চেতনায় নৈতিকতা মূল্যবোধ : বিরুদ্ধবাস্তবতা

এলিজা খাতুন

ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি, জ্ঞানের সুস্থ বিকাশ। এর মধ্যে দিয়েই জাতি হেঁটে চলেছে। বিজ্ঞান প্রযুক্তির বিকাশের ফলে মানুষের জীবনযাপনের পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু আত্মিক উন্নয়ন হচ্ছে কি! মানুষের বৈশিষ্ট্য তো এই যে, তারা সমাজ ও পরিবারে শান্তি বজায় রাখার জন্য সর্বদা সচেতন, এমনকি পরিচিত বা অপরিচিত যেই হোক একের দুঃখে অপরে দুঃখিত হবে, সহমর্মিতা প্রকাশ করবে। মানুষ ও পশুর মধ্যে পার্থক্য করে তো ঐতিহ্যবোধ! যা সভ্যতাকে প্রতিষ্ঠিত করে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, জোরালোভাবেই বলা যাবে- সভ্য দেশসমূহের মধ্যে শোষণ, নিপীড়ন, দুর্নীতি, অনাচার আমাদের দেশেই বেশি। আবার প্রতিবাদ করার নজির আমাদের দেশেই বেশি। হতাশাজনক হলেও সত্য যে- আজকাল বেশিরভাগ প্রতিবাদ রাজনৈতিক বা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য হাসিলেই নিবেদিত; যা ভালো ফলের বদলে কুফল বয়ে আনে। নীতি-নৈতিকতা মূল্যবোধের অবক্ষয় ধরেছে সমাজ-রাষ্ট্রের প্রত্যেক শ্রেণিপেশার মধ্যে, বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনা সমাজে হাজার প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে, প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে সুস্থ সমাজ প্রত্যাশী নাগরিক মনে।

মানুষের মনোজগতকে নিয়ন্ত্রণ করে নৈতিকতা, আর তার আচার আচরণকে পরিমাপ করে মূল্যবোধ। আমরা জানি বোধ শব্দটির প্রতিশব্দ- জ্ঞান, বুদ্ধি, প্রজ্ঞা, মেধাশক্তি, চেতনা, অনুভূতি, উপলব্ধি; আবার বিবেক, চিন্তা, বুদ্ধি ও ন্যায়পরায়ণতা হচ্ছে নৈতিকতার উৎস। এসবের মাধ্যমে ভালো মন্দের বিচার করার ক্ষমতা দ্বারা মানুষের সামাজিক আচার আচরণের সমষ্টিই মূল্যবোধ; যা সমাজের নানা ক্ষেত্র সুন্দর ও পরিপূর্ণ হতে সাহায্য করে। সহজভাবে বলা যায় মূল্যবোধ মানুষের কাজের ভালো মন্দ বিচারের ভিত্তি।

প্রায় দেড়-দুই দশক পূর্বে কিংবা তারও অতীতে ঘটে যাওয়া ঘটনা পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারা যেত। এবং সে সব ঘটনা তোলপাড় সৃষ্টি করলেও বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে গণ্য করা হতো। আর এখন সামাজিক ও পারিবারিক অপরাধমূলক ঘটনা জলের মতো সহজ প্রবাহমান, এগুলো আর বিচ্ছিন্ন বলে এড়িয়ে যাবার নয়।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অর্জন এ জাতির শ্রেষ্ঠতম অর্জন। কিছু সংখ্যক বিভ্রান্ত মানুষ ছাড়া সবাই এজন্য সংগ্রাম করেছেন, সহ্য করেছেন সীমাহীন যন্ত্রণা। এমন বৃহৎ অর্জনকে অক্ষুণ্ন রাখতে বা আরও সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে দেশের নাগরিক হিসাবে মূল্যবোধ জাগ্রত করার মাধ্যমে আমাদের দায়িত্ব অনেক। ব্যক্তিগত মূল্যবোধ বিশেষভাবে স্বাধীনতাকে লালন করে। একটা ইতিহাস, একটা আনন্দ, একটা চরম ত্যাগের স্মৃতিচারণ। সেই ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে হারিয়ে গেল স্বাধীনতা। দু’শো বছরের গোলামীর পর ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগ তারপর আরেক অধ্যায়। শুরু হয় বৈষম্যের কলঙ্কময় সেই ইতিহাস। ভাষার অধিকারে প্রাণ দিয়ে বাংলাকে আদায় করে নিল এ দেশেরই সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর আরও অনেকে। এরপর ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানীদের ঘৃণ্য, জঘন্য হত্যাযজ্ঞ ... দেশের জন্য প্রাণ দিতে ঝাঁপিয়ে পড়া মহান মানুষদের আত্মত্যাগে এবং লক্ষ্য শহীদের রক্তের বদলে আজ আমরা এত্ত স্বাধীন! আমরা পেয়েছি বিজয় শব্দটি, কিন্তু প্রকৃত বিজয়ী কারা? শত বছরের পুরোনো মুক্তি মিলেছে বৈকি, কিন্তু প্রাণের মুক্তি কি প্রতৃতই মিলেছে? আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কাক্সিক্ষতভাবে সফল হয়েছে কি? লক্ষ শহীদের রক্তস্নাত বাংলার মাটি আজও দেখেই চলেছে আরও রক্ত- দলাদলি, অন্যায়-অনাচার, খুনাখুনি, সাম্প্রদায়িক হানাহানি।

