আমরা এখন শান্ত হয়ে আছি

বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

আমার চারপাশে পাহাড়ের স্তব্ধতা। এই স্তব্ধতা কেউ ভেঙে দিক আমি চাই না। সকাল বেলা, রোদ যখন গাছের পাতা রঙিন করে আমি এক কাপ কালো কফি খেয়ে গরুর ঘণ্টার পিছু পিছু পাহাড়ের ঢালে আসি। আমাকে ঘিরে ধরে পাহাড়ের স্তব্ধতা কিন্তু পাহাড়ের মধ্যে নানা শব্দ আছে। সে সকল শব্দ কখনো পাখির ডাক, কখনো পাথরে বাতাসের বাজনা, কখনো গরুর পায়ের আওয়াজ, কখনো প্রজাপতির নড়াচড়া হয়ে যায়। আমি শব্দকে এভাবে ভিন্ন ভিন্ন করতে থাকি। আমি শান্ত হয়ে যাই।

তখন তুমি আমার সামনে এসে দাঁড়াও। তুমি এসেছ তোমার দেশ থেকে পালিয়ে, আমিও এসেছি আমার দেশ থেকে পালিয়ে। মানুষ কেন পালায়? পালাতে বাধ্য হয়? তুমি কি জবাব খুঁজে পেয়েছো?

কিংবা আমি?

মনে আছে আমরা যখন একত্রে থাকা শুরু করি। তুমি বলতে নিষিদ্ধ ইশতেহার যে-ভাবে আমি পড়ি সে-ভাবে নাকি আমি তোমার দিকে তাকাই, সেই একাগ্রতা নিয়ে। আসলে আমাদের দুজনের অভিজ্ঞতার মধ্যে নিষিদ্ধ ইশতেহার গেঁথে আছে।

তুমি কাজ সেরে সারাদিন পর ফিরে আসতে। তুমি কাজ নিয়েছিলে পাড়ার লাইব্রেরিতে। তুমি ফিরে এলেই বলতাম, চা?

হ্যাঁ, বলেই ক্লোকটা ছুঁড়ে দিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়তে।

কেটলি বসিয়ে দিয়ে আমি ফিরে আসতাম তোমার কাছে। তোমার চুলে হাত বুলোতাম। দেয়ালের ময়লা ওয়াল পেপার বাতির আলোয় আরো কদর্য হয়ে উঠত। আমার নাকে আসত কেন জানি পচা ফুলের গন্ধ।

ততক্ষণে তুমি উঠে বসেছ। একটু হেসে জিজ্ঞেস করতে, কী করলে সারাদিন?

আমি বলতাম, সেই একই কাজ। গ্যারেট সাফ করলাম কয়লা তুললাম। কিচেন সাফ করলাম।

লেখোনি কিছু?

না।

কেন লেখো না? লিখলে তো অতীতটাকে খুঁজে পাও।

আমি কোনো জবাব দিই না। ঠান্ডা লাগে, আর একটা পুলওভার গায়ে চাপাই। কিচেনে গিয়ে চা বানাই, ট্রেতে সাজিয়ে নিয়ে আসি দুটি কাপ, দুধের বোতল, চিনি। চা খেতে খেতে আমরা নিঃশব্দ হয়ে যাই। আমরা ফিরে যাই নিজের নিজের অভিজ্ঞতায়।

যেদিন তোমার মুড ভালো থাকত সেদিন কিংবা সেসব দিনগুলিতে তুমি বলতে তোমার ওয়ার্স শহরের কথা, তোমার প্রিয় শহর।

তুমি বলতে টমাসের কথা। তোমাদের প্রিয় কাফে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে। টমাস সবসময় দেরি করে আসত। কাফের কাছে যেই ট্রাম আসত লাফ দিয়ে নামত, কাচের দরজা ধাক্কা দিয়ে ঢুকত, যে কোণে তোমরা সবাই বসে থাকতে সেখানে এসে মাফ চাইত দেরির জন্য। ‘মারী’ কাউন্টারের পেছনের মেয়েটিকে চেঁচিয়ে ডাকত : ‘এক প্লেট মাসরুম ফ্রাই আর দুটো খালি প্লেট।’ কথা বলত জোরে; হাসত জোরে, যদিও তুমি কখনো বলনি, আমি বুঝতাম টমাস তোমাকে প্রেম করত সমস্ত সত্তা দিয়ে।

টমাসের কথা তুমি যখন বলতে কিংবা তোমার মনে পড়ে যেত তোমার চোখে পৃথিবীর সব নরম ভর করত।

