নজরুল সঙ্গীতবিষয়ক ধারাবাহিক রচনা : ০৩

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

সম্পা দাস

(পূর্ব প্রকাশের পর)

‘হে পার্থসারথি! বাজাও বাজাও পাঞ্চজন্য শঙ্খ”

‘হে পার্থসারথি! বাজাও বাজাও পাঞ্চজন্য শঙ্খ/চিত্তের অবসাদ দূর কর কর দূর/ ভয়-ভীত জনে কর হে নিঃশঙ্খ’- পরাধীন ভারতবর্ষের মুক্তিকামী মানুষের অধিকার আদায়ের প্রশ্নে কাজী নজরুল ইসলাম এ গানটি রচনা করেন। আপন শক্তিকে উজ্জীবিত করার দৃপ্ত আহ্বান গানটিতে। মহাভারতের শ্রীকৃষ্ণকে তিনি গানটিতে প্রতীক ব্যঞ্জনায় উপস্থাপন করেন। উপনিবেশ-শৃঙ্খলিত প্রথম বিশ^যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে পরাধীনতার গ্লানি থেকে ভারতবর্ষের অধঃপতিত, হতাশাগ্রস্ত, ঝিমিয়ে পড়া, নিপীড়িত মানুষের পূর্ণ মুক্তির লক্ষ্যে কাব্য ও সংগীতে তিনি মিথ ও মিথিক চরিত্রগুলো দৃঢ়ভাবে উপস্থাপন করেন। কারণ, তিনি জানতেন, এ অঞ্চলের মানুষের চিন্তা ও জীবনাচরনে ধর্মীয় প্রভাব ব্যাপক। তাই, বিশেষত মানবশক্তিকে জাগরণের প্রয়াসে ধর্মীয় বিভিন্ন চরিত্রগুলোকে তিনি কখনও উপমা, প্রতীক, রূপক সমসোক্তি ইত্যাদি নানা ব্যঞ্জনায় উপস্থাপন করেন। লক্ষ্যণীয়, এক নটরাজ শিবকেই নানারূপে তিনি নানাবিধ নামে উপস্থাপন করেন। রুদ্র, ভৈরব, দিগম্বর, ধূর্জটি, ব্যোমকেশ, পিনাকী, ত্রিশুলী, শিব মহেশ, শঙ্কর ইত্যাদি- কখনও কাব্যে কখনো বা সংগীতে। তাই বলা যায় Myth is made of cognition, a system of thought, a way of life [Richard chase, notes of the study of myth] ‘বিদ্রোহী’ কবিতায়ও তিনি পুরাণ ও পৌরাণিক চরিত্রগুলোর ব্যবহার করেছেন মানুষের চৈতন্যকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য। তিন দৃঢ়ভাবে বিশ^াস করতেন, মানুষ অসীম ক্ষতির অধিকারী এবং প্রতিটি মানুষের ভেতরেই সুপ্ত ক্ষমতা রয়েছে। প্রয়োজন শুধু সেটিকে জাগানো। মানুষের চেতনাকে জাগানোর জন্য তিনি তুমুল বিদ্রোহ করেন। ব্রিটিশ শাসকদের তিনি সর্বপ্রাণ দিয়ে ঘৃণা করতেন। তিনি এই শাসকদের অসুরের সাথে প্রতিতুলনায় দেশামাতৃকাকে রক্ষার প্রয়াসে কখনও হিন্দু পুরাণের আশ্রয় নিয়েছেন কখনও বা ইসলাম ধর্মীয় মিথগুলোর ব্যবহার করেছেন। ‘কারো মনে তুমি দিও না আঘাত লাগে কাবার গায়ে’, ‘মোহাম্মাদের নাম জপেছিলি বুলবুলি তুই আগে’, ‘আমার শ্যামা মায়ের কোলে চড়ে জপি আমি শ্যামের নাম’, ‘আয় মা উমা রাখব এবার ছেলের সাজে’, ‘আমার হাতে কালি মুখে কালি মা’- ইত্যাদি অসংখ্য সংগীত। তাঁর এ জাতীয় ধর্মভিত্তিক গানগুলো মানুষের ধর্মবিশ^াস, রাজনৈতিক আদর্শ, ব্যক্তিজীবন, শিল্পবোধ এসব কিছু ছাড়িয়ে শাশ^ত এক সত্যকে তুলে ধরে। সুরের আঁধারে নানা ভাবাবেগ সৃষ্টি হয় বলেই এ গানগুলো শ্রোতাকে ব্যাকুল করে, পরমতম তৃপ্তি দেয়। ভাবের ধ্যানে নিবিষ্ট হয়ে শাশ^ত সত্য ও সুন্দর প্রকাশিত বলেই এ গানগুলো সব সময়েই প্রাসঙ্গিক।

নজরুল চৈতন্যে মিথ কেবলই প্রতিবাদের অর্থেই নয়, দ্রোহ, ক্ষোভ, প্রেমাকাক্সক্ষা, অচরিতার্থ বেদনার নানামাত্রিক প্রকাশে- কখনও রূপক, প্রতীক, সমাসোক্তি ইত্যাদি অলংকারের ব্যবহাহের মধ্যে দিয়ে কখনও বা আত্মআবিষ্কারের প্রশ্নেও ব্যবহার করেন। তিনি কেবল ভারতীয় মিথ-পুরাণই নয়, মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসপুঞ্জ, সর্বোপরি তিনি বিশ^মিথ সাহিত্য জগতেও প্রবেশ করেন। তাই বলা যায়, নজরুলের সৃষ্টিতে মিথ সাহিত্য এক অনন্য জায়গা দখল করে আছে এবং এভাবেই তাঁর মিথ সাহিত্য ও সংগীতে আন্তর্জাতিক সাহিত্যের মর্যাদায় অংশীভূত হয়। এখানেও তাঁর চৈতন্যের দ্বৈত-অদ্বৈত সত্তার স্ফুরণ ঘটে।

রুশ বিপ্লবের আদর্শ নজরুলের অধ্যাত্মজগতে বিরাট প্রভাব ফেলে এবং বলা যায়, এর প্রভাব তাঁর সৃষ্টিশীলতায় নবমাত্রা প্রদান করে। তিনি অনুধাবন করেছিলেন, এই অঞ্চলের মানুষের জীবনে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হলো ধর্মীয় বিদ্বেষ। যদি হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সমঝোতা আনা যায়, তাদের ঐক্যভুক্ত করা যায় তবেই ব্রিটিশদের মোকাবেলা সম্ভব। এ প্রেক্ষাপটেই ধর্মীয় সংকীর্ণতাকে উপরে ফেলা তৎস্থলে মানবতাকে প্রতিষ্ঠিত করা- এটাই ছিল তাঁর অন্যতম মিশন। তাঁর সংগীতে ধর্মীয় বিভিন্ন মিথ ও মিথিক চরিত্রগুলোকে নানামাত্রিকভাবে উপস্থাপন করেন। ধর্মীয় উপাখ্যান, কিংবদন্তি, দেব-দেবীর চরিত্র, ঐতিহাসিক ব্যক্তি, নবী-রসুল এবং মহাপুরুষদের জীবন নজরুলের হাতে মানবভাগ্যের নিয়ন্ত্রণ শক্তি হিসেবে চিহ্নিত হতে শুরু করে। ধর্ম, মানবতা ও

স্বদেশিকতা সমর্থক ব্যঞ্জনায় ভাস্কর হয়ে ওঠে। তাঁর দর্শন ও টলস্টয়ের দর্শন একেবারেই কাছাকাছি হয়ে উঠে- Art, all art has characteristic that unites people’টলস্টয় মানব ঐক্যের মাঝে সকল শিল্পের প্রাণসত্তা খুঁজেছেন- নজরুল যেন তাঁরই বাস্তব রূপদান করেন। তাঁর সংগীতে ধর্ম হচ্ছে- মানবতার বিকাশ, আদর্শের প্রতিষ্ঠা, ঈশ^রের অবস্থান মানব অস্তিত্বে- এভাবেই তিনি সর্বমানবতার জয়গান করেছেন।

এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন মন্দির নাই এবং

সৃষ্টি রয়েছে তোমা পানে চেয়ে তুমি আছ চোখ বুজে

¯্রষ্টারে খোঁজ- আপনারে তুমি আপনি ফিরেছ খুঁজে

ইচ্ছা অন্ধ। আখি খোল, দেখ দর্পণে নিজ কায়া

দেখিবে তোমারি সব অবয়বে পড়েছে তাহার ছায়া।

‘হে পার্থসারথি! বাজাও বাজাও পাঞ্চজন্য শঙ্খ’- গানটিতে শ্রীকৃষ্ণ পার্থসারথি হয়ে ভগবানের প্রতীক রূপে তার সমস্ত শক্তি সামর্থ্য দিয়ে মানবজাতিকে পথ নির্দেশনা দেবার কথা বলেছেন। শ্রীকৃষ্ণের শঙ্খধ্বনি শুনে যেন মানবচিত্তের সকল অবসাদ ভয়ভীতি দূর হয়ে যায় এবং মানুষ যেন নিঃশঙ্কচিত্ত হয় এই অভিপ্রায় গানটির শরীর জুড়ে। মানুষের ভেতরে একান্তভাবে যদি দেশপ্রেম না থাকে, ভেতরটুকু যদি মুক্ত না হয়, সংস্কারবদ্ধ হয় অর্থাৎ তিনি বলতে চেয়েছেন প্রকৃত দেশপ্রেমের বোধটি যদি ব্যক্তির ভেতরে স্বতঃস্ফূর্তভাবে না আসে, সবাই যদি দেশকে রক্ষায় এক না হয়, তাহলে কখনোই পরাধীনতা থেকে দেশকে মুক্ত করা সম্ভব নয়। নজরুল তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে দেশপ্রেমের বন্দনা করেছেন।

‘হে পার্থসারথি! বাজাও বাজাও পাঞ্চজন্য শঙ্খ’- গানটিতে কাব্যমিশ্রিত কথা ও প্রতিতুলনাজাত অলঙ্কারের ব্যবহার গানটিকে এক অনন্য চিত্রকল্প সমৃদ্ধ সংগীত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। নজরুল কাহারবা তালে ও ‘শিবরঞ্জনী’ রাগের মিশ্রণে এ গানটি রচনা করেন। ‘শিবরঞ্জনী’ রাগের গাম্ভীর্য এ গানটির সুরের আবহ নির্মাণে সাহায্য করে। শিবরঞ্জনী রাগের স্বরূপ এটি তেজোদীপ্ত, হুঙ্কার, শান্ত ও দৃঢ় প্রকৃতির। গানটিতে শিবরঞ্জনী রাগ শুদ্ধভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। বলা যায়, অন্য কোন রাগের মিশ্রণ নজরুল এখানে ঘটাননি। গানের প্রকৃত ভাব বা মুড আনয়নের জন্য যেখানে যতটুকু সুরের আবেশ আনার প্রয়োজন বোধ করেন তিনি সেখানে ততটুকু যুক্ত করেন। তবে সংগীতের সুর নির্মাণে তাঁর নিরীক্ষা প্রায় সকল গানেই পাওয়া যায় যা তাঁকে নিশ্চিতভাবে স্বাতন্ত্র্যম-িত করে।

‘হে পার্থসারথি! বাজাও বাজাও পাঞ্চজন্য শঙ্খ’- গানটিতে নজরুল শব্দের পর শব্দ বসিয়ে দেশমাতার মুক্তির এক মহাচিত্রকল্প রচনা করেন- যা সুন্দর ও সাবলাইম। গানটির শেষ দিকে ‘মৃত্যে জীবনের শেষ নহে/ শোনাও শোনাও অনন্তকাল ধরি/অনন্তজীবন প্রবাহ বহে’- অনন্ত জীবনের দার্শনিক কথা এখানে তিনি বলেন। তাঁর আহ্বান-জীবন সংক্ষিপ্ত ও ক্ষুদ্র। এ জীবনকে বলিদান করতে হবে অনন্ত জীবনের অংশীদার হবার জন্য- এ প্রত্যয় গানটিতে। দুর্দমনীয় চঞ্চল যৌবন মায়ের আঁচল ছাড়িয়ে বীর বেশে মাতৃভূমিকে সাজাবার বাসনা এ গানটিতে।

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন, সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন, ওয়াহাবী আন্দোলন, খিলাফত আন্দোলন, প্রথম বিশ^যুদ্ধ-সময়ের যন্ত্রণাকে কবি চৈতন্যে ধারণ করেন। ‘মোর এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ-তুর্য- এই মন্ত্র নিয়ে ‘অগ্নিবীণায়’ আবির্ভাব হলেও তাঁর চৈতন্যজুড়ে ছিল গভীর দেশপ্রেম ও মানবপ্রেম- ‘অসহায় জাতি মরিয়া ডুবিয়া জানে না সন্তরণ/কা-ারী! আজ দেখিবো তোমার মাতৃমুক্তিপণ।’ বলা যায়, দেশপ্রেমের এই নিদর্শন তাঁর সৃষ্টিকে বিস্ময়কর জায়গায় পৌঁছে দেয়।

(চলবে)

বৃহস্পতিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২২ , ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪২৯, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৪

