ঐতিহ্য আর মুক্তচিন্তার সংবাদ

কাজী রোজী

এদেশের প্রগতিশীল আন্দোলন-সংগ্রাম, মুক্তচিন্তার চর্চা, ঐতিহ্যিক চেতনার লালনে যে পত্রিকাগুলো ভূমিকা রেখেছে, দৈনিক সংবাদ তার মধ্যে শীর্ষস্থানীয়। সংবাদ কখনো কারো সঙ্গে আপোস করেনি। শাসকের বন্দুকের নলে ভীত হয়নি। সে তার নিজের মতো করে অবতীর্ণ হয়েছে সাহসী ভূমিকায়। তাই আজ এত বছর ধরে, দীর্ঘ ৬৯ বছর ধরে প্রকাশিত হলেও কেউ সংবাদের গায়ে কালিমা লাগাতে পারেনি। সংবাদের নামে কুৎসা রটনা করতে পারেনি। এই পত্রিকাটির সংবাদ পরিবেশন থেকে নিত্যনতুন কলাম-ফিচার ও সাহিত্য সাময়িকী ও খেলাঘর পাতা শুরু থেকে সুনাম ও মর্যাদার সঙ্গে প্রকাশিত হয়ে আসছে। সংবাদের এই ৬৮ বছর পূর্তিতেও তার মান অক্ষুণ্ন রয়েছে।

কোন সংস্থা কিংবা কোন কার্যালয় প্রতিষ্ঠিতি হওয়ার পর যদি তা দীর্ঘকাল চলে তখন তার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্‌যাপন করা হয়। কোন পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হওয়ার পর অনুরূপভাবে যদি দীর্ঘকাল বর্তমান থাকে তাহলে তারও প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্‌যাপন করা হয়। এক্ষেত্রে যিনি সম্পাদক থাকেন তিনি যদি দীর্ঘকাল বেঁচে না থাকেন তখন তার নামটি প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

আমাদের ঐহিত্যিক সংবাদপত্রগুলোর মধ্যে আছে ইত্তেফাক, সংবাদ, অবজারভারের মতো পত্রিকা। এদের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে তাদের নাম আমরা উল্লেখ করে থাকি। ‘দৈনিক সংবাদ’ তেমনি একটি ঐতিহ্যবাহী পত্রিকা। একজন প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদকের যে বহুমাত্রিক ভূমিকা থাকে সেগুলো আমরা বছরে বছরে পরিমাপ করি। শুরু থেকেই এই পত্রিকার সম্পাদক এবং সম্পাদক মন্ডলীর অদম্য স্পৃহার কারণে পত্রিকাটি জনমানুষের কাছে বিশেষভাবে প্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। শহর-বন্দর-গ্রাম-উপশহর প্রতিটি জায়গায় এই সংবাদ প্রত্রিকাটির মূল্যায়ন আমরা লক্ষ্য করি। আজকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী লেখক, কবি ও শুভানুধ্যায়ীদের আন্তরিকতা ও সহযোগিতার কারণে বৃহৎ কলেবরে প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে।

অনেক অনেক বছর আগের কথা, সংবাদ প্রত্রিকাটির অফিস তখন বংশাল রোডে ছিল। আমার বাবা কাজী শহীদুল ইসলাম সেখানে প্রুফ সেকশনে কাজ করতেন। আমি ছোট ছিলাম। স্কুলে পড়তাম। বাবার সাইকেলে চড়ে প্রতিনিয়ত সেখানে যেতাম। অনেক বিখ্যাত লেখক, সাংবাদিক এবং কর্মকর্তাদের সমাবেশ ছিল সেখানে। আমি তখন কবিতার জগতে প্রবেশ করেছি। প্রথিতযশা সাংবাদিক রণেশ দাশগুপ্ত, লেখক সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সার, সন্তোষ গুপ্ত এবং আরো অনেক প্রসিদ্ধ সাংবাদিকদের সমাবেশ আমি সেখানে দেখেছি।

অফিসটি ছিল দোতলায়। নিচের তলায় ছাপাখানা। সীসা দিয়ে তৈরি টাইপের বর্ণগুলো সেখানে বর্তমান ছিল। সেই টাইপগুলো থেকেই কিছু কর্মচারী নিবেদিতপ্রাণ হয়ে পত্রিকাটি প্রকাশ করত। প্রুফ দেখার জন্য প্রুফ সেকশনে কিছু কাগজ পাঠিয়ে দিত। আমি মাঝে মাঝে সেগুলো হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখেছি, ছাপাখানার গন্ধ নিয়েছি, আমার খুব ভালো লাগতো। কর্মচারীদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতাম, কত রাত অব্দি কাজ করেন আপনারা? ওরা আমার শিশুকোমল প্রশ্ন শুনে হালকাভাবে জবাব দিতেন অনেক অনেক রাত অব্দি কাজ করি আমরা। ছাপাখানার শ্রমিকদের এবং কর্মচারীদের বেতন-ভাতা সম্পর্কে তেমন কোন আগ্রহ আমার হয়নি, তবে বুঝতে পারতাম তাদের এই বহুমাত্রিক কষ্টসাধ্য উপার্জন সারা মাস ধরে তারা নিয়ন্ত্রণ করতেন।

মাঝে মাঝে কবিতা হাতে নিয়ে অফিসের দোতলায় চলে যেতাম। রণেশদা বলতেন, শহীদুল্লা কায়সার আছেন, যাও তার কাছে লেখাটা নিয়ে যাও। আমি দ্রুততার সঙ্গে চলে যেতাম। শহীদ ভাইয়ের সঙ্গে গল্প করতাম। সাহিত্য সংস্কৃতি জগতের পুরধা ব্যক্তি তিনি। তার কাছ থেকে যা শুনতে পেতাম সেটাই অমূল্য সঞ্চয় হয়ে আমার ভেতরে গাঁথা থাকত।

তখন শহীদুল্লা কায়সারের ‘সংশপ্তক’, ‘রাজবন্দির রোজনামচা’ ও ‘সারেং বউ’ প্রকাশিত হয়েছিল। সংবাদে লেখা ছাপা হওয়ার পরে সম্মানী হিসেবে তেমন কিছু পেতাম না, তবে যা পেতাম তা অর্থ দিয়ে বিবেচনা করা যাবে না। শহীদ ভাই আমাকে তার রচিত অসম্ভব মূল্যমানের তিন তিনিটি বই ‘সংশপ্তক’, ‘সারেং বউ’ ও ‘রাজবন্দীর রোজনামচা’ আমাকে দিয়ে বলেছিলেন রোজী পারিশ্রমিক দিলাম না, সৌজন্য প্রীতি উপহার দিলাম। এটাই তোমার পারিশ্রমিক, আমি আজও সেই স্মৃতি ভুলতে পারিনি। শহীদ ভাই আজ আর নেই। তার স্ত্রী পান্না কায়সার আছে, আমি তার সাথে এ বিষয়টি নিয়ে বহুবার বিনিময় করেছি। পান্না আপা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে আমার এক বছরের সিনিয়র ছিলেন। তার সাথে পরিচয়ের গভীরতা অনেকাংশ ছিল আমার।

সংবাদের সাহিত্য সাময়িকী বিভাগ অত্যন্ত মর্যদাসম্পন্ন। যারাই এ বিভাগে হাত রেখেছেন সম্পাদনার জন্য তাদের প্রত্যেকের জাদুকরি স্পর্শ পত্রিকাটির মান শুধু উন্নত করেছে তাই নয়, কবি সাহিত্যিক সংস্কৃতিক জগতের একটি দৃষ্টান্ত করে রেখেছে। প্রত্যেকের নিবেদনের ভিতরে আন্তরিকতা ও ভালোবাসা এতো বেশি বর্তমান ছিল যে, সম্পাদকীয় কাঠামোতে সবকিছু মূল্যায়ন করা সম্ভব হতো না। রুচিশীল এবং বহুমাত্রিক রচনাগুলো সম্পাদক অত্যন্ত নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতেন। যে লেখাগুলো মানসম্পন্ন তেমন হতো না, সেগুলো সম্পাদকের নিকট প্রাধান্য পেত না। তিনি আবার লিখতে বলার অনুরোধ জানিয়ে তাকে শান্ত করতেন। আসলে তিনি চাইতেন মানের পরিমাপ কবি বা লেখকের কাছে সমমূল্যায়ন পাক।

