অতিবৃষ্টি ও বন্যায় ২৪ জেলায়

১২০টি সড়ক-মহাসড়ক বিপর্যস্ত

সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত আঞ্চলিক ও জেলা সড়ক মেরামতের জন্য ২৪০ কোটি টাকা চেয়েছে সওজ

অতিবৃষ্টি ও বন্যায় সারাদেশের সড়ক ও মহাসড়ক বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আঞ্চলিক ও জেলা সড়ক। সম্প্রতি বন্যায় সারাদেশের ২৪টি জেলার ১২০টি সড়ক ও মহাসড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে সড়ক ও জনপদ অধিদফতর (সড়ক) সূত্র জানায়। এর মধ্যে জাতীয়, আঞ্চলিক ও জেলা মহাসড়ক রয়েছে। সারাদেশে প্রায় ৫০০ কিলোমিটার সড়ক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এরমধ্যে বন্যার পানিতে ডুবে ছিল ৬৫টি সড়ক। এরমধ্যে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার সড়ক পানিতে নিমজ্জিত থাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়েছে যায়। এছাড়া অতিবৃষ্টিতে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও রংপুর-কুড়িগ্রাম জাতীয় মহাসড়কের বেহাল অবস্থা তৈরি হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানায়। এসব সড়ক স্থায়ী মেরামতের জন্য ২৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে বলে সওজ সূত্র জানায়।

সওজ এর ৮৭৬টি সড়কের মধ্যে

ক্ষতিগ্রস্ত ১২০টি

সারাদেশের ২১ হাজার ৫৭৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক ও মহাসড়ক রয়েছে। এরমধ্যে ৩ হাজার ৮২৬ কিলোমিটারের ৯৬টি জাতীয় মহাসড়ক, ৪ হাজার ৪৭০ কিলোমিটারের ১২৬টি আঞ্চলিক মহাসড়ক ও ১৩ হাজার ২৭৮ কিলোমিটারের ৬৫৪টি জেলা মহাসড়ক রয়েছে। সর্বমোট ৮৭৬টি সড়ক ও মহাসড়কের মধ্যে এবার বন্যায় ২৪ জেলায় ১২০টি সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত রয়েছে সড়ক ও জনপদ অধিদফতরে (সড়ক) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানা গেছে। এছাড়া স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও জেলা পরিষদের আওতায় বিভিন্ন গ্রামীণ সড়ক রয়েছে। এবার অতিবৃষ্টি ও বন্যার এসব সড়কের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে স্থানীয় সূত্র জানায়। এরমধ্যে রংপুর, সিলেট, রবিশাল, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও খুলনা বিভাগের বিভিন্ন জেলার সড়কের বেহাল অবস্থা তৈরি হয়েছে।

এ বিষয়ে সওজ’র রংপুর জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. মনিরুজ্জামান সংবাদকে বলেন, এবার বন্যায় রংপুর বিভাবে সবচেয়ে বেশি সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কুড়িগ্রাম জেলায়। এই জেলায় ৬টি সড়ক পুরোপুরি পানিতে ডুবে যায়। বর্তমানে সড়কের পানি নেমে গেছে। কিন্তু এখনো ক্ষয়ক্ষতি পরিমাণ নির্ধারণ করা যায়নি। বিভিন্ন জেলায় সার্ভে করা হচ্ছে। প্রাথমিক মেরামত করে সড়কগুলো যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে। তবে স্থানীয় মেরামতের জন্য বরাদ্দের আবেদন করা হবে।

৭টি জেলার সড়ক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত

সম্প্রতি জাতিসংঘের করা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বন্যায় বাংলাদেশের সাতটি জেলা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব জেলাগুলো হচ্ছে কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, সুনামগঞ্জ ও শরীয়তপুর। এসব জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত নদ-নদীর পানি নেমে যাওয়ার স্থানীয় মানুষের জীবন স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে কমপক্ষে আরও এক বছর। ২০২১ সালের মার্চের আগে এসব এলাকার মানুষের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হবে না। এই সাত জেলার মানুষকে পুনর্বাসনে সহায়তার জন্য ৩৩০ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে বলে সংস্থাটি জানায়। এ সব সড়ক ও মহাসড়ক ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে স্থানীয় সূত্র জানায়।

