কেন লিখি

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

কেন লিখি- এ প্রশ্নের দু’টি জবাব খুবই সহজ ও স্বাভাবিক। একটা জবাব হলো না লিখে পারি না, আরেকটা জবাব হবে লেখা অভ্যাস হয়ে গেছে। দু’টি জবাবই আমার ক্ষেত্রে সত্য। আমি লিখি, না লিখে উপায় নেই বলে, আর লিখতে লিখতে এমন অভ্যাস হয়ে গেছে যে, না-লিখে পার পাই না। আরও একটা কারণ আছে, সেটা হলো লেখার চাইতে ভালো কোনো কাজ আমার জানা নেই। কিন্তু লেখা আমার জন্য বিনোদন নয়, একটা লেখা যখন শেষ করি তখন আনন্দ পাই ঠিকই, কিন্তু লিখতে কষ্ট হয়। আর একটা কথা। লেখার পরে লেখাটা পড়তে গিয়ে কাজটা শেষ করতে পারার আনন্দ কিছুটা ফিকে হয়ে যায়; মনে হয় ঠিক হয়নি, যা বলতে চেয়েছিলাম তা বলতে পারিনি; চিন্তা ও অনুভবকে ভাষায় ঠিক মতো নিয়ে আসতে ব্যর্থ হয়েছি। সন্তুষ্ট হই না। আর ওই সন্তুষ্ট না-হওয়ার মুখোমুখি হয়ে মনে হয় আমার লেখার পেছনে আসল কারণটা হচ্ছে অসন্তোষ। আমি সন্তুষ্ট নই। আমার লেখার অন্যসব কারণের পেছনে লুকিয়ে আছে একটা অসন্তোষ, অসন্তোষই আমাকে চালায়। আমিই খুবই অসন্তুষ্ট; নিজের লেখা নিয়ে তো অবশ্যই, তার চেয়েও বেশি অসন্তুষ্ট বিদ্যমান ব্যবস্থা নিয়ে। আমার মনে হয় যা ঘটছে তা সঙ্গত নয়, ঘটনার ভেতরে অন্যায় আছে, আর সেই অন্যায়টা দূর করা দরকার। মনে হয় সেটাই প্রধান ব্যাখ্যা আমার এই লেখালেখির।

আমার প্রয়াত পিতা বলতেন ছেলেটা কিছুতেই খুশি হয় না। খুব একটা ভুল বলেন নি। তবে আবার যে সম্পূর্ণ সত্য বলেছেন এমনও নয়। কারণ খুশি হই নি যে এমন নয়; অনেক ঘটনা অবশ্যই ঘটেছে যেগুলো আমাকে খুশি করেছে; সে-খবর তিনি যে রাখতেন না এমনও নয়; তবে আমি সব সময়েই যে অসন্তুষ্ট ছিলাম এটা খুবই ঠিক। খুঁত খুঁত করতাম না, ও কাজকে মনে হতো অভদ্রতা; কিন্তু ভেতরে ভেতরে টের পেতাম যে অবস্থাটা আমার মনঃপূত নয়। আমার পিতাকে সেটা বলা হয় নি। সুযোগ ছিল না বলবার। বললে কাজটাকে মনে হতো অকাল পরিপক্বতা। অকালে পেকে যাওয়াকেও মোটেই রুচিকর ব্যাপার বলে ভাবতে পারি নি। প্রশ্ন করতাম? না। সাহস ছিল না প্রশ্ন করবার। কার কাছে যে করবো সেটাও তো জানতাম না; কিন্তু টের পেতাম খুশি না-হবার যেসব ঘটনাগুলো ঘটছে সেগুলো ঘটা উচিৎ নয়। কেন যে উচিৎ নয় সে নিয়ে কারো সঙ্গে আলাপ করবার সুযোগ ছিল না। কেউ বলেও দিতো না। সে জন্যই বোধ করি লেখার দিকে ঝুঁকেছিলাম। আত্মপ্রকাশের প্রবল চাপের চেয়েও অসন্তোষের অস্বস্তিই কাজ করেছে, অধিক পরিমাণে। বলা যেতে পারে আত্মপ্রকাশের তাড়াটাও আসলে অসন্তুষ্টির সঙ্গেই যুক্ত।

আমি অসঙ্গতিগুলো দেখতাম। দেখে ভেতরে ভেতরে রেগে যেতাম। রাগটা আসলে ছিল গোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। মনে হতো গোটা ব্যবস্থাটাই অন্যায়। অসঙ্গতিগুলো ব্যবস্থা থেকেই উৎপন্ন। একদিক দিয়ে আমার বয়োঃবৃদ্ধির ইতিহাস ব্যবস্থাটাকে চিনবারই ইতিহাস। ভেতরের বোধ ক্রমশ স্পষ্ট হয়েছে। ব্যবস্থাটাকে নিয়ে যে ভীষণ ক্রোধ প্রকাশ করবো সে-কাণ্ড অবশ্য কখনোই ঘটে নি। অল্পবয়সে তো নয়ই, পরিণত বয়সেও নয়। না, সে-সাহস আমার ছিল না। সাহস থাকলে, এবং ক্রোধ যদি ভীষণ হতো তবে, হয়তো ব্যঙ্গ রচনায় হাত দিতাম। পারি নি। কৌতুক করেছি কিছুটা। তাও প্রত্যক্ষ কৌতুক নয়, অনেকটা অপ্রত্যক্ষ; তাতে প্রসন্নতা থাকতো।

তা অসন্তুষ্ট হলেই লিখতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। অসন্তোষকে নিজের ভেতর চেপে রাখা যায়, পারা যায় আর পাঁচজনের সঙ্গে ঘরোয়া বৈঠকে প্রকাশ করা, যে-প্রকাশের অপর নাম আড্ডা দেওয়া। দুটোর কোনোটাই পারি নি বলেই লিখতে চেষ্টা করা। লেখার ভেতর দিয়ে ইচ্ছাটা ছিল অন্যের কাছে পৌঁছে যাওয়া, নিজের অনুভব ও চিন্তাকে সামাজিক করে তোলা। লেখা জিনিসটা তো আসলে সামাজিকীকরণই। যাঁরা লেখেন, কিন্তু প্রকাশ করেন না; ডায়েরিতে, কিংবা চিঠিপত্রেই সীমাবদ্ধ থাকেন, তাঁদের কাজটাও সামাজিকই। ডায়েরি অবশ্য মানুষ নিজের জন্যই লেখে, কথোপকথনটা চলে নিজের সঙ্গে নিজের, কিন্তু ওই যে লিপিবদ্ধ হওয়া তার কারণে তো নিজের একান্ত সীমা থেকে বের হয়ে যাওয়া, চলমান ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত হওয়া, ইতিহাসের কিছু উপাদান রেখে যাওয়ার একটা গোপন ইচ্ছা। সামাজিক হওয়ার এই যে ইচ্ছা এখানেই থাকে মানুষের মনুষ্যত্বের উপাদান ও প্রতিশ্রুতি। পাখি গান গায় হয়তো অন্য পাখির জন্যই, কিন্তু পাখি একটা বৃত্তের ভেতর রয়ে যায়, সেটা ভেঙে বের হতে পারে না, ওই খাঁচাটা তার সঙ্গেই রয়ে যায়। গানের পাখিটা তাই সামাজিক হতে পারে না, মানুষ যেটা পারে। কাজ এবং কথার ভেতর দিয়ে তো অবশ্যই, লেখার ভেতর দিয়ে আরো বেশি করে মানুষ মানুষ হয়ে ওঠে। আমার নিজেরও ওই কাজ।

বৃত্তের কথাটা উঠলো। বৃত্ত জিনিসটা দেখতে পাচ্ছি আমার লেখার ভেতর বেশ ভালোভাবেই জায়গা করে রেখেছে। ‘অনতিক্রান্ত বৃত্ত’ আমার একেবারে প্রথম জীবনের একটা বইয়ের নাম। পরে আরেকটা বইয়ের নাম হয়েছে ‘বৃত্তের ভাঙা-গড়া’; তারপরে লেখা হয়েছে ‘সেই অখন্ড বৃত্তে’। অনুক্রমটা আপতিক নয়। বৃত্ত অতিক্রম করতে হবে এটা প্রথমে ভেবেছি, পরে দেখেছি বৃত্তের ভাঙা-গড়ার কাজটা সমাজে ও সংস্কৃতিতে চলছেই, তবে দেখা যাচ্ছে বৃত্ত থেকেই যাচ্ছে। একটা বৃত্ত থেকে বের হয়ে আরেকটা বৃত্তে পদার্পণ ঘটছে। বৃত্তটা বড় হয়, কিন্তু উধাও হয় না। হবেও না। হওয়ার দরকারও নেই। বৃত্তটা খুব বড় হোক, সর্বজনীন হোক এটাই কামনা। অন্য প্রাণির বৃত্তটা প্রাকৃতিকভাবেই ছোট, মানুষের বৃত্তটা প্রধানত মানুষই তৈরি করে, করতে হয়; কিন্তু সেটা যেন ছোট না হয়। এই চাওয়াটাই দেখছি আমার লেখার মূল সুর। কিশোর বয়সে একটা কবিতা পড়েছিলাম, তাতে একটি পঙ্ক্তি ছিল, ‘বড় ছোট হয়ে আছি আমরা, মশারীর ভেতর আছি’; পঙ্ক্তিটি মনে ধরেছিল, এবং আজও মনে আছে। সেকালে ঢাকা শহরে মশাদের প্রতাপ ছিল দুর্দান্ত, তাদেরকে পরাস্ত করা ছিল অসম্ভব। সে জন্য আত্মরক্ষার প্রয়োজনে মশারীর ভেতরে আশ্রয় নিতে হতো। আত্মরক্ষার এই কাজটা নানান অর্থে সত্য। বৃত্ত সঙ্কুচিত হয়ে মশারী হয়ে যায়, আরো ছোট হয় যখন তখন নিজেই আটকা পড়ে যাই নিজের ভেতর, সমাজ বিচ্ছিন্নতা পরিণত হয় আত্ম-বিচ্ছিন্নতায়, সে ব্যাপারটা সুখকর তো নয়ই, স্বভাবগতভাবেই ভয়াবহ।

ছেলেবেলায় আমার দুঃস্বপ্নগুলোর মধ্যে একটি ছিল হারিয়ে যাবার। ঘুমের ভেতর আঁতকে উঠতাম, দেখতাম খুব বড় একটা প্রান্তরে আমি একাকী দাঁড়িয়ে আছি; প্রান্তটা বড় হচ্ছে, কেবলই বাড়ছে, আর আমার ভেতর দেখা দিচ্ছে আতঙ্ক। আতঙ্কে ঘুম ভেঙে যেত। হয়তো চিৎকারও করতাম, নিঃশব্দে। বিচ্ছিন্নতার ওই ভয়টা আমার ভেতর আছে। সকলের ভেতরেই থাকে। মানুষ একাকীত্ব কখনো কখনো পছন্দ করে, কিন্তু সেটা যদি বাধ্যতামূলক হয়, আর স্থায়ী হয়ে যায়, তাহলে মস্ত বিপদ। তখন প্রবণতাটা ঠিক আত্মহত্যার না হোক দুর্বিষহ যন্ত্রণায় অতিষ্ঠতার যে তাতে সন্দেহ কী। আমার আতঙ্ক ও বিচ্ছিন্নতাতে। হারিয়ে যাওয়ার সেই শৈশবিক অনুভূতিটা আমার পিছু ছাড়ে নি। এটি অবশ্য সবার জন্যই সত্য; কম আর বেশি। আমার যেহেতু অভ্যাস আছে লেখার তাই বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে লিখি। ‘বিচ্ছিন্নতায় অসম্মতি’ নামে আমার বইও আছে একটা। ওখানে যে অসম্মতি সেটা অন্যত্রও কার্যকর। বিচ্ছিন্ন হতে অসম্মত হওয়াটা লেখার পেছনেও একটা কারণ ঘটে। এই বিশেষ ক্ষেত্রে অসম্মতি, অন্য ক্ষেত্রে অসন্তোষ, এই দু’য়ে মিলে আমাকে অস্থির রাখে।

