২৪ বছর পর নায়ক সোহেল হত্যা মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু

দীর্ঘদিন মামলার নথির খোঁজ পাচ্ছিল না, রিটের পর উদ্ধার

চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যাকা-ের প্রায় ২৪ বছর পর এই হত্যা মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে। গতকাল মামলার বাদী সোহেলের ভাই তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী সাক্ষ্য দিয়েছেন। ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২ এর বিচারক জাকির হোসেন এই সাক্ষীর জবানবন্দি রেকর্ড করেন। এ সময় আদালতের কাছে ন্যায়বিচার চেয়েছেন বাদী। জবানবন্দিতে সোহেল চৌধুরীর ভাই তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘১৯৯৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর ভোররাতে আমার ভাই চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরীকে বনানীর ট্রাম্পস ক্লাবের কলাপসিবল গেটের সামনে কতিপয় আঁততায়ী গুলি করে হত্যা করে। এই হত্যাকা-ের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিচার চাই।’

তিনি বলেন, ১৯৯৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর রাত ৪টার সময় বেবিটেক্সিযোগে সোহেল চৌধুরীর গাড়িচালক সেলিম গুলশানের বাসায় আসেন। বাসার দারোয়ানকে জানান, বনানীর ১৪ নম্বর রোডের আবেদীন টাওয়ারের নিচে সোহেল চৌধুরীকে কতিপয় আঁততায়ী গুলি করেছে। দারোয়ান তৌহিদুল ইসলামকে জানালে তৌহিদুল ইসলাম ঘটনাস্থলে যান। সেখানে গিয়ে তিনি জানতে পারেন সোহেল চৌধুরীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গিয়ে তিনি সোহেল চৌধুরীকে দেখতে পান। কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে জানান, সোহেল চৌধুরী মারা গেছেন। পোস্টমর্টেম শেষে তার মরদেহ হস্তান্তর করা হবে। সোহেল চৌধুরীর গাড়িরচালক সেলিম তাকে জানান, সোহেল চৌধুরীর সঙ্গে আরও দুজন সঙ্গী ছিলেন। তারা ট্রাম্পস ক্লাবে ঢুকতে চাইলে কয়েকজন আঁততায়ী তাদের বাধা দেয়। প্রথমে কালামকে দুটি গুলি করে একজন আঁততায়ী। সোহেল চৌধুরী বাধা দিতে গেলে তাকেও গুলি করা হয়।

জবানবন্দিতে তিনি আরও বলেন, তিনি সেলিমের কাছে জানতে পারেন, আঁততায়ীরা গুলি করে পালানোর সময় এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। এ সময় ট্রাম্পস ক্লাবের আরও দুজন কর্মচারী আহত হন। এক পর্যায়ে আশপাশের লোকজন ও ঘটনাস্থলে আসা পুলিশ আদনান সিদ্দিকী নামে এক আঁততায়ীকে আটক করে। ঘটনা বিস্তারিত শুনে তিনি ওইদিনই গুলশান থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। ময়নাতদন্ত শেষে তিনি সোহেল চৌধুরীর মরদেহ হাসপাতাল থেকে গ্রহণ করেন।

বাদীর জবানবন্দি শেষ হওয়ার পর আসামি আদনান সিদ্দিকী ও সানজিদুল ইসলাম ইমনের পক্ষে আইনজীবী ফারুক আহমেদ জেরা করেন বলে জানান আদালতের স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) সৈয়দ শামসুল হক। শুনানি উপলক্ষে এদিন কারাগার থেকে মামলার আসামি আশীষ রায় চৌধুরী, সানজিদুল ইসলাম ইমন ও তারিক সাঈদ মামুনকে আদালতে হাজির করা হয়। এছাড়া জামিনে থাকা আসামি ফারুক আব্বাসীও আদালতে হাজির হয়েছেন।

১৯৯৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর গভীর রাতে বনানীর ট্রামস ক্লাবের নিচে সোহেলকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ১৯৯৯ সালের ৩০ জুলাই ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী পুলিশ কমিশনার আবুল কাশেম ব্যাপারী ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাইসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন। বিতর্কিত ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে বাদানুবাদই এ হত্যার নেপথ্য কারণ বলে মামলার অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়।

দীর্ঘদিন ধরে এই মামলার নথি গায়েব হয়েছিল। গত ২৩ জানুয়ারি গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে নথি খুঁজে বের করার দাবিতে রিট আবেদন হয়। পরে নথি পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে মামলার বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু এই মামলার কেস ডকেট (সিডি) খুঁজে না পাওয়ায় কয়েক মাস অতিবাহিত হয়। শেষ পর্যন্ত কেস ডাকেট ছাড়াই সাক্ষ্যগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয় ট্রাইব্যুনাল।

পরে গত ২০ জুলাই সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করা হয়। এরপর সাক্ষী হাজির না হওয়ায় ২২, ২৩ ও ২৪ আগস্ট পরপর তিন দিন তারিখ ধার্য করা হয়। ওই সময় আসামির পক্ষ থেকে মামলাটি দায়রা আদালতে ফেরত পাঠানোর আবেদন জানানো হয়। গত ২৪ আগস্ট ট্রাইব্যুনাল আসামিপক্ষের ওই আবেদন নামঞ্জুর করেন।

জানা গেছে, ২০০৫ সালের ২ জুন তৎকালীন ডিবির এসআই ফরিদ উদ্দিন কেস ডকেট গ্রহণ করেন। গত ১১ এপ্রিল ফরিদ উদ্দিনকে কেস ডকেটের বিষয়ে অবহিত করার জন্য ট্রাইব্যুনালের নির্দেশ দেন। সবশেষ গত ১৫ জুন মামলার কেস ডকেট সমন্বয় করে ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপনের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল সরকারি কৌঁসুলিদের।

এই মামলায় আসামি আদনান সিদ্দিকী ও ফারুক আব্বাসী জামিনে আছেন। আশীষ রায় চৌধুরী ওরফে বোতল চৌধুরী, সাজিদুল ইসলাম ও তারিক সাঈদ মামুন কারাগারে আছেন। আসামি হারুন অর রশীদ ওরফে লেদার লিটন, ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাই ওরফে আবদুল আজিজ, ট্রাম্পস ক্লাবের মালিক আফাকুল ইসলাম ওরফে বান্টি ইসলাম ও সেলিম খান পলাতক রয়েছেন।

সোমবার, ২৯ আগস্ট ২০২২ , ১৪ ভাদ্র ১৪২৯ ১ সফর ১৪৪৪

২৪ বছর পর নায়ক সোহেল হত্যা মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু

দীর্ঘদিন মামলার নথির খোঁজ পাচ্ছিল না, রিটের পর উদ্ধার

image

চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যাকা-ের প্রায় ২৪ বছর পর এই হত্যা মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে। গতকাল মামলার বাদী সোহেলের ভাই তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী সাক্ষ্য দিয়েছেন। ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২ এর বিচারক জাকির হোসেন এই সাক্ষীর জবানবন্দি রেকর্ড করেন। এ সময় আদালতের কাছে ন্যায়বিচার চেয়েছেন বাদী। জবানবন্দিতে সোহেল চৌধুরীর ভাই তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘১৯৯৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর ভোররাতে আমার ভাই চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরীকে বনানীর ট্রাম্পস ক্লাবের কলাপসিবল গেটের সামনে কতিপয় আঁততায়ী গুলি করে হত্যা করে। এই হত্যাকা-ের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিচার চাই।’

তিনি বলেন, ১৯৯৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর রাত ৪টার সময় বেবিটেক্সিযোগে সোহেল চৌধুরীর গাড়িচালক সেলিম গুলশানের বাসায় আসেন। বাসার দারোয়ানকে জানান, বনানীর ১৪ নম্বর রোডের আবেদীন টাওয়ারের নিচে সোহেল চৌধুরীকে কতিপয় আঁততায়ী গুলি করেছে। দারোয়ান তৌহিদুল ইসলামকে জানালে তৌহিদুল ইসলাম ঘটনাস্থলে যান। সেখানে গিয়ে তিনি জানতে পারেন সোহেল চৌধুরীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গিয়ে তিনি সোহেল চৌধুরীকে দেখতে পান। কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে জানান, সোহেল চৌধুরী মারা গেছেন। পোস্টমর্টেম শেষে তার মরদেহ হস্তান্তর করা হবে। সোহেল চৌধুরীর গাড়িরচালক সেলিম তাকে জানান, সোহেল চৌধুরীর সঙ্গে আরও দুজন সঙ্গী ছিলেন। তারা ট্রাম্পস ক্লাবে ঢুকতে চাইলে কয়েকজন আঁততায়ী তাদের বাধা দেয়। প্রথমে কালামকে দুটি গুলি করে একজন আঁততায়ী। সোহেল চৌধুরী বাধা দিতে গেলে তাকেও গুলি করা হয়।

জবানবন্দিতে তিনি আরও বলেন, তিনি সেলিমের কাছে জানতে পারেন, আঁততায়ীরা গুলি করে পালানোর সময় এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। এ সময় ট্রাম্পস ক্লাবের আরও দুজন কর্মচারী আহত হন। এক পর্যায়ে আশপাশের লোকজন ও ঘটনাস্থলে আসা পুলিশ আদনান সিদ্দিকী নামে এক আঁততায়ীকে আটক করে। ঘটনা বিস্তারিত শুনে তিনি ওইদিনই গুলশান থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। ময়নাতদন্ত শেষে তিনি সোহেল চৌধুরীর মরদেহ হাসপাতাল থেকে গ্রহণ করেন।

বাদীর জবানবন্দি শেষ হওয়ার পর আসামি আদনান সিদ্দিকী ও সানজিদুল ইসলাম ইমনের পক্ষে আইনজীবী ফারুক আহমেদ জেরা করেন বলে জানান আদালতের স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) সৈয়দ শামসুল হক। শুনানি উপলক্ষে এদিন কারাগার থেকে মামলার আসামি আশীষ রায় চৌধুরী, সানজিদুল ইসলাম ইমন ও তারিক সাঈদ মামুনকে আদালতে হাজির করা হয়। এছাড়া জামিনে থাকা আসামি ফারুক আব্বাসীও আদালতে হাজির হয়েছেন।

১৯৯৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর গভীর রাতে বনানীর ট্রামস ক্লাবের নিচে সোহেলকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ১৯৯৯ সালের ৩০ জুলাই ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী পুলিশ কমিশনার আবুল কাশেম ব্যাপারী ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাইসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন। বিতর্কিত ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে বাদানুবাদই এ হত্যার নেপথ্য কারণ বলে মামলার অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়।

দীর্ঘদিন ধরে এই মামলার নথি গায়েব হয়েছিল। গত ২৩ জানুয়ারি গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে নথি খুঁজে বের করার দাবিতে রিট আবেদন হয়। পরে নথি পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে মামলার বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু এই মামলার কেস ডকেট (সিডি) খুঁজে না পাওয়ায় কয়েক মাস অতিবাহিত হয়। শেষ পর্যন্ত কেস ডাকেট ছাড়াই সাক্ষ্যগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয় ট্রাইব্যুনাল।

পরে গত ২০ জুলাই সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করা হয়। এরপর সাক্ষী হাজির না হওয়ায় ২২, ২৩ ও ২৪ আগস্ট পরপর তিন দিন তারিখ ধার্য করা হয়। ওই সময় আসামির পক্ষ থেকে মামলাটি দায়রা আদালতে ফেরত পাঠানোর আবেদন জানানো হয়। গত ২৪ আগস্ট ট্রাইব্যুনাল আসামিপক্ষের ওই আবেদন নামঞ্জুর করেন।

জানা গেছে, ২০০৫ সালের ২ জুন তৎকালীন ডিবির এসআই ফরিদ উদ্দিন কেস ডকেট গ্রহণ করেন। গত ১১ এপ্রিল ফরিদ উদ্দিনকে কেস ডকেটের বিষয়ে অবহিত করার জন্য ট্রাইব্যুনালের নির্দেশ দেন। সবশেষ গত ১৫ জুন মামলার কেস ডকেট সমন্বয় করে ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপনের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল সরকারি কৌঁসুলিদের।

এই মামলায় আসামি আদনান সিদ্দিকী ও ফারুক আব্বাসী জামিনে আছেন। আশীষ রায় চৌধুরী ওরফে বোতল চৌধুরী, সাজিদুল ইসলাম ও তারিক সাঈদ মামুন কারাগারে আছেন। আসামি হারুন অর রশীদ ওরফে লেদার লিটন, ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাই ওরফে আবদুল আজিজ, ট্রাম্পস ক্লাবের মালিক আফাকুল ইসলাম ওরফে বান্টি ইসলাম ও সেলিম খান পলাতক রয়েছেন।