তোমারে বধিবে যে...

সেলিনা হোসেন

যদি এভাবে শুরু করা যায়, ‘তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে’- তাহলে কি বেশি বলা হবে? অবশ্যই না। শতকণ্ঠে চিৎকার করে বলবে এই সময়ের নারীরা। কারণ আইলাবিধ্বস্ত জনপদের পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য তারা ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে গিয়ে কথা বলার সাহস অর্জন করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিপূরণের জন্য তারা কোপেনহেগেন সম্মেলনে নিজেদের দাবি উত্থাপন করেছে। এই সাহস এবং শক্তি অর্জনের জন্য নারীর খুব বেশি সময় লাগেনি। তাদের দরকার ছিল সুযোগের। সেই সুযোগ তারা পেয়েছিল। যারা বিশ্বসভায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, তারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা ডিগ্রিধারী কেউ নন। তাদের যুদ্ধ তৃণমূলে- সেই জায়গা থেকে তারা এগিয়ে আসার মন্ত্র উচ্চারণ করেছেন। নারীরই আছে জেগে ওঠার স্বপ্ন!

এত নির্যাতন, এত অবমাননা! এত অবমূল্যায়ন, এত ভালোবাসাহীন জীবন! তারপরও জেগে ওঠার প্রেরণায় নারী জেগে ওঠে। কারণ মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়া নারীর আকাক্সক্ষা নয়। তাকে যতই দাবিয়ে রাখতে চাক না কেউ, জেগে তাকে উঠতেই হবে। এই বিশ্বাস এবং গভীরতায় নারী প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে এতদূর এসেছে। দেশের সরকারপ্রধান থেকে স্থানীয় প্রশাসনের নারীরা একই দৃঢ়তায় বাঁধা। এ অদৃশ্য বন্ধনের বড় টান আজ বাংলাদেশে সত্য। এশিয়ায় বাংলাদেশই একমাত্র রাষ্ট্র যেখানে সরকারপ্রধান এবং বিরোধী দলের প্রধান নারী। দীর্ঘ বছর ধরে তারা এ জায়গাটিকে ধরে রেখেছেন। তারপরও নারীর জীবনে জেগে ওঠার আহ্বান ফল্গুধারার মতো প্রবহমান।

নারীর টিকে থাকার শক্তি অপরিসীম। শত নির্যাতনেও তার আয়ুর ক্ষয় নেই। ইতিহাস সাক্ষী কতভাবে দমানোর চেষ্টা হয়েছে নারীকে; কিন্তু জীবনের বিনিময়ে শত ফুল ফুটিয়েছে তারা। ‘জেগে ওঠো বাংলাদেশ’- এ ডাক তো নারীই দিতে পারে। কারণ তার পরকালে স্বর্গ নেই- ইহকালই তার মমতা মাখানো জীবনসাধনা। তাই শত নির্যাতনে পিছিয়ে থাকে না। শত নির্যাতনে মুখ থুবড়ে পড়ে না। মার খেয়ে রুখে দাঁড়াতে শিখেছে নারী।

কারখানার ভেঁপু বাজা শেষ হয়েছে। মাঝরাতে দল বেঁধে হেঁটে যায় মেয়েরা। আকাশ থেকে জ্যোৎস্না ঝরে পড়ে। আর ওরা বলতে বলতে চলে যায় আবার আসিব ফিরে, ধানসিঁড়িটির তীরে, এই বাংলায়।