মাসরুমে কামড় দিয়ে টমাস একদিন বলেছিল, দ্যাখো সবই আমার মনে আছে; আজ সকালে মা চিঠি পেয়েছেন সেন্ট্রাল কমিটি থেকে : বাবাকে রিঅ্যাভিলেটি করা হয়েছে। চিঠি পড়ে মা শুধু বললেন, তোর বাবাকে যখন পুলিশ ধরে নিয়ে যায় সব তছনছ করে যায়; এমনকি তোর বাবার ফটোগ্রাফ পর্যন্ত। তখন থেকে আমার আছে কান্না আর চুপ করে থাকা। এখন এই চিঠি নিয়ে আমি কী করব। তোর কাছে রাখ।’ টমাস পকেট থেকে বের করে চিঠি দিয়েছিল তোমার দিকে। তুমি চিঠিটা নিয়ে ভাবছিলে, তাই না?

টমাসের বাবা গমুলকার সহকর্মী ছিলেন। রুটির রায়টে গমুলকাকে সরানো হল, সেই সঙ্গে টমাসের বাবাকে প্রতিবিপ্লবী কর্মে লিপ্ত দায়ী করে তাকে দেওয়া হল সশ্রম কারাদন্ড। জেলেই তিনি মারা যান, জানুয়ারির কোনো এক সকালে মৃতদেহ তাদের বাড়িতে পৌঁছেছিল। কবরস্থানে বরফ আর বরফ। কিছু নেই, কিছু ছিল না। না পাখি, না পাতা, না কোনো শব্দ। জানুয়ারির ছ’ তারিখ, দ্যাখো তারিখটা পর্যন্ত আমার মনে আছে।

তুমি টমাসের হাতে চাপ দিয়ে বলেছিলে, ‘ছিঃ মন খারাপ করে না।’

টমাস ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিল, চিৎকার শুরু করেছিল, ‘মন খারাপ করব না। ভদ্রলোক, বন্ধু, সহকর্মী, কমরেডরা বলুন আমি মন খারাপ করব না। আমার বাবাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়েছে তবু আমি মন খারাপ করব না। বলুন কমরেডরা, বন্ধুরা, সহকর্মীরা আমার মন খারাপ করা উচিত কি না।’

টমাসের চিৎকার শুনে কাফের অনেকেই হতবাক, রেগুলারদের অনেকেই বিল চুকিয়ে ততক্ষণে রাস্তায়। শুধু তুমি চুপ, আর কাউন্টারে মারী নির্বিকারে গ্লাস ধুচ্ছে।

ততক্ষণে টমাসের রাগ পড়ে গেছে। আস্তে আস্তে বলেছে, ‘মাপ করো লক্ষ্মীটি মাপ করো।’ বাবার কথা মনে হলেই আমার গলার মধ্যে রক্ত গলগল করে ওঠে। বাবাকে ধরে নিয়ে যাবার পর বাবার পুরোনো কাগজপত্র ঘেঁটেছি। বাবার বিশ্বাসের মধ্যে কোনো খাদ ছিল না। আমাদের দেশে শোষণহীন সমাজ তৈরি হবে সে সত্য, যেমন সত্য ওয়ার্স শহর কিংবা সত্য ক্রেকাও শহরের দুর্গ। বাবার ডায়েরিতে একটা নোট পড়েছি: ‘যদি মুক্ত ব্যক্তিদের সমাজ সম্ভব তা হলে মুক্ত ব্যক্তিরাই এই সমাজ রচনা করতে পারে।’

টমাস কথা বলছে, থেমে যাচ্ছে, ফের বলছে। তুমি তাকিয়ে টমাসের দিকে, কিংবা নয়। তুমি হয়তো ভাবছিলে ভিস্তলা নদীতে স্রোত কেমন ফুলে উঠেছে, হয়তো ভাবছিলে নদীর পাড়ে লিনডেন গাছের তলায় আগের জন্মে টমাসের পাশে বসে জন্মদিনের উৎসবের কথা। পুরোনো দিন পুরোনো দিনের মতন ধূসর, কতদূরের তাই না? যেখান থেকে স্বপ্নের শিস শোনা যায়।

টমাস তখনো বলছে, ‘স্ব-নিযুক্ত এলিটরা ক্ষমতা আর সুবিধে কতদিন অগণতান্ত্রিক উপায়ে ধরে রাখবে। নিশ্চয়ই শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলন ফের দেখা দেবে, মুক্ত ব্যক্তিরা ফের সমাজ তৈরি করবে, জরুরি অবস্থার সংবিধান খান খান হয়ে যাবে, গাডানস্কের লেনিন শিপইয়ার্ডের শ্রমিকরা প্রচলিত বিধিনিষেধ ভেঙে ফেলবে, আমরা ফের আসব সমাজের কেন্দ্রে, শেষ মানুষটি অব্দি তিক্ত শেষ অব্দি আমরা আসব...