জানা যায়, এবার বন্যায় উত্তরাঞ্চলের কুড়িগ্রাম জেলা ১২টি সড়ক পানি নিচে ডুবে গেছে। এর মধ্যে একটি জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আঞ্চলিক মহাসড়কে প্রায় সাড়ে ৬ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১২ কোটি চাহিদা দেয়া হয়েছে বলে স্থানীয় সূত্র জানায়। এছাড়া মানিকগঞ্জের ৩৩ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর জন্য ৪ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলার সওজ’ন নির্বাহী প্রকৌশলী গাউসুল হাসান মারুফ। এছাড়া জামালপুরে ৩০ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরজন্য প্রাথমিক মেরামতের জন্য ৫ কোটি ও স্থায়ী মেরামতের জন্য ২০ কোটি বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান।

এছাড়া অতিবৃষ্টি ও বন্যায় ঢাকা-টাঙ্গাইল, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-খুলনা, রংপুর-কুড়িগ্রাম ও ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কসহ দেশের বিভিন্ন গ্রামীণ সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে স্থানীয় সূত্র জানায়। দেশের বিভিন্ন গ্রামীণ সড়ক খানাখন্দে ভরে গেছে। ভাঙা ও কর্দমাক্ত সড়ক দিয়ে যাতায়াতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় বলে স্থানীয়রা জানায়। এদিকে বন্যায় সেতুর সংযোগ সড়ক ভেঙে যাওয়া টাঙ্গাইলের মির্জাপুর-বালিয়া সড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। গত ১৪ আগস্ট এই সড়কে রোয়াইল সেতুর সংযোগ সড়ক ধসে পড়ে বলে সড়ক ও জনপথ অধিফতরের মির্জাপুর অফিস ও স্থানীয়রা জানায়। এছাড়া এই সড়কের কয়েকটি স্থানে বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়ে ভাঙনের সৃষ্টি হওয়ায় চলাচলে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। সড়কটি সংস্কার ও রোয়াইল সেতুর সংযোগ সড়ক দ্রুত মেরামতের নির্দেশ দেয়া হয়েছে সওজ সূত্র জানায়।

স্থানীয়রা জানায়, বন্যার পানির প্রবল ¯্রােতে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর-বালিয়া সড়কের পুষ্টকামুরী, রাজনগর, ঘুগি, রোয়াইল অংশসহ অন্তত ২০টি জায়গায় ফাটল দেখা দিয়েছে। এছাড়া সড়কে রয়েছে খানাখন্দ। এরমধ্যেই ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে মানুষ ও ছোট যানবাহন। কেউ কেউ বিকল্প হিসেবে নৌকায় চলাচল করছে। গত ১৩ আগস্ট বৃহস্পতিবার সকালে সড়কটির রোয়াইল বাজার সংলগ্ন খালের ওপর নির্মিত সেতুর সংযোগ সড়কে ফাটল দেখা দেয়। শুক্রবার সংযোগ সড়কটি পানিতে তলিয়ে যায়। সেতুর নিচ দিয়ে তীব্রগতিতে বন্যার পানি প্রবাহিত হওয়া এই সমস্যা দেখা দেয়। এতে সেতুটিও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। ঝুঁকি নিয়ে সড়ক দিয়ে হেঁটে, অটোরিকশায়, নৌকায় এবং ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেলে মানুষ চলাচল করতে হয়।

আনোয়ার হোসেন নামের স্থানীয় বাসিন্দা সংবাদিকদের বলেন, ‘বন্যার সময় ২৫/৩০টি গ্রামের পানি এইখান দিয়ে নিষ্কাশন হয়ে থাকে। ব্রিজটি নির্মাণের সময় এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল আরও লম্বা করতে। তাদের কথা রাখলে এখন এ অবস্থা হতো না। সড়কের কাজ নিম্নমানের এবং সেতুটি অপরিকল্পিত হওয়ায় পানির ¯্রােতে শুক্রবার রোয়াইল সেতুর সংযোগ সড়ক ভেঙে পানিতে তলিয়ে গেছে।’

সওজ’র সূত্র জানায়, মির্জাপুর-বালিয়া সড়ক সহ টাঙ্গাইল জেলার প্রায় ১৮টি সড়ক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রাথমিক মেরামত করে সড়ক দিয়ে যান চলাচল করা হচ্ছে। এখনও অনেক সড়কে পানিতে ডুবে আছে। মির্জাপুর-বালিয়া সড়কের সেতুর সংযোগ সড়ক সংস্কারের কাজ চলছে। ২০১৭ সালে সড়কটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়। এরপর থেকে ভারী যানবাহন নিয়মিত চলতে থাকে, যা সড়কের জন্য ক্ষতিকর। দীর্ঘস্থায়ী বন্যার কারণে পানির প্রবল স্রোতে রোয়াইল সেতুর সংযোগ সড়ক ধসে পড়ে। এরপরেই সড়কটি সংস্কার কাজ শুরু হয়েছে। সড়কের খানাখন্দ সংস্কার করে যান চলাচলের উপযোগী করে রোয়াইল ব্রিজের সংযোগ সড়ক সংস্কার করা হবে। আগামী ৩/৪ দিনের মধ্যে সংস্কার কাজ শেষ করে সড়কটিতে যান চলাচলের উপযোগী করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানায়।

এ বিষয়ে টাঙ্গাইল জেলার সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মনিরুজ্জামান সংবাদকে বলেন, এবার বন্যায় টাঙ্গাইল জেলায় ১৮টি সড়ক পানিত ডুবে যায়। এখনো কয়েকটি সড়কে পানি রয়েছে। তাই পুরোপুরি ক্ষয়ক্ষতি নির্ণয় করা যায়নি। সড়কের পানি মেনে গেলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করা যাবে। পানি মেনে যাওয়া সড়কে সাময়িক মেরামত করে যান চলাচল শুরু করা হয়েছে। বন্যায় মির্জাপুর-বালিয়া সড়কের সেতুর সংযোগ ধসে যায়। ইতোমধ্যে সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে আশা করি দুই-এক দিনের মধ্যে ঠিক করা যাবে।

বেহাল অবস্থা রংপুর-কুড়িগ্রাম মহাসড়ক

অতিবৃষ্টিতে রংপুর-কুড়িগ্রাম মহাসড়কের বেহাল অবস্থা তৈরি হয়েছে। রংপুর শহরের পার্ক মোড় এলাকা থেকে কাউনিয়া উপজেলা পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার সড়কের শতাধিক স্থানে খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে। সড়কে চলাচলকারী বাস, পণ্যবাহী ট্রাকসহ সবধরনের যানবাহন চলাচলে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে বলে স্থানীয়রা জানান। রংপুর শহরের পার্ক মোড় থেকে নবদিগঞ্জ বাজার হয়ে কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটে যাওয়ার একমাত্র সড়ক। এছাড়া লালমনিরহাটে বুড়িমারী স্থলবন্দরের পণ্যবাহী ট্রাক এই সড়ক দিয়ে যাতায়াত করে। সড়কে খানাখন্দের কারণে দূরপাল্লার যাত্রীবাহী বাস ও পণ্যবাহী ট্রাকগুলো অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হয়। বিভিন্ন সময় পণ্যবাহী ট্রাক উল্টে যাওয়ার ঘটনা ঘটে বলে স্থানীয়রা জানান।

রংপুরের সাতমাথা এলাকায় সজিব নামের এক ট্রাকের চালক সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালানো খুবই কষ্টকর ব্যাপার। একটু এদিক-সেদিক হলে উল্টে যাওয়ার ভয় থাকে।’ কাউনিয়ার নবদিগঞ্জ বাজার এলাকায় খানাখন্দে ভরা রাস্তায় বাস ও ট্রাক ধীরে ধীরে চলাচল করতে হয়। আবুল হাসান নামের এক বাস চালক বলেন, ‘কী যে অবস্থা হয়েছে এই রাস্তার! অনেক দিন থেকে শুধু শুনে আসছি রাস্তাটি সংস্কার হবে। কিন্তু ভালো আর হয় না। এছাড়া এবার বন্যা ও অতিবৃষ্টির কারণে মহাসড়কটি বেহাল অবস্থা তৈরি হয়েছে। দিনের বেলা দেখে দেখে চালা গেলেও রাতের বেলা খুব কষ্ট হয়।’

সওজ’র সূত্র জানায়, মহাসড়কটি দিয়ে প্রতিদিন অতিরিক্ত পণ্য বোঝাই করে পাথরবাহী ট্রান চলাচল করে। এ জন্য সড়কটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া বর্ষায় অতিবৃষ্টির কারণে মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে। সড়কটি মেরামতের জন্য ইতিমধ্যে ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু পাথর সংকটের কাজ বন্ধ রয়েছে।

এ বিষয়ে রংপুর সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী একেএম শফিক উজ্জামান সংবাদকে বলেন, এবার রংপুর জেলায় সড়কের তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। দুটি সেতুর সংযোগ সড়ক ধসে গেছে। ইতোমধ্যে প্রাথমিক মেরামত করা হয়েছে। এছাড়া অতিবৃষ্টি ও ওভারলোডের কারণে রংপুর-কুড়িগ্রাম মহাসড়কের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এই মহাসড়কটি সংস্কারের জন্য ইতোমধ্যে ঠিকাদার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু পাথর সংকটের কারণে কাজ শুরু করতে পারেনি। আগামী এক-দুই সপ্তাহের মধ্যে কাজ শুরু হবে বলে জানান তিনি।

বুধবার, ২৬ আগস্ট ২০২০ , ৬ মহররম ১৪৪২, ২৬ আগস্ট ২০২০

অতিবৃষ্টি ও বন্যায় ২৪ জেলায়

১২০টি সড়ক-মহাসড়ক বিপর্যস্ত

সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত আঞ্চলিক ও জেলা সড়ক মেরামতের জন্য ২৪০ কোটি টাকা চেয়েছে সওজ

ইবরাহীম মাহমুদ আকাশ

image

অতিবৃষ্টি ও বন্যায় সারাদেশের সড়ক ও মহাসড়ক বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আঞ্চলিক ও জেলা সড়ক। সম্প্রতি বন্যায় সারাদেশের ২৪টি জেলার ১২০টি সড়ক ও মহাসড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে সড়ক ও জনপদ অধিদফতর (সড়ক) সূত্র জানায়। এর মধ্যে জাতীয়, আঞ্চলিক ও জেলা মহাসড়ক রয়েছে। সারাদেশে প্রায় ৫০০ কিলোমিটার সড়ক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এরমধ্যে বন্যার পানিতে ডুবে ছিল ৬৫টি সড়ক। এরমধ্যে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার সড়ক পানিতে নিমজ্জিত থাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়েছে যায়। এছাড়া অতিবৃষ্টিতে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও রংপুর-কুড়িগ্রাম জাতীয় মহাসড়কের বেহাল অবস্থা তৈরি হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানায়। এসব সড়ক স্থায়ী মেরামতের জন্য ২৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে বলে সওজ সূত্র জানায়।

সওজ এর ৮৭৬টি সড়কের মধ্যে

ক্ষতিগ্রস্ত ১২০টি

সারাদেশের ২১ হাজার ৫৭৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক ও মহাসড়ক রয়েছে। এরমধ্যে ৩ হাজার ৮২৬ কিলোমিটারের ৯৬টি জাতীয় মহাসড়ক, ৪ হাজার ৪৭০ কিলোমিটারের ১২৬টি আঞ্চলিক মহাসড়ক ও ১৩ হাজার ২৭৮ কিলোমিটারের ৬৫৪টি জেলা মহাসড়ক রয়েছে। সর্বমোট ৮৭৬টি সড়ক ও মহাসড়কের মধ্যে এবার বন্যায় ২৪ জেলায় ১২০টি সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত রয়েছে সড়ক ও জনপদ অধিদফতরে (সড়ক) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানা গেছে। এছাড়া স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও জেলা পরিষদের আওতায় বিভিন্ন গ্রামীণ সড়ক রয়েছে। এবার অতিবৃষ্টি ও বন্যার এসব সড়কের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে স্থানীয় সূত্র জানায়। এরমধ্যে রংপুর, সিলেট, রবিশাল, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও খুলনা বিভাগের বিভিন্ন জেলার সড়কের বেহাল অবস্থা তৈরি হয়েছে।

এ বিষয়ে সওজ’র রংপুর জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. মনিরুজ্জামান সংবাদকে বলেন, এবার বন্যায় রংপুর বিভাবে সবচেয়ে বেশি সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কুড়িগ্রাম জেলায়। এই জেলায় ৬টি সড়ক পুরোপুরি পানিতে ডুবে যায়। বর্তমানে সড়কের পানি নেমে গেছে। কিন্তু এখনো ক্ষয়ক্ষতি পরিমাণ নির্ধারণ করা যায়নি। বিভিন্ন জেলায় সার্ভে করা হচ্ছে। প্রাথমিক মেরামত করে সড়কগুলো যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে। তবে স্থানীয় মেরামতের জন্য বরাদ্দের আবেদন করা হবে।

৭টি জেলার সড়ক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত

সম্প্রতি জাতিসংঘের করা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বন্যায় বাংলাদেশের সাতটি জেলা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব জেলাগুলো হচ্ছে কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, সুনামগঞ্জ ও শরীয়তপুর। এসব জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত নদ-নদীর পানি নেমে যাওয়ার স্থানীয় মানুষের জীবন স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে কমপক্ষে আরও এক বছর। ২০২১ সালের মার্চের আগে এসব এলাকার মানুষের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হবে না। এই সাত জেলার মানুষকে পুনর্বাসনে সহায়তার জন্য ৩৩০ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে বলে সংস্থাটি জানায়। এ সব সড়ক ও মহাসড়ক ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে স্থানীয় সূত্র জানায়।

জানা যায়, এবার বন্যায় উত্তরাঞ্চলের কুড়িগ্রাম জেলা ১২টি সড়ক পানি নিচে ডুবে গেছে। এর মধ্যে একটি জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আঞ্চলিক মহাসড়কে প্রায় সাড়ে ৬ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১২ কোটি চাহিদা দেয়া হয়েছে বলে স্থানীয় সূত্র জানায়। এছাড়া মানিকগঞ্জের ৩৩ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর জন্য ৪ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলার সওজ’ন নির্বাহী প্রকৌশলী গাউসুল হাসান মারুফ। এছাড়া জামালপুরে ৩০ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরজন্য প্রাথমিক মেরামতের জন্য ৫ কোটি ও স্থায়ী মেরামতের জন্য ২০ কোটি বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান।

এছাড়া অতিবৃষ্টি ও বন্যায় ঢাকা-টাঙ্গাইল, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-খুলনা, রংপুর-কুড়িগ্রাম ও ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কসহ দেশের বিভিন্ন গ্রামীণ সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে স্থানীয় সূত্র জানায়। দেশের বিভিন্ন গ্রামীণ সড়ক খানাখন্দে ভরে গেছে। ভাঙা ও কর্দমাক্ত সড়ক দিয়ে যাতায়াতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় বলে স্থানীয়রা জানায়। এদিকে বন্যায় সেতুর সংযোগ সড়ক ভেঙে যাওয়া টাঙ্গাইলের মির্জাপুর-বালিয়া সড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। গত ১৪ আগস্ট এই সড়কে রোয়াইল সেতুর সংযোগ সড়ক ধসে পড়ে বলে সড়ক ও জনপথ অধিফতরের মির্জাপুর অফিস ও স্থানীয়রা জানায়। এছাড়া এই সড়কের কয়েকটি স্থানে বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়ে ভাঙনের সৃষ্টি হওয়ায় চলাচলে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। সড়কটি সংস্কার ও রোয়াইল সেতুর সংযোগ সড়ক দ্রুত মেরামতের নির্দেশ দেয়া হয়েছে সওজ সূত্র জানায়।

