নিউমার্কেটে হামলা, প্রধান আসামি বিএনপি নেতা মকবুল গ্রেপ্তার

রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশের দায়ের করা মামলায় এক নম্বর আসামি বিএনপির নিউমার্কেট থানার সাবেক সভাপতি মকবুল হোসেনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার গতকাল বলেন, গতকাল বিকেলে মকবুল হোসেনকে তার ধানমন্ডির বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পর তাকে মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। গোয়েন্দা তদন্ত রিপোর্ট বলছে, ঘটনা শুরুর পর থেকে সংঘর্ষ ছড়িয়ে দিতে ব্যবসায়ী ও শিক্ষার্থী দুই মহলকেই উসকে দিয়েছেন মকবুলসহ আরও কয়েকজন বিএনপি নেতাকর্মী। যে দুই ফাস্টফুডের কর্মচারীদের বিবাদে ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল সেই ওয়েলকাম ও ক্যাপিটাল নামের দোকান দুটির মালিক এই মকবুল।

এদিকে সংঘর্ষের সময় নিহত দোকানের কর্মচারী মুরসালিনের পরিবারের পক্ষ থেকে একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। নিহতের ভাই নূর মোহাম্মদ বাদী হয়ে নিউমার্কেট থানায় মামলাটি দায়ের করেন। এই মামলায় অজ্ঞাত ৩০০ থেকে ৪০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। মামলার বাদী নুর মোহাম্মদ জানান, আমার ভাই নিরাপরাধ ছিল। তার হত্যাকারীদের বিচার চাই। এই সংঘর্ষের ঘটনায় এ নিয়ে এখন পর্যন্ত চারটি মামলা দায়ের করা হলো। এর মধ্যে কম্পিউটার দোকানের ডেলিভ্যারিম্যান নাহিদ হাসানের মৃত্যুর ঘটনায় করা মামলার তদন্তভার পেয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ।

গতকাল বিকেলে নিউমার্কেট থানার ওসি শ ম কাইয়ুম বলেন, নাহিদ নিহতের ঘটনায় গত বুধবার রাতে তার চাচা মো. সাইদ যে হত্যা মামলা করেছেন, তা গোয়েন্দা রমনা বিভাগের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এছাড়া দোকান কর্মচারী মুরসালিন নিহতের মামলাটিও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে ডিবির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। শ ম কাইয়ুম বলেন, মুরসালিন হত্যাকা-ের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে ১০০ থেকে ১৫০ জনকে। এর আগে দায়ের করা তিন মামলায় ২৪ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ১৪শ’ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। চারটি মামলার মধ্যে দুটি মামলা পুলিশ বাদী অন্য দুটি মামলা নিহত মুরসালিন ও নাহিদের পরিবারের পক্ষ থেকে করা হয়েছে।

পুলিশ বাদী হয়ে দায়ের করা দুই মামলার তদন্ত নিউমার্কেট থানা পুলিশ তদন্ত করছে জানিয়েছেন ওসি শ ম কাইয়ুম বলেন, নিউমার্কেটে সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে যে দুটি মামলা করেছে তার তদন্ত করবে থানা পুলিশ। এসব ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য ও সিসি ক্যামেরা এবং অন্যান্য ভিডিও বিশ্লেষণ করে ঘটনায় জড়িতদের সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা চলছে।

প্রসঙ্গত, নিউমার্কেট থানার এসআই মেহেদী হাসান বাদী হয়ে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে সরকারি সম্পদ, জানমালের ক্ষয়ক্ষতি সাধনে ককটেল বিস্ফোরণের অভিযোগে অজ্ঞাত ২০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। নিউমার্কেট থানা পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) ইয়ামিন কবির বাদী হয়ে পুলিশের কাজে বাধা, পুলিশের ওপর আক্রমণ, ইটপাটকেল নিক্ষেপ, ভাঙচুর করার অপরাধে ২৪ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ৩০০ জন ব্যবসায়ী ও কর্মচারী এবং ঢাকা কলেজের অজ্ঞাত ৭০০ ছাত্রের বিরুদ্ধে মামলা করেন। সংঘর্ষের ঘটনায় নিহত নাহিদের চাচাতো ভাই মোহাম্মদ সাঈদ বাদী হয়ে ২০০

