৩৬ কোটি পাঠ্যপুস্তক সংরক্ষণের জায়গা নেই

সরকারের বিনামূল্যের ৩৬ কোটি কপি পাঠ্যবই রাখার জন্য এনসিটিবি ও মাউশি’র নিজস্ব কোন সংরক্ষণাগার নেই। এর ফলে বিতরণের এলাকার বইগুলো দু’একটি স্থানে রাখা হয়, যেখান থেকে এলাকার স্কুলে স্কুলে বিতরণ করা হয়। সংরক্ষণাগার (গুদাম) না থাকায় জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের স্কুলগুলো এখন নিজেদের প্রয়োজনীয় বই ছাড়া পার্শ্ববর্তী স্কুলের বই সংরক্ষণ করতে চায় না। পাঠ্যপুস্তক সংরক্ষণ করা নিয়ে বড় ধরনের সংকটে পড়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। প্রতিবছর বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তকের চাহিদা বাড়ছে; ছাপার পরিধিও বাড়ছে। এর ফলে কাজের চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের দায়িত্বে থাকা এনসিটিবির ওপর। কিন্তু বই সংরক্ষণ নিয়ে বেকায়দায় পড়েছে সংস্থাটি।

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম প্রধান সংবাদকে বলেন, ‘প্রতিবছর আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত উপজেলায় পাঠ্যবই সংরক্ষণ রাখতে হয়। কোন স্কুলই ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহের আগে বই নিতে চায় না। এর ফলে দু’একটি স্কুলে যেখানে বই রাখা হয়, তারাও জায়গার অভাবে অন্য স্কুলের বই রাখতে চান না। নতুন সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ায় সোনারগাঁয়ে বই সংরক্ষণে সমস্যা কিছুটা মিটেছে। তবে আড়াইহাজার উপজেলায় সমস্যা হয়েছে।’

এনসিটিবি জানিয়েছে, পাঠ্যপুস্তক সংরক্ষণের সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ২০০৯-১০ সালে প্রতি উপজেলায় একটি গুদাম করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল; কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয়নি। এবার রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট ও মতিঝিল থানা, বরিশাল, ভোলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় গত বছর সরকারের পাঠ্যবই সংরক্ষণে সমস্যায় পরে এসসিটিবি। ওইসব এলাকার শিক্ষা কর্মকর্তারা গতবছর বই সংরক্ষণে সমস্যার কথা এনসিটিবিকে জানিয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নির্ধারিত সময়ে বিপুলসংখ্যক পাঠ্যবই মুদ্রণ করে সরকার প্রতিবার সাফল্য লাভ করলেও উপজেলা পর্যায়ে বই সংরক্ষণে বেশ জটিলতা তৈরি হচ্ছে। স্থান সংকুলান না হওয়ায় জেলা ও উপজেলার সরকারি হাইস্কুলগুলো এখন আর পাঠ্যবই সংরক্ষণে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এই জটিলতা এড়াতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সরাসরি অনলাইনে বইয়ের চাহিদা সংগ্রহ এবং প্রাপ্তি স্বীকারের রিপোর্ট সংগ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছে এনসিটিবি। বর্তমানে এনসিটিবির ঢাকার তেজগাঁও ও টঙ্গীতে দুটি নিজস্ব গুদামে কাগজ রাখা হয়। পাঠ্যপুস্তক রাখার জন্য এনসিটিবির কোন গুদাম নেই। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড সূত্র জানায়, প্রতিবারই ৩/৫ শতাংশ বই বেশি ছাপছে সরকার। প্রাথমিক স্তরের জন্য বাফার স্টকের (আপদকালীন মজুদ) জন্য ৪/৫ শতাংশ বই বেশি ছাপা হয়। কারণ বই ছাপার কাজ শুরু করার আগে সারাদেশের স্কুল থেকে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যানুসারে বইয়ের চাহিদাপত্র তৈরি করে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর (ডিপিই)। এতে অনেক প্রতিষ্ঠানই অনুমানের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা নিরূপণ করে; কেউ কেউ শিক্ষার্থীর সংখ্যা কিছুটা বেশিও দেখায়। সবমিলিয়ে প্রায় প্রতিবছরই গড়ে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ লাখ কপি বই অব্যবহৃত থাকে, যা দীর্ঘ সময় সংরক্ষণে রাখতে হয় স্কুলগুলোকে।

