শিল্পী মোস্তাফিজুল হকের একক চিত্রপ্রদর্শনী “ফিরে দেখা”

স্বাধীনতার রূপবন্ধন ও জ্ঞানলব্ধতা

সঞ্জয় দে রিপন

ভাবনা বা ধারণালব্ধতাই জ্ঞানের মৌলিক অস্তিত্বকে ধারণ করে থাকে- যা চিন্তার বিশ্লেষণের মাধ্যমে সৃষ্টির দিকে ধাবিত হয়। শিল্প চর্চাটা ঠিক তাই; একটা ধারণালব্ধ জ্ঞানকে বিস্তৃত কাঠামোর মধ্যে রেখে নির্র্দিষ্ট রূপাবয়ব নির্মাণ করা। এই রূপাবয়বটাই হচ্ছে জ্ঞানের ইমেজ যা ধারণালব্ধ বিশ্লেষণের ফলাফলকে সৃষ্টির মাত্রা দান করে থাকে। আর শিল্প সবসময়ই জ্ঞানের মৌলিক অস্তিত্বকে বিধৃত করে বলেই তা বিস্ময় বা সৃষ্টিআনন্দের ধারায় সুন্দরকেই প্রতিষ্ঠা করে থাকে; যা মানবিক এবং প্রকৃতিগত বাস্তব চিন্তাকে প্রভাবিত করে এবং আলোকনির্ভর সময়কে আলিঙ্গন করে। শিল্পী মোস্তাফিজুল হক জীবন ও জগৎভাবনার আদলে জ্ঞানের মৌলিক অস্তিত্বকে ধারণ করেছেন তাঁর শিল্প চিন্তায়। তিনি সমসাময়িক ভাবনাকে আলোকনির্ভর চিন্তা দ্বারা, ভাব এবং বোধকে যুক্তিসঙ্গত ও সংগ্রামী করে তুলেছেন। শিল্পী সবসময়ই স্বাধীনতার রূপবন্ধন নির্মাণ করবার প্রচেষ্টায় যুক্ত থাকেন- যা সত্যিই একজন প্রকৃত শিল্পস্বত্তার অস্তিত্বকে ধারণ করে। এক্ষেত্রে অস্তিত্ববাদ নিয়ে দু’একটি কথা বলা খুবই প্রাসঙ্গিক। শিল্পবস্তুর যদি অস্তিত্ব রক্ষা না করা যায় তবে তা শিল্প হবে কী করে? ব্যাপারটা ঠিক তাই একজন শিল্পীকে নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রথমত এবং শেষপর্যন্ত শিল্পবস্তুর অস্তিত্ব নিশ্চিত করতে হবে; তা না হলে সেই সৃষ্টির মধ্যে বোধ বা জ্ঞান এর সঞ্চারণ থাকবে না আর জ্ঞান, সৃষ্টিচিন্তা অথবা মানবিক ক্রিয়ার সঞ্চারণ যদি না ঘটে, তবে টলস্টয়ের মতে তা শিল্পে উত্তীর্ণ হবে না। মানবিক ক্রিয়ার সঞ্চারণ ঘটানো শিল্পীর সৃষ্টিচিন্তার স্বার্থকতার প্রথম শর্ত- যা অবশ্যই পূরণীয় সোপান। আর তাই শিল্পবস্তুর অস্তিত্বই শিল্পীর নির্মাণকে বাঁচিয়ে রাখে। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে জিব্রাইল মার্সেল সর্বপ্রথম “অস্তিত্ববাদ” শব্দটি ব্যবহার করেছেন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্রান্স এবং জার্মানির চিন্তাবিদদের মাধ্যমে অস্তিত্ববাদ মানুষ এবং শিল্পের চৌহদ্দিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে- যা সমকালীন শিল্পচিন্তাতেও প্রবলভাবে যৌক্তিক। এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ‘অস্তিত্ববাদ সারসত্তার পূর্বগামী’- যা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং এখানে জীবন ও বস্তুগত সারবস্তুর সার্বিক ধারণাটাই হচ্ছে সারসত্তা বা Essence। এই যে সারসত্তা বা Essence এখানেই প্রকৃতি ও জীবন, আবেগ ও ধর্ম, ভাববোধ ও আবেগ অথবা সুন্দর বা মানবিকতা যুক্ত থাকে; তাইতো শিল্পী পাবলো পিকাসো বা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা সোমনাথ হোর সবাই সারসত্তার দিকে ছুটেছিলেন এবং রূপের মধ্যে অরূপের সন্ধান করেছিলেন। সকল শিল্পীসত্তাই অস্তিত্বের সনদ নিয়ে চিন্তার বিন্যাসকে ধারণ। শিল্পী মোস্তাফিজুল হকের শিল্পকর্মগুলোতে শিল্পবস্তুর সারসত্তা রয়েছে।

