পাকিস্তান আমলের সংবাদপত্র

একটি রাজনৈতিক পাঠ

সোহরাব হাসান

ভারতীয় উপমহাদেশে সংবাদপত্র এসেছে রাজনীতির হাত ধরেই। রাজনৈতিক কারণে যেমন বহু পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে, তেমনি রাজনৈতিক কারণে বন্ধও হয়ে গেছে। জেমস আগাস্টাস হিকি ভারতবর্ষে সংবাদপত্রের পথিকৃৎ- তার সম্পাদনায় ১৭৮০ সালের ২৯ জানুয়ারি প্রকাশিত হয় বেঙ্গল গেজেট- দুই পাতার একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক। হিকি ব্রিটিশ নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাঁকে রেহাই দেয়নি। যখনই তিনি কোম্পানির দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার সমালোচনা করলেন তাঁকে জেলে পাঠানো হলো। এরপর সরকার ১৭৯৪ সালে উইলিয়াম দুয়েন নামে আরেক সম্পাদককে গ্রেপ্তার করে এবং জোরপূর্বক জাহাজে করে ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দেয়। ১৮১৮ সালের এপ্রিলে প্রথম বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়- দিগদর্শন। এটি প্রকাশ করেছিল শ্রীরামপুরের ব্যাপটিস্ট মিশন। ১৮১৮ সালেই প্রথম বাঙালি মালিকানাধীন পত্রিকা ‘বেঙ্গল গেজেট’ বের হয়। প্রকাশক গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য। ১৮১৯ সালের ১ মে জেমস সিল বার্মিংহামের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ক্যালকাটা জার্নাল। এই সময়ে যে সম্পাদক ও ভাবুক ফারসি ও বাংলা পত্রিকা প্রকাশ করে আলোড়ন তুলেছিলেন তিনি রাজা রামমোহন রায়; ১৮২১ সালে তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘সংবাদ কৌমুদী।’ আর ১৮২২ সালে ফারসি ভাষায় ‘মিরাতুল আকবর।’ কিন্তু যখন তিনি দেখলেন সরকার ‘সংবাদ কৌমুদী’র কাজে বাধা দিচ্ছে, তখন পত্রিকাটি বন্ধ করে দিলেন। রামমোহন রায় শুধু সমাজ বিপ্লবী ছিলেন না, সাংবাদিক হিসেবেও ছিলেন বিদ্রোহী।

১৮৭৮ সালে ভাইসরয় লর্ড রিটন ভার্নাকুলার প্রেস আইন জারি করেন, যার মূলকথা ছিল দেশীয় ভাষায় কোনো কিছু ছাপা হলে তা সরকারের নিযুক্ত লোকজনকে দেখাতে হবে। ইংরেজিতে প্রকাশিত পত্রিকার ক্ষেত্রে এই নিয়ন্ত্রণ ছিল না। অমৃত বাজার পত্রিকা বের হতো বাংলায়। নতুন আইন জারির পর সম্পাদক শিশির ঘোষ পত্রিকাটি রাতারাতি বাংলা থেকে ইংরেজিতে রূপান্তরিত করলেন। এরপর বাংলা নামেই ইংরেজি ভাষায় পত্রিকাটি প্রকাশ হতে থাকে। ১৮৬৮ সালে অমৃত বাজার যশোরে যাত্রা শুরু করলেও পরে কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়।

অবিভক্ত ভারত, আরও নির্দিষ্ট করে বললে বাংলায় সংবাদপত্রের প্রসার ঘটে ঔপনিবেশিক শাসনবিরোধী ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বাহন হিসেবে। কংগ্রেস নেতা সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি ১৮৭৮ সালে বের করেন ‘বেঙ্গলি’। ১৯২০ সালে কংগ্রেসের সমর্থনে দৈনিক আনন্দবাজার প্রকাশিত হলে পত্রিকাটি দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে। এরপর মুসলিম লীগের সমর্থনে প্রকাশিত হয় ‘স্টার অব ইন্ডিয়া’ ও ‘মর্নিং নিউজ’। গান্ধীর নিজের পত্রিকা ছিল ‘হরিজন’ ও ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’। এসব পত্রিকা নিজ নিজ দলের রাজনৈতিক দর্শন ও নেতার মহিমা প্রচার করত।

কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ সমর্থিত পত্রিকাসমূহ যখন স্বরাজ, স্বায়ত্তশাসন ইত্যাদি নিয়ে শোরগোল তোলে এবং সম্প্রদায়গত স্বার্থরক্ষায় উচ্চকণ্ঠ তখন বাংলায় একটি পত্রিকা সরাসরি স্বাধীনতার আহ্বান নিয়ে আসে। কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত ‘ধূমকেতু’। পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যার সম্পাদকীয়তে বলা হয়:

সর্বপ্রথম, ‘ধূমকেতু’ ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়। স্বরাজ-টরাজ বুঝি না, কেননা, ও-কথাটার মানে এক এক মহারথী এক এক রকম করে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশির অধীন থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা-রক্ষা, শাসনভার, সমস্ত থাকবে ভারতীয়দের হাতে। তাতে কোনো বিদেশির মোড়লি করবার অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না। যাঁরা এখন রাজা বা শাসক হয়ে এদেশে মোড়লি করে দেশকে শ্মশান ভূমিতে পরিণত করছেন, তাঁদের পাততাড়ি গুটিয়ে, বোঁচকা-পুঁটলি বেঁধে সাগর পারে পাড়ি দিতে হবে। প্রার্থনা বা আবেদন নিবেদন করলে তাঁরা শুনবেন না। তাঁদের অতটুকু সুবুদ্ধি হয়নি এখনো। আমাদেরও এই প্রার্থনা করার, ভিক্ষা করার কুবুদ্ধিটুকুকে দূর করতে হবে।

পূর্ণ স্বাধীনতা পেতে হলে সকলের আগে আমাদের বিদ্রোহ করতে হবে, সকল-কিছু নিয়মকানুন বাঁধন-শৃঙ্খল মানা নিষেধের বিরুদ্ধে।’

ধূমকেতুর আগে নজরুলের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় নবযুগ; যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মুজাফফর আহমদও।

অধ্যাপক সাখাওয়াত আলী খান পাকিস্তান-পূর্ব সংবাদপত্রের চরিত্র ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘মুসলিম লীগের নেতা হয়েও মাওলানা আকরম খাঁ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম নিজস্ব ক্ষমতাবলয় তৈরি করতে প্রকাশ করেন যথাক্রমে ‘আজাদ’, ‘ইত্তেহাদ’ ও ‘মিল্লাত’। তিনটি পত্রিকা মুসলিম জাতীয়তাবাদ ও পাকিস্তানের পক্ষে প্রচার করলেও দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য ছিল।’ ইত্তেহাদ ও মিল্লাত দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত আজাদ, পাকিস্তান পর্ব পেরিয়ে বাংলাদেশেও দুই দশকের বেশি সময় চলেছে।

২.

বর্তমানে যে ভূখন্ডটি বাংলাদেশ নামে পরিচিত, তার প্রথম পত্রিকা হলো রঙ্গপুর বার্ত্তা, ১৮৪৭ সালে রংপুর থেকে প্রকাশিত , সম্পাদক গুরুচরণ রায়। ১৮৫৬ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশ পায় ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘ঢাকা নিউজ।’ ঢাকায় প্রকাশিত প্রথম বাংলা পত্রিকার নাম ‘ঢাকা প্রকাশ’। প্রকাশকাল ১৮৬১; সম্পাদক ছিলেন কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার। পত্রিকাটি ছিল ব্রাহ্ম মতের সমর্থক। প্রায় এক শ বছর টিকে ছিল ‘ঢাকা প্রকাশ।’ এ অঞ্চলের আর কোনো পত্রিকা এত দীর্ঘায়ু পায়নি। ১৮৫৬ সালে হিন্দু রক্ষিণী সভার মুখপত্র হিসেবে প্রকাশ পায় ‘হিন্দু হিতৈষিণী’। বাংলাদেশের আরেকটি প্রাচীন পত্রিকা হলো ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’। এটি বের হয় ১৮৬৪ সালে, কুষ্টিয়ার কুমারখালী থেকে, সম্পাদক ছিলেন দরিদ্র স্কুলশিক্ষক হরিনাথ মজুমদার- যিনি কাঙাল হরিনাথ নামে বেশি পরিচিত। ময়মনসিংহ থেকে প্রকাশিত প্রথম পত্রিকার নাম বিজ্ঞাপনী, প্রকাশকাল ১৮৮৬। ১৮৬৮ সালে এপ্রিলে রাজশাহীর বোয়ালিয়া থেকে বের হয় হিন্দু রঞ্জিকা। পরের বছর ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয় অর্ধ সাপ্তাহিক বেঙ্গল টাইমস। ১৮৭০ সালে নেপাল কোডে ‘রাজদ্রোহ নিয়ন্ত্রণ’ ধারা যুক্ত করা হলে সংবাদপত্রের ওপর আরেকটি হুমকি নেমে আসে। এ ধারায় বলা হয়, যে পত্রিকা সরকারের প্রতি অপ্রিয় মনোভাব সৃষ্টি করবে বা দেশবাসীকে সরকারের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করবে সেটিই শাস্তি পাবে এবং তা জরিমানা, জেল ও যাবজ্জীবন কারাদন্ড পর্যন্ত হতে পারে।