সাহিত্য সাময়িকীর বর্তমান সম্পাদক কবি ওবায়েদ আকাশ আমাকে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে একটি লেখার জন্য আহ্বান জানালেন। মনে পড়ে গেল “সংবাদ”-এর সাহিত্য পাতায় লেখা ছাপা হওয়া একটি দুর্লভ এবং বিরল সম্মান। তখন সাংবাদিক বজলুর রহমান ‘সংবাদ’ এর সম্পাদক ছিলেন। তিনি লেখনি বাবদ প্রাপ্য সম্মান দিয়ে সম্মানীর মাত্রাকে অনেক বেশি সম্মানিত করেছিলেন। মনে আছে আমি তখন প্রকাশিত লেখার কিছু সম্মানী পেয়েছিলাম, কথাগুলো উল্লেখ করলাম এই কারণে, ‘সংবাদ’ আবারো ঘুরে দাঁড়াবে, লেখকের সম্মানীর প্রতি আবারো আরো বেশি সম্মান প্রদর্শন করবে।

কলেবর বড় কথা নয় মানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ঐতিহ্যের ধারক-বাহকরূপে সংস্কৃতির ধারাকে দেশের নান্দনিক সৌন্দর্য্যকে, দেশের এগিয়ে চলার মতবাদকে বিভিন্ন অর্জনের মাধ্যমে দেশ-বিদেশের কাছে সম্মানিত করার প্রেক্ষিতে নারী উন্নয়ন, ক্যানসার ও কিডনীর মতো দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসার উন্নয়ন আগামী থেকে সংবাদের পাতায় পাতায় আমরা দেখতে পাব। আমি সেই আশাই করি। “সংবাদ” আমাদের আরাধ্য, আমাদের একান্ত ভালোবাসার জায়গা। সংবাদকে স্বীয় সাধনায় উজ্জীবিত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকুক এই আমার প্রার্থনা।

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী একটি ঐতিহ্যবাহী ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এই সংখ্যাতেও বহুমাত্রিক কবি, সাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক ও রচয়িতারা তাদের মূল্যবান রচনাগুলি দ্বারা সমৃদ্ধ করবেন। ছড়াকাররাও বাদ যাবেন না হয়তো। একটি ছড়া যে সমস্ত ব্যাঙ্গের উর্ধেও সাহিত্য হতে পারে আমাদের কাছে তার নজির আছে। আমরা আন্নদা শংকর রায়ের কথা ভুলতে পারি না- “তেলের শিশি ভাঙলো বলে, খোকার উপর রাগ কর/তোমরা যে সব বুড়ো খোকা ভারত ভেঙে ভাগ করো/তার বেলা?”। আমাদের সাহিত্যে এ ধরনের ছড়াগুলো প্রাধান্য দেবার জন্য “ঘুম পাড়ানি মাসিপিসি মোদের বাড়ি এসো/খাট নেই পালঙ নেই চোখ পেতে বস” মনে করা যায়। বিশিষ্ট ছড়াকার আমাদের দাদাভাই রোকনুজ্জামান যখন লেখেন- “নোটন নোটন পায়রাগুলো ঝোটন বেঁধেছে/ও পারেতে ছেলেমেয়ে নাইতে নেমেছে/ দুই ধারে দুই রুই কাতলা ভেসে উঠেছে/ কে দেখেছে কে দেখেছে, দাদা দেখেছে/ দাদার হাতে কলম ছিল ছুড়ে মেরেছে/ উহ! বড্ড লেগেছে” এ ছাড়া অন্য একজন ছড়াকার লিখেছেন, “ও দাদাভাই মূর্তি বানাও/ বুদ্ধ, যীশু সবই বানাও/ একটি মন বানাতে পার কি”- এ ধরনের ছড়ার মালা আরো মনে করিয়ে দেয় “ঘুম আসে না বলে খোকন যাসনে ঘরের বার/ ঘুম পাড়ানি দস্যি এলে ভাঙবে না ঘুম আর।” শিশু সাহিত্যের অন্যান্য বহুমাত্রিক রচনাগুলির মধ্যে শিশু মনোতোষকে আরো আকর্ষণীয় করার জন্য অনেক ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রাণী জগতের রহস্য উন্মোচন সবই প্রতিপাদ্য হয়েছে। তবে বিশিষ্ট শিশুসাহিত্যিক এখলাসউদ্দিনের “নেংটি ইঁদুর” রচনাটি শিশু মনোতোষকে অভাবনীয়ভাবে জাগ্রত করেছে। দক্ষিণারঞ্জন মিত্রের “ঠাকুরমার ঝুলি”, “ঠাকুর দাদার থলে” আমাদের ছোটদের সাহিত্য ভান্ডারে উল্লেখযোগ্য অবদান বলে আমি মনে করি। অতএব, “দৈনিক সংবাদ” পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যাটি হাতে পেলে আমি জানি আমরা সমৃদ্ধ হব, নিজেদের অস্তিত্বকে মূল্যায়ন করতে পারব। “সংবাদ” পত্রিকাটি আমাদের প্রত্যুশলগন থেকে নিশিরাত পর্যন্ত চোখের সামনে ধরে রাখার মানসিকতা করতে পারব। জয় হোক “দৈনিক সংবাদ”-এর সকল কলাকুশলীর এবং সম্পাদকীয় মণ্ডলীর। সকল মানুষের শুভেচ্ছা। সকল শুভানুধ্যায়ী আমরা সকলে যেন তার ভিতরে থাকতে পারি।

image

শিল্পী : কাইয়ুম চৌধুরী(বাম) শিল্পী : নাজিব তারেক(ডান)

আরও খবর
৬৯ বছরে সংবাদ
ভাষা থেকে ভূখন্ড
স্মৃতিময় সংবাদ-এর ৬৯ বছর
একটি রাজনৈতিক পাঠ
সংবাদ : কিছু কথা কিছু স্মৃতি
যুগে যুগে সংবাদপত্রের অগ্রযাত্রা
আলোর তৃষ্ণায় জাগো
ইতিহাস ঐতিহ্য ও আদর্শের স্মারক দৈনিক সংবাদ
কেন লিখি
সংবাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আত্মার
আমার সংবাদ সংবাদের আমি
বিচিত্র জীবিকা বিচিত্র জীবন
ঋতুপর্ণ ঘোষের এলোমেলো দেশকাল
চীন ও বাংলাদেশ : প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সম্পর্ক
সংবাদের জলসাঘর
আমরা এখন শান্ত হয়ে আছি
মাটির মাধুর্য
কষ্টের ঢাকা স্বপ্নের বাংলাদেশ
তোমারে বধিবে যে...
বঙ্গবন্ধুর জনকল্যাণের অর্থনৈতিক নীতি কৌশল
শারহুল পটবসন্ত ও বজলুর রহমান
শিশুশিক্ষায় শিল্প-সাহিত্য-সংগীত
গণমাধ্যমের হাল-হকিকত
এবং বজলুর রহমান স্মৃতিপদক
দুর্নীতি, পেশাদারিত্ব ও উন্নয়ন
বাংলাদেশের থিয়েটার চর্চার ভবিষ্যৎ
চেতনায় নৈতিকতা মূল্যবোধ : বিরুদ্ধবাস্তবতা
সবার উপরে মানুষ সত্য
আহমদুল কবির শ্রদ্ধাঞ্জলি
কার্যকর সংসদ এবং সুশাসনের স্বপ্ন
‘সংবাদ’ আমারই ছিল আমারই আছে
আমাদের ‘সংবাদ’
নারীর অধিকার ও সচেতনতা
গণমাধ্যমে বিশ্বাস কমছে পাঠকের
নারী ও তার বিধাতা পুরুষ
বাংলাদেশের নারী
সংবাদের কাছে আমি ঋণী
বিস্মৃতিপ্রবণতা ও রাষ্ট্রের অক্ষমতা
যে দীপশিখা দিয়েছে আলো

বুধবার, ১০ জুলাই ২০১৯ , ২৬ আষাঢ় ১৪২৫, ৬ জ্বিলকদ ১৪৪০

ঐতিহ্য আর মুক্তচিন্তার সংবাদ

কাজী রোজী

image

শিল্পী : কাইয়ুম চৌধুরী(বাম) শিল্পী : নাজিব তারেক(ডান)

এদেশের প্রগতিশীল আন্দোলন-সংগ্রাম, মুক্তচিন্তার চর্চা, ঐতিহ্যিক চেতনার লালনে যে পত্রিকাগুলো ভূমিকা রেখেছে, দৈনিক সংবাদ তার মধ্যে শীর্ষস্থানীয়। সংবাদ কখনো কারো সঙ্গে আপোস করেনি। শাসকের বন্দুকের নলে ভীত হয়নি। সে তার নিজের মতো করে অবতীর্ণ হয়েছে সাহসী ভূমিকায়। তাই আজ এত বছর ধরে, দীর্ঘ ৬৯ বছর ধরে প্রকাশিত হলেও কেউ সংবাদের গায়ে কালিমা লাগাতে পারেনি। সংবাদের নামে কুৎসা রটনা করতে পারেনি। এই পত্রিকাটির সংবাদ পরিবেশন থেকে নিত্যনতুন কলাম-ফিচার ও সাহিত্য সাময়িকী ও খেলাঘর পাতা শুরু থেকে সুনাম ও মর্যাদার সঙ্গে প্রকাশিত হয়ে আসছে। সংবাদের এই ৬৮ বছর পূর্তিতেও তার মান অক্ষুণ্ন রয়েছে।