সুরের কথা, গানের কথা এই লেখাটিতে এসেছে। স্বরের কথাও আসতে চায়। আমি দেখেছি স্বর কখনো উঁচু করতে পারি না। ভদ্রতা? তা হবে। সাহসের অভাব? হ্যাঁ, সেটাই মনে হয় প্রকৃত কারণ। ভীতিই ভদ্রতার আসল নিয়ামক। এটা সকলের ব্যাপারেই সত্য, সত্য আমার ব্যাপারেও। ভয় পাই বিচ্ছিন্নতার। এই বোধটাও কাজ করে যে উঁচু গলায় কথা বললে আলাদা হয়ে যাবো অন্যদের থেকে। অন্যরা ভাববে মস্ত কেউ হয়ে উঠেছি, ছাপিয়ে উঠতে চাচ্ছি সবাইকে, হটিয়ে দিচ্ছি অন্যদেরকে। দায়িত্ব নিচ্ছি বক্তব্যটাকে অন্যের ওপর চাপিয়ে দেবার, আর দেখা যাবে সে-কারণে পরিস্থিতিটা দাঁড়াচ্ছে বিরক্তিকর হয়ে ওঠার। ও কাজ বড়ই অপ্রীতিকর। কিন্তু তবু বক্তব্যটা তো থাকে। সেটা তৈরিও হয়। ব্যস্ত তার নির্মাণকার্য। তাই তাকে প্রকাশ করাটা দরকার। প্রকাশ করতে থাকি, তবে স্বর উঁচিয়ে নয়। যাদের জন্য লিখেছি তাদেরকে কাছে নিয়ে আসতে চাই, দূরে সরিয়ে না-দিয়ে। যে জন্য আমি অনেক লেখা ছদ্মনামে লিখেছি। লেখকের নাম দিয়েছি ‘গাছপাথর’, ‘নাগরিক’, ‘মিতভাষী’, ইত্যাদি। আহমদ ফারুক, সেলিম চৌধুরী নামেও লেখা পাওয়া যাবে, খুঁজলে। ওদিকে আমি পত্রিকা সম্পাদনাও করেছি অনেক ক’টি; তাদের ভেতর ত্রৈমাসিক ও মাসিক পত্রিকা তো ছিলই, আছেও; এমনকি সাপ্তাহিক পত্রিকাও ছিল। সেখানেও, ওই পত্রিকা-সম্পাদনাতেও, নিজেকে প্রচ্ছন্ন রাখার ব্যাপারটা থাকতো বৈকি। ভেবে দেখেছি, ছিল কিছুটা আমলাতান্ত্রিকতাও। যতই যা বলি না কেন আমাদের রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতিটা তো আমলাতান্ত্রিকই, সামাজিক সংস্কৃতিতেও তার দুর্বিনীত উপস্থিতি। সম্পাদকের টেবিলে যিনি বসছেন তাঁর ভেতর আমলা থাকেন একজন, কিন্তু আমি ভাবতে ভালোবেসেছি যে অনিবার্য সেই আমলাতান্ত্রিকতাকে আমি চেষ্টা করেছি লঙ্ঘন করতে। ভাবতে ভালো লাগে যে সম্পাদক হিসেবে আমি অন্যের লেখা নাকচ করেছি কম; লেখা আহ্বান করেছি সর্বক্ষণ। আর আমার প্রবণতা ছিল প্রতিষ্ঠান গড়ার, পত্রিকাকেও আমি প্রতিষ্ঠান হিসেবেই দেখেছি। যেখানে অনেকে আসবে, মিলবে, মিশবে, ব্যস্ত হবে সৃষ্টিশীলতায়। হিসেব করে দেখলাম আমার সম্পাদনার সবক’টি পত্রিকার প্রতিষ্ঠার সঙ্গেই আমি যুক্ত ছিলাম; পত্রিকাগুলোর কোনোটাই আগে ছিল না, গড়েপিটে দাঁড় করাতে হয়েছে। আমার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের দখলদারিত্বের ব্যাপারে কিন্তু ভেতর থেকেই ছিল অনীহা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের একবার আমাকে ডীন নির্বাচিত হতে হয়েছিল, দু’বছর পরে কার্যকাল যখন শেষ হলো তখন বুঝলাম ওই কাজের আমি যোগ্য নই। তার অল্প কিছুদিন পরে নির্বাচিত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়াটাও প্রায় অনিবার্যই হয়ে পড়েছিল; কোনো মতে এড়াতে পেরে ভেবেছি ‘বাঁচা গেল’।

সব লেখকের লেখার ভেতরই একটা সুর থাকে, থাকে একটা স্বরও। ধরে নিচ্ছি তারা আছে আমার লেখার ভেতরেও। স্বরটা কতটা নিজস্ব নিশ্চিত নই, সুরটাকে খুব নিজের বলে মনে হয়। এই সুর জিনিসটা গানের যেমন, তেমনি কবিতার, আবার গদ্যেরও। গান আমার লেখা হয় নি, গাওয়া হয় নি, কিন্তু গদ্য যে লিখেছি তার ভেতরও, ভাবতে ভালোবাসি, একটা সুর আছে। সেটা নিজস্ব। অন্যরা টের পান না পান, আমি পাই। কিন্তু ওই সুরকে আমি কবিতাতে নিয়ে যেতে পারি নি।

আসলে কবিতা আমি লিখিই নি। এমনকি কৈশোরেও নয়। কারণ কী? কল্পনাশক্তির দুর্বলতা? তা কিছুটা তো বটেই। তবে আসল কারণ কিন্তু ভয়। আমার ভয় ছিল ছন্দমেলানোর ব্যাপারে। মনে হয়েছে পারবো না। অথবা পারলেও সে মিলের গায়ে ছাপ থাকবে কষ্টের। চতুর্দিকে এতো অমিল, গরমিল, গোঁজামিল যে তার ভেতর নতুন কষ্টমিল কিংবা ছন্দপতন যোগ করাটা বিড়ম্বনার ব্যাপার হবে ধরে নিয়ে কিছুটা যে কৌতুক অনুভব করিনি এমনও নয়। মনে পড়ে ক্লাস টেনে যখন পড়ি সেই সময়ে ‘দিলরুবা’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা বেরুত, তার প্রথম সংখ্যাতে পত্রিকার সম্পাদক কাজী মোতাহার হোসেন নবীন লেখকদের জন্য কয়েকটা পরামর্শ দিয়েছিলেন, যেগুলোর মধ্যে একটা ছিল এই মর্মে যে বাংলা কবিতা ইতিমধ্যেই এমন একটা উৎকর্ষে গিয়ে পৌঁছে গেছে যে সেখানে নবিশি না-করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। সেটা আমিও বুঝতাম। তদুপরি এটাও দেখেছি যে, আমার যেসব বক্তব্য প্রকাশের পথ খুঁজছে সেগুলোকে কবিতার ছোট পরিসরে ধরাতে গেলে ঠাসাঠাসির এমন একটা ঘটনা ঘটবে যেটা কবিতা ও বক্তব্য কারো জন্যই সুবিধাজনক হবে না। এসব বিবেচনায় কবিতার পথ মাড়ানো হয়নি।

তাই বলে গদ্যরচনা কি সহজ কাজ? সাংবাদিকের মতো লেখা হয়তো কিছুটা সহজসাধ্য, কিন্তু যে গদ্য সাহিত্য হিসেবে বিবেচ্য হতে চায় তার পেছনে বিস্তর শ্রম, মেধা ও বক্তব্য থাকা প্রয়োজন। সেটা তো গেল, কিন্তু জিজ্ঞাসা থাকে যে গদ্যের ভেতর যেটা সবচাইতে বেশি কার্যকর ও স্থায়ী মূল্যে মূল্যবান সেই কথাসাহিত্যের পথে গেলাম না কেন। একেবারেই যে যাই নি তা নয়; গিয়েছিলাম। গল্প দিয়েই আমার লেখকযাত্রা শুরু, তারপরে উপন্যাসও লিখেছি দু’টি; কিন্তু কথাসাহিত্যে স্থির থাকতে পারি নি। কারণ একাধিক। একটি হলো অভিজ্ঞতার স্বল্পতা, অপরটি বিদ্যমান ব্যবস্থাকে মেনে না-নেওয়া। দ্বিতীয় ব্যাপারটা কম গুরুতর নয়। আমি দেখেছি কথাসাহিত্য যারা চর্চা করেন তাঁরা যে অবস্থাটা আছে, এবং আপাতত বদলাচ্ছে না সেটাকে মেনে নিয়ে ব্যবস্থার ভেতরে বসবাসকারী মানুষদের জীবনযাপনের খোঁজ নেন, তাদের সুখের খবর রাখেন, গভীরভাবে রাখেন দুঃখের খবর, এবং ওই মানুষদের সুখ-দুঃখের উন্মোচন ঘটান সাহিত্যে। আমার সমস্যা ওপরের ওই ব্যবস্থাটা নিয়েই। ব্যবস্থাটিকে আমার অন্যায় বলে মনে হয়। তাকে আমি দু’ঘা বসিয়ে দিতে চাই। তাই আমার রয়ে যাওয়াটা ঘটে ওই উপর কাঠামোতেই, ভেতরে যাওয়াটা যে মাত্রায় প্রয়োজন সে-মাত্রায় যাওয়া হয় না।

আমি হাত লাগিয়েছি নাটক লেখাতেও, কিন্তু সে-লেখাও এগোয় নি। এখানেও কারণটা এই রকমের যে নাটকে দ্বন্দ্ব থাকে, বস্তুত দ্বন্দ্ব ছাড়া তো নাটকই নেই; সেখানে নাট্যকারের অবস্থানটা হওয়া চাই নিরপেক্ষতার; নইলে নাটক জমবে কোন প্রকারে? আমার ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা অর্জন ও সংরক্ষণ দু’টোই ছিল কঠিন কাজ। ন্যায়-অন্যায়ের যখন যুদ্ধ চলে তখন নিরপেক্ষ থাকি কীভাবে? নাটক বলি কি উপন্যাসই বলি, শ্রেষ্ঠ রচনাগুলো তো সবসময়েই হয়ে পড়ে বিয়োগান্ত। যে পক্ষ শুভ সে ন্যায়বিচার পায় না, অশুভই জয়ী হয়। এই বেদনাদায়ক বাস্তবতা জীবনে সত্য, তাই সাহিত্যেও তার উপস্থিতি অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু শুভের দুর্দশাকে ফুটিয়ে তুলতে গেলে আমার খুবই কষ্ট হতো, মনে হতো আমার কর্তব্য তো শুভের পক্ষে দাঁড়িয়ে অশুভের বিরুদ্ধাচরণ করা। নৈর্ব্যত্তিক থাকলে তো চলবে না। নিরপেক্ষ বলে তো কোনো অবস্থান নেই। তাহলে? ছেলেমানুষি সরলতা? হয়তো তাই; হয়তো স্থূলতাও। তবে ওটি আমার ভেতর রয়ে গেছে, যে জন্য কথাসাহিত্য ও নাটক তৈরির ব্যাপারে আমার আর এগোনো হয় নি, রণে ভঙ্গ দিতে হয়েছে। আমার লেখালেখির উদ্দেশ্য দাঁড়িয়েছে অন্যায্য বিদ্যমানকে আঘাত করা। আঘাত করার কাজটা ভেতর থেকে, মানুষের যন্ত্রণার ও আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে মানুষের চারপাশের ব্যবস্থার দ্বন্দ্বকে তুলে ধরতে পারলে যে আরো ভালো ভাবে করা হয় তার প্রমাণ তো সাহিত্যেই রয়েছে; কিন্তু আমি দেখলাম আমার আঘাত মূলত ওপরেই, ভেতরে ঢুকতে পারাটা কর্তব্য ছিল কিন্তু সেটা করতে পারিনি। আমার লেখা নৈর্ব্যক্তিক হয়েও হতে চায় না, কোনো না কোনোভাবে আমার পক্ষপাতটা বেরিয়ে পড়ে। এমনকি গবেষণামূলক যে রচনা লিখেছি সেখানেও পক্ষপাত আছে। আসলে আমার কোনো রচনাই উপসংহারবিহীন নয়, এবং উপসংহারে আমার ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দটা ঠিকই চলে এসেছে। খাঁটি শিল্পীদের বেলায় ব্যক্তি যেভাবে অবলুপ্ত হয়ে যায় স্রষ্টার ভেতরে আমার ক্ষেত্রে সেটা ঘটে নি। সেটা ঘটলে খাঁটি শিল্পী হতাম, যেটা আমি মোটেই নই। ওই যে ব্যবস্থার পরিবর্তন চাওয়া, সেই চাওয়ার সঙ্গে আমি ব্যক্তিগতভাবে জড়িত; ব্যবস্থাকে আমি ব্যক্তিগতভাবেই শত্রু বলে মনে করি; আমার লেখায় তার কোনো রকমের সর্বনাশ হবে এমন কোনো সম্ভাবনা নেই ঠিকই, কিন্তু তাই বলে তাকে আঘাত করতে ছাড়বো কেন? এখানে পরাজয়ের তো কোনো স্থান নেই। দ্বন্দ্বটা তো জীবন-মৃত্যুর; বাঁচা কিংবা মরার। আপোসের সুযোগ কোথায়?

ওই দ্বন্দ্বের কথা আমার লেখার ভেতর আছে। প্রতিপক্ষ সেখানে সর্বদাই উপস্থিত, তা সে যে রূপেই হোক না কেন, এমনকি যদি অপ্রত্যক্ষ হয় তবেও। অনেক সময়েই সে আসে প্রশ্নের আকারে, পাল্টা যুক্তির রূপ নিয়ে। আমার বক্তব্য ও বক্তব্যের প্রতিপক্ষের ভেতর যে ঝগড়া বাঁধে তা নয়, তবে দ্বন্দ্বটা চলে। আর আমার এইসব লেখার ভেতর যেটুকু প্রাণবন্ততাটা থাকে তার উৎস হচ্ছে ওই তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব। প্রাণবন্ততার জায়গাতে ওজস্বিতাও যে আসে না, তা নয়। কিন্তু আমি ওজস্বী হতে চাই না; যেমন হতে চাই না যান্ত্রিক কিংবা বিষণœ, অথবা হতাশাগ্রস্ত। আত্মকরুণায় যে দগ্ধ অথবা সিক্ত হবো সেটাও পারি না।

ওজস্বিতার পরিমাণটা অবশ্য সব সময়েই কম ছিল, মূল ভঙ্গিটা শুরু থেকেই ছিল আলাপচারিতার। পেশাগতভাবে আমাকে ক্লাসরুমে এবং তার বাইরেও হামেশাই ‘বক্তৃতা’ দিতে হয়েছে, এখনও হয়; কিন্তু নিজেকে আমি বক্তা হিসেবে দেখতে পাইনি, কথক হিসেবেই দেখতে চেয়েছি ও পেয়েছি। সাফল্য-ব্যর্থতা অবশ্য ভিন্ন প্রশ্ন। জীবন ও জীবিকা আমার জন্য যে আলাদা ছিল না, ছিল পরস্পর জড়িত সেটা আমার এক সৌভাগ্য। জীবিকা যদি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তো জীবিকা থেকে তবে সেটা দুঃখজনক হতো তো বটেই ক্ষতিকরও হতো।

ছিল প্রসন্নতাও। দায়িত্ব পালন করেছি ঠিকই, কিন্তু তাতে কোনো গ্লানি ছিল না। কাজটা বরং উপভোগই করেছি বলা চলে। প্রশ্রয় দিয়েছি কৌতুকের বোধকেও।

কবিতা যে লিখবো না সে তো জানাই ছিল; কিন্তু কবিতার ছন্দস্পন্দ যদি গদ্যে আনা যায় তবে মন্দ কি? আরোপিত হয়ে নয়, আসুক সে ভেতর থেকেই। বাসনাটা ছিল এই রকমেরই। এবং আমি যুক্ত থাকতে চেয়েছি অন্যদের সঙ্গে, দল হিসেবে নয়। স্রোত হিসেবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা কখনোই দলনিরপেক্ষ ছিলাম না; আমাদের দল ছিল, দলীয় অবস্থান ছিল, কিন্তু নিজে আমি দলের পরিচয়ে পরিচিত হবো ভাবি নি, স্রোতের পরিচয়টিকেই বড় বলে জেনেছি। বলাই বাহুল্য স্রোতটা সমাজ-রূপান্তরের প্রচেষ্টার। এটা নিতান্ত আপতিক ঘটনা নয় যে ক্লাস রুমে পাঠদানের দায়িত্ব থেকে ছুটি পাবার সঙ্গে সঙ্গেই আমি যে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ায় ব্যস্ত হয়েছিলাম তার নামটা দাঁড়িয়েছিল সমাজ-রূপান্তর অধ্যয়ন কেন্দ্র। ওই নাম পূর্বচিন্তা থেকে আসেনি, এসেছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে, স্রোতের তাড়ানাতে। স্রোতটাকে চলতে হয়েছে প্রচলিতের বিপরীতে। অধিকাংশ মানুষই দেখা গেছে প্রচলিত স্রোতের পক্ষেই থাকে। তারা খুব যে সুখে থাকে তা নয়, কিন্তু বিদ্যমানকে মেনে নেয়। সে জন্য দেখা গেছে কখনোই আমরা দলে ভারি হতে পারি নি। সংখ্যালঘুই রয়ে গেছি। ওদিকে আবার বিরূপতার মুখে পড়তে হয়েছে; রাষ্ট্রীয়ভাবে যেমন, সামাজিক ভাবেও তেমনি। যেন বিধিলিপি।

অসন্তোষের কথা বলছিলাম। সভ্যতার ইতিহাস তো আসলে অসন্তোষেরই ইতিহাস। সন্তোষ দেখা দিলে সভ্যতা এগুতো না। কিন্তু ওই অসন্তোষটা কেবলমাত্র ব্যক্তিগত তো নয়ই, প্রধানতও ব্যক্তিগত নয়; হয়ে পড়েছে সমষ্টিগত, এবং যখন সে সমষ্টিগত হয়েছে তখনই ঘটেছে উত্তরণ, তার আগে নয়। সমষ্টির আঘাতে এবং সমষ্টির স্বার্থেই পুরাতন ব্যবস্থাটা ভেঙে পড়েছে।

আমার বয়স যত বেড়েছে অসন্তোষও বেড়েছে সেই পরিমাণেই। নিজের অসন্তুষ্টিকে আমি মেলাতে চেষ্টা করেছি সকলের অসন্তোষের সঙ্গে। চূড়ান্ত বিচারে আমার লেখালেখির পেছনের তাড়নাটা রয়েছে ওইখানেই। বয়ঃবৃদ্ধির সঙ্গে তাল রেখে ব্যবস্থার ত্রুটিগুলি চোখের সামনে ক্রমাগত পরিষ্কার হয়ে এসেছে। বাইরের চোখের শক্তি কমেছে, ভেতরের চোখের শক্তি বেড়েছে।