নজরুল সঙ্গীতবিষয়ক ধারাবাহিক রচনা : ০৩

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

সম্পা দাস

image

(পূর্ব প্রকাশের পর)

‘হে পার্থসারথি! বাজাও বাজাও পাঞ্চজন্য শঙ্খ”

‘হে পার্থসারথি! বাজাও বাজাও পাঞ্চজন্য শঙ্খ/চিত্তের অবসাদ দূর কর কর দূর/ ভয়-ভীত জনে কর হে নিঃশঙ্খ’- পরাধীন ভারতবর্ষের মুক্তিকামী মানুষের অধিকার আদায়ের প্রশ্নে কাজী নজরুল ইসলাম এ গানটি রচনা করেন। আপন শক্তিকে উজ্জীবিত করার দৃপ্ত আহ্বান গানটিতে। মহাভারতের শ্রীকৃষ্ণকে তিনি গানটিতে প্রতীক ব্যঞ্জনায় উপস্থাপন করেন। উপনিবেশ-শৃঙ্খলিত প্রথম বিশ^যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে পরাধীনতার গ্লানি থেকে ভারতবর্ষের অধঃপতিত, হতাশাগ্রস্ত, ঝিমিয়ে পড়া, নিপীড়িত মানুষের পূর্ণ মুক্তির লক্ষ্যে কাব্য ও সংগীতে তিনি মিথ ও মিথিক চরিত্রগুলো দৃঢ়ভাবে উপস্থাপন করেন। কারণ, তিনি জানতেন, এ অঞ্চলের মানুষের চিন্তা ও জীবনাচরনে ধর্মীয় প্রভাব ব্যাপক। তাই, বিশেষত মানবশক্তিকে জাগরণের প্রয়াসে ধর্মীয় বিভিন্ন চরিত্রগুলোকে তিনি কখনও উপমা, প্রতীক, রূপক সমসোক্তি ইত্যাদি নানা ব্যঞ্জনায় উপস্থাপন করেন। লক্ষ্যণীয়, এক নটরাজ শিবকেই নানারূপে তিনি নানাবিধ নামে উপস্থাপন করেন। রুদ্র, ভৈরব, দিগম্বর, ধূর্জটি, ব্যোমকেশ, পিনাকী, ত্রিশুলী, শিব মহেশ, শঙ্কর ইত্যাদি- কখনও কাব্যে কখনো বা সংগীতে। তাই বলা যায় Myth is made of cognition, a system of thought, a way of life [Richard chase, notes of the study of myth] ‘বিদ্রোহী’ কবিতায়ও তিনি পুরাণ ও পৌরাণিক চরিত্রগুলোর ব্যবহার করেছেন মানুষের চৈতন্যকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য। তিন দৃঢ়ভাবে বিশ^াস করতেন, মানুষ অসীম ক্ষতির অধিকারী এবং প্রতিটি মানুষের ভেতরেই সুপ্ত ক্ষমতা রয়েছে। প্রয়োজন শুধু সেটিকে জাগানো। মানুষের চেতনাকে জাগানোর জন্য তিনি তুমুল বিদ্রোহ করেন। ব্রিটিশ শাসকদের তিনি সর্বপ্রাণ দিয়ে ঘৃণা করতেন। তিনি এই শাসকদের অসুরের সাথে প্রতিতুলনায় দেশামাতৃকাকে রক্ষার প্রয়াসে কখনও হিন্দু পুরাণের আশ্রয় নিয়েছেন কখনও বা ইসলাম ধর্মীয় মিথগুলোর ব্যবহার করেছেন। ‘কারো মনে তুমি দিও না আঘাত লাগে কাবার গায়ে’, ‘মোহাম্মাদের নাম জপেছিলি বুলবুলি তুই আগে’, ‘আমার শ্যামা মায়ের কোলে চড়ে জপি আমি শ্যামের নাম’, ‘আয় মা উমা রাখব এবার ছেলের সাজে’, ‘আমার হাতে কালি মুখে কালি মা’- ইত্যাদি অসংখ্য সংগীত। তাঁর এ জাতীয় ধর্মভিত্তিক গানগুলো মানুষের ধর্মবিশ^াস, রাজনৈতিক আদর্শ, ব্যক্তিজীবন, শিল্পবোধ এসব কিছু ছাড়িয়ে শাশ^ত এক সত্যকে তুলে ধরে। সুরের আঁধারে নানা ভাবাবেগ সৃষ্টি হয় বলেই এ গানগুলো শ্রোতাকে ব্যাকুল করে, পরমতম তৃপ্তি দেয়। ভাবের ধ্যানে নিবিষ্ট হয়ে শাশ^ত সত্য ও সুন্দর প্রকাশিত বলেই এ গানগুলো সব সময়েই প্রাসঙ্গিক।

নজরুল চৈতন্যে মিথ কেবলই প্রতিবাদের অর্থেই নয়, দ্রোহ, ক্ষোভ, প্রেমাকাক্সক্ষা, অচরিতার্থ বেদনার নানামাত্রিক প্রকাশে- কখনও রূপক, প্রতীক, সমাসোক্তি ইত্যাদি অলংকারের ব্যবহাহের মধ্যে দিয়ে কখনও বা আত্মআবিষ্কারের প্রশ্নেও ব্যবহার করেন। তিনি কেবল ভারতীয় মিথ-পুরাণই নয়, মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসপুঞ্জ, সর্বোপরি তিনি বিশ^মিথ সাহিত্য জগতেও প্রবেশ করেন। তাই বলা যায়, নজরুলের সৃষ্টিতে মিথ সাহিত্য এক অনন্য জায়গা দখল করে আছে এবং এভাবেই তাঁর মিথ সাহিত্য ও সংগীতে আন্তর্জাতিক সাহিত্যের মর্যাদায় অংশীভূত হয়। এখানেও তাঁর চৈতন্যের দ্বৈত-অদ্বৈত সত্তার স্ফুরণ ঘটে।

রুশ বিপ্লবের আদর্শ নজরুলের অধ্যাত্মজগতে বিরাট প্রভাব ফেলে এবং বলা যায়, এর প্রভাব তাঁর সৃষ্টিশীলতায় নবমাত্রা প্রদান করে। তিনি অনুধাবন করেছিলেন, এই অঞ্চলের মানুষের জীবনে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হলো ধর্মীয় বিদ্বেষ। যদি হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সমঝোতা আনা যায়, তাদের ঐক্যভুক্ত করা যায় তবেই ব্রিটিশদের মোকাবেলা সম্ভব। এ প্রেক্ষাপটেই ধর্মীয় সংকীর্ণতাকে উপরে ফেলা তৎস্থলে মানবতাকে প্রতিষ্ঠিত করা- এটাই ছিল তাঁর অন্যতম মিশন। তাঁর সংগীতে ধর্মীয় বিভিন্ন মিথ ও মিথিক চরিত্রগুলোকে নানামাত্রিকভাবে উপস্থাপন করেন। ধর্মীয় উপাখ্যান, কিংবদন্তি, দেব-দেবীর চরিত্র, ঐতিহাসিক ব্যক্তি, নবী-রসুল এবং মহাপুরুষদের জীবন নজরুলের হাতে মানবভাগ্যের নিয়ন্ত্রণ শক্তি হিসেবে চিহ্নিত হতে শুরু করে। ধর্ম, মানবতা ও

স্বদেশিকতা সমর্থক ব্যঞ্জনায় ভাস্কর হয়ে ওঠে। তাঁর দর্শন ও টলস্টয়ের দর্শন একেবারেই কাছাকাছি হয়ে উঠে- Art, all art has characteristic that unites people’টলস্টয় মানব ঐক্যের মাঝে সকল শিল্পের প্রাণসত্তা খুঁজেছেন- নজরুল যেন তাঁরই বাস্তব রূপদান করেন। তাঁর সংগীতে ধর্ম হচ্ছে- মানবতার বিকাশ, আদর্শের প্রতিষ্ঠা, ঈশ^রের অবস্থান মানব অস্তিত্বে- এভাবেই তিনি সর্বমানবতার জয়গান করেছেন।

এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন মন্দির নাই এবং

সৃষ্টি রয়েছে তোমা পানে চেয়ে তুমি আছ চোখ বুজে

¯্রষ্টারে খোঁজ- আপনারে তুমি আপনি ফিরেছ খুঁজে

ইচ্ছা অন্ধ। আখি খোল, দেখ দর্পণে নিজ কায়া

দেখিবে তোমারি সব অবয়বে পড়েছে তাহার ছায়া।

‘হে পার্থসারথি! বাজাও বাজাও পাঞ্চজন্য শঙ্খ’- গানটিতে শ্রীকৃষ্ণ পার্থসারথি হয়ে ভগবানের প্রতীক রূপে তার সমস্ত শক্তি সামর্থ্য দিয়ে মানবজাতিকে পথ নির্দেশনা দেবার কথা বলেছেন। শ্রীকৃষ্ণের শঙ্খধ্বনি শুনে যেন মানবচিত্তের সকল অবসাদ ভয়ভীতি দূর হয়ে যায় এবং মানুষ যেন নিঃশঙ্কচিত্ত হয় এই অভিপ্রায় গানটির শরীর জুড়ে। মানুষের ভেতরে একান্তভাবে যদি দেশপ্রেম না থাকে, ভেতরটুকু যদি মুক্ত না হয়, সংস্কারবদ্ধ হয় অর্থাৎ তিনি বলতে চেয়েছেন প্রকৃত দেশপ্রেমের বোধটি যদি ব্যক্তির ভেতরে স্বতঃস্ফূর্তভাবে না আসে, সবাই যদি দেশকে রক্ষায় এক না হয়, তাহলে কখনোই পরাধীনতা থেকে দেশকে মুক্ত করা সম্ভব নয়। নজরুল তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে দেশপ্রেমের বন্দনা করেছেন।

‘হে পার্থসারথি! বাজাও বাজাও পাঞ্চজন্য শঙ্খ’- গানটিতে কাব্যমিশ্রিত কথা ও প্রতিতুলনাজাত অলঙ্কারের ব্যবহার গানটিকে এক অনন্য চিত্রকল্প সমৃদ্ধ সংগীত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। নজরুল কাহারবা তালে ও ‘শিবরঞ্জনী’ রাগের মিশ্রণে এ গানটি রচনা করেন। ‘শিবরঞ্জনী’ রাগের গাম্ভীর্য এ গানটির সুরের আবহ নির্মাণে সাহায্য করে। শিবরঞ্জনী রাগের স্বরূপ এটি তেজোদীপ্ত, হুঙ্কার, শান্ত ও দৃঢ় প্রকৃতির। গানটিতে শিবরঞ্জনী রাগ শুদ্ধভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। বলা যায়, অন্য কোন রাগের মিশ্রণ নজরুল এখানে ঘটাননি। গানের প্রকৃত ভাব বা মুড আনয়নের জন্য যেখানে যতটুকু সুরের আবেশ আনার প্রয়োজন বোধ করেন তিনি সেখানে ততটুকু যুক্ত করেন। তবে সংগীতের সুর নির্মাণে তাঁর নিরীক্ষা প্রায় সকল গানেই পাওয়া যায় যা তাঁকে নিশ্চিতভাবে স্বাতন্ত্র্যম-িত করে।

‘হে পার্থসারথি! বাজাও বাজাও পাঞ্চজন্য শঙ্খ’- গানটিতে নজরুল শব্দের পর শব্দ বসিয়ে দেশমাতার মুক্তির এক মহাচিত্রকল্প রচনা করেন- যা সুন্দর ও সাবলাইম। গানটির শেষ দিকে ‘মৃত্যে জীবনের শেষ নহে/ শোনাও শোনাও অনন্তকাল ধরি/অনন্তজীবন প্রবাহ বহে’- অনন্ত জীবনের দার্শনিক কথা এখানে তিনি বলেন। তাঁর আহ্বান-জীবন সংক্ষিপ্ত ও ক্ষুদ্র। এ জীবনকে বলিদান করতে হবে অনন্ত জীবনের অংশীদার হবার জন্য- এ প্রত্যয় গানটিতে। দুর্দমনীয় চঞ্চল যৌবন মায়ের আঁচল ছাড়িয়ে বীর বেশে মাতৃভূমিকে সাজাবার বাসনা এ গানটিতে।

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন, সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন, ওয়াহাবী আন্দোলন, খিলাফত আন্দোলন, প্রথম বিশ^যুদ্ধ-সময়ের যন্ত্রণাকে কবি চৈতন্যে ধারণ করেন। ‘মোর এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ-তুর্য- এই মন্ত্র নিয়ে ‘অগ্নিবীণায়’ আবির্ভাব হলেও তাঁর চৈতন্যজুড়ে ছিল গভীর দেশপ্রেম ও মানবপ্রেম- ‘অসহায় জাতি মরিয়া ডুবিয়া জানে না সন্তরণ/কা-ারী! আজ দেখিবো তোমার মাতৃমুক্তিপণ।’ বলা যায়, দেশপ্রেমের এই নিদর্শন তাঁর সৃষ্টিকে বিস্ময়কর জায়গায় পৌঁছে দেয়।

(চলবে)