এনসিটিবির সদস্য (টেক্সট) প্রফেসর ফরহাদুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘নতুন শিক্ষাবর্ষের ৩৫ কোটি ৩২ লাখ কপি বই ছেপে সরবরাহ করতে প্রায় ১৬ হাজার ট্রাক প্রয়োজন হয়। দেশের কোন উপজেলা বা থানায় একটি বা দুটি প্রতিষ্ঠানে ওই এলাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বই সংরক্ষণের জায়গা হয় না। এজন্য আগাম বই ছেপে রাখতে বড় সমস্যা হচ্ছে। এখন এই সমস্যা সমাধানের উপায় খুঁজতে হবে।’

তিনি জানান, ‘আগাম বই ছাপতে পারলে গুণগত মান ভালো হয়। সাধারণত প্রতিবছরই আগস্টে বই মুদ্রণ ও সরবরাহ শুরু হয়। পাঁচ মাস বই সংরক্ষণ করতে হয়। কিন্তু অনেক স্কুলেই বই রাখার ভালো জায়গা না থাকায় বই নষ্ট হয়। স্কুলগুলোও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শ্রেণীকক্ষ বই রাখার জন্য ছাড়তে চায় না। অনেক সময় বাধ্য হয়ে পরিত্যক্ত ভবনেই তা রাখতে হয়। আবার ডিইওরা (জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা) অনেক সময় অতিরিক্ত বই রাখতে চান না।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলা সদরে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরে (ডিপিই) বই রাখার জন্য বড় সংরক্ষণাগার রয়েছে। এমনকি ডিপিই’র প্রধান কার্যালয়েও বই বিতরণ শাখা আছে; যাতে উপ-পরিচালক, সহকারী পরিচালকসহ তিনজন কর্মকর্তা রয়েছেন। কিন্তু সবচেয়ে বেশি ছাপা হয় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) জন্য। অথচ মাউশিতে পাঠ্যপুস্তক ব্যবস্থাপনা ও বিতরণের জন্য কোন শাখা নেই; কর্মকর্তাও নেই। ফলে বই বিতরণের ভারও সামলাতে হয় এনসিটিবিকে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মাউশি’র পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) প্রফেসর শাহেদুল খবির চৌধুরী সংবাদকে বলেন, ‘পাঠ্যপুস্তক সংরক্ষণে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বই সংরক্ষণাগার স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে।’

গত ১ জানুয়ারি থেকে চলতি ২০২০ শিক্ষাবর্ষে প্রাক-প্রাথমিক স্তর থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত প্রায় চার কোটি ৩০ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য মোট ৩৫ কোটি ৩১ লাখ ৪৪ হাজার ৫৫৪ কপি বই বিতরণ করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। কিন্তু জানুয়ারি শেষ হলেও এখন দেশের প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কিছু কিছু বই উদ্বৃত্ত রয়েছে। মাঠপর্যায়ের স্কুলগুলো উদ্বৃত্ত বইগুলো থানা/উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে ফেরত পাঠাবে। যা উপজেলা পর্যায়ের সরকারি হাইস্কুলে সংরক্ষণ রাখা হবে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের অপ্রয়োজনীয় বই রাখার দায়িত্ব গ্রহণে অনীহা দেখায়।

জানা গেছে, সারাদেশে প্রায় সাড়ে তিনশ’ সরকারি হাইস্কুল থাকলেও সরকারের পাঠ্যপুস্তকের সংরক্ষণাগার নেই। সংরক্ষণাগার থাকলে অধিকাংশ বিষয়ের বই আগাম ছাপা যেত। এতে মুদ্রাকরদের সিন্ডিকেটও এড়ানো যেত। কারণ প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বই ছাপার দরপত্র আহ্বান করতে হয়। অনেক ক্ষেত্রেই মুদ্রাকররা একচেটিয়া মুনাফার লোভে সঙ্ঘবদ্ধভাবে দরপত্রে অংশগ্রহণ করে, কখনও বর্জনেরও চেষ্টা করে। এর ফলে বিপাকে পরে এনসিটিবি।

এদিকে মাউশি ও ডিপিইর মাধ্যমে পাঠ্যপুস্তকের চাহিদার সঠিক তথ্য সংগ্রহ না হওয়ায় এখন থেকে স্কুলগুলো থেকে সরাসরি অনলাইনে বইয়ের চাহিদা সংগ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছে পাঠ্যপুস্তক বোর্ড। এজন্য এনসিটিবি প্রতি শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যপুস্তকের চাহিদা সংগ্রহ এবং প্রাপ্ত চাহিদার ভিত্তিতে মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পাঠ্যপুস্তকের মুদ্রণ ও সংশ্লিষ্ট উপজেলা/থানা/জেলা/আঞ্চলিক শিক্ষা অফিসার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পাঠ্যপুস্তক গ্রহণের প্রাপ্তি স্বীকার অনলাইনে দাখিল ও প্রয়োজনীয় রিপোর্ট প্রস্তুতের জন্য একটি ‘এপ্লিকেশন সফটওয়্যার’ প্রস্তুত করেছে।

এই এপ্লিকেশন সফটওয়্যারের ওপর মাউশি’র শিক্ষা কর্মকর্তাদের এক দিনের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে এনসিটিবি। মাউশি’র ৮টি বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক, সংশ্লিষ্ট সব জেলা ও থানা বা উপজেলা শিক্ষা অফিসারকে ওই এপ্লিকেশন সফটওয়্যারটির ব্যবহার সর্ম্পকে ধারণা দেওয়া ও মতামত গ্রহণের জন্য চারটি ধাপে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে রাজধানীর মতিঝিলস্থ পাঠ্যপুস্তক ভবনে। এর মধ্যে গত ২৯ জানুয়ারি চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহের আঞ্চলিক পরিচালক, সব জেলা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এবং ৩০ জানুয়ারি খুলনা ও রংপুর অঞ্চলের পরিচালক, জেলা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ও সিলেট অঞ্চলের পরিচালক, জেলা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এবং ৮ ফেব্রুয়ারি বরিশাল ও রাজশাহী অঞ্চলের পরিচালক, জেলা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে।

রবিবার, ০৯ ফেব্রুয়ারী ২০২০ , ২৬ মাঘ ১৪২৬, ১৪ জমাদিউল সানি ১৪৪১

এনসিটিবি

৩৬ কোটি পাঠ্যপুস্তক সংরক্ষণের জায়গা নেই

রাকিব উদ্দিন

সরকারের বিনামূল্যের ৩৬ কোটি কপি পাঠ্যবই রাখার জন্য এনসিটিবি ও মাউশি’র নিজস্ব কোন সংরক্ষণাগার নেই। এর ফলে বিতরণের এলাকার বইগুলো দু’একটি স্থানে রাখা হয়, যেখান থেকে এলাকার স্কুলে স্কুলে বিতরণ করা হয়। সংরক্ষণাগার (গুদাম) না থাকায় জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের স্কুলগুলো এখন নিজেদের প্রয়োজনীয় বই ছাড়া পার্শ্ববর্তী স্কুলের বই সংরক্ষণ করতে চায় না। পাঠ্যপুস্তক সংরক্ষণ করা নিয়ে বড় ধরনের সংকটে পড়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। প্রতিবছর বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তকের চাহিদা বাড়ছে; ছাপার পরিধিও বাড়ছে। এর ফলে কাজের চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের দায়িত্বে থাকা এনসিটিবির ওপর। কিন্তু বই সংরক্ষণ নিয়ে বেকায়দায় পড়েছে সংস্থাটি।

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম প্রধান সংবাদকে বলেন, ‘প্রতিবছর আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত উপজেলায় পাঠ্যবই সংরক্ষণ রাখতে হয়। কোন স্কুলই ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহের আগে বই নিতে চায় না। এর ফলে দু’একটি স্কুলে যেখানে বই রাখা হয়, তারাও জায়গার অভাবে অন্য স্কুলের বই রাখতে চান না। নতুন সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ায় সোনারগাঁয়ে বই সংরক্ষণে সমস্যা কিছুটা মিটেছে। তবে আড়াইহাজার উপজেলায় সমস্যা হয়েছে।’

এনসিটিবি জানিয়েছে, পাঠ্যপুস্তক সংরক্ষণের সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ২০০৯-১০ সালে প্রতি উপজেলায় একটি গুদাম করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল; কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয়নি। এবার রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট ও মতিঝিল থানা, বরিশাল, ভোলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় গত বছর সরকারের পাঠ্যবই সংরক্ষণে সমস্যায় পরে এসসিটিবি। ওইসব এলাকার শিক্ষা কর্মকর্তারা গতবছর বই সংরক্ষণে সমস্যার কথা এনসিটিবিকে জানিয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নির্ধারিত সময়ে বিপুলসংখ্যক পাঠ্যবই মুদ্রণ করে সরকার প্রতিবার সাফল্য লাভ করলেও উপজেলা পর্যায়ে বই সংরক্ষণে বেশ জটিলতা তৈরি হচ্ছে। স্থান সংকুলান না হওয়ায় জেলা ও উপজেলার সরকারি হাইস্কুলগুলো এখন আর পাঠ্যবই সংরক্ষণে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এই জটিলতা এড়াতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সরাসরি অনলাইনে বইয়ের চাহিদা সংগ্রহ এবং প্রাপ্তি স্বীকারের রিপোর্ট সংগ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছে এনসিটিবি। বর্তমানে এনসিটিবির ঢাকার তেজগাঁও ও টঙ্গীতে দুটি নিজস্ব গুদামে কাগজ রাখা হয়। পাঠ্যপুস্তক রাখার জন্য এনসিটিবির কোন গুদাম নেই। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড সূত্র জানায়, প্রতিবারই ৩/৫ শতাংশ বই বেশি ছাপছে সরকার। প্রাথমিক স্তরের জন্য বাফার স্টকের (আপদকালীন মজুদ) জন্য ৪/৫ শতাংশ বই বেশি ছাপা হয়। কারণ বই ছাপার কাজ শুরু করার আগে সারাদেশের স্কুল থেকে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যানুসারে বইয়ের চাহিদাপত্র তৈরি করে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর (ডিপিই)। এতে অনেক প্রতিষ্ঠানই অনুমানের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা নিরূপণ করে; কেউ কেউ শিক্ষার্থীর সংখ্যা কিছুটা বেশিও দেখায়। সবমিলিয়ে প্রায় প্রতিবছরই গড়ে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ লাখ কপি বই অব্যবহৃত থাকে, যা দীর্ঘ সময় সংরক্ষণে রাখতে হয় স্কুলগুলোকে।

এনসিটিবির সদস্য (টেক্সট) প্রফেসর ফরহাদুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘নতুন শিক্ষাবর্ষের ৩৫ কোটি ৩২ লাখ কপি বই ছেপে সরবরাহ করতে প্রায় ১৬ হাজার ট্রাক প্রয়োজন হয়। দেশের কোন উপজেলা বা থানায় একটি বা দুটি প্রতিষ্ঠানে ওই এলাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বই সংরক্ষণের জায়গা হয় না। এজন্য আগাম বই ছেপে রাখতে বড় সমস্যা হচ্ছে। এখন এই সমস্যা সমাধানের উপায় খুঁজতে হবে।’

তিনি জানান, ‘আগাম বই ছাপতে পারলে গুণগত মান ভালো হয়। সাধারণত প্রতিবছরই আগস্টে বই মুদ্রণ ও সরবরাহ শুরু হয়। পাঁচ মাস বই সংরক্ষণ করতে হয়। কিন্তু অনেক স্কুলেই বই রাখার ভালো জায়গা না থাকায় বই নষ্ট হয়। স্কুলগুলোও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শ্রেণীকক্ষ বই রাখার জন্য ছাড়তে চায় না। অনেক সময় বাধ্য হয়ে পরিত্যক্ত ভবনেই তা রাখতে হয়। আবার ডিইওরা (জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা) অনেক সময় অতিরিক্ত বই রাখতে চান না।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলা সদরে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরে (ডিপিই) বই রাখার জন্য বড় সংরক্ষণাগার রয়েছে। এমনকি ডিপিই’র প্রধান কার্যালয়েও বই বিতরণ শাখা আছে; যাতে উপ-পরিচালক, সহকারী পরিচালকসহ তিনজন কর্মকর্তা রয়েছেন। কিন্তু সবচেয়ে বেশি ছাপা হয় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) জন্য। অথচ মাউশিতে পাঠ্যপুস্তক ব্যবস্থাপনা ও বিতরণের জন্য কোন শাখা নেই; কর্মকর্তাও নেই। ফলে বই বিতরণের ভারও সামলাতে হয় এনসিটিবিকে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মাউশি’র পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) প্রফেসর শাহেদুল খবির চৌধুরী সংবাদকে বলেন, ‘পাঠ্যপুস্তক সংরক্ষণে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বই সংরক্ষণাগার স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে।’

গত ১ জানুয়ারি থেকে চলতি ২০২০ শিক্ষাবর্ষে প্রাক-প্রাথমিক স্তর থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত প্রায় চার কোটি ৩০ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য মোট ৩৫ কোটি ৩১ লাখ ৪৪ হাজার ৫৫৪ কপি বই বিতরণ করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। কিন্তু জানুয়ারি শেষ হলেও এখন দেশের প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কিছু কিছু বই উদ্বৃত্ত রয়েছে। মাঠপর্যায়ের স্কুলগুলো উদ্বৃত্ত বইগুলো থানা/উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে ফেরত পাঠাবে। যা উপজেলা পর্যায়ের সরকারি হাইস্কুলে সংরক্ষণ রাখা হবে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের অপ্রয়োজনীয় বই রাখার দায়িত্ব গ্রহণে অনীহা দেখায়।

জানা গেছে, সারাদেশে প্রায় সাড়ে তিনশ’ সরকারি হাইস্কুল থাকলেও সরকারের পাঠ্যপুস্তকের সংরক্ষণাগার নেই। সংরক্ষণাগার থাকলে অধিকাংশ বিষয়ের বই আগাম ছাপা যেত। এতে মুদ্রাকরদের সিন্ডিকেটও এড়ানো যেত। কারণ প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বই ছাপার দরপত্র আহ্বান করতে হয়। অনেক ক্ষেত্রেই মুদ্রাকররা একচেটিয়া মুনাফার লোভে সঙ্ঘবদ্ধভাবে দরপত্রে অংশগ্রহণ করে, কখনও বর্জনেরও চেষ্টা করে। এর ফলে বিপাকে পরে এনসিটিবি।

এদিকে মাউশি ও ডিপিইর মাধ্যমে পাঠ্যপুস্তকের চাহিদার সঠিক তথ্য সংগ্রহ না হওয়ায় এখন থেকে স্কুলগুলো থেকে সরাসরি অনলাইনে বইয়ের চাহিদা সংগ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছে পাঠ্যপুস্তক বোর্ড। এজন্য এনসিটিবি প্রতি শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যপুস্তকের চাহিদা সংগ্রহ এবং প্রাপ্ত চাহিদার ভিত্তিতে মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পাঠ্যপুস্তকের মুদ্রণ ও সংশ্লিষ্ট উপজেলা/থানা/জেলা/আঞ্চলিক শিক্ষা অফিসার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পাঠ্যপুস্তক গ্রহণের প্রাপ্তি স্বীকার অনলাইনে দাখিল ও প্রয়োজনীয় রিপোর্ট প্রস্তুতের জন্য একটি ‘এপ্লিকেশন সফটওয়্যার’ প্রস্তুত করেছে।

এই এপ্লিকেশন সফটওয়্যারের ওপর মাউশি’র শিক্ষা কর্মকর্তাদের এক দিনের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে এনসিটিবি। মাউশি’র ৮টি বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক, সংশ্লিষ্ট সব জেলা ও থানা বা উপজেলা শিক্ষা অফিসারকে ওই এপ্লিকেশন সফটওয়্যারটির ব্যবহার সর্ম্পকে ধারণা দেওয়া ও মতামত গ্রহণের জন্য চারটি ধাপে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে রাজধানীর মতিঝিলস্থ পাঠ্যপুস্তক ভবনে। এর মধ্যে গত ২৯ জানুয়ারি চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহের আঞ্চলিক পরিচালক, সব জেলা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এবং ৩০ জানুয়ারি খুলনা ও রংপুর অঞ্চলের পরিচালক, জেলা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ও সিলেট অঞ্চলের পরিচালক, জেলা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এবং ৮ ফেব্রুয়ারি বরিশাল ও রাজশাহী অঞ্চলের পরিচালক, জেলা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে।