আমাদের ‘সংবাদ’

ফারুক মাহমুদ

পরিচয় হওয়ার আগেই ‘সংবাদ-এর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। বিদ্যালয়ে, শ্রেণিসিঁড়ির শেষ ধাপে আছি। নানা বিষয়ে মনে আগ্রহ জন্মাচ্ছে। সব সময় সুযোগ না-মিললেও দৈনিক পত্রিকা পড়ার তৃষ্ণা মনে বুদবুদ ছড়াচ্ছে। আমাদের বিদ্যালয়ের কাছেই ছিল সবুজ ট্রেয়ের মতো মাঠ। এখন আর নেই। ভাঙনে মেঘনায় মিলিয়ে গেছে। তাই মাঠের দক্ষিণ কোনার কাছে ছিল ‘হাকিম শাহ ইনস্টিটিউট’। আসলে ওটা একটা ক্লাবঘর। এর একটা ছোট কক্ষে খোলা কাচের আলমারিতে কিছু বইপত্র আর নড়বড়ে টেবিলে থাকত কয়েকটি দৈনিক পত্রিকা। ওখানেই দেখা হয়েছে ‘সংবাদ’ পত্রিকার সঙ্গে। সন্ধ্যায় ওই পত্রিকার কক্ষে যখন পৌঁছেছি, গম্ভীর পাঠকের দখলে চলে গেছে সবক’টি পত্রিকা। শুরু হতো অপেক্ষার পালা। একজন ছিলেন, বয়স্ক মতো, অনেক আগইে তার দখলে চলে যেত ‘সংবাদ’ পত্রিকাটি। আমারও সংবাদ পত্রিকাই চাই। কেন চাই। এ প্রসঙ্গে পরে বলছি। তো, ওই বয়স্কমতো ভদ্রলোক, ‘সংবাদ’ পড়ছেন। তিনি গভীর মনোসংযোগে পত্রিকার নাম থেকে শুরু করে, শেষ পৃষ্ঠার শেষ বাক্যটি পড়ছেন। আমি তার পেছনে বসে, ঘাড়ের উপর দিয়ে চোখ রেখে সংবাদ পড়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি। একদিন, সুযোগ মিলল, ভদ্রলোককে বললাম, ‘আচ্ছা, বেছে-বেছে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদগুলো আগে পড়লে হয় না?’ তিনি অতিশয় গম্ভীর কণ্ঠে যা বললেন, এর অর্থ দাঁড়ায়- পত্রিকার সম্পাদক গুরুত্ব বিবেচনা করেই পত্রিকার পৃষ্ঠা সাজিয়েছেন। শুরু থেকে শেষ পর্যন্তই পড়তে হবে। অকাট্য যুক্তি। কোনো কোনো দিন, সন্ধ্যার আগে গিয়েও দেখেছি, তখনো ‘সংবাদ’ ওই ভদ্রলোকের দখলেই চলে গেছে। ‘সংবাদ’ পড়ব, এই বাসনায় সংবাদের নিবিষ্ট পাঠক, বয়স্কমতো ভদ্রলোকের ঘাড় উজিয়ে, পেছনে বসে ‘সংবাদ’ পড়তে, এক সময়, আমার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল।

অন্যান্য পত্রিকা রেখে ‘সংবাদ’ পাঠের দুর্বলতার কারণটি বলছি, আমার এক বন্ধু, জালাল, ও ছিল আমাদের থেকে এক ধাপ এগিয়ে। ও-ই জানাল, ‘সংবাদ’-এ ‘খেলাঘর’ বলে একটা বিভাগ আছে, ওখানে ছোটদের ছড়া ছাপানো হয়। ইতোমধ্যেই আমার মাথায় দিনের প্রজাপতি আর রাতের জোনাকির ওড়াউড়ি শুরু হয়ে গেছে। জালালই ‘খেলাঘর’-এ লেখা পাঠানোর উৎসাহ এবং আয়োজন করে দিল। প্রতি সপ্তাহে ‘ছড়া’ পাঠাই। কত যে ছড়া পাঠিয়েছি, একটাও ছাপা হয়নি।