ফরাসি দার্শনিক জ্যাঁ পল সার্ত্রে তাঁর ইবরহম Being And Nothingness গ্রন্থে (পৃষ্ঠা-৬৭০) বলেছেন “আমার স্বাধীনতা আমারই, সে পূর্ণ এবং অনন্ত। মৃত্যু আমার পরিকল্পনা রূপায়নের ক্ষেত্রে কোনো বাধা নয়। ‘আমি মরবার জন্য স্বাধীন নই’; বরং আমি একটি স্বাধীন মরণশীল সত্তা। শিল্পী সেই স্বাধীন সত্তাকেই রং রেখা এবং টেক্সচারের মাধ্যমে পূর্ণতা দান করেছেন। শিল্পী মোস্তাফিজুল হক তাঁর ঝঢ়ৎরহঃ সিরিজের চিত্রকর্মগুলোতে সহসা সবেগে ধাবনকেই স্বাধীনতার নিমিত্ত করে তুলেছেন। রং এর বিস্তৃত বিন্যাসে চিত্রপটকে বিষয়বস্তুর অনুরৈখিক যাত্রার দিকে ধাবিত করেছে; মনে হয় যেন এখনই ছুটে চলছে দৃশ্যমান সেই ঘোরাগুলো। কোথাও আংশিক আবার কোথাও প্রায় পূর্ণরূপাবয়বের উপস্থিতিতে মনের আনন্দবেগ যেন উৎসারিত হচ্ছে ক্যানভাস থেকে বাস্তব সদৃশ কল্পনাতে। ক্যানভাসগুলোতে সারসত্তা হচ্ছে ব্যারিকেডবিহীন আনন্দ মাত্রা এবং বোধের গতি যা শিল্পীর অনন্ত স্বাধীন চিন্তার বিস্তারকে অগ্রসর করেছে। শিল্পী জীবনের বাধা বিপত্তিকে গতিময় চিন্তা দ্বারা উতরিয়ে গেছেন এক মহাকর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে, তাই চিত্রকর্মে জড়ানো হয়েছে গতিময় প্রাণীর আকারিক ছন্দের মাত্রা। হয়তো শিল্পী নিজেও স্বাধীনতাভোগের প্রতি খুবই আগ্রহী বিধায় স্বাধীনস্বত্তাকে তিনি গুরুত্ব দেন এবং এই ব্যাপারটা তাঁর কাজে ব্যাপকভাবেই ক্রিয়াশীল।

