কাজী আনোয়ার হোসেন : নিভৃত বোহেমিয়ান

মোজাম্মেল হক নিয়োগী

হোসেনকে নিয়ে। একইভাবে রোমেনা আফাজও একই ধারার লেখক দস্যু বনহুরের আড়ালে আলোচিত। উভয়ের সৃষ্ট চরিত্র তাঁদের কীর্তি নামকে আড়াল করে দিয়েছে।

কাজী আনোয়ার হোসেনের সৃষ্টিশীল চিন্তার জন্যই সেবা প্রকাশনীর বই বাংলাদেশে গ্রামে-গঞ্জে এক শ্রেণির অগণিত পাঠকের হাতে চলে যায় যা বাংলাদেশে আর কোনো ব্যক্তি বা প্রকাশক করতে পারেননি। শুরুটা তিনি কুয়াশা থ্রিলারের গুপ্তচর কাহিনি দিয়ে করলেও মাসুদ রানা সিরিজে অধিকর জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এবং পরিণামে তাঁর জীবদ্দশায় প্রায় চার শতাধিক বই লেখা, প্রকাশ ও বাজারজাত করতে সক্ষম হন। পেপারব্যাকে নিউজপ্রিন্ট কাগজে মুদ্রিত মাসুদ রানা সিরিজের বই তরুণ সমাজকে ব্যাপকভাবে আকৃষ্ট করেছে এবং এখনো করে। এটি জনপ্রিয়তার দিক থেকে শীর্ষে; যদিও এসব বই নিয়ে কোনো গবেষণা হয়নি। জনপ্রিয়তার শীর্ষে কিনা সে তথ্য না থাকলেও আপাতদৃষ্টিতে তাই মনে হয়। বইমেলায় সেবা প্রকাশনীর ভিড় দেখলে এরকম বোধ জাগ্রত হওয়াটা খুব স্বাভাবিক। পূর্বে গ্রামেগঞ্জের বইয়ের দোকানে, লঞ্চে বা ট্রেনে হকারদের হাতে সেবা প্রকাশনীর অসংখ্য বই যেভাবে দেখা যেত তাতেও এই অনুমান সত্য বলেই ধরে নেওয়া যায়। মাসুদ রানা সিরিজের বইগুলোর দাম কম হওয়াতেও এবং সব শ্রেণির পাঠকের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকার কারণেও তরুণ-তরুণীদের হাতের নাগালে চলে যায়। দু-তিন দশক আগেও প্রতিটি রেলস্টেশনে একটি করে বুকস্টল থাকত যেখানে পত্রপত্রিকাসহ সাহিত্যের বইও পাওয়া যেত। তখন সেবা প্রকাশনীর বই অর্থাৎ কুয়াশা বা মাসুদ রানার সিরিজের অনেক বইও দেখা যেত। গ্রামের পাঠাগারেও থাকত অসংখ্য বই। তখনকার সময়ে ভাড়াতেও বই নিয়ে পড়ার মানুষের অভাব ছিল না। বর্তমানে বইয়ের বাজার সংকুচিত ও মন্দা হওয়াতে এবং সহজলভ্য যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে পত্রপত্রিকা গ্রামেগঞ্জে চলে যাওয়াতে রেলস্টেশনের বুকস্টলগুলো ব্যবসা হারিয়েছে। কিন্তু মাসুদ রানার জনপ্রিয়তার এখনো ততটা কমতি নেই বলেই প্রতীয়মান হয়।

তাঁর কৈশোরেই পাওয়া যায় গোয়েন্দাগিরির নমুনা। তিনি প্রায়ই বাসা থেকে হারিয়ে যেতেন অর্থাৎ কাউকে না জানিয়েই দূর দূরান্তে বেড়াতে চলে যেতেন এবং কিছুদিন পর আবার ফিরে আসতেন। প্রথম দিকে পরিবারের লোকজন খুব চিন্তিত হলেও পরে সবার কাছে সহনীয় হয়ে দাঁড়ায়

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডিটেক্টিভ জনপ্রিয় ব্যোমকেশ, পাঁচকড়ি দের দেবেন্দ্রবিজয়, শশধর দত্তের মোহন এবং নীহাররঞ্জন গুপ্তের কিরীটি রায় বাংলা সাহিত্যের অধিকাংশ গোয়েন্দা কাহিনিই পাশ্চাত্যের সাহিত্য-গোয়েন্দা কোনান ডয়েলের শার্লক হোমস, রেমন্ড চ্যান্ডলারের ফিলিপ মার্লোর প্রভাবে রচিত হয়েছে বলে অনেকেই মত প্রকাশ করেন। মাসুদ রানাও কোনো মৌলিক কাহিনি নয়, ওয়েস্টার্ন কাহিনির ছায়াবলম্বনে রচিত বলে প্রায় সবার কাছেই স্বীকৃত। এই চরিত্র ইয়ান ফ্লেমিংয়ের জেমস বন্ড চরিত্রের ছায়াবলম্বনে সৃষ্টি বলে বিবেচিত। গোয়েন্দা কাহিনির মাসুদ রানা মূলধারার সাহিত্য বলে বিবেচিত নয় বলে বিদগ্ধ পাঠকের কাছে সাহিত্যাঙ্গনে এসব বই নিয়ে কোনো আলোচনা-সমালোচনা নেই। পাঠককুল বই পড়ে আনন্দ উপভোগ করেন এই পর্যন্তই এসব গোয়েন্দা কাহিনির সর্বশেষ ফল, এর বেশি কিছু নয়। এর মূল কারণ হলো, মাসুদ রানার চরিত্রগুলো ‘টাইপ’ চরিত্র হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় এবং গল্পগুলো প্রায় একই ধরনের। কখনো বাস্তবতা কিংবা পরাবাস্তবতার ছায়ায় রচিত হলেও মূলধারার সাহিত্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারেনি।

কাজী আনোয়ার হোসেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করলেও তিনি স্বকীয়তা বজায় রেখে একই ধারার কাহিনি নির্মাণ করেছেন। সচেতন থেকেছেন ভাষার দিকে। এসব বইয়ের ভাষা অতি সরল, বোধগম্য এবং জলের ধারার মতো তরতরিয়ে পড়ার মতো। সাধারণ লেখাপড়া জানা মানুষও মাসুদ রানা পড়ার জন্য ভাষাগত কারণে কোনো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে না বলে এসব বইয়ের জনপ্রিয়তার আরেকটি কারণ। এছাড়া এই বইয়ে রয়েছে টান টান উত্তেজনা, সাসপেন্স, রোমাঞ্চ এবং রহস্যময় গল্প। গল্পটা একবার পড়া শুরু করলে শেষ না করা পর্যন্ত পাঠকের মনে স্বস্তি মিলে না। এমনভাবে পাঠককে আটকে রাখার বই সৃষ্টি করা কম কৃতিত্বের ঘটনা নয়। একটি বইয়ের গল্প পাঠকের মনে থেকে রহস্যময়তার রেশ এবং সিরিজের পরের বইটি পড়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। এভাবেই সিরিজ সৃষ্টি করা হয়েছে যাতে পাঠককে আকৃষ্ট করে একটির পর একটি গল্পে টেনে আনা যায়। ‘রিডিং ফর প্লেজার’ পড়া যদি আনন্দের জন্য তাহলে মাসুদ রানা সিরিজ একটি সফল সিরিজ থ্রিলার হিসেবে সন্দেহাতীতভাবে আখ্যায়িত করতে হবে।

তিনি শুধু কাজী আনোয়ার হোসেন নামে মাসুদ রানা লিখেছেন তা নয়। তিনি বিদ্যুৎ মিত্র ও শামসুদ্দিন নওয়াব- এ দুটি ছদ্মনামেও লিখতেন যা অনেকের কাছে অজানা। সাংবাদিক রাহাত খানের অনুপ্রেরণায় তিনি ১৯৬৯-৭০ সালে একটি রহস্যপত্রিকা প্রকাশ করার পরিকল্পনা নেন এবং ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসে প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। তারপর স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এটি বন্ধ ছিল, পরে ১৯৮৪ সালে এটি পুনরায় প্রকাশিত হতে থাকে এবং অদ্যাবধি নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে।

চাঁদেরও কলঙ্ক থাকে, আলোরও থাকে ছায়া। কাজী আনোয়ার হোসেনও তা থেকে মুক্ত নন। প্রথমত মাসুদ রানা সিরিজে যৌন সুড়সুড়ির অভিযোগে অভিযুক্ত। অনেক অগ্রজই ছোটদের হাতে মাসুদ রানা দেখলে টেরা চোখে তাকান। দ্বিতীয়ত প্রায় চার শতাধিক বই লেখা একজন মানুষের পক্ষে প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। তাই তিনি আবদুল হাকিম নামে একজন থ্রিলার লেখককে দিয়ে প্রায় পঞ্চাশটি কিংবা তারও অধিক বই লিখিয়ে নিয়েছেন। সাহিত্য জগতে এই ধরনের রেওয়াজ আছে যাকে গোস্ট রাইটার বলা হয়। কাজী আনোয়ার হোসেন মাসুদ রানার স্টোরিলাইন দিয়েছেন অথবা দেননি কিন্তু পারিশ্রমিক দিয়ে আবদুল হাকিমকে দিয়ে থ্রিলার উপন্যাস লিখিয়ে নিয়েছেন। গোস্ট রাইটার হিসেবে দুনিয়াজুড়ে প্রচলিত ধারায় কাজী আনোয়ার হোসেনও এই কাজ করেছেন তাই এটি অনৈতিকতার ঘটনা বলে উল্লেখ করা যাবে না। তিনি বিনিয়োগ করেছেন এবং পাঠকের হাতে বই পৌঁছে দিয়েছেন। গত দুবছর আগে কপিরাইট আইনে আবদুল হাকিম পঞ্চাশটি বইয়ের লেখক স্বত্তা দাবি করে একটি মামলা রুজু করেন। কিছু দিন আগে মামলার রায়ে আবদুল হাকিম স্বত্ব পান। দুঃখের ব্যাপার হলো, গত বছর আবদুল হাকিমও করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান আর কাজী আনোয়ার হোসেন গত ১৯ই জানুয়ারি মারা যান। এতো স্বল্প সময়ের ব্যবধানে দুজন মানুষের মৃত্যু সাহিত্যাঙ্গনের অনেককে ব্যথিত করেছে, করেছে শোকস্তব্ধ। বলা বাহুল্য যে, বাংলা সাহিত্যে দুজনই ছিলেন নিপাট ভদ্র লোক এবং প্রচারবিমুখ। দুজনের কেউই অন্যান্য জনপ্রিয় লেখকের মতো সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত মুখ ছিলেন না। কাজী আনোয়ার হোসেন নিজেকে লুকিয়ে রাখতেন বলা যায়। কোনো সভাসমিতি কিংবা আত্মপ্রচারের জন্য হল্লা করে ছুটতেন না, এমনকি কোনো বইয়ে ছবিও ছাপা হতো কিনা সন্দেহ।

কাজী আনোয়ার হোসেন আজ আমাদের মাঝে নেই কিন্তু তাঁর সৃষ্টকর্মের মধ্য দিয়ে তিনি এদেশের মানুষের মনে অনেক দিন বেঁচে থাকবেন।

বৃহস্পতিবার, ২৭ জানুয়ারী ২০২২ , ১৩ মাঘ ১৪২৮, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৩

কাজী আনোয়ার হোসেন : নিভৃত বোহেমিয়ান

মোজাম্মেল হক নিয়োগী

image

হোসেনকে নিয়ে। একইভাবে রোমেনা আফাজও একই ধারার লেখক দস্যু বনহুরের আড়ালে আলোচিত। উভয়ের সৃষ্ট চরিত্র তাঁদের কীর্তি নামকে আড়াল করে দিয়েছে।

কাজী আনোয়ার হোসেনের সৃষ্টিশীল চিন্তার জন্যই সেবা প্রকাশনীর বই বাংলাদেশে গ্রামে-গঞ্জে এক শ্রেণির অগণিত পাঠকের হাতে চলে যায় যা বাংলাদেশে আর কোনো ব্যক্তি বা প্রকাশক করতে পারেননি। শুরুটা তিনি কুয়াশা থ্রিলারের গুপ্তচর কাহিনি দিয়ে করলেও মাসুদ রানা সিরিজে অধিকর জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এবং পরিণামে তাঁর জীবদ্দশায় প্রায় চার শতাধিক বই লেখা, প্রকাশ ও বাজারজাত করতে সক্ষম হন। পেপারব্যাকে নিউজপ্রিন্ট কাগজে মুদ্রিত মাসুদ রানা সিরিজের বই তরুণ সমাজকে ব্যাপকভাবে আকৃষ্ট করেছে এবং এখনো করে। এটি জনপ্রিয়তার দিক থেকে শীর্ষে; যদিও এসব বই নিয়ে কোনো গবেষণা হয়নি। জনপ্রিয়তার শীর্ষে কিনা সে তথ্য না থাকলেও আপাতদৃষ্টিতে তাই মনে হয়। বইমেলায় সেবা প্রকাশনীর ভিড় দেখলে এরকম বোধ জাগ্রত হওয়াটা খুব স্বাভাবিক। পূর্বে গ্রামেগঞ্জের বইয়ের দোকানে, লঞ্চে বা ট্রেনে হকারদের হাতে সেবা প্রকাশনীর অসংখ্য বই যেভাবে দেখা যেত তাতেও এই অনুমান সত্য বলেই ধরে নেওয়া যায়। মাসুদ রানা সিরিজের বইগুলোর দাম কম হওয়াতেও এবং সব শ্রেণির পাঠকের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকার কারণেও তরুণ-তরুণীদের হাতের নাগালে চলে যায়। দু-তিন দশক আগেও প্রতিটি রেলস্টেশনে একটি করে বুকস্টল থাকত যেখানে পত্রপত্রিকাসহ সাহিত্যের বইও পাওয়া যেত। তখন সেবা প্রকাশনীর বই অর্থাৎ কুয়াশা বা মাসুদ রানার সিরিজের অনেক বইও দেখা যেত। গ্রামের পাঠাগারেও থাকত অসংখ্য বই। তখনকার সময়ে ভাড়াতেও বই নিয়ে পড়ার মানুষের অভাব ছিল না। বর্তমানে বইয়ের বাজার সংকুচিত ও মন্দা হওয়াতে এবং সহজলভ্য যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে পত্রপত্রিকা গ্রামেগঞ্জে চলে যাওয়াতে রেলস্টেশনের বুকস্টলগুলো ব্যবসা হারিয়েছে। কিন্তু মাসুদ রানার জনপ্রিয়তার এখনো ততটা কমতি নেই বলেই প্রতীয়মান হয়।

তাঁর কৈশোরেই পাওয়া যায় গোয়েন্দাগিরির নমুনা। তিনি প্রায়ই বাসা থেকে হারিয়ে যেতেন অর্থাৎ কাউকে না জানিয়েই দূর দূরান্তে বেড়াতে চলে যেতেন এবং কিছুদিন পর আবার ফিরে আসতেন। প্রথম দিকে পরিবারের লোকজন খুব চিন্তিত হলেও পরে সবার কাছে সহনীয় হয়ে দাঁড়ায়

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডিটেক্টিভ জনপ্রিয় ব্যোমকেশ, পাঁচকড়ি দের দেবেন্দ্রবিজয়, শশধর দত্তের মোহন এবং নীহাররঞ্জন গুপ্তের কিরীটি রায় বাংলা সাহিত্যের অধিকাংশ গোয়েন্দা কাহিনিই পাশ্চাত্যের সাহিত্য-গোয়েন্দা কোনান ডয়েলের শার্লক হোমস, রেমন্ড চ্যান্ডলারের ফিলিপ মার্লোর প্রভাবে রচিত হয়েছে বলে অনেকেই মত প্রকাশ করেন। মাসুদ রানাও কোনো মৌলিক কাহিনি নয়, ওয়েস্টার্ন কাহিনির ছায়াবলম্বনে রচিত বলে প্রায় সবার কাছেই স্বীকৃত। এই চরিত্র ইয়ান ফ্লেমিংয়ের জেমস বন্ড চরিত্রের ছায়াবলম্বনে সৃষ্টি বলে বিবেচিত। গোয়েন্দা কাহিনির মাসুদ রানা মূলধারার সাহিত্য বলে বিবেচিত নয় বলে বিদগ্ধ পাঠকের কাছে সাহিত্যাঙ্গনে এসব বই নিয়ে কোনো আলোচনা-সমালোচনা নেই। পাঠককুল বই পড়ে আনন্দ উপভোগ করেন এই পর্যন্তই এসব গোয়েন্দা কাহিনির সর্বশেষ ফল, এর বেশি কিছু নয়। এর মূল কারণ হলো, মাসুদ রানার চরিত্রগুলো ‘টাইপ’ চরিত্র হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় এবং গল্পগুলো প্রায় একই ধরনের। কখনো বাস্তবতা কিংবা পরাবাস্তবতার ছায়ায় রচিত হলেও মূলধারার সাহিত্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারেনি।

কাজী আনোয়ার হোসেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করলেও তিনি স্বকীয়তা বজায় রেখে একই ধারার কাহিনি নির্মাণ করেছেন। সচেতন থেকেছেন ভাষার দিকে। এসব বইয়ের ভাষা অতি সরল, বোধগম্য এবং জলের ধারার মতো তরতরিয়ে পড়ার মতো। সাধারণ লেখাপড়া জানা মানুষও মাসুদ রানা পড়ার জন্য ভাষাগত কারণে কোনো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে না বলে এসব বইয়ের জনপ্রিয়তার আরেকটি কারণ। এছাড়া এই বইয়ে রয়েছে টান টান উত্তেজনা, সাসপেন্স, রোমাঞ্চ এবং রহস্যময় গল্প। গল্পটা একবার পড়া শুরু করলে শেষ না করা পর্যন্ত পাঠকের মনে স্বস্তি মিলে না। এমনভাবে পাঠককে আটকে রাখার বই সৃষ্টি করা কম কৃতিত্বের ঘটনা নয়। একটি বইয়ের গল্প পাঠকের মনে থেকে রহস্যময়তার রেশ এবং সিরিজের পরের বইটি পড়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। এভাবেই সিরিজ সৃষ্টি করা হয়েছে যাতে পাঠককে আকৃষ্ট করে একটির পর একটি গল্পে টেনে আনা যায়। ‘রিডিং ফর প্লেজার’ পড়া যদি আনন্দের জন্য তাহলে মাসুদ রানা সিরিজ একটি সফল সিরিজ থ্রিলার হিসেবে সন্দেহাতীতভাবে আখ্যায়িত করতে হবে।

তিনি শুধু কাজী আনোয়ার হোসেন নামে মাসুদ রানা লিখেছেন তা নয়। তিনি বিদ্যুৎ মিত্র ও শামসুদ্দিন নওয়াব- এ দুটি ছদ্মনামেও লিখতেন যা অনেকের কাছে অজানা। সাংবাদিক রাহাত খানের অনুপ্রেরণায় তিনি ১৯৬৯-৭০ সালে একটি রহস্যপত্রিকা প্রকাশ করার পরিকল্পনা নেন এবং ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসে প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। তারপর স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এটি বন্ধ ছিল, পরে ১৯৮৪ সালে এটি পুনরায় প্রকাশিত হতে থাকে এবং অদ্যাবধি নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে।

চাঁদেরও কলঙ্ক থাকে, আলোরও থাকে ছায়া। কাজী আনোয়ার হোসেনও তা থেকে মুক্ত নন। প্রথমত মাসুদ রানা সিরিজে যৌন সুড়সুড়ির অভিযোগে অভিযুক্ত। অনেক অগ্রজই ছোটদের হাতে মাসুদ রানা দেখলে টেরা চোখে তাকান। দ্বিতীয়ত প্রায় চার শতাধিক বই লেখা একজন মানুষের পক্ষে প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। তাই তিনি আবদুল হাকিম নামে একজন থ্রিলার লেখককে দিয়ে প্রায় পঞ্চাশটি কিংবা তারও অধিক বই লিখিয়ে নিয়েছেন। সাহিত্য জগতে এই ধরনের রেওয়াজ আছে যাকে গোস্ট রাইটার বলা হয়। কাজী আনোয়ার হোসেন মাসুদ রানার স্টোরিলাইন দিয়েছেন অথবা দেননি কিন্তু পারিশ্রমিক দিয়ে আবদুল হাকিমকে দিয়ে থ্রিলার উপন্যাস লিখিয়ে নিয়েছেন। গোস্ট রাইটার হিসেবে দুনিয়াজুড়ে প্রচলিত ধারায় কাজী আনোয়ার হোসেনও এই কাজ করেছেন তাই এটি অনৈতিকতার ঘটনা বলে উল্লেখ করা যাবে না। তিনি বিনিয়োগ করেছেন এবং পাঠকের হাতে বই পৌঁছে দিয়েছেন। গত দুবছর আগে কপিরাইট আইনে আবদুল হাকিম পঞ্চাশটি বইয়ের লেখক স্বত্তা দাবি করে একটি মামলা রুজু করেন। কিছু দিন আগে মামলার রায়ে আবদুল হাকিম স্বত্ব পান। দুঃখের ব্যাপার হলো, গত বছর আবদুল হাকিমও করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান আর কাজী আনোয়ার হোসেন গত ১৯ই জানুয়ারি মারা যান। এতো স্বল্প সময়ের ব্যবধানে দুজন মানুষের মৃত্যু সাহিত্যাঙ্গনের অনেককে ব্যথিত করেছে, করেছে শোকস্তব্ধ। বলা বাহুল্য যে, বাংলা সাহিত্যে দুজনই ছিলেন নিপাট ভদ্র লোক এবং প্রচারবিমুখ। দুজনের কেউই অন্যান্য জনপ্রিয় লেখকের মতো সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত মুখ ছিলেন না। কাজী আনোয়ার হোসেন নিজেকে লুকিয়ে রাখতেন বলা যায়। কোনো সভাসমিতি কিংবা আত্মপ্রচারের জন্য হল্লা করে ছুটতেন না, এমনকি কোনো বইয়ে ছবিও ছাপা হতো কিনা সন্দেহ।

কাজী আনোয়ার হোসেন আজ আমাদের মাঝে নেই কিন্তু তাঁর সৃষ্টকর্মের মধ্য দিয়ে তিনি এদেশের মানুষের মনে অনেক দিন বেঁচে থাকবেন।