১৮৯৮ সালে রাজদ্রোহ আইন সংশোধন করে আইনি ক্ষমতা বাড়ানো হয় এবং আরও দুটি ধারা এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়। তবে সাংবাদিকদের আন্দোলনের কারণে সরকার ১৮৭৭ সালে জারিকৃত ভার্নাকুলার প্রেস আইন প্রত্যাহার করে। এটি ছিল পরাধীন ভারতে সাংবাদিকদের একটি বড় বিজয়।

দেশ বিভাগের আগ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্য-শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং সাংবাদিকতার কেন্দ্র ছিল কলকাতা। ফলে ১৯৪৭-এর আগে প্রায় সব জনপ্রিয় বাংলা পত্রিকা বের হতো কলকাতা থেকে। ১৯৪৭ সালে জুন মাসে চট্টগ্রাম থেকে দৈনিক পূর্ব পাকিস্তান নামে একটি পত্রিকা বের হয়। পাকিস্তান হওয়ার পরও বেশ কিছু দিন আজাদ, ইত্তেহাদ, মিল্লাত ও মর্নিং নিউজ কলকাতা থেকে প্রকাশিত হতো। ১৯৪৮ সালে দৈনিক আজাদ কলকাতা থেকে ঢাকায় স্থানান্তর হয়। ১৯৪৯ সালের ১১ মার্চ ঢাকা থেকে প্রথম ইংরেজি দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার প্রকাশিত হয়। এর মালিক ছিলেন মুসলিম লীগ নেতা হামিদুল হক চৌধুরী, পরে তিনি কেএসপিতে যোগ দেন। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পর এর মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক ইত্তেফাক। প্রথম সম্পাদক হিসেবে নাম ছাপা হতো আবদুল হামিদ খান ভাসানীর। ১৯৫৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর ইত্তেফাক দৈনিক পত্রিকা হিসেবে প্রকাশিত হয়। ১৯৫১ সালের ১৭ মে দৈনিক সংবাদ প্রকাশিত হয় খায়রুল কবিরের সম্পাদনায়। শুরুতে এটি মুসলিম লীগের মুখপত্র ছিল, পরে বামপন্থীদের কাগজ হয়ে যায়।

পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকে আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পত্রিকা হলো ইনসাফ, জিন্দেগী, দেশের দাবী। এসব পত্রিকার সম্পাদক-সাংবাদিকেরা শুধু ভাষা আন্দোলনের খবরই গুরুত্বের সঙ্গে ছাপতেন না; রাষ্ট্রভাষা কমিটির সদস্য হিসেবেও তাঁরা অগ্রণী পালন করতেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ৯ বছরের মধ্যে কোনো সংবিধান দিতে পারেনি শাসকদল। দেশ চলছিল ব্রিটিশ প্রবর্তিত আইন দ্বারা। সংবাদপত্রের ওপর ব্রিটিশদের কালাকানুনগুলো পুরোপুরিই বহাল ছিল। তদুপরি ১৯৫০ সালে পাকিস্তান সরকার নতুন একটি ডিক্রি জারি করে বলে দেয়, ‘মৌখিক বা লিখিতভাবে নতুন দেশের উদ্ভবের বিরোধিতা করা যাবে না।’ এ ছাড়া প্রাদেশিক সরকারের জননিরাপত্তা আইন এবং কেন্দ্রীয় সরকারের পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনেও সংবাদপত্রের কণ্ঠ স্তব্ধ করার চেষ্টা চলে। এসব সত্ত্বেও বিরোধী দলের মুখপত্র হিসেবে ইত্তেফাক, পাকিস্তান অবজারভার, মিল্লাত ও ইত্তেহাদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই আইন ব্যবহার করা হতো বিরোধী রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে। ফলে কারাগারই হয়ে ওঠে সরকারবিরোধী রাজনীতিক ও সাংবাদিকদের অস্থায়ী নিবাস।

১৯৫৮ সালে মার্শাল ল’ জারি হওয়ার পর অনেক পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়। যেসব পত্রিকা বের হতো তাদেরও কঠোর সেন্সরশিপ মেনে চলতে হতো। সে সময়ে অধিকাংশ পত্রিকায় বেতন-ভাতা অনিয়মিত ছিল। ফলে মেধাবী তরুণেরা সাংবাদিকতায় আসতে উৎসাহিত হতেন না। আবার আসলেও বেশি দিন থাকতেন না। সে সময়ে রাজনৈতিক কারণে যারা চাকরি পাবেন না, বা করবেন না, সেই তরুণেরাই সাংবাদিকতা করতেন।

১৯৬০ সালের আইয়ুব খান জারি করেন প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনস অধ্যাদেশ। এ অধ্যাদেশ মতে, সংবাদপত্র সংশ্লিষ্ট আগের সব আইন বহাল থাকে। নতুন শর্ত যুক্ত হলো: ‘এখন থেকে সংবাদপত্রের প্রকাশক ও ছাপাখানার মালিকদের জামানত দিতে হবে।’ এর পাশাপাশি নিষিদ্ধ ঘোষিত সংবাদপত্রের সন্ধানে খানা তল্লাশি চালানোরও অধিকার সরকারের থাকবে।

১৯৬২ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ‘ছাত্র আন্দোলন’ শুরু হলে সরকার পাকিস্তান দ-বিধিতে ১৫.৩ (খ) ধারা যুক্ত করে। ১৯৬৩ সালে সংশোধিত প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স আইন জারি হলে সাংবাদিক সমাজ তার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন। এই আইনে পত্রিকার ডিক্লারেশন বা ছাড়পত্রের বিপরীতে নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ জমা দিতে হতো, সংবাদপত্র প্রকাশের আগেই সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হতো। অনুমতি দেবেন একজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। সাময়িকপত্রের জন্যও এই নিয়ম প্রযোজ্য। এই আইনের কারণে প্রায় শখানেক দৈনিক, তিন শ’র মতো সাপ্তাহিক পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়।

১৯৬৩ সালের প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স আইনের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের দুই অংশেই সাংবাদিকেরা জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলেন। তাঁরা ১৭ সেপ্টেম্বর দেশব্যাপী ধর্মঘট পালন করেন। ফলে ১৮ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানে কোনো পত্রিকা পকাশিত হয়নি। ১৯ সেপ্টেম্বরের Pakistan Observer থেকে সেই ধর্মঘটের খবরটি এখানে উদ্ধৃত করছি।

Unprecedented in the history of journalism, the journalists of News papers, Press workers and other News papers employees all over the country struck work and demonstrated on Monday to protest against the imposition of fresh curbs by government in the form of two provincial ordinances. There was no news paper on Tuesday in the country.

From khaibar pass to Chittagong in all principal cities slogan chanting black flag waving journalists held protest meeting and paraded city streets to raise their voice of indignation against the black law.