যখন কলেজে ভর্তি হলাম, জড়িয়ে পড়লাম ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে। ছোট্ট, মফস্বল শহরে, ওই সময় যারা ‘বাম রাজনীতি’র প্রকাশ্য এবং গোপন নেতা ছিলেন, তাদের একটা ডেরা ছিল। সামনের দিকটায় অষুধের দোকান, পেছটায় আড্ডা-স্থান। ওখানে ‘সংবাদ’ থাকত। তখন আর ‘সংবাদ’ পাঠে কোনো পাঠক-দেওয়াল ছিল না। বরং নিজেই দখল করে মন ডুবিয়ে পত্রিকাটি পাঠ করতাম। আরও পরে আমাদের বাড়ির ‘পুবের ঘর’-এ, অর্থাৎ যাকে বনেদি ভাষায় ‘বৈঠকখানা’ বলে- নিয়মিত ‘সংবাদ’ রাখার ব্যবস্থা হয়েছিল। আমার এক জেঠাতুতো ভাই, এক চাচাতুতো ভাই আর আমি- তিনজন মিলে ‘সংবাদ’-এর মাসিক বিল পরিশোধ করতাম। খেলাঘর-এর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে এর মূল আধার ‘সংবাদ’-এর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। তখন ‘খেলাঘর’-এ আমার একটা-দুটো ছড়া ছাপছে।

একটা সময় ঢাকায় চলে এলাম। অপরিচিত, এত বড় শহর। ঢাকা-জীবনের শুরুর দিকে, একটা কাজ ছিল, খুঁজে-খুঁজে পত্রিকা অফিস বের করা। বংশালের ‘সংবাদ’ অফিস বের করতে বেশি সময় লাগেনি। একাত্তরে পাকিস্তানি বর্বর সৈন্যরা, তখনকার অন্যতম জনপ্রিয় ‘সংবাদ’ অফিস জ্বালিয়ে দিয়েছিল। ওই অফিসে কবি ও সাংবাদিক শহীদ সাবের দগ্ধ হয়ে মারা গিয়েছিলেন। আমরা যখন সংবাদ অফিস চিনেছি, তখনও ওর ভস্মদশা কাটেনি। টিনের দুতলা অংশে, খেলাঘর পাতার কর্মী-লেখকরা মিলিত হতেন। জিয়া উদ্দিন, সবার প্রিয় জিয়া ভাই, ঝরা ভাই- এঁদের কথা মনে পড়ে। ওখানেই পরিচয় হয়েছিল ছড়াকার (প্রয়াত) আলতাফ আলী হাসু, আখতার হুসেন, খালেক বিন জয়েনউদ্দিন, শাহাদাত বুলবুল (প্রয়াত), আরও অনেকের সঙ্গে। এঁদের অনেকেই পরবর্তীতে বিশ্বসাহিত্যর গুরুত্বপূর্ণ লেখক হয়ে উঠেছেন। সংবাদের ‘খেলাঘর’ আমার লেখালেখির জীবনে গুরুত্বপূর্ণ স্থান হয়ে রয়েছে। সংবাদের খেলাঘরের সক্রিয় কর্মী ছিলাম না। তবে আমার বন্ধুদের অনেকেই এ ঐতিহ্যবাহী সংগঠনের নেতাকর্মী ছিলেন। সেই সুবাদে খেলাঘরের হুসনি দালান রোডের এবং পুরানা পল্টন অফিসে আমার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। একসময় লেখা ছাপা না হলেও পরবর্তীতে খেলাঘরে গদ্য-পদ্য কত লেখা যে লিখেছি। দেশের গুরুত্বপূর্ণ লেখকের ‘শিশুসাহিত্য’ নিয়ে একটি ধারাবাহিক লেখা লিখেছিলাম খেলাঘর-এ। ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না’ এই শিরোনামে। আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান, হাবীবুর রহমান, রোকনুজ্জামান খান আরও অনেকের শিশুসাহিত্য গভীর আগ্রহে পাঠের যে সুযোগ হয়েছিল, তা অমূল্য। এখনও চোখে ভাসে মাসুক হেলালের আঁকা সে লোগোটি।

