও দ্বীপের মতো। কিন্তু নিজেরা পরস্পরকে জানলাম না যে।” [পৃ. ৬৩]

বাঙালির চূড়ান্ত আত্মজাগরণ ঘটেছিল ’৭১-এ। কিন্তু এই ধ্বংসযজ্ঞের নায়ক কি কেবলই ঔপনিবেশিক ও মিলিটারি শাসন-শাসক? কালগ্রন্থির সামূহিক সম্ভাবনাকে বাঙালি জাতির তথাকথিত শিক্ষিত, সংস্কৃতিবান এবং নিঃসন্দেহে বিত্তশালী শ্রেণিটি কি এই ধ্বংসযজ্ঞে ঘৃতাহুতি দেয়নি? বরং শিক্ষিত শ্রেণিটি ঔপনিবেশিক জ্ঞানকাণ্ডের ভূমিকাকে প্রবলভাবে প্রচলন করিয়ে দেয়। মিশেল ফুকো যেটিকে বলেছেন প্রদর্শননির্ভর জ্ঞান, যা প্রকৃতপক্ষে ঔপনিবেশিক বিকৃতিকেই প্রতিষ্ঠা করে এবং জ্ঞানকাণ্ডের কেন্দ্রে ব্যক্তি মুখ্য হয়ে ওঠার কথা, কিন্তু ব্যক্তি সেখানে নিতান্তই গৌণ হয়ে পড়ে। শওকত আলী মঞ্জু চরিত্রের পরিকল্পনায় এই প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। একটি পারিবারিক বন্ধন ও সংস্কৃতি ধীরে ধীরে ছিন্ন হতে হতে সমূলে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। সেখানে মঞ্জুর জীবন হয়ে ওঠে পরিকীর্ণ সভ্যতার ভগ্নস্তুপ। যদিও মানুষের শরীর কলুষিত হতে পারে- এমন গোঁড়ামি মঞ্জুর নেই, তথাপি তার ঘৃণা নিজেরই দুর্বলতার বিরুদ্ধে। কাসেম খানের যৌনপৈশাচিকতার কাছে কৌমার্য হারিয়ে মঞ্জু মানসিকভাবে হয়ে পড়ে নিঃস্ব ও মৃত্যুন্মুখ।

চার

কিন্তু শওকত আলী তাঁর উপন্যাসে একজন নারীকে কেন কেন্দ্রে স্থাপন করলেন? ঔপনিবেশিক সমাজবাস্তবতার সঙ্কট পুরুষ চরিত্রের জীবনাভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েও রূপায়ণ করা সম্ভব ছিল, কেবল পিঙ্গল আকাশ নয়, পরবর্তীকালে তাঁর আরো একাধিক উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র নারী। হতে পারে, অত্যন্ত নিকট থেকে গ্রামীণ জীবন ও পরিবারকাঠামো দেখা, তাছাড়া দেশবিভাগোত্তর কালে কংগ্রেসের সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতাসূত্রে পরিবারে পিতার উপস্থিতির চাইতে অধিক মাত্রায় মায়ের সান্নিধ্য প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে তিনি নারীর জীবনকে প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা লাভ করেন। এ কারণে নারীর জীবন ও দৃষ্টির আলোয় তাঁর কতিপয় উপন্যাসের পটভূমি রূপায়ণ করেছেন। অন্তর্নিহিত কারণ যেটিই হোক না কেন, এ উপন্যাসের মঞ্জু চরিত্র রূপায়ণে ঔপন্যাসিকের নারীবাদী সংবেদনার আবেগ তলিয়ে দেখা আমাদের অভিপ্রায়।