তুমি খোলা দরজার ফাঁক দিয়ে দেখছিলে সচ্ছল সমাজের জন্য পৃথিবীর সকল সরকার কেমনভাবে তৈরি করে খবর কাগজের হেড লাইন। তুমি দেখছিলে আর ভাবছিলে যুদ্ধের পর যুদ্ধ, গোস্ত কাটার কাঠের টুকরোয় ফোঁটা ফোঁটা চোখের পানি, রকেট ঠেকানো রকেট, রুটির ঝুড়ি, শ্রেণী সংগ্রাম। তুমি ভাবছিলে সেই লিনডেন গাছের তলায় কখনো আর যাবে না। তুমি ভাবছিলে তোমার আর টমাসের শরীরে শরীর জুড়ে যে-নম্র কোমলতা তৈরি হয়েছে, সারারাত যা তোমরা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়েছÑ সে-সব আর আসবে না। কারণ টমাস দাঙ্গা বাধিয়েছে। আমূল আদিগন্ত সর্বগ্রাসী।

টমাস ফের চিৎকার শুরু করেছে ‘কমরেডরা ভদ্রলোকেরা সহ-কর্মীরা বন্ধুরা আপনারা কেউ কি কোথাও নেই। আপনারা কি জানেন না আপনাদের সমাজ আপনাদের বাদ দিয়ে কীভাবে তৈরি হয়!’

তোমার চোখ, তুমি বলেছিলে পরে আমাকে, তোমার মনে হয়েছে কে যেন মেশিনগানের সামনে মেলে ধরেছে। যেন ভয়ঙ্কর ধৈর্য তোমার মুখ, এক লৌহ-মুখোশ পরা।

বেশ কিছুদিন ধরে তোমার শরীর খারাপ যাচ্ছে। লাইব্রেরি থেকে ফিরে আসতে ক্লান্ত, ক্লান্ত হয়ে। এক উইক এন্ডে, শনিবার, ভোরে দেখি জানালা খুলে তুমি বাইরে তাকিয়ে। মনে হচ্ছে আবৃত্তি করছ:

এক ছাড়পত্রের মালিক তুমি

রাষ্ট্রপতির

রুপোলি স্বাক্ষর হলফ করে বলে

এই হলে তুমি

তোমার ছাড়পত্র আছে

পাহাড়ি দেশের পাখিরা

রবারের মোহরে বসে থাকে

যেন বসে আছে কোনো পাহাড়ের চুড়োয়

তারা পাহারা দিচ্ছে তোমার

তোমার আধ সের মাংস

ভয় পেয়ো না

তুমি হারিয়ে যাবে না

রাষ্ট্রপতি তোমার ওপর নজর রাখছেন

তোমার এক ছাড়পত্র আছে

এতএব তুমি আছ

আমি শুয়ে শুয়ে জিজ্ঞেস করেছি, আশ্চর্য সুন্দর কবিতা। কার লেখা?

তুমি বলেছ ইয়েশি হারাসিমোভিচের।

কোন দেশী?

পোলিশ!

তখন দেখি আরো কবিতার বই ছড়ানো বিছানার পাশে। লাইব্রেরি থেকে নিয়ে এসেছ।

তুমি বলেছ, শুনবে আর একটি কবিতা?

শোনাও, সিগারেট ধরিয়ে আমি বলেছি।

তুমি আস্তে আস্তে বলেছ, গাছের পাতায় যেমন করে কুয়াশা নামে তেমন বোধ হয়েছে তোমার গলা, কবিতাটির নাম : কার্ল হাইনরিখ মার্ক্স। একটু শোনাই :

আজ দেখি তুমি ফেঁসে গিয়েছ।

তোমারই চেলাদের কৃপায়

কেবল তোমার শত্রুরাই

রয়ে গেছে অবিকল যেমনকে তেমন।

আমি তখন বুঝতে পারি কবিতা পড়ে, কথাগুলি পড়ে, পাশাপাশি, ওপর-নিচ, পৌনঃপুনিক, প্রতিধ্বনিময় পড়ে পড়ে তুমি ধরতে চাচ্ছ টমাসকে, টমাস আর তোমার অভিজ্ঞতাকে; যেন আমি তোমাকে একটু সাহায্য করেছি তোমার অভিজ্ঞতা টিকিয়ে রাখতে।