সময়ের আবর্তে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে জাতীয় ঐক্য খন্ড-বিখন্ড হয়েছে, বিভক্তি এসেছে চেতনায়। জাতীয় লক্ষ্যও অনেক সময় ম্রিয়মাণ হয়েছে। যুগ ও সভ্যতার পরিবর্তনে সমাজের মানুষের মূল্যবোধেরও পরিবর্তন হয়। সহনশীলতা, আইনের শাসন ও সুশৃঙ্খল পরিবেশের অভাবে মূল্যবোধের অবক্ষয় হচ্ছে। একটা সমাজের মানুষের শিক্ষা, সংস্কৃতি, চিন্তা, চেতনা, বিশ্বাস, আচরণ এর ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে সামাজিক মূল্যবোধ। অথচ আজকের দিনে বিষের মতো সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে- হিংসা, দলাদলি, অন্যায়-অনাচার, দুর্বলের ওপর অকথ্য নির্যাতন, খুন, ধর্ষণ ইত্যাদি জঘন্য কার্যকলাপ; যা বিশ্বের কাছে আমাদের জাতির জন্য লজ্জার।

রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, সরকারি চাকরিজীবীদের নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় দেখে আমরা প্রায় অভ্যস্ত, কিন্তু শিক্ষক সমাজে অবক্ষয়? শিক্ষকতা পেশায় থেকে অনেকেরই চারিত্রিক স্খলন নির্মমভাবে দুশ্চিন্তা এনে দিয়েছে অভিভাবক সমাজে। এমনকি ধর্মীয় উপাসনালয়েও যৌন হয়রানি, ধর্ষণ নামক অনৈতিক বীভৎস কার্যকলাপ বিষাতুরভাবে উঁকি দিচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে। এটা কি সময় না-কি দুঃসময় চলছে!

একসময় এদেশে শিক্ষার হার খুব কম ছিল। বলা হতো- অশিক্ষিত জাতি এবং বর্বর জাতির মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না। অথচ বর্তমানে শিক্ষার হার যথেষ্ট হলেও মানুষের আচার-আচরণের মধ্যে পাশবিকতা বিরাজ করছে। মানবিক গুণাবলি থেকে এবং পারিবারিক-সামাজিক মূল্যবোধ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে গোটা সমাজ। সাধারণ মানুষ অন্তর্গত ন্যায়বোধের দ্বারা নির্দেশিত পথে চলতে পারছে না। বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ও জীবনধারায় ঘুষ-সুদ দুর্নীতি যেন অনিবার্য হয়ে উঠেছে! সমাজে দুর্নীতিগ্রস্ত ও চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা নানা রকম ভীতি সৃষ্টি করে সাধারণের জীবনযাপনকে দুঃসহ ও অসুস্থ করে তুলেছে।

বিস্ময়ের ব্যাপার আমরাই ওদের অবস্থানকে শক্ত করার সুযোগ দিচ্ছি। ভীতি সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর হুমকি মেনে নিচ্ছি; অন্যের বাঁচা মরা নিয়ে টুঁ শব্দ করি না। কীভাবে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ করতে হবে তা জেনেও উদ্যোগী হই না। কত শিশু ও নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছে প্রতিদিন তার সঠিক কোন হিসাব নেই, সব ঘটনা সংবাদ মাধ্যমে আসে না। সবটার প্রতিবাদও হয় না, অনেকে লোকলজ্জার ভয়ে চুপ থাকে, যে দু’একটির প্রতিবাদ হয় তার বিচার কার্য চলতে থাকে বছরের পর বছর। আমাদের সমাজে নারী ও শিশুর প্রতি যে আক্রমণাত্মক পরিস্থিতি তা বেড়েই চলছে দিনের পর দিন, তা মূল্যবোধের অভাবে। এসব অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি মোকাবিলায় কেবল সরকারের ওপর দায়ভার চাপিয়ে বসে থাকলে সমস্যা নিরসনের নিশ্চয়তা মিলবে না। উচিতও নয়। সমস্যার মূল জায়গাটিতে পৌঁছাতে হবে।

ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ অপরিহার্য। সমাজে অন্যায়-অনাচারের প্রতিবাদ-আন্দোলন করতে গিয়ে বিভ্রান্তিময় পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে আজকাল। গভীরভাবে লক্ষ্য করলে পাওয়া যায়- একসময়ের “নারীমুক্তি আন্দোলন” আজ “নারীবাদী আন্দোলন”-এ ঠেকেছে; যা সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রের। জাতীয় নানা সমস্যার প্রেক্ষিতে জাতীয় মুক্তির থেকে নারীমুক্তির বিষয়কে সম্পূর্ণ আলাদা করে নেয়া যুক্তিযুক্ত নয়।