ওদের দৃষ্টিতে, কণ্ঠস্বরে, পদধ্বনিতে জেগে থাকে বাংলাদেশ।

সিডরবিধ্বস্ত জনপদে আবার নতুন নির্মাণ শুরু করে নারীরা। ক্ষুধার জ্বালা মেটাতে চুলোয় আগুন জ্বালায় নারী। গ্রিক মিথে প্রমিথিউস মানুষের জন্য আগুন চুরি করেছিলেন। দেবতা জিউস তাকে শাস্তি দিয়েছিলেন। নির্জন দ্বীপের পাহাড়ের চূড়ায় বেঁধে রাখা হয়েছিল তাকে। প্রতিদিন হিংস্র ঈগল খুবলে খেত তার হৃৎপিন্ড। সেই আগুনের সর্বোত্তম ব্যবহার করে নারী। শিশুর মুখে তুলে দেয় অন্ন। দিনমজুর বাবা-মায়ের মেয়েরা সারা দিন ঘরের কাজ করে এসএসসি পরীক্ষায় অসাধারণ রেজাল্ট করে। গণমাধ্যমে উঠে আসে তাদের সাফল্যের কথা। এসব জেগে ওঠা মেয়েকে দমিয়ে রাখবে কে? বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে এগোচ্ছে নানা ক্ষেত্রে মেয়েরা- বিস্তৃত হচ্ছে তাদের কাজের পরিসর।

ওরাই বলে, যে জীবন তোমার আমার বলে প্রতিজ্ঞা কর সেখানে আমাকে পাবে প্রিয়তম। যে জীবন তোমার একার বলে উড়িয়ে দিতে চাও সেখানে আমাকে ডেকো না।

আমি আধিপত্য এবং ভোগে বিনষ্ট জীবনকে আঁকড়ে ধরতে চাই না। আমি চাই স্রোতের সুস্থ এবং সহজাত বিকাশ। শুরুতে যে প্রশ্নটি ছিল, সেটি আবার করি। কাকে বধিবে নারী? নিঃসন্দেহে বলা যায়, পুরুষতন্ত্রের মতো প্রথাকে বধিবে। তাই নারীর জেগে ওঠা সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য জরুরি।

সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে তৃণমূলের নারীর জীবনসাধনায় জেগে ওঠার যে তীব্রতা আছে, তাকে বুঝতে হবে সবাইকে। বুঝতে হবে দেশের জনগোষ্ঠীর প্রতিটি নারী-পুরুষকে। এই বোঝার শক্তি থেকে নির্মূল হবে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির অযৌক্তিক, অবৈজ্ঞানিক মেকি প্রথাটি। প্রতিষ্ঠিত হবে নারী-পুরুষের সমতার ভিত্তি।

আমার শৈশব, কৈশোর, যৌবনের তিনটি অভিজ্ঞতা নারী বিষয়ক ধারণায় চিন্তার দরজা খুলে দিয়েছে। বই পড়ে নানাকিছু জানার পাশাপাশি এসব অভিজ্ঞতা আমার কাছে সমাজের কাছ থেকে পাওয়া দৃষ্টান্ত।

আমার বয়স তখন নয় বা দশ হবে। আমার মা গ্রামের বাড়ি থেকে একটি কাজের মেয়ে এনেছিলেন। ওর বয়স এগারো-বারো হতে পারে। দু’জনে কাছাকাছি বয়সের হওয়ায় আমরা ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়েছিলাম। ওর সঙ্গে অনেক সময় কাটাতাম। একদিন বাবা বাড়িতে এসে বললেন, আমি ঠিক করেছি আমার অফিসের পিয়ন ওসমানের সঙ্গে তারার বিয়ে দেব। মা প্রবল আপত্তি করলেন। বললেন, ওসমানের বয়স ২৩-২৪ হবে। তারা তো ছোট্ট মেয়ে। বাবা মায়ের আপত্তি মানলেন না। বললেন, মেয়েদের আবার বয়স কি? এখন ছেলে পাওয়া যাবে না। আমি বিয়ে দেব। আয়োজন কর।

বাবার হুকুমে তারার বিয়ে হয়ে গেল। আমরা দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরে অনেক কাঁদলাম। কান্নার দিন আমাদের ফুরালো না। দেখলাম অনবরত স্বামীর হাতে পিটুনি খাচ্ছে তারা। কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বলে, বিয়ে খুব খারাপ রে।

