ঋতুপর্ণ ঘোষের এলোমেলো দেশকাল

দেবাহুতি চক্রবর্তী

ঋতুপর্ণ ঘোষ বাংলা চলচ্চিত্র জগতের অতি পরিচিত এক নাম। পশ্চিম বাংলার শিক্ষিত-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষকে সেখানকার চলচ্চিত্র জগতের এক দুঃসময়ে প্রেক্ষাগৃহে ফিরিয়ে নেবার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। শুধু পশ্চিম বাংলার নয়, বাঙালি হিসেবে চলচ্চিত্রপ্রেমী সকলেই কোনো না কোনোভাবে ঋতুপর্ণের কাছে কৃতজ্ঞ। সেই ঋতুপর্ণের সংসার-জীবন ঘিরে আমবাঙালির কৌতূহল ছিল অনিঃশেষ, সকলেই কোনো না কোনো অছিলায় তার খড়খড়িতে চোখ রাখতে চেয়েছেন অবরেসবরে থ- (অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়)। আশৈশব তাঁর স্বভাবের ও কণ্ঠস্বরের নারী সুলভতার জন্য অপরিশীলিত উপহাস-অপমান সহ্য করেই এক বিপন্ন ও নিঃসঙ্গ জীবনচর্চার মাঝ দিয়েই শিল্পজগতের বিভিন্ন অঙ্গনে তাঁর অসাধারণ অবদান চিরস্মরণীয়।

এই ঋতুপর্ণের বাইরে কলাম-লেখক হিসেবেও তিনি বিশেষ এক স্থানের অধিকারী। প্রায় সাত বছর একটানা একটি পত্রিকায় তিনি কলাম লেখেন। সম্পাদক হিসেবে নিজে লেখার সময় পত্রিকার বিষয় বা আঙ্গিক নিয়ে তিনি ভাবেননি। নিজের ভালো লাগা-মন্দ লাগা, নিজের বিশ্বাসকে প্রাধান্য দিয়ে ভাষার বিশিষ্টতায় একের পর এক বিষয়ের নিগড় ভাঙা আর গড়ায় নিজেকে ব্যাপৃত রাখেন। বাংলা ভাষার কলাম সাহিত্য হিসেবে যা অনবদ্য। সেই অসংখ্য কলাম থেকে রচনাকালীন পশ্চিমবাংলার রাজনীতি আর দেশকাল নিয়ে তাঁর লেখা আর চিন্তাচেতনা নিয়ে কিছু আলোকপাত করাই আমার উদ্দেশ্য। বলা ভালো, এখানে আলোচিত তাঁর মতামত সম্পূর্ণই তাঁর নিজস্ব। সেখানে মতদ্বৈধতা, সমালোচনা করার স্বাধীনতা সকলেরই রয়েছে। নিরেট চলচ্চিত্র জগতের মানুষ হিসেবে আমাদের অধিকাংশের জানার আড়ালে এলোমেলো দেশকাল তাঁকেও রাজনীতি-সচেতন যে কোন ব্যক্তির মতো তাড়িত করেছে এবং সেটা না জানলে তাঁকে যে সম্পূর্ণ জানা হয় না, এটুকুই জানানোর।

পশ্চিমবাংলার বামফ্রন্টের ক্ষমতার শেষদিকে শিল্পের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে নন্দীগ্রাম আর সিঙ্গুরের কৃষক জনতার সঙ্গে শাসক শ্রেণির বিরোধ এতটাই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে যে, এতদিন যারা সুবিধা করতে পারেনি, সেই রাজনৈতিক দল এই বিরোধকে ব্যবহার করে বাম শাসনের উচ্ছেদ এবং নিজেদের ক্ষমতা চূড়ান্ত করতে সম্ভবপর হয়ে ওঠে। এই সময়কালের লেখাগুলোই মূলত এখানকার আলোচ্য। ঋতুপর্ণর ভাবনায় সিঙ্গুর নিয়ে যে বিতর্কটা শুরু হয়েছিল, আমি বিশ্বাস করি, তার গূঢ় এবং মূল প্রশ্নটি মানবসভ্যতার। কোন রাজনৈতিক দলের নয়। কৃষিজমিতে শিল্প বা ভূমিপুত্র সমস্যা থেকে আমরা স্বাচ্ছন্দ্যে সরে এসেছি মমতা-বুদ্ধদেবের দ্বৈরথে। কেন? সিঙ্গুরের লড়াইটা সিঙ্গুরের মানুষের, তাকে নেতৃত্ব দেওয়ার আমরা কেউ নই। এটাকে বুদ্ধদেব-মমতার ক্ষমতা বা জনপ্রিয়তা দখলের লড়াই থেকে সরিয়ে এনে দেখতে পারলে, সভ্যতার একটা সংকট হিসেবে এর দিকে তাকাতে পারলে, তবেই কিছুটা সুবিচার হয়তো আমরা মনে মনে হলেও করতে পারতাম। যে কোন ঘটনা মানুষের কাছ থেকে যেমন নানা প্রতিক্রিয়া আদায় করে নেয়, সমর্থন বা তীব্র বিদ্বেষ, এই ঘটনার পরিণতি তেমনই হতে পারত।