স্প্রিন্ট-৮ চিত্রকর্মটি দেখে মনে হচ্ছে যেন চিত্রপট হয়ে উঠেছে ঘোড়ার গতিময় সা¤্রাজ্য; নিবেদনে রয়েছে গভীর ভাবাবেগ এবং লড়াইয়ের স্বাধীনতা। সম্মখস্থ ঘোড়ার শারীরিক গতির সাথে ভেতরকার সাহসকে সঞ্চারিত করেছে। এই সাহসটাই স্বাধীনতার রূপকে শিল্পরূপে পরিবর্তিত করেছে। শিল্পী গভীর এবং গাঢ় রং এর স্পেসগুলোতে অনেক সময় মধ্যবর্তী কালারটোন প্রয়োগ করেছেন আবার অনেকসময় তা পরিহার করেছেন বিষয়কে কেন্দ্রীভূত করার জন্য। শিল্পী এখানে টেক্সচারের ব্যবহার করেছেন আবার খুব সচেতনভাবেই টেক্সচারের অংশগুলো অপেক্ষাকৃত গাঢ় রং এর আবরণে আচ্ছাদিত যা স্পেসকে গভীর থেকে গভীরতর দৃশ্যমানতার দিকে নিয়ে যায়। এখানে চিত্রকর্মটি সারবস্তু দ্বারাই সার্বিকভাবে প্রভাবিত।

স্প্রিন্ট-৪ চিত্রকর্মটির ব্যাকস্পেস মার্ক রথকোর কালার ফিল্ড পেইন্টিংয়ের মতো বিভাজিত করা এবং সেটার উপরে শিল্পী স্বতন্ত্র ভাবনায় বাস্তব এবং স্বাধীন সত্তার গতিযুক্ত অবয়ব এঁকেছেন। চিত্রকর্মটি একটি বিশেষ কারণে ব্যতিক্রম আনন্দ

তৈরি করে; কারণটি বেশ রঙিন পরীক্ষকের মতো। ডানদিকে অন্ধকার আর বামদিকে লাল রংয়ের প্রচ্ছন্ন আত্মোপলব্ধি ঘোড়ার শারীরিক দেহসৌষ্ঠবকে সম্মুখস্ত গতিবেগের দিকে নিমন্ত্রিত করেছে। যেহেতু চিত্রাবয়টি ভাব এবং আবেগের গতিকে ধারণ করেছে তাই শিল্পী এখানে সফল; এই চিত্রটি দেখতে কোলাজ ইফেক্টের টেক্সচারের মতো। একধরনের সুরালোকিত এবং ছন্দোময়তা প্রাণীবয়বের অস্তিত্বকে নিরলসভাবেই স্বীকৃতি দিচ্ছে।

প্লেজার-৩ চিত্রকর্মটিতে প্রাণী অবয়বের অরূপ ব্যঞ্জণা দৃশ্যমান। গতিময় বাহুবল যেনো ছড়িয়ে দিচ্ছে এক অদ্ভুত অন্তপ্রায় গতিকে। চিত্রকর্মটি ডায়াগনাল রূপবিন্যাসে নির্মিত এবং এখানে নেতিয়ে পড়া অস্থিরতাকে হার মানিয়ে উজিয়ে উঠছে কেবলই এক মানবিক শক্তি। এখানে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে রূপের সামগ্রিক অবয়ব এবং একটি মৌলিক রূপাদর্শ এখানে তৈরি হয়েছে যা চিন্তার নান্দনিক দৃষ্টিকে গভীরে নিয়ে যাচ্ছে। রেখার ব্যবহার রং এর অবরহণের মধ্যে রয়েছে দেখে যেন মনে হচ্ছে চিন্তার রূপরৈখিকতাকে বিন্যস্ত করা। তীব্র ভাববোধের ক্ষেত্র বিন্যাস অন্তর্লীনের আনন্দকে বিধৃত করেছে; যেন এক কাঠামো থেকে নতুন কাঠামো নির্মাণের আনন্দ। শেষ অবধি শিল্পী মোস্তাফিজুল হকের এই কাজটি পরীক্ষামূলক চিত্রবিন্যাসের খোঁজে ভাষাগত আননন্দের গতিকে সমীকরণীক করে তুলেছে। মাই-প্লেজার সিরিজের চিত্রকর্মগুলোতে প্রাণময় চিন্তাকল্পের সংমিশ্রণ রয়েছে। যাপিত সময়ের আবেগ-অনুভূতি, জীর্ণতা এবং বাধাবিপত্তির স্বপ্রণোদিত প্রকাশকালকে নিবন্ধিত করে শিল্পী স্বতন্ত্র নির্বস্তুক কাঠামো তৈরি করেছেন।