নারী প্রসঙ্গে আসা এ জন্য যে, নৈতিক মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রে বা সমাজে বিরাজমান পরিস্থিতি অনুকূলে আসা বাঞ্ছনীয়। চেতনাগত দিক থেকে নারী পুরুষের মধ্যকার বৈষম্য, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, অস্পষ্টতা, কুসংষ্কারাচ্ছন্ন প্রচলিত ধারা- এসবকে সমাজ থেকে বিতাড়িত করার মনমানসিকতা গঠন হওয়া জরুরি। এ ব্যাপারে সক্রিয় হওয়া দরকার সমাজের প্রত্যেককেই। অন্যের গোঁড়ামি, মূর্খতা, ধুর্ততা, কুসংস্কার, অন্ধত্ব, এসবের বিরুদ্ধেও সোচ্চার ও সচেতন হওয়া বা মুখ খোলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এসবই অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় মানুষের সুস্থ সুন্দর মননের বিকাশ পথে। নেতিবাচক বিষয়গুলো মুখ বুজে দেখার এবং ভোগ করার মধ্যে মহত্ত্ব আছে কিছু!

অপরাধ সংঘটিত হয়ে গেলে তার শাস্তির বিধানস্বরূপ পরবর্তী পদক্ষেপ প্রশাসনের উপরে একশত ভাগ বর্তায়, কিন্তু অপরাধ প্রবণতা রোধ করার প্রধান উপায় শৈশবকে সুষ্ঠু-সুন্দর ও সঠিক পথে চালিত করা। এ শিক্ষা প্রদানের ভার পরিবারের। প্রত্যেক শিশুর পারিবারিক নৈতিক শিক্ষা পরিবারের অভিভাবকের উপরেই ন্যস্ত। সমাজের পথশিশু বা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন শিশুদের সঠিক পথ দেখানো, তাদের নষ্ট হওয়া থেকে টেনে ধরা দেশের নাগরিক তথা আমাদেরই কাজ। অথচ কতিপয় বিত্তশালী, রাজনৈতিক ব্যাক্তিবর্গ নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে ওদেরকে।

নৈতিক মূল্যবোধের এই ধ্বংসাত্মক চিত্র রোধে কর্মসূচি গ্রহণ করা এখন অতীব প্রয়োজন। আলো ও অন্ধকারের বিপরীতমুখী অবস্থানে ব্যক্তির মধ্যে চিন্তা বা বোধের জন্ম হয়। মানুষের জন্যই মানসিকতা শব্দটি নির্ধারিত; এই মানসিক পরিভ্রমণ দ্বারাই সঠিক বা ভুল নির্ণয় করা যায়। আর এই শিক্ষা ও মূল্যবোধ এর ভিত্তি প্রথমত তৈরি হয় শৈশবে পরিবার থেকে ভদ্রতা, শিষ্টাচার, সততা, নিয়ম-নিষ্ঠা, সহনশীলতা, ন্যায়-পরায়ণতা ইত্যাদি দ্বারা। দ্বিতীয়ত সূচনা হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। আমাদের প্রয়োজন নতুন প্রজন্মের কাছে সুন্দর ও সঠিক ভাবনা তুলে ধরা। অথচ আমরা খোঁজ রাখছি না আমাদের চারপাশেই উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা কীভাবে ভুল পথে নীরবে হাঁটছে। তাদের হাতের নাগালে পর্ণ ছবি, অশ্লীল ভিডিও, নেশাজাত দ্রব্যের সহজলভ্যতা; রাতে দেরি করে বাড়ি ফেরা। ওদের অনেকেরই অভিভাবকেরা দেখেও বিষয়টা তেমন আমলে নেন না। কোথায় ছিল? কেন ছিল? এসব প্রশ্ন তাৎক্ষণিক, এটুকু খোঁজ নিলেই বিপথে পা বাড়ানো সন্তান সুপথে ফেরে কি?

অনেক বাবা মা বলে থাকেন- বিয়ে দিলে সংসার হলে ঠিক হয়ে যাবে। অথচ আয়ত্তের বাইরে চলে যাওয়া নেশাজাতীয় দ্রব্যের প্রতি আকৃষ্ট ছেলেটি পরবর্তী সাংসারিক জীবনে অর্থের জন্য স্ত্রীকে নির্যাতন করে। আমাদের সমাজে অহরহ ঘটছে এমন ঘটনা। যা সমাজকে কলুষিত করছে স্লো পয়জনের মতো। এই নিশ্চিত অধঃপতন ঠেকাতে শিক্ষা জীবনেই শিক্ষার্থীদের মাঝে পুঁথিগত শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষার গুরুত্ব সমানভাবে দেয়া প্রয়োজন। তা হতে হবে ব্যবহারিক কাজের মধ্যে, তাদের বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজে অন্তর্ভুক্ত করে নষ্ট চিন্তা থেকে দূরে রাখতে হবে। তাছাড়া পাঠ্য বইয়ের বাইরেও শিক্ষামূলক গল্প কাহিনী পড়ায় আগ্রহী করে তোলা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মূল্যবোধ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে।