এর আগে সম্মিলিত বিরোধী দলের ১০ নেতা এক বিবৃতিতে প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স আইনের নিন্দা করে সংবাদপত্র বিবৃতি দেন। এতে বলা হয়:

সরকার কর্তৃক সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণকারী সংশোধিত প্রেস অর্ডিন্যান্স জারি করায় দেশের সর্বত্র গণমানুষের প্রচন্ড বিক্ষোভের সঞ্চার হহইয়াছে। দলমত নির্বিশেষে সকল শ্রেণির মানুষ এই জঘন্য গণতন্ত্রবিরোধী ও বাকস্বাধীনতা হরণকারী অর্ডিনেন্সের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন করিয়া অবিলম্বে উহার প্রত্যাহার দাবি করিতেছে। পাকিস্তানের সংবাদপত্রসমূহের স্বাধীনতা খর্ব করার জন্য সরকার যে নজিরবিহীন ব্যবস্থা গ্রহণ করিয়াছে, তাহাতে দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আতঙ্কিত হইয়া পড়িয়াছি। বর্তমানের এই ব্যবস্থা সামরিক শাসন শাসনামলেও কল্পনা করা যায় নাই। নেতৃবৃন্দ অত্যন্ত কঠোর ভাষায় এই ব্যবস্থার তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন করিয়া এহেন এক নায়কত্ববাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অবিচলিতভাবে প্রতিবাদমুখর হইয়া উঠিতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।

বিবৃতিতে সাক্ষরদানকারী নেতারা হলেন: নুরুল আমিন, আতাউর রহমান খান, হামিদুল হক চৌধুরী, শেখ মুজিবুর রহমান, শাহ আজিজুর রহমান, মাহমুদ আলী, ইউসুফ আলি চৌধুরী, সৈয়দ আজিজুল হক, আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, মোহাম্মদ সোলায়মান।

পরবর্তীকালে এই নেতাদের অন্তত পাঁচজন (নূরুল আমিন, হামিদুল হক চৌধুরী, মাহমুদ আলী, শাহ আজিজুর রহমান, মোহাম্মদ সোলায়মান) বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন।

নানা কালাকানুন ও দমনপীড়ন সত্ত্বেও ষাটের দশকের সংবাদপত্র এ দেশের বৃহত্তর জনগণের দাবি-দাওয়ার কথা তুলে ধরা তথা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে সাহসী ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে পাকিস্তান সরকারের অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ ও বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে এবং ছয় দফা ও ১১ দফার পক্ষে অধিকাংশ পত্রিকা ছিল উচ্চকণ্ঠ। সত্তরের প্রথম দিকে প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক বাংলার বাণী ও একতা। বাংলার বাণী ছিল আওয়ামী লীগের সমর্থক এবং একতা নিষিদ্ধ ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র। রাজনৈতিক নীতি-আদর্শ প্রচারই ছিল এসব পত্রিকার মূল উদ্দেশ্য।

ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনের সময় আমাদের সংবাদপত্রগুলো হয়ে ওঠে সময়ের সাহসী যোদ্ধা। সরকারি বিধিনিষেধ ও দমননীতির প্রতিবাদে আন্দোলনকামী মানুষের সঙ্গে সাংবাদিকরাও একাত্ম ঘোষণা করেছিলেন। রাজনীতি ও সাংবাদিকতা একে অপরের পরিপূরক হয়ে ওঠে। ২৪ জানুয়ারি সংগঠিত গণঅভ্যুত্থানের খবর পরদিন সব পত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হয়েছিল। লিখেছিল সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয়। কিন্তু দৈনিক আজাদ ২৬ জানুয়ারি একটি ব্যতিক্রমী রিপোর্ট করে, যার শিরোনাম ছিল, ‘নয়া ইতিহাস লিখেছে ধর্মঘট: রক্তে রক্তে আঁকা প্রচ্ছদপট’। রিপোর্টটির কিছু অংশ এখানে তুলে ধরছি:

‘শুক্রবার ঢাকা শহর ছিল মিছিলের শহর। ভোরে কাক ডাকার আগেই প্রতিটি মহল্লায় তরুণ, কিশোর যুবকবৃন্দ মোড়ে মোড়ে জমায়েত হয়, আর খন্ড খন্ড মিছিলে শরিক হয়— নিজ নিজ এলাকা পরিক্রমণ করে। সবার চোখে আগুনের হল্কা, মুখে নির্ভীক ভ্রুকুটি, আর কণ্ঠে তুলছে আওয়াজ। মহল্লার এসব খন্ড মিছিলে আমি দেখেছি পানওয়ালা, মজুর, রিকশাওয়ালা আর সাধারণ মেহনতী মানুষ। ...সকাল দশটার মধ্যেই সারা শহরে অগণিত খন্ড মিছিলের শহরে পরিণত হয়। সব পথে মিছিল। কোথাও শ্রমিকের মিছিল, কোথাও মেহনতী মানুষের মিছিল। মিছিল আর স্লোগান। যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই মানুষের মিছিল আর যেদিকেই কান যায় সেদিকেই বিক্ষুব্ধ মানুষের স্লোগান। সূর্যের তাপ যত প্রখর হয় রাজধানীর পরিবেশ তত প্রতিবাদমুখর হয়।’

একাত্তরের পঁচিশে মার্চ পর্যন্ত সংবাদপত্রগুলো দেশবাসীকে সাহসের সমাচার শুনিয়েছে। এ কারণে সেদিন মধ্যরাতে পাকিস্তানি বাহিনীর অভিযানের অন্যতম লক্ষ্যবস্তু ছিল পড়লে সংবাদপত্র। সেদিন রাতেই পিপল অফিস জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। এরপর ২৬ মার্চ ইত্তেফাক ও ২৭ মার্চ সংবাদ অফিস পুড়িয়ে দেয় দখলদার বাহিনী। সাংবাদিক শহীদ সাবের ‘সংবাদ’ অফিসেই অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান।

আরও পেছনে গেলে আমরা দেখতে পাই, আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিবষদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। আজাদ-এ বিশেষ ক্রাড়পত্রও বের হয়েছিল তাঁরই উদ্যোগে। ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ও সংবাদ সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরী দৌর্দন্ড প্রতাপশালী শাসক আইয়ুব খানকে মুখের ওপর কথা শুনিয়ে দিতেও দ্বিধা করেননি।

একাত্তরে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর থাবা এড়িয়ে যেসব সাংবাদিক নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে পেরেছেন তারা কেউ মুজিবনগরে, কেউ মুক্তাঞ্চলে গিয়ে পত্রিকা বের করেছেন। এসব পত্রিকায় নিয়মিত মুক্তিযুদ্ধের ও মুক্তিযোদ্ধাদের খবর থাকত। উদ্বাস্তু পরিবেশে, ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই পত্রিকাগুলো স্বাধীনতাকামী গণমানুষের মনোবল উজ্জীবিত রাখতে সক্ষম হয়েছে। মুক্তাঞ্চল থেকে অনেকগুলো পত্রিকা বের হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল- জয় বাংলা, রণাঙ্গন, মুক্তবাংলা, স্বাধীন বাংলা, নতুন বাংলা, বাংলার বাণী, বাংলাদেশ, বিপ্লবী বাংলাদেশ, দাবানল, স্বদেশ, জাগ্রত বাংলা, মুক্তিযুদ্ধ, অগ্রদূত, বাংলার মুখ, সাপ্তাহিক বাংলা, বঙ্গবাণী, মুক্তি, অগ্রদূত, দেশ বাংলা, অভিযান, সোনার বাংলা, জন্মভূমি, দাবানল, সংগ্রামী বাংলা, The nation, Bangladesh প্রভৃতি। মুক্তিযুদ্ধকালীন সংবাদপত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে শিক্ষক-গবেষক সুব্রত শঙ্কর ধর লিখেছেন, একিট জাতির স্বাধীনতা সংগ্রাম ও তার জন্ম যন্ত্রণার মুহূর্তগুলো এসব পত্রিকায় চিত্রিত হয়েছে যথেষ্ট বিশ্বস্ততার সাথে। পরিবেশিত সংবাদের সঠিকত্ব বিচারেই শুধু নয়, একটি জাতির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষার সাথে জড়িত যে আবেগ তার প্রতিফলনেও সেই বিশ্বস্ততা বিচার্য। (বাংলাদেশের সংবাদপত্র, সুব্রত শঙ্কর ধর)

দেশভাগের আগে ঢাকায় প্রতিনিধিত্বশীল কোনো পত্রিকা ছিল না। মুসলিম লীগের মুখপত্র হিসেবে পরিচিত আজাদ, ইত্তেহাদও মিল্লাত বের হতো কলকাতা থেকে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম দেশ ভাগের পরও কলকাতায় থেকে যান।

১৯৪৮ সালে আজাদ ঢাকায় স্থানান্তরিত হওয়ার পরও ইত্তেহাদ ও মিল্লাত কলকাতায় থেকে যায় এবং কিছু দিন পর বন্ধ হয়ে যায়। সোহরাওয়ার্দীর অনুসারীরা ঢাকায় চলে এলেও তিনি সেখানে থেকে যান। সোহরাওয়ার্দী ছিলেন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ও জনপ্রিয় নেতা । কিন্তু জিন্নাহ তাঁকে বাদ দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী করেন খাজা নাজিমউদ্দীনকে। তিনি মুখ্যমন্ত্রী হয়েই সোহরাওয়ার্দীর পূর্ব পাকিস্তানে আসার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। পাকিস্তানে স্থায়ী ঠিকানা নেই- এই অজুহাতে পরে তাঁর গণপরিষদের সদস্যপদও বাতিল করা হয়। আবুল হাশিম পশ্চিমবঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নেন এবং পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিরোধী দলের নেতার দায়িত্ব নেন। তিনি পূর্ববঙ্গে আসেন পঞ্চাশের দাঙ্গার সময়।

পাকিস্তান আমলে প্রথম বিরোধী দলীয় মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক ইত্তেফাক। অন্যদিকে ইত্তেহাদ, মিল্লাত ঢাকায় নতুন করে প্রকাশিত হলেও স্থায়ী হয়নি। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে আমরা ইত্তেফাক প্রকাশের পটভূমি জানতে পারি। তিনি লিখেছেন,

“একদিন ভাসানী সাহেব ও আমি কোর্টে যেতে দেখি মানিক ভাই দাঁড়িয়ে আছেন, আমাদের সঙ্গে সাথে দেখা করার জন্য। আলাপ-আলোচনা হওয়ার পরে মানিক ভাই বললেন, না না অসুবিধায় অছি, আমাদের দিকে খেয়াল রাখার কেউই নাই। আমি কি আর করতে পারব, একটা বড় চাকরি পেয়েছি করাচিতে চলে যেতে চাই, আপনারা কী বলেন? আমি বললাম, মানিক ভাই, আপনিও আমাদের জেলে রেখে চলে যাবেন? আমাদের দেখবার কেউ বোধহয় থাকবে না। ...মানিক ভাই কিছুক্ষণ কিছু সময় চুপ করে থেকে আমাদের বললেন, না যাব না, আপনাদের রেখে।”

এরপর বঙ্গবন্ধু যোগ করেন, “মাওলানা সাহেব সাপ্তাহিক ইত্তেফাক কাগজ বের করেছিলেন। কয়েক সপ্তাহ বের হওয়ার পরে বন্ধ হয়ে যায়। কারণ টাকা কোথায়? মওলানা সাহেব বললেন, কাগজটা তো বন্ধ হয়ে গেছে, যদি পার তুমি চালাও। মানিক ভাই বললেন, কী করে চলবে, টাকা কোথায়? তবুও চেষ্টা করে দেখব। আমি মানিক ভাইকে আমার এক বন্ধু কর্মচারীর কথা বললাম। ভদ্রলোক আমাকে আপন ভাইয়ের মতো ভালোবাসতেন। কলকাতায় চাকরি করতেন, সোহরাওয়ার্দী সাহেবের ভক্ত ছিলেন। বাংলাদেশের বাসিন্দা নন, তবু বাংলাদেশকে ও তার জনগণকে তিনি ভালোবাসতেন। আমার কথা বলল কিছু সাহায্য করতেও পারেন। মানিক ভাই পরের মামলার তারিখে বললেন যে কাগজ তিনি চালাবেন।” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান)

এই দীর্ঘ উদ্ধৃতি দেওয়ার কারণ তখন রাজনীতি ও সংবাদপত্রের মধ্যে সম্পর্কটা যে কত নিবিড় ছিল সেটা বোঝানো। মানিক মিয়া ও ইত্তেফাকের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্ক আমৃত্যু অটুট ছিল। আনুষ্ঠানিকভাবে না হলেও মানুষ ইত্তেফাককে আওয়ামী লীগের মুখপাত্র ভাবত। ১৯৫১ সালের ১৭ মে যে সংবাদ বের হয়; তার পেছনেও ছিল মুসলিম লীগ। নূরুল আমিন তখন মুখ্যমন্ত্রী। সরকারের সমর্থনেই পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়েছিল।

অবিভক্ত পাকিস্তানের বয়স ছিল ২৩ বছর। এর মধ্যে সামরিক শাসকেরা ক্ষমতায় ছিলেন ১৩ বছর। আর সামরিক শাসনের মধ্যে সাংবাদিকদের কাজ করা ছিল অনেকটা কুমির পোষা পুকুরে সাঁতার কাটার মতো। প্রত্যেক সামরিক শাসকই ক্ষমতায় এসে সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধের চেষ্টা করেন। ভাবেন সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের বশ করতে পারলেই সারা দেশের মানুষ ঠান্ডা হয়ে যাবে। সব দেশেই সামরিক শাসকেরা প্রথমে কিছু লোকদেখানো গণমুখী কাজ করেন, যেমন সামরিক আদালতে দ্রুত অভিযুক্ত ব্যক্তির বিচার, কালোবাজারীদের বিরুদ্ধে অভিযান, পরিচ্ছন্নতা অভিযান ইত্যাদি।

আইয়ুব খান ক্ষমতায় এসেই ১৯৫৬ সালের সংবিধান রহিত ও রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ করেন। সংবিধান রহিত করা মানে মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করা। সংবিধান রহিত সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ। এ অবস্থায় সাংবাদিকতা করা ছিল অত্যন্ত কঠিন। পাকিস্তান আমলে বেশিরভাগ সংবাদপত্র প্রকাশ হতো রাজনৈতিক দল ও দর্শনের মুখপত্র হিসেবে। আবার অনেকে রাজনীতির মাঠ থেকে সরাসরি সাংবাদিকতায় এসেছেন। ফলে জেলখানা ও সংবাদপত্র অফিসের মধ্যে দূরত্ব খুব বেশি ছিল না।

পাকিস্তান আমলে জেলখাটা সাংবাদিকদের মধ্যে ছিলেন তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, কেজি মুস্তাফা, ফয়েজ আহমদ, কামাল লোহানী, রণেশ দাশগুপ্ত, সন্তোষ গুপ্ত, সত্যেন সেন, নির্মল সেন, আলী আকসাদ প্রমুখ। তবে সবাই সাংবাদিকতার জন্য জেল খাটেননি। অনেকে রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন।

সামরিক শাসনামলের সাংবাদিকতার চালচিত্র ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কামাল লোহানী লিখেছেন, ‘মৌলিক গণতন্ত্রের নির্বাচনের (বেসিক ডেমোক্রেসির ইলেকশনের) পরে আইয়ুব খান আদমজীতে দাঙ্গা বাধানোর চেষ্টা করছে, এমনকি সারা দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তৈরির চেষ্টা করছে তখনো সম্পাদক ও সংবাদপত্রের এমনই বিশাল ভূমিকা ছিল। তোপখানা রোডে আহমদুল কবিরের (সংবাদ-এর মালিক) অফিসকে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা প্রতিরোধ অফিস বানানো হয়। ওখানেই সব কর্মসূচি গ্রহণ করা হতো, লিফলেট ছাপানো হতো। ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’ অভিন্ন শিরোনামে সংবাদ, ইত্তেফাক ও আজাদ পত্রিকায় প্রথম পাতায় সম্পাদকীয় ছাপা হয়। ঢাকা শহরে মিছিলও বের করা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাড়াও’ ব্যানার নিয়ে, যাতে সাংবাদিক, রাজনীতিকসহ সর্বস্তরের মানুষ ছিলেন।’

image
আরও খবর
৬৯ বছরে সংবাদ
ভাষা থেকে ভূখন্ড
স্মৃতিময় সংবাদ-এর ৬৯ বছর
সংবাদ : কিছু কথা কিছু স্মৃতি
যুগে যুগে সংবাদপত্রের অগ্রযাত্রা
আলোর তৃষ্ণায় জাগো
ইতিহাস ঐতিহ্য ও আদর্শের স্মারক দৈনিক সংবাদ
কেন লিখি
সংবাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আত্মার
ঐতিহ্য আর মুক্তচিন্তার সংবাদ
আমার সংবাদ সংবাদের আমি
বিচিত্র জীবিকা বিচিত্র জীবন
ঋতুপর্ণ ঘোষের এলোমেলো দেশকাল
চীন ও বাংলাদেশ : প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সম্পর্ক
সংবাদের জলসাঘর
আমরা এখন শান্ত হয়ে আছি
মাটির মাধুর্য
কষ্টের ঢাকা স্বপ্নের বাংলাদেশ
তোমারে বধিবে যে...
বঙ্গবন্ধুর জনকল্যাণের অর্থনৈতিক নীতি কৌশল
শারহুল পটবসন্ত ও বজলুর রহমান
শিশুশিক্ষায় শিল্প-সাহিত্য-সংগীত
গণমাধ্যমের হাল-হকিকত
এবং বজলুর রহমান স্মৃতিপদক
দুর্নীতি, পেশাদারিত্ব ও উন্নয়ন
বাংলাদেশের থিয়েটার চর্চার ভবিষ্যৎ
চেতনায় নৈতিকতা মূল্যবোধ : বিরুদ্ধবাস্তবতা
সবার উপরে মানুষ সত্য
আহমদুল কবির শ্রদ্ধাঞ্জলি
কার্যকর সংসদ এবং সুশাসনের স্বপ্ন
‘সংবাদ’ আমারই ছিল আমারই আছে
আমাদের ‘সংবাদ’
নারীর অধিকার ও সচেতনতা
গণমাধ্যমে বিশ্বাস কমছে পাঠকের
নারী ও তার বিধাতা পুরুষ
বাংলাদেশের নারী
সংবাদের কাছে আমি ঋণী
বিস্মৃতিপ্রবণতা ও রাষ্ট্রের অক্ষমতা
যে দীপশিখা দিয়েছে আলো

বুধবার, ১০ জুলাই ২০১৯ , ২৬ আষাঢ় ১৪২৫, ৬ জ্বিলকদ ১৪৪০

পাকিস্তান আমলের সংবাদপত্র

একটি রাজনৈতিক পাঠ

সোহরাব হাসান

image

ভারতীয় উপমহাদেশে সংবাদপত্র এসেছে রাজনীতির হাত ধরেই। রাজনৈতিক কারণে যেমন বহু পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে, তেমনি রাজনৈতিক কারণে বন্ধও হয়ে গেছে। জেমস আগাস্টাস হিকি ভারতবর্ষে সংবাদপত্রের পথিকৃৎ- তার সম্পাদনায় ১৭৮০ সালের ২৯ জানুয়ারি প্রকাশিত হয় বেঙ্গল গেজেট- দুই পাতার একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক। হিকি ব্রিটিশ নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাঁকে রেহাই দেয়নি। যখনই তিনি কোম্পানির দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার সমালোচনা করলেন তাঁকে জেলে পাঠানো হলো। এরপর সরকার ১৭৯৪ সালে উইলিয়াম দুয়েন নামে আরেক সম্পাদককে গ্রেপ্তার করে এবং জোরপূর্বক জাহাজে করে ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দেয়। ১৮১৮ সালের এপ্রিলে প্রথম বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়- দিগদর্শন। এটি প্রকাশ করেছিল শ্রীরামপুরের ব্যাপটিস্ট মিশন। ১৮১৮ সালেই প্রথম বাঙালি মালিকানাধীন পত্রিকা ‘বেঙ্গল গেজেট’ বের হয়। প্রকাশক গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য। ১৮১৯ সালের ১ মে জেমস সিল বার্মিংহামের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ক্যালকাটা জার্নাল। এই সময়ে যে সম্পাদক ও ভাবুক ফারসি ও বাংলা পত্রিকা প্রকাশ করে আলোড়ন তুলেছিলেন তিনি রাজা রামমোহন রায়; ১৮২১ সালে তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘সংবাদ কৌমুদী।’ আর ১৮২২ সালে ফারসি ভাষায় ‘মিরাতুল আকবর।’ কিন্তু যখন তিনি দেখলেন সরকার ‘সংবাদ কৌমুদী’র কাজে বাধা দিচ্ছে, তখন পত্রিকাটি বন্ধ করে দিলেন। রামমোহন রায় শুধু সমাজ বিপ্লবী ছিলেন না, সাংবাদিক হিসেবেও ছিলেন বিদ্রোহী।

১৮৭৮ সালে ভাইসরয় লর্ড রিটন ভার্নাকুলার প্রেস আইন জারি করেন, যার মূলকথা ছিল দেশীয় ভাষায় কোনো কিছু ছাপা হলে তা সরকারের নিযুক্ত লোকজনকে দেখাতে হবে। ইংরেজিতে প্রকাশিত পত্রিকার ক্ষেত্রে এই নিয়ন্ত্রণ ছিল না। অমৃত বাজার পত্রিকা বের হতো বাংলায়। নতুন আইন জারির পর সম্পাদক শিশির ঘোষ পত্রিকাটি রাতারাতি বাংলা থেকে ইংরেজিতে রূপান্তরিত করলেন। এরপর বাংলা নামেই ইংরেজি ভাষায় পত্রিকাটি প্রকাশ হতে থাকে। ১৮৬৮ সালে অমৃত বাজার যশোরে যাত্রা শুরু করলেও পরে কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়।

অবিভক্ত ভারত, আরও নির্দিষ্ট করে বললে বাংলায় সংবাদপত্রের প্রসার ঘটে ঔপনিবেশিক শাসনবিরোধী ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বাহন হিসেবে। কংগ্রেস নেতা সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি ১৮৭৮ সালে বের করেন ‘বেঙ্গলি’। ১৯২০ সালে কংগ্রেসের সমর্থনে দৈনিক আনন্দবাজার প্রকাশিত হলে পত্রিকাটি দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে। এরপর মুসলিম লীগের সমর্থনে প্রকাশিত হয় ‘স্টার অব ইন্ডিয়া’ ও ‘মর্নিং নিউজ’। গান্ধীর নিজের পত্রিকা ছিল ‘হরিজন’ ও ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’। এসব পত্রিকা নিজ নিজ দলের রাজনৈতিক দর্শন ও নেতার মহিমা প্রচার করত।

কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ সমর্থিত পত্রিকাসমূহ যখন স্বরাজ, স্বায়ত্তশাসন ইত্যাদি নিয়ে শোরগোল তোলে এবং সম্প্রদায়গত স্বার্থরক্ষায় উচ্চকণ্ঠ তখন বাংলায় একটি পত্রিকা সরাসরি স্বাধীনতার আহ্বান নিয়ে আসে। কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত ‘ধূমকেতু’। পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যার সম্পাদকীয়তে বলা হয়:

সর্বপ্রথম, ‘ধূমকেতু’ ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়। স্বরাজ-টরাজ বুঝি না, কেননা, ও-কথাটার মানে এক এক মহারথী এক এক রকম করে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশির অধীন থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা-রক্ষা, শাসনভার, সমস্ত থাকবে ভারতীয়দের হাতে। তাতে কোনো বিদেশির মোড়লি করবার অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না। যাঁরা এখন রাজা বা শাসক হয়ে এদেশে মোড়লি করে দেশকে শ্মশান ভূমিতে পরিণত করছেন, তাঁদের পাততাড়ি গুটিয়ে, বোঁচকা-পুঁটলি বেঁধে সাগর পারে পাড়ি দিতে হবে। প্রার্থনা বা আবেদন নিবেদন করলে তাঁরা শুনবেন না। তাঁদের অতটুকু সুবুদ্ধি হয়নি এখনো। আমাদেরও এই প্রার্থনা করার, ভিক্ষা করার কুবুদ্ধিটুকুকে দূর করতে হবে।

পূর্ণ স্বাধীনতা পেতে হলে সকলের আগে আমাদের বিদ্রোহ করতে হবে, সকল-কিছু নিয়মকানুন বাঁধন-শৃঙ্খল মানা নিষেধের বিরুদ্ধে।’

ধূমকেতুর আগে নজরুলের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় নবযুগ; যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মুজাফফর আহমদও।

অধ্যাপক সাখাওয়াত আলী খান পাকিস্তান-পূর্ব সংবাদপত্রের চরিত্র ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘মুসলিম লীগের নেতা হয়েও মাওলানা আকরম খাঁ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম নিজস্ব ক্ষমতাবলয় তৈরি করতে প্রকাশ করেন যথাক্রমে ‘আজাদ’, ‘ইত্তেহাদ’ ও ‘মিল্লাত’। তিনটি পত্রিকা মুসলিম জাতীয়তাবাদ ও পাকিস্তানের পক্ষে প্রচার করলেও দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য ছিল।’ ইত্তেহাদ ও মিল্লাত দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত আজাদ, পাকিস্তান পর্ব পেরিয়ে বাংলাদেশেও দুই দশকের বেশি সময় চলেছে।

২.

বর্তমানে যে ভূখন্ডটি বাংলাদেশ নামে পরিচিত, তার প্রথম পত্রিকা হলো রঙ্গপুর বার্ত্তা, ১৮৪৭ সালে রংপুর থেকে প্রকাশিত , সম্পাদক গুরুচরণ রায়। ১৮৫৬ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশ পায় ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘ঢাকা নিউজ।’ ঢাকায় প্রকাশিত প্রথম বাংলা পত্রিকার নাম ‘ঢাকা প্রকাশ’। প্রকাশকাল ১৮৬১; সম্পাদক ছিলেন কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার। পত্রিকাটি ছিল ব্রাহ্ম মতের সমর্থক। প্রায় এক শ বছর টিকে ছিল ‘ঢাকা প্রকাশ।’ এ অঞ্চলের আর কোনো পত্রিকা এত দীর্ঘায়ু পায়নি। ১৮৫৬ সালে হিন্দু রক্ষিণী সভার মুখপত্র হিসেবে প্রকাশ পায় ‘হিন্দু হিতৈষিণী’। বাংলাদেশের আরেকটি প্রাচীন পত্রিকা হলো ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’। এটি বের হয় ১৮৬৪ সালে, কুষ্টিয়ার কুমারখালী থেকে, সম্পাদক ছিলেন দরিদ্র স্কুলশিক্ষক হরিনাথ মজুমদার- যিনি কাঙাল হরিনাথ নামে বেশি পরিচিত। ময়মনসিংহ থেকে প্রকাশিত প্রথম পত্রিকার নাম বিজ্ঞাপনী, প্রকাশকাল ১৮৮৬। ১৮৬৮ সালে এপ্রিলে রাজশাহীর বোয়ালিয়া থেকে বের হয় হিন্দু রঞ্জিকা। পরের বছর ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয় অর্ধ সাপ্তাহিক বেঙ্গল টাইমস। ১৮৭০ সালে নেপাল কোডে ‘রাজদ্রোহ নিয়ন্ত্রণ’ ধারা যুক্ত করা হলে সংবাদপত্রের ওপর আরেকটি হুমকি নেমে আসে। এ ধারায় বলা হয়, যে পত্রিকা সরকারের প্রতি অপ্রিয় মনোভাব সৃষ্টি করবে বা দেশবাসীকে সরকারের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করবে সেটিই শাস্তি পাবে এবং তা জরিমানা, জেল ও যাবজ্জীবন কারাদন্ড পর্যন্ত হতে পারে।

১৮৯৮ সালে রাজদ্রোহ আইন সংশোধন করে আইনি ক্ষমতা বাড়ানো হয় এবং আরও দুটি ধারা এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়। তবে সাংবাদিকদের আন্দোলনের কারণে সরকার ১৮৭৭ সালে জারিকৃত ভার্নাকুলার প্রেস আইন প্রত্যাহার করে। এটি ছিল পরাধীন ভারতে সাংবাদিকদের একটি বড় বিজয়।

দেশ বিভাগের আগ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্য-শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং সাংবাদিকতার কেন্দ্র ছিল কলকাতা। ফলে ১৯৪৭-এর আগে প্রায় সব জনপ্রিয় বাংলা পত্রিকা বের হতো কলকাতা থেকে। ১৯৪৭ সালে জুন মাসে চট্টগ্রাম থেকে দৈনিক পূর্ব পাকিস্তান নামে একটি পত্রিকা বের হয়। পাকিস্তান হওয়ার পরও বেশ কিছু দিন আজাদ, ইত্তেহাদ, মিল্লাত ও মর্নিং নিউজ কলকাতা থেকে প্রকাশিত হতো। ১৯৪৮ সালে দৈনিক আজাদ কলকাতা থেকে ঢাকায় স্থানান্তর হয়। ১৯৪৯ সালের ১১ মার্চ ঢাকা থেকে প্রথম ইংরেজি দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার প্রকাশিত হয়। এর মালিক ছিলেন মুসলিম লীগ নেতা হামিদুল হক চৌধুরী, পরে তিনি কেএসপিতে যোগ দেন। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পর এর মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক ইত্তেফাক। প্রথম সম্পাদক হিসেবে নাম ছাপা হতো আবদুল হামিদ খান ভাসানীর। ১৯৫৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর ইত্তেফাক দৈনিক পত্রিকা হিসেবে প্রকাশিত হয়। ১৯৫১ সালের ১৭ মে দৈনিক সংবাদ প্রকাশিত হয় খায়রুল কবিরের সম্পাদনায়। শুরুতে এটি মুসলিম লীগের মুখপত্র ছিল, পরে বামপন্থীদের কাগজ হয়ে যায়।

পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকে আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পত্রিকা হলো ইনসাফ, জিন্দেগী, দেশের দাবী। এসব পত্রিকার সম্পাদক-সাংবাদিকেরা শুধু ভাষা আন্দোলনের খবরই গুরুত্বের সঙ্গে ছাপতেন না; রাষ্ট্রভাষা কমিটির সদস্য হিসেবেও তাঁরা অগ্রণী পালন করতেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ৯ বছরের মধ্যে কোনো সংবিধান দিতে পারেনি শাসকদল। দেশ চলছিল ব্রিটিশ প্রবর্তিত আইন দ্বারা। সংবাদপত্রের ওপর ব্রিটিশদের কালাকানুনগুলো পুরোপুরিই বহাল ছিল। তদুপরি ১৯৫০ সালে পাকিস্তান সরকার নতুন একটি ডিক্রি জারি করে বলে দেয়, ‘মৌখিক বা লিখিতভাবে নতুন দেশের উদ্ভবের বিরোধিতা করা যাবে না।’ এ ছাড়া প্রাদেশিক সরকারের জননিরাপত্তা আইন এবং কেন্দ্রীয় সরকারের পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনেও সংবাদপত্রের কণ্ঠ স্তব্ধ করার চেষ্টা চলে। এসব সত্ত্বেও বিরোধী দলের মুখপত্র হিসেবে ইত্তেফাক, পাকিস্তান অবজারভার, মিল্লাত ও ইত্তেহাদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই আইন ব্যবহার করা হতো বিরোধী রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে। ফলে কারাগারই হয়ে ওঠে সরকারবিরোধী রাজনীতিক ও সাংবাদিকদের অস্থায়ী নিবাস।

১৯৫৮ সালে মার্শাল ল’ জারি হওয়ার পর অনেক পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়। যেসব পত্রিকা বের হতো তাদেরও কঠোর সেন্সরশিপ মেনে চলতে হতো। সে সময়ে অধিকাংশ পত্রিকায় বেতন-ভাতা অনিয়মিত ছিল। ফলে মেধাবী তরুণেরা সাংবাদিকতায় আসতে উৎসাহিত হতেন না। আবার আসলেও বেশি দিন থাকতেন না। সে সময়ে রাজনৈতিক কারণে যারা চাকরি পাবেন না, বা করবেন না, সেই তরুণেরাই সাংবাদিকতা করতেন।

১৯৬০ সালের আইয়ুব খান জারি করেন প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনস অধ্যাদেশ। এ অধ্যাদেশ মতে, সংবাদপত্র সংশ্লিষ্ট আগের সব আইন বহাল থাকে। নতুন শর্ত যুক্ত হলো: ‘এখন থেকে সংবাদপত্রের প্রকাশক ও ছাপাখানার মালিকদের জামানত দিতে হবে।’ এর পাশাপাশি নিষিদ্ধ ঘোষিত সংবাদপত্রের সন্ধানে খানা তল্লাশি চালানোরও অধিকার সরকারের থাকবে।

১৯৬২ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ‘ছাত্র আন্দোলন’ শুরু হলে সরকার পাকিস্তান দ-বিধিতে ১৫.৩ (খ) ধারা যুক্ত করে। ১৯৬৩ সালে সংশোধিত প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স আইন জারি হলে সাংবাদিক সমাজ তার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন। এই আইনে পত্রিকার ডিক্লারেশন বা ছাড়পত্রের বিপরীতে নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ জমা দিতে হতো, সংবাদপত্র প্রকাশের আগেই সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হতো। অনুমতি দেবেন একজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। সাময়িকপত্রের জন্যও এই নিয়ম প্রযোজ্য। এই আইনের কারণে প্রায় শখানেক দৈনিক, তিন শ’র মতো সাপ্তাহিক পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়।

১৯৬৩ সালের প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স আইনের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের দুই অংশেই সাংবাদিকেরা জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলেন। তাঁরা ১৭ সেপ্টেম্বর দেশব্যাপী ধর্মঘট পালন করেন। ফলে ১৮ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানে কোনো পত্রিকা পকাশিত হয়নি। ১৯ সেপ্টেম্বরের Pakistan Observer থেকে সেই ধর্মঘটের খবরটি এখানে উদ্ধৃত করছি।

Unprecedented in the history of journalism, the journalists of News papers, Press workers and other News papers employees all over the country struck work and demonstrated on Monday to protest against the imposition of fresh curbs by government in the form of two provincial ordinances. There was no news paper on Tuesday in the country.

From khaibar pass to Chittagong in all principal cities slogan chanting black flag waving journalists held protest meeting and paraded city streets to raise their voice of indignation against the black law.

এর আগে সম্মিলিত বিরোধী দলের ১০ নেতা এক বিবৃতিতে প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স আইনের নিন্দা করে সংবাদপত্র বিবৃতি দেন। এতে বলা হয়:

সরকার কর্তৃক সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণকারী সংশোধিত প্রেস অর্ডিন্যান্স জারি করায় দেশের সর্বত্র গণমানুষের প্রচন্ড বিক্ষোভের সঞ্চার হহইয়াছে। দলমত নির্বিশেষে সকল শ্রেণির মানুষ এই জঘন্য গণতন্ত্রবিরোধী ও বাকস্বাধীনতা হরণকারী অর্ডিনেন্সের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন করিয়া অবিলম্বে উহার প্রত্যাহার দাবি করিতেছে। পাকিস্তানের সংবাদপত্রসমূহের স্বাধীনতা খর্ব করার জন্য সরকার যে নজিরবিহীন ব্যবস্থা গ্রহণ করিয়াছে, তাহাতে দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আতঙ্কিত হইয়া পড়িয়াছি। বর্তমানের এই ব্যবস্থা সামরিক শাসন শাসনামলেও কল্পনা করা যায় নাই। নেতৃবৃন্দ অত্যন্ত কঠোর ভাষায় এই ব্যবস্থার তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন করিয়া এহেন এক নায়কত্ববাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অবিচলিতভাবে প্রতিবাদমুখর হইয়া উঠিতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।

বিবৃতিতে সাক্ষরদানকারী নেতারা হলেন: নুরুল আমিন, আতাউর রহমান খান, হামিদুল হক চৌধুরী, শেখ মুজিবুর রহমান, শাহ আজিজুর রহমান, মাহমুদ আলী, ইউসুফ আলি চৌধুরী, সৈয়দ আজিজুল হক, আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, মোহাম্মদ সোলায়মান।

পরবর্তীকালে এই নেতাদের অন্তত পাঁচজন (নূরুল আমিন, হামিদুল হক চৌধুরী, মাহমুদ আলী, শাহ আজিজুর রহমান, মোহাম্মদ সোলায়মান) বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন।

নানা কালাকানুন ও দমনপীড়ন সত্ত্বেও ষাটের দশকের সংবাদপত্র এ দেশের বৃহত্তর জনগণের দাবি-দাওয়ার কথা তুলে ধরা তথা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে সাহসী ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে পাকিস্তান সরকারের অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ ও বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে এবং ছয় দফা ও ১১ দফার পক্ষে অধিকাংশ পত্রিকা ছিল উচ্চকণ্ঠ। সত্তরের প্রথম দিকে প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক বাংলার বাণী ও একতা। বাংলার বাণী ছিল আওয়ামী লীগের সমর্থক এবং একতা নিষিদ্ধ ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র। রাজনৈতিক নীতি-আদর্শ প্রচারই ছিল এসব পত্রিকার মূল উদ্দেশ্য।

ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনের সময় আমাদের সংবাদপত্রগুলো হয়ে ওঠে সময়ের সাহসী যোদ্ধা। সরকারি বিধিনিষেধ ও দমননীতির প্রতিবাদে আন্দোলনকামী মানুষের সঙ্গে সাংবাদিকরাও একাত্ম ঘোষণা করেছিলেন। রাজনীতি ও সাংবাদিকতা একে অপরের পরিপূরক হয়ে ওঠে। ২৪ জানুয়ারি সংগঠিত গণঅভ্যুত্থানের খবর পরদিন সব পত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হয়েছিল। লিখেছিল সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয়। কিন্তু দৈনিক আজাদ ২৬ জানুয়ারি একটি ব্যতিক্রমী রিপোর্ট করে, যার শিরোনাম ছিল, ‘নয়া ইতিহাস লিখেছে ধর্মঘট: রক্তে রক্তে আঁকা প্রচ্ছদপট’। রিপোর্টটির কিছু অংশ এখানে তুলে ধরছি:

‘শুক্রবার ঢাকা শহর ছিল মিছিলের শহর। ভোরে কাক ডাকার আগেই প্রতিটি মহল্লায় তরুণ, কিশোর যুবকবৃন্দ মোড়ে মোড়ে জমায়েত হয়, আর খন্ড খন্ড মিছিলে শরিক হয়— নিজ নিজ এলাকা পরিক্রমণ করে। সবার চোখে আগুনের হল্কা, মুখে নির্ভীক ভ্রুকুটি, আর কণ্ঠে তুলছে আওয়াজ। মহল্লার এসব খন্ড মিছিলে আমি দেখেছি পানওয়ালা, মজুর, রিকশাওয়ালা আর সাধারণ মেহনতী মানুষ। ...সকাল দশটার মধ্যেই সারা শহরে অগণিত খন্ড মিছিলের শহরে পরিণত হয়। সব পথে মিছিল। কোথাও শ্রমিকের মিছিল, কোথাও মেহনতী মানুষের মিছিল। মিছিল আর স্লোগান। যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই মানুষের মিছিল আর যেদিকেই কান যায় সেদিকেই বিক্ষুব্ধ মানুষের স্লোগান। সূর্যের তাপ যত প্রখর হয় রাজধানীর পরিবেশ তত প্রতিবাদমুখর হয়।’

একাত্তরের পঁচিশে মার্চ পর্যন্ত সংবাদপত্রগুলো দেশবাসীকে সাহসের সমাচার শুনিয়েছে। এ কারণে সেদিন মধ্যরাতে পাকিস্তানি বাহিনীর অভিযানের অন্যতম লক্ষ্যবস্তু ছিল পড়লে সংবাদপত্র। সেদিন রাতেই পিপল অফিস জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। এরপর ২৬ মার্চ ইত্তেফাক ও ২৭ মার্চ সংবাদ অফিস পুড়িয়ে দেয় দখলদার বাহিনী। সাংবাদিক শহীদ সাবের ‘সংবাদ’ অফিসেই অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান।

আরও পেছনে গেলে আমরা দেখতে পাই, আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিবষদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। আজাদ-এ বিশেষ ক্রাড়পত্রও বের হয়েছিল তাঁরই উদ্যোগে। ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ও সংবাদ সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরী দৌর্দন্ড প্রতাপশালী শাসক আইয়ুব খানকে মুখের ওপর কথা শুনিয়ে দিতেও দ্বিধা করেননি।

একাত্তরে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর থাবা এড়িয়ে যেসব সাংবাদিক নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে পেরেছেন তারা কেউ মুজিবনগরে, কেউ মুক্তাঞ্চলে গিয়ে পত্রিকা বের করেছেন। এসব পত্রিকায় নিয়মিত মুক্তিযুদ্ধের ও মুক্তিযোদ্ধাদের খবর থাকত। উদ্বাস্তু পরিবেশে, ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই পত্রিকাগুলো স্বাধীনতাকামী গণমানুষের মনোবল উজ্জীবিত রাখতে সক্ষম হয়েছে। মুক্তাঞ্চল থেকে অনেকগুলো পত্রিকা বের হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল- জয় বাংলা, রণাঙ্গন, মুক্তবাংলা, স্বাধীন বাংলা, নতুন বাংলা, বাংলার বাণী, বাংলাদেশ, বিপ্লবী বাংলাদেশ, দাবানল, স্বদেশ, জাগ্রত বাংলা, মুক্তিযুদ্ধ, অগ্রদূত, বাংলার মুখ, সাপ্তাহিক বাংলা, বঙ্গবাণী, মুক্তি, অগ্রদূত, দেশ বাংলা, অভিযান, সোনার বাংলা, জন্মভূমি, দাবানল, সংগ্রামী বাংলা, The nation, Bangladesh প্রভৃতি। মুক্তিযুদ্ধকালীন সংবাদপত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে শিক্ষক-গবেষক সুব্রত শঙ্কর ধর লিখেছেন, একিট জাতির স্বাধীনতা সংগ্রাম ও তার জন্ম যন্ত্রণার মুহূর্তগুলো এসব পত্রিকায় চিত্রিত হয়েছে যথেষ্ট বিশ্বস্ততার সাথে। পরিবেশিত সংবাদের সঠিকত্ব বিচারেই শুধু নয়, একটি জাতির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষার সাথে জড়িত যে আবেগ তার প্রতিফলনেও সেই বিশ্বস্ততা বিচার্য। (বাংলাদেশের সংবাদপত্র, সুব্রত শঙ্কর ধর)

দেশভাগের আগে ঢাকায় প্রতিনিধিত্বশীল কোনো পত্রিকা ছিল না। মুসলিম লীগের মুখপত্র হিসেবে পরিচিত আজাদ, ইত্তেহাদও মিল্লাত বের হতো কলকাতা থেকে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম দেশ ভাগের পরও কলকাতায় থেকে যান।

১৯৪৮ সালে আজাদ ঢাকায় স্থানান্তরিত হওয়ার পরও ইত্তেহাদ ও মিল্লাত কলকাতায় থেকে যায় এবং কিছু দিন পর বন্ধ হয়ে যায়। সোহরাওয়ার্দীর অনুসারীরা ঢাকায় চলে এলেও তিনি সেখানে থেকে যান। সোহরাওয়ার্দী ছিলেন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ও জনপ্রিয় নেতা । কিন্তু জিন্নাহ তাঁকে বাদ দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী করেন খাজা নাজিমউদ্দীনকে। তিনি মুখ্যমন্ত্রী হয়েই সোহরাওয়ার্দীর পূর্ব পাকিস্তানে আসার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। পাকিস্তানে স্থায়ী ঠিকানা নেই- এই অজুহাতে পরে তাঁর গণপরিষদের সদস্যপদও বাতিল করা হয়। আবুল হাশিম পশ্চিমবঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নেন এবং পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিরোধী দলের নেতার দায়িত্ব নেন। তিনি পূর্ববঙ্গে আসেন পঞ্চাশের দাঙ্গার সময়।

পাকিস্তান আমলে প্রথম বিরোধী দলীয় মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক ইত্তেফাক। অন্যদিকে ইত্তেহাদ, মিল্লাত ঢাকায় নতুন করে প্রকাশিত হলেও স্থায়ী হয়নি। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে আমরা ইত্তেফাক প্রকাশের পটভূমি জানতে পারি। তিনি লিখেছেন,

“একদিন ভাসানী সাহেব ও আমি কোর্টে যেতে দেখি মানিক ভাই দাঁড়িয়ে আছেন, আমাদের সঙ্গে সাথে দেখা করার জন্য। আলাপ-আলোচনা হওয়ার পরে মানিক ভাই বললেন, না না অসুবিধায় অছি, আমাদের দিকে খেয়াল রাখার কেউই নাই। আমি কি আর করতে পারব, একটা বড় চাকরি পেয়েছি করাচিতে চলে যেতে চাই, আপনারা কী বলেন? আমি বললাম, মানিক ভাই, আপনিও আমাদের জেলে রেখে চলে যাবেন? আমাদের দেখবার কেউ বোধহয় থাকবে না। ...মানিক ভাই কিছুক্ষণ কিছু সময় চুপ করে থেকে আমাদের বললেন, না যাব না, আপনাদের রেখে।”

এরপর বঙ্গবন্ধু যোগ করেন, “মাওলানা সাহেব সাপ্তাহিক ইত্তেফাক কাগজ বের করেছিলেন। কয়েক সপ্তাহ বের হওয়ার পরে বন্ধ হয়ে যায়। কারণ টাকা কোথায়? মওলানা সাহেব বললেন, কাগজটা তো বন্ধ হয়ে গেছে, যদি পার তুমি চালাও। মানিক ভাই বললেন, কী করে চলবে, টাকা কোথায়? তবুও চেষ্টা করে দেখব। আমি মানিক ভাইকে আমার এক বন্ধু কর্মচারীর কথা বললাম। ভদ্রলোক আমাকে আপন ভাইয়ের মতো ভালোবাসতেন। কলকাতায় চাকরি করতেন, সোহরাওয়ার্দী সাহেবের ভক্ত ছিলেন। বাংলাদেশের বাসিন্দা নন, তবু বাংলাদেশকে ও তার জনগণকে তিনি ভালোবাসতেন। আমার কথা বলল কিছু সাহায্য করতেও পারেন। মানিক ভাই পরের মামলার তারিখে বললেন যে কাগজ তিনি চালাবেন।” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান)

এই দীর্ঘ উদ্ধৃতি দেওয়ার কারণ তখন রাজনীতি ও সংবাদপত্রের মধ্যে সম্পর্কটা যে কত নিবিড় ছিল সেটা বোঝানো। মানিক মিয়া ও ইত্তেফাকের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্ক আমৃত্যু অটুট ছিল। আনুষ্ঠানিকভাবে না হলেও মানুষ ইত্তেফাককে আওয়ামী লীগের মুখপাত্র ভাবত। ১৯৫১ সালের ১৭ মে যে সংবাদ বের হয়; তার পেছনেও ছিল মুসলিম লীগ। নূরুল আমিন তখন মুখ্যমন্ত্রী। সরকারের সমর্থনেই পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়েছিল।

অবিভক্ত পাকিস্তানের বয়স ছিল ২৩ বছর। এর মধ্যে সামরিক শাসকেরা ক্ষমতায় ছিলেন ১৩ বছর। আর সামরিক শাসনের মধ্যে সাংবাদিকদের কাজ করা ছিল অনেকটা কুমির পোষা পুকুরে সাঁতার কাটার মতো। প্রত্যেক সামরিক শাসকই ক্ষমতায় এসে সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধের চেষ্টা করেন। ভাবেন সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের বশ করতে পারলেই সারা দেশের মানুষ ঠান্ডা হয়ে যাবে। সব দেশেই সামরিক শাসকেরা প্রথমে কিছু লোকদেখানো গণমুখী কাজ করেন, যেমন সামরিক আদালতে দ্রুত অভিযুক্ত ব্যক্তির বিচার, কালোবাজারীদের বিরুদ্ধে অভিযান, পরিচ্ছন্নতা অভিযান ইত্যাদি।

আইয়ুব খান ক্ষমতায় এসেই ১৯৫৬ সালের সংবিধান রহিত ও রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ করেন। সংবিধান রহিত করা মানে মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করা। সংবিধান রহিত সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ। এ অবস্থায় সাংবাদিকতা করা ছিল অত্যন্ত কঠিন। পাকিস্তান আমলে বেশিরভাগ সংবাদপত্র প্রকাশ হতো রাজনৈতিক দল ও দর্শনের মুখপত্র হিসেবে। আবার অনেকে রাজনীতির মাঠ থেকে সরাসরি সাংবাদিকতায় এসেছেন। ফলে জেলখানা ও সংবাদপত্র অফিসের মধ্যে দূরত্ব খুব বেশি ছিল না।

পাকিস্তান আমলে জেলখাটা সাংবাদিকদের মধ্যে ছিলেন তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, কেজি মুস্তাফা, ফয়েজ আহমদ, কামাল লোহানী, রণেশ দাশগুপ্ত, সন্তোষ গুপ্ত, সত্যেন সেন, নির্মল সেন, আলী আকসাদ প্রমুখ। তবে সবাই সাংবাদিকতার জন্য জেল খাটেননি। অনেকে রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন।

সামরিক শাসনামলের সাংবাদিকতার চালচিত্র ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কামাল লোহানী লিখেছেন, ‘মৌলিক গণতন্ত্রের নির্বাচনের (বেসিক ডেমোক্রেসির ইলেকশনের) পরে আইয়ুব খান আদমজীতে দাঙ্গা বাধানোর চেষ্টা করছে, এমনকি সারা দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তৈরির চেষ্টা করছে তখনো সম্পাদক ও সংবাদপত্রের এমনই বিশাল ভূমিকা ছিল। তোপখানা রোডে আহমদুল কবিরের (সংবাদ-এর মালিক) অফিসকে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা প্রতিরোধ অফিস বানানো হয়। ওখানেই সব কর্মসূচি গ্রহণ করা হতো, লিফলেট ছাপানো হতো। ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’ অভিন্ন শিরোনামে সংবাদ, ইত্তেফাক ও আজাদ পত্রিকায় প্রথম পাতায় সম্পাদকীয় ছাপা হয়। ঢাকা শহরে মিছিলও বের করা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাড়াও’ ব্যানার নিয়ে, যাতে সাংবাদিক, রাজনীতিকসহ সর্বস্তরের মানুষ ছিলেন।’