“আমার আনন্দ” সিরিজের চিত্রকর্মগুলো শিল্পী বিংশ শতাব্দীর শেষপর্বে এঁকেছেন। এই সময়কালটাতেই শিল্পী অনেক বেশি অনুসন্ধিৎসু হয়ে উঠেছেন; এই সময়কালের কাজে প্রাণি অবয়ব, প্রকৃতির বিভিন্ন আনুষঙ্গিক উপাদান যেন বাস্তব সদৃশ কল্পনার মতো ক্যানভাসে উঠে আসে। শিল্পী অনেক ক্ষেত্রেই ভারি রং এর ব্যবহার আবার একই সাথে বিপরীত ঘরাণার রংঙের আলাপন চিত্রকলার মধ্যে ভাবের দর্শন তথা চিন্তার ভাষাকে আলোড়িত করে আর বয়কট করেছে নিরানন্দের অন্ধকারকে।

রেখার স্বাধীনতা অথবা সাবলীল রেখার স্বাধীন বিচরণ ক্ষেত্র হচ্ছে শিল্পী মোস্তাফিজুল হকের চিত্রকর্মগুলো। রেখা ঘুরে ফিরে রূপের বৈচিত্র্যকে আলিঙ্গন করেছে আবার শিল্পী ইচ্ছে করেই অনেক সময় রেখাকে অন্তর্লীন করে দিয়েছেন রং-এর আস্তরনের মধ্যে। নন্দলাল বসু বলেছেন- “স্বার্থের ও অজ্ঞানের ঘনীভূত অন্ধকারেও আমরা অন্তঃকরণে যে আলোক দেখতে পাই সাহিত্য বা শিল্প তারই ছটা; তাতে বাইরের অন্ধকারও দূর হতে পারে; দুঃখ দূর না হ্কো দুঃখের কারণ দূর হতে পারে”। শিল্পী মোস্তাফিজুল হক আলোকনির্ভর মানুষ, চেতনায় আশাবাদীতার ভাবসৌকর্য রেখেই তিনি টিন্তা চর্চা করেন, তাই তো শিল্পীর চিত্রকর্মে অন্তঃকরণের আলো খুঁজে পাই।

শিল্পী তাঁর কাজে রূপ নির্মাণের ক্ষেত্রে অনন্ত মুক্তির কথা মনে রেখেছেন, স্বাধীনভাবে বিষয়ভাবনার আদলে তিনি পূর্ণতা এনেছেন ক্ষেত্রের সারসত্তার রসবোধ তৈরিতে। দার্শণিক সার্তে-র দৃষ্টিভঙ্গিতে শিল্পী মোস্তাফিজুল হক-এর চিত্রকর্মগুলো যদি বিবেচনা করি তবে বিষয়ভিত্তিক উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে সারবস্তুর আনন্দময় স্বাধীনতা প্রকাশ পেয়েছে এবং সারসত্তার পূর্ণ সৌন্দর্যবোধ আদৃত হয়েছে। বিন্যাসের মৌলিক আকৃতিগত এবং নির্বস্তুক রূপ চর্চার ধারাবাহিক সত্যনিষ্ঠ ধারা ব্যাপ্তিময় হয়েছে।

শিল্পী নির্লীপ্ত হয়েছেন তাঁর কাজে। ছবির বিষয়ে নিজেকে জড়িয়েছেন এবং নৈর্ব্যক্তিক রূপ নির্ণয় করে সৃষ্টির আবেগকে বিস্তৃত করেছেন।