তিন-চার বছর আমাদের বাড়িতে থাকার পরে ওসমান তারাকে নিয়ে নোয়াখালীর গ্রামের বাড়িতে চলে যায়। পরে জানতে পেরেছি ওদের তিনটা ছেলে হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ওদের গ্রামের বাড়িতে যাই। তারাকে জিজ্ঞেস করি, বিয়ে কি খুব খারাপ রে? তারা মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, হ্যাঁ, খুব খারাপ। আমি বলি, তুই তো বারো বছর ধরে ঘর করলি। তারা গলা উঁচু করে বলে, ছেলেদের জন্য ঘর করি। আর লোকটা তো আর একটা বিয়া করে নাই। সেজন্য থেকে গেছি। সেদিন বুঝেছিলাম যে নারী নিজের সবটুকু উৎসর্গ করে বৃহত্তর স্বার্থে। মঙ্গল ও কল্যাণই তার বেঁচে থাকার স্বপ্ন। নিজের দুর্ভোগকে কাটিয়ে ওঠার প্রেরণা অর্জন করে মানব কল্যাণের চেতনায়। যাত্রা শুরু করে ঘরের মানুষদের সঙ্গে।

দ্বিতীয় উদাহরণটিও এরকম। ততদিনে আমি কিশোর বয়সে পৌঁছে গেছি। বগুড়ার করতোয়া নদীর ধারের এক সাধারণ বাড়িতে আগুন লাগে। আমরা একদল ছেলেমেয়ে দৌড়ে গিয়ে পুড়তে থাকা ঘরের দৃশ্য দেখি। হঠাৎ দেখতে পাই মাঝির বৌ আগুনলাগা ঘরের একপাশ দিয়ে ঢুকে চালের বস্তাটা টেনে বের করে আনছে। আশপাশে জড়ো হওয়া লোকজন তার এই সাহসী ভূমিকার প্রশংসা ধরে। নিজের সন্তানদের থালায় ভাত দেয়ার জন্য এবং বয়সী শ্বশুর-শাশুড়িকে খাইয়ে রাখার জন্য তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন। নারী এভাবে প্রিয়জনের চিন্তায় বেপরোয়া হন। নিজের জীবনের মায়া তার কাছে তুচ্ছ হয়ে যায়। এ ঘটনাও আমার কাছে শিক্ষার উদাহরণ। নারীর দায়িত্ববোধ এবং ভালোবাসা কীভাবে প্রিয়জনকে মমতায় বেঁধে রাখে তা শুধু ব্যক্তি নয়, সামাজিক মূল্যবোধের দৃষ্টান্তও।

এখন থেকে ত্রিশ বছর আগে পতিতালয়ের নারীদের নিয়ে একটি উপন্যাস লিখব বলে চিন্তা করি। সেজন্য মোংলা বন্দরের কাছে রূপসা নদীর বেড়িবাঁধের কাছে একটি পতিতালয়ে যাই। ঘুরেফিরে এলাকাটি দেখি, কয়েকজন নারীর সাক্ষাৎকার নেই। ফিরে আসার সময় দেখি গেটের কাছে একটি মেয়ে দুটো ছোট্ট শিশুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শিশু দুটিকে দেখে আমার রাগ হলো। ওদেরকে কেন এখানে এনেছে? অনেক রাগ করে কথা বললে মেয়েটি কেঁদে দেয়া দু’হাতে চোখ মুছে বলে, ওদের একমুঠো ভাত খাওয়ানোর জন্য আমি এখানে এসেছি। ওদের বাপ তো ফেলে রেখে চলে গেছে; আরেকটা বিয়ে করেছে। আমি ওর দু’হাত চেপে ধরি। বাচ্চাদের আদর করে ওকে কিছু টাকা দেই। ধরে নেই ও আজ থেকে আমার শিক্ষাগুরু। ও আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে যে, নারী মানবসভ্যতার ধারাবাহিকতা রক্ষা করে। মানবশিশু রক্ষার প্রয়োজনে নিজেকে উৎসর্গ করে।