ঊনবিংশ-বিংশ শতাব্দীর নারীবাদী আন্দোলনের প্রবক্তাদের কথা বর্তমানের অনুসন্ধিৎসু পাঠকের জানা রয়েছে, বিধায় তা পুনরুল্লেখের প্রয়োজন বোধ করছি না। তবে প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় ফরাসি নারীবাদী হেলেন সিজো ও জেভিয়ার গোথিয়ারের বরাত দিয়ে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর অধস্তনতাকে ব্যাখ্যা করা যায়। তাঁরা বলেছেন, ইতিহাসের দীর্ঘ অধ্যায় জুড়ে নারী বাধ্য হয়েছিল নীরব থাকতে, নিজের কথা বলতে পারেনি সে, এ কারণে নারীর কোনো ইতিহাস নেই। নারী ইতিহাস রূপে যা রচিত হয়েছে, তা প্রকৃতপক্ষে পুরুষ নির্মিত ও রচিত ভাবমূর্তি, যা পুরুষতন্ত্রের নিজস্ব চিন্তাকাঠামো দ্বারা নারীকে অধস্তন করে রাখা ও নির্যাতন করার নতুন কৌশল মাত্র। নারীকে পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে লিখতে হবে নারীর নিজস্ব ইতিহাস। শওকত আলী ওই ইতিহাসটিই বয়ানের চেষ্টা করেছেন। পিতৃপুরুষের পরিচয় উন্মোচিত হয়েছে বটে, কিন্তু ঔপন্যাসিক অবচেতনেও মঞ্জুর বাবার নাম উল্লেখ করেননি। এমনকি মায়ের ভর্ৎসনায় একটিবারই মাত্র মঞ্জুর মনে বাবার সম্পর্কে শ্রুতি-অভিজ্ঞতা ভেসে উঠেছে- ‘বাবা কেমন দেখিনি। কিন্তু শুনেছি, বাবা আমাকে খুব ভালোবাসতেন।’ অর্থাৎ পিতৃত্বের নাম-পরিচয়হীন, অবয়বশূন্য পরিপ্রেক্ষিতের মধ্যে স্বয়ং নারীর ব্যক্তিঅস্তিত্বের লড়াইটাকে প্রধান করে তুলেছেন। এই রূপায়ণের মধ্য দিয়ে পিতা-স্বামী-সন্তানের উপর নারীর নির্ভরতার চিরায়ত বিশ্বাস-সংস্কার ও পিতৃতন্ত্রকে ঔপন্যাসিক ছুঁড়ে ফেলেছেন আঁস্তাকুড়ে। উন্মোচন করেছেন নারীর প্রতি সমাজের নগ্ন নোংরা দৃষ্টিভঙ্গি। কুমারীত্ব হারিয়ে এক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ রাত্রে মঞ্জু বাড়ি ছেড়ে নিরুদ্দেশ হলে প্রতিবেশীরা ধরেই নেয়, সে বিবাহপূর্ব যৌনসম্পর্কের কারণে গর্ভবতী হয় এবং এই অপকর্ম আড়াল করতে বেছে নেয় আত্মহননের পথ। একজন কুমারী মেয়ের নিরুদ্দেশ হওয়ার কারণ রূপে এর চাইতে সরল ব্যাখ্যা ও মীমাংসা আর কী হতে পারে! তবে এই ব্যাখ্যা ও যুক্তি বিন্যাস করতে গিয়ে ঔপন্যাসিকও কি তাঁর আকৈশোর বেড়ে ওঠা পিতৃতান্ত্রিক জ্ঞানকাঠামো থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি?