আর জানালা দিয়ে তখন ভেসে ওঠে আমার শহর, যেখানে গণতন্ত্র ফের সামরিকতন্ত্র ফের পর্যায়ক্রমে গণতন্ত্র ফের সামরিকতন্ত্রের লেফট-রাইট লেফট-রাইট। বাড়িটা চুপচাপ, আমি উঠি, কিচেনে গিয়ে চায়ের কেটলি বসাই, রুটি কাটি। বাড়িটা চুপচাপ; ফ্লোরের ওপর তুমি উবু বসে আছ, তোমার চোখ আমার ওপর নিবদ্ধ; আর আমার চোখ তোমার ওপর।

তোমার শরীর আরো খারাপ হয়ে গিয়েছে। কাজ থেকে ফিরে এলে পর তোমার নড়াচড়া করতে কষ্ট হয় দম ফুরিয়ে যায়। কোনো কিছু তোলার জন্য নিচু হলে তোমার সিধে দাঁড়াতে অসুবিধা হয়।

আমি জোর করে তোমাকে ডক্টরের কাছে নিয়ে গিয়েছি। সার্জারিতে লোক ভরতি। তোমার নম্বর দশ। তোমার ডাক এল। তোমার সঙ্গে আমিও গিয়েছি ভেতরে।

ডক্টর হাসিখুশি মুখ, চোখের চশমা মনে হয় দারুণ তেজে জ্বলছে।

কী হয়েছে তোমার?

আমি জবাব দিয়েছি, খুব ক্লান্ত ও। হাঁটতে কষ্ট হয়। কখনো কখনো রাত্রে দেখি হাঁটু মুড়ে বসে আছে। খুব তাড়াতাড়ি দম ফুরিয়ে যায়।

কখনো কি বাত-জ্বর হয়েছিল বাচ্চা বয়সে?

তুমি এবার জবাব দিয়েছ, না।

শুনি তোমার হৃদয়, যেন ঠাট্টা ডক্টর করছেন।

ডক্টর দেখলেন, বললেন, তেমন কিছু নয়। কবে এসেছ ইংল্যান্ডে?

বছর খানেক। পোল্যান্ড থেকে।

ওয়ার্স?

হ্যাঁ।

ডক্টর খসখস করে প্রেসক্রিপশন লিখলেন, লেখা থামিয়ে বললেন, সুন্দর শহর; আমি বার দুই গিয়েছি।

তুমি শুনে উজ্জ্বল হলে, সত্যি!

ডক্টর একটু থেমে বললেন, আমার বেশ কজন পোলিশ বন্ধু আছে। আশ্চর্য দেশ, আশ্চর্য আমার বন্ধুরা। দ্যাখোÑ ডক্টর ক্যাবিনেট খুলে একটা ফটোগ্রাফ দেখালেন। দুজন পুরুষ; একজন মহিলা। মহিলাটি টাইট স্কার্ট পরা, মাথায় একটি সিফন স্কার্ফ জড়ানো; একজন পুরুষের মুখে সিগারেট, অপরজনের হাতে একটি বই।

তুমি ফটোগ্রাফটির দিকে তাকিয়ে থাকলে। কোনো পটভূমি নেই। ডক্টর উঠে ক্যাবিনেটে ফটো রাখলেন, প্রেসক্রিপশন দিয়ে বললেন; তিনটে ট্যাবলেট ছ ঘণ্টা পরপর খাবে। সামনের সপ্তাহে একবার এসো।

আমরা উঠে দাঁড়িয়েছি। তুমি হঠাৎ বললে, ডক্টর আমি কি খুব বুড়ো হয়ে গিয়েছি? আমি কেন যৌন সুখ পাই না?

ডক্টর স্থির, আমি নিশ্চুপ; তুমি বক্তৃতার মতন বলে গেলে, দ্যাখো, এতদিন পরও আমার মনে আছে।

ডক্টর ওর সঙ্গে শুয়ে আমি আরাম পাই না। টমাসই আমাকে যৌন সুখ দিয়েছে। সুন্দর, এমন সুন্দর। আমাদের একসঙ্গে হতো। আমি টমাসকে সব দিতে পারতাম। আমার শরীর তৈরি থাকত। ডক্টর আগের মতন আর হয় না। ডক্টর কেন হয় না?

