আবুল কাসেম
(পূর্ব প্রকাশের পর)
একাশি.
ইমন ইঝোমির বাড়িতে গেছেন। দেখে ইঝোমির মধ্যে স্থিতিশীলতা এসেছে বলে মনে হল। গৃহিণীর মনোভাবও জন্মেছে। স্বামী সেত্তু প্রদেশে থাকেন। কিয়োটোতে ইঝোমির অবস্থানে কোনো সমস্যা নেই। মিচিনাগার দেয়া বাড়িতে বেশ আছেন। স্বামী সামরিককর্মকর্তা, ছুটি নিয়ে মাঝে মধ্যে আসেন।
এভাবে চলতে পারতো। কিন্তু প্রিন্স অতসুমিচির অপমৃত্যু তাকে আবার ভাবিয়ে তোলে। কবির জেদি মন যেন বিদ্রোহ করে ওঠে।
মিচিনাগা তার গোয়েন্দা সূত্রে আবারো এই তৎপরতার খবর জানতে পেরে এবারে ইমনকে পাঠিয়েছেন। ইমন কথা শুরু করলেন সেই শোনাগনের প্রসঙ্গ দিয়ে। বললেন, শোনাগনের কা- দেখো, প্রভু মহামন্ত্রীর সঙ্গে টেক্কা দিতে চায়। আমি বলি, তোমার কী প্রয়োজন সম্রাটকে এত কিছু বলা।
সভাকবি কিন্তু তাকে ব্যবহার করছেন।
সভাকবি কিন্তু প্রবীন মানুষ। তারও উচিত নিজের মর্যাদা রক্ষা করে চলা। তাকাকু, তার অমুলক প্রশ্নের অত্যন্ত রূঢ়ভাবে জবাব দিয়েছে বলে তাকাকুকে অকবির পর্যায়ে ফেলে দিতে হবে? তাকাকু বড় কথাশিল্পীই নয়, অনেক বড় কবি। তা বুঝবার ক্ষমতা কিন্তুর আছে? আমি তার ওপর বিরক্ত।
তুমি তো জানোই না প্রভু মহামন্ত্রী খুব খেপেছেন। তার ক্ষতি করতে পারেন।
কাঝান আমলের কবিতা সংকলনে নিজের পনেরটি কবিতা স্থান করে দিয়েছেন।
‘শুধু ওয়াকাশুই’ সংকলনে একজনেরই পনেরটি কবিতা ভাবা যায়?
এটি তো তারই সম্পাদিত।
সম্রাট কাঝান কম সময় সম্রাট ছিলেন। মাত্র দুই বছর। কিন্তু তাকে খ্যাতির লোভ দেখিয়ে তড়িঘড়ি করে তা করিয়েছেন।
মাত্র দুই বৎসর শাসনের পর তাকে জোর করে সিংহাসন থেকে নামিয়ে দেয়া হল। এই সুযোগটা কিন্তু নিয়েছেন।
তিনি তো একজন জাঁদরেল আমলা। সুযোগ নেবেনই।
তবে হাতের লেখা চমৎকার।
ক্যালিগ্রাফি জানেন বলেই তার পক্ষে সংকলন করা সম্ভব হচ্ছে।
মানুষের ভালো গুণগুলো খারাপ কাজের নিচে চাপা পড়ে যায়।
আরো অনেকক্ষণ এরা কিন্তুকে নিয়ে কথা বললেন। পরে ইমন বললেন, ইঝোমি, তোমাকে একটা কথা বলার ছিল।
ভূমিকা শুনেই ইঝোমি ভাবলেন ইমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা বলবেন। তাই আগ্রহ এবং শঙ্কা নিয়ে ইমনের দিকে তাকালেন। ইমন বললেন, যে চলে গেছে তাকে নিয়ে আর কেন তৎপর হয়ে পড়া।
তাকে নয়, তার মৃত্যুকে নিয়ে তৎপর আমি। তদন্ত আর বিচার চাইছি।
প্রভু মহামন্ত্রী আমাকে পাঠিয়েছেন। তুমি এসব এখন বাদ দাও।
তার সমস্যা কোথায়? তিনি তো তা হলে লাভবানই হবেন। সানজু সম্রাট না হলে তার ক্রাউন প্রিন্স সম্রাট হবেন। তিনি শিশু সম্রাটের অভিভাবক হিসেবে সাম্রাজ্য চালাবেন।
আমাদের হিসেবে তা ঠিক আছে। তার হিসেবে তা ঠিক নেই।
কি রকম?
সানজু যদি মৃত্যু ঘটিয়েও থাকেন, তা প্রমাণ করা কঠিন। প্রমাণ হলেও সম্রাট ইচিজো তা প্রকাশ হতে দেবেন না, দিলে প্রজাদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে। তারা ভাববে প্রাক্তন সম্রাট রেইঝেই-এর সঙ্গে চুক্তির বরখেলাপ ঘটাতেই মিচিনাগার পরামর্শে সম্রাট সানজুকে বিনা অপরাধে শাস্তি দিতে যাচ্ছেন। আরো কোনো বিবেচনা থাকতে পারে, যা আমার জানা নেই।
ইমন ইচ্ছা করেই বললেন না যে, লোকজন ভাববে তোমাকে দিয়ে মিচিনাগা এসব করাচ্ছেন, তোমার ভাবমূর্তি এরই মধ্যে খারাপ হয়ে গেছে।
ইঝোমি বললেন, কে কী ভাবলো তার জন্য একটি বিচার হবে না, এ কেমন কথা। মিচিনাগার কাছে আমি কৃতজ্ঞ, অনেক করেছেন তিনি।
এখন তার জন্য এটুকু ত্যাগ স্বীকার করো।
আমার পক্ষে হজম করা কঠিন। কী করে সম্ভব?