মঞ্জুর ডায়েরির সূচনাতেই তাই রয়েছে আনিস-প্রসঙ্গ। আনিস তাকে এ বাড়ি থেকে [দাদার বাড়ি] চলে যেতে বারণ করেছে, আনিস মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করতে বলেছে, ইংরেজি পড়তে বলেছিল আনিস- ‘সেই থেকে রোজ একটু করে পড়তাম।’ অন্ধকারে শাড়ি পরিহিত তাকে আনিস চিনতে না পারলে তার অভিমান, ‘ও কি দেখেনি আমি কতো সুন্দর হয়েছি?’ কুমারীত্ব হারিয়ে মঞ্জুর উপলব্ধি- ‘না, মানুষের দেহ কলুষিত হতে পারে- এমন গোঁড়ামি আমার নেই।’ অতঃপর ক্ষুদ্র একটি প্যারার পরেই ঔপন্যাসিক লিখেছেন- ‘এতোকাল ধরে ভেতরে বাইরে এতো বাধার পাহাড় পার হয়ে এসে শেষ মুহূর্তে আমি আনিসকে হারিয়ে ফেললাম।’ কেননা পুরুষের কাছে কুমারী নারীই গ্রহণযোগ্য। পুরুষের বিবাহপূর্ব যৌনসম্পর্ক সমাজ মেনে নিলেও নারীকে হতে হবে শুভ্র, সুন্দর, পবিত্র। পুরুষই নারীর কুমারীত্ব হরণ করে তাকে কলঙ্কের দায় চাপিয়ে নিক্ষেপ করে অন্ধকূপে। পুরুষের এই ‘শুভ্রতা’ প্রাপ্তির আকাক্সক্ষা অবচেতনে নারীর রক্তের মধ্যে প্রবহমান। শরীর কলুষিত হবার গোঁড়ামি মঞ্জুর নেই- এই ভাবনার পরও সুন্দর শুভ্র আর পবিত্র থাকতে ব্যর্থ হবার গ্লানির চাইতে তার কাছে বড়ো হয়ে দেখা দিয়েছে আনিসের ঘৃণা। অর্থাৎ আনিসের জন্যই তার সমস্ত আয়োজন। আধুনিক শিক্ষিত পুরুষের জন্য চাই শিক্ষিত, একটু-আধটু ইংরেজি জানা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে পারদর্শী নারী। কেননা নিজের কব্জাগত নারীটি ইংরেজি জানলে, গান গাইতে পারলে সমাজে পুরুষের স্ট্যাটাস বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া শিক্ষিত সংস্কৃতিবান নারীর বাজারমূল্যও বেশি। একজন পুরুষের জন্য ‘নারী’ হয়ে ওঠার এই আয়োজন প্রকৃতপক্ষে পুরুষতান্ত্রিক জ্ঞানকাণ্ডের ভেতর থেকে নারীকে আরো অধস্তন করে তুলবার স্বর রচনা।

তথাপি সমাজের সংস্কার, পারিবারিক সংস্কৃতির আলো-হাওয়ায় নারীর ‘মানুষ’ হয়ে ওঠার যে সংকট ও দুর্বিপাক রয়েছে পিঙ্গল আকাশে তার স্ফুরণ প্রকাশে ঔপন্যাসিক অনেকাংশেইসচেতন। বিয়ের জন্য কনে দেখা প্রথার বিরুদ্ধে মঞ্জু ভেবেছে- ‘... কাপড় আর জামার পুঁটুলি হয়ে চলাফেরা করতে হতো। একের পর এক বরপক্ষ থেকে দেখতে আসতো, জিজ্ঞেস করতো নাম কি, হাঁটিয়ে পরখ করতো খোঁড়া কিনা, চুল মাপতো কেউ, মাগো, কি বিচ্ছিরি কা-!’ তদুপরি ছিল খালাতো ভাই বেনুর অনাকাক্সিক্ষত যৌন উৎপীড়নের আতঙ্ক, সংসারে বাঁদীগিরি করার যন্ত্রণা এবং সর্বোপরি নারীরাও যে হতে পারে পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার ধারক-বাহক মায়ের চরিত্রে তার রূপায়ণ ঘটেছে। সংসারের সচ্ছলতার জন্যই কেবল মা মঞ্জুকে বরকত এলাহীর সঙ্গে বিয়ে দিতে চেয়েছে, তা নয়। বরং নারী যে পুরুষের যৌন-সেবাদাসী ঔপন্যাসিক সালেহা চরিত্রে সমাজের এই মনস্তত্ত্বটি তুলে এনেছেন। ষোল বছরের কিশোরী মঞ্জুকে তার সৎ বাবা ব্যবসায়ী বন্ধু বরকত এলাহীর সঙ্গে বিয়ে দিতে আপত্তি জানালে সালেহা বয়স সংশোধন করে দেয়- “ষোল নয়, সতেরো।... এমন তো কত হচ্ছে। আমি যে তোমার বয়সী একটা লোককে বিয়ে করে সুখী হয়েছি- এটাও তো হওয়া উচিত ছিলো না।”

বাইরের পরিবেশের সঙ্গে মঞ্জু খুব বেশি পরিচিত নয়, প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া খুব বেশি করেনি। এমন একজন তরুণীর পক্ষে একাকী অনিশ্চিত গন্তব্যে যাত্রা নিরাপদ নয়। কিন্তু যে পরিবেশে মা ব্যক্তিগত সুখ ও স্বার্থচিন্তায় নিজের মেয়ের সর্বনাশ করতে দ্বিধান্বিত নয় সেই পরিবেশও কি একজন তরুণী নিরাপদ? ফলে নারীর সংস্কার, পরিবারের বৃত্ত ও পুরুষের নোংরা যৌনকাতরত-পরাধিনতা থেকে বেরিয়ে নিজের স্বাধীন চৈতন্যের আকাক্সক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে অস্তিত্বময় হয়ে উঠবে সেই পরিপ্রেক্ষিত রচনা না করেই শওকত আলী মঞ্জুকে নিক্ষেপ করেছেন অনিশ্চিত অন্ধকার গহ্বরে। কেননা শওকত আলী জানেন, যেসমস্ত শর্ত, দায়বদ্ধতা ও অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সমাজে নারী সুস্থ, শুভ্র জীবনযাপন করতে পারে ঔপনিবেশিক ও পণ্যমানসিকতাযুক্ত এবং সামরিক শাসননির্ভর রাষ্ট্রে ওই পরিপ্রেক্ষিত সৃষ্টি সম্ভব নয়। এ কারণে মঞ্জু বারবার নিজেকে প্রশ্ন করেছে- সে কী করবে? কিন্তু উত্তর মেলেনি। ঔপন্যাসিকের পক্ষে উত্তর দেওয়া সম্ভব হয়নি। এমনকি ১৯৭৬, ’৭৭, ’৭৮ সালে ‘বিচিত্রা’র ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত তাঁর ত্রয়ী উপন্যাসের [দক্ষিণায়নের দিন, কুলায় কালস্রোত ও পূর্বরাত্রি পূর্বদিন] কেন্দ্রীয় চরিত্র রাখীও নিজেকে একই প্রশ্ন করেছে- এখন সে কী করবে? তখনও বাংলাদেশে স্বৈর-সামরিক সরকার রাষ্ট্র ক্ষমতায়। যদিও রাখী-চরিত্র নির্মাণে শওকত আলী অনেক বেশি সাহসী ও প্রাগ্রসর চিন্তার পরিচয় দিয়েছেন। রাখী অবৈবাহিক সম্পর্কে সেজানের সন্তান গর্ভে ধারণ করে, কিন্তু এই মাতৃত্ব সে অস্বীকার করেনি, বরং রাখী তার অনাগত সন্তানের উদ্দেশে উচ্চারণ করে, ‘এই রাস্তায় সেজান মিছিল নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল- তুইও এই রাস্তা দিয়ে মিছিল নিয়ে এগিয়ে যাস, হ্যাঁরে, পারবি তো?’ তাহলে বলা যেতে পারে, যে সম্ভাবনা ও সমাজরূপান্তরের অঙ্গীকার শাখায়-প্রশাখায়, পত্রপুষ্পে সমাচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে ত্রয়ী উপন্যাসের রাখী চরিত্রের পরিকল্পনা ও পরিণামে তার সূচনাবিন্দু পিঙ্গল আকাশে, মঞ্জুর আবেগময় কথামালায়।