আমি তোমাকে নিয়ে বাসায় ফিরে এসেছি। বাসা মানে এক কোণে একটা বড়ো খাট, বেশ কটা কম্বল আর মেঝের ওপর আরো গোটা দুই। একটা চেস্ট অব ড্রয়ার, ওপরে একটা ঘড়ি আর একটা ট্রানজিস্টার। আর একটা ভাড়া করা টেলিভিশন। জানালায় ঘন আইভি আর কিচেনে গর্ত।

আমি তোমাকে আমাদের এই বাসায় নিয়ে এসেছি। কেন জানি মনে হয়েছে কোনো ভার নেই। আসলে তোমার আর আমার মধ্যে টমাস শুয়ে আছে, আমার ভূমিকা কেবল তোমাকে সাহায্য করাÑ যাতে তুমি তোমার অভিজ্ঞতা টিকিয়ে রাখতে পারো। টমাস ধরা পড়ে কই গিয়েছে তুমি জানো না। তোমাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে গিয়েছিল। তোমাকে তোমার বন্ধুরা স্মাগল করে সীমান্ত পার করিয়ে দিয়েছে। তুমি ট্রাফালগার স্কোয়ারে চিৎকার করেছ। রেড লায়ন স্কোয়ারে কিংবা ক্যামডেন টাউনে বক্তৃতা শুনতে গিয়েছ। তোমার পাশে আমি থেকেছি, তুমি আমাকে আদর করেছ, অন্যমনস্কভাবে। কিংবা আদর করেছ টমাস ভেবে।

এর মধ্যে আমাদের এক বন্ধু হয়েছে। এক পোল, বিশ বছর লন্ডনের বাসিন্দা। জনের একটা এন্টিকশপ আছে, আর আছে একটা ভ্যান। আমরা ঠাট্টা করে বলি : জাঙ্কশপ। হঠাৎ হঠাৎ হাজির হয়, টেনে নিয়ে চলে দূরে, কখনো কিংস্টনে, কখনো সেন্ট আইভসে।

জন কোনো কিছু নিয়ে ভাবে না, পোল্যান্ড না, লেবানন না, আণবিক যুদ্ধ না।

জন বোধহয় তোমাকে পছন্দ করে। জন এলে তুমি খুশি হতে। জনের অভিজ্ঞতা আমাদের দুজন থেকে পৃথক। আমাদের অতীত জুড়ে গর্ত আর গর্ত। জন তো সমস্তক্ষণ বর্তমানেই আছে।

জন বলত, সামারে কই যাবে?

তুমি বলতে, জানি না।

আমি বলতাম, জানি না।

জন বলত, রোমে যাব। তুমিও যাবে, তোমরাও।

যেন নিশ্চিত, আমরা তিনজন মিলে যাব; যাবই, এই সামারে রোমে, পরের সামারে বুদাপেস্টে, তারপরের সামারে প্রাগে।

আমি ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। তুমি টের পাচ্ছিলে। তোমার চোখ থেকে কোথাও পালাবার জো ছিল না, যতই আমাদের মধ্যে টমাস থাকুক না কেন। আমার ব্যথা বেড়ে যাচ্ছিল, আমার পিঠের ব্যথা।

জন এলেই তুমি বলতে, জানো ওর পিঠের ব্যথা বেড়েছে। বোধহয় স্লিপ ডিস্ক। ওকে ডক্টরের কাছে নিয়ে যেতেই হবে।

জন দুদিন বাদে ফের এসেছে।

তুমি বলেছ, দুদিন ধরে ও বিছানায় শুয়ে। ওর শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ভাবছি কাজ থেকে ছুটি নেব।

জন কিছু বলছে না দেখে তুমি বলে উঠেছ, জন তুমি এসেছ বলে আমি খুশি। আর তো কেউ নেই। ওর শরীর ভেঙে পড়েছে। ঘুমের ঘোরে ও খালি নিজের দেশের কথা বলে। ওর ঘুমুতে খুব কষ্ট হয়। আমি ঘুমোই আর জাগি, জাগি আর ঘুমোই- ওর যে ঘুম হয় না।

জন যাবে বলে উঠেছে। তুমি বলেছ, আমরা দুজন বাদে আমাদের কেউ নেই।

আমি তোমার কথা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যাই।

আমি ক্রমে ভালো হয়ে উঠি। তুমি আবার ঠিকঠাক অফিস যেতে শুরু কর। আমি ফিরে যাই আমার ভাবনায় যেখানে গণতন্ত্র ফের সামরিকতন্ত্র ফের পর্যায়ক্রমে গণতন্ত্র ফের সামরিকতন্ত্রের লেফট-রাইট লেফট-রাইট। তুমি ফের ভাবতে শুরু কর টমাসকে নিয়ে, তোমার ও টমাসের মিলিত অভিজ্ঞতা নিয়ে। এইভাবে আরো কিছু দিন। আমরা মধ্যে মধ্যে কাপড়ের তলায় টের পাই আমাদের শরীরটা।

