‘বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা ও পরিবীক্ষণ ইউনিট’ গুটানোর উদ্যোগ

এই সময়ে ক্ষতির পরিমাণ ৬শ’ কোটি টাকা

বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম বিলুপ্তির প্রায় দশ বছর পর ‘বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ ইউনিট’ গুটিয়ে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষা ভবন থেকে জরুরি ভিত্তিতে এই ইউনিটের কার্যক্রম স্থানান্তর করতে দশ বছরে গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অন্তত পাঁচবার চিঠি দিয়েছে মাউশি। তবে নিজেদের পদ-পদবি ও সুযোগ-সুবিধার স্বার্থে পরিবীক্ষণ ইউনিটের কার্যক্রম চালু রাখতে কর্মকর্তারা নানা চেষ্টা-তদবির করছেন বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

২০১৩ সাল থেকেই এই ইউনিটের কর্মকর্তারা ‘অলস’ সময় পার করে আসছেন। বেতন-ভাতাসহ নানা সুযোগ-সুবিধাও ভোগ করে আসছেন। এতে প্রতি মাসে সরকারের চার থেকে পাঁচ কোটি টানা ব্যয় হয়েছে। এ হিসেবে দশ বছরের সরকারের প্রায় ৬০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ধারণা।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আমিনুল ইসলাম খান গত ১৯ জুলাই এক সভায় ‘বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ ইউনিট’ এর কার্যক্রম গুটিয়ে ফেলার নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে সিনিয়র সচিব এই ইউনিটে কতজন কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত আছেন, তাদের কে কত টাকা বেতন-ভাতা পাচ্ছেন, কে কী সুবিধা ভোগ করছেন, কার চাকরির কত বয়স, কী কী অবকাঠামো সুবিধা রয়েছে এসব বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন বলে ওই সভায় উপস্থিত থাকা একাধিক কর্মকর্তা সংবাদকে জানিয়েছেন।

এ বিষয়ে মতামত জানার জন্য সিনিয়র সচিব আমিনুল ইসলাম খানের সঙ্গে সেলফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি ধরেননি।

‘বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ ইউনিট’র কার্যক্রম বিলুপ্তির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে এই ইউনিটের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত) আবু বকর সিদ্দিক কথা বলতে অনীহা প্রকাশ করেন। মহাপরিচালকের পদটি যুগ্মসচিব পদমর্যাদার। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই এখানে অতিরিক্ত সচিব পদায়ন পাচ্ছেন।

এই ইউনিট বিলুপ্ত হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে এর পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) কামাল হোসেন সংবাদকে বলেন, ‘এটা সরকারের বিষয়, সরকার চাইলে বিলুপ্ত করতেই পারে।’

গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন উপসচিব ও একজন যুগ্মসচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে জানিয়েছেন, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ ইউনিটে ‘জনবল অনেক’। এজন্য এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে কাজ করতে হচ্ছে। এ কারণে ইউনিটটি বিলুপ্ত করতে ‘অনেক সময়’ লাগবে।

রাজধানীর আবদুল গণি রোডে শিক্ষা ভবনের পঞ্চম তলায় অর্ধেকের বেশি ফ্লোরে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ ইউনিটের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ‘বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ ইউনিট’ বিলুপ্ত করে এর স্থলে প্রাথমিক শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের জন্য একটি অডিটোরিয়াম প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

ওই ভবনের বাকি পাঁচটি ফ্লোরে রয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনন্থ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) দপ্তর। জায়গার অভাবে দীর্ঘদিন ধরে মাউশি’র দাপ্তরিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘শিক্ষা ভবন’ নামে পরিচিত এখান থেকে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন ইউনিট সরাতে বিভিন্ন সময়ে মাউশি কর্তৃপক্ষ তৎপর হলেও তা আমলে নেয়া হয়নি বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ ইউনিটের অফিস শিক্ষা ভবন থেকে সরিয়ে নিতে ২০১৩ সাল থেকে মাউশির চারজন মহাপরিচালক অন্তত পাঁচবার মাধ্যমিক উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং এই ইউনিটের মহাপরিচালকের কাছে চিঠি দিয়েছেন।