বৃহস্পতিবার, ২৮ জুলাই ২০২২ , ১৩ শ্রাবণ ১৪২৯ ২৯ জিলহজ ১৪৪৩

শিল্পী মোস্তাফিজুল হকের একক চিত্রপ্রদর্শনী “ফিরে দেখা”

স্বাধীনতার রূপবন্ধন ও জ্ঞানলব্ধতা

সঞ্জয় দে রিপন

image

মাই প্লেজার ৩ / এক্রেলিক অন ক্যানভাস

ভাবনা বা ধারণালব্ধতাই জ্ঞানের মৌলিক অস্তিত্বকে ধারণ করে থাকে- যা চিন্তার বিশ্লেষণের মাধ্যমে সৃষ্টির দিকে ধাবিত হয়। শিল্প চর্চাটা ঠিক তাই; একটা ধারণালব্ধ জ্ঞানকে বিস্তৃত কাঠামোর মধ্যে রেখে নির্র্দিষ্ট রূপাবয়ব নির্মাণ করা। এই রূপাবয়বটাই হচ্ছে জ্ঞানের ইমেজ যা ধারণালব্ধ বিশ্লেষণের ফলাফলকে সৃষ্টির মাত্রা দান করে থাকে। আর শিল্প সবসময়ই জ্ঞানের মৌলিক অস্তিত্বকে বিধৃত করে বলেই তা বিস্ময় বা সৃষ্টিআনন্দের ধারায় সুন্দরকেই প্রতিষ্ঠা করে থাকে; যা মানবিক এবং প্রকৃতিগত বাস্তব চিন্তাকে প্রভাবিত করে এবং আলোকনির্ভর সময়কে আলিঙ্গন করে। শিল্পী মোস্তাফিজুল হক জীবন ও জগৎভাবনার আদলে জ্ঞানের মৌলিক অস্তিত্বকে ধারণ করেছেন তাঁর শিল্প চিন্তায়। তিনি সমসাময়িক ভাবনাকে আলোকনির্ভর চিন্তা দ্বারা, ভাব এবং বোধকে যুক্তিসঙ্গত ও সংগ্রামী করে তুলেছেন। শিল্পী সবসময়ই স্বাধীনতার রূপবন্ধন নির্মাণ করবার প্রচেষ্টায় যুক্ত থাকেন- যা সত্যিই একজন প্রকৃত শিল্পস্বত্তার অস্তিত্বকে ধারণ করে। এক্ষেত্রে অস্তিত্ববাদ নিয়ে দু’একটি কথা বলা খুবই প্রাসঙ্গিক। শিল্পবস্তুর যদি অস্তিত্ব রক্ষা না করা যায় তবে তা শিল্প হবে কী করে? ব্যাপারটা ঠিক তাই একজন শিল্পীকে নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রথমত এবং শেষপর্যন্ত শিল্পবস্তুর অস্তিত্ব নিশ্চিত করতে হবে; তা না হলে সেই সৃষ্টির মধ্যে বোধ বা জ্ঞান এর সঞ্চারণ থাকবে না আর জ্ঞান, সৃষ্টিচিন্তা অথবা মানবিক ক্রিয়ার সঞ্চারণ যদি না ঘটে, তবে টলস্টয়ের মতে তা শিল্পে উত্তীর্ণ হবে না। মানবিক ক্রিয়ার সঞ্চারণ ঘটানো শিল্পীর সৃষ্টিচিন্তার স্বার্থকতার প্রথম শর্ত- যা অবশ্যই পূরণীয় সোপান। আর তাই শিল্পবস্তুর অস্তিত্বই শিল্পীর নির্মাণকে বাঁচিয়ে রাখে। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে জিব্রাইল মার্সেল সর্বপ্রথম “অস্তিত্ববাদ” শব্দটি ব্যবহার করেছেন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্রান্স এবং জার্মানির চিন্তাবিদদের মাধ্যমে অস্তিত্ববাদ মানুষ এবং শিল্পের চৌহদ্দিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে- যা সমকালীন শিল্পচিন্তাতেও প্রবলভাবে যৌক্তিক। এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ‘অস্তিত্ববাদ সারসত্তার পূর্বগামী’- যা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং এখানে জীবন ও বস্তুগত সারবস্তুর সার্বিক ধারণাটাই হচ্ছে সারসত্তা বা Essence। এই যে সারসত্তা বা Essence এখানেই প্রকৃতি ও জীবন, আবেগ ও ধর্ম, ভাববোধ ও আবেগ অথবা সুন্দর বা মানবিকতা যুক্ত থাকে; তাইতো শিল্পী পাবলো পিকাসো বা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা সোমনাথ হোর সবাই সারসত্তার দিকে ছুটেছিলেন এবং রূপের মধ্যে অরূপের সন্ধান করেছিলেন। সকল শিল্পীসত্তাই অস্তিত্বের সনদ নিয়ে চিন্তার বিন্যাসকে ধারণ। শিল্পী মোস্তাফিজুল হকের শিল্পকর্মগুলোতে শিল্পবস্তুর সারসত্তা রয়েছে।