একদিন তুমি কাজ থেকে ফিরে এলে না। দু দিন বাদে তোমার চিঠি পেলাম : আমি ওয়ার্স ফিরে যাচ্ছি। আমি চিঠিটা পড়লাম একবার দুবার তিনবার। কিচেনে গিয়ে চা বানালাম। বাড়িটা চুপচাপ, বাতাস পর্যন্ত নেই। তুমি সারাজীবন লড়েছ একটা জিনিসের জন্য দাঁতে-নখে; দাঁতে দাঁত চেপে; একা কিংবা একসঙ্গে। এক ধরনের শান্তি পেয়েছ, মরে গেলে তোমার হাড়গোড়-ও পাবে।

আমার সাহস নেই। আমি থেকে গিয়েছি এখানে। আমি বোধহয় নির্জীব ব্যক্তি, শুধু ভয় পাই, রাত্রে ভালো ঘুম হয় না; কখনো-কখনো তাবৎ দুনিয়ার ইশতেহার পড়ি, আর ঘৃণা করি ডিকটেটরদের, ফ্যাসিস্টদের, চটকদার কেশ বিন্যাস করা মেয়েদের, টিভির স্টারদের, চাটুকারদের। আমার হাড়গোড় মরে গেলে হয়তো শান্তি পাব না।

পাহাড়ের স্তব্ধতার মধ্যে আমরা এখন শান্ত হয়ে আছি।

image
আরও খবর
৬৯ বছরে সংবাদ
ভাষা থেকে ভূখন্ড
স্মৃতিময় সংবাদ-এর ৬৯ বছর
একটি রাজনৈতিক পাঠ
সংবাদ : কিছু কথা কিছু স্মৃতি
যুগে যুগে সংবাদপত্রের অগ্রযাত্রা
আলোর তৃষ্ণায় জাগো
ইতিহাস ঐতিহ্য ও আদর্শের স্মারক দৈনিক সংবাদ
কেন লিখি
সংবাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আত্মার
ঐতিহ্য আর মুক্তচিন্তার সংবাদ
আমার সংবাদ সংবাদের আমি
বিচিত্র জীবিকা বিচিত্র জীবন
ঋতুপর্ণ ঘোষের এলোমেলো দেশকাল
চীন ও বাংলাদেশ : প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সম্পর্ক
সংবাদের জলসাঘর
মাটির মাধুর্য
কষ্টের ঢাকা স্বপ্নের বাংলাদেশ
তোমারে বধিবে যে...
বঙ্গবন্ধুর জনকল্যাণের অর্থনৈতিক নীতি কৌশল
শারহুল পটবসন্ত ও বজলুর রহমান
শিশুশিক্ষায় শিল্প-সাহিত্য-সংগীত
গণমাধ্যমের হাল-হকিকত
এবং বজলুর রহমান স্মৃতিপদক
দুর্নীতি, পেশাদারিত্ব ও উন্নয়ন
বাংলাদেশের থিয়েটার চর্চার ভবিষ্যৎ
চেতনায় নৈতিকতা মূল্যবোধ : বিরুদ্ধবাস্তবতা
সবার উপরে মানুষ সত্য
আহমদুল কবির শ্রদ্ধাঞ্জলি
কার্যকর সংসদ এবং সুশাসনের স্বপ্ন
‘সংবাদ’ আমারই ছিল আমারই আছে
আমাদের ‘সংবাদ’
নারীর অধিকার ও সচেতনতা
গণমাধ্যমে বিশ্বাস কমছে পাঠকের
নারী ও তার বিধাতা পুরুষ
বাংলাদেশের নারী
সংবাদের কাছে আমি ঋণী
বিস্মৃতিপ্রবণতা ও রাষ্ট্রের অক্ষমতা
যে দীপশিখা দিয়েছে আলো

