‘এদন কষ্ট করি কি থাকা যায়’

‘বার দিন ধরি বাড়িত পানি। নলকূপ-পায়খানা তলে গেইছে। বউ-বাচ্চা নিয়া খুব বিপদে আছি। কাঁইয়োতো দেকপের আসিল না। এদন কষ্ট করি কি থাকা যায়।’ বেশ ক্ষোভ নিয়ে কথাগুলো বললেন কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের নুরানীপাড়া গ্রামের আবদুল হকের স্ত্রী রেজিয়া বেগম (৪৮)।

১৩ জনের সংসার তার। স্বামী, স্ত্রী, তিন ছেলে, তিন ছেলের বউ ও বাচ্চাসহ একান্নবর্তী পরিবার। কৃষির ওপর নির্ভর করে চলছে এই পরিবার। বোরো ধান, কাউন আর পাট আবাদ করেছিলেন। পেয়েছেন শুধু ধান। কাউন নষ্ট হয়ে গেছে। পাট বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। সেই পাট ছিঁড়ে শাক আর কচুর ডাল দিয়ে দুপুরের রান্না হয়েছে। সকালে শুকনো চিড়া আর বিস্কুট দিয়ে নাস্তা সেরেছে সবাই। দুপুরের রান্না রাতসহ কাল দুপুর পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে হবে। খাদিজা বেগম জানালেন, ‘নলকূপ ডুবি গেইছে। সেই পানি সবাই খাবার নাগছি। পায়খানা তলে গেইছে বয়ষ্ক মানুষ আর বউ-ঝিদের খুব সমস্যা হইছে।’

আবদুল হক জানালেন, ‘বাড়ির পাঁচ হাত কাছেই দুধকুমর নদ। নৌকা চলাচল করায় সেই ঢেউয়ে ঘরের বেড়া-ধারিয়া ভাঙি যাইতেছে। থকথকা কাদোর উপর খাট রাখছি শুতলে ভয় হয় কখন খাট ভাঙি পরি যাই। কোন রকমে রাইতটা পার করি।’

পাশাপাশি এরশাদুল, শুক্কুর, জব্বার আর বাচ্চুর বাড়ি। প্রতিটি বাড়ি ১০ থেকে ১২ দিন ধরে পানিবন্দী। শুক্কুরের স্ত্রী রোশনা (৩২) ছোট সিলভার কার্প মাছ রান্না করছিলেন। তিনি জানালেন, শ্বশুর-শাশুড়িসহ ৬ জনের সংসার। স্বামী গরু কেনাবেচা করে সেই লাভের টাকায় সংসার চালান। এখন বন্যা হওয়ায় গরু আমদানি কমে গেছে। ফলে পাশর্^বর্তী লালমনিরহাট জেলার বড়বাড়ি হাটে গেছেন। সন্তানসহ তিনি রান্নায় ব্যস্ত সময় পার করছিলেন। তার ছেলে আবদুল রশীদ (৯) ও সৈয়দ রাসেলকে (৭) প্রশ্ন করা হলে তারা জানায়, ‘বিয়ানোত বিস্কুট খাইছি। মেলাদিন থাকি গোস্ত খাই না। খুব খাবার মোনায়।’ রোশনার প্রতিবেশী খাদিজার (৩০) বাড়ি কিছুটা উঁচু। উঠান ভর্তি পানি। ঘরগুলোতে এখনো পানি ঢোকেনি। দুটো গরু ছিল নুরানী-ফারাজিপাড়া সড়কে রাখা হয়েছে। খাদিজা জানান, ‘গরুর খাদ্য নিয়া খুব দুশ্চিন্তায় আছি। হামরায় খাবার পাই না। গরুর খাবার কিনি কেমনে। গরু দুটা শুকি যাবার নাগছে। ‘বেটিটা পানিত সারাদিন ডুবি থাকি জ¦র হইছে। টেবলেট কিনিও দিবার পাবার নাগছি না। চারপাকে পানি বেড়ালেই কাপড় ভিজি যায়। সেই ভিজা কাপড় পরি সারাদিন চলাফিরা করি। বাড়ি বাড়ি সর্দি-কাশি ধরছে। ডাক্তারও পাওয়া যায় না। একেবারে যাত্রাপুর হাটোত গিয়ে অষুধ কিনি আনা নাগে।’ এই এলাকায় প্রায় অর্ধ শতাধিক বাড়িতে পানি উঠেছে। অনেকে রাতে সড়কে গিয়ে অবস্থান নেয়। সেই সড়কেও নেই নলকূপ ও পায়খানার ব্যবস্থা। ফলে বানভাসি মানুষ চরম ভোগান্তির মধ্যে রয়েছে।

যাত্রাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আবদুল গফুর জানান, আমার ইউনিয়নে ১৫০০ বাড়িতে পানি উঠেছে। পানিবন্দী হয়েছে আরও ৪ হাজার পরিবার। সকল পরিবারকে সহযোগতা করা সম্ভব হয়নি। আমরা প্রশাসনকে বিষয়টি জানিয়েছি।

এ ব্যাপারে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. রাসেদুল হাসান জানান, আমাদের কাছে পর্যাপ্ত ত্রাণ মজুদ রয়েছে। জনপ্রতিনিধিদের চাহিদা মোতাবেক আমরা সরবরাহ করছি। ইতোমধ্যে সদর উপজেলায় ভাঙনকবলিত ৯৪টি পরিবারের প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে মোট ১৭ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। প্রশাসন প্রতিদিন দুর্গম এলাকায় গিয়ে বন্যাকবলিতদের খোঁজ-খবর নিচ্ছে এবং জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে শুকনো খাবার বিতরণ করছে। কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল্ল্যাহ আল মামুন জানান, ব্রহ্মপুত্র ও ধরলার পানি কিছুটা কমতে শুরু করেছে। গতকাল বিকেল ৩টার সময় অনুযায়ী গত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েন্টে ৬ সেন্টিমিটার কমে গিয়ে ৫১ সেন্টিমিটার, নুনখাওয়া পয়েন্টে ৮ সেন্টিমিটার কমে গিয়ে ১৪ সেন্টিমিটার এবং ধরলার পানি সেতু পয়েন্টে এক সেন্টিমিটার কমে গিয়ে বিপদসীমার ৩৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

বৃহস্পতিবার, ২৩ জুন ২০২২ , ৯ আষাড় ১৪২৮ ২৩ জিলকদ ১৪৪৩

‘এদন কষ্ট করি কি থাকা যায়’

হুমায়ুন কবির সূর্য, কুড়িগ্রাম

‘বার দিন ধরি বাড়িত পানি। নলকূপ-পায়খানা তলে গেইছে। বউ-বাচ্চা নিয়া খুব বিপদে আছি। কাঁইয়োতো দেকপের আসিল না। এদন কষ্ট করি কি থাকা যায়।’ বেশ ক্ষোভ নিয়ে কথাগুলো বললেন কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের নুরানীপাড়া গ্রামের আবদুল হকের স্ত্রী রেজিয়া বেগম (৪৮)।

১৩ জনের সংসার তার। স্বামী, স্ত্রী, তিন ছেলে, তিন ছেলের বউ ও বাচ্চাসহ একান্নবর্তী পরিবার। কৃষির ওপর নির্ভর করে চলছে এই পরিবার। বোরো ধান, কাউন আর পাট আবাদ করেছিলেন। পেয়েছেন শুধু ধান। কাউন নষ্ট হয়ে গেছে। পাট বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। সেই পাট ছিঁড়ে শাক আর কচুর ডাল দিয়ে দুপুরের রান্না হয়েছে। সকালে শুকনো চিড়া আর বিস্কুট দিয়ে নাস্তা সেরেছে সবাই। দুপুরের রান্না রাতসহ কাল দুপুর পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে হবে। খাদিজা বেগম জানালেন, ‘নলকূপ ডুবি গেইছে। সেই পানি সবাই খাবার নাগছি। পায়খানা তলে গেইছে বয়ষ্ক মানুষ আর বউ-ঝিদের খুব সমস্যা হইছে।’

আবদুল হক জানালেন, ‘বাড়ির পাঁচ হাত কাছেই দুধকুমর নদ। নৌকা চলাচল করায় সেই ঢেউয়ে ঘরের বেড়া-ধারিয়া ভাঙি যাইতেছে। থকথকা কাদোর উপর খাট রাখছি শুতলে ভয় হয় কখন খাট ভাঙি পরি যাই। কোন রকমে রাইতটা পার করি।’

পাশাপাশি এরশাদুল, শুক্কুর, জব্বার আর বাচ্চুর বাড়ি। প্রতিটি বাড়ি ১০ থেকে ১২ দিন ধরে পানিবন্দী। শুক্কুরের স্ত্রী রোশনা (৩২) ছোট সিলভার কার্প মাছ রান্না করছিলেন। তিনি জানালেন, শ্বশুর-শাশুড়িসহ ৬ জনের সংসার। স্বামী গরু কেনাবেচা করে সেই লাভের টাকায় সংসার চালান। এখন বন্যা হওয়ায় গরু আমদানি কমে গেছে। ফলে পাশর্^বর্তী লালমনিরহাট জেলার বড়বাড়ি হাটে গেছেন। সন্তানসহ তিনি রান্নায় ব্যস্ত সময় পার করছিলেন। তার ছেলে আবদুল রশীদ (৯) ও সৈয়দ রাসেলকে (৭) প্রশ্ন করা হলে তারা জানায়, ‘বিয়ানোত বিস্কুট খাইছি। মেলাদিন থাকি গোস্ত খাই না। খুব খাবার মোনায়।’ রোশনার প্রতিবেশী খাদিজার (৩০) বাড়ি কিছুটা উঁচু। উঠান ভর্তি পানি। ঘরগুলোতে এখনো পানি ঢোকেনি। দুটো গরু ছিল নুরানী-ফারাজিপাড়া সড়কে রাখা হয়েছে। খাদিজা জানান, ‘গরুর খাদ্য নিয়া খুব দুশ্চিন্তায় আছি। হামরায় খাবার পাই না। গরুর খাবার কিনি কেমনে। গরু দুটা শুকি যাবার নাগছে। ‘বেটিটা পানিত সারাদিন ডুবি থাকি জ¦র হইছে। টেবলেট কিনিও দিবার পাবার নাগছি না। চারপাকে পানি বেড়ালেই কাপড় ভিজি যায়। সেই ভিজা কাপড় পরি সারাদিন চলাফিরা করি। বাড়ি বাড়ি সর্দি-কাশি ধরছে। ডাক্তারও পাওয়া যায় না। একেবারে যাত্রাপুর হাটোত গিয়ে অষুধ কিনি আনা নাগে।’ এই এলাকায় প্রায় অর্ধ শতাধিক বাড়িতে পানি উঠেছে। অনেকে রাতে সড়কে গিয়ে অবস্থান নেয়। সেই সড়কেও নেই নলকূপ ও পায়খানার ব্যবস্থা। ফলে বানভাসি মানুষ চরম ভোগান্তির মধ্যে রয়েছে।

যাত্রাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আবদুল গফুর জানান, আমার ইউনিয়নে ১৫০০ বাড়িতে পানি উঠেছে। পানিবন্দী হয়েছে আরও ৪ হাজার পরিবার। সকল পরিবারকে সহযোগতা করা সম্ভব হয়নি। আমরা প্রশাসনকে বিষয়টি জানিয়েছি।

এ ব্যাপারে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. রাসেদুল হাসান জানান, আমাদের কাছে পর্যাপ্ত ত্রাণ মজুদ রয়েছে। জনপ্রতিনিধিদের চাহিদা মোতাবেক আমরা সরবরাহ করছি। ইতোমধ্যে সদর উপজেলায় ভাঙনকবলিত ৯৪টি পরিবারের প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে মোট ১৭ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। প্রশাসন প্রতিদিন দুর্গম এলাকায় গিয়ে বন্যাকবলিতদের খোঁজ-খবর নিচ্ছে এবং জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে শুকনো খাবার বিতরণ করছে। কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল্ল্যাহ আল মামুন জানান, ব্রহ্মপুত্র ও ধরলার পানি কিছুটা কমতে শুরু করেছে। গতকাল বিকেল ৩টার সময় অনুযায়ী গত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েন্টে ৬ সেন্টিমিটার কমে গিয়ে ৫১ সেন্টিমিটার, নুনখাওয়া পয়েন্টে ৮ সেন্টিমিটার কমে গিয়ে ১৪ সেন্টিমিটার এবং ধরলার পানি সেতু পয়েন্টে এক সেন্টিমিটার কমে গিয়ে বিপদসীমার ৩৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।