চীন ও বাংলাদেশ : প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সম্পর্ক

শান্তা মারিয়া

চীনের সঙ্গে সুপ্রাচীনকাল থেকেই বঙ্গভূমির সম্পর্ক রয়েছে। এই সম্পর্ক যেমন সাংস্কৃতিক তেমনি অর্থনৈতিক। বিশ্বের সুপ্রাচীন সভ্যতাগুলোর অন্যতম চীন। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিও সমৃদ্ধ। বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপ গাঙ্গেয় অববাহিকায় প্রাচীনকাল থেকেই জনবসতি গড়ে ওঠে। গ্রিক ইতিহাসবিদদের লেখায় গঙ্গা অববাহিকায় মোহনা অঞ্চলে অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ অঞ্চলে গঙ্গাহৃদয় বা গঙ্গাহৃদি নামে এক শক্তিশালী রাজ্যের কথা রয়েছে। তাদের গঙ্গারাইডিস নামে অভিহিত করা হয়েছে।

মহান ভারতীয় মহাকাব্য মহাভারতে বঙ্গ নামে দেশের উল্লেখ রয়েছে। বঙ্গের রাজা তার হস্তিবাহিনী নিয়ে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। মহাভারতে চীন জাতিরও উল্লেখ রয়েছে। মহাভারতের আদিপর্বে রয়েছে বিশিষ্ট মুনির কথা। রাজা বিশ্বামিত্র বিশিষ্ট মুনির আশ্রমের ধেনু নন্দিনীকে ধরে নিয়ে যেতে চাইলে নন্দিনীর দেহ থেকে অসংখ্য সৈন্যর উৎপত্তি হয়। সেই সৈন্যদলে বিভিন্ন জাতির সৈন্য ছিল। এরা নন্দিনীকে রক্ষা করে। এই জাতিগুলোর মধ্যে বাহ্লিক, পারসিক, শক, যবন, চীনসহ বিভিন্ন জাতির নাম উল্লেখ করা হয়। একইভাবে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধেও বিভিন্ন জাতির সৈন্যদলের যে উল্লেখ রয়েছে তার মধ্যে বঙ্গ ও চীন জাতির কথা রয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব যুগে প্রাচীন বাংলায় বিভিন্ন সামন্ত রাজ্য বিকশিত হয়। পুন্ড্রবর্ধনের সভ্যতা প্রায় আড়াই হাজার বছরের পুরনো। গৌড়, বঙ্গ, পু্ন্ড্র, সমতট, রাঢ়, হরিকেল, চন্দ্রদীপ, চন্দ্রকেতুগড়, চন্দ্রকোটসহ বিভিন্ন রাজ্য মিলে গড়ে ওঠে আজকের বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ। এককথায় একে বৃহত্তর বঙ্গ বলে অভিহিত করা যায়। প্রাচীন বাংলার সমাজ ব্যবস্থার বর্ণনা পাওয়া যায় বিখ্যাত চীনা পর্যটক ও তীর্থযাত্রী ফা হিয়েন (৩৩৭-৪২২ খ্রিস্টাব্দ) এর লেখায়। তিনি বৌদ্ধশাস্ত্রের জ্ঞানকে চীনে নিয়ে যান। চীনের পর্যটক ও তীর্থযাত্রী হিউয়েন সাং নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন সপ্তম শতকে। তার বর্ণনায় বাংলার সামাজিক অবস্থার বর্ণনা পাওয়া যায়। তিনি পুন্ড্রবর্ধনেও এসেছিলেন। আরও অনেক চীনা পর্যটক প্রাচীন বাংলায় এসেছিলেন। প্রাচীন বাংলার সামাজিক ইতিহাসের মূল্যবান দলির আমরা তাদের কাছ থেকেই পেয়েছি।

পক্ষান্তরে বাংলার চর্যাপদের কবি ও নাথপন্থার গুরু মীননাথ এবং তার শিষ্য নাথপন্থি বিখ্যাত গুরু গোরক্ষনাথ যখন তিব্বতে যান এবং সেখানেই অন্তিমকাল পর্যন্ত জীবন অতিবাহিত করেন তখন অনিবার্যভাবে তারা বাংলার সহজসাধন জ্ঞানকে এবং দোহা বা বুদ্ধিষ্ট মিষ্টিক সং ও বাংলার সংস্কৃতিকে সেখানে বয়ে নিয়ে যান। বাংলার পন্ডিত অতীশ দীপংকর যখন তিব্বতে যান তিনিও একইভাবে শুধু বৌদ্ধশাস্ত্রকেই নয় বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতিকেও চীনে নিয়ে গিয়েছিলেন।

চীনের ও বাংলার মানুষের পারস্পরিক লেনদেন যে প্রাচীনকালে বেশ সুচারুভাবেই ছিল তা বাংলার শব্দভান্ডারে বিভিন্ন চীনা শব্দের উপস্থিতি প্রমাণ করে। হুজুগে বাঙালি আর হেকমতে চীন বাগধারাটি বাঙালির আবেগপ্রবণতা আর চীনাদের কর্মদক্ষতাকেই শুধু নয়, চীনা ও বাঙালির মানসিক যোগাযোগকেও তুলে ধরে।

শেরশাহের আমলে যে গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড নির্মিত হয় তা দিল্লি থেকে বাংলা পর্যন্ত পৌঁছায়। এই পথ দিল্লি থেকে রেশমপথের সঙ্গে যুক্ত ছিল। ফলে রেশমপথের মাধ্যমে চীনের সঙ্গে বাংলার যোগাযোগ স্থাপিত হয়। বাংলার মসলিন ও সুতিবস্ত্র যেমন চীন, আরব, মিশর, গ্রিস ও রোমে পৌঁছায় তেমনি চীনের রেশমও পৌঁছে যায় বাংলায়। বাংলার প্রাচীন রাজধানী সোনারগাঁও-এর সঙ্গে চীনের কেন্দ্রভূমির মধ্যে বাণিজ্যিক লেনদেন তখন থেকেই প্রচলিত ছিল। বাংলার অভিজাত সমাজ যেমন রাজা, সুলতান, ভূস্বামীরা চীনের রেশম ব্যবহার করতেন। এ প্রসঙ্গে বাংলার শব্দভান্ডারের একটি সুন্দর শব্দের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। শব্দটি হলো চীনাংশুক। এই শব্দের অর্থ রেশম বা চীনা রেশম। বিভিন্ন সাহিত্যে উল্লেখ আছে যে, অভিজাতরা চীনাংশুক পরেন। এই একটি শব্দ থেকেই অনুধাবন করা যায় প্রাচীনকাল বা মধ্যযুগ থেকে রেশমপথ (সিল্ক রোড) এর মাধ্যমে চীনের রেশম বাংলায় এসেছে এবং রাজারাজড়া ও অভিজাতদের পরিধেয় হয়েছে। তেমনি বাংলার মসলিন এবং সুতিবস্ত্র চীনে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

এবার একটু আধুনিক যুগের দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে বাংলাদেশের যশোর, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া অঞ্চলে বেশ কিছু চিনির কল স্থাপন করেছিল চীনা ব্যবসায়ীরা। কিন্তু সে সময় নীলকরদের দাপটে আখের চাষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় দারুণভাবে। চিনির কলগুলোও ব্যবসা গুটিয়ে ফেলে। ইংরেজ আমলেই কলকাতায় ও ঢাকায় চায়না টাউন গড়ে ওঠে। ঊনবিংশ শতকে ঢাকার ইসলামপুরে চীনা জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল। ঢাকার জুতার ব্যবসার সিংহভাগ ছিল চীনাদের দখলে। কলকাতারও চীনাপট্টিতে বা চায়না টাউনে জুতার ব্যবসা গড়ে ওঠে। তাদের সঙ্গে চীনের খাবার-দাবারও বাংলায় জনপ্রিয়তা পেতে থাকে। বাংলার খাদ্য-সংস্কৃতিতে চীনা খাবার এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছে বিংশ শতকের প্রথম দিক থেকেই।

বর্তমানে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক অংশীদার চীন। বাংলাদেশের মোবাইল ফোন এবং ইলেকট্রনিক সামগ্রীর বাজার চীনের দখলেই বলা চলে। রাসায়নিক সামগ্রী, খেলনা, ক্রোকারিজ, ক্রীড়াক্ষেত্রে ব্যবহৃত সামগ্রী, জুতা, কম্পিউটার ও কম্পিউটার একসেসরিজসহ বিভিন্ন সামগ্রীর ক্ষেত্রে চীনা পণ্যের প্রাধান্য রয়েছে। বাংলাদেশের অন্যতম বড় উন্নয়ন অংশীদারও চীন। নির্মাণ, গতানুগতিক ও বিকল্প বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং অবকাঠামো উন্নয়নের বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চীনা কোম্পানি। বাংলাদেশের বিভিন্ন নির্মাণ প্রকল্পে চীনের সহযোগিতা অব্যাহত আছে। পায়রা বন্দর নির্মাণেও চীনের সহযোগিতা রয়েছে।

খুনমিং, কুয়াংচোওসহ চীনের বিভিন্ন শহরে বাস করছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিনই ব্যবসায়িক প্রয়োজনে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা চীনে যাতায়াত করছেন। তারা চীন থেকে হরেক রকম সামগ্রী বাংলাদেশে আমদানি করছেন। বাংলাদেশ থেকে কিছু কিছু সামগ্রী চীনে রফতানি হয়। এর মধ্যে রয়েছে তৈরি পোশাক, পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়া, ইলিশ মাছ, কুঁচে, কাঁকড়া, প্লাস্টিক পণ্য, ফুল, সবজি, ফল, মসলা, তামাক ইত্যাদি। বাংলাদেশে উৎপাদিত প্রক্রিয়াজাত চামড়ার ৬০ শতাংশের বেশি চীনে রফতানি হয়। অপ্রক্রিয়াজাত চামড়ারও একটি বড় অংশ চীনে রফতানি হচ্ছে। চীনের বাজারে এশিয়া-প্যাসিফিক ট্রেড এগ্রিমেন্টের (আপটা) আওতায় ৮৩টি পণ্যে এবং বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার আওতায় আরও পাঁচ হাজার পণ্যে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা পাচ্ছে বাংলাদেশ। তবে তৈরি পোশাকসহ প্রধান কিছু রফতানি পণ্য এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না থাকায় বাংলাদেশের রফতানি বাড়ছে না।

চীনে বাংলাদেশি পণ্যের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। আরও বেশি পরিমাণে পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়াজাত পণ্য, ওষুধ, সামুদ্রিক খাদ্য, সুতিবস্ত্র, হস্তশিল্পজাত বিভিন্ন সামগ্রী চীনের বাজারে ভালো অবস্থান গড়ে নিতে পারে। বাংলাদেশের রয়েছে তুলনামূলকভাবে সস্তা শ্রমশক্তি। এ জন্য অনেক চীনা প্রতিষ্ঠান তাদের শিল্পকারখানা বাংলাদেশে স্থাপন করতে পারে। বাংলাদেশের হোটেল ও পর্যটন ব্যবসায় চীনা ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করতে পারেন। বিনিয়োগের আরও অনেক খাত রয়েছে। বস্ত্র ও চামড়ার মতো শিল্প খাত এবং কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ ও হালকা প্রকৌশলের মতো মাঝারি ও ভারি শিল্প খাতে চীনা ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করতে পারেন।

চীন বাংলাদেশের সঙ্গে নতুন করে জিরো ট্যারিফ স্কিম নামে একটি সুবিধা চালু করতে যাচ্ছে। এর ফলে চীনে রফতানিযোগ্য ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে বাংলাদেশ। এখন ৬৫ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পায় বাংলাদেশ।

চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বন্ধুত্ব যত দৃঢ় হবে দুটি দেশই ততো বেশি উপকৃত হবে। তবে অর্থনৈতিক সম্পর্কের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক বিনিময়কেও বাড়াতে হবে। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণের বন্ধুত্বকে আরও প্রাণময় করতে তাই প্রয়োজন সাহিত্যিক লেনদেন বাড়ানো। বাংলা ভাষার সাহিত্য সম্পদ যেমন চীনা ভাষায় অনুবাদ হওয়া প্রয়োজন, তেমনি চীনা ভাষার সাহিত্য সম্পদও বাংলায় অনুবাদ হওয়া জরুরি। এজন্য পরস্পরের ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আরও বেশি জানতে হবে, জানাতে হবে।

চীন বাংলাদেশের বন্ধুত্বকে আরও দৃঢ় করতে হবে। পুরোনো রেশম পথের মতো নতুন রেশম পথ যুগেও যেন চীন ও বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অব্যাহত থাকে এটা দুদেশের দেশপ্রেমিক নাগরিকদের কামনা।

image

চীনের মহাপ্রাচীরের ওপর বাংলাদেশের পতাকা হাতে লেখক

আরও খবর
৬৯ বছরে সংবাদ
ভাষা থেকে ভূখন্ড
স্মৃতিময় সংবাদ-এর ৬৯ বছর
একটি রাজনৈতিক পাঠ
সংবাদ : কিছু কথা কিছু স্মৃতি
যুগে যুগে সংবাদপত্রের অগ্রযাত্রা
আলোর তৃষ্ণায় জাগো
ইতিহাস ঐতিহ্য ও আদর্শের স্মারক দৈনিক সংবাদ
কেন লিখি
সংবাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আত্মার
ঐতিহ্য আর মুক্তচিন্তার সংবাদ
আমার সংবাদ সংবাদের আমি
বিচিত্র জীবিকা বিচিত্র জীবন
ঋতুপর্ণ ঘোষের এলোমেলো দেশকাল
সংবাদের জলসাঘর
আমরা এখন শান্ত হয়ে আছি
মাটির মাধুর্য
কষ্টের ঢাকা স্বপ্নের বাংলাদেশ
তোমারে বধিবে যে...
বঙ্গবন্ধুর জনকল্যাণের অর্থনৈতিক নীতি কৌশল
শারহুল পটবসন্ত ও বজলুর রহমান
শিশুশিক্ষায় শিল্প-সাহিত্য-সংগীত
গণমাধ্যমের হাল-হকিকত
এবং বজলুর রহমান স্মৃতিপদক
দুর্নীতি, পেশাদারিত্ব ও উন্নয়ন
বাংলাদেশের থিয়েটার চর্চার ভবিষ্যৎ
চেতনায় নৈতিকতা মূল্যবোধ : বিরুদ্ধবাস্তবতা
সবার উপরে মানুষ সত্য
আহমদুল কবির শ্রদ্ধাঞ্জলি
কার্যকর সংসদ এবং সুশাসনের স্বপ্ন
‘সংবাদ’ আমারই ছিল আমারই আছে
আমাদের ‘সংবাদ’
নারীর অধিকার ও সচেতনতা
গণমাধ্যমে বিশ্বাস কমছে পাঠকের
নারী ও তার বিধাতা পুরুষ
বাংলাদেশের নারী
সংবাদের কাছে আমি ঋণী
বিস্মৃতিপ্রবণতা ও রাষ্ট্রের অক্ষমতা
যে দীপশিখা দিয়েছে আলো

বুধবার, ১০ জুলাই ২০১৯ , ২৬ আষাঢ় ১৪২৫, ৬ জ্বিলকদ ১৪৪০

চীন ও বাংলাদেশ : প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সম্পর্ক

শান্তা মারিয়া

image

চীনের মহাপ্রাচীরের ওপর বাংলাদেশের পতাকা হাতে লেখক

চীনের সঙ্গে সুপ্রাচীনকাল থেকেই বঙ্গভূমির সম্পর্ক রয়েছে। এই সম্পর্ক যেমন সাংস্কৃতিক তেমনি অর্থনৈতিক। বিশ্বের সুপ্রাচীন সভ্যতাগুলোর অন্যতম চীন। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিও সমৃদ্ধ। বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপ গাঙ্গেয় অববাহিকায় প্রাচীনকাল থেকেই জনবসতি গড়ে ওঠে। গ্রিক ইতিহাসবিদদের লেখায় গঙ্গা অববাহিকায় মোহনা অঞ্চলে অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ অঞ্চলে গঙ্গাহৃদয় বা গঙ্গাহৃদি নামে এক শক্তিশালী রাজ্যের কথা রয়েছে। তাদের গঙ্গারাইডিস নামে অভিহিত করা হয়েছে।

মহান ভারতীয় মহাকাব্য মহাভারতে বঙ্গ নামে দেশের উল্লেখ রয়েছে। বঙ্গের রাজা তার হস্তিবাহিনী নিয়ে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। মহাভারতে চীন জাতিরও উল্লেখ রয়েছে। মহাভারতের আদিপর্বে রয়েছে বিশিষ্ট মুনির কথা। রাজা বিশ্বামিত্র বিশিষ্ট মুনির আশ্রমের ধেনু নন্দিনীকে ধরে নিয়ে যেতে চাইলে নন্দিনীর দেহ থেকে অসংখ্য সৈন্যর উৎপত্তি হয়। সেই সৈন্যদলে বিভিন্ন জাতির সৈন্য ছিল। এরা নন্দিনীকে রক্ষা করে। এই জাতিগুলোর মধ্যে বাহ্লিক, পারসিক, শক, যবন, চীনসহ বিভিন্ন জাতির নাম উল্লেখ করা হয়। একইভাবে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধেও বিভিন্ন জাতির সৈন্যদলের যে উল্লেখ রয়েছে তার মধ্যে বঙ্গ ও চীন জাতির কথা রয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব যুগে প্রাচীন বাংলায় বিভিন্ন সামন্ত রাজ্য বিকশিত হয়। পুন্ড্রবর্ধনের সভ্যতা প্রায় আড়াই হাজার বছরের পুরনো। গৌড়, বঙ্গ, পু্ন্ড্র, সমতট, রাঢ়, হরিকেল, চন্দ্রদীপ, চন্দ্রকেতুগড়, চন্দ্রকোটসহ বিভিন্ন রাজ্য মিলে গড়ে ওঠে আজকের বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ। এককথায় একে বৃহত্তর বঙ্গ বলে অভিহিত করা যায়। প্রাচীন বাংলার সমাজ ব্যবস্থার বর্ণনা পাওয়া যায় বিখ্যাত চীনা পর্যটক ও তীর্থযাত্রী ফা হিয়েন (৩৩৭-৪২২ খ্রিস্টাব্দ) এর লেখায়। তিনি বৌদ্ধশাস্ত্রের জ্ঞানকে চীনে নিয়ে যান। চীনের পর্যটক ও তীর্থযাত্রী হিউয়েন সাং নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন সপ্তম শতকে। তার বর্ণনায় বাংলার সামাজিক অবস্থার বর্ণনা পাওয়া যায়। তিনি পুন্ড্রবর্ধনেও এসেছিলেন। আরও অনেক চীনা পর্যটক প্রাচীন বাংলায় এসেছিলেন। প্রাচীন বাংলার সামাজিক ইতিহাসের মূল্যবান দলির আমরা তাদের কাছ থেকেই পেয়েছি।

পক্ষান্তরে বাংলার চর্যাপদের কবি ও নাথপন্থার গুরু মীননাথ এবং তার শিষ্য নাথপন্থি বিখ্যাত গুরু গোরক্ষনাথ যখন তিব্বতে যান এবং সেখানেই অন্তিমকাল পর্যন্ত জীবন অতিবাহিত করেন তখন অনিবার্যভাবে তারা বাংলার সহজসাধন জ্ঞানকে এবং দোহা বা বুদ্ধিষ্ট মিষ্টিক সং ও বাংলার সংস্কৃতিকে সেখানে বয়ে নিয়ে যান। বাংলার পন্ডিত অতীশ দীপংকর যখন তিব্বতে যান তিনিও একইভাবে শুধু বৌদ্ধশাস্ত্রকেই নয় বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতিকেও চীনে নিয়ে গিয়েছিলেন।

চীনের ও বাংলার মানুষের পারস্পরিক লেনদেন যে প্রাচীনকালে বেশ সুচারুভাবেই ছিল তা বাংলার শব্দভান্ডারে বিভিন্ন চীনা শব্দের উপস্থিতি প্রমাণ করে। হুজুগে বাঙালি আর হেকমতে চীন বাগধারাটি বাঙালির আবেগপ্রবণতা আর চীনাদের কর্মদক্ষতাকেই শুধু নয়, চীনা ও বাঙালির মানসিক যোগাযোগকেও তুলে ধরে।

শেরশাহের আমলে যে গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড নির্মিত হয় তা দিল্লি থেকে বাংলা পর্যন্ত পৌঁছায়। এই পথ দিল্লি থেকে রেশমপথের সঙ্গে যুক্ত ছিল। ফলে রেশমপথের মাধ্যমে চীনের সঙ্গে বাংলার যোগাযোগ স্থাপিত হয়। বাংলার মসলিন ও সুতিবস্ত্র যেমন চীন, আরব, মিশর, গ্রিস ও রোমে পৌঁছায় তেমনি চীনের রেশমও পৌঁছে যায় বাংলায়। বাংলার প্রাচীন রাজধানী সোনারগাঁও-এর সঙ্গে চীনের কেন্দ্রভূমির মধ্যে বাণিজ্যিক লেনদেন তখন থেকেই প্রচলিত ছিল। বাংলার অভিজাত সমাজ যেমন রাজা, সুলতান, ভূস্বামীরা চীনের রেশম ব্যবহার করতেন। এ প্রসঙ্গে বাংলার শব্দভান্ডারের একটি সুন্দর শব্দের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। শব্দটি হলো চীনাংশুক। এই শব্দের অর্থ রেশম বা চীনা রেশম। বিভিন্ন সাহিত্যে উল্লেখ আছে যে, অভিজাতরা চীনাংশুক পরেন। এই একটি শব্দ থেকেই অনুধাবন করা যায় প্রাচীনকাল বা মধ্যযুগ থেকে রেশমপথ (সিল্ক রোড) এর মাধ্যমে চীনের রেশম বাংলায় এসেছে এবং রাজারাজড়া ও অভিজাতদের পরিধেয় হয়েছে। তেমনি বাংলার মসলিন এবং সুতিবস্ত্র চীনে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

এবার একটু আধুনিক যুগের দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে বাংলাদেশের যশোর, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া অঞ্চলে বেশ কিছু চিনির কল স্থাপন করেছিল চীনা ব্যবসায়ীরা। কিন্তু সে সময় নীলকরদের দাপটে আখের চাষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় দারুণভাবে। চিনির কলগুলোও ব্যবসা গুটিয়ে ফেলে। ইংরেজ আমলেই কলকাতায় ও ঢাকায় চায়না টাউন গড়ে ওঠে। ঊনবিংশ শতকে ঢাকার ইসলামপুরে চীনা জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল। ঢাকার জুতার ব্যবসার সিংহভাগ ছিল চীনাদের দখলে। কলকাতারও চীনাপট্টিতে বা চায়না টাউনে জুতার ব্যবসা গড়ে ওঠে। তাদের সঙ্গে চীনের খাবার-দাবারও বাংলায় জনপ্রিয়তা পেতে থাকে। বাংলার খাদ্য-সংস্কৃতিতে চীনা খাবার এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছে বিংশ শতকের প্রথম দিক থেকেই।

বর্তমানে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক অংশীদার চীন। বাংলাদেশের মোবাইল ফোন এবং ইলেকট্রনিক সামগ্রীর বাজার চীনের দখলেই বলা চলে। রাসায়নিক সামগ্রী, খেলনা, ক্রোকারিজ, ক্রীড়াক্ষেত্রে ব্যবহৃত সামগ্রী, জুতা, কম্পিউটার ও কম্পিউটার একসেসরিজসহ বিভিন্ন সামগ্রীর ক্ষেত্রে চীনা পণ্যের প্রাধান্য রয়েছে। বাংলাদেশের অন্যতম বড় উন্নয়ন অংশীদারও চীন। নির্মাণ, গতানুগতিক ও বিকল্প বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং অবকাঠামো উন্নয়নের বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চীনা কোম্পানি। বাংলাদেশের বিভিন্ন নির্মাণ প্রকল্পে চীনের সহযোগিতা অব্যাহত আছে। পায়রা বন্দর নির্মাণেও চীনের সহযোগিতা রয়েছে।

খুনমিং, কুয়াংচোওসহ চীনের বিভিন্ন শহরে বাস করছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিনই ব্যবসায়িক প্রয়োজনে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা চীনে যাতায়াত করছেন। তারা চীন থেকে হরেক রকম সামগ্রী বাংলাদেশে আমদানি করছেন। বাংলাদেশ থেকে কিছু কিছু সামগ্রী চীনে রফতানি হয়। এর মধ্যে রয়েছে তৈরি পোশাক, পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়া, ইলিশ মাছ, কুঁচে, কাঁকড়া, প্লাস্টিক পণ্য, ফুল, সবজি, ফল, মসলা, তামাক ইত্যাদি। বাংলাদেশে উৎপাদিত প্রক্রিয়াজাত চামড়ার ৬০ শতাংশের বেশি চীনে রফতানি হয়। অপ্রক্রিয়াজাত চামড়ারও একটি বড় অংশ চীনে রফতানি হচ্ছে। চীনের বাজারে এশিয়া-প্যাসিফিক ট্রেড এগ্রিমেন্টের (আপটা) আওতায় ৮৩টি পণ্যে এবং বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার আওতায় আরও পাঁচ হাজার পণ্যে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা পাচ্ছে বাংলাদেশ। তবে তৈরি পোশাকসহ প্রধান কিছু রফতানি পণ্য এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না থাকায় বাংলাদেশের রফতানি বাড়ছে না।

চীনে বাংলাদেশি পণ্যের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। আরও বেশি পরিমাণে পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়াজাত পণ্য, ওষুধ, সামুদ্রিক খাদ্য, সুতিবস্ত্র, হস্তশিল্পজাত বিভিন্ন সামগ্রী চীনের বাজারে ভালো অবস্থান গড়ে নিতে পারে। বাংলাদেশের রয়েছে তুলনামূলকভাবে সস্তা শ্রমশক্তি। এ জন্য অনেক চীনা প্রতিষ্ঠান তাদের শিল্পকারখানা বাংলাদেশে স্থাপন করতে পারে। বাংলাদেশের হোটেল ও পর্যটন ব্যবসায় চীনা ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করতে পারেন। বিনিয়োগের আরও অনেক খাত রয়েছে। বস্ত্র ও চামড়ার মতো শিল্প খাত এবং কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ ও হালকা প্রকৌশলের মতো মাঝারি ও ভারি শিল্প খাতে চীনা ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করতে পারেন।

চীন বাংলাদেশের সঙ্গে নতুন করে জিরো ট্যারিফ স্কিম নামে একটি সুবিধা চালু করতে যাচ্ছে। এর ফলে চীনে রফতানিযোগ্য ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে বাংলাদেশ। এখন ৬৫ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পায় বাংলাদেশ।

চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বন্ধুত্ব যত দৃঢ় হবে দুটি দেশই ততো বেশি উপকৃত হবে। তবে অর্থনৈতিক সম্পর্কের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক বিনিময়কেও বাড়াতে হবে। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণের বন্ধুত্বকে আরও প্রাণময় করতে তাই প্রয়োজন সাহিত্যিক লেনদেন বাড়ানো। বাংলা ভাষার সাহিত্য সম্পদ যেমন চীনা ভাষায় অনুবাদ হওয়া প্রয়োজন, তেমনি চীনা ভাষার সাহিত্য সম্পদও বাংলায় অনুবাদ হওয়া জরুরি। এজন্য পরস্পরের ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আরও বেশি জানতে হবে, জানাতে হবে।

চীন বাংলাদেশের বন্ধুত্বকে আরও দৃঢ় করতে হবে। পুরোনো রেশম পথের মতো নতুন রেশম পথ যুগেও যেন চীন ও বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অব্যাহত থাকে এটা দুদেশের দেশপ্রেমিক নাগরিকদের কামনা।