এই তিনটি উদাহরণ সামনে রেখে নারী-পুরুষের সমতার জায়গা উজ্জীবিত রাখে না পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্য। চারপাশে ঘটে যাওয়া নারী-নির্যাতনের ঘটনাগুলো সামাজিক অর্থে বেঁচে থাকার বিপরীত আগ্রাসন। তাই মূল্যবোধের অবক্ষয় আজকের দিনের এক মর্মান্তিক চিত্র। কোন অর্থেই সমাজের সত্য-সুন্দর ধারাক্রম রক্ষা করছে না। বেঁচে থাকার অবমাননায় ডুবে যাচ্ছে প্রজন্ম।

image

শিল্পী : সৈয়দ জাহাঙ্গীর

আরও খবর
৬৯ বছরে সংবাদ
ভাষা থেকে ভূখন্ড
স্মৃতিময় সংবাদ-এর ৬৯ বছর
একটি রাজনৈতিক পাঠ
সংবাদ : কিছু কথা কিছু স্মৃতি
যুগে যুগে সংবাদপত্রের অগ্রযাত্রা
আলোর তৃষ্ণায় জাগো
ইতিহাস ঐতিহ্য ও আদর্শের স্মারক দৈনিক সংবাদ
কেন লিখি
সংবাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আত্মার
ঐতিহ্য আর মুক্তচিন্তার সংবাদ
আমার সংবাদ সংবাদের আমি
বিচিত্র জীবিকা বিচিত্র জীবন
ঋতুপর্ণ ঘোষের এলোমেলো দেশকাল
চীন ও বাংলাদেশ : প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সম্পর্ক
সংবাদের জলসাঘর
আমরা এখন শান্ত হয়ে আছি
মাটির মাধুর্য
কষ্টের ঢাকা স্বপ্নের বাংলাদেশ
বঙ্গবন্ধুর জনকল্যাণের অর্থনৈতিক নীতি কৌশল
শারহুল পটবসন্ত ও বজলুর রহমান
শিশুশিক্ষায় শিল্প-সাহিত্য-সংগীত
গণমাধ্যমের হাল-হকিকত
এবং বজলুর রহমান স্মৃতিপদক
দুর্নীতি, পেশাদারিত্ব ও উন্নয়ন
বাংলাদেশের থিয়েটার চর্চার ভবিষ্যৎ
চেতনায় নৈতিকতা মূল্যবোধ : বিরুদ্ধবাস্তবতা
সবার উপরে মানুষ সত্য
আহমদুল কবির শ্রদ্ধাঞ্জলি
কার্যকর সংসদ এবং সুশাসনের স্বপ্ন
‘সংবাদ’ আমারই ছিল আমারই আছে
আমাদের ‘সংবাদ’
নারীর অধিকার ও সচেতনতা
গণমাধ্যমে বিশ্বাস কমছে পাঠকের
নারী ও তার বিধাতা পুরুষ
বাংলাদেশের নারী
সংবাদের কাছে আমি ঋণী
বিস্মৃতিপ্রবণতা ও রাষ্ট্রের অক্ষমতা
যে দীপশিখা দিয়েছে আলো

বুধবার, ১০ জুলাই ২০১৯ , ২৬ আষাঢ় ১৪২৫, ৬ জ্বিলকদ ১৪৪০

তোমারে বধিবে যে...

সেলিনা হোসেন

image

শিল্পী : সৈয়দ জাহাঙ্গীর

যদি এভাবে শুরু করা যায়, ‘তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে’- তাহলে কি বেশি বলা হবে? অবশ্যই না। শতকণ্ঠে চিৎকার করে বলবে এই সময়ের নারীরা। কারণ আইলাবিধ্বস্ত জনপদের পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য তারা ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে গিয়ে কথা বলার সাহস অর্জন করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিপূরণের জন্য তারা কোপেনহেগেন সম্মেলনে নিজেদের দাবি উত্থাপন করেছে। এই সাহস এবং শক্তি অর্জনের জন্য নারীর খুব বেশি সময় লাগেনি। তাদের দরকার ছিল সুযোগের। সেই সুযোগ তারা পেয়েছিল। যারা বিশ্বসভায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, তারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা ডিগ্রিধারী কেউ নন। তাদের যুদ্ধ তৃণমূলে- সেই জায়গা থেকে তারা এগিয়ে আসার মন্ত্র উচ্চারণ করেছেন। নারীরই আছে জেগে ওঠার স্বপ্ন!