সর্বশেষ গত ৩ মার্চ এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিবের কাছে চিঠি দেন মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ। তিনি বলেন, ‘মাউশির কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং বিভিন্ন প্রকল্পের জনবলের দাপ্তরিক কাজের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে জরুরি ভিত্তিতে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ইউনিটের দপ্তরটি মাউশি (শিক্ষা ভবন) থেকে অন্যত্র স্থানান্তরের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো।’

জানতে চাইলে মাউশির পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) অধ্যাপক শাহেদুল খবির চৌধুরী সংবাদকে বলেন, ‘বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন ইউনিটের কার্যক্রম এখন নেই বললেই চলে। অথচ তাদের অনেক জনবল রয়েছে। একটি ফ্লোরই তাদের দখলে। কিন্তু আমাদের (মাউশি) জায়গার সংকুলান হচ্ছে না। ফাইল ও নথিপত্র রাখা এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বসার জায়গাও ঠিকমত হচ্ছে না। প্রতিদিন সারাদেশ থেকে শিক্ষক ও সেবা প্রত্যাশীরা আসছেন, তাদেরও সমস্যা পোহাতে হচ্ছে।’

বর্তমানে একজন মহাপরিচালকের (অতিরিক্ত সচিব) নেতৃত্বে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ ইউনিটের ইউনিটে প্রায় অর্ধশত কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। তাদের বেতন-ভাতা, পরিবহন ও দাপ্তরিক ব্যয়, আপ্যায়ন ভাতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সরকারের চার থেকে পাঁচ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে বলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হিসাব শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

সরকার সব শিশুকে বিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিত করতে এবং নির্দিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত শিক্ষাগ্রহণ বাধ্যতামূলক করার লক্ষ্যেই বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। ১৯৯০ সালে ‘বাংলাদেশ বাধ্যতামূলক প্রাথমিক আইন’ পাস হয়। এই আইনের অধীনে প্রথম পর্যায়ে ১৯৯২ সালে প্রতি জেলার একটি করে থানায় পরীক্ষামূলকভাবে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা হয়। ১৯৯৩ সালে সারাদেশে তা সম্প্রসারণ করা হয়।

১৯৯৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে সারাদেশে আইনটি কার্যকর করা হয়। ১৯৯৫ সালে ‘বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ ইউনিট’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে ২০১৪ সালের মধ্যে নিরক্ষরতা দূরীকরণের কথা বলা হয়।

ইতোমধ্যে সরকারের এই ইউনিটের লক্ষ্য অর্জিতও হয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশ এসডিজি অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করেছে। প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থী ভর্তি এখন প্রায় শতভাগ, ঝরে পড়ার হারও কম। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার প্রায় শতভাগ। এজন্য বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা ইউনিটের আর প্রয়োজন নেই বলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা মনে করছেন।

জানা গেছে, প্রতিষ্ঠালঘœ থেকেই এই ইউনিটের মূল কাজ ছিল বেসরকারি রেজিস্ট্রার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় ও এনজিও পরিচালিত বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এমপিও (মান্থলি পে অর্ডার) প্রদান। কিন্ত সরকার ২০১৩ সালের ১ জানুয়ারি দেশের সব রেজিস্ট্রার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করে। এতে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ ইউনিটের কাজ শেষ হয়ে যায়। কারণ ওই ইউনিটের অধীনেই রেজিস্ট্রার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালিত হতো। এসব বিদ্যালয় জাতীয়করণ হওয়ায় কর্মহীন হয়ে পড়ে এই ইউনিটের প্রায় অর্ধশত কর্মী, যাদের প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে পদায়ন করা হয়েছিল।

ওই ইউনিটের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে বলেন, ‘সব বিদ্যালয় জাতীয়করণের আওতায় নেয়ার পর স্বাভাবিক কারণেই আমাদের মূল কর্মস্থল প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে (ডিপিই) চাকরি ন্যাস্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের নীতি নির্ধারকরা এই দায়িত্ব এড়িয়ে এসেছেন। কারণ এখানে অতিরিক্ত, যুগ্ম ও উপসচিবের ১০-১১টি পদ রয়েছে। তাদের সুবিধার কারণেই এই ইউনিট বিলুপ্ত হয়নি।’