আসলে তা হয়নি। ঘোলাজলে মাছ শিকারে রাজনীতিবিদরা সবসময় পটু। উল্টোভাবে ধরলে জল ঘোলা করার দায়িত্বটাও কোন এক পক্ষ নিয়ে নেয়। মানে মূল লড়াইটা দাঁড়ায়, ক্ষমতায় টিকে থাকার বা ক্ষমতায় যাওয়ার। নন্দীগ্রাম আর সিঙ্গুর বর্বরতার কলঙ্কনিন্দিত সাক্ষী হয়ে ওঠে অচিরেই। প্রাত্যহিক জীবনে ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে লালিত সন্ত্রাস চারপাশের আলো-বাতাস অন্ধকারে ঢেকে দেয়। যে পদ্ধতিতে পশ্চিমবাংলার ক্ষমতাসীন সরকার এই দুই গ্রামের কৃষি জমিতে উচ্ছেদ প্রক্রিয়া চালায়, তার সঙ্গে অধিকাংশ কৃষকেরই সমর্থন ঘটেনি। কোনো একজন কৃষক সন্তান কৃষিকাজ করতে চান না বলে কৃষিজমির প্রয়োজনীয়তা লুপ্ত হয়ে যাবে, এ কথা কে বলেছে, যেসব কৃষক অধিকাংশের ওপর ক্ষমতা দেখাতে গেছেন, তাদের সম্পর্কে কলামের ভাষা আমরা কি ভুলে যাচ্ছি যে, একটা লম্বা সময় ধরে গ্রামাঞ্চলের কৃষককে সিপিএম ক্যাডার বানানো হয়েছে পয়সা বা ক্ষমতার প্রলোভন দেখিয়ে। একসময় যারা কৃষক ছিলেন, আজ তাদের অনেকেই ক্যাডার। এমনই ভয়ংকর এই ক্যাডারিকরণ পদ্ধতি, এমনই সুদীর্ঘ নিষ্ঠুর যে- আজ ধানের গোলায় আগুন দিতে সেই কৃষক ক্যাডারের এতটুকু হাত কাঁপে না। সিপিএম এখন ধর্ম।

স্বাভাবিকভাবে অনেকের মনে হতে পারে ঋতুপর্ণ তৃণমূলের টাকা খেয়ে এসব লিখছেন। সেই জবাব তিনি নিজেই দেন। তাঁর পরম প্রিয়জন বাবা পরিবর্তনের চাহিদায় সিপিএম এর সমর্থক হন। এবং শেষ অবধি সেই সমর্থন বহন করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, হতে পারে, দেশভাগে ভিটেমাটি উচ্ছিন্ন হয়ে এ বাংলায় চলে আসার সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন নেহরু-গান্ধীর উচ্চবিত্ত রাজনীতি সম্পর্কে এক উদগ্র অভিমান। স্থান পরিবর্তন ও পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের মধ্যে একটা বাধ্যতামূলক বেদনা আছে। হয়তোবা সেই সময় নীচুতলার মানুষের স্বপ্ন দেখার যে অমোঘ প্রভাতসূর্য-রঙা পার্টি, তাকেই অজান্তে আঁকড়ে ধরেছিল বাবা। আরও অনেক অনেক মানুষের মতো। সেটাই বোধহয় বাবার সামাজিক-রাজনৈতিক চেতনায় সব থেকে বড় পরিবর্তন। যেটা আজও মনে মনে অপরিবর্তিত থেকে গেছে। বাম রাজনীতি বা বাম সরকারের সঙ্গে ঋতুপর্ণের সম্পর্কেও কোন ফাটল ছিল না। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী যখন একের পর এক মারণযজ্ঞের দায়িত্ব নিচ্ছেন কিন্তু কৃতকর্মের দায়ভাগ নিচ্ছেন না, নেতাদের ধবধবে আদ্দির পোশাক যখন কার্যত খাকি পোশাকের মতো দেখায়, বামফ্রন্টের শরিক দলগুলোর প্রতি জ্যোতিবাবুর- ‘খেয়োখেয়ি করো না’- নিষ্ফল আর্তি যখন মহাকাব্যের কুরুশক্তির অশক্ত ধৃতরাষ্ট্রকে মনে করিয়ে দেয়, যখন সবাই ভুলে বসে- মাটি নিয়ে এই নিরন্তর বিবাদসূত্রের অন্তিম পরিণতি যে কুরুক্ষেত্রের ঘোর প্রলয়যুদ্ধ, তখন নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে সন্দেহ ও অবিশ্বাসের উৎস খোঁজেন। একসময় বাম সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্কের কথা অবলীলায় স্বীকার করেন। যে কোন ছোট সাহসের কাজে পাশে দাঁড়ানোর জন্য বারবার তো এই বিশ্বাসের জায়গাতেই শরণসন্ধান করেছি। সেই আশ্রয় খোঁজার মধ্যে কোনো গ্লানি ছিল না, কোনো অগৌরব বোধ করিনি কোনোদিনও। কিন্তু যা ঘটে গেল গত কয়েক মাসে, তার থেকে বড় সর্বনাশ আর কী হবে? বিজেপি মৌলবাদী তাই তাঁরা প্রগতিশীল চিন্তায় নিন্দার্হ্য। পশ্চিমবাংলায় সিপিএম-ও তো এখন ধর্ম। প্রাতিষ্ঠানিক সমাজ চালনাপন্থা। নিজের বিশ্বাসকে অভ্রান্ত মনে করে সদম্ভে বেঁচে থাকা, যেখানে অন্য কোনো সমান্তরাল বিশ্বাসই যদি মৌলবাদ হয়, তাহলে নতুন করে কেন মৌলবাদের ভয় পাচ্ছি আর?

ঋতুপর্ণ দেখেন আর লেখেন- শাসকরা কৃত্রিম স্বচ্ছতায় যে সত্য তুলে ধরেন, তার পেছনে ভারি অন্ধকার পর্দা। আর এই পর্দার অন্তরালে প্রতিনিয়ত পালটে যাচ্ছে রঙ্গমঞ্চের দৃশ্যপট। অন্যদিকে বিরোধীরা আপাতত অত্যাচারীদের পক্ষে কথা বলে নিজেদের মতো করে তথ্য সাজাচ্ছেন। সাধারণ জনগণ বিবেকের দায়ভার লঘু করার জন্য বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের ডালি সাজিয়ে চলছেন। রাজ্যপ্রধান কেবল তাঁর রাজনৈতিক দলকর্মীদের দায়িত্ব নিয়েই দায়মুক্ত হতে পারেন না। মানুষের প্রতি ক্ষীণ, মুমূর্ষু, প্রতিবাদী, শান্ত নিশ্বাস-প্রশ্বাসের প্রতিও তাঁর সমান দায়িত্ব আছে। হিংসার নিরপেক্ষ হিসেবের দায়িত্ব আপনার, আমাদের, সকলের। যারা শাসন করছেন বা যারা বিরোধিতা করছেন- সবার। শাসক না বিরোধী- সেই তকমাই কি এখন থেকে নির্ধারণ করবে মানবজীবনের পরিণতিমূল্য? সত্যিই জীবন কি তাহলে এত মূল্যহীন?

এসব কথা এত স্পষ্ট করে বলার বিপদ সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট সজাগ থাকেন। কিন্তু তাঁর বিবেকবোধের তাড়নায় কলাম লেখা চলেছে নির্ভয়ে। এই দুঃসময়ে বারবার তাকান দেশের সচেতন সমাজের দিক। অগ্রজরা, যারা আদর্শ হয়ে ছিলেন চোখের সামনে, যাদের বাক্য-কর্ম-যুক্তি চিরকাল ঈর্ষণীয়ভাবে অনুকরণযোগ্য ছিল, তাঁরা কোথায়? যাঁদের জীবনচর্চা শিখিয়েছে কী করে মাথা উঁচু করে বাঁচতে হয়, তারা চুপ কেন? মহাশ্বেতা দেবীদের মতো মানুষ কেন আন্দোলনকে মমতামুক্ত করে উভয় দলকে বোঝাতে পারলেন না- না, কোনো ব্যক্তি নয়, সমস্যাটা এই। সেটাকে চেনো। এই চেনাচেনির চেষ্টার জায়গায় আর একটা পক্ষ এখন বড় শক্তিশালী। সেটা হচ্ছে মিডিয়া। এইসব প্রতিবাদী কৃষক পরিবারের পাঁচশ’ বাচ্চা একদিন অনাহারে রইল, সেটা খবর হয় না। খবর হয় চৌরঙ্গীর ধরণা মঞ্চে কে এলেন, কে গেলেন। মিডিয়া বড় চতুরভাবে, কখন যে সবার অজান্তে কোনো একটা আন্দোলনের গায়ে একটা বিশেষ মানুষের পোস্টার সেঁটে দেয় সেটা বুঝতেও দেয় না। এমনভাবে দেয়, যাতে সেই মানুষটার ব্যক্তিগত ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো আন্দোলনটার স্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়। শাসকদলের ঔদ্ধত্য নিয়ে কথা হয়, কিন্তু যে সাধারণ মানুষ নিজেদের রুটি রুজির প্রশ্নে কোনো আন্দোলনে যান, সেখানে তাদের মতামত ছাড়াই রাজনৈতিক ফায়দা লাভের প্রশ্নে যখন কেউ হরতাল বা ইত্যাদি কর্মসূচি ডেকে দেয় সেটাই কী কম ঔদ্ধত্যপূর্ণ? গ্রামে গিয়ে তাদের সঙ্গে কাজ করার একটা শৌখিন বুলি সবাই আওড়ায়। ঋতুপর্ণের কলামে দেখা যায়, এই নাগরিক উন্নাসিকতা একটু দূরে সরিয়ে রেখে তাকালেই দেখতে পাব যে আমরা গ্রামকে শেখাব কয়েকটা ইংরেজিতে লেখা অক্ষর। আর, গ্রাম আমাদের শেখাবে হাজার হাজার বছরের ইতিহাস। যার কাছে আমরা সকলেই নতজানু। যার চোখে চোখ রাখবার মতো ক্ষণজন্মা বড় কম। কালেভদ্রে, একটা কার্ল মার্ক্স, একটা রবীন্দ্রনাথ, ব্যস। এই প্রবাহমান সভ্যতার শরিক হতে পারলে সত্যিকারের উন্নয়ন কাকে বলে বোঝা যায়।

শাসকদলের কর্মী দিয়ে ধর্ষিতা তাপসি মালিকের মৃত্যুকেও মিডিয়া ইনিয়ে-বিনিয়ে রোমাঞ্চকর করে তোলে। এই ধর্ষণ আর গ্রামের মাটিকে ক্ষমতার লড়াইয়ে রক্তাক্ত করা একই পুরুষতন্ত্রের মাফিয়া বলে তিনি মনে করেন। খুব বেশিদিন হয়তো লাগবে না। আগামী যুগের বাংলা অভিধানে কিছুদিনের মধ্যেই উন্নয়ন মানে লেখা হবে উৎখাত। কাছের জনরা বারবার সাবধান করেছে তাঁর এই কলম চালনাকে। উভয় পক্ষেরই শিকার হতে পারতেন যে কোন সময়। শুধুমাত্র জাতীয় আন্তর্জাতিক স্তরে বিশাল পরিচিতির কারণে বড়সড় বিপদ থেকে বেঁচে গেছেন। তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের বিষয়ে এবং সুযোগ-সুবিধামতো কোন প্রতিবাদে শামিল হবার আত্মগরিমা নিয়েও তিনি লেখেন, নিজেদের বুদ্ধিজীবী ঘোষণা করতে কেমন যেন একটু অপ্রস্তুত লাগছে না? মিডিয়া যা বলে বলুক, আমরা কেন নিজেদের বুদ্ধিজীবী বলে ডাকতে শুরু করলাম? কথাটা গালভরা বলে? মানুষ মাত্রেই বুদ্ধির সাহায্যে জীবনযাপন করেন। তবে এই শৌখিন শ্রেণিবিভাগ কেন? আমরা কি আমাদের নিজ নিজ শক্তির পরিচয়- লেখক, শিল্পী, কবি, নাট্যকর্মী, চলচ্চিত্রকারের অভিধাগুলোয় আর বিশ্বাস করতে পারছি না?

খুব দ্রুত পট পরিবর্তন হলো। বাম শাসনের তাকাতে তাঁর কষ্ট হচ্ছে। কেন হচ্ছে? তাও লেখেন কলামে অন্তর থেকে যাকে চূড়ান্ত পরিবর্তন বলে জেনে এসেছে মানুষটা, যে পরিবর্তনের স্থিতিতে বিশ্বাস করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে গত ৩২ বছর, তাকে কী বলে বোঝাব, -এটা পরিবর্তন ছিল না, বাবা। পরিবর্তন কায়েম করে না। পরিবর্তন বদল আনে।

পশ্চিমবাংলার রাজনীতিতে বামফ্রন্টের তিন দশকের বেশি সময়ের পতন আর তৃণমূলের উত্থান ও জনজীবনে কোনো বদল আনেনি। রাজ্য সরকারের ক্ষমতার পরিবর্তন হয়নি বলে কদিনের মধ্যেই অসন্তোষ প্রকট হচ্ছে বলে মনে হতে থাকে ঋতুপর্ণের কাছে। সবার মনেই প্রশ্ন একটানা ক্ষমতায় বামফ্রন্টের ভেতর গজিয়ে ওঠা যে স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে মানুষ পরিবর্তন আনে, সেখানেও কি অপরিণামদর্শী অন্ধকার ঢেকে দেবে সব আলোর প্রতিশ্রুতি। কলামের ভাষায় সেই সংশয়কে ঘিরে তাঁর লেখায় দেখি, কোনো প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে যখন কোনো নেতিবাচকতা তৈরি হয়, তখন তার সমালোচনাপ্রবাহ এত দ্রুত এক গভীর নদীপথ তৈরি করে নেয়, যার স্রোতে সামগ্রিক যুক্তি-বুদ্ধিও নিতান্তই খড়কুটো। সমালোচনা বা বিদ্বেষটুকু এক সর্বনাশা সংক্রামক ব্যাধির মতোই সর্বগ্রাসী সামগ্রিক হতাশার মধ্যেও নতুন সরকারের কোনো শুভ উদ্যোগকে নিরবচ্ছিন্ন বিতৃষ্ণা দিয়ে দূরে ঠেলতে সেই সময়কালে তাঁর দ্বিধা ছিল। তিমিরবিনাশী শুভ কোন সকালের প্রত্যাশা তাঁর অবশ্যই ছিল। সেটা জীবনে-মরণে সমালোচিতও হন অনেকের কাছেই। ব্যক্তি ঋতুপর্ণের জীবনে সকল কর্ম আনন্দর মাঝেও অন্তঃসলিলা বেদনার ফল্গুধারা বহমান ছিল। শিল্প ও সুন্দরের ভাববাদে অরাজনৈতিক এই মানুষটি দেশ-কালের এলোমেলো পরিস্থিতিতে তাঁর মতো করেই সবকিছু দেখেন এবং বিশ্লেষণ করেন। সেখানে আবেগ আছে। কিন্তু যে যুক্তির কষ্টিপাথরে আবেগ বোধ হয়ে ওঠে সেই পদ্ধতিটা তাঁর চিন্তা-চেতনায় অনুপস্থিত তা বলা যায় না ।

শুরুতেই বলেছি, নির্দিষ্ট কোন মতবাদ দিয়ে ঋতুপর্ণের রাজনৈতিক চেতনাবোধের বিশ্লেষণ করার জন্য এই লেখা নয়। অসময়ে চলে না গেলে আজ তিনিও নিজের বাবার মতো আহত হতেন বলেই মনে হয়। কারণ, তাঁর মনোবীক্ষণের চলমানতা ও প্রসারণশীলতা বর্তমান ধারাকে মানতে পারত বলে সন্দেহ হয়। তাঁর এই লেখাগুলো নিজের দেশের ও সময়ের প্রেক্ষিতে। আমাদের নিজেদের দেশ-কালের সঙ্গে এলোমেলো কিছু মিল বা অমিল হয়ত আমরা পেলেও পেতেও পারি। তবে তাঁর মতো করে বলতে পারা অনেকের জন্যই হয়তো কঠিন। আমি সাধারণ মানুষ। আমার মধ্যে এখনও কিছু সাদা কালো আছে- সেটা থাক। সেটা হারাতে চাই না আমি। আমি সরকারের থেকে আমার বিবেককে বেশি বিশ্বাস করি। আপনাদেরও করতে হবে বলছি না। শুধু খবরটা দিলাম। এই শুধু নিজের বিবেককে বিশ্বাসের খবরটা কানাকানি হয় যদি, হোক না!

image

ঋতুপর্ণ ঘোষ

আরও খবর
৬৯ বছরে সংবাদ
ভাষা থেকে ভূখন্ড
স্মৃতিময় সংবাদ-এর ৬৯ বছর
একটি রাজনৈতিক পাঠ
সংবাদ : কিছু কথা কিছু স্মৃতি
যুগে যুগে সংবাদপত্রের অগ্রযাত্রা
আলোর তৃষ্ণায় জাগো
ইতিহাস ঐতিহ্য ও আদর্শের স্মারক দৈনিক সংবাদ
কেন লিখি
সংবাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আত্মার
ঐতিহ্য আর মুক্তচিন্তার সংবাদ
আমার সংবাদ সংবাদের আমি
বিচিত্র জীবিকা বিচিত্র জীবন
চীন ও বাংলাদেশ : প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সম্পর্ক
সংবাদের জলসাঘর
আমরা এখন শান্ত হয়ে আছি
মাটির মাধুর্য
কষ্টের ঢাকা স্বপ্নের বাংলাদেশ
তোমারে বধিবে যে...
বঙ্গবন্ধুর জনকল্যাণের অর্থনৈতিক নীতি কৌশল
শারহুল পটবসন্ত ও বজলুর রহমান
শিশুশিক্ষায় শিল্প-সাহিত্য-সংগীত
গণমাধ্যমের হাল-হকিকত
এবং বজলুর রহমান স্মৃতিপদক
দুর্নীতি, পেশাদারিত্ব ও উন্নয়ন
বাংলাদেশের থিয়েটার চর্চার ভবিষ্যৎ
চেতনায় নৈতিকতা মূল্যবোধ : বিরুদ্ধবাস্তবতা
সবার উপরে মানুষ সত্য
আহমদুল কবির শ্রদ্ধাঞ্জলি
কার্যকর সংসদ এবং সুশাসনের স্বপ্ন
‘সংবাদ’ আমারই ছিল আমারই আছে
আমাদের ‘সংবাদ’
নারীর অধিকার ও সচেতনতা
গণমাধ্যমে বিশ্বাস কমছে পাঠকের
নারী ও তার বিধাতা পুরুষ
বাংলাদেশের নারী
সংবাদের কাছে আমি ঋণী
বিস্মৃতিপ্রবণতা ও রাষ্ট্রের অক্ষমতা
যে দীপশিখা দিয়েছে আলো

বুধবার, ১০ জুলাই ২০১৯ , ২৬ আষাঢ় ১৪২৫, ৬ জ্বিলকদ ১৪৪০

ঋতুপর্ণ ঘোষের এলোমেলো দেশকাল

দেবাহুতি চক্রবর্তী

image

ঋতুপর্ণ ঘোষ

ঋতুপর্ণ ঘোষ বাংলা চলচ্চিত্র জগতের অতি পরিচিত এক নাম। পশ্চিম বাংলার শিক্ষিত-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষকে সেখানকার চলচ্চিত্র জগতের এক দুঃসময়ে প্রেক্ষাগৃহে ফিরিয়ে নেবার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। শুধু পশ্চিম বাংলার নয়, বাঙালি হিসেবে চলচ্চিত্রপ্রেমী সকলেই কোনো না কোনোভাবে ঋতুপর্ণের কাছে কৃতজ্ঞ। সেই ঋতুপর্ণের সংসার-জীবন ঘিরে আমবাঙালির কৌতূহল ছিল অনিঃশেষ, সকলেই কোনো না কোনো অছিলায় তার খড়খড়িতে চোখ রাখতে চেয়েছেন অবরেসবরে থ- (অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়)। আশৈশব তাঁর স্বভাবের ও কণ্ঠস্বরের নারী সুলভতার জন্য অপরিশীলিত উপহাস-অপমান সহ্য করেই এক বিপন্ন ও নিঃসঙ্গ জীবনচর্চার মাঝ দিয়েই শিল্পজগতের বিভিন্ন অঙ্গনে তাঁর অসাধারণ অবদান চিরস্মরণীয়।

এই ঋতুপর্ণের বাইরে কলাম-লেখক হিসেবেও তিনি বিশেষ এক স্থানের অধিকারী। প্রায় সাত বছর একটানা একটি পত্রিকায় তিনি কলাম লেখেন। সম্পাদক হিসেবে নিজে লেখার সময় পত্রিকার বিষয় বা আঙ্গিক নিয়ে তিনি ভাবেননি। নিজের ভালো লাগা-মন্দ লাগা, নিজের বিশ্বাসকে প্রাধান্য দিয়ে ভাষার বিশিষ্টতায় একের পর এক বিষয়ের নিগড় ভাঙা আর গড়ায় নিজেকে ব্যাপৃত রাখেন। বাংলা ভাষার কলাম সাহিত্য হিসেবে যা অনবদ্য। সেই অসংখ্য কলাম থেকে রচনাকালীন পশ্চিমবাংলার রাজনীতি আর দেশকাল নিয়ে তাঁর লেখা আর চিন্তাচেতনা নিয়ে কিছু আলোকপাত করাই আমার উদ্দেশ্য। বলা ভালো, এখানে আলোচিত তাঁর মতামত সম্পূর্ণই তাঁর নিজস্ব। সেখানে মতদ্বৈধতা, সমালোচনা করার স্বাধীনতা সকলেরই রয়েছে। নিরেট চলচ্চিত্র জগতের মানুষ হিসেবে আমাদের অধিকাংশের জানার আড়ালে এলোমেলো দেশকাল তাঁকেও রাজনীতি-সচেতন যে কোন ব্যক্তির মতো তাড়িত করেছে এবং সেটা না জানলে তাঁকে যে সম্পূর্ণ জানা হয় না, এটুকুই জানানোর।

পশ্চিমবাংলার বামফ্রন্টের ক্ষমতার শেষদিকে শিল্পের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে নন্দীগ্রাম আর সিঙ্গুরের কৃষক জনতার সঙ্গে শাসক শ্রেণির বিরোধ এতটাই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে যে, এতদিন যারা সুবিধা করতে পারেনি, সেই রাজনৈতিক দল এই বিরোধকে ব্যবহার করে বাম শাসনের উচ্ছেদ এবং নিজেদের ক্ষমতা চূড়ান্ত করতে সম্ভবপর হয়ে ওঠে। এই সময়কালের লেখাগুলোই মূলত এখানকার আলোচ্য। ঋতুপর্ণর ভাবনায় সিঙ্গুর নিয়ে যে বিতর্কটা শুরু হয়েছিল, আমি বিশ্বাস করি, তার গূঢ় এবং মূল প্রশ্নটি মানবসভ্যতার। কোন রাজনৈতিক দলের নয়। কৃষিজমিতে শিল্প বা ভূমিপুত্র সমস্যা থেকে আমরা স্বাচ্ছন্দ্যে সরে এসেছি মমতা-বুদ্ধদেবের দ্বৈরথে। কেন? সিঙ্গুরের লড়াইটা সিঙ্গুরের মানুষের, তাকে নেতৃত্ব দেওয়ার আমরা কেউ নই। এটাকে বুদ্ধদেব-মমতার ক্ষমতা বা জনপ্রিয়তা দখলের লড়াই থেকে সরিয়ে এনে দেখতে পারলে, সভ্যতার একটা সংকট হিসেবে এর দিকে তাকাতে পারলে, তবেই কিছুটা সুবিচার হয়তো আমরা মনে মনে হলেও করতে পারতাম। যে কোন ঘটনা মানুষের কাছ থেকে যেমন নানা প্রতিক্রিয়া আদায় করে নেয়, সমর্থন বা তীব্র বিদ্বেষ, এই ঘটনার পরিণতি তেমনই হতে পারত।

আসলে তা হয়নি। ঘোলাজলে মাছ শিকারে রাজনীতিবিদরা সবসময় পটু। উল্টোভাবে ধরলে জল ঘোলা করার দায়িত্বটাও কোন এক পক্ষ নিয়ে নেয়। মানে মূল লড়াইটা দাঁড়ায়, ক্ষমতায় টিকে থাকার বা ক্ষমতায় যাওয়ার। নন্দীগ্রাম আর সিঙ্গুর বর্বরতার কলঙ্কনিন্দিত সাক্ষী হয়ে ওঠে অচিরেই। প্রাত্যহিক জীবনে ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে লালিত সন্ত্রাস চারপাশের আলো-বাতাস অন্ধকারে ঢেকে দেয়। যে পদ্ধতিতে পশ্চিমবাংলার ক্ষমতাসীন সরকার এই দুই গ্রামের কৃষি জমিতে উচ্ছেদ প্রক্রিয়া চালায়, তার সঙ্গে অধিকাংশ কৃষকেরই সমর্থন ঘটেনি। কোনো একজন কৃষক সন্তান কৃষিকাজ করতে চান না বলে কৃষিজমির প্রয়োজনীয়তা লুপ্ত হয়ে যাবে, এ কথা কে বলেছে, যেসব কৃষক অধিকাংশের ওপর ক্ষমতা দেখাতে গেছেন, তাদের সম্পর্কে কলামের ভাষা আমরা কি ভুলে যাচ্ছি যে, একটা লম্বা সময় ধরে গ্রামাঞ্চলের কৃষককে সিপিএম ক্যাডার বানানো হয়েছে পয়সা বা ক্ষমতার প্রলোভন দেখিয়ে। একসময় যারা কৃষক ছিলেন, আজ তাদের অনেকেই ক্যাডার। এমনই ভয়ংকর এই ক্যাডারিকরণ পদ্ধতি, এমনই সুদীর্ঘ নিষ্ঠুর যে- আজ ধানের গোলায় আগুন দিতে সেই কৃষক ক্যাডারের এতটুকু হাত কাঁপে না। সিপিএম এখন ধর্ম।

স্বাভাবিকভাবে অনেকের মনে হতে পারে ঋতুপর্ণ তৃণমূলের টাকা খেয়ে এসব লিখছেন। সেই জবাব তিনি নিজেই দেন। তাঁর পরম প্রিয়জন বাবা পরিবর্তনের চাহিদায় সিপিএম এর সমর্থক হন। এবং শেষ অবধি সেই সমর্থন বহন করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, হতে পারে, দেশভাগে ভিটেমাটি উচ্ছিন্ন হয়ে এ বাংলায় চলে আসার সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন নেহরু-গান্ধীর উচ্চবিত্ত রাজনীতি সম্পর্কে এক উদগ্র অভিমান। স্থান পরিবর্তন ও পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের মধ্যে একটা বাধ্যতামূলক বেদনা আছে। হয়তোবা সেই সময় নীচুতলার মানুষের স্বপ্ন দেখার যে অমোঘ প্রভাতসূর্য-রঙা পার্টি, তাকেই অজান্তে আঁকড়ে ধরেছিল বাবা। আরও অনেক অনেক মানুষের মতো। সেটাই বোধহয় বাবার সামাজিক-রাজনৈতিক চেতনায় সব থেকে বড় পরিবর্তন। যেটা আজও মনে মনে অপরিবর্তিত থেকে গেছে। বাম রাজনীতি বা বাম সরকারের সঙ্গে ঋতুপর্ণের সম্পর্কেও কোন ফাটল ছিল না। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী যখন একের পর এক মারণযজ্ঞের দায়িত্ব নিচ্ছেন কিন্তু কৃতকর্মের দায়ভাগ নিচ্ছেন না, নেতাদের ধবধবে আদ্দির পোশাক যখন কার্যত খাকি পোশাকের মতো দেখায়, বামফ্রন্টের শরিক দলগুলোর প্রতি জ্যোতিবাবুর- ‘খেয়োখেয়ি করো না’- নিষ্ফল আর্তি যখন মহাকাব্যের কুরুশক্তির অশক্ত ধৃতরাষ্ট্রকে মনে করিয়ে দেয়, যখন সবাই ভুলে বসে- মাটি নিয়ে এই নিরন্তর বিবাদসূত্রের অন্তিম পরিণতি যে কুরুক্ষেত্রের ঘোর প্রলয়যুদ্ধ, তখন নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে সন্দেহ ও অবিশ্বাসের উৎস খোঁজেন। একসময় বাম সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্কের কথা অবলীলায় স্বীকার করেন। যে কোন ছোট সাহসের কাজে পাশে দাঁড়ানোর জন্য বারবার তো এই বিশ্বাসের জায়গাতেই শরণসন্ধান করেছি। সেই আশ্রয় খোঁজার মধ্যে কোনো গ্লানি ছিল না, কোনো অগৌরব বোধ করিনি কোনোদিনও। কিন্তু যা ঘটে গেল গত কয়েক মাসে, তার থেকে বড় সর্বনাশ আর কী হবে? বিজেপি মৌলবাদী তাই তাঁরা প্রগতিশীল চিন্তায় নিন্দার্হ্য। পশ্চিমবাংলায় সিপিএম-ও তো এখন ধর্ম। প্রাতিষ্ঠানিক সমাজ চালনাপন্থা। নিজের বিশ্বাসকে অভ্রান্ত মনে করে সদম্ভে বেঁচে থাকা, যেখানে অন্য কোনো সমান্তরাল বিশ্বাসই যদি মৌলবাদ হয়, তাহলে নতুন করে কেন মৌলবাদের ভয় পাচ্ছি আর?

ঋতুপর্ণ দেখেন আর লেখেন- শাসকরা কৃত্রিম স্বচ্ছতায় যে সত্য তুলে ধরেন, তার পেছনে ভারি অন্ধকার পর্দা। আর এই পর্দার অন্তরালে প্রতিনিয়ত পালটে যাচ্ছে রঙ্গমঞ্চের দৃশ্যপট। অন্যদিকে বিরোধীরা আপাতত অত্যাচারীদের পক্ষে কথা বলে নিজেদের মতো করে তথ্য সাজাচ্ছেন। সাধারণ জনগণ বিবেকের দায়ভার লঘু করার জন্য বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের ডালি সাজিয়ে চলছেন। রাজ্যপ্রধান কেবল তাঁর রাজনৈতিক দলকর্মীদের দায়িত্ব নিয়েই দায়মুক্ত হতে পারেন না। মানুষের প্রতি ক্ষীণ, মুমূর্ষু, প্রতিবাদী, শান্ত নিশ্বাস-প্রশ্বাসের প্রতিও তাঁর সমান দায়িত্ব আছে। হিংসার নিরপেক্ষ হিসেবের দায়িত্ব আপনার, আমাদের, সকলের। যারা শাসন করছেন বা যারা বিরোধিতা করছেন- সবার। শাসক না বিরোধী- সেই তকমাই কি এখন থেকে নির্ধারণ করবে মানবজীবনের পরিণতিমূল্য? সত্যিই জীবন কি তাহলে এত মূল্যহীন?

এসব কথা এত স্পষ্ট করে বলার বিপদ সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট সজাগ থাকেন। কিন্তু তাঁর বিবেকবোধের তাড়নায় কলাম লেখা চলেছে নির্ভয়ে। এই দুঃসময়ে বারবার তাকান দেশের সচেতন সমাজের দিক। অগ্রজরা, যারা আদর্শ হয়ে ছিলেন চোখের সামনে, যাদের বাক্য-কর্ম-যুক্তি চিরকাল ঈর্ষণীয়ভাবে অনুকরণযোগ্য ছিল, তাঁরা কোথায়? যাঁদের জীবনচর্চা শিখিয়েছে কী করে মাথা উঁচু করে বাঁচতে হয়, তারা চুপ কেন? মহাশ্বেতা দেবীদের মতো মানুষ কেন আন্দোলনকে মমতামুক্ত করে উভয় দলকে বোঝাতে পারলেন না- না, কোনো ব্যক্তি নয়, সমস্যাটা এই। সেটাকে চেনো। এই চেনাচেনির চেষ্টার জায়গায় আর একটা পক্ষ এখন বড় শক্তিশালী। সেটা হচ্ছে মিডিয়া। এইসব প্রতিবাদী কৃষক পরিবারের পাঁচশ’ বাচ্চা একদিন অনাহারে রইল, সেটা খবর হয় না। খবর হয় চৌরঙ্গীর ধরণা মঞ্চে কে এলেন, কে গেলেন। মিডিয়া বড় চতুরভাবে, কখন যে সবার অজান্তে কোনো একটা আন্দোলনের গায়ে একটা বিশেষ মানুষের পোস্টার সেঁটে দেয় সেটা বুঝতেও দেয় না। এমনভাবে দেয়, যাতে সেই মানুষটার ব্যক্তিগত ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো আন্দোলনটার স্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়। শাসকদলের ঔদ্ধত্য নিয়ে কথা হয়, কিন্তু যে সাধারণ মানুষ নিজেদের রুটি রুজির প্রশ্নে কোনো আন্দোলনে যান, সেখানে তাদের মতামত ছাড়াই রাজনৈতিক ফায়দা লাভের প্রশ্নে যখন কেউ হরতাল বা ইত্যাদি কর্মসূচি ডেকে দেয় সেটাই কী কম ঔদ্ধত্যপূর্ণ? গ্রামে গিয়ে তাদের সঙ্গে কাজ করার একটা শৌখিন বুলি সবাই আওড়ায়। ঋতুপর্ণের কলামে দেখা যায়, এই নাগরিক উন্নাসিকতা একটু দূরে সরিয়ে রেখে তাকালেই দেখতে পাব যে আমরা গ্রামকে শেখাব কয়েকটা ইংরেজিতে লেখা অক্ষর। আর, গ্রাম আমাদের শেখাবে হাজার হাজার বছরের ইতিহাস। যার কাছে আমরা সকলেই নতজানু। যার চোখে চোখ রাখবার মতো ক্ষণজন্মা বড় কম। কালেভদ্রে, একটা কার্ল মার্ক্স, একটা রবীন্দ্রনাথ, ব্যস। এই প্রবাহমান সভ্যতার শরিক হতে পারলে সত্যিকারের উন্নয়ন কাকে বলে বোঝা যায়।

শাসকদলের কর্মী দিয়ে ধর্ষিতা তাপসি মালিকের মৃত্যুকেও মিডিয়া ইনিয়ে-বিনিয়ে রোমাঞ্চকর করে তোলে। এই ধর্ষণ আর গ্রামের মাটিকে ক্ষমতার লড়াইয়ে রক্তাক্ত করা একই পুরুষতন্ত্রের মাফিয়া বলে তিনি মনে করেন। খুব বেশিদিন হয়তো লাগবে না। আগামী যুগের বাংলা অভিধানে কিছুদিনের মধ্যেই উন্নয়ন মানে লেখা হবে উৎখাত। কাছের জনরা বারবার সাবধান করেছে তাঁর এই কলম চালনাকে। উভয় পক্ষেরই শিকার হতে পারতেন যে কোন সময়। শুধুমাত্র জাতীয় আন্তর্জাতিক স্তরে বিশাল পরিচিতির কারণে বড়সড় বিপদ থেকে বেঁচে গেছেন। তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের বিষয়ে এবং সুযোগ-সুবিধামতো কোন প্রতিবাদে শামিল হবার আত্মগরিমা নিয়েও তিনি লেখেন, নিজেদের বুদ্ধিজীবী ঘোষণা করতে কেমন যেন একটু অপ্রস্তুত লাগছে না? মিডিয়া যা বলে বলুক, আমরা কেন নিজেদের বুদ্ধিজীবী বলে ডাকতে শুরু করলাম? কথাটা গালভরা বলে? মানুষ মাত্রেই বুদ্ধির সাহায্যে জীবনযাপন করেন। তবে এই শৌখিন শ্রেণিবিভাগ কেন? আমরা কি আমাদের নিজ নিজ শক্তির পরিচয়- লেখক, শিল্পী, কবি, নাট্যকর্মী, চলচ্চিত্রকারের অভিধাগুলোয় আর বিশ্বাস করতে পারছি না?

খুব দ্রুত পট পরিবর্তন হলো। বাম শাসনের তাকাতে তাঁর কষ্ট হচ্ছে। কেন হচ্ছে? তাও লেখেন কলামে অন্তর থেকে যাকে চূড়ান্ত পরিবর্তন বলে জেনে এসেছে মানুষটা, যে পরিবর্তনের স্থিতিতে বিশ্বাস করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে গত ৩২ বছর, তাকে কী বলে বোঝাব, -এটা পরিবর্তন ছিল না, বাবা। পরিবর্তন কায়েম করে না। পরিবর্তন বদল আনে।

পশ্চিমবাংলার রাজনীতিতে বামফ্রন্টের তিন দশকের বেশি সময়ের পতন আর তৃণমূলের উত্থান ও জনজীবনে কোনো বদল আনেনি। রাজ্য সরকারের ক্ষমতার পরিবর্তন হয়নি বলে কদিনের মধ্যেই অসন্তোষ প্রকট হচ্ছে বলে মনে হতে থাকে ঋতুপর্ণের কাছে। সবার মনেই প্রশ্ন একটানা ক্ষমতায় বামফ্রন্টের ভেতর গজিয়ে ওঠা যে স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে মানুষ পরিবর্তন আনে, সেখানেও কি অপরিণামদর্শী অন্ধকার ঢেকে দেবে সব আলোর প্রতিশ্রুতি। কলামের ভাষায় সেই সংশয়কে ঘিরে তাঁর লেখায় দেখি, কোনো প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে যখন কোনো নেতিবাচকতা তৈরি হয়, তখন তার সমালোচনাপ্রবাহ এত দ্রুত এক গভীর নদীপথ তৈরি করে নেয়, যার স্রোতে সামগ্রিক যুক্তি-বুদ্ধিও নিতান্তই খড়কুটো। সমালোচনা বা বিদ্বেষটুকু এক সর্বনাশা সংক্রামক ব্যাধির মতোই সর্বগ্রাসী সামগ্রিক হতাশার মধ্যেও নতুন সরকারের কোনো শুভ উদ্যোগকে নিরবচ্ছিন্ন বিতৃষ্ণা দিয়ে দূরে ঠেলতে সেই সময়কালে তাঁর দ্বিধা ছিল। তিমিরবিনাশী শুভ কোন সকালের প্রত্যাশা তাঁর অবশ্যই ছিল। সেটা জীবনে-মরণে সমালোচিতও হন অনেকের কাছেই। ব্যক্তি ঋতুপর্ণের জীবনে সকল কর্ম আনন্দর মাঝেও অন্তঃসলিলা বেদনার ফল্গুধারা বহমান ছিল। শিল্প ও সুন্দরের ভাববাদে অরাজনৈতিক এই মানুষটি দেশ-কালের এলোমেলো পরিস্থিতিতে তাঁর মতো করেই সবকিছু দেখেন এবং বিশ্লেষণ করেন। সেখানে আবেগ আছে। কিন্তু যে যুক্তির কষ্টিপাথরে আবেগ বোধ হয়ে ওঠে সেই পদ্ধতিটা তাঁর চিন্তা-চেতনায় অনুপস্থিত তা বলা যায় না ।

শুরুতেই বলেছি, নির্দিষ্ট কোন মতবাদ দিয়ে ঋতুপর্ণের রাজনৈতিক চেতনাবোধের বিশ্লেষণ করার জন্য এই লেখা নয়। অসময়ে চলে না গেলে আজ তিনিও নিজের বাবার মতো আহত হতেন বলেই মনে হয়। কারণ, তাঁর মনোবীক্ষণের চলমানতা ও প্রসারণশীলতা বর্তমান ধারাকে মানতে পারত বলে সন্দেহ হয়। তাঁর এই লেখাগুলো নিজের দেশের ও সময়ের প্রেক্ষিতে। আমাদের নিজেদের দেশ-কালের সঙ্গে এলোমেলো কিছু মিল বা অমিল হয়ত আমরা পেলেও পেতেও পারি। তবে তাঁর মতো করে বলতে পারা অনেকের জন্যই হয়তো কঠিন। আমি সাধারণ মানুষ। আমার মধ্যে এখনও কিছু সাদা কালো আছে- সেটা থাক। সেটা হারাতে চাই না আমি। আমি সরকারের থেকে আমার বিবেককে বেশি বিশ্বাস করি। আপনাদেরও করতে হবে বলছি না। শুধু খবরটা দিলাম। এই শুধু নিজের বিবেককে বিশ্বাসের খবরটা কানাকানি হয় যদি, হোক না!