জনকে অজ্ঞাত আসামি করে নিউমার্কেট থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। নিউমার্কেটের চার নম্বর ফটকের ভেতরের সিসি ক্যামেরা ভিডিওতে ঢাকা কলেজের তিন শিক্ষার্থী চিহ্নিত হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি বলেন, সবকিছুর তদন্ত চলছে। ঘটনায় জড়িত কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না।

৮ জুন মুরসালিন হত্যা মামলার প্রতবেদন দাখিলের দিন ধার্য

শিক্ষার্থী-ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষে দোকান কর্মচারী মুরসালিনের মৃত্যুর ঘটনায় করা হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ৮ জুন দিন ধার্য করেছেন আদালত। গতকাল ঢাকা মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আতিকুল ইসলাম মামলার এজাহার গ্রহণ করে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য এ দিন ধার্য করেন।

তদন্তের বিষয়ে যা বলছে পুলিশ ও গোয়েন্দারা

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত এই সংঘর্ষের মামলায় এজাহারভুক্ত যে ২৪ জনের নাম এসেছে, তারা ঘটনার সুযোগ নিয়ে ‘উসকানি দিয়েছেন’। তবে ঘটনার দিন মঙ্গলবার সকালে ঢাকা কলেজের সামনে নূরজাহান মার্কেটের ফুটপাতে ব্যবসায়ী-হকারদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ চলাকালে এক/দেড়শ’ হেলমেট পরিহিত যেসব হামলাকারীদের দেখা গেছে, তাদের বিষয়ে খোঁজ-খবর নিতে গোয়েন্দারা মাঠে নেমেছে। প্রাথমিকভাবে ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে গোয়েন্দারা বলছেন, ফুটপাতে আহত হয়ে পরে থাকা নাহিদকে হেলমেট পরিহিত এক যুবক ধারালো অস্ত্র দিয়ে পরপর দুই বার কোপ দিতে দেখা গেছে। পরবর্তীতে ওই ধারালো অস্ত্রটি অন্য দুই হেলমেট পরিহিত যুবকের হাতে দেখা গেছে। আশপাশের যেসব হেলমেট পরিহিত যুবককে হামলা করতে দেখা গেছে, তাদের অধিকাংশই ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী। তবে হেলমেট পরিহিত বাহিনীর ভেতর বহিরাগতরা থাকতে পারে।

জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের নিউমার্কেট জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহেন শাহ বলেন, ঘটনার সময় গোয়েন্দা পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থাও ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করে কাজ করছে। তার মধ্যে যেসব ভিডিও পাওয়া গেছে, সেখানে ঘটনায় কে কে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে, কারা নেপথ্যে থেকে উসকানি দিয়েছে তা এখন অনেকটাই পরিষ্কার। ঘটনাস্থল থেকে শতাধিক সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করে ঘটনার পুঙ্খানুপঙ্খ বিশ্লে­ষণ চলছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি কাজে বাধা, পুলিশের ওপর আক্রমণ, ইট-পাটকেল নিক্ষেপ, ভাঙচুর ও জখম করার অভিযোগে পুলিশের মামলায় যে ২৪ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তাতে ১ নম্বরে আছে নিউমার্কেট থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট মকবুল হোসেনের নাম। ওয়েলকাম ও ক্যাপিটাল ফাস্টফুড নামের যে দুই দোকানের কর্মচারীদের দ্বন্দ্ব থেকে গত সোমবার রাতে সংঘর্ষের সূত্রপাত, সেই দোকান দুটি সিটি করপোরেশন থেকে মকবুলের নামে বরাদ্দ হওয়া। তবে তিনি দাবি করেছেন, কোন দোকানই তিনি নিজে চালান না। রফিকুল ইসলাম ও শহিদুল ইসলাম নামে দুজনকে দোকান দুটি ভাড়া দিয়ে রেখেছেন। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় ইফতারের টেবিল সাজানো নিয়ে ওয়েলকাম ও ক্যাপিটাল ফাস্টফুডের কর্মীদের মধ্যে ঝগড়ার জের ধরে এক পক্ষ ঢাকা কলেজ ছাত্রাবাস থেকে শিক্ষার্থীদের ডেকে আনলে বাঁধে সংঘর্ষ।

যেসব ভিডিও পাওয়া গেছে, সেখানেই অনেক কিছু বের হয়ে এসেছে- কে কে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে, আর কারা উসকানিদাতা হিসেবে কাজ করেছে। সরকারি কাজে বাধা, পুলিশের ওপর আক্রমণ, ইটপাটকেল নিক্ষেপ, ভাঙচুর ও জখম করার অভিযোগে ওই মামলায় যে ২৪ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, ১ নম্বরে আছে নিউ মার্কেট থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট মকবুল হোসেনের নাম। মামলায় অন্য আসামিরা হলো আমীর হোসেন আলমগীর, মিজান, টিপু, হাজি জাহাঙ্গীর হোসেন পাটোয়ারী, হাসান জাহাঙ্গীর মিঠু, হারুন হাওলাদার, শাহ আলম শন্টু, শহীদুল ইসলাম শহীদ, জাপানি ফারুক, মিজান ব্যাপারী, আসিফ, রহমত, সুমন, জসিম, বিল্লাল, হারুন, তোহা, মনির, বাচ্চু, জুলহাস, মিঠু, মিন্টু ও বাবুল। তারা ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপির বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মী।

যে দুই দোকান থেকে সূত্রপাত, তার মালিক মকবুল প্রধান আসামি। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে পুলিশ কর্মকর্তা শাহেন শাহ বলেন, তারা ঘটনার সুযোগ নিয়েছে। ব্যবসায়ী ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে কারা মাঠে ছিল, তাদের সবাইকে চিহ্নিত করা হচ্ছে। নিউমার্কেট থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ইয়ামিন কবিরের দায়ের করা এ মামলায় অজ্ঞাত আরও ২০০ থেকে ৩০০ জন ব্যবসায়ী ও কর্মচারী এবং ৫০০ থেকে ৬০০ জন শিক্ষার্থীকে আসামি করা হয়েছে। দোকান মালিকরা বলছেন, সেদিন ইফতারের টেবিল সাজানো নিয়ে ওয়েলকাম ও ক্যাপিটাল ফাস্টফুডের কর্মীদের বচসার এক পর্যায়ে এক পক্ষ ঢাকা কলেজ ছাত্রাবাস থেকে ছাত্রলীগের কয়েক কর্মীকে ডেকে আনে। তারা গিয়ে মারধরের শিকার হওয়ার পর ছাত্রাবাসে ফিরে আরও শিক্ষার্থীদের নিয়ে মধ্যরাতে নিউ মার্কেটে হামলা চালাতে গেলে বাঁধে সংঘর্ষ।

সংঘর্ষের শুরুতে দোকানের সিসি ক্যামেরার একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। সেখানে তিনজন ছাত্রলীগ কর্মীর নাম বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এসেছে। এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে অতিরিক্ত কমিশনার শাহেন শাহ বলেন, দুই পক্ষের অনেকেই চিহ্নিত হয়েছেন। তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পরে জানতে পারবেন। সোমবার মধ্যরাতে সংঘর্ষ শুরুর পর পুলিশ টিয়ার শেল ছুড়ে দুই পক্ষকে সরিয়ে দেয়। পরদিন সকালে আবার ওই এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়, তাতে আহত হন অর্ধশতাধিক। পরে তাদের মধ্যে দুইজনের মৃত্যু হয়। সংঘর্ষের সময় অনেকেকে হেলমেট মাথায় মারামারিতে জড়াতে দেখা যায়। লাঠিসোঁটার পাশাপাশি কারও কারও হাতে দেখা যায় ধারালো অস্ত্র। ওই হেলমেটধারীরা কারা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সংবাদমাধ্যমে। এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে পুলিশ কর্মকর্তা শাহেন শাহ বলেন, শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ী দুই পক্ষেই সেদিন অনেকে হেলমেট পরে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। এর কারণ দুটি, নিজেকে নিরাপদ রাখা, আর নিজের পরিচয় গোপন রাখা। তিনি বলেন, এই এলাকায় যাদের দোকান রয়েছে, তাদের অনেকের মোটরসাইকেল আছে, ফলে হেলমেট ব্যবহার করেন। আবার শিক্ষার্থীদের অনেকেরও মোটরসাইকেল আছেন, তাদের সঙ্গেও হেলমেট থাকে। সেদিন দুপক্ষের সংঘর্ষে ইট নিক্ষেপ বেশি হয়েছে। তাই দুপক্ষেই হেলমেট ব্যবহার বেশি হয়েছে। বাইরে থেকে কেউ হেলমেট পরে ঢুকে মারামারিতে জড়িয়েছিল কিনা- এ প্রশ্নে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার বলেন, আমিতো বলেছি যে, একটি পক্ষ সুযোগ নিয়েছে। তবে যেভাবে বলা হচ্ছে হেলমেট বাহিনী’‘, বিষয়টি তা নয়, সাংবাদিকের মধ্যে অনেকেও তো হেলমেট পরেছেন। সংঘর্ষ থামাতে পুলিশ দুই দিনে ৮৮টি টিয়ার গ্যাসের শেল এবং শটগানের ২১১ রাউন্ড গুলি ছুড়েছে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

শনিবার, ২৩ এপ্রিল ২০২২ , ১০ বৈশাখ ১৪২৮ ২১ রমাদ্বান ১৪৪৩

নিউমার্কেটে হামলা, প্রধান আসামি বিএনপি নেতা মকবুল গ্রেপ্তার

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশের দায়ের করা মামলায় এক নম্বর আসামি বিএনপির নিউমার্কেট থানার সাবেক সভাপতি মকবুল হোসেনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার গতকাল বলেন, গতকাল বিকেলে মকবুল হোসেনকে তার ধানমন্ডির বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পর তাকে মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। গোয়েন্দা তদন্ত রিপোর্ট বলছে, ঘটনা শুরুর পর থেকে সংঘর্ষ ছড়িয়ে দিতে ব্যবসায়ী ও শিক্ষার্থী দুই মহলকেই উসকে দিয়েছেন মকবুলসহ আরও কয়েকজন বিএনপি নেতাকর্মী। যে দুই ফাস্টফুডের কর্মচারীদের বিবাদে ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল সেই ওয়েলকাম ও ক্যাপিটাল নামের দোকান দুটির মালিক এই মকবুল।

এদিকে সংঘর্ষের সময় নিহত দোকানের কর্মচারী মুরসালিনের পরিবারের পক্ষ থেকে একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। নিহতের ভাই নূর মোহাম্মদ বাদী হয়ে নিউমার্কেট থানায় মামলাটি দায়ের করেন। এই মামলায় অজ্ঞাত ৩০০ থেকে ৪০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। মামলার বাদী নুর মোহাম্মদ জানান, আমার ভাই নিরাপরাধ ছিল। তার হত্যাকারীদের বিচার চাই। এই সংঘর্ষের ঘটনায় এ নিয়ে এখন পর্যন্ত চারটি মামলা দায়ের করা হলো। এর মধ্যে কম্পিউটার দোকানের ডেলিভ্যারিম্যান নাহিদ হাসানের মৃত্যুর ঘটনায় করা মামলার তদন্তভার পেয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ।

গতকাল বিকেলে নিউমার্কেট থানার ওসি শ ম কাইয়ুম বলেন, নাহিদ নিহতের ঘটনায় গত বুধবার রাতে তার চাচা মো. সাইদ যে হত্যা মামলা করেছেন, তা গোয়েন্দা রমনা বিভাগের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এছাড়া দোকান কর্মচারী মুরসালিন নিহতের মামলাটিও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে ডিবির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। শ ম কাইয়ুম বলেন, মুরসালিন হত্যাকা-ের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে ১০০ থেকে ১৫০ জনকে। এর আগে দায়ের করা তিন মামলায় ২৪ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ১৪শ’ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। চারটি মামলার মধ্যে দুটি মামলা পুলিশ বাদী অন্য দুটি মামলা নিহত মুরসালিন ও নাহিদের পরিবারের পক্ষ থেকে করা হয়েছে।

পুলিশ বাদী হয়ে দায়ের করা দুই মামলার তদন্ত নিউমার্কেট থানা পুলিশ তদন্ত করছে জানিয়েছেন ওসি শ ম কাইয়ুম বলেন, নিউমার্কেটে সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে যে দুটি মামলা করেছে তার তদন্ত করবে থানা পুলিশ। এসব ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য ও সিসি ক্যামেরা এবং অন্যান্য ভিডিও বিশ্লেষণ করে ঘটনায় জড়িতদের সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা চলছে।

প্রসঙ্গত, নিউমার্কেট থানার এসআই মেহেদী হাসান বাদী হয়ে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে সরকারি সম্পদ, জানমালের ক্ষয়ক্ষতি সাধনে ককটেল বিস্ফোরণের অভিযোগে অজ্ঞাত ২০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। নিউমার্কেট থানা পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) ইয়ামিন কবির বাদী হয়ে পুলিশের কাজে বাধা, পুলিশের ওপর আক্রমণ, ইটপাটকেল নিক্ষেপ, ভাঙচুর করার অপরাধে ২৪ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ৩০০ জন ব্যবসায়ী ও কর্মচারী এবং ঢাকা কলেজের অজ্ঞাত ৭০০ ছাত্রের বিরুদ্ধে মামলা করেন। সংঘর্ষের ঘটনায় নিহত নাহিদের চাচাতো ভাই মোহাম্মদ সাঈদ বাদী হয়ে ২০০

জনকে অজ্ঞাত আসামি করে নিউমার্কেট থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। নিউমার্কেটের চার নম্বর ফটকের ভেতরের সিসি ক্যামেরা ভিডিওতে ঢাকা কলেজের তিন শিক্ষার্থী চিহ্নিত হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি বলেন, সবকিছুর তদন্ত চলছে। ঘটনায় জড়িত কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না।

৮ জুন মুরসালিন হত্যা মামলার প্রতবেদন দাখিলের দিন ধার্য

শিক্ষার্থী-ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষে দোকান কর্মচারী মুরসালিনের মৃত্যুর ঘটনায় করা হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ৮ জুন দিন ধার্য করেছেন আদালত। গতকাল ঢাকা মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আতিকুল ইসলাম মামলার এজাহার গ্রহণ করে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য এ দিন ধার্য করেন।

তদন্তের বিষয়ে যা বলছে পুলিশ ও গোয়েন্দারা

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত এই সংঘর্ষের মামলায় এজাহারভুক্ত যে ২৪ জনের নাম এসেছে, তারা ঘটনার সুযোগ নিয়ে ‘উসকানি দিয়েছেন’। তবে ঘটনার দিন মঙ্গলবার সকালে ঢাকা কলেজের সামনে নূরজাহান মার্কেটের ফুটপাতে ব্যবসায়ী-হকারদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ চলাকালে এক/দেড়শ’ হেলমেট পরিহিত যেসব হামলাকারীদের দেখা গেছে, তাদের বিষয়ে খোঁজ-খবর নিতে গোয়েন্দারা মাঠে নেমেছে। প্রাথমিকভাবে ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে গোয়েন্দারা বলছেন, ফুটপাতে আহত হয়ে পরে থাকা নাহিদকে হেলমেট পরিহিত এক যুবক ধারালো অস্ত্র দিয়ে পরপর দুই বার কোপ দিতে দেখা গেছে। পরবর্তীতে ওই ধারালো অস্ত্রটি অন্য দুই হেলমেট পরিহিত যুবকের হাতে দেখা গেছে। আশপাশের যেসব হেলমেট পরিহিত যুবককে হামলা করতে দেখা গেছে, তাদের অধিকাংশই ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী। তবে হেলমেট পরিহিত বাহিনীর ভেতর বহিরাগতরা থাকতে পারে।

জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের নিউমার্কেট জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহেন শাহ বলেন, ঘটনার সময় গোয়েন্দা পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থাও ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করে কাজ করছে। তার মধ্যে যেসব ভিডিও পাওয়া গেছে, সেখানে ঘটনায় কে কে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে, কারা নেপথ্যে থেকে উসকানি দিয়েছে তা এখন অনেকটাই পরিষ্কার। ঘটনাস্থল থেকে শতাধিক সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করে ঘটনার পুঙ্খানুপঙ্খ বিশ্লে­ষণ চলছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি কাজে বাধা, পুলিশের ওপর আক্রমণ, ইট-পাটকেল নিক্ষেপ, ভাঙচুর ও জখম করার অভিযোগে পুলিশের মামলায় যে ২৪ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তাতে ১ নম্বরে আছে নিউমার্কেট থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট মকবুল হোসেনের নাম। ওয়েলকাম ও ক্যাপিটাল ফাস্টফুড নামের যে দুই দোকানের কর্মচারীদের দ্বন্দ্ব থেকে গত সোমবার রাতে সংঘর্ষের সূত্রপাত, সেই দোকান দুটি সিটি করপোরেশন থেকে মকবুলের নামে বরাদ্দ হওয়া। তবে তিনি দাবি করেছেন, কোন দোকানই তিনি নিজে চালান না। রফিকুল ইসলাম ও শহিদুল ইসলাম নামে দুজনকে দোকান দুটি ভাড়া দিয়ে রেখেছেন। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় ইফতারের টেবিল সাজানো নিয়ে ওয়েলকাম ও ক্যাপিটাল ফাস্টফুডের কর্মীদের মধ্যে ঝগড়ার জের ধরে এক পক্ষ ঢাকা কলেজ ছাত্রাবাস থেকে শিক্ষার্থীদের ডেকে আনলে বাঁধে সংঘর্ষ।

যেসব ভিডিও পাওয়া গেছে, সেখানেই অনেক কিছু বের হয়ে এসেছে- কে কে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে, আর কারা উসকানিদাতা হিসেবে কাজ করেছে। সরকারি কাজে বাধা, পুলিশের ওপর আক্রমণ, ইটপাটকেল নিক্ষেপ, ভাঙচুর ও জখম করার অভিযোগে ওই মামলায় যে ২৪ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, ১ নম্বরে আছে নিউ মার্কেট থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট মকবুল হোসেনের নাম। মামলায় অন্য আসামিরা হলো আমীর হোসেন আলমগীর, মিজান, টিপু, হাজি জাহাঙ্গীর হোসেন পাটোয়ারী, হাসান জাহাঙ্গীর মিঠু, হারুন হাওলাদার, শাহ আলম শন্টু, শহীদুল ইসলাম শহীদ, জাপানি ফারুক, মিজান ব্যাপারী, আসিফ, রহমত, সুমন, জসিম, বিল্লাল, হারুন, তোহা, মনির, বাচ্চু, জুলহাস, মিঠু, মিন্টু ও বাবুল। তারা ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপির বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মী।

যে দুই দোকান থেকে সূত্রপাত, তার মালিক মকবুল প্রধান আসামি। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে পুলিশ কর্মকর্তা শাহেন শাহ বলেন, তারা ঘটনার সুযোগ নিয়েছে। ব্যবসায়ী ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে কারা মাঠে ছিল, তাদের সবাইকে চিহ্নিত করা হচ্ছে। নিউমার্কেট থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ইয়ামিন কবিরের দায়ের করা এ মামলায় অজ্ঞাত আরও ২০০ থেকে ৩০০ জন ব্যবসায়ী ও কর্মচারী এবং ৫০০ থেকে ৬০০ জন শিক্ষার্থীকে আসামি করা হয়েছে। দোকান মালিকরা বলছেন, সেদিন ইফতারের টেবিল সাজানো নিয়ে ওয়েলকাম ও ক্যাপিটাল ফাস্টফুডের কর্মীদের বচসার এক পর্যায়ে এক পক্ষ ঢাকা কলেজ ছাত্রাবাস থেকে ছাত্রলীগের কয়েক কর্মীকে ডেকে আনে। তারা গিয়ে মারধরের শিকার হওয়ার পর ছাত্রাবাসে ফিরে আরও শিক্ষার্থীদের নিয়ে মধ্যরাতে নিউ মার্কেটে হামলা চালাতে গেলে বাঁধে সংঘর্ষ।

সংঘর্ষের শুরুতে দোকানের সিসি ক্যামেরার একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। সেখানে তিনজন ছাত্রলীগ কর্মীর নাম বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এসেছে। এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে অতিরিক্ত কমিশনার শাহেন শাহ বলেন, দুই পক্ষের অনেকেই চিহ্নিত হয়েছেন। তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পরে জানতে পারবেন। সোমবার মধ্যরাতে সংঘর্ষ শুরুর পর পুলিশ টিয়ার শেল ছুড়ে দুই পক্ষকে সরিয়ে দেয়। পরদিন সকালে আবার ওই এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়, তাতে আহত হন অর্ধশতাধিক। পরে তাদের মধ্যে দুইজনের মৃত্যু হয়। সংঘর্ষের সময় অনেকেকে হেলমেট মাথায় মারামারিতে জড়াতে দেখা যায়। লাঠিসোঁটার পাশাপাশি কারও কারও হাতে দেখা যায় ধারালো অস্ত্র। ওই হেলমেটধারীরা কারা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সংবাদমাধ্যমে। এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে পুলিশ কর্মকর্তা শাহেন শাহ বলেন, শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ী দুই পক্ষেই সেদিন অনেকে হেলমেট পরে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। এর কারণ দুটি, নিজেকে নিরাপদ রাখা, আর নিজের পরিচয় গোপন রাখা। তিনি বলেন, এই এলাকায় যাদের দোকান রয়েছে, তাদের অনেকের মোটরসাইকেল আছে, ফলে হেলমেট ব্যবহার করেন। আবার শিক্ষার্থীদের অনেকেরও মোটরসাইকেল আছেন, তাদের সঙ্গেও হেলমেট থাকে। সেদিন দুপক্ষের সংঘর্ষে ইট নিক্ষেপ বেশি হয়েছে। তাই দুপক্ষেই হেলমেট ব্যবহার বেশি হয়েছে। বাইরে থেকে কেউ হেলমেট পরে ঢুকে মারামারিতে জড়িয়েছিল কিনা- এ প্রশ্নে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার বলেন, আমিতো বলেছি যে, একটি পক্ষ সুযোগ নিয়েছে। তবে যেভাবে বলা হচ্ছে হেলমেট বাহিনী’‘, বিষয়টি তা নয়, সাংবাদিকের মধ্যে অনেকেও তো হেলমেট পরেছেন। সংঘর্ষ থামাতে পুলিশ দুই দিনে ৮৮টি টিয়ার গ্যাসের শেল এবং শটগানের ২১১ রাউন্ড গুলি ছুড়েছে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।