অনির্ণীত সম্পর্কের খসড়া

খালেদ চৌধুরী

কুয়াশার ফোঁটা, ঘুমের স্বর, দেয়াল ঘড়ির টিকটিক; রাত্রির স্রোতে মিশে কী এক নৈঃশব্দ্যের নদী। কোথাও নাগরিক বুদ্ধিতা নেই। অকারণ পশু শিকারের হাততালি এখানে পৌঁছায় না। প্রতিরাত এমন ঘনঘোরে আপেলের সূত্র খোঁজে? তখন মনে হয়, চোখ নেই, নাক নেই, ঠোঁট নেই, মুখ নেই, হাত নেই, বুক নেই, পেট নেই, এক না-মানুষ; দেশহীন নদীর কিনারে বাদাম খুঁটে খায়। চাঁদনি রাতে হাতের তসবি জপে ঘাসের বিছানায় কোন্ এক আরব্যরজনীকে আহ্বান, ঘুঙুরের তালে মীরাবাঈয়ের দেহ বঙ্কিম, বেণির দুলুনি। রঙ বদলানো পান্নার অভিসার। পানীয় আর মাংসে কী এক চুম্বকের আবেশ। কতটুকু ডোবা যায়? না হয় ডুবে গেলাম শরীর সুরভির স্তূপে। গরিবিকে ভয় কেন? খানা নেই দানা নেই। পাঁজর ঘষে ডেকে তুলি আরেক না-মানুষ।

-আচ্ছা তুমি কোথায় থাক বলো তো?

-যেখানে থাকার সেখানে থাকি।

-বাকা কথা বলো কেন?

-যদি বলি অভ্যস্থ কথায় বসবাস ছাড়।

-তাই তো।

-খুব সহজে নিজের ভুল বুঝে গেলে তাই না-বউ থাকার পরও ডাক কেন?

-তোমাকেও পেতে মন চায়।

-বিয়ে করো।

-তুমি তো বন্ধ্যা।

-সব ফুল ফল হয়?

[যুগপৎ নীরবতা]

-এই যে এত এত অর্থকরী হবার সাধনা। তা দিয়ে কি পাও? শুধু মাংসে কার তৃপ্তি?

-মিথ্যা বলব না, সেই জিনিসটা এখনো খুঁজে পাইনি।

-এই যে প্রবঞ্চনা। না-মানুষ তুমি প্রতিদিন মিথ্যা সাজাও।

-আলোর গভীরে থাকে অন্ধকার। অন্ধকারের গভীরে আলো।

-এ বুঝি প্রবঞ্চনার সত্যায়ন?

-হতে পারে।

-যেহেতু আত্মহত্যা করবে না, সঙ্গটাকে তুমি অস্বীকার করতে পার?

-গোলাপ কি চাইলেই তার ঘ্রাণ মুছে ফেলতে পারে?

-সৃষ্টি করেছিলে কেন আমাকে?

-যে সৃষ্টি হয়ে আছে তাকে কে বানায়?

-তাহলে কী করেছ?

-সামান্য একটু ঘষামাজা।

-কেন করলে?

-আলাদিনের চেরাগ হাতে পেলে কে না ঘষবে?

-তুমি কী চেয়েছিলে?

-অস্বীকার করতে পারবে? হংসবলাকার ক্ষণটা। ওই ব্যথাটুকু তো তোমারও। চুপ করে আছো কেন?

-না মানুষের কোনো যৌনতা থাকতে নেই।

-তাহলে?

-নিঃসঙ্গতার আয়াত পেয়েই ভাবছ পেয়ে গেছ গোপন সুরঙ্গ।

-না-মানুষ তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে হ্যাঁ মানুষটা সয়ম্ভূ হয়ে গেছে। সে এখন তোমার থেকেও ভালো পারফরমান। কথা ছিল মন্দের অর্ধেক, তারপর ভালোর। ওর যে পালা আর শেষ হয় না।

-আমি কি জন্মেছিলাম, প্রভাতের আলোয় না ফুলফোটা সন্ধ্যায়, দীপাবলীর উৎসবে-একটা নাকফুলের ব্যথা নিয়ে, সুনীল প্রান্তরে-এক রতি বিষ মিশাতে? কখনো মনে হয়-অভ্রমাখা দু-একটা রেণু সেটাও কম কী। কী সব গতানুগতিক সবকিছু ভোঁতা করে দেয়। আবেগ আর যুক্তির মধ্যরেখায় মমির ব্যবচ্ছেদ, স্নায়ুকোষগুলো-বাসনা থেকেই বের হতে পারছে না। আর তুমি বলছো সন্ন্যাসী হতে। ভোগ্যপণ্যের প্রদর্শনী এত বেশি পলকা বানিয়ে দেয়। কোথাও তার শেকড় নেই। উড়তে উড়তে ভাসতে ভাসতে যা নেই তা শুধু মনে পড়ে।

বাইরে থেকে এসে কাপড়গুলো ভিজিয়ে দেই। ফ্যানের নিচে বসি। ঘাম শুকালে গোসল করব। গুড়োঁ সাবানে কাপড় ভিজে থাকে। একটা শার্ট, প্যান্ট, জাঙ্গিয়া। দৃশ্যও কী রকম বাজারি। এখন যদি বলতাম, একটা সালোয়ার, কামিজ, ব্রা, পেন্টি গুঁড়ো সাবানে চুবিয়ে রেখেছি। নখ কাটছি। তার পর স্নানে যাব। তাহলে দৃশ্যটা বোধহয় আকর্ষণ করত। পুরুষকে মাথায় রেখে বাজার ব্যবস্থা। কেন নারীর কি পুরুষের ঘামের বর্ণনা শুনতে মন চায় না? ১০০০ জনে কয় জন আর লেসবিয়ান। জাঙ্গিয়া ডলে ডলে পরিস্কার করলাম। শার্টের কলার আরেক প্রস্থ সাবান লাগিয়ে ডললাম। আলাদা আলাদাভাবে শার্ট কাচলাম, প্যান্ট কাচলাম, জাঙ্গিয়া কাচলাম। স্নানঘরের জলধারায় দাঁড়াতেই, মনে পড়ে গেলে তুমি। ২০০৭ সালের পর তোমার সঙ্গে কোনো ধরনের সংযোগ নেই। না শব্দগত, না শারীরিক। মানসে যা একটু আধটু টুংটাং। তুমিও কোনো ধরনের আগ্রহ দেখাওনি। ১৩ বছরের মরা বীজে কেনই বা অঙ্কুরোদগম। উদয় যখন হয়েছো, তোমাকে কিছু কথা শুনতে হবে। প্রমি, তোমাকে কাতরভাবে বলেছিলাম, সাইকোলজিকেল ডিজঅর্ডারে ইন্টারমিডিয়েটের গণ্ডি কিছুতেই পার হতে পারছি না। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হবার দুরাশা ত্যাগ করে-উন্মুক্ত বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। তুমিও ভর্তি হলে প্রাইভেটে চিকিৎসাবিদ্যায়। এত বেশি কথায় যাচ্ছি না। তোমাকে দেখার পর ভিতরের পাগলটা আবার ফিরে এলো। তখন আমাদের কথা হতো। তোমার মোবাইল নাম্বারটা পাওয়ার পর আমিই তোমাকে ফোন দিতাম। তোমার কণ্ঠস্বর রক্তবীজের মতো আমার কোষে প্রদীপ হয়ে জ¦লত। বলেছিলাম, তোমাকে কোনো ধরনের পাওয়ার আশা নাই। প্রমি, আমি আবার পাগল হয়ে যাচ্ছি। জানো, শিকল দিয়ে বেধে রাখে আমাকে। আমি বিপন্ন। প্রমি, তোমার স্নায়ু থেকে একটু মদ দাও। কোনো দিন অধিকার চাইব না। কথা দিলাম এবার সুস্থ হবার পর আর কোনো দিন তোমাকে ফোন দেব না। তুমি দক্ষ ডাক্তারের মতো আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলে। তুমি ভেবেছো তোমাকে পাওয়ার জন্য এ আমার চাতুরি। না একদম না। আমি মিথ্যা বলিনি। ব্যালেন্স ফুরিয়ে লাইন কেটে গেলে, তুমি কখনো ফোন দাওনি; সেদিনের পর আমিও আর তোমাকে ফোন দেইনি। শুকনো পাতা পুকুরে ভাসিয়ে কাছে ডেকে যখন দেখলাম ডুবে যায়। তখন থেকে আমি সবুজমুখী। তোমার নাম্বার ভুলে গেছি ঠিক। কিন্তু ডায়েরিতে লেখা আছে। চাইলেই তোমাকে ফোন দিতে পারি। কিন্তু কেন দেব? তোমাকে একদিন দেখেছি। পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছ। ডাক দেইনি। পরে শুনেছি, তুমি বিসিএস ক্যাডার। শান্তিবাজারে সপ্তাহে একদিন রোগী দেখ। কেন জানি তোমাকে খুব অপরিচিত মনে হয়েছে। স্কুলের দিন কে মনে রাখে? নাগরিক ফুল হয়ে কোথায় ফুটেছ? সে তোমার স্বাধীনতা। এর মাঝে তোমার নাম-বদনপুস্তুকে সার্চ দেইনি তা কিন্তু না। ওখানে তুমি নেই। হয়তো অন্য নামে আছ। তোমার খুব কাছের ডাক্তার বন্ধু ইশরাক আমারও পরিচিত। ও তোমার খোঁজ জানে। বদনপুস্তুকে তার সঙ্গে প্রায়ই চ্যাট হয়। ওকে জিগ্যেস করলেই তোমার সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারি। এই তের বছর তোমার সম্পর্কে একটা শব্দও জানতে ইচ্ছে করেনি। যখন তুমি মনে পড়েছ-তোমাকে এই কথাগুলো শুনতেই হবে। দু হাতে কান চেপে ধরেও তুমি নিস্তার পাবে না।

ওকে জিগ্যেস করলেই তোমার সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারি। এই তেরো বছর তোমার সম্পর্কে একটা শব্দও জানতে ইচ্ছে করেনি। যখন তুমি মনে পড়েছ-তোমাকে এই কথাগুলো শুনতেই হবে। দু হাতে কান চেপে ধরেও তুমি নিস্তার পাবে না

ষুপ্তিকে একদিন তোমার কথা বলি। পাগল থাকার দিনগুলোতে ও যেন একটা মিশনে নেমেছে আমাকে সুস্থ করে তুলবে। অথচ আমি ওকে দুচোখে সহ্য করতে পারতাম না। বুঝতে পারতাম ও আমাকে একটু বেশি সময় দিচ্ছে। কেন জানি ওর সান্নিধ্য থেকে তোমার তাচ্ছিল্য আমার কাছে আপন ছিল। কী আশ্চর্য দেখো ফুল থেকে মাকড়সা নেয় বিষ আর মৌমাছি নেয় মধু। আমি যেন মাকড়সার পেছনেই ছুটছিলাম। ষুপ্তি আমাকে শালদা নদীর পাড়ে ঘুরতে নিয়ে যেত। আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা শহর পেরিয়ে গ্রামের দিকে হাঁটতাম। বারবার দেখা ধানক্ষেত আবার দেখলাম। একই নদী আবার দেখতাম। একই কথা বারবার বলতাম। একই কবিতা বারবার শুনতাম। ও আবার গান জানত। শূন্যতা গান কবিতা দিয়ে ভরাট ছাড়া আর কি বিকল্প হতে পারে? রিমোটের বাটন কিংবা টাচ স্কিনের সময় গ্রন্থিতে স্ববিরোধিতা ক্রমাগত আপসগামী। সেখানে আমি কোন ছাই। ব্যক্তিক হোক কিংবা সামষ্টিক হোক নিজেকে কেউ খুঁড়তে চায় না। যেন আগেই জানে বীভৎসতা। সেই কালিমা থেকে আমিও মুক্ত নই। তোমাকে দোষ দিচ্ছি না।

একবার হলো কী সেন্টমার্টিনে শিক্ষা সফর। আমিও সেবার যাই। রাতের বাসে আমরা টেকনাফের জেটিতে পৌঁছাই। সূর্যের আলো বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লবণ ক্ষেত চিকচিক করছিল। আগে কখনো মাইলের পর মাইল লবণ ক্ষেত দেখিনি। বাতাসে একটা নোনা ভাব। নির্ঘুম চোখে কুয়াশা সরানো আলোর চিরিক, কাঠের সাঁকো বেয়ে জাহাজে ওঠি। পিস্টন ফেনা তুলে অবাধ বয়ে চলে। গাঙচিলগুলো খুঁটে খায় ফেনা। আমি আর ষুপ্তি মাঝখানে একটা চেয়ার দূরত্ব পাশাপাশি বসে আছি। ও বারবার জানতে চেয়েছিল, তোমাকে ভুলেছি কি না। ডাকাতের ভয় পাড়ি দিয়ে। নীল সমুদ্রের দিকে চোখ রেখে অবশেষে দারুচিনি দ্বীপ। সেই দ্বীপ যেন সমুদ্রের প্রহরী। কচি ডাব। ডাবের শাস। বালিয়ারি দ্বীপে সমুদ্রের গর্জন। পড়ন্ত সূর্যের কমলা আভা। প্রবাল বিছানো বালিয়াড়িতে মদহীন রাত্রি-এত উজ্জ্বল হতে পারে জানা ছিল না। অন্ধকারে ফসফরাসের জ্বলজ্বল আমাকে ডেকে তুলে। কোন এক মায়ার টানে সেদিন মরতে পারিনি। ঘুমের ছুড়ি রক্তাক্ত করে রাখে। সূর্যরশ্মি ডেকে তোলে। জনহীন বেলাভূমিতে ঘুমভাঙা সূর্যের আড়মোড়া দেখতে দেখতে ফেলে যাওয়া কাছিমের খোল আর ভালো লাগছিল না। সমুদ্রলতায় ফুটে থাকা নামহীন ঘ্রাণ বেঁচে থাকা সকালটাকে স্বাগত জানায়। ক্রমেই সূর্যের তেজ বাড়ছে।

বৃহস্পতিবার, ২৭ জানুয়ারী ২০২২ , ১৩ মাঘ ১৪২৮, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৩

অনির্ণীত সম্পর্কের খসড়া

খালেদ চৌধুরী

image

কুয়াশার ফোঁটা, ঘুমের স্বর, দেয়াল ঘড়ির টিকটিক; রাত্রির স্রোতে মিশে কী এক নৈঃশব্দ্যের নদী। কোথাও নাগরিক বুদ্ধিতা নেই। অকারণ পশু শিকারের হাততালি এখানে পৌঁছায় না। প্রতিরাত এমন ঘনঘোরে আপেলের সূত্র খোঁজে? তখন মনে হয়, চোখ নেই, নাক নেই, ঠোঁট নেই, মুখ নেই, হাত নেই, বুক নেই, পেট নেই, এক না-মানুষ; দেশহীন নদীর কিনারে বাদাম খুঁটে খায়। চাঁদনি রাতে হাতের তসবি জপে ঘাসের বিছানায় কোন্ এক আরব্যরজনীকে আহ্বান, ঘুঙুরের তালে মীরাবাঈয়ের দেহ বঙ্কিম, বেণির দুলুনি। রঙ বদলানো পান্নার অভিসার। পানীয় আর মাংসে কী এক চুম্বকের আবেশ। কতটুকু ডোবা যায়? না হয় ডুবে গেলাম শরীর সুরভির স্তূপে। গরিবিকে ভয় কেন? খানা নেই দানা নেই। পাঁজর ঘষে ডেকে তুলি আরেক না-মানুষ।

-আচ্ছা তুমি কোথায় থাক বলো তো?

-যেখানে থাকার সেখানে থাকি।

-বাকা কথা বলো কেন?

-যদি বলি অভ্যস্থ কথায় বসবাস ছাড়।

-তাই তো।

-খুব সহজে নিজের ভুল বুঝে গেলে তাই না-বউ থাকার পরও ডাক কেন?

-তোমাকেও পেতে মন চায়।

-বিয়ে করো।

-তুমি তো বন্ধ্যা।

-সব ফুল ফল হয়?

[যুগপৎ নীরবতা]

-এই যে এত এত অর্থকরী হবার সাধনা। তা দিয়ে কি পাও? শুধু মাংসে কার তৃপ্তি?

-মিথ্যা বলব না, সেই জিনিসটা এখনো খুঁজে পাইনি।

-এই যে প্রবঞ্চনা। না-মানুষ তুমি প্রতিদিন মিথ্যা সাজাও।

-আলোর গভীরে থাকে অন্ধকার। অন্ধকারের গভীরে আলো।

-এ বুঝি প্রবঞ্চনার সত্যায়ন?

-হতে পারে।

-যেহেতু আত্মহত্যা করবে না, সঙ্গটাকে তুমি অস্বীকার করতে পার?

-গোলাপ কি চাইলেই তার ঘ্রাণ মুছে ফেলতে পারে?

-সৃষ্টি করেছিলে কেন আমাকে?

-যে সৃষ্টি হয়ে আছে তাকে কে বানায়?

-তাহলে কী করেছ?

-সামান্য একটু ঘষামাজা।

-কেন করলে?

-আলাদিনের চেরাগ হাতে পেলে কে না ঘষবে?

-তুমি কী চেয়েছিলে?

-অস্বীকার করতে পারবে? হংসবলাকার ক্ষণটা। ওই ব্যথাটুকু তো তোমারও। চুপ করে আছো কেন?

-না মানুষের কোনো যৌনতা থাকতে নেই।

-তাহলে?

-নিঃসঙ্গতার আয়াত পেয়েই ভাবছ পেয়ে গেছ গোপন সুরঙ্গ।

-না-মানুষ তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে হ্যাঁ মানুষটা সয়ম্ভূ হয়ে গেছে। সে এখন তোমার থেকেও ভালো পারফরমান। কথা ছিল মন্দের অর্ধেক, তারপর ভালোর। ওর যে পালা আর শেষ হয় না।

-আমি কি জন্মেছিলাম, প্রভাতের আলোয় না ফুলফোটা সন্ধ্যায়, দীপাবলীর উৎসবে-একটা নাকফুলের ব্যথা নিয়ে, সুনীল প্রান্তরে-এক রতি বিষ মিশাতে? কখনো মনে হয়-অভ্রমাখা দু-একটা রেণু সেটাও কম কী। কী সব গতানুগতিক সবকিছু ভোঁতা করে দেয়। আবেগ আর যুক্তির মধ্যরেখায় মমির ব্যবচ্ছেদ, স্নায়ুকোষগুলো-বাসনা থেকেই বের হতে পারছে না। আর তুমি বলছো সন্ন্যাসী হতে। ভোগ্যপণ্যের প্রদর্শনী এত বেশি পলকা বানিয়ে দেয়। কোথাও তার শেকড় নেই। উড়তে উড়তে ভাসতে ভাসতে যা নেই তা শুধু মনে পড়ে।

বাইরে থেকে এসে কাপড়গুলো ভিজিয়ে দেই। ফ্যানের নিচে বসি। ঘাম শুকালে গোসল করব। গুড়োঁ সাবানে কাপড় ভিজে থাকে। একটা শার্ট, প্যান্ট, জাঙ্গিয়া। দৃশ্যও কী রকম বাজারি। এখন যদি বলতাম, একটা সালোয়ার, কামিজ, ব্রা, পেন্টি গুঁড়ো সাবানে চুবিয়ে রেখেছি। নখ কাটছি। তার পর স্নানে যাব। তাহলে দৃশ্যটা বোধহয় আকর্ষণ করত। পুরুষকে মাথায় রেখে বাজার ব্যবস্থা। কেন নারীর কি পুরুষের ঘামের বর্ণনা শুনতে মন চায় না? ১০০০ জনে কয় জন আর লেসবিয়ান। জাঙ্গিয়া ডলে ডলে পরিস্কার করলাম। শার্টের কলার আরেক প্রস্থ সাবান লাগিয়ে ডললাম। আলাদা আলাদাভাবে শার্ট কাচলাম, প্যান্ট কাচলাম, জাঙ্গিয়া কাচলাম। স্নানঘরের জলধারায় দাঁড়াতেই, মনে পড়ে গেলে তুমি। ২০০৭ সালের পর তোমার সঙ্গে কোনো ধরনের সংযোগ নেই। না শব্দগত, না শারীরিক। মানসে যা একটু আধটু টুংটাং। তুমিও কোনো ধরনের আগ্রহ দেখাওনি। ১৩ বছরের মরা বীজে কেনই বা অঙ্কুরোদগম। উদয় যখন হয়েছো, তোমাকে কিছু কথা শুনতে হবে। প্রমি, তোমাকে কাতরভাবে বলেছিলাম, সাইকোলজিকেল ডিজঅর্ডারে ইন্টারমিডিয়েটের গণ্ডি কিছুতেই পার হতে পারছি না। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হবার দুরাশা ত্যাগ করে-উন্মুক্ত বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। তুমিও ভর্তি হলে প্রাইভেটে চিকিৎসাবিদ্যায়। এত বেশি কথায় যাচ্ছি না। তোমাকে দেখার পর ভিতরের পাগলটা আবার ফিরে এলো। তখন আমাদের কথা হতো। তোমার মোবাইল নাম্বারটা পাওয়ার পর আমিই তোমাকে ফোন দিতাম। তোমার কণ্ঠস্বর রক্তবীজের মতো আমার কোষে প্রদীপ হয়ে জ¦লত। বলেছিলাম, তোমাকে কোনো ধরনের পাওয়ার আশা নাই। প্রমি, আমি আবার পাগল হয়ে যাচ্ছি। জানো, শিকল দিয়ে বেধে রাখে আমাকে। আমি বিপন্ন। প্রমি, তোমার স্নায়ু থেকে একটু মদ দাও। কোনো দিন অধিকার চাইব না। কথা দিলাম এবার সুস্থ হবার পর আর কোনো দিন তোমাকে ফোন দেব না। তুমি দক্ষ ডাক্তারের মতো আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলে। তুমি ভেবেছো তোমাকে পাওয়ার জন্য এ আমার চাতুরি। না একদম না। আমি মিথ্যা বলিনি। ব্যালেন্স ফুরিয়ে লাইন কেটে গেলে, তুমি কখনো ফোন দাওনি; সেদিনের পর আমিও আর তোমাকে ফোন দেইনি। শুকনো পাতা পুকুরে ভাসিয়ে কাছে ডেকে যখন দেখলাম ডুবে যায়। তখন থেকে আমি সবুজমুখী। তোমার নাম্বার ভুলে গেছি ঠিক। কিন্তু ডায়েরিতে লেখা আছে। চাইলেই তোমাকে ফোন দিতে পারি। কিন্তু কেন দেব? তোমাকে একদিন দেখেছি। পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছ। ডাক দেইনি। পরে শুনেছি, তুমি বিসিএস ক্যাডার। শান্তিবাজারে সপ্তাহে একদিন রোগী দেখ। কেন জানি তোমাকে খুব অপরিচিত মনে হয়েছে। স্কুলের দিন কে মনে রাখে? নাগরিক ফুল হয়ে কোথায় ফুটেছ? সে তোমার স্বাধীনতা। এর মাঝে তোমার নাম-বদনপুস্তুকে সার্চ দেইনি তা কিন্তু না। ওখানে তুমি নেই। হয়তো অন্য নামে আছ। তোমার খুব কাছের ডাক্তার বন্ধু ইশরাক আমারও পরিচিত। ও তোমার খোঁজ জানে। বদনপুস্তুকে তার সঙ্গে প্রায়ই চ্যাট হয়। ওকে জিগ্যেস করলেই তোমার সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারি। এই তের বছর তোমার সম্পর্কে একটা শব্দও জানতে ইচ্ছে করেনি। যখন তুমি মনে পড়েছ-তোমাকে এই কথাগুলো শুনতেই হবে। দু হাতে কান চেপে ধরেও তুমি নিস্তার পাবে না।

ওকে জিগ্যেস করলেই তোমার সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারি। এই তেরো বছর তোমার সম্পর্কে একটা শব্দও জানতে ইচ্ছে করেনি। যখন তুমি মনে পড়েছ-তোমাকে এই কথাগুলো শুনতেই হবে। দু হাতে কান চেপে ধরেও তুমি নিস্তার পাবে না

ষুপ্তিকে একদিন তোমার কথা বলি। পাগল থাকার দিনগুলোতে ও যেন একটা মিশনে নেমেছে আমাকে সুস্থ করে তুলবে। অথচ আমি ওকে দুচোখে সহ্য করতে পারতাম না। বুঝতে পারতাম ও আমাকে একটু বেশি সময় দিচ্ছে। কেন জানি ওর সান্নিধ্য থেকে তোমার তাচ্ছিল্য আমার কাছে আপন ছিল। কী আশ্চর্য দেখো ফুল থেকে মাকড়সা নেয় বিষ আর মৌমাছি নেয় মধু। আমি যেন মাকড়সার পেছনেই ছুটছিলাম। ষুপ্তি আমাকে শালদা নদীর পাড়ে ঘুরতে নিয়ে যেত। আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা শহর পেরিয়ে গ্রামের দিকে হাঁটতাম। বারবার দেখা ধানক্ষেত আবার দেখলাম। একই নদী আবার দেখতাম। একই কথা বারবার বলতাম। একই কবিতা বারবার শুনতাম। ও আবার গান জানত। শূন্যতা গান কবিতা দিয়ে ভরাট ছাড়া আর কি বিকল্প হতে পারে? রিমোটের বাটন কিংবা টাচ স্কিনের সময় গ্রন্থিতে স্ববিরোধিতা ক্রমাগত আপসগামী। সেখানে আমি কোন ছাই। ব্যক্তিক হোক কিংবা সামষ্টিক হোক নিজেকে কেউ খুঁড়তে চায় না। যেন আগেই জানে বীভৎসতা। সেই কালিমা থেকে আমিও মুক্ত নই। তোমাকে দোষ দিচ্ছি না।

একবার হলো কী সেন্টমার্টিনে শিক্ষা সফর। আমিও সেবার যাই। রাতের বাসে আমরা টেকনাফের জেটিতে পৌঁছাই। সূর্যের আলো বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লবণ ক্ষেত চিকচিক করছিল। আগে কখনো মাইলের পর মাইল লবণ ক্ষেত দেখিনি। বাতাসে একটা নোনা ভাব। নির্ঘুম চোখে কুয়াশা সরানো আলোর চিরিক, কাঠের সাঁকো বেয়ে জাহাজে ওঠি। পিস্টন ফেনা তুলে অবাধ বয়ে চলে। গাঙচিলগুলো খুঁটে খায় ফেনা। আমি আর ষুপ্তি মাঝখানে একটা চেয়ার দূরত্ব পাশাপাশি বসে আছি। ও বারবার জানতে চেয়েছিল, তোমাকে ভুলেছি কি না। ডাকাতের ভয় পাড়ি দিয়ে। নীল সমুদ্রের দিকে চোখ রেখে অবশেষে দারুচিনি দ্বীপ। সেই দ্বীপ যেন সমুদ্রের প্রহরী। কচি ডাব। ডাবের শাস। বালিয়ারি দ্বীপে সমুদ্রের গর্জন। পড়ন্ত সূর্যের কমলা আভা। প্রবাল বিছানো বালিয়াড়িতে মদহীন রাত্রি-এত উজ্জ্বল হতে পারে জানা ছিল না। অন্ধকারে ফসফরাসের জ্বলজ্বল আমাকে ডেকে তুলে। কোন এক মায়ার টানে সেদিন মরতে পারিনি। ঘুমের ছুড়ি রক্তাক্ত করে রাখে। সূর্যরশ্মি ডেকে তোলে। জনহীন বেলাভূমিতে ঘুমভাঙা সূর্যের আড়মোড়া দেখতে দেখতে ফেলে যাওয়া কাছিমের খোল আর ভালো লাগছিল না। সমুদ্রলতায় ফুটে থাকা নামহীন ঘ্রাণ বেঁচে থাকা সকালটাকে স্বাগত জানায়। ক্রমেই সূর্যের তেজ বাড়ছে।