কথা না শুনলে তিনি তোমার ক্ষতি করতে পারেন। তোমাকে বিয়ে দেয়ার সুদূর পরিকল্পনাটা ছিল তার।
পরে আমারও তা মনে হয়েছে। সামুরাই সেনা অধিনায়ক আমাকে সহযোগিতা করবেন না?
প্রভু মহামন্ত্রী না চাইলে তার পক্ষে কীভাবে সম্ভব?
আমাকে ভাবতে দিন।
বেশ ভাবো। তবে আমার কথাটা মনে রেখো। তুমি মানসিক সমস্যায় আছো, আমি আছি অসম্ভব চাপে। তাই এ নিয়ে কথা বলতে আসতে হলো।
তা বুঝতেই পারছি।
তাকাকু, বলছিল, তোমার রাজনীতিতে জড়ানোটা তার একেবারেই পছন্দ না।
আমাকেও সে বলেছে।
সে তোমার ভালোটা চায়।
আমাদের সকলেরই ভালোটা চায় সে।
তুমি তার সঙ্গে চাইলে পরামর্শ করতে পার।
সে আপনার পক্ষেই কথা বলবে।
সাক্ষাৎকালে ইঝোমিকে অবাক করে দিয়ে মুরাসাকি বললেন, আমি তোমার পক্ষে আছি। অন্যায়ের প্রতিবাদ হবে না, অপরাধের বিচার হবে না, তা হবে না। আর কিছু না হোক, তদন্ত হোক। স্বাভাবিক মৃত্যু হলে তোমার মনে আর সন্দেহ থাকবে না। অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে তার বিচারের জন্য আন্দোলনে যাব আমরা।
তুমি আমার রাজনৈতিক তৎপরতা পছন্দ করতে না। এখন তোমার কথা শুনে আমি অবাক হচ্ছি।
এটা রাজনীতি না, ন্যায়ের পক্ষে সংগ্রাম, ভালোবাসার প্রতি দায়বদ্ধতা। আমি এজন্যই তোমার পক্ষ নিয়েছি। কীভাবে অগ্রসর হতে চাও তুমি?
সেনাদের বিক্ষুব্ধ করে।
না, না। তা করতে যাবে না। এখন তদন্ত করাতে হবে কৌশলে। (একটু চিন্তা করে) আচ্ছা, আমি দেখছি ব্যাপারটা।
কী করবে তুমি?
পরে জানবে।
সম্রাজ্ঞীর কাছ থেকে দুজনেরই ডাক এলো। ইঝোমি অর্থপূর্ণভাবে মুরাসাকির দিকে তাকালেন। কারণ তিনি আর এখন শোশির লেডি-ইন-ওয়েটিং নন।
মুরাসাকি হেসে দিয়ে বললেন, চলো।
সাক্ষাৎকালে সম্রাজ্ঞী দু’জনকে বললেন, বসো। ইঝোমিকে বললেন, তোমার বিয়ে হয়েছে শুনে খুশি হয়েছি। তাকাকু বিয়ে করলে আরো খুশি হতাম। নিশ্চয়ই এ ব্যাপারে তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি আছে। এখন বলো সাহিত্য চর্চা কেমন হচ্ছে?
ইঝোমি বললেন, আমার হচ্ছে না, তবে এখানে একটি কবিতা সংকলন হতে যাচ্ছে।
এ সংবাদ আমি জানি। সম্রাটের মধ্যে এ নিয়ে আগ্রহের কমতি নেই। তাকাকুর কী অবস্থা?
ইঝোমি বললেন, কবি, সভাকবি কিন্তু এবং সেই শোনাগন তাকাকুর কবিতা সংকলনে না দেয়ার পক্ষপাতী। সম্রাট এবং প্রধানমন্ত্রী বলেছেন বাদ যাবে না, থাকবে।
তাও আমি জানি। সম্রাটকে বলতে শুনেছি।
আপনি সবই জানেন দেখছি।
তাকাকু কিছু বলছো না কেন? আমি তোমাকে পূর্বে একদিন বলেছিলাম, তুমি তোমার নিজেকে আড়াল করবার জন্য সর্বদা চেষ্টা করো, বোধ হয় এ জন্যই আমি অন্যদের চেয়ে তোমার সঙ্গে বেশি ঘনিষ্ঠ হতে চেয়েছি। আজও তাই চাইছি।
মুরাসাকি হেসে দিয়ে বললেন, আপনি তো আমার ঘনিষ্ঠই। আমি ভেবে দেখেছি আমি সকলের চেয়ে আপনার কথা বেশি ভাবি।
শোশি বললেন, মানুষ ঘনিষ্ঠজনদের কথাই বেশি ভাবে।
ইঝোমির ধারণাটা ভিন্ন। তার চিন্তায় মানুষ শত্রুর কথাই বেশি ভাবে, এখন যেমন তিনি সার্বক্ষণিকই সানজুর কথা ভাবছেন।
মুরাসাকি বিশ্বাস করেন, যারা খারাপ প্রকৃতির মানুষ, ক্ষতিগ্রস্ত এবং সমাজের অপ্রয়োজনীয় বলে বিবেচিত এরাও তার প্রতি তিরস্কারের মনোভাব নিয়ে তাকায় না। তার সহজ কারণ বিনয়, নম্রতা এবং প্রশান্ত স্বভাব।
তখনই সম্রাজ্ঞী বলেন, এত লেডি-ইন-ওয়েটিং থাকতে সেই শোনাগন কেন তোমাকে লক্ষ্যবস্তু করেছে?