বুধবার, ১০ জুলাই ২০১৯ , ২৬ আষাঢ় ১৪২৫, ৬ জ্বিলকদ ১৪৪০

আমরা এখন শান্ত হয়ে আছি

বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

image

আমার চারপাশে পাহাড়ের স্তব্ধতা। এই স্তব্ধতা কেউ ভেঙে দিক আমি চাই না। সকাল বেলা, রোদ যখন গাছের পাতা রঙিন করে আমি এক কাপ কালো কফি খেয়ে গরুর ঘণ্টার পিছু পিছু পাহাড়ের ঢালে আসি। আমাকে ঘিরে ধরে পাহাড়ের স্তব্ধতা কিন্তু পাহাড়ের মধ্যে নানা শব্দ আছে। সে সকল শব্দ কখনো পাখির ডাক, কখনো পাথরে বাতাসের বাজনা, কখনো গরুর পায়ের আওয়াজ, কখনো প্রজাপতির নড়াচড়া হয়ে যায়। আমি শব্দকে এভাবে ভিন্ন ভিন্ন করতে থাকি। আমি শান্ত হয়ে যাই।

তখন তুমি আমার সামনে এসে দাঁড়াও। তুমি এসেছ তোমার দেশ থেকে পালিয়ে, আমিও এসেছি আমার দেশ থেকে পালিয়ে। মানুষ কেন পালায়? পালাতে বাধ্য হয়? তুমি কি জবাব খুঁজে পেয়েছো?

কিংবা আমি?

মনে আছে আমরা যখন একত্রে থাকা শুরু করি। তুমি বলতে নিষিদ্ধ ইশতেহার যে-ভাবে আমি পড়ি সে-ভাবে নাকি আমি তোমার দিকে তাকাই, সেই একাগ্রতা নিয়ে। আসলে আমাদের দুজনের অভিজ্ঞতার মধ্যে নিষিদ্ধ ইশতেহার গেঁথে আছে।

তুমি কাজ সেরে সারাদিন পর ফিরে আসতে। তুমি কাজ নিয়েছিলে পাড়ার লাইব্রেরিতে। তুমি ফিরে এলেই বলতাম, চা?

হ্যাঁ, বলেই ক্লোকটা ছুঁড়ে দিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়তে।

কেটলি বসিয়ে দিয়ে আমি ফিরে আসতাম তোমার কাছে। তোমার চুলে হাত বুলোতাম। দেয়ালের ময়লা ওয়াল পেপার বাতির আলোয় আরো কদর্য হয়ে উঠত। আমার নাকে আসত কেন জানি পচা ফুলের গন্ধ।

ততক্ষণে তুমি উঠে বসেছ। একটু হেসে জিজ্ঞেস করতে, কী করলে সারাদিন?

আমি বলতাম, সেই একই কাজ। গ্যারেট সাফ করলাম কয়লা তুললাম। কিচেন সাফ করলাম।

লেখোনি কিছু?

না।

কেন লেখো না? লিখলে তো অতীতটাকে খুঁজে পাও।

আমি কোনো জবাব দিই না। ঠান্ডা লাগে, আর একটা পুলওভার গায়ে চাপাই। কিচেনে গিয়ে চা বানাই, ট্রেতে সাজিয়ে নিয়ে আসি দুটি কাপ, দুধের বোতল, চিনি। চা খেতে খেতে আমরা নিঃশব্দ হয়ে যাই। আমরা ফিরে যাই নিজের নিজের অভিজ্ঞতায়।

যেদিন তোমার মুড ভালো থাকত সেদিন কিংবা সেসব দিনগুলিতে তুমি বলতে তোমার ওয়ার্স শহরের কথা, তোমার প্রিয় শহর।

তুমি বলতে টমাসের কথা। তোমাদের প্রিয় কাফে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে। টমাস সবসময় দেরি করে আসত। কাফের কাছে যেই ট্রাম আসত লাফ দিয়ে নামত, কাচের দরজা ধাক্কা দিয়ে ঢুকত, যে কোণে তোমরা সবাই বসে থাকতে সেখানে এসে মাফ চাইত দেরির জন্য। ‘মারী’ কাউন্টারের পেছনের মেয়েটিকে চেঁচিয়ে ডাকত : ‘এক প্লেট মাসরুম ফ্রাই আর দুটো খালি প্লেট।’ কথা বলত জোরে; হাসত জোরে, যদিও তুমি কখনো বলনি, আমি বুঝতাম টমাস তোমাকে প্রেম করত সমস্ত সত্তা দিয়ে।

টমাসের কথা তুমি যখন বলতে কিংবা তোমার মনে পড়ে যেত তোমার চোখে পৃথিবীর সব নরম ভর করত।