এত নির্যাতন, এত অবমাননা! এত অবমূল্যায়ন, এত ভালোবাসাহীন জীবন! তারপরও জেগে ওঠার প্রেরণায় নারী জেগে ওঠে। কারণ মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়া নারীর আকাক্সক্ষা নয়। তাকে যতই দাবিয়ে রাখতে চাক না কেউ, জেগে তাকে উঠতেই হবে। এই বিশ্বাস এবং গভীরতায় নারী প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে এতদূর এসেছে। দেশের সরকারপ্রধান থেকে স্থানীয় প্রশাসনের নারীরা একই দৃঢ়তায় বাঁধা। এ অদৃশ্য বন্ধনের বড় টান আজ বাংলাদেশে সত্য। এশিয়ায় বাংলাদেশই একমাত্র রাষ্ট্র যেখানে সরকারপ্রধান এবং বিরোধী দলের প্রধান নারী। দীর্ঘ বছর ধরে তারা এ জায়গাটিকে ধরে রেখেছেন। তারপরও নারীর জীবনে জেগে ওঠার আহ্বান ফল্গুধারার মতো প্রবহমান।

নারীর টিকে থাকার শক্তি অপরিসীম। শত নির্যাতনেও তার আয়ুর ক্ষয় নেই। ইতিহাস সাক্ষী কতভাবে দমানোর চেষ্টা হয়েছে নারীকে; কিন্তু জীবনের বিনিময়ে শত ফুল ফুটিয়েছে তারা। ‘জেগে ওঠো বাংলাদেশ’- এ ডাক তো নারীই দিতে পারে। কারণ তার পরকালে স্বর্গ নেই- ইহকালই তার মমতা মাখানো জীবনসাধনা। তাই শত নির্যাতনে পিছিয়ে থাকে না। শত নির্যাতনে মুখ থুবড়ে পড়ে না। মার খেয়ে রুখে দাঁড়াতে শিখেছে নারী।

কারখানার ভেঁপু বাজা শেষ হয়েছে। মাঝরাতে দল বেঁধে হেঁটে যায় মেয়েরা। আকাশ থেকে জ্যোৎস্না ঝরে পড়ে। আর ওরা বলতে বলতে চলে যায় আবার আসিব ফিরে, ধানসিঁড়িটির তীরে, এই বাংলায়।

ওদের দৃষ্টিতে, কণ্ঠস্বরে, পদধ্বনিতে জেগে থাকে বাংলাদেশ।

সিডরবিধ্বস্ত জনপদে আবার নতুন নির্মাণ শুরু করে নারীরা। ক্ষুধার জ্বালা মেটাতে চুলোয় আগুন জ্বালায় নারী। গ্রিক মিথে প্রমিথিউস মানুষের জন্য আগুন চুরি করেছিলেন। দেবতা জিউস তাকে শাস্তি দিয়েছিলেন। নির্জন দ্বীপের পাহাড়ের চূড়ায় বেঁধে রাখা হয়েছিল তাকে। প্রতিদিন হিংস্র ঈগল খুবলে খেত তার হৃৎপিন্ড। সেই আগুনের সর্বোত্তম ব্যবহার করে নারী। শিশুর মুখে তুলে দেয় অন্ন। দিনমজুর বাবা-মায়ের মেয়েরা সারা দিন ঘরের কাজ করে এসএসসি পরীক্ষায় অসাধারণ রেজাল্ট করে। গণমাধ্যমে উঠে আসে তাদের সাফল্যের কথা। এসব জেগে ওঠা মেয়েকে দমিয়ে রাখবে কে? বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে এগোচ্ছে নানা ক্ষেত্রে মেয়েরা- বিস্তৃত হচ্ছে তাদের কাজের পরিসর।

ওরাই বলে, যে জীবন তোমার আমার বলে প্রতিজ্ঞা কর সেখানে আমাকে পাবে প্রিয়তম। যে জীবন তোমার একার বলে উড়িয়ে দিতে চাও সেখানে আমাকে ডেকো না।

আমি আধিপত্য এবং ভোগে বিনষ্ট জীবনকে আঁকড়ে ধরতে চাই না। আমি চাই স্রোতের সুস্থ এবং সহজাত বিকাশ। শুরুতে যে প্রশ্নটি ছিল, সেটি আবার করি। কাকে বধিবে নারী? নিঃসন্দেহে বলা যায়, পুরুষতন্ত্রের মতো প্রথাকে বধিবে। তাই নারীর জেগে ওঠা সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য জরুরি।

সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে তৃণমূলের নারীর জীবনসাধনায় জেগে ওঠার যে তীব্রতা আছে, তাকে বুঝতে হবে সবাইকে। বুঝতে হবে দেশের জনগোষ্ঠীর প্রতিটি নারী-পুরুষকে। এই বোঝার শক্তি থেকে নির্মূল হবে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির অযৌক্তিক, অবৈজ্ঞানিক মেকি প্রথাটি। প্রতিষ্ঠিত হবে নারী-পুরুষের সমতার ভিত্তি।

আমার শৈশব, কৈশোর, যৌবনের তিনটি অভিজ্ঞতা নারী বিষয়ক ধারণায় চিন্তার দরজা খুলে দিয়েছে। বই পড়ে নানাকিছু জানার পাশাপাশি এসব অভিজ্ঞতা আমার কাছে সমাজের কাছ থেকে পাওয়া দৃষ্টান্ত।

আমার বয়স তখন নয় বা দশ হবে। আমার মা গ্রামের বাড়ি থেকে একটি কাজের মেয়ে এনেছিলেন। ওর বয়স এগারো-বারো হতে পারে। দু’জনে কাছাকাছি বয়সের হওয়ায় আমরা ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়েছিলাম। ওর সঙ্গে অনেক সময় কাটাতাম। একদিন বাবা বাড়িতে এসে বললেন, আমি ঠিক করেছি আমার অফিসের পিয়ন ওসমানের সঙ্গে তারার বিয়ে দেব। মা প্রবল আপত্তি করলেন। বললেন, ওসমানের বয়স ২৩-২৪ হবে। তারা তো ছোট্ট মেয়ে। বাবা মায়ের আপত্তি মানলেন না। বললেন, মেয়েদের আবার বয়স কি? এখন ছেলে পাওয়া যাবে না। আমি বিয়ে দেব। আয়োজন কর।

বাবার হুকুমে তারার বিয়ে হয়ে গেল। আমরা দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরে অনেক কাঁদলাম। কান্নার দিন আমাদের ফুরালো না। দেখলাম অনবরত স্বামীর হাতে পিটুনি খাচ্ছে তারা। কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বলে, বিয়ে খুব খারাপ রে।

তিন-চার বছর আমাদের বাড়িতে থাকার পরে ওসমান তারাকে নিয়ে নোয়াখালীর গ্রামের বাড়িতে চলে যায়। পরে জানতে পেরেছি ওদের তিনটা ছেলে হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ওদের গ্রামের বাড়িতে যাই। তারাকে জিজ্ঞেস করি, বিয়ে কি খুব খারাপ রে? তারা মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, হ্যাঁ, খুব খারাপ। আমি বলি, তুই তো বারো বছর ধরে ঘর করলি। তারা গলা উঁচু করে বলে, ছেলেদের জন্য ঘর করি। আর লোকটা তো আর একটা বিয়া করে নাই। সেজন্য থেকে গেছি। সেদিন বুঝেছিলাম যে নারী নিজের সবটুকু উৎসর্গ করে বৃহত্তর স্বার্থে। মঙ্গল ও কল্যাণই তার বেঁচে থাকার স্বপ্ন। নিজের দুর্ভোগকে কাটিয়ে ওঠার প্রেরণা অর্জন করে মানব কল্যাণের চেতনায়। যাত্রা শুরু করে ঘরের মানুষদের সঙ্গে।