আমি জানি না মহামান্যা।
আমি জানি। তোমার শান্ত স্বভাব এবং ভদ্রতাকে সে দুর্বলতা ভেবে নিয়েছে। আমার অন্য কাউকে সে লক্ষ্যবস্তু করবে না বা করতে পারে না। কিন্তু আমাকে নাজেহাল করার জন্য কাউকে তো লক্ষ্যবস্তু করতে হবে। হবে না?
ইঝোমি জানেন, কারণটা তা নয়, পেশাগত ঈর্ষা। তার কেন্দ্রে আছে লেখক হিসেবে পরস্পরের সুখ্যাতি। সেই শোনাগন মুরাসাকিকে (তাকাকু) সহ্যই করতে পারেন না। খ্যাতির প্রতিদ্বন্দ্বিতা তাকে আপোষহীন ও ক্রুদ্ধ করে তুলেছে।
পরে সম্রাজ্ঞী বললেন, তাকে আমি সাম্রাজ্য ছাড়া করবো।
মুরাসাকি হেসে দিয়ে বললেন, আমি ক্ষমা করে দিয়েছি, আপনিও দিন।
তোমার ক্ষমা তুমি করেছ, ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ সে আমার বিরুদ্ধেও করেছে। তুমি কি জানো, সে সম্রাটের মাতাকে সম্রাটের কাছে পাঠিয়েছে? সম্রাটের মাতা বিদগ্ধ রমণী, প্রভাবশালী ছড়ি ঘুরানেওয়ালি, সম্রাট-সম্রাজ্ঞীকে দাবিয়ে রাখতে চান। ক্ষমতায় অন্ধ তিনি। আমি এবার তাকেও কোনো ছাড় দেব না।
বিরাশি.
মুরাসাকি গেছেন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে। প্রধানমন্ত্রী মিচিনাগা দাপ্তরিক কাজে ব্যস্ত। অভ্যর্থনা কক্ষে মুরাসাকিকে বসাতে তার লোকজনদের বললেন, মুরাসাকি দেখলেন এখানকার লোকজন তাকে বেশ খাতিরযতœ এবং সম্মান করছেন। কেউ কেউ বললেনও তার কারণ। এরা তার ‘গেঞ্জি মনোগাতারি’ পড়েছেন। অভিভূত সবাই। একজন বললেন, এত এত কবিতা এতে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। এরা সবাই তার মুখে গেঞ্জি সম্পর্কিত কথাবার্তা শুনতে থাকলেন।
মিচিনাগা সাম্রাজ্যের কাজে নয়, ব্যক্তিগত কাজে দরকষাকষি নিয়ে ব্যস্ত। এতদিন যে বিষয়টি গোপন রাখা হয়েছিল আজ প্রকাশ্য আলোচনায় তা এলো। ক্রাউন প্রিন্স সানজুর সঙ্গে তার দ্বিতীয় কন্যা কেনশির বিয়ে। সানজুর স্ত্রী রয়েছে। বয়সের তুলনায় কেনশি অনেক ছোট। তাই সানজুকে বাগে আনা যাচ্ছিল না। সানজুর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেয়ার এটিও একটি কারণ।
লোকজনদের বিদায় করে মিচিনাগা মুরাসাকিকে ডাকালেন এবং বিস্ময়সহকারে বললেন, তুমি এখানে? সংবাদ দিলে আমিই যেতাম।
মুরাসাকি মজা করে বললেন, কেন? প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর তো সাম্রাজ্যের সকলের জন্যই উন্মুক্ত, আমার আসতে বারণ আছে নাকি?
না তা নেই। তুমি এলে আমার সম্মান বাড়ে। এখন বলো কী খেদমত করতে পারি।
আপনাকে খুব ব্যস্ত এবং চিন্তিত মনে হচ্ছে, ভাবছি কিছু বলা ঠিক হবে কিনা।
না, না, তোমার জন্য সবকিছু উন্মুক্ত। সকল ব্যস্ততা সকল চিন্তা মুক্ত আমি এখন তোমাকে দেখে। বলো অনায়াসেই বলো।
বলছিলাম ইঝোমির কথা। অনেক করেছেন আপনি তার জন্য। একটি ব্যাপারে কষ্ট পাচ্ছে সে। অতসুমিচির মৃত্যুর ওপর একটি তদন্ত করিয়ে দিন অনুগ্রহ করে। তদন্ত হলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়।
তোমাকে তো অনেক কথাই বলি তাকাকু, একটি পারিবারিক কথা বলতে পারছি না। পরে তুমি জানবে।
তুমি এসেছ আমি তা মাথায় রাখলাম। অন্য প্রসঙ্গে বললেন, তুমি শোনাগনের জন্য সুপারিশ করেছিলে, আর সে তোমার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।
তা তো নতুন নয়, মাননীয় মন্ত্রী। আমি ক্ষমা করে দিয়েছি। আপনিও ক্ষমা করে দিন।
তুমি আমাকে হাসালে তাকাকু। তোমার এই সুপারিশ মানা কঠিন। তোমার সম্পর্কে সম্রাট খুবই উচ্চ ধারণা পোষণ করেন। আমি চাইলে সম্রাট তোমার জন্য সাহিত্যের একটি সর্বোচ্চ পদ সৃষ্টি করে সে পদে তোমাকে নিয়োগ দেবেন। বলবো তোমার কথা?
এবারও মুরাসাকি হাসলেন। বললেন, পদপদবী মন্ত্রী আমলাদের জন্য। লেখকদের জন্য কেন রাজকীয় পদ থাকবে। আমি মনে করি এতে অন্য কবি-লেখকদের অমর্যাদা করা হবে। আমি যেভাবে আছি ভালো আছি।
আমি ভেবেছিলাম সভাকবি কিন্তুর ওপর একটা পদ সৃষ্টি করতে। ওই পদের অধিকারী শুধু তিনিই হবেন, যিনি কবিতা এবং মনোগাতারি উভয় ক্ষেত্রেই কিংবদন্তি তুল্য।
আমি কি সে পর্যায়ের?
আমার চোখে তো তাই।
আপনার চোখে আমি পক্ষপাতিত্ব দেখছি। যাক এসব কথা। আপনি অনুগ্রহ করে তা করবেন না। যদি আমার জন্য কিছু করতে চান, তাহলে ইঝোমি এবং শোনাগনের জন্য কিছু করুন।
এখন আসি? ভালো থাকুন।
তুমি কিছুক্ষণ বসো। কী অদ্ভুত ব্যাপার জানো? আমি তুমি আসার আগে মানসিকভাবে খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলাম, তোমাকে দেখে সব ভার লাঘব হয়ে গেছে। তোমার মধ্যে কী আছে জানি না।
কিছুক্ষণ বসে থেকে মুরাসাকি বিদায় নিলেন। যাবার কালে একটা মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে গেলেন।
তা দেখে মিচিনাগার মনে আবেগ এসে ভর করলো।
তিনি সত্যিই কাঁদলেন। ভালোবাসার পবিত্র কান্না। ভাবলেন, মুরাসাকির কথা তিনি রাখবেন। জগতের নির্লোভ নির্মোহ এই নারী পবিত্র ভালোবাসার যে পথ দেখিয়েছেন তা কাম-ক্রোধের বহু ঊর্ধ্বে। জীবনের এ অংশটায় ভালোবাসার পবিত্র ছায়া ছায়াবিস্তার করে থাক।
মিচিনাগা কাম্পাকুর পদটা আনুষ্ঠানিক ভাবে গ্রহণ করেননি। তা হলে প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন না, তা ছাড়তে হবে। যিনি সম্রাটকে উপদেশ দেবেন তিনি সম্রাটের আদেশ মানতে পারেন না, তাই পদটা গ্রহণ ছাড়াই সে মর্যাদা ভোগ করেন, সম্রাটকে পরামর্শ-উপদেশ দেন। তার কথা সম্রাট ফেলতে পারেন না।
এবারও ব্যতিক্রম হলো না। সম্রাট নানা যুক্তির কথা বললেন বটে, কিন্তু তার পরামর্শ মতে বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়ে দিলেন।
প্রাক্তন সম্রাট রেইঝেই তাতে খুশি হলেন। বহু দিন পর সম্রাটের দরবারে এসে তাকে ধন্যবাদ দিয়ে গেলেন।
ক্রাউন প্রিন্স সানজু সম্ভাব্য বিপদ শঙ্কায় অস্থির হয়ে উঠলেন। স্ত্রী এবং শ্যালক লেফটেন্যান্ট জেনারেলের সঙ্গে কথা বললেন। তাদেরকে জানালেন, যিনি এ ব্যাপারে তদবির করতে পারতেন সম্রাটের কাছে, তিনি (রেইঝেই) নিজেই ক্ষুব্ধ। এখন উপায় একটাই প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব মেনে তার কন্যাকে বিয়ে করে ফেলা।
তাতে প্রিন্সেস আপত্তি করলেন। বললেন, চাই না সম্রাজ্ঞী হতে। আমার বোনের কষ্ট আমি দেখেছি।
জেনারেল তার বোনকে বোঝালেন। অবশেষে তাকে নানা শর্তসাপেক্ষে রাজি করানো গেল।
তদন্ত হচ্ছে শুনে ইমন অবাকই হলেন, বেশি অবাক হলেন ইঝোমি। ছুটে গেলেন মুরাসাকির দপ্তরে।
তাকে তার দপ্তরে পাওয়া গেল না। তিনি চলে গেছেন বাবার ভিটায়, টেরামাচি লেনে। এখানে কত দিন থাকবেন তিনি নিজেও জানেন না। ভারতবর্ষের এক বাঙালি লেখকের কথাই সত্য ‘বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না, দূরেও ঢেলে দেয়।’ ক্রমশ...
বৃহস্পতিবার, ১৯ মে ২০২২ , ০৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ১৭ শাওয়াল ১৪৪৩
আবুল কাসেম
(পূর্ব প্রকাশের পর)
একাশি.
ইমন ইঝোমির বাড়িতে গেছেন। দেখে ইঝোমির মধ্যে স্থিতিশীলতা এসেছে বলে মনে হল। গৃহিণীর মনোভাবও জন্মেছে। স্বামী সেত্তু প্রদেশে থাকেন। কিয়োটোতে ইঝোমির অবস্থানে কোনো সমস্যা নেই। মিচিনাগার দেয়া বাড়িতে বেশ আছেন। স্বামী সামরিককর্মকর্তা, ছুটি নিয়ে মাঝে মধ্যে আসেন।
এভাবে চলতে পারতো। কিন্তু প্রিন্স অতসুমিচির অপমৃত্যু তাকে আবার ভাবিয়ে তোলে। কবির জেদি মন যেন বিদ্রোহ করে ওঠে।
মিচিনাগা তার গোয়েন্দা সূত্রে আবারো এই তৎপরতার খবর জানতে পেরে এবারে ইমনকে পাঠিয়েছেন। ইমন কথা শুরু করলেন সেই শোনাগনের প্রসঙ্গ দিয়ে। বললেন, শোনাগনের কা- দেখো, প্রভু মহামন্ত্রীর সঙ্গে টেক্কা দিতে চায়। আমি বলি, তোমার কী প্রয়োজন সম্রাটকে এত কিছু বলা।
সভাকবি কিন্তু তাকে ব্যবহার করছেন।
সভাকবি কিন্তু প্রবীন মানুষ। তারও উচিত নিজের মর্যাদা রক্ষা করে চলা। তাকাকু, তার অমুলক প্রশ্নের অত্যন্ত রূঢ়ভাবে জবাব দিয়েছে বলে তাকাকুকে অকবির পর্যায়ে ফেলে দিতে হবে? তাকাকু বড় কথাশিল্পীই নয়, অনেক বড় কবি। তা বুঝবার ক্ষমতা কিন্তুর আছে? আমি তার ওপর বিরক্ত।
তুমি তো জানোই না প্রভু মহামন্ত্রী খুব খেপেছেন। তার ক্ষতি করতে পারেন।
কাঝান আমলের কবিতা সংকলনে নিজের পনেরটি কবিতা স্থান করে দিয়েছেন।
‘শুধু ওয়াকাশুই’ সংকলনে একজনেরই পনেরটি কবিতা ভাবা যায়?
এটি তো তারই সম্পাদিত।
সম্রাট কাঝান কম সময় সম্রাট ছিলেন। মাত্র দুই বছর। কিন্তু তাকে খ্যাতির লোভ দেখিয়ে তড়িঘড়ি করে তা করিয়েছেন।
মাত্র দুই বৎসর শাসনের পর তাকে জোর করে সিংহাসন থেকে নামিয়ে দেয়া হল। এই সুযোগটা কিন্তু নিয়েছেন।
তিনি তো একজন জাঁদরেল আমলা। সুযোগ নেবেনই।
তবে হাতের লেখা চমৎকার।
ক্যালিগ্রাফি জানেন বলেই তার পক্ষে সংকলন করা সম্ভব হচ্ছে।
মানুষের ভালো গুণগুলো খারাপ কাজের নিচে চাপা পড়ে যায়।
আরো অনেকক্ষণ এরা কিন্তুকে নিয়ে কথা বললেন। পরে ইমন বললেন, ইঝোমি, তোমাকে একটা কথা বলার ছিল।
ভূমিকা শুনেই ইঝোমি ভাবলেন ইমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা বলবেন। তাই আগ্রহ এবং শঙ্কা নিয়ে ইমনের দিকে তাকালেন। ইমন বললেন, যে চলে গেছে তাকে নিয়ে আর কেন তৎপর হয়ে পড়া।
তাকে নয়, তার মৃত্যুকে নিয়ে তৎপর আমি। তদন্ত আর বিচার চাইছি।
প্রভু মহামন্ত্রী আমাকে পাঠিয়েছেন। তুমি এসব এখন বাদ দাও।
তার সমস্যা কোথায়? তিনি তো তা হলে লাভবানই হবেন। সানজু সম্রাট না হলে তার ক্রাউন প্রিন্স সম্রাট হবেন। তিনি শিশু সম্রাটের অভিভাবক হিসেবে সাম্রাজ্য চালাবেন।
আমাদের হিসেবে তা ঠিক আছে। তার হিসেবে তা ঠিক নেই।
কি রকম?
সানজু যদি মৃত্যু ঘটিয়েও থাকেন, তা প্রমাণ করা কঠিন। প্রমাণ হলেও সম্রাট ইচিজো তা প্রকাশ হতে দেবেন না, দিলে প্রজাদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে। তারা ভাববে প্রাক্তন সম্রাট রেইঝেই-এর সঙ্গে চুক্তির বরখেলাপ ঘটাতেই মিচিনাগার পরামর্শে সম্রাট সানজুকে বিনা অপরাধে শাস্তি দিতে যাচ্ছেন। আরো কোনো বিবেচনা থাকতে পারে, যা আমার জানা নেই।
ইমন ইচ্ছা করেই বললেন না যে, লোকজন ভাববে তোমাকে দিয়ে মিচিনাগা এসব করাচ্ছেন, তোমার ভাবমূর্তি এরই মধ্যে খারাপ হয়ে গেছে।
ইঝোমি বললেন, কে কী ভাবলো তার জন্য একটি বিচার হবে না, এ কেমন কথা। মিচিনাগার কাছে আমি কৃতজ্ঞ, অনেক করেছেন তিনি।
এখন তার জন্য এটুকু ত্যাগ স্বীকার করো।
আমার পক্ষে হজম করা কঠিন। কী করে সম্ভব?
কথা না শুনলে তিনি তোমার ক্ষতি করতে পারেন। তোমাকে বিয়ে দেয়ার সুদূর পরিকল্পনাটা ছিল তার।
পরে আমারও তা মনে হয়েছে। সামুরাই সেনা অধিনায়ক আমাকে সহযোগিতা করবেন না?
প্রভু মহামন্ত্রী না চাইলে তার পক্ষে কীভাবে সম্ভব?
আমাকে ভাবতে দিন।
বেশ ভাবো। তবে আমার কথাটা মনে রেখো। তুমি মানসিক সমস্যায় আছো, আমি আছি অসম্ভব চাপে। তাই এ নিয়ে কথা বলতে আসতে হলো।
তা বুঝতেই পারছি।
তাকাকু, বলছিল, তোমার রাজনীতিতে জড়ানোটা তার একেবারেই পছন্দ না।
আমাকেও সে বলেছে।
সে তোমার ভালোটা চায়।
আমাদের সকলেরই ভালোটা চায় সে।
তুমি তার সঙ্গে চাইলে পরামর্শ করতে পার।
সে আপনার পক্ষেই কথা বলবে।
সাক্ষাৎকালে ইঝোমিকে অবাক করে দিয়ে মুরাসাকি বললেন, আমি তোমার পক্ষে আছি। অন্যায়ের প্রতিবাদ হবে না, অপরাধের বিচার হবে না, তা হবে না। আর কিছু না হোক, তদন্ত হোক। স্বাভাবিক মৃত্যু হলে তোমার মনে আর সন্দেহ থাকবে না। অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে তার বিচারের জন্য আন্দোলনে যাব আমরা।
তুমি আমার রাজনৈতিক তৎপরতা পছন্দ করতে না। এখন তোমার কথা শুনে আমি অবাক হচ্ছি।
এটা রাজনীতি না, ন্যায়ের পক্ষে সংগ্রাম, ভালোবাসার প্রতি দায়বদ্ধতা। আমি এজন্যই তোমার পক্ষ নিয়েছি। কীভাবে অগ্রসর হতে চাও তুমি?
সেনাদের বিক্ষুব্ধ করে।
না, না। তা করতে যাবে না। এখন তদন্ত করাতে হবে কৌশলে। (একটু চিন্তা করে) আচ্ছা, আমি দেখছি ব্যাপারটা।
কী করবে তুমি?
পরে জানবে।
সম্রাজ্ঞীর কাছ থেকে দুজনেরই ডাক এলো। ইঝোমি অর্থপূর্ণভাবে মুরাসাকির দিকে তাকালেন। কারণ তিনি আর এখন শোশির লেডি-ইন-ওয়েটিং নন।
মুরাসাকি হেসে দিয়ে বললেন, চলো।
সাক্ষাৎকালে সম্রাজ্ঞী দু’জনকে বললেন, বসো। ইঝোমিকে বললেন, তোমার বিয়ে হয়েছে শুনে খুশি হয়েছি। তাকাকু বিয়ে করলে আরো খুশি হতাম। নিশ্চয়ই এ ব্যাপারে তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি আছে। এখন বলো সাহিত্য চর্চা কেমন হচ্ছে?
ইঝোমি বললেন, আমার হচ্ছে না, তবে এখানে একটি কবিতা সংকলন হতে যাচ্ছে।
এ সংবাদ আমি জানি। সম্রাটের মধ্যে এ নিয়ে আগ্রহের কমতি নেই। তাকাকুর কী অবস্থা?
ইঝোমি বললেন, কবি, সভাকবি কিন্তু এবং সেই শোনাগন তাকাকুর কবিতা সংকলনে না দেয়ার পক্ষপাতী। সম্রাট এবং প্রধানমন্ত্রী বলেছেন বাদ যাবে না, থাকবে।
তাও আমি জানি। সম্রাটকে বলতে শুনেছি।
আপনি সবই জানেন দেখছি।
তাকাকু কিছু বলছো না কেন? আমি তোমাকে পূর্বে একদিন বলেছিলাম, তুমি তোমার নিজেকে আড়াল করবার জন্য সর্বদা চেষ্টা করো, বোধ হয় এ জন্যই আমি অন্যদের চেয়ে তোমার সঙ্গে বেশি ঘনিষ্ঠ হতে চেয়েছি। আজও তাই চাইছি।
মুরাসাকি হেসে দিয়ে বললেন, আপনি তো আমার ঘনিষ্ঠই। আমি ভেবে দেখেছি আমি সকলের চেয়ে আপনার কথা বেশি ভাবি।
শোশি বললেন, মানুষ ঘনিষ্ঠজনদের কথাই বেশি ভাবে।
ইঝোমির ধারণাটা ভিন্ন। তার চিন্তায় মানুষ শত্রুর কথাই বেশি ভাবে, এখন যেমন তিনি সার্বক্ষণিকই সানজুর কথা ভাবছেন।
মুরাসাকি বিশ্বাস করেন, যারা খারাপ প্রকৃতির মানুষ, ক্ষতিগ্রস্ত এবং সমাজের অপ্রয়োজনীয় বলে বিবেচিত এরাও তার প্রতি তিরস্কারের মনোভাব নিয়ে তাকায় না। তার সহজ কারণ বিনয়, নম্রতা এবং প্রশান্ত স্বভাব।
তখনই সম্রাজ্ঞী বলেন, এত লেডি-ইন-ওয়েটিং থাকতে সেই শোনাগন কেন তোমাকে লক্ষ্যবস্তু করেছে?
আমি জানি না মহামান্যা।
আমি জানি। তোমার শান্ত স্বভাব এবং ভদ্রতাকে সে দুর্বলতা ভেবে নিয়েছে। আমার অন্য কাউকে সে লক্ষ্যবস্তু করবে না বা করতে পারে না। কিন্তু আমাকে নাজেহাল করার জন্য কাউকে তো লক্ষ্যবস্তু করতে হবে। হবে না?
ইঝোমি জানেন, কারণটা তা নয়, পেশাগত ঈর্ষা। তার কেন্দ্রে আছে লেখক হিসেবে পরস্পরের সুখ্যাতি। সেই শোনাগন মুরাসাকিকে (তাকাকু) সহ্যই করতে পারেন না। খ্যাতির প্রতিদ্বন্দ্বিতা তাকে আপোষহীন ও ক্রুদ্ধ করে তুলেছে।
পরে সম্রাজ্ঞী বললেন, তাকে আমি সাম্রাজ্য ছাড়া করবো।
মুরাসাকি হেসে দিয়ে বললেন, আমি ক্ষমা করে দিয়েছি, আপনিও দিন।
তোমার ক্ষমা তুমি করেছ, ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ সে আমার বিরুদ্ধেও করেছে। তুমি কি জানো, সে সম্রাটের মাতাকে সম্রাটের কাছে পাঠিয়েছে? সম্রাটের মাতা বিদগ্ধ রমণী, প্রভাবশালী ছড়ি ঘুরানেওয়ালি, সম্রাট-সম্রাজ্ঞীকে দাবিয়ে রাখতে চান। ক্ষমতায় অন্ধ তিনি। আমি এবার তাকেও কোনো ছাড় দেব না।
বিরাশি.
মুরাসাকি গেছেন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে। প্রধানমন্ত্রী মিচিনাগা দাপ্তরিক কাজে ব্যস্ত। অভ্যর্থনা কক্ষে মুরাসাকিকে বসাতে তার লোকজনদের বললেন, মুরাসাকি দেখলেন এখানকার লোকজন তাকে বেশ খাতিরযতœ এবং সম্মান করছেন। কেউ কেউ বললেনও তার কারণ। এরা তার ‘গেঞ্জি মনোগাতারি’ পড়েছেন। অভিভূত সবাই। একজন বললেন, এত এত কবিতা এতে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। এরা সবাই তার মুখে গেঞ্জি সম্পর্কিত কথাবার্তা শুনতে থাকলেন।
মিচিনাগা সাম্রাজ্যের কাজে নয়, ব্যক্তিগত কাজে দরকষাকষি নিয়ে ব্যস্ত। এতদিন যে বিষয়টি গোপন রাখা হয়েছিল আজ প্রকাশ্য আলোচনায় তা এলো। ক্রাউন প্রিন্স সানজুর সঙ্গে তার দ্বিতীয় কন্যা কেনশির বিয়ে। সানজুর স্ত্রী রয়েছে। বয়সের তুলনায় কেনশি অনেক ছোট। তাই সানজুকে বাগে আনা যাচ্ছিল না। সানজুর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেয়ার এটিও একটি কারণ।
লোকজনদের বিদায় করে মিচিনাগা মুরাসাকিকে ডাকালেন এবং বিস্ময়সহকারে বললেন, তুমি এখানে? সংবাদ দিলে আমিই যেতাম।
মুরাসাকি মজা করে বললেন, কেন? প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর তো সাম্রাজ্যের সকলের জন্যই উন্মুক্ত, আমার আসতে বারণ আছে নাকি?
না তা নেই। তুমি এলে আমার সম্মান বাড়ে। এখন বলো কী খেদমত করতে পারি।
আপনাকে খুব ব্যস্ত এবং চিন্তিত মনে হচ্ছে, ভাবছি কিছু বলা ঠিক হবে কিনা।
না, না, তোমার জন্য সবকিছু উন্মুক্ত। সকল ব্যস্ততা সকল চিন্তা মুক্ত আমি এখন তোমাকে দেখে। বলো অনায়াসেই বলো।
বলছিলাম ইঝোমির কথা। অনেক করেছেন আপনি তার জন্য। একটি ব্যাপারে কষ্ট পাচ্ছে সে। অতসুমিচির মৃত্যুর ওপর একটি তদন্ত করিয়ে দিন অনুগ্রহ করে। তদন্ত হলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়।
তোমাকে তো অনেক কথাই বলি তাকাকু, একটি পারিবারিক কথা বলতে পারছি না। পরে তুমি জানবে।
তুমি এসেছ আমি তা মাথায় রাখলাম। অন্য প্রসঙ্গে বললেন, তুমি শোনাগনের জন্য সুপারিশ করেছিলে, আর সে তোমার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।
তা তো নতুন নয়, মাননীয় মন্ত্রী। আমি ক্ষমা করে দিয়েছি। আপনিও ক্ষমা করে দিন।
তুমি আমাকে হাসালে তাকাকু। তোমার এই সুপারিশ মানা কঠিন। তোমার সম্পর্কে সম্রাট খুবই উচ্চ ধারণা পোষণ করেন। আমি চাইলে সম্রাট তোমার জন্য সাহিত্যের একটি সর্বোচ্চ পদ সৃষ্টি করে সে পদে তোমাকে নিয়োগ দেবেন। বলবো তোমার কথা?
এবারও মুরাসাকি হাসলেন। বললেন, পদপদবী মন্ত্রী আমলাদের জন্য। লেখকদের জন্য কেন রাজকীয় পদ থাকবে। আমি মনে করি এতে অন্য কবি-লেখকদের অমর্যাদা করা হবে। আমি যেভাবে আছি ভালো আছি।
আমি ভেবেছিলাম সভাকবি কিন্তুর ওপর একটা পদ সৃষ্টি করতে। ওই পদের অধিকারী শুধু তিনিই হবেন, যিনি কবিতা এবং মনোগাতারি উভয় ক্ষেত্রেই কিংবদন্তি তুল্য।
আমি কি সে পর্যায়ের?
আমার চোখে তো তাই।
আপনার চোখে আমি পক্ষপাতিত্ব দেখছি। যাক এসব কথা। আপনি অনুগ্রহ করে তা করবেন না। যদি আমার জন্য কিছু করতে চান, তাহলে ইঝোমি এবং শোনাগনের জন্য কিছু করুন।
এখন আসি? ভালো থাকুন।
তুমি কিছুক্ষণ বসো। কী অদ্ভুত ব্যাপার জানো? আমি তুমি আসার আগে মানসিকভাবে খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলাম, তোমাকে দেখে সব ভার লাঘব হয়ে গেছে। তোমার মধ্যে কী আছে জানি না।
কিছুক্ষণ বসে থেকে মুরাসাকি বিদায় নিলেন। যাবার কালে একটা মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে গেলেন।
তা দেখে মিচিনাগার মনে আবেগ এসে ভর করলো।
তিনি সত্যিই কাঁদলেন। ভালোবাসার পবিত্র কান্না। ভাবলেন, মুরাসাকির কথা তিনি রাখবেন। জগতের নির্লোভ নির্মোহ এই নারী পবিত্র ভালোবাসার যে পথ দেখিয়েছেন তা কাম-ক্রোধের বহু ঊর্ধ্বে। জীবনের এ অংশটায় ভালোবাসার পবিত্র ছায়া ছায়াবিস্তার করে থাক।
মিচিনাগা কাম্পাকুর পদটা আনুষ্ঠানিক ভাবে গ্রহণ করেননি। তা হলে প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন না, তা ছাড়তে হবে। যিনি সম্রাটকে উপদেশ দেবেন তিনি সম্রাটের আদেশ মানতে পারেন না, তাই পদটা গ্রহণ ছাড়াই সে মর্যাদা ভোগ করেন, সম্রাটকে পরামর্শ-উপদেশ দেন। তার কথা সম্রাট ফেলতে পারেন না।
এবারও ব্যতিক্রম হলো না। সম্রাট নানা যুক্তির কথা বললেন বটে, কিন্তু তার পরামর্শ মতে বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়ে দিলেন।
প্রাক্তন সম্রাট রেইঝেই তাতে খুশি হলেন। বহু দিন পর সম্রাটের দরবারে এসে তাকে ধন্যবাদ দিয়ে গেলেন।
ক্রাউন প্রিন্স সানজু সম্ভাব্য বিপদ শঙ্কায় অস্থির হয়ে উঠলেন। স্ত্রী এবং শ্যালক লেফটেন্যান্ট জেনারেলের সঙ্গে কথা বললেন। তাদেরকে জানালেন, যিনি এ ব্যাপারে তদবির করতে পারতেন সম্রাটের কাছে, তিনি (রেইঝেই) নিজেই ক্ষুব্ধ। এখন উপায় একটাই প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব মেনে তার কন্যাকে বিয়ে করে ফেলা।
তাতে প্রিন্সেস আপত্তি করলেন। বললেন, চাই না সম্রাজ্ঞী হতে। আমার বোনের কষ্ট আমি দেখেছি।
জেনারেল তার বোনকে বোঝালেন। অবশেষে তাকে নানা শর্তসাপেক্ষে রাজি করানো গেল।
তদন্ত হচ্ছে শুনে ইমন অবাকই হলেন, বেশি অবাক হলেন ইঝোমি। ছুটে গেলেন মুরাসাকির দপ্তরে।
তাকে তার দপ্তরে পাওয়া গেল না। তিনি চলে গেছেন বাবার ভিটায়, টেরামাচি লেনে। এখানে কত দিন থাকবেন তিনি নিজেও জানেন না। ভারতবর্ষের এক বাঙালি লেখকের কথাই সত্য ‘বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না, দূরেও ঢেলে দেয়।’ ক্রমশ...