ব্যবস্থাটা যে পুঁজিবাদী আমার সেটা বোঝা হয়ে গেছে প্রায় শুরুতেই। তবে ভালোভাবে বোঝার ব্যাপারে অসুবিধা ছিল। পুঁজিবাদ নিজেকে নানাভাবে অস্পষ্ট করে রাখে। আর তাকে চিনবার জন্য যে সাহায্য এবং যে অনুশীলন দরকার ছিল সেটা মোটেই সহজলভ্য ছিল না। রাষ্ট্র তো বটেই সমাজও দীক্ষিত ছিল পুঁজিবাদেই। সাতচল্লিশে দেশ যখন তথাকথিত রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা পেলো তখন আওয়াজ উঠেছিল সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের। আমরা শুনতাম পূর্ববঙ্গের সাহিত্য কেমন করে পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য থেকে স্বতন্ত্র করা যায় সেই চেষ্টার কথা। দৃষ্টান্ত দেওয়া হতো আমেরিকান সাহিত্যের; বলা হতো সে-সাহিত্যে ইংরেজি সাহিত্যের মূলধারা থেকে কী ভাবে ও কী কারণে আলাদা হলো সেটা দেখতে হবে, এবং দেখে নিয়ে পূর্ববঙ্গের সাহিত্যে স্বতন্ত্র ধারা তৈরি করার চেষ্টা করা চাই। আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের মাঝখানে এটলান্টিক নামের একটা সমুদ্র আছে বললে জবাবে বলা হতো তাহলে আইরিশ সাহিত্য দেখো, আয়ারল্যান্ড তো গা ঘেঁষেই রয়েছে ইংল্যান্ডের, কিন্তু সাহিত্য তো আলাদা। জাতীয়তাবাদের বিষয়টা তুলে ধরা হতো। যে জাতীয়তাবাদ তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছিল সঙ্গতভাবেই তার নাম দেওয়া হয়েছিল পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদ। স্বাতন্ত্র্যটা আসবে এই জাতীয়তাবাদের কারণেই, চিন্তাটা ছিল এই রকমের। এর বিপরীত ধারায় যাঁরা সাহিত্যের চর্চা করতেন তাঁরা ছিলেন উদারনীতিক। তাঁরা গোটা বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্যকে সঙ্গে নিয়ে সাহিত্যচর্চা করবেন মনস্থ করেছিলেন। পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে এঁদের বিস্তর পার্থক্য। এঁরা ছিলেন আধুনিক। কিন্তু অন্তরে ঐক্য ছিল ওই দুই ধারার ভেতরে। উভয় ধারাই ছিল পুঁজিবাদে বিশ্বাসী। পুঁজিবাদের সমালোচনা দুই ধারা থেকেই পাওয়া যেত। কিন্তু সমালোচনার সুর ও স্বর দুটোই ছিল মৃদু। উভয় পক্ষই পুঁজিবাদকে মেনে নিয়েছিলেন, মেনে নিয়েই সংস্কার চাইতেন। বিকল্প ব্যবস্থার কথা কোনো পক্ষই বলতেন না, ভাবতেও চাইতেন না। অথবা যেটা ভাবতেন সেটা পুঁজিবাদকে নিয়েই। যেমন, জাতীয়তাবাদীরা কেউ কেউ বলতেন ইসলামী সমাজতন্ত্র চাই; তাঁদের সেই সমাজতন্ত্রে ব্যক্তিগত সম্পত্তির উচ্ছেদের কল্পনা স্থান পেতো না, ব্যক্তিমালিকানা ঠিক রেখেই তাঁরা সমাজতন্ত্র চাইতেন। ব্যক্তিগতভাবে উদারনীতিকরা ব্যক্তি মালিকানার সমস্যা দ্বারা পীড়িত ছিলেন, জীবিকা ও আবাসনের সুবন্দোবস্তকরণটা সহজ ব্যাপার ছিল না, অনিশ্চয়তা ছিল অর্থনৈতিক জীবনে, কিন্তু তাই বলে তাঁরা যে সমাজতন্ত্রের পক্ষে ছিলেন তা নয়, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ভেতরে থেকেই তাঁরা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের জন্য আশা ব্যক্ত করতেন। ছাত্রজীবনে দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভেতর সমাজতন্ত্রের পক্ষে বলবার মতো প্রায় কেউই ছিলেন না। ছাত্র মহলে ও আন্দোলনে বরং সমাজতন্ত্রের চিন্তাটা ছিল। কিন্তু ছাত্র আন্দোলন রাষ্ট্রীয় আক্রোশের কবলে পড়ে গিয়েছিল, যতটুকু প্রবহমান ছিল তাও বেগবান হবার সুযোগ পেতো না। সমাজতন্ত্রের পক্ষে রাজনৈতিক কর্মী যাঁরা ছিলেন রাষ্ট্র তাঁদেরকে কমিউনিস্ট বলতো, এবং অত্যন্ত তৎপর থাকতো যত দ্রুত পারা যায় তাঁদেরকে কারারুদ্ধ করতে।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদের ওপর একটা বড় রকমের আঘাত হেনেছিল, এবং পথ পরিষ্কার করে দিয়েছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের অগ্রযাত্রার জন্য। কিন্তু বাঙালি জাতীয়তাবাদী নেতারাও তো ছিলেন পুঁজিবাদীই। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে একটা প্রশ্নের মীমাংসা হয়ে গেল, সেটা হলো পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা আর পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদের অধীনে থাকবে না, তারা একটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবেই করবে। প্রশ্ন আরো একটা ছিল। খুবই জরুরি প্রশ্ন। সেটা হলো রাষ্ট্রের চরিত্রটা কী হবে? পুঁজিবাদী, নাকি সমাজতন্ত্রী? নেতৃত্বে ছিলেন যে জাতীয়তাবাদীরা তাঁরা সমাজতন্ত্রের কথা বলেছিলেন, অর্থাৎ বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, কিন্তু রাষ্ট্রকে সমাজতন্ত্রী করবেন এমন অঙ্গীকার তাঁদের মোটেই ছিল না। আমরা তো চোখের সামনেই দেখেছি যে পুঁজিবাদী বিশ্ব মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে; তাদের ভয় ছিল স্বাধীন হলে বাংলাদেশের মানুষ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাইবে। কিন্তু যুদ্ধের পরে তারা দেখলো নতুন রাষ্ট্রের রাজনীতিতে প্রবেশ করাটা মোটেই দুরূহ কাজ নয়। এবং দ্রুতই তারা প্রবেশ করলো। ভেতের ও বাইরের, দু’দিকের টানে বাংলাদেশ চলে গেল পুঁজিবাদী বলয়ের ভেতরে। আসলে যেখানে ছিল রয়ে গেল সেখানেই।

ঘটনার ওই প্রবাহ অন্যদের মতো আমাকেও দেখতে ও সহ্য করতে হয়েছে। এ দেশের মানুষের দারিদ্র্য অতি পুরাতন ব্যাপার। দারিদ্র্যের কারণ অন্যকিছু নয়; কারণ হচ্ছে ভেতরের ও বাইরের শোষণ। ভেতরের শোষণে ধনীরা আরো ধনী হয়েছে; বাইরের শোষণে ওই ধনীদের সহায়তায় দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। এটা তো আমরা হরদম দেখতে পাচ্ছি। মন্বন্তর, দুর্ভিক্ষ, প্রায়-দুর্ভিক্ষ, নীরব দুর্ভিক্ষ কতবার কতভাবে সহ্য করতে হয়েছে। অল্পকজনের বিলাসিতা ঢেকে দিতে পারে নি অগণিত মানুষের বঞ্চনা-যন্ত্রণা। কিন্তু এর বিরুদ্ধে আমরা দাঁড়াতে পারছি না। আমাদের, অর্থাৎ অধিকাংশ মানুষের, পক্ষে ভীষণ অসন্তুষ্ট হবার কথা এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। কিন্তু সেটা ঘটছে না। একটা কারণ ব্যক্তিমালিকানার গুণগান গাইবার লোকের অভাব নেই; কিন্তু সামাজিক মালিকানার পক্ষে অবস্থান নেবার ক্ষেত্রে মানুষের খুবই দুর্ভিক্ষ। যাঁরা বলেন তাঁদের কথা যাতে শোনা না যায় তার ব্যবস্থা রয়েছে সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভেতরেই। আমার অবস্থান সামাজিক মালিকানার পক্ষে।

কথাটা তাই দাঁড়ায় এই যে আমার লেখালেখি উদ্দেশ্যমূলক। কিন্তু তাই বলে প্রচারমূলক যে তা নয়। বলা যাবে যে লেখা একটা সাংস্কৃতিক কাজ। ব্যক্তিমালিকানা ব্যবস্থাকে বিদায় করে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার যে সংগ্রাম চলছে, আমার লেখার কাজ তার সঙ্গে যুক্ত হতে চেয়েছে। এই লেখা রক্ষণশীল নয়, আবার উদারনীতিক যে তাও নয়। উদারনীতিকে আমি বরঞ্চ অধিক পরিমাণে ভয় করি, কারণ সে রক্ষণশীল তো বটেই আবার ছদ্মবেশীও। তার ভদ্রতাটা ছদ্মবেশ মাত্র। ছদ্মবেশী বলে সে নিরেই রক্ষণশীলতার তুলনাতে বেশি ক্ষতিকর।

ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লেখার প্রয়োজনে আমাকে অনেক পরিমাণে লিখতে হয়। পত্রিকাতে লিখি, আবার বই-ও বের করি। অনেক কিছু লেখার দরুন উদারনীতিকেরা ভাবেন সাহিত্যের নয়, চর্চা করছি সাংবাদিকতার। সেটা তাঁরা বলেনও। আবার এক সময়ে খবরের কাগজে নিয়মিত লিখতাম বলে রটে গিয়েছিল যে আদপে আমি একজন কলামিস্ট। তা পরিচয়টা যা-ই হোক আমি দেখেছি না-লিখে কোনো উপায় নেই। বিশেষ করে এই কারণে যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা ভেঙেও ভাঙছে না; সূচনাকালের গুণগুলো খুইয়ে, নিছক টিকে থাকবার প্রয়োজনেই সে এখন বেপরোয়া হয়ে অতিনৃশংস আচরণ করছে; মানুষ, প্রকৃতি, প্রাণি সবার সঙ্গেই আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় অধিক নৃশংস আচরণ তার। এর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর আবশ্যকতা এখন তাই আরো বেশি, আগের যে কোনো সময়ের তুলনাতে। লেখা থামানোর কোনো সুযোগ দেখতে পাই না।

তা ব্যবস্থার শত্রুতার বিরুদ্ধে বিক্ষোভটা অবশ্য এখন প্রায় সর্বজনীন। যে কোনো বৈঠকে এর প্রকাশ দেখি। বিষোদ্গার, দৃষ্টান্ত-উপস্থান, দুঃসহ যন্ত্রণায় আর্তকণ্ঠ, এসব উঠে আসে। ভাসতে থাকে। বাংলাভাষায় এরকম বৈঠককে আমরা বলি আড্ডা দেওয়া। আমি যে লিখি তার একটা অতিরিক্ত কারণ হলো আড্ডাতে অনীহা। আলাপ ঠিক আছে, কিন্তু আলাপ আর আড্ডা দু’টির ভিন্ন জিনিস। আলাপে একটা লক্ষ্য থাকে, আড্ডা লক্ষ্যবিহীন। আড্ডাতে বৈদগ্ধতার যে প্রকাশ পায় না তা নয়, হাসি-ঠাট্টাও খুব চলে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরিণতিটা দাঁড়ায় ক্লান্তি। আমার লেখার ভিতরের সুরটা কথাবার্তার; আশা করি তা আড্ডাবাজির নয়। কথাবার্তা বাড়ানো চাই, আড্ডাবাজি কমিয়ে। সে জন্য দরকার সাংস্কৃতিক অনুশীলনের, লেখার মধ্যে দিয়ে সাংস্কৃতিক ওই অনুশীলনটাই করছি বলে আমার ধারণা।

বর্তমান লেখাটিতে মনের প্রসঙ্গ বার বার এসেছে। যতই যা বলা হোক, মন কিন্তু স্বাধীন নয়। মন বস্তুর ওপর নির্ভর করে, এবং বস্তুর সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। দ্বন্দ্বটা চলতেই থাকে। আমার ধারণা আমার লেখা মন ও বস্তুর ভেতরকার এই দ্বন্দ্বেরই প্রকাশ।

আমি বস্তুকে মেনে নেওয়ার পক্ষে নই, তাকে বদলানোর পক্ষে। এমতাবস্থায় না-লিখে পার পাই কী প্রকারে।

image

প্রচ্ছদ : সঞ্জয় দে রিপন

আরও খবর
৬৯ বছরে সংবাদ
ভাষা থেকে ভূখন্ড
স্মৃতিময় সংবাদ-এর ৬৯ বছর
একটি রাজনৈতিক পাঠ
সংবাদ : কিছু কথা কিছু স্মৃতি
যুগে যুগে সংবাদপত্রের অগ্রযাত্রা
আলোর তৃষ্ণায় জাগো
ইতিহাস ঐতিহ্য ও আদর্শের স্মারক দৈনিক সংবাদ
সংবাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আত্মার
ঐতিহ্য আর মুক্তচিন্তার সংবাদ
আমার সংবাদ সংবাদের আমি
বিচিত্র জীবিকা বিচিত্র জীবন
ঋতুপর্ণ ঘোষের এলোমেলো দেশকাল
চীন ও বাংলাদেশ : প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সম্পর্ক
সংবাদের জলসাঘর
আমরা এখন শান্ত হয়ে আছি
মাটির মাধুর্য
কষ্টের ঢাকা স্বপ্নের বাংলাদেশ
তোমারে বধিবে যে...
বঙ্গবন্ধুর জনকল্যাণের অর্থনৈতিক নীতি কৌশল
শারহুল পটবসন্ত ও বজলুর রহমান
শিশুশিক্ষায় শিল্প-সাহিত্য-সংগীত
গণমাধ্যমের হাল-হকিকত
এবং বজলুর রহমান স্মৃতিপদক
দুর্নীতি, পেশাদারিত্ব ও উন্নয়ন
বাংলাদেশের থিয়েটার চর্চার ভবিষ্যৎ
চেতনায় নৈতিকতা মূল্যবোধ : বিরুদ্ধবাস্তবতা
সবার উপরে মানুষ সত্য
আহমদুল কবির শ্রদ্ধাঞ্জলি
কার্যকর সংসদ এবং সুশাসনের স্বপ্ন
‘সংবাদ’ আমারই ছিল আমারই আছে
আমাদের ‘সংবাদ’
নারীর অধিকার ও সচেতনতা
গণমাধ্যমে বিশ্বাস কমছে পাঠকের
নারী ও তার বিধাতা পুরুষ
বাংলাদেশের নারী
সংবাদের কাছে আমি ঋণী
বিস্মৃতিপ্রবণতা ও রাষ্ট্রের অক্ষমতা
যে দীপশিখা দিয়েছে আলো

বুধবার, ১০ জুলাই ২০১৯ , ২৬ আষাঢ় ১৪২৫, ৬ জ্বিলকদ ১৪৪০

কেন লিখি

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

image

প্রচ্ছদ : সঞ্জয় দে রিপন

কেন লিখি- এ প্রশ্নের দু’টি জবাব খুবই সহজ ও স্বাভাবিক। একটা জবাব হলো না লিখে পারি না, আরেকটা জবাব হবে লেখা অভ্যাস হয়ে গেছে। দু’টি জবাবই আমার ক্ষেত্রে সত্য। আমি লিখি, না লিখে উপায় নেই বলে, আর লিখতে লিখতে এমন অভ্যাস হয়ে গেছে যে, না-লিখে পার পাই না। আরও একটা কারণ আছে, সেটা হলো লেখার চাইতে ভালো কোনো কাজ আমার জানা নেই। কিন্তু লেখা আমার জন্য বিনোদন নয়, একটা লেখা যখন শেষ করি তখন আনন্দ পাই ঠিকই, কিন্তু লিখতে কষ্ট হয়। আর একটা কথা। লেখার পরে লেখাটা পড়তে গিয়ে কাজটা শেষ করতে পারার আনন্দ কিছুটা ফিকে হয়ে যায়; মনে হয় ঠিক হয়নি, যা বলতে চেয়েছিলাম তা বলতে পারিনি; চিন্তা ও অনুভবকে ভাষায় ঠিক মতো নিয়ে আসতে ব্যর্থ হয়েছি। সন্তুষ্ট হই না। আর ওই সন্তুষ্ট না-হওয়ার মুখোমুখি হয়ে মনে হয় আমার লেখার পেছনে আসল কারণটা হচ্ছে অসন্তোষ। আমি সন্তুষ্ট নই। আমার লেখার অন্যসব কারণের পেছনে লুকিয়ে আছে একটা অসন্তোষ, অসন্তোষই আমাকে চালায়। আমিই খুবই অসন্তুষ্ট; নিজের লেখা নিয়ে তো অবশ্যই, তার চেয়েও বেশি অসন্তুষ্ট বিদ্যমান ব্যবস্থা নিয়ে। আমার মনে হয় যা ঘটছে তা সঙ্গত নয়, ঘটনার ভেতরে অন্যায় আছে, আর সেই অন্যায়টা দূর করা দরকার। মনে হয় সেটাই প্রধান ব্যাখ্যা আমার এই লেখালেখির।

আমার প্রয়াত পিতা বলতেন ছেলেটা কিছুতেই খুশি হয় না। খুব একটা ভুল বলেন নি। তবে আবার যে সম্পূর্ণ সত্য বলেছেন এমনও নয়। কারণ খুশি হই নি যে এমন নয়; অনেক ঘটনা অবশ্যই ঘটেছে যেগুলো আমাকে খুশি করেছে; সে-খবর তিনি যে রাখতেন না এমনও নয়; তবে আমি সব সময়েই যে অসন্তুষ্ট ছিলাম এটা খুবই ঠিক। খুঁত খুঁত করতাম না, ও কাজকে মনে হতো অভদ্রতা; কিন্তু ভেতরে ভেতরে টের পেতাম যে অবস্থাটা আমার মনঃপূত নয়। আমার পিতাকে সেটা বলা হয় নি। সুযোগ ছিল না বলবার। বললে কাজটাকে মনে হতো অকাল পরিপক্বতা। অকালে পেকে যাওয়াকেও মোটেই রুচিকর ব্যাপার বলে ভাবতে পারি নি। প্রশ্ন করতাম? না। সাহস ছিল না প্রশ্ন করবার। কার কাছে যে করবো সেটাও তো জানতাম না; কিন্তু টের পেতাম খুশি না-হবার যেসব ঘটনাগুলো ঘটছে সেগুলো ঘটা উচিৎ নয়। কেন যে উচিৎ নয় সে নিয়ে কারো সঙ্গে আলাপ করবার সুযোগ ছিল না। কেউ বলেও দিতো না। সে জন্যই বোধ করি লেখার দিকে ঝুঁকেছিলাম। আত্মপ্রকাশের প্রবল চাপের চেয়েও অসন্তোষের অস্বস্তিই কাজ করেছে, অধিক পরিমাণে। বলা যেতে পারে আত্মপ্রকাশের তাড়াটাও আসলে অসন্তুষ্টির সঙ্গেই যুক্ত।

আমি অসঙ্গতিগুলো দেখতাম। দেখে ভেতরে ভেতরে রেগে যেতাম। রাগটা আসলে ছিল গোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। মনে হতো গোটা ব্যবস্থাটাই অন্যায়। অসঙ্গতিগুলো ব্যবস্থা থেকেই উৎপন্ন। একদিক দিয়ে আমার বয়োঃবৃদ্ধির ইতিহাস ব্যবস্থাটাকে চিনবারই ইতিহাস। ভেতরের বোধ ক্রমশ স্পষ্ট হয়েছে। ব্যবস্থাটাকে নিয়ে যে ভীষণ ক্রোধ প্রকাশ করবো সে-কাণ্ড অবশ্য কখনোই ঘটে নি। অল্পবয়সে তো নয়ই, পরিণত বয়সেও নয়। না, সে-সাহস আমার ছিল না। সাহস থাকলে, এবং ক্রোধ যদি ভীষণ হতো তবে, হয়তো ব্যঙ্গ রচনায় হাত দিতাম। পারি নি। কৌতুক করেছি কিছুটা। তাও প্রত্যক্ষ কৌতুক নয়, অনেকটা অপ্রত্যক্ষ; তাতে প্রসন্নতা থাকতো।

তা অসন্তুষ্ট হলেই লিখতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। অসন্তোষকে নিজের ভেতর চেপে রাখা যায়, পারা যায় আর পাঁচজনের সঙ্গে ঘরোয়া বৈঠকে প্রকাশ করা, যে-প্রকাশের অপর নাম আড্ডা দেওয়া। দুটোর কোনোটাই পারি নি বলেই লিখতে চেষ্টা করা। লেখার ভেতর দিয়ে ইচ্ছাটা ছিল অন্যের কাছে পৌঁছে যাওয়া, নিজের অনুভব ও চিন্তাকে সামাজিক করে তোলা। লেখা জিনিসটা তো আসলে সামাজিকীকরণই। যাঁরা লেখেন, কিন্তু প্রকাশ করেন না; ডায়েরিতে, কিংবা চিঠিপত্রেই সীমাবদ্ধ থাকেন, তাঁদের কাজটাও সামাজিকই। ডায়েরি অবশ্য মানুষ নিজের জন্যই লেখে, কথোপকথনটা চলে নিজের সঙ্গে নিজের, কিন্তু ওই যে লিপিবদ্ধ হওয়া তার কারণে তো নিজের একান্ত সীমা থেকে বের হয়ে যাওয়া, চলমান ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত হওয়া, ইতিহাসের কিছু উপাদান রেখে যাওয়ার একটা গোপন ইচ্ছা। সামাজিক হওয়ার এই যে ইচ্ছা এখানেই থাকে মানুষের মনুষ্যত্বের উপাদান ও প্রতিশ্রুতি। পাখি গান গায় হয়তো অন্য পাখির জন্যই, কিন্তু পাখি একটা বৃত্তের ভেতর রয়ে যায়, সেটা ভেঙে বের হতে পারে না, ওই খাঁচাটা তার সঙ্গেই রয়ে যায়। গানের পাখিটা তাই সামাজিক হতে পারে না, মানুষ যেটা পারে। কাজ এবং কথার ভেতর দিয়ে তো অবশ্যই, লেখার ভেতর দিয়ে আরো বেশি করে মানুষ মানুষ হয়ে ওঠে। আমার নিজেরও ওই কাজ।

বৃত্তের কথাটা উঠলো। বৃত্ত জিনিসটা দেখতে পাচ্ছি আমার লেখার ভেতর বেশ ভালোভাবেই জায়গা করে রেখেছে। ‘অনতিক্রান্ত বৃত্ত’ আমার একেবারে প্রথম জীবনের একটা বইয়ের নাম। পরে আরেকটা বইয়ের নাম হয়েছে ‘বৃত্তের ভাঙা-গড়া’; তারপরে লেখা হয়েছে ‘সেই অখন্ড বৃত্তে’। অনুক্রমটা আপতিক নয়। বৃত্ত অতিক্রম করতে হবে এটা প্রথমে ভেবেছি, পরে দেখেছি বৃত্তের ভাঙা-গড়ার কাজটা সমাজে ও সংস্কৃতিতে চলছেই, তবে দেখা যাচ্ছে বৃত্ত থেকেই যাচ্ছে। একটা বৃত্ত থেকে বের হয়ে আরেকটা বৃত্তে পদার্পণ ঘটছে। বৃত্তটা বড় হয়, কিন্তু উধাও হয় না। হবেও না। হওয়ার দরকারও নেই। বৃত্তটা খুব বড় হোক, সর্বজনীন হোক এটাই কামনা। অন্য প্রাণির বৃত্তটা প্রাকৃতিকভাবেই ছোট, মানুষের বৃত্তটা প্রধানত মানুষই তৈরি করে, করতে হয়; কিন্তু সেটা যেন ছোট না হয়। এই চাওয়াটাই দেখছি আমার লেখার মূল সুর। কিশোর বয়সে একটা কবিতা পড়েছিলাম, তাতে একটি পঙ্ক্তি ছিল, ‘বড় ছোট হয়ে আছি আমরা, মশারীর ভেতর আছি’; পঙ্ক্তিটি মনে ধরেছিল, এবং আজও মনে আছে। সেকালে ঢাকা শহরে মশাদের প্রতাপ ছিল দুর্দান্ত, তাদেরকে পরাস্ত করা ছিল অসম্ভব। সে জন্য আত্মরক্ষার প্রয়োজনে মশারীর ভেতরে আশ্রয় নিতে হতো। আত্মরক্ষার এই কাজটা নানান অর্থে সত্য। বৃত্ত সঙ্কুচিত হয়ে মশারী হয়ে যায়, আরো ছোট হয় যখন তখন নিজেই আটকা পড়ে যাই নিজের ভেতর, সমাজ বিচ্ছিন্নতা পরিণত হয় আত্ম-বিচ্ছিন্নতায়, সে ব্যাপারটা সুখকর তো নয়ই, স্বভাবগতভাবেই ভয়াবহ।

ছেলেবেলায় আমার দুঃস্বপ্নগুলোর মধ্যে একটি ছিল হারিয়ে যাবার। ঘুমের ভেতর আঁতকে উঠতাম, দেখতাম খুব বড় একটা প্রান্তরে আমি একাকী দাঁড়িয়ে আছি; প্রান্তটা বড় হচ্ছে, কেবলই বাড়ছে, আর আমার ভেতর দেখা দিচ্ছে আতঙ্ক। আতঙ্কে ঘুম ভেঙে যেত। হয়তো চিৎকারও করতাম, নিঃশব্দে। বিচ্ছিন্নতার ওই ভয়টা আমার ভেতর আছে। সকলের ভেতরেই থাকে। মানুষ একাকীত্ব কখনো কখনো পছন্দ করে, কিন্তু সেটা যদি বাধ্যতামূলক হয়, আর স্থায়ী হয়ে যায়, তাহলে মস্ত বিপদ। তখন প্রবণতাটা ঠিক আত্মহত্যার না হোক দুর্বিষহ যন্ত্রণায় অতিষ্ঠতার যে তাতে সন্দেহ কী। আমার আতঙ্ক ও বিচ্ছিন্নতাতে। হারিয়ে যাওয়ার সেই শৈশবিক অনুভূতিটা আমার পিছু ছাড়ে নি। এটি অবশ্য সবার জন্যই সত্য; কম আর বেশি। আমার যেহেতু অভ্যাস আছে লেখার তাই বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে লিখি। ‘বিচ্ছিন্নতায় অসম্মতি’ নামে আমার বইও আছে একটা। ওখানে যে অসম্মতি সেটা অন্যত্রও কার্যকর। বিচ্ছিন্ন হতে অসম্মত হওয়াটা লেখার পেছনেও একটা কারণ ঘটে। এই বিশেষ ক্ষেত্রে অসম্মতি, অন্য ক্ষেত্রে অসন্তোষ, এই দু’য়ে মিলে আমাকে অস্থির রাখে।

সুরের কথা, গানের কথা এই লেখাটিতে এসেছে। স্বরের কথাও আসতে চায়। আমি দেখেছি স্বর কখনো উঁচু করতে পারি না। ভদ্রতা? তা হবে। সাহসের অভাব? হ্যাঁ, সেটাই মনে হয় প্রকৃত কারণ। ভীতিই ভদ্রতার আসল নিয়ামক। এটা সকলের ব্যাপারেই সত্য, সত্য আমার ব্যাপারেও। ভয় পাই বিচ্ছিন্নতার। এই বোধটাও কাজ করে যে উঁচু গলায় কথা বললে আলাদা হয়ে যাবো অন্যদের থেকে। অন্যরা ভাববে মস্ত কেউ হয়ে উঠেছি, ছাপিয়ে উঠতে চাচ্ছি সবাইকে, হটিয়ে দিচ্ছি অন্যদেরকে। দায়িত্ব নিচ্ছি বক্তব্যটাকে অন্যের ওপর চাপিয়ে দেবার, আর দেখা যাবে সে-কারণে পরিস্থিতিটা দাঁড়াচ্ছে বিরক্তিকর হয়ে ওঠার। ও কাজ বড়ই অপ্রীতিকর। কিন্তু তবু বক্তব্যটা তো থাকে। সেটা তৈরিও হয়। ব্যস্ত তার নির্মাণকার্য। তাই তাকে প্রকাশ করাটা দরকার। প্রকাশ করতে থাকি, তবে স্বর উঁচিয়ে নয়। যাদের জন্য লিখেছি তাদেরকে কাছে নিয়ে আসতে চাই, দূরে সরিয়ে না-দিয়ে। যে জন্য আমি অনেক লেখা ছদ্মনামে লিখেছি। লেখকের নাম দিয়েছি ‘গাছপাথর’, ‘নাগরিক’, ‘মিতভাষী’, ইত্যাদি। আহমদ ফারুক, সেলিম চৌধুরী নামেও লেখা পাওয়া যাবে, খুঁজলে। ওদিকে আমি পত্রিকা সম্পাদনাও করেছি অনেক ক’টি; তাদের ভেতর ত্রৈমাসিক ও মাসিক পত্রিকা তো ছিলই, আছেও; এমনকি সাপ্তাহিক পত্রিকাও ছিল। সেখানেও, ওই পত্রিকা-সম্পাদনাতেও, নিজেকে প্রচ্ছন্ন রাখার ব্যাপারটা থাকতো বৈকি। ভেবে দেখেছি, ছিল কিছুটা আমলাতান্ত্রিকতাও। যতই যা বলি না কেন আমাদের রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতিটা তো আমলাতান্ত্রিকই, সামাজিক সংস্কৃতিতেও তার দুর্বিনীত উপস্থিতি। সম্পাদকের টেবিলে যিনি বসছেন তাঁর ভেতর আমলা থাকেন একজন, কিন্তু আমি ভাবতে ভালোবেসেছি যে অনিবার্য সেই আমলাতান্ত্রিকতাকে আমি চেষ্টা করেছি লঙ্ঘন করতে। ভাবতে ভালো লাগে যে সম্পাদক হিসেবে আমি অন্যের লেখা নাকচ করেছি কম; লেখা আহ্বান করেছি সর্বক্ষণ। আর আমার প্রবণতা ছিল প্রতিষ্ঠান গড়ার, পত্রিকাকেও আমি প্রতিষ্ঠান হিসেবেই দেখেছি। যেখানে অনেকে আসবে, মিলবে, মিশবে, ব্যস্ত হবে সৃষ্টিশীলতায়। হিসেব করে দেখলাম আমার সম্পাদনার সবক’টি পত্রিকার প্রতিষ্ঠার সঙ্গেই আমি যুক্ত ছিলাম; পত্রিকাগুলোর কোনোটাই আগে ছিল না, গড়েপিটে দাঁড় করাতে হয়েছে। আমার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের দখলদারিত্বের ব্যাপারে কিন্তু ভেতর থেকেই ছিল অনীহা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের একবার আমাকে ডীন নির্বাচিত হতে হয়েছিল, দু’বছর পরে কার্যকাল যখন শেষ হলো তখন বুঝলাম ওই কাজের আমি যোগ্য নই। তার অল্প কিছুদিন পরে নির্বাচিত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়াটাও প্রায় অনিবার্যই হয়ে পড়েছিল; কোনো মতে এড়াতে পেরে ভেবেছি ‘বাঁচা গেল’।

সব লেখকের লেখার ভেতরই একটা সুর থাকে, থাকে একটা স্বরও। ধরে নিচ্ছি তারা আছে আমার লেখার ভেতরেও। স্বরটা কতটা নিজস্ব নিশ্চিত নই, সুরটাকে খুব নিজের বলে মনে হয়। এই সুর জিনিসটা গানের যেমন, তেমনি কবিতার, আবার গদ্যেরও। গান আমার লেখা হয় নি, গাওয়া হয় নি, কিন্তু গদ্য যে লিখেছি তার ভেতরও, ভাবতে ভালোবাসি, একটা সুর আছে। সেটা নিজস্ব। অন্যরা টের পান না পান, আমি পাই। কিন্তু ওই সুরকে আমি কবিতাতে নিয়ে যেতে পারি নি।

আসলে কবিতা আমি লিখিই নি। এমনকি কৈশোরেও নয়। কারণ কী? কল্পনাশক্তির দুর্বলতা? তা কিছুটা তো বটেই। তবে আসল কারণ কিন্তু ভয়। আমার ভয় ছিল ছন্দমেলানোর ব্যাপারে। মনে হয়েছে পারবো না। অথবা পারলেও সে মিলের গায়ে ছাপ থাকবে কষ্টের। চতুর্দিকে এতো অমিল, গরমিল, গোঁজামিল যে তার ভেতর নতুন কষ্টমিল কিংবা ছন্দপতন যোগ করাটা বিড়ম্বনার ব্যাপার হবে ধরে নিয়ে কিছুটা যে কৌতুক অনুভব করিনি এমনও নয়। মনে পড়ে ক্লাস টেনে যখন পড়ি সেই সময়ে ‘দিলরুবা’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা বেরুত, তার প্রথম সংখ্যাতে পত্রিকার সম্পাদক কাজী মোতাহার হোসেন নবীন লেখকদের জন্য কয়েকটা পরামর্শ দিয়েছিলেন, যেগুলোর মধ্যে একটা ছিল এই মর্মে যে বাংলা কবিতা ইতিমধ্যেই এমন একটা উৎকর্ষে গিয়ে পৌঁছে গেছে যে সেখানে নবিশি না-করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। সেটা আমিও বুঝতাম। তদুপরি এটাও দেখেছি যে, আমার যেসব বক্তব্য প্রকাশের পথ খুঁজছে সেগুলোকে কবিতার ছোট পরিসরে ধরাতে গেলে ঠাসাঠাসির এমন একটা ঘটনা ঘটবে যেটা কবিতা ও বক্তব্য কারো জন্যই সুবিধাজনক হবে না। এসব বিবেচনায় কবিতার পথ মাড়ানো হয়নি।

তাই বলে গদ্যরচনা কি সহজ কাজ? সাংবাদিকের মতো লেখা হয়তো কিছুটা সহজসাধ্য, কিন্তু যে গদ্য সাহিত্য হিসেবে বিবেচ্য হতে চায় তার পেছনে বিস্তর শ্রম, মেধা ও বক্তব্য থাকা প্রয়োজন। সেটা তো গেল, কিন্তু জিজ্ঞাসা থাকে যে গদ্যের ভেতর যেটা সবচাইতে বেশি কার্যকর ও স্থায়ী মূল্যে মূল্যবান সেই কথাসাহিত্যের পথে গেলাম না কেন। একেবারেই যে যাই নি তা নয়; গিয়েছিলাম। গল্প দিয়েই আমার লেখকযাত্রা শুরু, তারপরে উপন্যাসও লিখেছি দু’টি; কিন্তু কথাসাহিত্যে স্থির থাকতে পারি নি। কারণ একাধিক। একটি হলো অভিজ্ঞতার স্বল্পতা, অপরটি বিদ্যমান ব্যবস্থাকে মেনে না-নেওয়া। দ্বিতীয় ব্যাপারটা কম গুরুতর নয়। আমি দেখেছি কথাসাহিত্য যারা চর্চা করেন তাঁরা যে অবস্থাটা আছে, এবং আপাতত বদলাচ্ছে না সেটাকে মেনে নিয়ে ব্যবস্থার ভেতরে বসবাসকারী মানুষদের জীবনযাপনের খোঁজ নেন, তাদের সুখের খবর রাখেন, গভীরভাবে রাখেন দুঃখের খবর, এবং ওই মানুষদের সুখ-দুঃখের উন্মোচন ঘটান সাহিত্যে। আমার সমস্যা ওপরের ওই ব্যবস্থাটা নিয়েই। ব্যবস্থাটিকে আমার অন্যায় বলে মনে হয়। তাকে আমি দু’ঘা বসিয়ে দিতে চাই। তাই আমার রয়ে যাওয়াটা ঘটে ওই উপর কাঠামোতেই, ভেতরে যাওয়াটা যে মাত্রায় প্রয়োজন সে-মাত্রায় যাওয়া হয় না।

আমি হাত লাগিয়েছি নাটক লেখাতেও, কিন্তু সে-লেখাও এগোয় নি। এখানেও কারণটা এই রকমের যে নাটকে দ্বন্দ্ব থাকে, বস্তুত দ্বন্দ্ব ছাড়া তো নাটকই নেই; সেখানে নাট্যকারের অবস্থানটা হওয়া চাই নিরপেক্ষতার; নইলে নাটক জমবে কোন প্রকারে? আমার ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা অর্জন ও সংরক্ষণ দু’টোই ছিল কঠিন কাজ। ন্যায়-অন্যায়ের যখন যুদ্ধ চলে তখন নিরপেক্ষ থাকি কীভাবে? নাটক বলি কি উপন্যাসই বলি, শ্রেষ্ঠ রচনাগুলো তো সবসময়েই হয়ে পড়ে বিয়োগান্ত। যে পক্ষ শুভ সে ন্যায়বিচার পায় না, অশুভই জয়ী হয়। এই বেদনাদায়ক বাস্তবতা জীবনে সত্য, তাই সাহিত্যেও তার উপস্থিতি অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু শুভের দুর্দশাকে ফুটিয়ে তুলতে গেলে আমার খুবই কষ্ট হতো, মনে হতো আমার কর্তব্য তো শুভের পক্ষে দাঁড়িয়ে অশুভের বিরুদ্ধাচরণ করা। নৈর্ব্যত্তিক থাকলে তো চলবে না। নিরপেক্ষ বলে তো কোনো অবস্থান নেই। তাহলে? ছেলেমানুষি সরলতা? হয়তো তাই; হয়তো স্থূলতাও। তবে ওটি আমার ভেতর রয়ে গেছে, যে জন্য কথাসাহিত্য ও নাটক তৈরির ব্যাপারে আমার আর এগোনো হয় নি, রণে ভঙ্গ দিতে হয়েছে। আমার লেখালেখির উদ্দেশ্য দাঁড়িয়েছে অন্যায্য বিদ্যমানকে আঘাত করা। আঘাত করার কাজটা ভেতর থেকে, মানুষের যন্ত্রণার ও আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে মানুষের চারপাশের ব্যবস্থার দ্বন্দ্বকে তুলে ধরতে পারলে যে আরো ভালো ভাবে করা হয় তার প্রমাণ তো সাহিত্যেই রয়েছে; কিন্তু আমি দেখলাম আমার আঘাত মূলত ওপরেই, ভেতরে ঢুকতে পারাটা কর্তব্য ছিল কিন্তু সেটা করতে পারিনি। আমার লেখা নৈর্ব্যক্তিক হয়েও হতে চায় না, কোনো না কোনোভাবে আমার পক্ষপাতটা বেরিয়ে পড়ে। এমনকি গবেষণামূলক যে রচনা লিখেছি সেখানেও পক্ষপাত আছে। আসলে আমার কোনো রচনাই উপসংহারবিহীন নয়, এবং উপসংহারে আমার ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দটা ঠিকই চলে এসেছে। খাঁটি শিল্পীদের বেলায় ব্যক্তি যেভাবে অবলুপ্ত হয়ে যায় স্রষ্টার ভেতরে আমার ক্ষেত্রে সেটা ঘটে নি। সেটা ঘটলে খাঁটি শিল্পী হতাম, যেটা আমি মোটেই নই। ওই যে ব্যবস্থার পরিবর্তন চাওয়া, সেই চাওয়ার সঙ্গে আমি ব্যক্তিগতভাবে জড়িত; ব্যবস্থাকে আমি ব্যক্তিগতভাবেই শত্রু বলে মনে করি; আমার লেখায় তার কোনো রকমের সর্বনাশ হবে এমন কোনো সম্ভাবনা নেই ঠিকই, কিন্তু তাই বলে তাকে আঘাত করতে ছাড়বো কেন? এখানে পরাজয়ের তো কোনো স্থান নেই। দ্বন্দ্বটা তো জীবন-মৃত্যুর; বাঁচা কিংবা মরার। আপোসের সুযোগ কোথায়?

ওই দ্বন্দ্বের কথা আমার লেখার ভেতর আছে। প্রতিপক্ষ সেখানে সর্বদাই উপস্থিত, তা সে যে রূপেই হোক না কেন, এমনকি যদি অপ্রত্যক্ষ হয় তবেও। অনেক সময়েই সে আসে প্রশ্নের আকারে, পাল্টা যুক্তির রূপ নিয়ে। আমার বক্তব্য ও বক্তব্যের প্রতিপক্ষের ভেতর যে ঝগড়া বাঁধে তা নয়, তবে দ্বন্দ্বটা চলে। আর আমার এইসব লেখার ভেতর যেটুকু প্রাণবন্ততাটা থাকে তার উৎস হচ্ছে ওই তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব। প্রাণবন্ততার জায়গাতে ওজস্বিতাও যে আসে না, তা নয়। কিন্তু আমি ওজস্বী হতে চাই না; যেমন হতে চাই না যান্ত্রিক কিংবা বিষণœ, অথবা হতাশাগ্রস্ত। আত্মকরুণায় যে দগ্ধ অথবা সিক্ত হবো সেটাও পারি না।

ওজস্বিতার পরিমাণটা অবশ্য সব সময়েই কম ছিল, মূল ভঙ্গিটা শুরু থেকেই ছিল আলাপচারিতার। পেশাগতভাবে আমাকে ক্লাসরুমে এবং তার বাইরেও হামেশাই ‘বক্তৃতা’ দিতে হয়েছে, এখনও হয়; কিন্তু নিজেকে আমি বক্তা হিসেবে দেখতে পাইনি, কথক হিসেবেই দেখতে চেয়েছি ও পেয়েছি। সাফল্য-ব্যর্থতা অবশ্য ভিন্ন প্রশ্ন। জীবন ও জীবিকা আমার জন্য যে আলাদা ছিল না, ছিল পরস্পর জড়িত সেটা আমার এক সৌভাগ্য। জীবিকা যদি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তো জীবিকা থেকে তবে সেটা দুঃখজনক হতো তো বটেই ক্ষতিকরও হতো।

ছিল প্রসন্নতাও। দায়িত্ব পালন করেছি ঠিকই, কিন্তু তাতে কোনো গ্লানি ছিল না। কাজটা বরং উপভোগই করেছি বলা চলে। প্রশ্রয় দিয়েছি কৌতুকের বোধকেও।

কবিতা যে লিখবো না সে তো জানাই ছিল; কিন্তু কবিতার ছন্দস্পন্দ যদি গদ্যে আনা যায় তবে মন্দ কি? আরোপিত হয়ে নয়, আসুক সে ভেতর থেকেই। বাসনাটা ছিল এই রকমেরই। এবং আমি যুক্ত থাকতে চেয়েছি অন্যদের সঙ্গে, দল হিসেবে নয়। স্রোত হিসেবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা কখনোই দলনিরপেক্ষ ছিলাম না; আমাদের দল ছিল, দলীয় অবস্থান ছিল, কিন্তু নিজে আমি দলের পরিচয়ে পরিচিত হবো ভাবি নি, স্রোতের পরিচয়টিকেই বড় বলে জেনেছি। বলাই বাহুল্য স্রোতটা সমাজ-রূপান্তরের প্রচেষ্টার। এটা নিতান্ত আপতিক ঘটনা নয় যে ক্লাস রুমে পাঠদানের দায়িত্ব থেকে ছুটি পাবার সঙ্গে সঙ্গেই আমি যে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ায় ব্যস্ত হয়েছিলাম তার নামটা দাঁড়িয়েছিল সমাজ-রূপান্তর অধ্যয়ন কেন্দ্র। ওই নাম পূর্বচিন্তা থেকে আসেনি, এসেছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে, স্রোতের তাড়ানাতে। স্রোতটাকে চলতে হয়েছে প্রচলিতের বিপরীতে। অধিকাংশ মানুষই দেখা গেছে প্রচলিত স্রোতের পক্ষেই থাকে। তারা খুব যে সুখে থাকে তা নয়, কিন্তু বিদ্যমানকে মেনে নেয়। সে জন্য দেখা গেছে কখনোই আমরা দলে ভারি হতে পারি নি। সংখ্যালঘুই রয়ে গেছি। ওদিকে আবার বিরূপতার মুখে পড়তে হয়েছে; রাষ্ট্রীয়ভাবে যেমন, সামাজিক ভাবেও তেমনি। যেন বিধিলিপি।

অসন্তোষের কথা বলছিলাম। সভ্যতার ইতিহাস তো আসলে অসন্তোষেরই ইতিহাস। সন্তোষ দেখা দিলে সভ্যতা এগুতো না। কিন্তু ওই অসন্তোষটা কেবলমাত্র ব্যক্তিগত তো নয়ই, প্রধানতও ব্যক্তিগত নয়; হয়ে পড়েছে সমষ্টিগত, এবং যখন সে সমষ্টিগত হয়েছে তখনই ঘটেছে উত্তরণ, তার আগে নয়। সমষ্টির আঘাতে এবং সমষ্টির স্বার্থেই পুরাতন ব্যবস্থাটা ভেঙে পড়েছে।

আমার বয়স যত বেড়েছে অসন্তোষও বেড়েছে সেই পরিমাণেই। নিজের অসন্তুষ্টিকে আমি মেলাতে চেষ্টা করেছি সকলের অসন্তোষের সঙ্গে। চূড়ান্ত বিচারে আমার লেখালেখির পেছনের তাড়নাটা রয়েছে ওইখানেই। বয়ঃবৃদ্ধির সঙ্গে তাল রেখে ব্যবস্থার ত্রুটিগুলি চোখের সামনে ক্রমাগত পরিষ্কার হয়ে এসেছে। বাইরের চোখের শক্তি কমেছে, ভেতরের চোখের শক্তি বেড়েছে।

ব্যবস্থাটা যে পুঁজিবাদী আমার সেটা বোঝা হয়ে গেছে প্রায় শুরুতেই। তবে ভালোভাবে বোঝার ব্যাপারে অসুবিধা ছিল। পুঁজিবাদ নিজেকে নানাভাবে অস্পষ্ট করে রাখে। আর তাকে চিনবার জন্য যে সাহায্য এবং যে অনুশীলন দরকার ছিল সেটা মোটেই সহজলভ্য ছিল না। রাষ্ট্র তো বটেই সমাজও দীক্ষিত ছিল পুঁজিবাদেই। সাতচল্লিশে দেশ যখন তথাকথিত রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা পেলো তখন আওয়াজ উঠেছিল সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের। আমরা শুনতাম পূর্ববঙ্গের সাহিত্য কেমন করে পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য থেকে স্বতন্ত্র করা যায় সেই চেষ্টার কথা। দৃষ্টান্ত দেওয়া হতো আমেরিকান সাহিত্যের; বলা হতো সে-সাহিত্যে ইংরেজি সাহিত্যের মূলধারা থেকে কী ভাবে ও কী কারণে আলাদা হলো সেটা দেখতে হবে, এবং দেখে নিয়ে পূর্ববঙ্গের সাহিত্যে স্বতন্ত্র ধারা তৈরি করার চেষ্টা করা চাই। আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের মাঝখানে এটলান্টিক নামের একটা সমুদ্র আছে বললে জবাবে বলা হতো তাহলে আইরিশ সাহিত্য দেখো, আয়ারল্যান্ড তো গা ঘেঁষেই রয়েছে ইংল্যান্ডের, কিন্তু সাহিত্য তো আলাদা। জাতীয়তাবাদের বিষয়টা তুলে ধরা হতো। যে জাতীয়তাবাদ তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছিল সঙ্গতভাবেই তার নাম দেওয়া হয়েছিল পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদ। স্বাতন্ত্র্যটা আসবে এই জাতীয়তাবাদের কারণেই, চিন্তাটা ছিল এই রকমের। এর বিপরীত ধারায় যাঁরা সাহিত্যের চর্চা করতেন তাঁরা ছিলেন উদারনীতিক। তাঁরা গোটা বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্যকে সঙ্গে নিয়ে সাহিত্যচর্চা করবেন মনস্থ করেছিলেন। পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে এঁদের বিস্তর পার্থক্য। এঁরা ছিলেন আধুনিক। কিন্তু অন্তরে ঐক্য ছিল ওই দুই ধারার ভেতরে। উভয় ধারাই ছিল পুঁজিবাদে বিশ্বাসী। পুঁজিবাদের সমালোচনা দুই ধারা থেকেই পাওয়া যেত। কিন্তু সমালোচনার সুর ও স্বর দুটোই ছিল মৃদু। উভয় পক্ষই পুঁজিবাদকে মেনে নিয়েছিলেন, মেনে নিয়েই সংস্কার চাইতেন। বিকল্প ব্যবস্থার কথা কোনো পক্ষই বলতেন না, ভাবতেও চাইতেন না। অথবা যেটা ভাবতেন সেটা পুঁজিবাদকে নিয়েই। যেমন, জাতীয়তাবাদীরা কেউ কেউ বলতেন ইসলামী সমাজতন্ত্র চাই; তাঁদের সেই সমাজতন্ত্রে ব্যক্তিগত সম্পত্তির উচ্ছেদের কল্পনা স্থান পেতো না, ব্যক্তিমালিকানা ঠিক রেখেই তাঁরা সমাজতন্ত্র চাইতেন। ব্যক্তিগতভাবে উদারনীতিকরা ব্যক্তি মালিকানার সমস্যা দ্বারা পীড়িত ছিলেন, জীবিকা ও আবাসনের সুবন্দোবস্তকরণটা সহজ ব্যাপার ছিল না, অনিশ্চয়তা ছিল অর্থনৈতিক জীবনে, কিন্তু তাই বলে তাঁরা যে সমাজতন্ত্রের পক্ষে ছিলেন তা নয়, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ভেতরে থেকেই তাঁরা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের জন্য আশা ব্যক্ত করতেন। ছাত্রজীবনে দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভেতর সমাজতন্ত্রের পক্ষে বলবার মতো প্রায় কেউই ছিলেন না। ছাত্র মহলে ও আন্দোলনে বরং সমাজতন্ত্রের চিন্তাটা ছিল। কিন্তু ছাত্র আন্দোলন রাষ্ট্রীয় আক্রোশের কবলে পড়ে গিয়েছিল, যতটুকু প্রবহমান ছিল তাও বেগবান হবার সুযোগ পেতো না। সমাজতন্ত্রের পক্ষে রাজনৈতিক কর্মী যাঁরা ছিলেন রাষ্ট্র তাঁদেরকে কমিউনিস্ট বলতো, এবং অত্যন্ত তৎপর থাকতো যত দ্রুত পারা যায় তাঁদেরকে কারারুদ্ধ করতে।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদের ওপর একটা বড় রকমের আঘাত হেনেছিল, এবং পথ পরিষ্কার করে দিয়েছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের অগ্রযাত্রার জন্য। কিন্তু বাঙালি জাতীয়তাবাদী নেতারাও তো ছিলেন পুঁজিবাদীই। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে একটা প্রশ্নের মীমাংসা হয়ে গেল, সেটা হলো পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা আর পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদের অধীনে থাকবে না, তারা একটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবেই করবে। প্রশ্ন আরো একটা ছিল। খুবই জরুরি প্রশ্ন। সেটা হলো রাষ্ট্রের চরিত্রটা কী হবে? পুঁজিবাদী, নাকি সমাজতন্ত্রী? নেতৃত্বে ছিলেন যে জাতীয়তাবাদীরা তাঁরা সমাজতন্ত্রের কথা বলেছিলেন, অর্থাৎ বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, কিন্তু রাষ্ট্রকে সমাজতন্ত্রী করবেন এমন অঙ্গীকার তাঁদের মোটেই ছিল না। আমরা তো চোখের সামনেই দেখেছি যে পুঁজিবাদী বিশ্ব মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে; তাদের ভয় ছিল স্বাধীন হলে বাংলাদেশের মানুষ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাইবে। কিন্তু যুদ্ধের পরে তারা দেখলো নতুন রাষ্ট্রের রাজনীতিতে প্রবেশ করাটা মোটেই দুরূহ কাজ নয়। এবং দ্রুতই তারা প্রবেশ করলো। ভেতের ও বাইরের, দু’দিকের টানে বাংলাদেশ চলে গেল পুঁজিবাদী বলয়ের ভেতরে। আসলে যেখানে ছিল রয়ে গেল সেখানেই।

ঘটনার ওই প্রবাহ অন্যদের মতো আমাকেও দেখতে ও সহ্য করতে হয়েছে। এ দেশের মানুষের দারিদ্র্য অতি পুরাতন ব্যাপার। দারিদ্র্যের কারণ অন্যকিছু নয়; কারণ হচ্ছে ভেতরের ও বাইরের শোষণ। ভেতরের শোষণে ধনীরা আরো ধনী হয়েছে; বাইরের শোষণে ওই ধনীদের সহায়তায় দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। এটা তো আমরা হরদম দেখতে পাচ্ছি। মন্বন্তর, দুর্ভিক্ষ, প্রায়-দুর্ভিক্ষ, নীরব দুর্ভিক্ষ কতবার কতভাবে সহ্য করতে হয়েছে। অল্পকজনের বিলাসিতা ঢেকে দিতে পারে নি অগণিত মানুষের বঞ্চনা-যন্ত্রণা। কিন্তু এর বিরুদ্ধে আমরা দাঁড়াতে পারছি না। আমাদের, অর্থাৎ অধিকাংশ মানুষের, পক্ষে ভীষণ অসন্তুষ্ট হবার কথা এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। কিন্তু সেটা ঘটছে না। একটা কারণ ব্যক্তিমালিকানার গুণগান গাইবার লোকের অভাব নেই; কিন্তু সামাজিক মালিকানার পক্ষে অবস্থান নেবার ক্ষেত্রে মানুষের খুবই দুর্ভিক্ষ। যাঁরা বলেন তাঁদের কথা যাতে শোনা না যায় তার ব্যবস্থা রয়েছে সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভেতরেই। আমার অবস্থান সামাজিক মালিকানার পক্ষে।

কথাটা তাই দাঁড়ায় এই যে আমার লেখালেখি উদ্দেশ্যমূলক। কিন্তু তাই বলে প্রচারমূলক যে তা নয়। বলা যাবে যে লেখা একটা সাংস্কৃতিক কাজ। ব্যক্তিমালিকানা ব্যবস্থাকে বিদায় করে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার যে সংগ্রাম চলছে, আমার লেখার কাজ তার সঙ্গে যুক্ত হতে চেয়েছে। এই লেখা রক্ষণশীল নয়, আবার উদারনীতিক যে তাও নয়। উদারনীতিকে আমি বরঞ্চ অধিক পরিমাণে ভয় করি, কারণ সে রক্ষণশীল তো বটেই আবার ছদ্মবেশীও। তার ভদ্রতাটা ছদ্মবেশ মাত্র। ছদ্মবেশী বলে সে নিরেই রক্ষণশীলতার তুলনাতে বেশি ক্ষতিকর।

ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লেখার প্রয়োজনে আমাকে অনেক পরিমাণে লিখতে হয়। পত্রিকাতে লিখি, আবার বই-ও বের করি। অনেক কিছু লেখার দরুন উদারনীতিকেরা ভাবেন সাহিত্যের নয়, চর্চা করছি সাংবাদিকতার। সেটা তাঁরা বলেনও। আবার এক সময়ে খবরের কাগজে নিয়মিত লিখতাম বলে রটে গিয়েছিল যে আদপে আমি একজন কলামিস্ট। তা পরিচয়টা যা-ই হোক আমি দেখেছি না-লিখে কোনো উপায় নেই। বিশেষ করে এই কারণে যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা ভেঙেও ভাঙছে না; সূচনাকালের গুণগুলো খুইয়ে, নিছক টিকে থাকবার প্রয়োজনেই সে এখন বেপরোয়া হয়ে অতিনৃশংস আচরণ করছে; মানুষ, প্রকৃতি, প্রাণি সবার সঙ্গেই আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় অধিক নৃশংস আচরণ তার। এর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর আবশ্যকতা এখন তাই আরো বেশি, আগের যে কোনো সময়ের তুলনাতে। লেখা থামানোর কোনো সুযোগ দেখতে পাই না।

তা ব্যবস্থার শত্রুতার বিরুদ্ধে বিক্ষোভটা অবশ্য এখন প্রায় সর্বজনীন। যে কোনো বৈঠকে এর প্রকাশ দেখি। বিষোদ্গার, দৃষ্টান্ত-উপস্থান, দুঃসহ যন্ত্রণায় আর্তকণ্ঠ, এসব উঠে আসে। ভাসতে থাকে। বাংলাভাষায় এরকম বৈঠককে আমরা বলি আড্ডা দেওয়া। আমি যে লিখি তার একটা অতিরিক্ত কারণ হলো আড্ডাতে অনীহা। আলাপ ঠিক আছে, কিন্তু আলাপ আর আড্ডা দু’টির ভিন্ন জিনিস। আলাপে একটা লক্ষ্য থাকে, আড্ডা লক্ষ্যবিহীন। আড্ডাতে বৈদগ্ধতার যে প্রকাশ পায় না তা নয়, হাসি-ঠাট্টাও খুব চলে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরিণতিটা দাঁড়ায় ক্লান্তি। আমার লেখার ভিতরের সুরটা কথাবার্তার; আশা করি তা আড্ডাবাজির নয়। কথাবার্তা বাড়ানো চাই, আড্ডাবাজি কমিয়ে। সে জন্য দরকার সাংস্কৃতিক অনুশীলনের, লেখার মধ্যে দিয়ে সাংস্কৃতিক ওই অনুশীলনটাই করছি বলে আমার ধারণা।

বর্তমান লেখাটিতে মনের প্রসঙ্গ বার বার এসেছে। যতই যা বলা হোক, মন কিন্তু স্বাধীন নয়। মন বস্তুর ওপর নির্ভর করে, এবং বস্তুর সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। দ্বন্দ্বটা চলতেই থাকে। আমার ধারণা আমার লেখা মন ও বস্তুর ভেতরকার এই দ্বন্দ্বেরই প্রকাশ।

আমি বস্তুকে মেনে নেওয়ার পক্ষে নই, তাকে বদলানোর পক্ষে। এমতাবস্থায় না-লিখে পার পাই কী প্রকারে।