কোন সংস্থা কিংবা কোন কার্যালয় প্রতিষ্ঠিতি হওয়ার পর যদি তা দীর্ঘকাল চলে তখন তার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্‌যাপন করা হয়। কোন পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হওয়ার পর অনুরূপভাবে যদি দীর্ঘকাল বর্তমান থাকে তাহলে তারও প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্‌যাপন করা হয়। এক্ষেত্রে যিনি সম্পাদক থাকেন তিনি যদি দীর্ঘকাল বেঁচে না থাকেন তখন তার নামটি প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

আমাদের ঐহিত্যিক সংবাদপত্রগুলোর মধ্যে আছে ইত্তেফাক, সংবাদ, অবজারভারের মতো পত্রিকা। এদের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে তাদের নাম আমরা উল্লেখ করে থাকি। ‘দৈনিক সংবাদ’ তেমনি একটি ঐতিহ্যবাহী পত্রিকা। একজন প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদকের যে বহুমাত্রিক ভূমিকা থাকে সেগুলো আমরা বছরে বছরে পরিমাপ করি। শুরু থেকেই এই পত্রিকার সম্পাদক এবং সম্পাদক মন্ডলীর অদম্য স্পৃহার কারণে পত্রিকাটি জনমানুষের কাছে বিশেষভাবে প্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। শহর-বন্দর-গ্রাম-উপশহর প্রতিটি জায়গায় এই সংবাদ প্রত্রিকাটির মূল্যায়ন আমরা লক্ষ্য করি। আজকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী লেখক, কবি ও শুভানুধ্যায়ীদের আন্তরিকতা ও সহযোগিতার কারণে বৃহৎ কলেবরে প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে।

অনেক অনেক বছর আগের কথা, সংবাদ প্রত্রিকাটির অফিস তখন বংশাল রোডে ছিল। আমার বাবা কাজী শহীদুল ইসলাম সেখানে প্রুফ সেকশনে কাজ করতেন। আমি ছোট ছিলাম। স্কুলে পড়তাম। বাবার সাইকেলে চড়ে প্রতিনিয়ত সেখানে যেতাম। অনেক বিখ্যাত লেখক, সাংবাদিক এবং কর্মকর্তাদের সমাবেশ ছিল সেখানে। আমি তখন কবিতার জগতে প্রবেশ করেছি। প্রথিতযশা সাংবাদিক রণেশ দাশগুপ্ত, লেখক সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সার, সন্তোষ গুপ্ত এবং আরো অনেক প্রসিদ্ধ সাংবাদিকদের সমাবেশ আমি সেখানে দেখেছি।

অফিসটি ছিল দোতলায়। নিচের তলায় ছাপাখানা। সীসা দিয়ে তৈরি টাইপের বর্ণগুলো সেখানে বর্তমান ছিল। সেই টাইপগুলো থেকেই কিছু কর্মচারী নিবেদিতপ্রাণ হয়ে পত্রিকাটি প্রকাশ করত। প্রুফ দেখার জন্য প্রুফ সেকশনে কিছু কাগজ পাঠিয়ে দিত। আমি মাঝে মাঝে সেগুলো হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখেছি, ছাপাখানার গন্ধ নিয়েছি, আমার খুব ভালো লাগতো। কর্মচারীদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতাম, কত রাত অব্দি কাজ করেন আপনারা? ওরা আমার শিশুকোমল প্রশ্ন শুনে হালকাভাবে জবাব দিতেন অনেক অনেক রাত অব্দি কাজ করি আমরা। ছাপাখানার শ্রমিকদের এবং কর্মচারীদের বেতন-ভাতা সম্পর্কে তেমন কোন আগ্রহ আমার হয়নি, তবে বুঝতে পারতাম তাদের এই বহুমাত্রিক কষ্টসাধ্য উপার্জন সারা মাস ধরে তারা নিয়ন্ত্রণ করতেন।

মাঝে মাঝে কবিতা হাতে নিয়ে অফিসের দোতলায় চলে যেতাম। রণেশদা বলতেন, শহীদুল্লা কায়সার আছেন, যাও তার কাছে লেখাটা নিয়ে যাও। আমি দ্রুততার সঙ্গে চলে যেতাম। শহীদ ভাইয়ের সঙ্গে গল্প করতাম। সাহিত্য সংস্কৃতি জগতের পুরধা ব্যক্তি তিনি। তার কাছ থেকে যা শুনতে পেতাম সেটাই অমূল্য সঞ্চয় হয়ে আমার ভেতরে গাঁথা থাকত।

তখন শহীদুল্লা কায়সারের ‘সংশপ্তক’, ‘রাজবন্দির রোজনামচা’ ও ‘সারেং বউ’ প্রকাশিত হয়েছিল। সংবাদে লেখা ছাপা হওয়ার পরে সম্মানী হিসেবে তেমন কিছু পেতাম না, তবে যা পেতাম তা অর্থ দিয়ে বিবেচনা করা যাবে না। শহীদ ভাই আমাকে তার রচিত অসম্ভব মূল্যমানের তিন তিনিটি বই ‘সংশপ্তক’, ‘সারেং বউ’ ও ‘রাজবন্দীর রোজনামচা’ আমাকে দিয়ে বলেছিলেন রোজী পারিশ্রমিক দিলাম না, সৌজন্য প্রীতি উপহার দিলাম। এটাই তোমার পারিশ্রমিক, আমি আজও সেই স্মৃতি ভুলতে পারিনি। শহীদ ভাই আজ আর নেই। তার স্ত্রী পান্না কায়সার আছে, আমি তার সাথে এ বিষয়টি নিয়ে বহুবার বিনিময় করেছি। পান্না আপা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে আমার এক বছরের সিনিয়র ছিলেন। তার সাথে পরিচয়ের গভীরতা অনেকাংশ ছিল আমার।

সংবাদের সাহিত্য সাময়িকী বিভাগ অত্যন্ত মর্যদাসম্পন্ন। যারাই এ বিভাগে হাত রেখেছেন সম্পাদনার জন্য তাদের প্রত্যেকের জাদুকরি স্পর্শ পত্রিকাটির মান শুধু উন্নত করেছে তাই নয়, কবি সাহিত্যিক সংস্কৃতিক জগতের একটি দৃষ্টান্ত করে রেখেছে। প্রত্যেকের নিবেদনের ভিতরে আন্তরিকতা ও ভালোবাসা এতো বেশি বর্তমান ছিল যে, সম্পাদকীয় কাঠামোতে সবকিছু মূল্যায়ন করা সম্ভব হতো না। রুচিশীল এবং বহুমাত্রিক রচনাগুলো সম্পাদক অত্যন্ত নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতেন। যে লেখাগুলো মানসম্পন্ন তেমন হতো না, সেগুলো সম্পাদকের নিকট প্রাধান্য পেত না। তিনি আবার লিখতে বলার অনুরোধ জানিয়ে তাকে শান্ত করতেন। আসলে তিনি চাইতেন মানের পরিমাপ কবি বা লেখকের কাছে সমমূল্যায়ন পাক।

সাহিত্য সাময়িকীর বর্তমান সম্পাদক কবি ওবায়েদ আকাশ আমাকে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে একটি লেখার জন্য আহ্বান জানালেন। মনে পড়ে গেল “সংবাদ”-এর সাহিত্য পাতায় লেখা ছাপা হওয়া একটি দুর্লভ এবং বিরল সম্মান। তখন সাংবাদিক বজলুর রহমান ‘সংবাদ’ এর সম্পাদক ছিলেন। তিনি লেখনি বাবদ প্রাপ্য সম্মান দিয়ে সম্মানীর মাত্রাকে অনেক বেশি সম্মানিত করেছিলেন। মনে আছে আমি তখন প্রকাশিত লেখার কিছু সম্মানী পেয়েছিলাম, কথাগুলো উল্লেখ করলাম এই কারণে, ‘সংবাদ’ আবারো ঘুরে দাঁড়াবে, লেখকের সম্মানীর প্রতি আবারো আরো বেশি সম্মান প্রদর্শন করবে।

কলেবর বড় কথা নয় মানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ঐতিহ্যের ধারক-বাহকরূপে সংস্কৃতির ধারাকে দেশের নান্দনিক সৌন্দর্য্যকে, দেশের এগিয়ে চলার মতবাদকে বিভিন্ন অর্জনের মাধ্যমে দেশ-বিদেশের কাছে সম্মানিত করার প্রেক্ষিতে নারী উন্নয়ন, ক্যানসার ও কিডনীর মতো দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসার উন্নয়ন আগামী থেকে সংবাদের পাতায় পাতায় আমরা দেখতে পাব। আমি সেই আশাই করি। “সংবাদ” আমাদের আরাধ্য, আমাদের একান্ত ভালোবাসার জায়গা। সংবাদকে স্বীয় সাধনায় উজ্জীবিত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকুক এই আমার প্রার্থনা।

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী একটি ঐতিহ্যবাহী ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এই সংখ্যাতেও বহুমাত্রিক কবি, সাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক ও রচয়িতারা তাদের মূল্যবান রচনাগুলি দ্বারা সমৃদ্ধ করবেন। ছড়াকাররাও বাদ যাবেন না হয়তো। একটি ছড়া যে সমস্ত ব্যাঙ্গের উর্ধেও সাহিত্য হতে পারে আমাদের কাছে তার নজির আছে। আমরা আন্নদা শংকর রায়ের কথা ভুলতে পারি না- “তেলের শিশি ভাঙলো বলে, খোকার উপর রাগ কর/তোমরা যে সব বুড়ো খোকা ভারত ভেঙে ভাগ করো/তার বেলা?”। আমাদের সাহিত্যে এ ধরনের ছড়াগুলো প্রাধান্য দেবার জন্য “ঘুম পাড়ানি মাসিপিসি মোদের বাড়ি এসো/খাট নেই পালঙ নেই চোখ পেতে বস” মনে করা যায়। বিশিষ্ট ছড়াকার আমাদের দাদাভাই রোকনুজ্জামান যখন লেখেন- “নোটন নোটন পায়রাগুলো ঝোটন বেঁধেছে/ও পারেতে ছেলেমেয়ে নাইতে নেমেছে/ দুই ধারে দুই রুই কাতলা ভেসে উঠেছে/ কে দেখেছে কে দেখেছে, দাদা দেখেছে/ দাদার হাতে কলম ছিল ছুড়ে মেরেছে/ উহ! বড্ড লেগেছে” এ ছাড়া অন্য একজন ছড়াকার লিখেছেন, “ও দাদাভাই মূর্তি বানাও/ বুদ্ধ, যীশু সবই বানাও/ একটি মন বানাতে পার কি”- এ ধরনের ছড়ার মালা আরো মনে করিয়ে দেয় “ঘুম আসে না বলে খোকন যাসনে ঘরের বার/ ঘুম পাড়ানি দস্যি এলে ভাঙবে না ঘুম আর।” শিশু সাহিত্যের অন্যান্য বহুমাত্রিক রচনাগুলির মধ্যে শিশু মনোতোষকে আরো আকর্ষণীয় করার জন্য অনেক ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রাণী জগতের রহস্য উন্মোচন সবই প্রতিপাদ্য হয়েছে। তবে বিশিষ্ট শিশুসাহিত্যিক এখলাসউদ্দিনের “নেংটি ইঁদুর” রচনাটি শিশু মনোতোষকে অভাবনীয়ভাবে জাগ্রত করেছে। দক্ষিণারঞ্জন মিত্রের “ঠাকুরমার ঝুলি”, “ঠাকুর দাদার থলে” আমাদের ছোটদের সাহিত্য ভান্ডারে উল্লেখযোগ্য অবদান বলে আমি মনে করি। অতএব, “দৈনিক সংবাদ” পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যাটি হাতে পেলে আমি জানি আমরা সমৃদ্ধ হব, নিজেদের অস্তিত্বকে মূল্যায়ন করতে পারব। “সংবাদ” পত্রিকাটি আমাদের প্রত্যুশলগন থেকে নিশিরাত পর্যন্ত চোখের সামনে ধরে রাখার মানসিকতা করতে পারব। জয় হোক “দৈনিক সংবাদ”-এর সকল কলাকুশলীর এবং সম্পাদকীয় মণ্ডলীর। সকল মানুষের শুভেচ্ছা। সকল শুভানুধ্যায়ী আমরা সকলে যেন তার ভিতরে থাকতে পারি।