স্থানীয়রা জানায়, বন্যার পানির প্রবল ¯্রােতে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর-বালিয়া সড়কের পুষ্টকামুরী, রাজনগর, ঘুগি, রোয়াইল অংশসহ অন্তত ২০টি জায়গায় ফাটল দেখা দিয়েছে। এছাড়া সড়কে রয়েছে খানাখন্দ। এরমধ্যেই ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে মানুষ ও ছোট যানবাহন। কেউ কেউ বিকল্প হিসেবে নৌকায় চলাচল করছে। গত ১৩ আগস্ট বৃহস্পতিবার সকালে সড়কটির রোয়াইল বাজার সংলগ্ন খালের ওপর নির্মিত সেতুর সংযোগ সড়কে ফাটল দেখা দেয়। শুক্রবার সংযোগ সড়কটি পানিতে তলিয়ে যায়। সেতুর নিচ দিয়ে তীব্রগতিতে বন্যার পানি প্রবাহিত হওয়া এই সমস্যা দেখা দেয়। এতে সেতুটিও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। ঝুঁকি নিয়ে সড়ক দিয়ে হেঁটে, অটোরিকশায়, নৌকায় এবং ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেলে মানুষ চলাচল করতে হয়।

আনোয়ার হোসেন নামের স্থানীয় বাসিন্দা সংবাদিকদের বলেন, ‘বন্যার সময় ২৫/৩০টি গ্রামের পানি এইখান দিয়ে নিষ্কাশন হয়ে থাকে। ব্রিজটি নির্মাণের সময় এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল আরও লম্বা করতে। তাদের কথা রাখলে এখন এ অবস্থা হতো না। সড়কের কাজ নিম্নমানের এবং সেতুটি অপরিকল্পিত হওয়ায় পানির ¯্রােতে শুক্রবার রোয়াইল সেতুর সংযোগ সড়ক ভেঙে পানিতে তলিয়ে গেছে।’

সওজ’র সূত্র জানায়, মির্জাপুর-বালিয়া সড়ক সহ টাঙ্গাইল জেলার প্রায় ১৮টি সড়ক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রাথমিক মেরামত করে সড়ক দিয়ে যান চলাচল করা হচ্ছে। এখনও অনেক সড়কে পানিতে ডুবে আছে। মির্জাপুর-বালিয়া সড়কের সেতুর সংযোগ সড়ক সংস্কারের কাজ চলছে। ২০১৭ সালে সড়কটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়। এরপর থেকে ভারী যানবাহন নিয়মিত চলতে থাকে, যা সড়কের জন্য ক্ষতিকর। দীর্ঘস্থায়ী বন্যার কারণে পানির প্রবল স্রোতে রোয়াইল সেতুর সংযোগ সড়ক ধসে পড়ে। এরপরেই সড়কটি সংস্কার কাজ শুরু হয়েছে। সড়কের খানাখন্দ সংস্কার করে যান চলাচলের উপযোগী করে রোয়াইল ব্রিজের সংযোগ সড়ক সংস্কার করা হবে। আগামী ৩/৪ দিনের মধ্যে সংস্কার কাজ শেষ করে সড়কটিতে যান চলাচলের উপযোগী করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানায়।

এ বিষয়ে টাঙ্গাইল জেলার সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মনিরুজ্জামান সংবাদকে বলেন, এবার বন্যায় টাঙ্গাইল জেলায় ১৮টি সড়ক পানিত ডুবে যায়। এখনো কয়েকটি সড়কে পানি রয়েছে। তাই পুরোপুরি ক্ষয়ক্ষতি নির্ণয় করা যায়নি। সড়কের পানি মেনে গেলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করা যাবে। পানি মেনে যাওয়া সড়কে সাময়িক মেরামত করে যান চলাচল শুরু করা হয়েছে। বন্যায় মির্জাপুর-বালিয়া সড়কের সেতুর সংযোগ ধসে যায়। ইতোমধ্যে সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে আশা করি দুই-এক দিনের মধ্যে ঠিক করা যাবে।

বেহাল অবস্থা রংপুর-কুড়িগ্রাম মহাসড়ক

অতিবৃষ্টিতে রংপুর-কুড়িগ্রাম মহাসড়কের বেহাল অবস্থা তৈরি হয়েছে। রংপুর শহরের পার্ক মোড় এলাকা থেকে কাউনিয়া উপজেলা পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার সড়কের শতাধিক স্থানে খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে। সড়কে চলাচলকারী বাস, পণ্যবাহী ট্রাকসহ সবধরনের যানবাহন চলাচলে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে বলে স্থানীয়রা জানান। রংপুর শহরের পার্ক মোড় থেকে নবদিগঞ্জ বাজার হয়ে কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটে যাওয়ার একমাত্র সড়ক। এছাড়া লালমনিরহাটে বুড়িমারী স্থলবন্দরের পণ্যবাহী ট্রাক এই সড়ক দিয়ে যাতায়াত করে। সড়কে খানাখন্দের কারণে দূরপাল্লার যাত্রীবাহী বাস ও পণ্যবাহী ট্রাকগুলো অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হয়। বিভিন্ন সময় পণ্যবাহী ট্রাক উল্টে যাওয়ার ঘটনা ঘটে বলে স্থানীয়রা জানান।

রংপুরের সাতমাথা এলাকায় সজিব নামের এক ট্রাকের চালক সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালানো খুবই কষ্টকর ব্যাপার। একটু এদিক-সেদিক হলে উল্টে যাওয়ার ভয় থাকে।’ কাউনিয়ার নবদিগঞ্জ বাজার এলাকায় খানাখন্দে ভরা রাস্তায় বাস ও ট্রাক ধীরে ধীরে চলাচল করতে হয়। আবুল হাসান নামের এক বাস চালক বলেন, ‘কী যে অবস্থা হয়েছে এই রাস্তার! অনেক দিন থেকে শুধু শুনে আসছি রাস্তাটি সংস্কার হবে। কিন্তু ভালো আর হয় না। এছাড়া এবার বন্যা ও অতিবৃষ্টির কারণে মহাসড়কটি বেহাল অবস্থা তৈরি হয়েছে। দিনের বেলা দেখে দেখে চালা গেলেও রাতের বেলা খুব কষ্ট হয়।’

সওজ’র সূত্র জানায়, মহাসড়কটি দিয়ে প্রতিদিন অতিরিক্ত পণ্য বোঝাই করে পাথরবাহী ট্রান চলাচল করে। এ জন্য সড়কটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া বর্ষায় অতিবৃষ্টির কারণে মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে। সড়কটি মেরামতের জন্য ইতিমধ্যে ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু পাথর সংকটের কাজ বন্ধ রয়েছে।

এ বিষয়ে রংপুর সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী একেএম শফিক উজ্জামান সংবাদকে বলেন, এবার রংপুর জেলায় সড়কের তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। দুটি সেতুর সংযোগ সড়ক ধসে গেছে। ইতোমধ্যে প্রাথমিক মেরামত করা হয়েছে। এছাড়া অতিবৃষ্টি ও ওভারলোডের কারণে রংপুর-কুড়িগ্রাম মহাসড়কের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এই মহাসড়কটি সংস্কারের জন্য ইতোমধ্যে ঠিকাদার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু পাথর সংকটের কারণে কাজ শুরু করতে পারেনি। আগামী এক-দুই সপ্তাহের মধ্যে কাজ শুরু হবে বলে জানান তিনি।