মাসরুমে কামড় দিয়ে টমাস একদিন বলেছিল, দ্যাখো সবই আমার মনে আছে; আজ সকালে মা চিঠি পেয়েছেন সেন্ট্রাল কমিটি থেকে : বাবাকে রিঅ্যাভিলেটি করা হয়েছে। চিঠি পড়ে মা শুধু বললেন, তোর বাবাকে যখন পুলিশ ধরে নিয়ে যায় সব তছনছ করে যায়; এমনকি তোর বাবার ফটোগ্রাফ পর্যন্ত। তখন থেকে আমার আছে কান্না আর চুপ করে থাকা। এখন এই চিঠি নিয়ে আমি কী করব। তোর কাছে রাখ।’ টমাস পকেট থেকে বের করে চিঠি দিয়েছিল তোমার দিকে। তুমি চিঠিটা নিয়ে ভাবছিলে, তাই না?

টমাসের বাবা গমুলকার সহকর্মী ছিলেন। রুটির রায়টে গমুলকাকে সরানো হল, সেই সঙ্গে টমাসের বাবাকে প্রতিবিপ্লবী কর্মে লিপ্ত দায়ী করে তাকে দেওয়া হল সশ্রম কারাদন্ড। জেলেই তিনি মারা যান, জানুয়ারির কোনো এক সকালে মৃতদেহ তাদের বাড়িতে পৌঁছেছিল। কবরস্থানে বরফ আর বরফ। কিছু নেই, কিছু ছিল না। না পাখি, না পাতা, না কোনো শব্দ। জানুয়ারির ছ’ তারিখ, দ্যাখো তারিখটা পর্যন্ত আমার মনে আছে।

তুমি টমাসের হাতে চাপ দিয়ে বলেছিলে, ‘ছিঃ মন খারাপ করে না।’

টমাস ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিল, চিৎকার শুরু করেছিল, ‘মন খারাপ করব না। ভদ্রলোক, বন্ধু, সহকর্মী, কমরেডরা বলুন আমি মন খারাপ করব না। আমার বাবাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়েছে তবু আমি মন খারাপ করব না। বলুন কমরেডরা, বন্ধুরা, সহকর্মীরা আমার মন খারাপ করা উচিত কি না।’

টমাসের চিৎকার শুনে কাফের অনেকেই হতবাক, রেগুলারদের অনেকেই বিল চুকিয়ে ততক্ষণে রাস্তায়। শুধু তুমি চুপ, আর কাউন্টারে মারী নির্বিকারে গ্লাস ধুচ্ছে।

ততক্ষণে টমাসের রাগ পড়ে গেছে। আস্তে আস্তে বলেছে, ‘মাপ করো লক্ষ্মীটি মাপ করো।’ বাবার কথা মনে হলেই আমার গলার মধ্যে রক্ত গলগল করে ওঠে। বাবাকে ধরে নিয়ে যাবার পর বাবার পুরোনো কাগজপত্র ঘেঁটেছি। বাবার বিশ্বাসের মধ্যে কোনো খাদ ছিল না। আমাদের দেশে শোষণহীন সমাজ তৈরি হবে সে সত্য, যেমন সত্য ওয়ার্স শহর কিংবা সত্য ক্রেকাও শহরের দুর্গ। বাবার ডায়েরিতে একটা নোট পড়েছি: ‘যদি মুক্ত ব্যক্তিদের সমাজ সম্ভব তা হলে মুক্ত ব্যক্তিরাই এই সমাজ রচনা করতে পারে।’

টমাস কথা বলছে, থেমে যাচ্ছে, ফের বলছে। তুমি তাকিয়ে টমাসের দিকে, কিংবা নয়। তুমি হয়তো ভাবছিলে ভিস্তলা নদীতে স্রোত কেমন ফুলে উঠেছে, হয়তো ভাবছিলে নদীর পাড়ে লিনডেন গাছের তলায় আগের জন্মে টমাসের পাশে বসে জন্মদিনের উৎসবের কথা। পুরোনো দিন পুরোনো দিনের মতন ধূসর, কতদূরের তাই না? যেখান থেকে স্বপ্নের শিস শোনা যায়।

টমাস তখনো বলছে, ‘স্ব-নিযুক্ত এলিটরা ক্ষমতা আর সুবিধে কতদিন অগণতান্ত্রিক উপায়ে ধরে রাখবে। নিশ্চয়ই শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলন ফের দেখা দেবে, মুক্ত ব্যক্তিরা ফের সমাজ তৈরি করবে, জরুরি অবস্থার সংবিধান খান খান হয়ে যাবে, গাডানস্কের লেনিন শিপইয়ার্ডের শ্রমিকরা প্রচলিত বিধিনিষেধ ভেