দুর্নীতি, ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এবং তার পূর্বাপর

২০০১ সালে মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতুর ভিত্তিস্থাপন করেছিলেন শেখ হাসিনা। এরপর এই সেতু নিয়ে তেমন অগ্রগতি হয়নি। সেতুটি মাওয়ায় হবে, না কি পাটুরিয়ায় হবে তা নিয়েও অঞ্চলবাসীর মধ্যে বিভেদ দেখা দেয়। ২০০৪ সালে জাইকা একটি সমীক্ষা চালিয়ে মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টে সেতু নির্মাণের পরামর্শ দেয়।

সেতুর বিষয়ে কিছুদিন আলোচনা বন্ধ ছিল। এরপর ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে এই সেতু নির্মাণের আলোচনা নতুন করে শুরু হয় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সহায়তায়। তখন একনেকে অনুমোদিত প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা (শুধু সড়ক পথে যানবাহন চলাচলের জন্য)। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার সরকার দায়িত্ব নিয়ে নতুন আঙ্গিকে সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা করে। সিদ্ধান্ত হয়, সড়ক ও রেল উভয় যান পারাপার হবে এই সেতুতে। উপরে চলবে গাড়ি ও নিচে ট্রেন।

কয়েক দফায় ব্যয় বাড়ানোর পর ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকায় পদ্মা বহুমুখী সেতু সংশোধিত নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন করে একনেক। এর আগেই নিশ্চিত করা হয় ঋণদাতাদের প্রতিশ্রুতি। এডিবি প্রধান উদ্যোক্তা হলেও সবচেয়ে বেশি ঋণ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পে ‘প্রধান অর্থদাতা’ হিসেবে যুক্ত হয় বিশ্বব্যাংক।

এরই মধ্যে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ উঠার খবর পাওয়া যায় আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে। তখন কানাডা পুলিশ এসএনসি লাভালিনের দুই কর্মকর্তাকে বাংলাদেশের কয়েকজন কর্মকর্তাকে ঘুষ দেয়ার প্রস্তাবের অভিযোগে গ্রেপ্তার করে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে পরামর্শক হিসেবে প্রাকযোগ্য তালিকায় থাকা পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের একটি ছিল কানাডাভিত্তিক লাভালিন। মূল্যায়ন কমিটির মনোনীত এই পাঁচ প্রতিষ্ঠান থেকে একটিকে নির্বাচিত করার কথা ছিল বিশ্বব্যাংকের।

বিশ্বব্যাংক জানায়, পদ্মা সেতু প্রকল্পের দরপত্র প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির অভিযোগে তাদের কাছ থেকে তথ্য পেয়ে এ তদন্ত শুরু করেছে কানাডীয় কর্তৃপক্ষ। রয়্যাল কানাডীয় পুলিশ লাভালিনের আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ শাহ এবং পরিচালক মোহাম্মদ ইসমাইলকে গ্রেপ্তার করে। মামলাও হয় তাদের বিরুদ্ধে। পরে বাংলাদেশের মামলায়ও আসামি করা হয়েছিল এই দুজনকে। এরপরই এই প্রকল্পে অর্থায়ন স্থগিত করলো বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি জানায়, ‘দুর্নীতির’ তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোন সিদ্ধান্ত তারা নেবে না।

এরপর কিছু দিন চলে যায়। বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ তোলার পর সরকারের পক্ষ থেকে তা বারবারই নাকচ করা হচ্ছিল। এই নিয়ে টানাপোড়েনের মধ্যে ২০১২ সালের ২৯ জুন পদ্মা প্রকল্পে অর্থায়নের সিদ্ধান্ত বাতিল করে বিশ্বব্যাংক। চুক্তি বাতিলের পক্ষে বিশ্বব্যাংক যুক্তি দেখায়, এই প্রকল্পে বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির ‘বিশ্বাসযোগ্য’ প্রমাণ মিলেছে।

‘দুর্নীতির’ বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারকে জানানো হয়েছিল জানিয়ে এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ সরকারের যথাযথ সাড়া না মেলায় প্রকল্পে অর্থায়ন বাতিল করা হয়েছে।’ ঋণ বাতিলের সিদ্ধান্ত বদলানোর বিষয়ে দুর্নীতির অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মাধ্যমে তদন্তের শর্ত দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক। তখন তদন্ত এবং প্রকল্পের কাজ একসঙ্গে চালাতে সরকার চাইলেও ২০১২ সালের ২ ডিসেম্বর বিশ্বব্যাংক সাফ জানিয়ে দেয়, ‘মামলা না হলে ঋণ মিলবে না’।

তখন দেশে এই প্রকল্প নিয়ে নানা আলোচনা সমালোচনা শুরু হয়। এর মধ্যেই মন্ত্রীর পদ ছাড়েন সৈয়দ আবুল হোসেন। দুর্নীতির অভিযোগ উঠার পর তাকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। এরপর ছুটিতে যান সেতু বিভাগের তৎকালীন সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া এবং প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মসিউর রহমান।

এরপর প্রাথমিক অনুসন্ধানের পর ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে দুদক জানিয়েছিল, ‘মূল সেতু নির্মাণে প্রাকযোগ্য প্রতিষ্ঠান নির্বাচনে কোন রকম দুর্নীতি হয়নি’। তবে বিশ্বব্যাংকের তাগিদে ‘ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগে দুদক কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল জাহিদ ২০১২ সালের ১৭ ডিসেম্বর বনানী থানায় একটি মামলা করেন, যাতে সেতু বিভাগের তখনকার সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে প্রধান আসামি করে সাতজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল।

মামলার আগে অভিযোগ অনুসন্ধানে মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী, জাতীয় সংসদের হুইপ নূরে আলম চৌধুরীর ভাই নিক্সন চৌধুরী, সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া, এসএনসি-লাভালিনের বাংলাদেশ প্রতিনিধি জিয়াউল হকসহ ২৯ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক কর্মকর্তারা।

এর মধ্যে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ব ব্যাংককে বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে এই বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের ঘোষণা সরকার দিলে পরের বছরের সেপ্টেম্বরে দুদক ওই মামলায় আসামিদের অব্যাহতি দেয়। দুদকের পক্ষ থেকে বলা হয়, পদ্মা সেতু নির্মাণে ‘দুর্নীতি বা ষড়যন্ত্রের প্রমাণ পাওয়া যায়নি’।

এরপর একই বছরের অক্টোবরে দুদকের চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে পদ্মা সেতু দুর্নীতি মামলায় সাত আসামির সবাইকে অব্যাহতির আদেশ দেয় আদালত। এ মামলায় মোশাররফ হোসেন গ্রেপ্তার হওয়ার পাশাপাশি সরকারি চাকরি থেকেও সাময়িক বরখাস্ত হয়েছিলেন। পরে তিনি মুক্তি পান। ২০১৩ সালের জুনে বরখাস্তের আদেশও প্রত্যাহার করে তাকে চাকরি ফিরিয়ে দেয়া হয়।

ছয় বছর বিচারিক প্রক্রিয়ার পর পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের প্রমাণ না পাওয়ার কথা জানায় কানাডার আদালত। ২০১৭ সালে এই মামলার তিন আসামিকে কানাডার আদালত খালাস দেয়।

বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বাতিলের ঘোষণা এলে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায় বাংলাদেশ সরকার। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ওয়াশিংটনভিত্তিক বহুজাতিক এই সংস্থার সমালোচনা আসে। তখনই ২০১২ সালের ৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে প্রয়োজনে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত জানান।

নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর ঘোষণা পর বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা টাকা তুলতে থাকে। সংসদ সদস্য, সরকারি কর্মকর্তা, সাধারণ মানুষসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি মেলে সহায়তার। অনুদান দেয়ার সুযোগ রেখে ওই বছরেই দুটি ব্যাংক হিসাব খোলা হয়। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংগঠনগুলো একদিনের বেতনের সমপরিমাণ অর্থ অনুদান হিসেবে দেয়ার ঘোষণা দেয়। তবে এ পদ্ধতিতে অর্থ সংগ্রহে সরকার আগ্রহ দেখায়নি। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ এগিয়ে নিতে বাজেট থেকে বরাদ্দ দিতে শুরু করে সরকার।

এই প্রকল্পে প্রথম অর্থ বরাদ্দ আসে ২০১৩-২০১৪ অর্থবছর থেকে। এর আগে ২০১৩ সালের ৩১ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্বব্যাংককে জানিয়ে দেয়া হয়, এই প্রকল্পের জন্য তাদের ঋণ নেয়া হবে না। পদ্মা সেতুর নকশা ঠিক রেখেই এরপর শুরু হয় সেতু নির্মাণের বাকি কাজগুলো। ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেটে সরকার পদ্মা সেতুর জন্য বরাদ্দ দেয় প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। পরের বছরগুলোতেও প্রয়োজন অনুযায়ী বরাদ্দ দিয়ে গেছে সরকার। ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে মূল সেতুর নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তবে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সমালোচনা উঠে দেশের ভেতরে, অনেক অর্থনীতিবিদ প্রশ্ন তুলেন। তারা বলেন, ‘নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু করলে দেশ তারল্য সংকট পড়বে, ব্যাংকে টাকা কমে যাবে, প্রাইভেট সেক্টরে বিনিয়োগ কমে যাবে।’

এমন আরও নানা সমালোচনা করা হয়। তবে সবার সমালোচনা এক রকম ছিল না। কোন কোন অর্থনীতিবিদ এর পক্ষেও কথা বলেছিলেন।

শনিবার, ২৫ জুন ২০২২ , ১১ আষাড় ১৪২৮ ২৫ জিলকদ ১৪৪৩

দুর্নীতি, ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এবং তার পূর্বাপর

রেজাউল করিম

২০০১ সালে মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতুর ভিত্তিস্থাপন করেছিলেন শেখ হাসিনা। এরপর এই সেতু নিয়ে তেমন অগ্রগতি হয়নি। সেতুটি মাওয়ায় হবে, না কি পাটুরিয়ায় হবে তা নিয়েও অঞ্চলবাসীর মধ্যে বিভেদ দেখা দেয়। ২০০৪ সালে জাইকা একটি সমীক্ষা চালিয়ে মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টে সেতু নির্মাণের পরামর্শ দেয়।

সেতুর বিষয়ে কিছুদিন আলোচনা বন্ধ ছিল। এরপর ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে এই সেতু নির্মাণের আলোচনা নতুন করে শুরু হয় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সহায়তায়। তখন একনেকে অনুমোদিত প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা (শুধু সড়ক পথে যানবাহন চলাচলের জন্য)। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার সরকার দায়িত্ব নিয়ে নতুন আঙ্গিকে সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা করে। সিদ্ধান্ত হয়, সড়ক ও রেল উভয় যান পারাপার হবে এই সেতুতে। উপরে চলবে গাড়ি ও নিচে ট্রেন।

কয়েক দফায় ব্যয় বাড়ানোর পর ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকায় পদ্মা বহুমুখী সেতু সংশোধিত নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন করে একনেক। এর আগেই নিশ্চিত করা হয় ঋণদাতাদের প্রতিশ্রুতি। এডিবি প্রধান উদ্যোক্তা হলেও সবচেয়ে বেশি ঋণ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পে ‘প্রধান অর্থদাতা’ হিসেবে যুক্ত হয় বিশ্বব্যাংক।

এরই মধ্যে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ উঠার খবর পাওয়া যায় আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে। তখন কানাডা পুলিশ এসএনসি লাভালিনের দুই কর্মকর্তাকে বাংলাদেশের কয়েকজন কর্মকর্তাকে ঘুষ দেয়ার প্রস্তাবের অভিযোগে গ্রেপ্তার করে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে পরামর্শক হিসেবে প্রাকযোগ্য তালিকায় থাকা পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের একটি ছিল কানাডাভিত্তিক লাভালিন। মূল্যায়ন কমিটির মনোনীত এই পাঁচ প্রতিষ্ঠান থেকে একটিকে নির্বাচিত করার কথা ছিল বিশ্বব্যাংকের।

বিশ্বব্যাংক জানায়, পদ্মা সেতু প্রকল্পের দরপত্র প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির অভিযোগে তাদের কাছ থেকে তথ্য পেয়ে এ তদন্ত শুরু করেছে কানাডীয় কর্তৃপক্ষ। রয়্যাল কানাডীয় পুলিশ লাভালিনের আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ শাহ এবং পরিচালক মোহাম্মদ ইসমাইলকে গ্রেপ্তার করে। মামলাও হয় তাদের বিরুদ্ধে। পরে বাংলাদেশের মামলায়ও আসামি করা হয়েছিল এই দুজনকে। এরপরই এই প্রকল্পে অর্থায়ন স্থগিত করলো বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি জানায়, ‘দুর্নীতির’ তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোন সিদ্ধান্ত তারা নেবে না।

এরপর কিছু দিন চলে যায়। বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ তোলার পর সরকারের পক্ষ থেকে তা বারবারই নাকচ করা হচ্ছিল। এই নিয়ে টানাপোড়েনের মধ্যে ২০১২ সালের ২৯ জুন পদ্মা প্রকল্পে অর্থায়নের সিদ্ধান্ত বাতিল করে বিশ্বব্যাংক। চুক্তি বাতিলের পক্ষে বিশ্বব্যাংক যুক্তি দেখায়, এই প্রকল্পে বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির ‘বিশ্বাসযোগ্য’ প্রমাণ মিলেছে।

‘দুর্নীতির’ বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারকে জানানো হয়েছিল জানিয়ে এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ সরকারের যথাযথ সাড়া না মেলায় প্রকল্পে অর্থায়ন বাতিল করা হয়েছে।’ ঋণ বাতিলের সিদ্ধান্ত বদলানোর বিষয়ে দুর্নীতির অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মাধ্যমে তদন্তের শর্ত দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক। তখন তদন্ত এবং প্রকল্পের কাজ একসঙ্গে চালাতে সরকার চাইলেও ২০১২ সালের ২ ডিসেম্বর বিশ্বব্যাংক সাফ জানিয়ে দেয়, ‘মামলা না হলে ঋণ মিলবে না’।

তখন দেশে এই প্রকল্প নিয়ে নানা আলোচনা সমালোচনা শুরু হয়। এর মধ্যেই মন্ত্রীর পদ ছাড়েন সৈয়দ আবুল হোসেন। দুর্নীতির অভিযোগ উঠার পর তাকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। এরপর ছুটিতে যান সেতু বিভাগের তৎকালীন সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া এবং প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মসিউর রহমান।

এরপর প্রাথমিক অনুসন্ধানের পর ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে দুদক জানিয়েছিল, ‘মূল সেতু নির্মাণে প্রাকযোগ্য প্রতিষ্ঠান নির্বাচনে কোন রকম দুর্নীতি হয়নি’। তবে বিশ্বব্যাংকের তাগিদে ‘ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগে দুদক কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল জাহিদ ২০১২ সালের ১৭ ডিসেম্বর বনানী থানায় একটি মামলা করেন, যাতে সেতু বিভাগের তখনকার সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে প্রধান আসামি করে সাতজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল।

মামলার আগে অভিযোগ অনুসন্ধানে মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী, জাতীয় সংসদের হুইপ নূরে আলম চৌধুরীর ভাই নিক্সন চৌধুরী, সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া, এসএনসি-লাভালিনের বাংলাদেশ প্রতিনিধি জিয়াউল হকসহ ২৯ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক কর্মকর্তারা।

এর মধ্যে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ব ব্যাংককে বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে এই বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের ঘোষণা সরকার দিলে পরের বছরের সেপ্টেম্বরে দুদক ওই মামলায় আসামিদের অব্যাহতি দেয়। দুদকের পক্ষ থেকে বলা হয়, পদ্মা সেতু নির্মাণে ‘দুর্নীতি বা ষড়যন্ত্রের প্রমাণ পাওয়া যায়নি’।

এরপর একই বছরের অক্টোবরে দুদকের চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে পদ্মা সেতু দুর্নীতি মামলায় সাত আসামির সবাইকে অব্যাহতির আদেশ দেয় আদালত। এ মামলায় মোশাররফ হোসেন গ্রেপ্তার হওয়ার পাশাপাশি সরকারি চাকরি থেকেও সাময়িক বরখাস্ত হয়েছিলেন। পরে তিনি মুক্তি পান। ২০১৩ সালের জুনে বরখাস্তের আদেশও প্রত্যাহার করে তাকে চাকরি ফিরিয়ে দেয়া হয়।

ছয় বছর বিচারিক প্রক্রিয়ার পর পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের প্রমাণ না পাওয়ার কথা জানায় কানাডার আদালত। ২০১৭ সালে এই মামলার তিন আসামিকে কানাডার আদালত খালাস দেয়।

বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বাতিলের ঘোষণা এলে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায় বাংলাদেশ সরকার। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ওয়াশিংটনভিত্তিক বহুজাতিক এই সংস্থার সমালোচনা আসে। তখনই ২০১২ সালের ৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে প্রয়োজনে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত জানান।

নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর ঘোষণা পর বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা টাকা তুলতে থাকে। সংসদ সদস্য, সরকারি কর্মকর্তা, সাধারণ মানুষসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি মেলে সহায়তার। অনুদান দেয়ার সুযোগ রেখে ওই বছরেই দুটি ব্যাংক হিসাব খোলা হয়। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংগঠনগুলো একদিনের বেতনের সমপরিমাণ অর্থ অনুদান হিসেবে দেয়ার ঘোষণা দেয়। তবে এ পদ্ধতিতে অর্থ সংগ্রহে সরকার আগ্রহ দেখায়নি। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ এগিয়ে নিতে বাজেট থেকে বরাদ্দ দিতে শুরু করে সরকার।

এই প্রকল্পে প্রথম অর্থ বরাদ্দ আসে ২০১৩-২০১৪ অর্থবছর থেকে। এর আগে ২০১৩ সালের ৩১ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্বব্যাংককে জানিয়ে দেয়া হয়, এই প্রকল্পের জন্য তাদের ঋণ নেয়া হবে না। পদ্মা সেতুর নকশা ঠিক রেখেই এরপর শুরু হয় সেতু নির্মাণের বাকি কাজগুলো। ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেটে সরকার পদ্মা সেতুর জন্য বরাদ্দ দেয় প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। পরের বছরগুলোতেও প্রয়োজন অনুযায়ী বরাদ্দ দিয়ে গেছে সরকার। ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে মূল সেতুর নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তবে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সমালোচনা উঠে দেশের ভেতরে, অনেক অর্থনীতিবিদ প্রশ্ন তুলেন। তারা বলেন, ‘নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু করলে দেশ তারল্য সংকট পড়বে, ব্যাংকে টাকা কমে যাবে, প্রাইভেট সেক্টরে বিনিয়োগ কমে যাবে।’

এমন আরও নানা সমালোচনা করা হয়। তবে সবার সমালোচনা এক রকম ছিল না। কোন কোন অর্থনীতিবিদ এর পক্ষেও কথা বলেছিলেন।