হাতেগোনা কিছু সংখ্যক ছাত্রছাত্রী তাদের ওপর ছুড়ে দেয়া ক্যারিয়ারের লক্ষ্যে অবিরাম পাঠ্যপুস্তকে নিমগ্ন থাকে। অধিকাংশই শ্রেণি-পাঠের পড়াশোনার বাইরে বেশিরভাগ সময়েই আড্ডা, এখানে ওখানে জোট বেঁধে হাসি তামাশা, বিদেশি চ্যানেলের অপসংস্কৃতি অনুসরণ ইত্যাদিতে সময় অপচয় করে। কিংবা পাঠ্যপুস্তকের বাইরে অন্য বই পড়া যে দু-চারজন আছে তাদেরও অধিকাংশই শুধু নিম্নশ্রেণির উপন্যাসের পাঠক। আমার দেখা অনেকের পাঠকক্ষের টেবিলে বিনোদনসর্বস্ব নোংরা পত্রপত্রিকার সমাবেশ তার উদাহারণ। আজকাল অশ্লীল ছবি সংবলিত পত্রিকা সংগ্রহ করাও খুব সহজসাধ্য ব্যাপার।

দেশের লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়েকে নৈতিক শিক্ষা সংবলিত, শিক্ষণীয় বই ধরাতে হবে। মূল্যবোধ প্রসঙ্গ থেকে যে বই প্রসঙ্গে চলে এসেছি; অবশ্যই তা অস্বাভাবিক মনে করছি না। সত্যি বলতে- সন্তানকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে পরিবার, সমাজ, বা রাষ্ট্রে উপস্থাপনের জন্য প্রয়োজন তার নৈতিক ও মানসিক সমৃদ্ধি। প্রয়োজন মূল্যবোধ ও সামাজিক সচেতনতা। আমি ভালোবাসি আমার দেশকে, আমি প্রত্যেকদিন দেখতে চাই সুন্দর বাংলাদেশকে, আর এ জন্য শিশু থেকেই তাকে স্থিরতা ও অধ্যাবসায় এর মধ্যে অভ্যস্ত করে তোলা জরুরি।

মূল্যবোধ ব্যক্তি জীবনের আচরণগত বৈপরীত্য দূর করতে সক্ষম। সমাজে যে সব সংঘাত ঘটছে একমাত্র মূল্যবোধ অবক্ষয়ের কারণে, নৈতিক শিক্ষায় সমৃদ্ধ করে এসব সংঘাত এড়ানো সম্ভব। তবে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ সহজ; সমাজ রাষ্ট্রের নিশ্চিত অধঃপতন ঠেকাতে তাই নৈতিক মূল্যবোধ এর অবক্ষয় রোধ করা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।

অন্যদিকে, মূল্যবোধকে আইনের ভিত্তি বলা হলেও দুঃখের বিষয় আজকাল আইন রক্ষাকারী বিভাগে কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষের অনৈতিকতার কালো ছায়া মূল্যবোধকে নিশ্চিহ্ন করে তুলেছে। এটা তারা ভুলতে বসেছে যে- মূল্যবোধ শিক্ষা সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই সুশাসন নিশ্চিত করে। অপরাধ করার পর বিচার না হলে অপরাধীর উৎসাহ বাড়ে, অপরাধও বাড়ে। তা থামাতে সুষ্ঠু বিচার ব্যবস্থা ও স্বচ্ছতা প্রয়োজন। অর্থাৎ- সমাজে বা ব্যক্তি জীবনে নৈতিক মূল্যবোধের সর্বগ্রাসী অবক্ষয় থামাতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার পাশাপাশি সরকারকে বিদ্যমান আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করে আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি।

image

শিল্পী : মনিরুল ইসলাম

আরও খবর
৬৯ বছরে সংবাদ
ভাষা থেকে ভূখন্ড
স্মৃতিময় সংবাদ-এর ৬৯ বছর
একটি রাজনৈতিক পাঠ
সংবাদ : কিছু কথা কিছু স্মৃতি
যুগে যুগে সংবাদপত্রের অগ্রযাত্রা
আলোর তৃষ্ণায় জাগো
ইতিহাস ঐতিহ্য ও আদর্শের স্মারক দৈনিক সংবাদ
কেন লিখি
সংবাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আত্মার
ঐতিহ্য আর মুক্তচিন্তার সংবাদ
আমার সংবাদ সংবাদের আমি
বিচিত্র জীবিকা বিচিত্র জীবন
ঋতুপর্ণ ঘোষের এলোমেলো দেশকাল
চীন ও বাংলাদেশ : প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সম্পর্ক
সংবাদের জলসাঘর
আমরা এখন শান্ত হয়ে আছি
মাটির মাধুর্য
কষ্টের ঢাকা স্বপ্নের বাংলাদেশ
তোমারে বধিবে যে...
বঙ্গবন্ধুর জনকল্যাণের অর্থনৈতিক নীতি কৌশল
শারহুল পটবসন্ত ও বজলুর রহমান
শিশুশিক্ষায় শিল্প-সাহিত্য-সংগীত
গণমাধ্যমের হাল-হকিকত
এবং বজলুর রহমান স্মৃতিপদক
দুর্নীতি, পেশাদারিত্ব ও উন্নয়ন
বাংলাদেশের থিয়েটার চর্চার ভবিষ্যৎ
সবার উপরে মানুষ সত্য
আহমদুল কবির শ্রদ্ধাঞ্জলি
কার্যকর সংসদ এবং সুশাসনের স্বপ্ন
‘সংবাদ’ আমারই ছিল আমারই আছে
আমাদের ‘সংবাদ’
নারীর অধিকার ও সচেতনতা
গণমাধ্যমে বিশ্বাস কমছে পাঠকের
নারী ও তার বিধাতা পুরুষ
বাংলাদেশের নারী
সংবাদের কাছে আমি ঋণী
বিস্মৃতিপ্রবণতা ও রাষ্ট্রের অক্ষমতা
যে দীপশিখা দিয়েছে আলো