সোমবার, ০৮ আগস্ট ২০২২ , ২৪ শ্রাবণ ১৪২৯ ৯ মহররম ১৪৪৪

ঘোষণার দশ বছর পর

‘বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা ও পরিবীক্ষণ ইউনিট’ গুটানোর উদ্যোগ

এই সময়ে ক্ষতির পরিমাণ ৬শ’ কোটি টাকা

রাকিব উদ্দিন

বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম বিলুপ্তির প্রায় দশ বছর পর ‘বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ ইউনিট’ গুটিয়ে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষা ভবন থেকে জরুরি ভিত্তিতে এই ইউনিটের কার্যক্রম স্থানান্তর করতে দশ বছরে গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অন্তত পাঁচবার চিঠি দিয়েছে মাউশি। তবে নিজেদের পদ-পদবি ও সুযোগ-সুবিধার স্বার্থে পরিবীক্ষণ ইউনিটের কার্যক্রম চালু রাখতে কর্মকর্তারা নানা চেষ্টা-তদবির করছেন বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

২০১৩ সাল থেকেই এই ইউনিটের কর্মকর্তারা ‘অলস’ সময় পার করে আসছেন। বেতন-ভাতাসহ নানা সুযোগ-সুবিধাও ভোগ করে আসছেন। এতে প্রতি মাসে সরকারের চার থেকে পাঁচ কোটি টানা ব্যয় হয়েছে। এ হিসেবে দশ বছরের সরকারের প্রায় ৬০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ধারণা।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আমিনুল ইসলাম খান গত ১৯ জুলাই এক সভায় ‘বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ ইউনিট’ এর কার্যক্রম গুটিয়ে ফেলার নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে সিনিয়র সচিব এই ইউনিটে কতজন কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত আছেন, তাদের কে কত টাকা বেতন-ভাতা পাচ্ছেন, কে কী সুবিধা ভোগ করছেন, কার চাকরির কত বয়স, কী কী অবকাঠামো সুবিধা রয়েছে এসব বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন বলে ওই সভায় উপস্থিত থাকা একাধিক কর্মকর্তা সংবাদকে জানিয়েছেন।

এ বিষয়ে মতামত জানার জন্য সিনিয়র সচিব আমিনুল ইসলাম খানের সঙ্গে সেলফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি ধরেননি।

‘বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ ইউনিট’র কার্যক্রম বিলুপ্তির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে এই ইউনিটের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত) আবু বকর সিদ্দিক কথা বলতে অনীহা প্রকাশ করেন। মহাপরিচালকের পদটি যুগ্মসচিব পদমর্যাদার। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই এখানে অতিরিক্ত সচিব পদায়ন পাচ্ছেন।

এই ইউনিট বিলুপ্ত হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে এর পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) কামাল হোসেন সংবাদকে বলেন, ‘এটা সরকারের বিষয়, সরকার চাইলে বিলুপ্ত করতেই পারে।’

গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন উপসচিব ও একজন যুগ্মসচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে জানিয়েছেন, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ ইউনিটে ‘জনবল অনেক’। এজন্য এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে কাজ করতে হচ্ছে। এ কারণে ইউনিটটি বিলুপ্ত করতে ‘অনেক সময়’ লাগবে।

রাজধানীর আবদুল গণি রোডে শিক্ষা ভবনের পঞ্চম তলায় অর্ধেকের বেশি ফ্লোরে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ ইউনিটের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ‘বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ ইউনিট’ বিলুপ্ত করে এর স্থলে প্রাথমিক শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের জন্য একটি অডিটোরিয়াম প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

ওই ভবনের বাকি পাঁচটি ফ্লোরে রয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনন্থ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) দপ্তর। জায়গার অভাবে দীর্ঘদিন ধরে মাউশি’র দাপ্তরিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘শিক্ষা ভবন’ নামে পরিচিত এখান থেকে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন ইউনিট সরাতে বিভিন্ন সময়ে মাউশি কর্তৃপক্ষ তৎপর হলেও তা আমলে নেয়া হয়নি বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ ইউনিটের অফিস শিক্ষা ভবন থেকে সরিয়ে নিতে ২০১৩ সাল থেকে মাউশির চারজন মহাপরিচালক অন্তত পাঁচবার মাধ্যমিক উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং এই ইউনিটের মহাপরিচালকের কাছে চিঠি দিয়েছেন।

সর্বশেষ গত ৩ মার্চ এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিবের কাছে চিঠি দেন মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ। তিনি বলেন, ‘মাউশির কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং বিভিন্ন প্রকল্পের জনবলের দাপ্তরিক কাজের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে জরুরি ভিত্তিতে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ইউনিটের দপ্তরটি মাউশি (শিক্ষা ভবন) থেকে অন্যত্র স্থানান্তরের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো।’

জানতে চাইলে মাউশির পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) অধ্যাপক শাহেদুল খবির চৌধুরী সংবাদকে বলেন, ‘বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন ইউনিটের কার্যক্রম এখন নেই বললেই চলে। অথচ তাদের অনেক জনবল রয়েছে। একটি ফ্লোরই তাদের দখলে। কিন্তু আমাদের (মাউশি) জায়গার সংকুলান হচ্ছে না। ফাইল ও নথিপত্র রাখা এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বসার জায়গাও ঠিকমত হচ্ছে না। প্রতিদিন সারাদেশ থেকে শিক্ষক ও সেবা প্রত্যাশীরা আসছেন, তাদেরও সমস্যা পোহাতে হচ্ছে।’

বর্তমানে একজন মহাপরিচালকের (অতিরিক্ত সচিব) নেতৃত্বে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ ইউনিটের ইউনিটে প্রায় অর্ধশত কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। তাদের বেতন-ভাতা, পরিবহন ও দাপ্তরিক ব্যয়, আপ্যায়ন ভাতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সরকারের চার থেকে পাঁচ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে বলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হিসাব শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

সরকার সব শিশুকে বিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিত করতে এবং নির্দিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত শিক্ষাগ্রহণ বাধ্যতামূলক করার লক্ষ্যেই বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। ১৯৯০ সালে ‘বাংলাদেশ বাধ্যতামূলক প্রাথমিক আইন’ পাস হয়। এই আইনের অধীনে প্রথম পর্যায়ে ১৯৯২ সালে প্রতি জেলার একটি করে থানায় পরীক্ষামূলকভাবে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা হয়। ১৯৯৩ সালে সারাদেশে তা সম্প্রসারণ করা হয়।

১৯৯৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে সারাদেশে আইনটি কার্যকর করা হয়। ১৯৯৫ সালে ‘বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ ইউনিট’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে ২০১৪ সালের মধ্যে নিরক্ষরতা দূরীকরণের কথা বলা হয়।

ইতোমধ্যে সরকারের এই ইউনিটের লক্ষ্য অর্জিতও হয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশ এসডিজি অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করেছে। প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থী ভর্তি এখন প্রায় শতভাগ, ঝরে পড়ার হারও কম। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার প্রায় শতভাগ। এজন্য বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা ইউনিটের আর প্রয়োজন নেই বলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা মনে করছেন।

জানা গেছে, প্রতিষ্ঠালঘœ থেকেই এই ইউনিটের মূল কাজ ছিল বেসরকারি রেজিস্ট্রার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় ও এনজিও পরিচালিত বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এমপিও (মান্থলি পে অর্ডার) প্রদান। কিন্ত সরকার ২০১৩ সালের ১ জানুয়ারি দেশের সব রেজিস্ট্রার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করে। এতে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ ইউনিটের কাজ শেষ হয়ে যায়। কারণ ওই ইউনিটের অধীনেই রেজিস্ট্রার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালিত হতো। এসব বিদ্যালয় জাতীয়করণ হওয়ায় কর্মহীন হয়ে পড়ে এই ইউনিটের প্রায় অর্ধশত কর্মী, যাদের প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে পদায়ন করা হয়েছিল।

ওই ইউনিটের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে বলেন, ‘সব বিদ্যালয় জাতীয়করণের আওতায় নেয়ার পর স্বাভাবিক কারণেই আমাদের মূল কর্মস্থল প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে (ডিপিই) চাকরি ন্যাস্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের নীতি নির্ধারকরা এই দায়িত্ব এড়িয়ে এসেছেন। কারণ এখানে অতিরিক্ত, যুগ্ম ও উপসচিবের ১০-১১টি পদ রয়েছে। তাদের সুবিধার কারণেই এই ইউনিট বিলুপ্ত হয়নি।’