দ্বিতীয় উদাহরণটিও এরকম। ততদিনে আমি কিশোর বয়সে পৌঁছে গেছি। বগুড়ার করতোয়া নদীর ধারের এক সাধারণ বাড়িতে আগুন লাগে। আমরা একদল ছেলেমেয়ে দৌড়ে গিয়ে পুড়তে থাকা ঘরের দৃশ্য দেখি। হঠাৎ দেখতে পাই মাঝির বৌ আগুনলাগা ঘরের একপাশ দিয়ে ঢুকে চালের বস্তাটা টেনে বের করে আনছে। আশপাশে জড়ো হওয়া লোকজন তার এই সাহসী ভূমিকার প্রশংসা ধরে। নিজের সন্তানদের থালায় ভাত দেয়ার জন্য এবং বয়সী শ্বশুর-শাশুড়িকে খাইয়ে রাখার জন্য তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন। নারী এভাবে প্রিয়জনের চিন্তায় বেপরোয়া হন। নিজের জীবনের মায়া তার কাছে তুচ্ছ হয়ে যায়। এ ঘটনাও আমার কাছে শিক্ষার উদাহরণ। নারীর দায়িত্ববোধ এবং ভালোবাসা কীভাবে প্রিয়জনকে মমতায় বেঁধে রাখে তা শুধু ব্যক্তি নয়, সামাজিক মূল্যবোধের দৃষ্টান্তও।

এখন থেকে ত্রিশ বছর আগে পতিতালয়ের নারীদের নিয়ে একটি উপন্যাস লিখব বলে চিন্তা করি। সেজন্য মোংলা বন্দরের কাছে রূপসা নদীর বেড়িবাঁধের কাছে একটি পতিতালয়ে যাই। ঘুরেফিরে এলাকাটি দেখি, কয়েকজন নারীর সাক্ষাৎকার নেই। ফিরে আসার সময় দেখি গেটের কাছে একটি মেয়ে দুটো ছোট্ট শিশুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শিশু দুটিকে দেখে আমার রাগ হলো। ওদেরকে কেন এখানে এনেছে? অনেক রাগ করে কথা বললে মেয়েটি কেঁদে দেয়া দু’হাতে চোখ মুছে বলে, ওদের একমুঠো ভাত খাওয়ানোর জন্য আমি এখানে এসেছি। ওদের বাপ তো ফেলে রেখে চলে গেছে; আরেকটা বিয়ে করেছে। আমি ওর দু’হাত চেপে ধরি। বাচ্চাদের আদর করে ওকে কিছু টাকা দেই। ধরে নেই ও আজ থেকে আমার শিক্ষাগুরু। ও আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে যে, নারী মানবসভ্যতার ধারাবাহিকতা রক্ষা করে। মানবশিশু রক্ষার প্রয়োজনে নিজেকে উৎসর্গ করে।

এই তিনটি উদাহরণ সামনে রেখে নারী-পুরুষের সমতার জায়গা উজ্জীবিত রাখে না পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্য। চারপাশে ঘটে যাওয়া নারী-নির্যাতনের ঘটনাগুলো সামাজিক অর্থে বেঁচে থাকার বিপরীত আগ্রাসন। তাই মূল্যবোধের অবক্ষয় আজকের দিনের এক মর্মান্তিক চিত্র। কোন অর্থেই সমাজের সত্য-সুন্দর ধারাক্রম রক্ষা করছে না। বেঁচে থাকার অবমাননায় ডুবে যাচ্ছে প্রজন্ম।