একসময় বাশিরা ইসলাম শান্তি ছিলেন ‘সংবাদ’-এর খেলাঘর পাতার সম্পাদক। তখনও লিখেছি। এখন আর ছড়া লেখা হয় না, পেরে উঠি না। এ বয়সে এসে বুঝেছি, ছড়া লেখা একটি কঠিন কাজ। খেলাঘর-এর সঙ্গে সংযোগ শিথিল হলেও ‘সংবাদ’-এর সঙ্গে সম্পর্ক আগের মতোই গভীর রয়েছে। বাঘা বাঘা লেখকরা সংবাদের সাহিত্য পাতা সম্পাদনা করেছেন। সাংবাদ অফিসে সন্তোষ গুপ্তের সঙ্গে দেখা হলেও তাঁর হাতে লেখা দেয়ার সাহস হয়নি। আবুল হাসনাত যখন থেকে এই পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক হয়েছেন, বহুবার গেছি। তিনি অনেক লেখা ছেপেছেনও। পরবর্তীতে আমাদের প্রিয়জনদের অনেকে ‘সংবাদ’-এ যুক্ত হয়েছেন; তাদের সঙ্গে দেখা করার অছিলায় অসংখ্যবার গিয়েছি সংবাদ কার্যালয়ে। সন্তোষ গুপ্ত, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, বজলুর রহমান, আবু কায়সার এরা এখন প্রয়াণ পথের যাত্রী। সোহরাব হাসান, মিনার মনসুর, মনজুরুল আহসান বুলবুল, আদিলা বকুল, আহসান হামিদ, শওকত মাহমুদ- কত প্রিয় নাম। সন্তোষদা হাতে সিগারেট- সারাক্ষণ কী যে ভাবতেন! সাইয়িদ ভাই সর্বদাহ গম্ভীর মুখ। প্রচলনের বাইরে গিয়ে অসাধারণ সব প্রতিবেদন লিখতেন। জাতীয় কবিতা পরিষদ মঞ্চে একটা ছবি আঁকলেন পটুয়া কামরুল হাসান। এর কয়েক মুহূর্ত পরেই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। জননেত্রী শেখ হাসিনা তখন শ্রোতার সারিতে বসে কবিতা পাঠ শুনছিলেন। তাঁর গাড়িতে করেই মুমূর্ষু কামরুল হাসানকে হাসপাতালে নেয়া হলো। এ মহান শিল্পীর শেষ আঁকা ছবিটি পরদিন প্রকাশিত হলো সংবাদের প্রথম পৃষ্ঠায়। এর প্রতিটি রেখা ধরে ধরে বিশ্লেষণ করে লিখলেন সাইয়িদ আতীকুল্লাহ। সে এক অসাধারণ রচনা। ‘দেশ আজ বিশ্ব বেহায়ার খপ্পড়ে’ কামরুল হাসানেরই দেয়া শিরোনাম নতুন মাত্রা পেল সাইয়িদ আতীকুল্লাহর কলমে। এর জন্যে ‘সংবাদ’ এবং সাইয়িদ আতীকুল্লাহকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের ইতিহাসে এগুলো গুরুত্বের সঙ্গে লেখা আছে। মৌলবাদীরা একবার ‘সংবাদ’ কার্যালয় আক্রমণ করেছিল। আবু কায়সার তো দু’তলা থেকে লাফিয়ে পড়ে প্রাণে বেঁচে ছিলেন। অবশ্য সংবাদের সাহসী কর্মীদের প্রতিরোধের মুখে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে গিয়েছিল।

একসময় দৈনিক পত্রিকার সংবাদের পাশাপাশি কলামগুলোও ছিল বিশেষ আকর্ষণীয়। এখনও সংবাদপত্রে উপসম্পাদকীয় ছাপা হয়। কিন্তু অদূর অতীতে কোনো কোনো দৈনিক পত্রিকা ছদ্মনামে লেখা বিশেষ বিশেষ কলামের জন্য পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। দৈনিক সংবাদের বেলায় অন্তত দুটি কলামের কথা উল্লেখ করা যায়। একটি ‘দরবার-ই-জহুর’, অন্যটি ‘সময় বহিয়া যায়’। প্রথমটি লিখতেন জহুর হোসেন চৌধুরী, অন্যটি ‘গাছপাথর’ ছদ্মনামে লিখতেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। কী যে জনপ্রিয় দুটি কলাম, আমরা গভীর অপেক্ষায় থাকতাম কলাম দুটি পাঠের জন্য।

জহুর হোসেন চৌধুরী ‘দরবার-ই-জহুর’ ছিল রসাত্মক এবং ব্যঙ্গাত্মক ভাষায় লেখা। গভীর কথা বলা হতো রসিয়ে রসিয়ে। আর ‘সময় বহিয়া যায়’ ছিল সমাজ দর্শনের গদ্যভাষ্য। শব্দ যে কত শাণিত হতে পারে, দুটি কলাম পাঠে পাঠক তা অনুভব করতে পারতেন।

সংবাদ-এর সাহিত্য পাতার খ্যাতি চিরকালের। নবীন-প্রবীণ লেখকের সমন্বয় ঘটে এ পাতায়। সংবাদের সাহিত্য পাতায় জীবনের প্রথম লেখা ছাপা হওয়ার অনন্য স্মৃতি রয়েছে অনেকের। সংবাদে লেখেননি এমন লেখক একজনও নেই- এমন কথা অনেকটা নিশ্চিত হয়েই বলা যায়। ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চার পৃষ্ঠার সাহিত্যপাতা এখনো বেরোচ্ছে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অন্যান্য ফিচার পাতাও যথেষ্ট সমৃদ্ধ। দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার উজ্জ্বল উদাহরণ দৈনিক সংবাদ।

সংবাদ হচ্ছে সাংবাদিক তৈরির প্রতিষ্ঠান। বলা হয়ে থাকে, অতীতে এবং বর্তমানেও দেশের খ্যাতিমান অনেক সাংবাদিকের কর্মজীবন শুরু হয়েছে ‘সংবাদ’-এ। কথাটি বহুলাংশে সত্য। সংবাদের একটি আদর্শিক অবস্থান আছে। যারা এ কাগজের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন, আছেন, তাদের পেশাদরিত্বের সমান্তরালে রয়েছে ‘প্রতিশ্রুতি’র স্বচ্ছ অবস্থান। শুধু কর্মস্থল নয়, এ কাগজের সঙ্গে জড়িত থেকে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে নিজেদের দায়বদ্ধতাও পালন করে থাকেন। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে সংবাদের কর্মীরা প্রতিষ্ঠানের সুনাম-ঐতিহ্য বজায় রাখতে সচেষ্ট থেকেছেন। সাংবাদিকতার হাতেখড়ি রয়েছে ‘সংবাদ’-এ, কর্মজীবন শেষ করেছেন এ প্রতিষ্ঠানে, এমন উদাহরণও বিরল নয়।

‘সংবাদ’ আগামী দিনগুলোতে ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারবে, এ প্রত্যাশা আমরা করতে পারি।

image

শিল্পী : সমর মজুমদার

আরও খবর
৬৯ বছরে সংবাদ
ভাষা থেকে ভূখন্ড
স্মৃতিময় সংবাদ-এর ৬৯ বছর
একটি রাজনৈতিক পাঠ
সংবাদ : কিছু কথা কিছু স্মৃতি
যুগে যুগে সংবাদপত্রের অগ্রযাত্রা
আলোর তৃষ্ণায় জাগো
ইতিহাস ঐতিহ্য ও আদর্শের স্মারক দৈনিক সংবাদ
কেন লিখি
সংবাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আত্মার
ঐতিহ্য আর মুক্তচিন্তার সংবাদ
আমার সংবাদ সংবাদের আমি
বিচিত্র জীবিকা বিচিত্র জীবন
ঋতুপর্ণ ঘোষের এলোমেলো দেশকাল
চীন ও বাংলাদেশ : প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সম্পর্ক
সংবাদের জলসাঘর
আমরা এখন শান্ত হয়ে আছি
মাটির মাধুর্য
কষ্টের ঢাকা স্বপ্নের বাংলাদেশ
তোমারে বধিবে যে...
বঙ্গবন্ধুর জনকল্যাণের অর্থনৈতিক নীতি কৌশল
শারহুল পটবসন্ত ও বজলুর রহমান
শিশুশিক্ষায় শিল্প-সাহিত্য-সংগীত
গণমাধ্যমের হাল-হকিকত
এবং বজলুর রহমান স্মৃতিপদক
দুর্নীতি, পেশাদারিত্ব ও উন্নয়ন
বাংলাদেশের থিয়েটার চর্চার ভবিষ্যৎ
চেতনায় নৈতিকতা মূল্যবোধ : বিরুদ্ধবাস্তবতা
সবার উপরে মানুষ সত্য
আহমদুল কবির শ্রদ্ধাঞ্জলি
কার্যকর সংসদ এবং সুশাসনের স্বপ্ন
‘সংবাদ’ আমারই ছিল আমারই আছে
নারীর অধিকার ও সচেতনতা
গণমাধ্যমে বিশ্বাস কমছে পাঠকের
নারী ও তার বিধাতা পুরুষ
বাংলাদেশের নারী
সংবাদের কাছে আমি ঋণী
বিস্মৃতিপ্রবণতা ও রাষ্ট্রের অক্ষমতা
যে দীপশিখা দিয়েছে আলো

বুধবার, ১০ জুলাই ২০১৯ , ২৬ আষাঢ় ১৪২৫, ৬ জ্বিলকদ ১৪৪০

আমাদের ‘সংবাদ’

ফারুক মাহমুদ

image

শিল্পী : সমর মজুমদার

পরিচয় হওয়ার আগেই ‘সংবাদ-এর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। বিদ্যালয়ে, শ্রেণিসিঁড়ির শেষ ধাপে আছি। নানা বিষয়ে মনে আগ্রহ জন্মাচ্ছে। সব সময় সুযোগ না-মিললেও দৈনিক পত্রিকা পড়ার তৃষ্ণা মনে বুদবুদ ছড়াচ্ছে। আমাদের বিদ্যালয়ের কাছেই ছিল সবুজ ট্রেয়ের মতো মাঠ। এখন আর নেই। ভাঙনে মেঘনায় মিলিয়ে গেছে। তাই মাঠের দক্ষিণ কোনার কাছে ছিল ‘হাকিম শাহ ইনস্টিটিউট’। আসলে ওটা একটা ক্লাবঘর। এর একটা ছোট কক্ষে খোলা কাচের আলমারিতে কিছু বইপত্র আর নড়বড়ে টেবিলে থাকত কয়েকটি দৈনিক পত্রিকা। ওখানেই দেখা হয়েছে ‘সংবাদ’ পত্রিকার সঙ্গে। সন্ধ্যায় ওই পত্রিকার কক্ষে যখন পৌঁছেছি, গম্ভীর পাঠকের দখলে চলে গেছে সবক’টি পত্রিকা। শুরু হতো অপেক্ষার পালা। একজন ছিলেন, বয়স্ক মতো, অনেক আগইে তার দখলে চলে যেত ‘সংবাদ’ পত্রিকাটি। আমারও সংবাদ পত্রিকাই চাই। কেন চাই। এ প্রসঙ্গে পরে বলছি। তো, ওই বয়স্কমতো ভদ্রলোক, ‘সংবাদ’ পড়ছেন। তিনি গভীর মনোসংযোগে পত্রিকার নাম থেকে শুরু করে, শেষ পৃষ্ঠার শেষ বাক্যটি পড়ছেন। আমি তার পেছনে বসে, ঘাড়ের উপর দিয়ে চোখ রেখে সংবাদ পড়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি। একদিন, সুযোগ মিলল, ভদ্রলোককে বললাম, ‘আচ্ছা, বেছে-বেছে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদগুলো আগে পড়লে হয় না?’ তিনি অতিশয় গম্ভীর কণ্ঠে যা বললেন, এর অর্থ দাঁড়ায়- পত্রিকার সম্পাদক গুরুত্ব বিবেচনা করেই পত্রিকার পৃষ্ঠা সাজিয়েছেন। শুরু থেকে শেষ পর্যন্তই পড়তে হবে। অকাট্য যুক্তি। কোনো কোনো দিন, সন্ধ্যার আগে গিয়েও দেখেছি, তখনো ‘সংবাদ’ ওই ভদ্রলোকের দখলেই চলে গেছে। ‘সংবাদ’ পড়ব, এই বাসনায় সংবাদের নিবিষ্ট পাঠক, বয়স্কমতো ভদ্রলোকের ঘাড় উজিয়ে, পেছনে বসে ‘সংবাদ’ পড়তে, এক সময়, আমার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল।

অন্যান্য পত্রিকা রেখে ‘সংবাদ’ পাঠের দুর্বলতার কারণটি বলছি, আমার এক বন্ধু, জালাল, ও ছিল আমাদের থেকে এক ধাপ এগিয়ে। ও-ই জানাল, ‘সংবাদ’-এ ‘খেলাঘর’ বলে একটা বিভাগ আছে, ওখানে ছোটদের ছড়া ছাপানো হয়। ইতোমধ্যেই আমার মাথায় দিনের প্রজাপতি আর রাতের জোনাকির ওড়াউড়ি শুরু হয়ে গেছে। জালালই ‘খেলাঘর’-এ লেখা পাঠানোর উৎসাহ এবং আয়োজন করে দিল। প্রতি সপ্তাহে ‘ছড়া’ পাঠাই। কত যে ছড়া পাঠিয়েছি, একটাও ছাপা হয়নি।

যখন কলেজে ভর্তি হলাম, জড়িয়ে পড়লাম ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে। ছোট্ট, মফস্বল শহরে, ওই সময় যারা ‘বাম রাজনীতি’র প্রকাশ্য এবং গোপন নেতা ছিলেন, তাদের একটা ডেরা ছিল। সামনের দিকটায় অষুধের দোকান, পেছটায় আড্ডা-স্থান। ওখানে ‘সংবাদ’ থাকত। তখন আর ‘সংবাদ’ পাঠে কোনো পাঠক-দেওয়াল ছিল না। বরং নিজেই দখল করে মন ডুবিয়ে পত্রিকাটি পাঠ করতাম। আরও পরে আমাদের বাড়ির ‘পুবের ঘর’-এ, অর্থাৎ যাকে বনেদি ভাষায় ‘বৈঠকখানা’ বলে- নিয়মিত ‘সংবাদ’ রাখার ব্যবস্থা হয়েছিল। আমার এক জেঠাতুতো ভাই, এক চাচাতুতো ভাই আর আমি- তিনজন মিলে ‘সংবাদ’-এর মাসিক বিল পরিশোধ করতাম। খেলাঘর-এর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে এর মূল আধার ‘সংবাদ’-এর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। তখন ‘খেলাঘর’-এ আমার একটা-দুটো ছড়া ছাপছে।

একটা সময় ঢাকায় চলে এলাম। অপরিচিত, এত বড় শহর। ঢাকা-জীবনের শুরুর দিকে, একটা কাজ ছিল, খুঁজে-খুঁজে পত্রিকা অফিস বের করা। বংশালের ‘সংবাদ’ অফিস বের করতে বেশি সময় লাগেনি। একাত্তরে পাকিস্তানি বর্বর সৈন্যরা, তখনকার অন্যতম জনপ্রিয় ‘সংবাদ’ অফিস জ্বালিয়ে দিয়েছিল। ওই অফিসে কবি ও সাংবাদিক শহীদ সাবের দগ্ধ হয়ে মারা গিয়েছিলেন। আমরা যখন সংবাদ অফিস চিনেছি, তখনও ওর ভস্মদশা কাটেনি। টিনের দুতলা অংশে, খেলাঘর পাতার কর্মী-লেখকরা মিলিত হতেন। জিয়া উদ্দিন, সবার প্রিয় জিয়া ভাই, ঝরা ভাই- এঁদের কথা মনে পড়ে। ওখানেই পরিচয় হয়েছিল ছড়াকার (প্রয়াত) আলতাফ আলী হাসু, আখতার হুসেন, খালেক বিন জয়েনউদ্দিন, শাহাদাত বুলবুল (প্রয়াত), আরও অনেকের সঙ্গে। এঁদের অনেকেই পরবর্তীতে বিশ্বসাহিত্যর গুরুত্বপূর্ণ লেখক হয়ে উঠেছেন। সংবাদের ‘খেলাঘর’ আমার লেখালেখির জীবনে গুরুত্বপূর্ণ স্থান হয়ে রয়েছে। সংবাদের খেলাঘরের সক্রিয় কর্মী ছিলাম না। তবে আমার বন্ধুদের অনেকেই এ ঐতিহ্যবাহী সংগঠনের নেতাকর্মী ছিলেন। সেই সুবাদে খেলাঘরের হুসনি দালান রোডের এবং পুরানা পল্টন অফিসে আমার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। একসময় লেখা ছাপা না হলেও পরবর্তীতে খেলাঘরে গদ্য-পদ্য কত লেখা যে লিখেছি। দেশের গুরুত্বপূর্ণ লেখকের ‘শিশুসাহিত্য’ নিয়ে একটি ধারাবাহিক লেখা লিখেছিলাম খেলাঘর-এ। ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না’ এই শিরোনামে। আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান, হাবীবুর রহমান, রোকনুজ্জামান খান আরও অনেকের শিশুসাহিত্য গভীর আগ্রহে পাঠের যে সুযোগ হয়েছিল, তা অমূল্য। এখনও চোখে ভাসে মাসুক হেলালের আঁকা সে লোগোটি।

একসময় বাশিরা ইসলাম শান্তি ছিলেন ‘সংবাদ’-এর খেলাঘর পাতার সম্পাদক। তখনও লিখেছি। এখন আর ছড়া লেখা হয় না, পেরে উঠি না। এ বয়সে এসে বুঝেছি, ছড়া লেখা একটি কঠিন কাজ। খেলাঘর-এর সঙ্গে সংযোগ শিথিল হলেও ‘সংবাদ’-এর সঙ্গে সম্পর্ক আগের মতোই গভীর রয়েছে। বাঘা বাঘা লেখকরা সংবাদের সাহিত্য পাতা সম্পাদনা করেছেন। সাংবাদ অফিসে সন্তোষ গুপ্তের সঙ্গে দেখা হলেও তাঁর হাতে লেখা দেয়ার সাহস হয়নি। আবুল হাসনাত যখন থেকে এই পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক হয়েছেন, বহুবার গেছি। তিনি অনেক লেখা ছেপেছেনও। পরবর্তীতে আমাদের প্রিয়জনদের অনেকে ‘সংবাদ’-এ যুক্ত হয়েছেন; তাদের সঙ্গে দেখা করার অছিলায় অসংখ্যবার গিয়েছি সংবাদ কার্যালয়ে। সন্তোষ গুপ্ত, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, বজলুর রহমান, আবু কায়সার এরা এখন প্রয়াণ পথের যাত্রী। সোহরাব হাসান, মিনার মনসুর, মনজুরুল আহসান বুলবুল, আদিলা বকুল, আহসান হামিদ, শওকত মাহমুদ- কত প্রিয় নাম। সন্তোষদা হাতে সিগারেট- সারাক্ষণ কী যে ভাবতেন! সাইয়িদ ভাই সর্বদাহ গম্ভীর মুখ। প্রচলনের বাইরে গিয়ে অসাধারণ সব প্রতিবেদন লিখতেন। জাতীয় কবিতা পরিষদ মঞ্চে একটা ছবি আঁকলেন পটুয়া কামরুল হাসান। এর কয়েক মুহূর্ত পরেই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। জননেত্রী শেখ হাসিনা তখন শ্রোতার সারিতে বসে কবিতা পাঠ শুনছিলেন। তাঁর গাড়িতে করেই মুমূর্ষু কামরুল হাসানকে হাসপাতালে নেয়া হলো। এ মহান শিল্পীর শেষ আঁকা ছবিটি পরদিন প্রকাশিত হলো সংবাদের প্রথম পৃষ্ঠায়। এর প্রতিটি রেখা ধরে ধরে বিশ্লেষণ করে লিখলেন সাইয়িদ আতীকুল্লাহ। সে এক অসাধারণ রচনা। ‘দেশ আজ বিশ্ব বেহায়ার খপ্পড়ে’ কামরুল হাসানেরই দেয়া শিরোনাম নতুন মাত্রা পেল সাইয়িদ আতীকুল্লাহর কলমে। এর জন্যে ‘সংবাদ’ এবং সাইয়িদ আতীকুল্লাহকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের ইতিহাসে এগুলো গুরুত্বের সঙ্গে লেখা আছে। মৌলবাদীরা একবার ‘সংবাদ’ কার্যালয় আক্রমণ করেছিল। আবু কায়সার তো দু’তলা থেকে লাফিয়ে পড়ে প্রাণে বেঁচে ছিলেন। অবশ্য সংবাদের সাহসী কর্মীদের প্রতিরোধের মুখে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে গিয়েছিল।

একসময় দৈনিক পত্রিকার সংবাদের পাশাপাশি কলামগুলোও ছিল বিশেষ আকর্ষণীয়। এখনও সংবাদপত্রে উপসম্পাদকীয় ছাপা হয়। কিন্তু অদূর অতীতে কোনো কোনো দৈনিক পত্রিকা ছদ্মনামে লেখা বিশেষ বিশেষ কলামের জন্য পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। দৈনিক সংবাদের বেলায় অন্তত দুটি কলামের কথা উল্লেখ করা যায়। একটি ‘দরবার-ই-জহুর’, অন্যটি ‘সময় বহিয়া যায়’। প্রথমটি লিখতেন জহুর হোসেন চৌধুরী, অন্যটি ‘গাছপাথর’ ছদ্মনামে লিখতেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। কী যে জনপ্রিয় দুটি কলাম, আমরা গভীর অপেক্ষায় থাকতাম কলাম দুটি পাঠের জন্য।

জহুর হোসেন চৌধুরী ‘দরবার-ই-জহুর’ ছিল রসাত্মক এবং ব্যঙ্গাত্মক ভাষায় লেখা। গভীর কথা বলা হতো রসিয়ে রসিয়ে। আর ‘সময় বহিয়া যায়’ ছিল সমাজ দর্শনের গদ্যভাষ্য। শব্দ যে কত শাণিত হতে পারে, দুটি কলাম পাঠে পাঠক তা অনুভব করতে পারতেন।

সংবাদ-এর সাহিত্য পাতার খ্যাতি চিরকালের। নবীন-প্রবীণ লেখকের সমন্বয় ঘটে এ পাতায়। সংবাদের সাহিত্য পাতায় জীবনের প্রথম লেখা ছাপা হওয়ার অনন্য স্মৃতি রয়েছে অনেকের। সংবাদে লেখেননি এমন লেখক একজনও নেই- এমন কথা অনেকটা নিশ্চিত হয়েই বলা যায়। ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চার পৃষ্ঠার সাহিত্যপাতা এখনো বেরোচ্ছে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অন্যান্য ফিচার পাতাও যথেষ্ট সমৃদ্ধ। দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার উজ্জ্বল উদাহরণ দৈনিক সংবাদ।

সংবাদ হচ্ছে সাংবাদিক তৈরির প্রতিষ্ঠান। বলা হয়ে থাকে, অতীতে এবং বর্তমানেও দেশের খ্যাতিমান অনেক সাংবাদিকের কর্মজীবন শুরু হয়েছে ‘সংবাদ’-এ। কথাটি বহুলাংশে সত্য। সংবাদের একটি আদর্শিক অবস্থান আছে। যারা এ কাগজের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন, আছেন, তাদের পেশাদরিত্বের সমান্তরালে রয়েছে ‘প্রতিশ্রুতি’র স্বচ্ছ অবস্থান। শুধু কর্মস্থল নয়, এ কাগজের সঙ্গে জড়িত থেকে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে নিজেদের দায়বদ্ধতাও পালন করে থাকেন। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে সংবাদের কর্মীরা প্রতিষ্ঠানের সুনাম-ঐতিহ্য বজায় রাখতে সচেষ্ট থেকেছেন। সাংবাদিকতার হাতেখড়ি রয়েছে ‘সংবাদ’-এ, কর্মজীবন শেষ করেছেন এ প্রতিষ্ঠানে, এমন উদাহরণও বিরল নয়।

‘সংবাদ’ আগামী দিনগুলোতে ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারবে, এ প্রত্যাশা আমরা করতে পারি।