ফরাসি দার্শনিক জ্যাঁ পল সার্ত্রে তাঁর ইবরহম Being And Nothingness গ্রন্থে (পৃষ্ঠা-৬৭০) বলেছেন “আমার স্বাধীনতা আমারই, সে পূর্ণ এবং অনন্ত। মৃত্যু আমার পরিকল্পনা রূপায়নের ক্ষেত্রে কোনো বাধা নয়। ‘আমি মরবার জন্য স্বাধীন নই’; বরং আমি একটি স্বাধীন মরণশীল সত্তা। শিল্পী সেই স্বাধীন সত্তাকেই রং রেখা এবং টেক্সচারের মাধ্যমে পূর্ণতা দান করেছেন। শিল্পী মোস্তাফিজুল হক তাঁর ঝঢ়ৎরহঃ সিরিজের চিত্রকর্মগুলোতে সহসা সবেগে ধাবনকেই স্বাধীনতার নিমিত্ত করে তুলেছেন। রং এর বিস্তৃত বিন্যাসে চিত্রপটকে বিষয়বস্তুর অনুরৈখিক যাত্রার দিকে ধাবিত করেছে; মনে হয় যেন এখনই ছুটে চলছে দৃশ্যমান সেই ঘোরাগুলো। কোথাও আংশিক আবার কোথাও প্রায় পূর্ণরূপাবয়বের উপস্থিতিতে মনের আনন্দবেগ যেন উৎসারিত হচ্ছে ক্যানভাস থেকে বাস্তব সদৃশ কল্পনাতে। ক্যানভাসগুলোতে সারসত্তা হচ্ছে ব্যারিকেডবিহীন আনন্দ মাত্রা এবং বোধের গতি যা শিল্পীর অনন্ত স্বাধীন চিন্তার বিস্তারকে অগ্রসর করেছে। শিল্পী জীবনের বাধা বিপত্তিকে গতিময় চিন্তা দ্বারা উতরিয়ে গেছেন এক মহাকর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে, তাই চিত্রকর্মে জড়ানো হয়েছে গতিময় প্রাণীর আকারিক ছন্দের মাত্রা। হয়তো শিল্পী নিজেও স্বাধীনতাভোগের প্রতি খুবই আগ্রহী বিধায় স্বাধীনস্বত্তাকে তিনি গুরুত্ব দেন এবং এই ব্যাপারটা তাঁর কাজে ব্যাপকভাবেই ক্রিয়াশীল।