শওকত আলী জানেন, যেসমস্ত শর্ত, দায়বদ্ধতা ও অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সমাজে নারী সুস্থ, শুভ্র জীবনযাপন করতে পারে ঔপনিবেশিক ও পণ্যমানসিকতাযুক্ত এবং সামরিক শাসননির্ভর রাষ্ট্রে ওই পরিপ্রেক্ষিত সৃষ্টি সম্ভব নয়।

কিন্তু মঞ্জু চরিত্র রূপায়ণে শেষপর্যন্ত ঔপন্যাসিক তাঁর সৃষ্টিক্ষমপ্রজ্ঞার যথাযথ পরিচয় দিতে পারেননি। মঞ্জু বারবার নিজেকে প্রশ্ন করেছে- এখন সে কী করবে? একই প্রশ্ন তাঁর ত্রয়ী উপন্যাসের রাখী চরিত্রের কণ্ঠস্বরে বেজে উঠেছে। এই ত্রয়ী উপন্যাসে লিঙ্গভিত্তিক পুরুষতান্ত্রিক ইচ্ছে-অনিচ্ছের প্রতিফলনকে শওকত আলী অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে রোপন করেছেন শ্রেণিবিভাজনহীন সমাজ নির্মাণের স্বপ্নীল জীবনকোষ। রাখী-সেজানের সমাজঅস্বীকৃত সন্তানের মধ্যে ঔপন্যাসিক যে স্বপ্ন পল্লবিত করেছেন, মঞ্জু চরিত্রটি ওই পরিপ্রেক্ষিতে পরিণামের দিকে অগ্রসর হয়েছে মাত্র, পরিপূর্ণতা পায়নি। শিক্ষাবঞ্চিত হলেও ইংরেজি পড়–য়া, পারিবারিক সংস্কৃতির মধ্যে নিষ্পেষিত, লাঞ্ছিত মঞ্জুর মধ্যে নিজেকে সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে অন্তর্গত শক্তির সাহসি ভূমিকায় রূপান্বিত হয়ে ওঠার সামূহিক পরিপ্রেক্ষিত ছিল। তাছাড়া সেজানের মতো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা অথবা দার্শনিক অবস্থান কোনো কিছুই আনিসের মধ্যে উপ্ত হয়নি। আনিস পিঙ্গল আকাশে নিতান্তই গৌণ ও উপেক্ষিত। ষাটের দশকের সমাজতন্ত্রীদের মতো [যেমন সেজান] আনিস সারাদিন উদ্দেশ্যহীন সময় অতিবাহিত করে, তেলহীন রুক্ষ চুল, জামাকাপড় নোংরা, বিশ্রী গন্ধ এবং সে ঢাকায় চাকরি করে, মাঝেমধ্যে বাড়ি আসে, মঞ্জুকে হঠাৎ চিঠি লেখে- এরকম আকস্মিক দু-একটি তথ্য ব্যতীত উপন্যাসে তার ভূমিকা শূন্য। ফলে নারী-পুরুষের যৌথ সংস্কৃতি ও মানবিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিত্বের বিকাশ অথবা সমাজ নির্মাণের অঙ্গীকারটি পল্লবিত হতে পারে, পিঙ্গল আকাশে তা অনেকটাই ক্লিশে। বরং বলা যায়, আলেহো কার্পেন্তিয়ারের প্রসঙ্গ টেনে যে সংস্কৃতির শেকড় অনুসন্ধানের চিন্তার উন্মেষ এই প্রবন্ধের সূচনায় উল্লিখিত হয়েছে, সেইসূত্রে, শওকত আলীর পরবর্তী উপন্যাসে ওই প্রক্রিয়া ও পরিণাম নির্দেশ করে বস্তুময় সমগ্রতার অভিমুখে, পিঙ্গল আকাশ ওই যাত্রার সূচনাবিন্দু।