রেকর্ড ভেঙে মমতা জয়ী

সব ওয়ার্ডে রিগিং হয়েছে : প্রিয়াঙ্কা টিবরেওয়াল

মমতার উপরই আস্থা রেখেছেন ভবানীপুরের ভোটাররা। রেকর্ড পরিমাণ ভোট দিয়ে ভবানীপুরবাসী তৃতীয়বারের মতো বিধায়ক করেছেন ঘরের মেয়েকে। ৫৮ হাজার ৮৩২ ভোটের ব্যবধানে নিজের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপির প্রার্থী প্রিয়াঙ্কা টিবরেওয়ালকে পরাজিত করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এর মাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রী পদে থাকা নিয়ে সংশয় উড়িয়ে দিলেন তৃণমূল কংগ্রেস প্রধান।

গতকাল সকালে ভোট গণনার শুরু হওয়ার পর থেকেই তার ভোটের ব্যবধান বাড়তে থাকে। নির্বাচন কমিশন সূত্রে খবর, ২১ রাউন্ড গণনা শেষে তৃণমূল প্রার্থী মমতা মোট ভোট পেয়েছেন ৮৪ হাজার ৩৮৯টি। বিজেপি প্রার্থী প্রিয়াঙ্কা টিবরেওয়াল পেয়েছেন ২৬ হাজার ৩২০ ভোট। শেষ পর্যন্ত সিপিএম প্রার্থী শ্রীজীব বিশ্বাস পেয়েছেন ৪২০১ ভোট। অর্থাৎ পোস্টাল ব্যালট নিয়ে মোট ৫৮ হাজার ৮৩২ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন মমতা। ভবানীপুরে এতো ব্যবধানে এর আগে কেউ জয় পাননি। এর আগে বড় ব্যবধানে ভবানীপুরে জয়ের রেকর্ড ছিল মমতার ঝুলিতেই। ২০১১ সালে বিপুল ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী। সেবার তার ব্যবধান ছিল ৫৪ হাজারের কিছু বেশি। কিন্তু এ বার সেই ব্যবধানকেও ছাপিয়ে গিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী।

এই জয়ের পর থেকেই তৃণমূল শিবিরে শুরু হয় বিজয় উৎসব। অন্যদিকে, ভোটের ফলাফল ঘোষণার পরই ক্ষোভে রীতিমতো ফেটে পড়েন বিজেপি প্রার্থী প্রিয়াঙ্কা টিবরেওয়াল। তিনি হতাশ। তার বিস্ফোরক অভিযোগ, ‘সব ওয়ার্ডে রিগিং হয়েছে।’ হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা থেকেও তিনি যে লিড পাননি, সেটাও চেপে রাখেননি তিনি। ফল ঘোষণার পরই সংবাদ মাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে প্রিয়াঙ্কা বলেন, ‘ভোটের দিন কীভাবে রিগিং করতে হয় সেটা আপনাদের মাধ্যমেই দেখেছি। তাই ওদের রিগিং করে, ছাপ্পা ভোট মেরে জেতার জন্য শুভেচ্ছা জানাই।’ কোথায় কোথায় রিগিং হয়েছে? প্রশ্ন করায় প্রিয়াঙ্কা বলেন, ‘সবকটা ওয়ার্ডেই রিগিং ও ছাপ্পা ভোট পড়েছে।’ কিন্তু একটা বাচ্চা মেয়েকে হারাতে যেভাবে দিদি পুরো মন্ত্রিসভাসহ রাজ্য প্রশাসন, পুরো পুলিশ প্রশাসন ও নিজস্ব ক্যাডার ব্যবহার করেছেন তার জন্য আমি খুব খুশি।

প্রসঙ্গত, এর আগেও দুইবার ভবানীপুরের এই আসন থেকে জিতেছিলেন মমতা। এ বছরের বিধানসভা নির্বাচনে আসনটি শোভনদেব চট্টপাধ্যায়কে ছেড়ে নিজে দাঁড়িয়েছিলেন পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রাম আসনে। তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতার পর সেখানে তিনি হেরে যান এক সময় তারই ডেপুটি শুভেন্দু অধিকারীর কাছে। মমতা হারলেও তৃণমূলই সরকার গড়ে, মমতাকে তৃতীয়বারের মতো মুখ্যমন্ত্রীও বানায়। ভারতের নিয়ম অনুযায়ী কেউ হেরে যাওয়ার পরও তার দল যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় এবং দলের নির্বাচিত সদস্যরা যদি তাকে নেতা নির্বাচিত করেন, তাহলে তার মুখ্যমন্ত্রী হতে আইনগত কোন বাধা নেই। তবে ভোটে না জিতেও মুখ্যমন্ত্রী হলে তাকে ওই পদে বসার ১৮০ দিনের মধ্যে কোন একটি আসন থেকে জিতে আসতে হবে। তা না পারলে ছেড়ে দিতে হবে পদ। মমতাকে জিতিয়ে আনতে শোভনদেব পরে ভবানীপুরের আসন থেকে পদত্যাগ করে নেত্রীর জন্য পথ খুলে দেন।

ভবানীপুরে এতদিন যা বিজেপির শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল, সেখানেই এবার হানা দিল তৃণমূল। ৮টি ওয়ার্ডের বিচিত্র এই বিধানসভা কেন্দ্রে ৭০ নম্বর ওয়ার্ডে গণনার শেষে দেখা যায়, সেখান থেকে ১৫৫৬ ভোটের ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ৭০ নম্বর ওয়ার্ডের এই ফলাফল বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ কারণ, এই ওয়ার্ড পুরোপুরি অবাঙালি অধ্যুষিত। তাই ভবানীপুর বিধানসভা কেন্দ্রকে বলা হয় ‘মিনি ভারতবর্ষ’। কারণ, গোটা ভারতে যে ধরনের ভাষাভাষি মানুষদের বসবাসের বৈচিত্র দেখা যায়, ঠিক একই ধরনের বৈচিত্র রয়েছে ভবানীপুরেও। এখানে বাঙালি হিন্দু ভোটারদের হার ৪২ শতাংশ। অবাঙালি হিন্দু রয়েছেন ৩৪ শতাংশ। সংখ্যালঘু মুসলিম ভোটার হার ২৪ শতাংশ।

বিজেপিকে বড় ধাক্কা দিয়েছে ভবানীপুরের ৬৩ নম্বর, ৭৪ নম্বর ও ৭১ নম্বর ওয়ার্ড। ৬৩ নম্বর ওয়ার্ডে অবাঙালি আধিপত্য বেশি। মোট ভোটারদের মধ্যে ৫০ শতাংশ এই ওয়ার্ডে অবাঙালি। ২০১৪ সাল থেকে মাত্র একবার ৭৪ নম্বর ওয়ার্ডে লিড নিতে পেরেছিল বিজেপি। সেটা ২০১৬ সালে। তার পর যতবার ভোট হয়েছে, ততবার বিজেপিই এগিয়ে থেকেছে। কিন্তু এবার সেই ট্রেন্ড উল্টে গেল। ভবানীপুরের ৭১ নম্বর ওয়ার্ডে লোকসভা ভোটে বিজেপি এগিয়ে থাকত। কিন্তু সেখানেও এবার লিড নিয়েছেন মমতা। অর্থাৎ যে কেন্দ্রগুলো ঘিরে বিজেপি জয়ের আশা করেছিল, সেই ওয়ার্ডগুলোই গেরুয়া শিবিরকে ধাক্কা দিয়েছে ব্যাপকভাবে। ভবানীপুরে ভোটের অবস্থা এই হবে সে ব্যাপারে রাজনৈতিক মহলও বুঝতে পারেনি।

মমতা যে এই উপনির্বাচনে জিতবেন তা ভেবেছিলেন রাজ্য রাজনীতিবিদরা। কিন্তু বিরাট ব্যবধানে বিজেপি ও সিপিএম কার্যত মুখ থুবড়ে পড়বে মমতা ম্যাজিকের সামনে তা বুঝতে পারেননি, এমনটাই বলেছেন কলকাতা বিশ্ববিধ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রফেসর বিশ্বাস। তিনি বলেন, ভোটপরবর্তী হিংসা মামলায় সাফল্য পাবার পর দাপুটে আইনজীবী তথা মহিলা মুখ প্রিয়াঙ্কা টিব্রেওয়ালের ওপর ভরসা রেখেছিল বিজেপি। আট বছরের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রিয়াঙ্কা জোরদার লড়ার চেষ্টা করেছিলেন এ কথা সত্যি; তবে সে লড়াই একেবারেই কাজে এল না।

বিশাল জয়ের পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভবানীপুরবাসীকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘ভবানীপুর বিজেপিকে জব্দ করেছে। ভবানীপুর আমাকে আরও কাজ করার প্রেরণা জুগিয়েছে। আমি চিরঋণী। ভবানীপুরের সব মা-ভাই-বোনদের কাছে। ভবানীপুরে উপনির্বাচনে এবার ১ লাখ ১৫ হাজারের মতো ভোট পড়েছিল। সেই তুলনায় সামশেরগঞ্জ ও জঙ্গিপুরে ভোট পড়েছিল অনেক বেশি। ২০১১ সালে আমি ভবানীপুরে ৫৪ হাজার ভোটে জিতেছিলাম। গত বিধানসভা নির্বাচনে ভবানীপুরে শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় ২৮ হাজার ভোটে জিতেছিলেন। এবার আমরা ৫৮ হাজারের বেশি ভোটে জিতেছি। ভবানীপুরবাসীকে অভিনন্দন। ভবানীপুর বিধানসভার অন্তর্গত কোন ওয়ার্ডে এবার হারিনি।

মমতা ব্যানার্জি আরও বলেন, ‘পূজার পরই শান্তিপুর, খড়দহ, গোসাবা, দিনহাটায় উপনির্বাচন রয়েছে। শান্তিপুরে তৃণমূল প্রার্থী হচ্ছেন ব্রজকিশোর গোস্বামী। দিনহাটায় তৃণমূল প্রার্থী হচ্ছেন উদয়ন গুহ। খড়দহে তৃণমূল প্রার্থী হচ্ছেন শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। গোসাবার জন্য দুটি নাম ভাবা হয়েছে এখনও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি কাকে প্রার্থী করা হবে। ৩০ অক্টোবর ওই চারটি কেন্দ্রে উপনির্বাচন হবে। বিজেপির এই উপনির্বাচনে এই খারাপ রেজাল্ট করার পেছেনে অনেকগুলো ফ্যাক্টর কাজ করেছে। তার মধ্যে বাঙালি-অবাঙালি হিন্দু, মুসলিম সংখ্যালঘুর মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করাটাই ছিল মূল, এমনটাই বলেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক অরিন্দম সিনহা রায়। বিধান সভা ভোটের আগেও বিজেপিকে বাঙালিবিরোধী ও বহিরাগত এবং সংখ্যালঘুদের কাছে সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধ দল হিসেবে প্রচার করে আসছে তৃণমূল।

বিজেপি আস্তে আস্তে পিছিয়ে যায়। তারা বাঙালি-আবাঙালি-সংখ্যালঘু তথা সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদী দল, এই বিষয়টিকে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের মাঝে বুঝাতে পারেনি। তারা বাঙালিবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক দল হিসেবে যতটা না, তার চেয়ে বেশি তাদের বাঙালিবিরোধী দল বলে গুরুত্ব দিয়ে প্রচারণা চালিয়ে তৃণমূল বিজেপিকে কোণঠাসা করেছে। বিজেপির পশ্চিমবঙ্গের নেতৃত্ব তারা যে বাঙালিবিরোধী নয়, এই বিষয়টিকে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যর্থ হয়েছে।

বিশ্লেষক অরিন্দম বলেন, বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কিছু ভুল সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার কারণে রাজ্য বিজেপির অন্দরে অসন্তোষ কাজ করে। তিনি উল্লেখ করেছেন, এই উপনির্বাচনের সন্ধিক্ষণে রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষকে সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে সেখানে উত্তরাঞ্চলের সাংসদ ড. সুকান্ত মজুমদারকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আরিন্দম সিনহার মতে, পরিবর্তন দলের প্রয়োজনে হতে পারে কিন্তু নির্বাচন সমগতকালীন কেন করা হলো বোধগম্য নয়। দিলীপ ঘোষ একটানা সাত বছর দলটিকে বাংলায় একটি ভালো পর্যায়ে এনে দিয়েছেন। দুই থেকে ১৮ সাংসদ ও তিন থেকে ৭৭ বিধায়ক হওয়াটা তার নেতৃত্বে হয়েছে। তৃণমূলের কাছে দিলীপ ঘোষের নেতৃত্বের গুরুত্ব ছিল। ভবানীপুরে বাঙালি আবালীর কাছেও বিষয়টি রেখাপাত করেছে।

এ ব্যাপারে বিজেপি সভাপতি ড. সুকান্ত মজুমদার বলেন, নির্বাচনে সাফল্যের আশা নিয়ে লড়তে হয়। কিন্তু ক্রমাগত মিথ্যাচার করে তৃণমূল বিজেপিকে বাংলায় বঙালিবিরোধী ও সাম্প্রদায়ক দল হিসেবে বলে বাংলাকে সর্বনাশের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আমরা এই পরাজয়ের ব্যাপারটি সম্মিলিতভাবে বিশ্লেষণ করবো।

সুকান্ত মজুমদার বলেন, আমরা বাঙালি-অবাঙালি, বিহারী-হিন্দুস্তানি বা মুসলিম সংখ্যালঘু এই ধরনের উগ্রপ্রাদেশিকতাবাদে বিশ্বাস করি না। আমরা মনে করি ভারত সবার। বাংলা যতখানি বাঙালির ততখানিই কয়েকশ বছর ধরে এখানে বসবাসকারী অন্য প্রদেশ বা রাজ্যের মানুষের। আবার গুজরাট যতটা গুজরাটির ততোটাই বাঙালির। গোয়া যতটা গোয়ানিজের ততোটাই বাঙালির। বাংলায় কেউ এলে তাদের বহিরাগত তকমা দেয়া হয় তৃণমূলী প্রচারে। এমনকি আমাদের ভবানীপুরের প্রার্থী প্রিয়াঙ্কা টিব্রেয়ালকেও বহিরাগত বলে প্রচার করেছে তৃণমূল। অথচ তার জন্ম ভবানীপুরেই। মমতা যেমন ভবানীপুরের মেয়ে তেমনি প্রিয়াঙ্কাও ভবানীপুরের ঘরের মেয়ে।

সোমবার, ০৪ অক্টোবর ২০২১ , ১৯ আশ্বিন ১৪২৮ ২৫ সফর ১৪৪৩

রেকর্ড ভেঙে মমতা জয়ী

সব ওয়ার্ডে রিগিং হয়েছে : প্রিয়াঙ্কা টিবরেওয়াল

দীপক মুখার্জী, কলকাতা

image

মমতার উপরই আস্থা রেখেছেন ভবানীপুরের ভোটাররা। রেকর্ড পরিমাণ ভোট দিয়ে ভবানীপুরবাসী তৃতীয়বারের মতো বিধায়ক করেছেন ঘরের মেয়েকে। ৫৮ হাজার ৮৩২ ভোটের ব্যবধানে নিজের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপির প্রার্থী প্রিয়াঙ্কা টিবরেওয়ালকে পরাজিত করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এর মাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রী পদে থাকা নিয়ে সংশয় উড়িয়ে দিলেন তৃণমূল কংগ্রেস প্রধান।

গতকাল সকালে ভোট গণনার শুরু হওয়ার পর থেকেই তার ভোটের ব্যবধান বাড়তে থাকে। নির্বাচন কমিশন সূত্রে খবর, ২১ রাউন্ড গণনা শেষে তৃণমূল প্রার্থী মমতা মোট ভোট পেয়েছেন ৮৪ হাজার ৩৮৯টি। বিজেপি প্রার্থী প্রিয়াঙ্কা টিবরেওয়াল পেয়েছেন ২৬ হাজার ৩২০ ভোট। শেষ পর্যন্ত সিপিএম প্রার্থী শ্রীজীব বিশ্বাস পেয়েছেন ৪২০১ ভোট। অর্থাৎ পোস্টাল ব্যালট নিয়ে মোট ৫৮ হাজার ৮৩২ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন মমতা। ভবানীপুরে এতো ব্যবধানে এর আগে কেউ জয় পাননি। এর আগে বড় ব্যবধানে ভবানীপুরে জয়ের রেকর্ড ছিল মমতার ঝুলিতেই। ২০১১ সালে বিপুল ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী। সেবার তার ব্যবধান ছিল ৫৪ হাজারের কিছু বেশি। কিন্তু এ বার সেই ব্যবধানকেও ছাপিয়ে গিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী।

এই জয়ের পর থেকেই তৃণমূল শিবিরে শুরু হয় বিজয় উৎসব। অন্যদিকে, ভোটের ফলাফল ঘোষণার পরই ক্ষোভে রীতিমতো ফেটে পড়েন বিজেপি প্রার্থী প্রিয়াঙ্কা টিবরেওয়াল। তিনি হতাশ। তার বিস্ফোরক অভিযোগ, ‘সব ওয়ার্ডে রিগিং হয়েছে।’ হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা থেকেও তিনি যে লিড পাননি, সেটাও চেপে রাখেননি তিনি। ফল ঘোষণার পরই সংবাদ মাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে প্রিয়াঙ্কা বলেন, ‘ভোটের দিন কীভাবে রিগিং করতে হয় সেটা আপনাদের মাধ্যমেই দেখেছি। তাই ওদের রিগিং করে, ছাপ্পা ভোট মেরে জেতার জন্য শুভেচ্ছা জানাই।’ কোথায় কোথায় রিগিং হয়েছে? প্রশ্ন করায় প্রিয়াঙ্কা বলেন, ‘সবকটা ওয়ার্ডেই রিগিং ও ছাপ্পা ভোট পড়েছে।’ কিন্তু একটা বাচ্চা মেয়েকে হারাতে যেভাবে দিদি পুরো মন্ত্রিসভাসহ রাজ্য প্রশাসন, পুরো পুলিশ প্রশাসন ও নিজস্ব ক্যাডার ব্যবহার করেছেন তার জন্য আমি খুব খুশি।

প্রসঙ্গত, এর আগেও দুইবার ভবানীপুরের এই আসন থেকে জিতেছিলেন মমতা। এ বছরের বিধানসভা নির্বাচনে আসনটি শোভনদেব চট্টপাধ্যায়কে ছেড়ে নিজে দাঁড়িয়েছিলেন পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রাম আসনে। তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতার পর সেখানে তিনি হেরে যান এক সময় তারই ডেপুটি শুভেন্দু অধিকারীর কাছে। মমতা হারলেও তৃণমূলই সরকার গড়ে, মমতাকে তৃতীয়বারের মতো মুখ্যমন্ত্রীও বানায়। ভারতের নিয়ম অনুযায়ী কেউ হেরে যাওয়ার পরও তার দল যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় এবং দলের নির্বাচিত সদস্যরা যদি তাকে নেতা নির্বাচিত করেন, তাহলে তার মুখ্যমন্ত্রী হতে আইনগত কোন বাধা নেই। তবে ভোটে না জিতেও মুখ্যমন্ত্রী হলে তাকে ওই পদে বসার ১৮০ দিনের মধ্যে কোন একটি আসন থেকে জিতে আসতে হবে। তা না পারলে ছেড়ে দিতে হবে পদ। মমতাকে জিতিয়ে আনতে শোভনদেব পরে ভবানীপুরের আসন থেকে পদত্যাগ করে নেত্রীর জন্য পথ খুলে দেন।

ভবানীপুরে এতদিন যা বিজেপির শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল, সেখানেই এবার হানা দিল তৃণমূল। ৮টি ওয়ার্ডের বিচিত্র এই বিধানসভা কেন্দ্রে ৭০ নম্বর ওয়ার্ডে গণনার শেষে দেখা যায়, সেখান থেকে ১৫৫৬ ভোটের ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ৭০ নম্বর ওয়ার্ডের এই ফলাফল বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ কারণ, এই ওয়ার্ড পুরোপুরি অবাঙালি অধ্যুষিত। তাই ভবানীপুর বিধানসভা কেন্দ্রকে বলা হয় ‘মিনি ভারতবর্ষ’। কারণ, গোটা ভারতে যে ধরনের ভাষাভাষি মানুষদের বসবাসের বৈচিত্র দেখা যায়, ঠিক একই ধরনের বৈচিত্র রয়েছে ভবানীপুরেও। এখানে বাঙালি হিন্দু ভোটারদের হার ৪২ শতাংশ। অবাঙালি হিন্দু রয়েছেন ৩৪ শতাংশ। সংখ্যালঘু মুসলিম ভোটার হার ২৪ শতাংশ।

বিজেপিকে বড় ধাক্কা দিয়েছে ভবানীপুরের ৬৩ নম্বর, ৭৪ নম্বর ও ৭১ নম্বর ওয়ার্ড। ৬৩ নম্বর ওয়ার্ডে অবাঙালি আধিপত্য বেশি। মোট ভোটারদের মধ্যে ৫০ শতাংশ এই ওয়ার্ডে অবাঙালি। ২০১৪ সাল থেকে মাত্র একবার ৭৪ নম্বর ওয়ার্ডে লিড নিতে পেরেছিল বিজেপি। সেটা ২০১৬ সালে। তার পর যতবার ভোট হয়েছে, ততবার বিজেপিই এগিয়ে থেকেছে। কিন্তু এবার সেই ট্রেন্ড উল্টে গেল। ভবানীপুরের ৭১ নম্বর ওয়ার্ডে লোকসভা ভোটে বিজেপি এগিয়ে থাকত। কিন্তু সেখানেও এবার লিড নিয়েছেন মমতা। অর্থাৎ যে কেন্দ্রগুলো ঘিরে বিজেপি জয়ের আশা করেছিল, সেই ওয়ার্ডগুলোই গেরুয়া শিবিরকে ধাক্কা দিয়েছে ব্যাপকভাবে। ভবানীপুরে ভোটের অবস্থা এই হবে সে ব্যাপারে রাজনৈতিক মহলও বুঝতে পারেনি।

মমতা যে এই উপনির্বাচনে জিতবেন তা ভেবেছিলেন রাজ্য রাজনীতিবিদরা। কিন্তু বিরাট ব্যবধানে বিজেপি ও সিপিএম কার্যত মুখ থুবড়ে পড়বে মমতা ম্যাজিকের সামনে তা বুঝতে পারেননি, এমনটাই বলেছেন কলকাতা বিশ্ববিধ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রফেসর বিশ্বাস। তিনি বলেন, ভোটপরবর্তী হিংসা মামলায় সাফল্য পাবার পর দাপুটে আইনজীবী তথা মহিলা মুখ প্রিয়াঙ্কা টিব্রেওয়ালের ওপর ভরসা রেখেছিল বিজেপি। আট বছরের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রিয়াঙ্কা জোরদার লড়ার চেষ্টা করেছিলেন এ কথা সত্যি; তবে সে লড়াই একেবারেই কাজে এল না।

বিশাল জয়ের পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভবানীপুরবাসীকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘ভবানীপুর বিজেপিকে জব্দ করেছে। ভবানীপুর আমাকে আরও কাজ করার প্রেরণা জুগিয়েছে। আমি চিরঋণী। ভবানীপুরের সব মা-ভাই-বোনদের কাছে। ভবানীপুরে উপনির্বাচনে এবার ১ লাখ ১৫ হাজারের মতো ভোট পড়েছিল। সেই তুলনায় সামশেরগঞ্জ ও জঙ্গিপুরে ভোট পড়েছিল অনেক বেশি। ২০১১ সালে আমি ভবানীপুরে ৫৪ হাজার ভোটে জিতেছিলাম। গত বিধানসভা নির্বাচনে ভবানীপুরে শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় ২৮ হাজার ভোটে জিতেছিলেন। এবার আমরা ৫৮ হাজারের বেশি ভোটে জিতেছি। ভবানীপুরবাসীকে অভিনন্দন। ভবানীপুর বিধানসভার অন্তর্গত কোন ওয়ার্ডে এবার হারিনি।

মমতা ব্যানার্জি আরও বলেন, ‘পূজার পরই শান্তিপুর, খড়দহ, গোসাবা, দিনহাটায় উপনির্বাচন রয়েছে। শান্তিপুরে তৃণমূল প্রার্থী হচ্ছেন ব্রজকিশোর গোস্বামী। দিনহাটায় তৃণমূল প্রার্থী হচ্ছেন উদয়ন গুহ। খড়দহে তৃণমূল প্রার্থী হচ্ছেন শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। গোসাবার জন্য দুটি নাম ভাবা হয়েছে এখনও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি কাকে প্রার্থী করা হবে। ৩০ অক্টোবর ওই চারটি কেন্দ্রে উপনির্বাচন হবে। বিজেপির এই উপনির্বাচনে এই খারাপ রেজাল্ট করার পেছেনে অনেকগুলো ফ্যাক্টর কাজ করেছে। তার মধ্যে বাঙালি-অবাঙালি হিন্দু, মুসলিম সংখ্যালঘুর মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করাটাই ছিল মূল, এমনটাই বলেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক অরিন্দম সিনহা রায়। বিধান সভা ভোটের আগেও বিজেপিকে বাঙালিবিরোধী ও বহিরাগত এবং সংখ্যালঘুদের কাছে সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধ দল হিসেবে প্রচার করে আসছে তৃণমূল।

বিজেপি আস্তে আস্তে পিছিয়ে যায়। তারা বাঙালি-আবাঙালি-সংখ্যালঘু তথা সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদী দল, এই বিষয়টিকে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের মাঝে বুঝাতে পারেনি। তারা বাঙালিবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক দল হিসেবে যতটা না, তার চেয়ে বেশি তাদের বাঙালিবিরোধী দল বলে গুরুত্ব দিয়ে প্রচারণা চালিয়ে তৃণমূল বিজেপিকে কোণঠাসা করেছে। বিজেপির পশ্চিমবঙ্গের নেতৃত্ব তারা যে বাঙালিবিরোধী নয়, এই বিষয়টিকে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যর্থ হয়েছে।

বিশ্লেষক অরিন্দম বলেন, বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কিছু ভুল সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার কারণে রাজ্য বিজেপির অন্দরে অসন্তোষ কাজ করে। তিনি উল্লেখ করেছেন, এই উপনির্বাচনের সন্ধিক্ষণে রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষকে সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে সেখানে উত্তরাঞ্চলের সাংসদ ড. সুকান্ত মজুমদারকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আরিন্দম সিনহার মতে, পরিবর্তন দলের প্রয়োজনে হতে পারে কিন্তু নির্বাচন সমগতকালীন কেন করা হলো বোধগম্য নয়। দিলীপ ঘোষ একটানা সাত বছর দলটিকে বাংলায় একটি ভালো পর্যায়ে এনে দিয়েছেন। দুই থেকে ১৮ সাংসদ ও তিন থেকে ৭৭ বিধায়ক হওয়াটা তার নেতৃত্বে হয়েছে। তৃণমূলের কাছে দিলীপ ঘোষের নেতৃত্বের গুরুত্ব ছিল। ভবানীপুরে বাঙালি আবালীর কাছেও বিষয়টি রেখাপাত করেছে।

এ ব্যাপারে বিজেপি সভাপতি ড. সুকান্ত মজুমদার বলেন, নির্বাচনে সাফল্যের আশা নিয়ে লড়তে হয়। কিন্তু ক্রমাগত মিথ্যাচার করে তৃণমূল বিজেপিকে বাংলায় বঙালিবিরোধী ও সাম্প্রদায়ক দল হিসেবে বলে বাংলাকে সর্বনাশের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আমরা এই পরাজয়ের ব্যাপারটি সম্মিলিতভাবে বিশ্লেষণ করবো।

সুকান্ত মজুমদার বলেন, আমরা বাঙালি-অবাঙালি, বিহারী-হিন্দুস্তানি বা মুসলিম সংখ্যালঘু এই ধরনের উগ্রপ্রাদেশিকতাবাদে বিশ্বাস করি না। আমরা মনে করি ভারত সবার। বাংলা যতখানি বাঙালির ততখানিই কয়েকশ বছর ধরে এখানে বসবাসকারী অন্য প্রদেশ বা রাজ্যের মানুষের। আবার গুজরাট যতটা গুজরাটির ততোটাই বাঙালির। গোয়া যতটা গোয়ানিজের ততোটাই বাঙালির। বাংলায় কেউ এলে তাদের বহিরাগত তকমা দেয়া হয় তৃণমূলী প্রচারে। এমনকি আমাদের ভবানীপুরের প্রার্থী প্রিয়াঙ্কা টিব্রেয়ালকেও বহিরাগত বলে প্রচার করেছে তৃণমূল। অথচ তার জন্ম ভবানীপুরেই। মমতা যেমন ভবানীপুরের মেয়ে তেমনি প্রিয়াঙ্কাও ভবানীপুরের ঘরের মেয়ে।