স্প্রিন্ট-৮ চিত্রকর্মটি দেখে মনে হচ্ছে যেন চিত্রপট হয়ে উঠেছে ঘোড়ার গতিময় সা¤্রাজ্য; নিবেদনে রয়েছে গভীর ভাবাবেগ এবং লড়াইয়ের স্বাধীনতা। সম্মখস্থ ঘোড়ার শারীরিক গতির সাথে ভেতরকার সাহসকে সঞ্চারিত করেছে। এই সাহসটাই স্বাধীনতার রূপকে শিল্পরূপে পরিবর্তিত করেছে। শিল্পী গভীর এবং গাঢ় রং এর স্পেসগুলোতে অনেক সময় মধ্যবর্তী কালারটোন প্রয়োগ করেছেন আবার অনেকসময় তা পরিহার করেছেন বিষয়কে কেন্দ্রীভূত করার জন্য। শিল্পী এখানে টেক্সচারের ব্যবহার করেছেন আবার খুব সচেতনভাবেই টেক্সচারের অংশগুলো অপেক্ষাকৃত গাঢ় রং এর আবরণে আচ্ছাদিত যা স্পেসকে গভীর থেকে গভীরতর দৃশ্যমানতার দিকে নিয়ে যায়। এখানে চিত্রকর্মটি সারবস্তু দ্বারাই সার্বিকভাবে প্রভাবিত।

স্প্রিন্ট-৪ চিত্রকর্মটির ব্যাকস্পেস মার্ক রথকোর কালার ফিল্ড পেইন্টিংয়ের মতো বিভাজিত করা এবং সেটার উপরে শিল্পী স্বতন্ত্র ভাবনায় বাস্তব এবং স্বাধীন সত্তার গতিযুক্ত অবয়ব এঁকেছেন। চিত্রকর্মটি একটি বিশেষ কারণে ব্যতিক্রম আনন্দ

তৈরি করে; কারণটি বেশ রঙিন পরীক্ষকের মতো। ডানদিকে অন্ধকার আর বামদিকে লাল রংয়ের প্রচ্ছন্ন আত্মোপলব্ধি ঘোড়ার শারীরিক দেহসৌষ্ঠবকে সম্মুখস্ত গতিবেগের দিকে নিমন্ত্রিত করেছে। যেহেতু চিত্রাবয়টি ভাব এবং আবেগের গতিকে ধারণ করেছে তাই শিল্পী এখানে সফল; এই চিত্রটি দেখতে কোলাজ ইফেক্টের টেক্সচারের মতো। একধরনের সুরালোকিত এবং ছন্দোময়তা প্রাণীবয়বের অস্তিত্বকে নিরলসভাবেই স্বীকৃতি দিচ্ছে।

প্লেজার-৩ চিত্রকর্মটিতে প্রাণী অবয়বের অরূপ ব্যঞ্জণা দৃশ্যমান। গতিময় বাহুবল যেনো ছড়িয়ে দিচ্ছে এক অদ্ভুত অন্তপ্রায় গতিকে। চিত্রকর্মটি ডায়াগনাল রূপবিন্যাসে নির্মিত এবং এখানে নেতিয়ে পড়া অস্থিরতাকে হার মানিয়ে উজিয়ে উঠছে কেবলই এক মানবিক শক্তি। এখানে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে রূপের সামগ্রিক অবয়ব এবং একটি মৌলিক রূপাদর্শ এখানে তৈরি হয়েছে যা চিন্তার নান্দনিক দৃষ্টিকে গভীরে নিয়ে যাচ্ছে। রেখার ব্যবহার রং এর অবরহণের মধ্যে রয়েছে দেখে যেন মনে হচ্ছে চিন্তার রূপরৈখিকতাকে বিন্যস্ত করা। তীব্র ভাববোধের ক্ষেত্র বিন্যাস অন্তর্লীনের আনন্দকে বিধৃত করেছে; যেন এক কাঠামো থেকে নতুন কাঠামো নির্মাণের আনন্দ। শেষ অবধি শিল্পী মোস্তাফিজুল হকের এই কাজটি পরীক্ষামূলক চিত্রবিন্যাসের খোঁজে ভাষাগত আননন্দের গতিকে সমীকরণীক করে তুলেছে। মাই-প্লেজার সিরিজের চিত্রকর্মগুলোতে প্রাণময় চিন্তাকল্পের সংমিশ্রণ রয়েছে। যাপিত সময়ের আবেগ-অনুভূতি, জীর্ণতা এবং বাধাবিপত্তির স্বপ্রণোদিত প্রকাশকালকে নিবন্ধিত করে শিল্পী স্বতন্ত্র নির্বস্তুক কাঠামো তৈরি করেছেন।

“আমার আনন্দ” সিরিজের চিত্রকর্মগুলো শিল্পী বিংশ শতাব্দীর শেষপর্বে এঁকেছেন। এই সময়কালটাতেই শিল্পী অনেক বেশি অনুসন্ধিৎসু হয়ে উঠেছেন; এই সময়কালের কাজে প্রাণি অবয়ব, প্রকৃতির বিভিন্ন আনুষঙ্গিক উপাদান যেন বাস্তব সদৃশ কল্পনার মতো ক্যানভাসে উঠে আসে। শিল্পী অনেক ক্ষেত্রেই ভারি রং এর ব্যবহার আবার একই সাথে বিপরীত ঘরাণার রংঙের আলাপন চিত্রকলার মধ্যে ভাবের দর্শন তথা চিন্তার ভাষাকে আলোড়িত করে আর বয়কট করেছে নিরানন্দের অন্ধকারকে।

রেখার স্বাধীনতা অথবা সাবলীল রেখার স্বাধীন বিচরণ ক্ষেত্র হচ্ছে শিল্পী মোস্তাফিজুল হকের চিত্রকর্মগুলো। রেখা ঘুরে ফিরে রূপের বৈচিত্র্যকে আলিঙ্গন করেছে আবার শিল্পী ইচ্ছে করেই অনেক সময় রেখাকে অন্তর্লীন করে দিয়েছেন রং-এর আস্তরনের মধ্যে। নন্দলাল বসু বলেছেন- “স্বার্থের ও অজ্ঞানের ঘনীভূত অন্ধকারেও আমরা অন্তঃকরণে যে আলোক দেখতে পাই সাহিত্য বা শিল্প তারই ছটা; তাতে বাইরের অন্ধকারও দূর হতে পারে; দুঃখ দূর না হ্কো দুঃখের কারণ দূর হতে পারে”। শিল্পী মোস্তাফিজুল হক আলোকনির্ভর মানুষ, চেতনায় আশাবাদীতার ভাবসৌকর্য রেখেই তিনি টিন্তা চর্চা করেন, তাই তো শিল্পীর চিত্রকর্মে অন্তঃকরণের আলো খুঁজে পাই।

শিল্পী তাঁর কাজে রূপ নির্মাণের ক্ষেত্রে অনন্ত মুক্তির কথা মনে রেখেছেন, স্বাধীনভাবে বিষয়ভাবনার আদলে তিনি পূর্ণতা এনেছেন ক্ষেত্রের সারসত্তার রসবোধ তৈরিতে। দার্শণিক সার্তে-র দৃষ্টিভঙ্গিতে শিল্পী মোস্তাফিজুল হক-এর চিত্রকর্মগুলো যদি বিবেচনা করি তবে বিষয়ভিত্তিক উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে সারবস্তুর আনন্দময় স্বাধীনতা প্রকাশ পেয়েছে এবং সারসত্তার পূর্ণ সৌন্দর্যবোধ আদৃত হয়েছে। বিন্যাসের মৌলিক আকৃতিগত এবং নির্বস্তুক রূপ চর্চার ধারাবাহিক সত্যনিষ্ঠ ধারা ব্যাপ্তিময় হয়েছে।

শিল্পী নির্লীপ্ত হয়েছেন তাঁর কাজে। ছবির বিষয়ে নিজেকে জড়িয়েছেন এবং নৈর্ব্যক্তিক রূপ নির্ণয় করে সৃষ্টির আবেগকে বিস্তৃত করেছেন।