বুধবার, ১০ জুলাই ২০১৯ , ২৬ আষাঢ় ১৪২৫, ৬ জ্বিলকদ ১৪৪০

চেতনায় নৈতিকতা মূল্যবোধ : বিরুদ্ধবাস্তবতা

এলিজা খাতুন

image

শিল্পী : মনিরুল ইসলাম

ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি, জ্ঞানের সুস্থ বিকাশ। এর মধ্যে দিয়েই জাতি হেঁটে চলেছে। বিজ্ঞান প্রযুক্তির বিকাশের ফলে মানুষের জীবনযাপনের পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু আত্মিক উন্নয়ন হচ্ছে কি! মানুষের বৈশিষ্ট্য তো এই যে, তারা সমাজ ও পরিবারে শান্তি বজায় রাখার জন্য সর্বদা সচেতন, এমনকি পরিচিত বা অপরিচিত যেই হোক একের দুঃখে অপরে দুঃখিত হবে, সহমর্মিতা প্রকাশ করবে। মানুষ ও পশুর মধ্যে পার্থক্য করে তো ঐতিহ্যবোধ! যা সভ্যতাকে প্রতিষ্ঠিত করে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, জোরালোভাবেই বলা যাবে- সভ্য দেশসমূহের মধ্যে শোষণ, নিপীড়ন, দুর্নীতি, অনাচার আমাদের দেশেই বেশি। আবার প্রতিবাদ করার নজির আমাদের দেশেই বেশি। হতাশাজনক হলেও সত্য যে- আজকাল বেশিরভাগ প্রতিবাদ রাজনৈতিক বা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য হাসিলেই নিবেদিত; যা ভালো ফলের বদলে কুফল বয়ে আনে। নীতি-নৈতিকতা মূল্যবোধের অবক্ষয় ধরেছে সমাজ-রাষ্ট্রের প্রত্যেক শ্রেণিপেশার মধ্যে, বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনা সমাজে হাজার প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে, প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে সুস্থ সমাজ প্রত্যাশী নাগরিক মনে।

মানুষের মনোজগতকে নিয়ন্ত্রণ করে নৈতিকতা, আর তার আচার আচরণকে পরিমাপ করে মূল্যবোধ। আমরা জানি বোধ শব্দটির প্রতিশব্দ- জ্ঞান, বুদ্ধি, প্রজ্ঞা, মেধাশক্তি, চেতনা, অনুভূতি, উপলব্ধি; আবার বিবেক, চিন্তা, বুদ্ধি ও ন্যায়পরায়ণতা হচ্ছে নৈতিকতার উৎস। এসবের মাধ্যমে ভালো মন্দের বিচার করার ক্ষমতা দ্বারা মানুষের সামাজিক আচার আচরণের সমষ্টিই মূল্যবোধ; যা সমাজের নানা ক্ষেত্র সুন্দর ও পরিপূর্ণ হতে সাহায্য করে। সহজভাবে বলা যায় মূল্যবোধ মানুষের কাজের ভালো মন্দ বিচারের ভিত্তি।

প্রায় দেড়-দুই দশক পূর্বে কিংবা তারও অতীতে ঘটে যাওয়া ঘটনা পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারা যেত। এবং সে সব ঘটনা তোলপাড় সৃষ্টি করলেও বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে গণ্য করা হতো। আর এখন সামাজিক ও পারিবারিক অপরাধমূলক ঘটনা জলের মতো সহজ প্রবাহমান, এগুলো আর বিচ্ছিন্ন বলে এড়িয়ে যাবার নয়।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অর্জন এ জাতির শ্রেষ্ঠতম অর্জন। কিছু সংখ্যক বিভ্রান্ত মানুষ ছাড়া সবাই এজন্য সংগ্রাম করেছেন, সহ্য করেছেন সীমাহীন যন্ত্রণা। এমন বৃহৎ অর্জনকে অক্ষুণ্ন রাখতে বা আরও সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে দেশের নাগরিক হিসাবে মূল্যবোধ জাগ্রত করার মাধ্যমে আমাদের দায়িত্ব অনেক। ব্যক্তিগত মূল্যবোধ বিশেষভাবে স্বাধীনতাকে লালন করে। একটা ইতিহাস, একটা আনন্দ, একটা চরম ত্যাগের স্মৃতিচারণ। সেই ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে হারিয়ে গেল স্বাধীনতা। দু’শো বছরের গোলামীর পর ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগ তারপর আরেক অধ্যায়। শুরু হয় বৈষম্যের কলঙ্কময় সেই ইতিহাস। ভাষার অধিকারে প্রাণ দিয়ে বাংলাকে আদায় করে নিল এ দেশেরই সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর আরও অনেকে। এরপর ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানীদের ঘৃণ্য, জঘন্য হত্যাযজ্ঞ ... দেশের জন্য প্রাণ দিতে ঝাঁপিয়ে পড়া মহান মানুষদের আত্মত্যাগে এবং লক্ষ্য শহীদের রক্তের বদলে আজ আমরা এত্ত স্বাধীন! আমরা পেয়েছি বিজয় শব্দটি, কিন্তু প্রকৃত বিজয়ী কারা? শত বছরের পুরোনো মুক্তি মিলেছে বৈকি, কিন্তু প্রাণের মুক্তি কি প্রতৃতই মিলেছে? আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কাক্সিক্ষতভাবে সফল হয়েছে কি? লক্ষ শহীদের রক্তস্নাত বাংলার মাটি আজও দেখেই চলেছে আরও রক্ত- দলাদলি, অন্যায়-অনাচার, খুনাখুনি, সাম্প্রদায়িক হানাহানি।

সময়ের আবর্তে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে জাতীয় ঐক্য খন্ড-বিখন্ড হয়েছে, বিভক্তি এসেছে চেতনায়। জাতীয় লক্ষ্যও অনেক সময় ম্রিয়মাণ হয়েছে। যুগ ও সভ্যতার পরিবর্তনে সমাজের মানুষের মূল্যবোধেরও পরিবর্তন হয়। সহনশীলতা, আইনের শাসন ও সুশৃঙ্খল পরিবেশের অভাবে মূল্যবোধের অবক্ষয় হচ্ছে। একটা সমাজের মানুষের শিক্ষা, সংস্কৃতি, চিন্তা, চেতনা, বিশ্বাস, আচরণ এর ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে সামাজিক মূল্যবোধ। অথচ আজকের দিনে বিষের মতো সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে- হিংসা, দলাদলি, অন্যায়-অনাচার, দুর্বলের ওপর অকথ্য নির্যাতন, খুন, ধর্ষণ ইত্যাদি জঘন্য কার্যকলাপ; যা বিশ্বের কাছে আমাদের জাতির জন্য লজ্জার।

রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, সরকারি চাকরিজীবীদের নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় দেখে আমরা প্রায় অভ্যস্ত, কিন্তু শিক্ষক সমাজে অবক্ষয়? শিক্ষকতা পেশায় থেকে অনেকেরই চারিত্রিক স্খলন নির্মমভাবে দুশ্চিন্তা এনে দিয়েছে অভিভাবক সমাজে। এমনকি ধর্মীয় উপাসনালয়েও যৌন হয়রানি, ধর্ষণ নামক অনৈতিক বীভৎস কার্যকলাপ বিষাতুরভাবে উঁকি দিচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে। এটা কি সময় না-কি দুঃসময় চলছে!

একসময় এদেশে শিক্ষার হার খুব কম ছিল। বলা হতো- অশিক্ষিত জাতি এবং বর্বর জাতির মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না। অথচ বর্তমানে শিক্ষার হার যথেষ্ট হলেও মানুষের আচার-আচরণের মধ্যে পাশবিকতা বিরাজ করছে। মানবিক গুণাবলি থেকে এবং পারিবারিক-সামাজিক মূল্যবোধ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে গোটা সমাজ। সাধারণ মানুষ অন্তর্গত ন্যায়বোধের দ্বারা নির্দেশিত পথে চলতে পারছে না। বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ও জীবনধারায় ঘুষ-সুদ দুর্নীতি যেন অনিবার্য হয়ে উঠেছে! সমাজে দুর্নীতিগ্রস্ত ও চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা নানা রকম ভীতি সৃষ্টি করে সাধারণের জীবনযাপনকে দুঃসহ ও অসুস্থ করে তুলেছে।

বিস্ময়ের ব্যাপার আমরাই ওদের অবস্থানকে শক্ত করার সুযোগ দিচ্ছি। ভীতি সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর হুমকি মেনে নিচ্ছি; অন্যের বাঁচা মরা নিয়ে টুঁ শব্দ করি না। কীভাবে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ করতে হবে তা জেনেও উদ্যোগী হই না। কত শিশু ও নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছে প্রতিদিন তার সঠিক কোন হিসাব নেই, সব ঘটনা সংবাদ মাধ্যমে আসে না। সবটার প্রতিবাদও হয় না, অনেকে লোকলজ্জার ভয়ে চুপ থাকে, যে দু’একটির প্রতিবাদ হয় তার বিচার কার্য চলতে থাকে বছরের পর বছর। আমাদের সমাজে নারী ও শিশুর প্রতি যে আক্রমণাত্মক পরিস্থিতি তা বেড়েই চলছে দিনের পর দিন, তা মূল্যবোধের অভাবে। এসব অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি মোকাবিলায় কেবল সরকারের ওপর দায়ভার চাপিয়ে বসে থাকলে সমস্যা নিরসনের নিশ্চয়তা মিলবে না। উচিতও নয়। সমস্যার মূল জায়গাটিতে পৌঁছাতে হবে।

ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ অপরিহার্য। সমাজে অন্যায়-অনাচারের প্রতিবাদ-আন্দোলন করতে গিয়ে বিভ্রান্তিময় পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে আজকাল। গভীরভাবে লক্ষ্য করলে পাওয়া যায়- একসময়ের “নারীমুক্তি আন্দোলন” আজ “নারীবাদী আন্দোলন”-এ ঠেকেছে; যা সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রের। জাতীয় নানা সমস্যার প্রেক্ষিতে জাতীয় মুক্তির থেকে নারীমুক্তির বিষয়কে সম্পূর্ণ আলাদা করে নেয়া যুক্তিযুক্ত নয়।

নারী প্রসঙ্গে আসা এ জন্য যে, নৈতিক মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রে বা সমাজে বিরাজমান পরিস্থিতি অনুকূলে আসা বাঞ্ছনীয়। চেতনাগত দিক থেকে নারী পুরুষের মধ্যকার বৈষম্য, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, অস্পষ্টতা, কুসংষ্কারাচ্ছন্ন প্রচলিত ধারা- এসবকে সমাজ থেকে বিতাড়িত করার মনমানসিকতা গঠন হওয়া জরুরি। এ ব্যাপারে সক্রিয় হওয়া দরকার সমাজের প্রত্যেককেই। অন্যের গোঁড়ামি, মূর্খতা, ধুর্ততা, কুসংস্কার, অন্ধত্ব, এসবের বিরুদ্ধেও সোচ্চার ও সচেতন হওয়া বা মুখ খোলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এসবই অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় মানুষের সুস্থ সুন্দর মননের বিকাশ পথে। নেতিবাচক বিষয়গুলো মুখ বুজে দেখার এবং ভোগ করার মধ্যে মহত্ত্ব আছে কিছু!

অপরাধ সংঘটিত হয়ে গেলে তার শাস্তির বিধানস্বরূপ পরবর্তী পদক্ষেপ প্রশাসনের উপরে একশত ভাগ বর্তায়, কিন্তু অপরাধ প্রবণতা রোধ করার প্রধান উপায় শৈশবকে সুষ্ঠু-সুন্দর ও সঠিক পথে চালিত করা। এ শিক্ষা প্রদানের ভার পরিবারের। প্রত্যেক শিশুর পারিবারিক নৈতিক শিক্ষা পরিবারের অভিভাবকের উপরেই ন্যস্ত। সমাজের পথশিশু বা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন শিশুদের সঠিক পথ দেখানো, তাদের নষ্ট হওয়া থেকে টেনে ধরা দেশের নাগরিক তথা আমাদেরই কাজ। অথচ কতিপয় বিত্তশালী, রাজনৈতিক ব্যাক্তিবর্গ নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে ওদেরকে।

নৈতিক মূল্যবোধের এই ধ্বংসাত্মক চিত্র রোধে কর্মসূচি গ্রহণ করা এখন অতীব প্রয়োজন। আলো ও অন্ধকারের বিপরীতমুখী অবস্থানে ব্যক্তির মধ্যে চিন্তা বা বোধের জন্ম হয়। মানুষের জন্যই মানসিকতা শব্দটি নির্ধারিত; এই মানসিক পরিভ্রমণ দ্বারাই সঠিক বা ভুল নির্ণয় করা যায়। আর এই শিক্ষা ও মূল্যবোধ এর ভিত্তি প্রথমত তৈরি হয় শৈশবে পরিবার থেকে ভদ্রতা, শিষ্টাচার, সততা, নিয়ম-নিষ্ঠা, সহনশীলতা, ন্যায়-পরায়ণতা ইত্যাদি দ্বারা। দ্বিতীয়ত সূচনা হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। আমাদের প্রয়োজন নতুন প্রজন্মের কাছে সুন্দর ও সঠিক ভাবনা তুলে ধরা। অথচ আমরা খোঁজ রাখছি না আমাদের চারপাশেই উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা কীভাবে ভুল পথে নীরবে হাঁটছে। তাদের হাতের নাগালে পর্ণ ছবি, অশ্লীল ভিডিও, নেশাজাত দ্রব্যের সহজলভ্যতা; রাতে দেরি করে বাড়ি ফেরা। ওদের অনেকেরই অভিভাবকেরা দেখেও বিষয়টা তেমন আমলে নেন না। কোথায় ছিল? কেন ছিল? এসব প্রশ্ন তাৎক্ষণিক, এটুকু খোঁজ নিলেই বিপথে পা বাড়ানো সন্তান সুপথে ফেরে কি?

অনেক বাবা মা বলে থাকেন- বিয়ে দিলে সংসার হলে ঠিক হয়ে যাবে। অথচ আয়ত্তের বাইরে চলে যাওয়া নেশাজাতীয় দ্রব্যের প্রতি আকৃষ্ট ছেলেটি পরবর্তী সাংসারিক জীবনে অর্থের জন্য স্ত্রীকে নির্যাতন করে। আমাদের সমাজে অহরহ ঘটছে এমন ঘটনা। যা সমাজকে কলুষিত করছে স্লো পয়জনের মতো। এই নিশ্চিত অধঃপতন ঠেকাতে শিক্ষা জীবনেই শিক্ষার্থীদের মাঝে পুঁথিগত শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষার গুরুত্ব সমানভাবে দেয়া প্রয়োজন। তা হতে হবে ব্যবহারিক কাজের মধ্যে, তাদের বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজে অন্তর্ভুক্ত করে নষ্ট চিন্তা থেকে দূরে রাখতে হবে। তাছাড়া পাঠ্য বইয়ের বাইরেও শিক্ষামূলক গল্প কাহিনী পড়ায় আগ্রহী করে তোলা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মূল্যবোধ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে।

হাতেগোনা কিছু সংখ্যক ছাত্রছাত্রী তাদের ওপর ছুড়ে দেয়া ক্যারিয়ারের লক্ষ্যে অবিরাম পাঠ্যপুস্তকে নিমগ্ন থাকে। অধিকাংশই শ্রেণি-পাঠের পড়াশোনার বাইরে বেশিরভাগ সময়েই আড্ডা, এখানে ওখানে জোট বেঁধে হাসি তামাশা, বিদেশি চ্যানেলের অপসংস্কৃতি অনুসরণ ইত্যাদিতে সময় অপচয় করে। কিংবা পাঠ্যপুস্তকের বাইরে অন্য বই পড়া যে দু-চারজন আছে তাদেরও অধিকাংশই শুধু নিম্নশ্রেণির উপন্যাসের পাঠক। আমার দেখা অনেকের পাঠকক্ষের টেবিলে বিনোদনসর্বস্ব নোংরা পত্রপত্রিকার সমাবেশ তার উদাহারণ। আজকাল অশ্লীল ছবি সংবলিত পত্রিকা সংগ্রহ করাও খুব সহজসাধ্য ব্যাপার।

দেশের লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়েকে নৈতিক শিক্ষা সংবলিত, শিক্ষণীয় বই ধরাতে হবে। মূল্যবোধ প্রসঙ্গ থেকে যে বই প্রসঙ্গে চলে এসেছি; অবশ্যই তা অস্বাভাবিক মনে করছি না। সত্যি বলতে- সন্তানকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে পরিবার, সমাজ, বা রাষ্ট্রে উপস্থাপনের জন্য প্রয়োজন তার নৈতিক ও মানসিক সমৃদ্ধি। প্রয়োজন মূল্যবোধ ও সামাজিক সচেতনতা। আমি ভালোবাসি আমার দেশকে, আমি প্রত্যেকদিন দেখতে চাই সুন্দর বাংলাদেশকে, আর এ জন্য শিশু থেকেই তাকে স্থিরতা ও অধ্যাবসায় এর মধ্যে অভ্যস্ত করে তোলা জরুরি।

মূল্যবোধ ব্যক্তি জীবনের আচরণগত বৈপরীত্য দূর করতে সক্ষম। সমাজে যে সব সংঘাত ঘটছে একমাত্র মূল্যবোধ অবক্ষয়ের কারণে, নৈতিক শিক্ষায় সমৃদ্ধ করে এসব সংঘাত এড়ানো সম্ভব। তবে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ সহজ; সমাজ রাষ্ট্রের নিশ্চিত অধঃপতন ঠেকাতে তাই নৈতিক মূল্যবোধ এর অবক্ষয় রোধ করা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।

অন্যদিকে, মূল্যবোধকে আইনের ভিত্তি বলা হলেও দুঃখের বিষয় আজকাল আইন রক্ষাকারী বিভাগে কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষের অনৈতিকতার কালো ছায়া মূল্যবোধকে নিশ্চিহ্ন করে তুলেছে। এটা তারা ভুলতে বসেছে যে- মূল্যবোধ শিক্ষা সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই সুশাসন নিশ্চিত করে। অপরাধ করার পর বিচার না হলে অপরাধীর উৎসাহ বাড়ে, অপরাধও বাড়ে। তা থামাতে সুষ্ঠু বিচার ব্যবস্থা ও স্বচ্ছতা প্রয়োজন। অর্থাৎ- সমাজে বা ব্যক্তি জীবনে নৈতিক মূল্যবোধের সর্বগ্রাসী অবক্ষয় থামাতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার পাশাপাশি সরকারকে বিদ্যমান আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করে আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি।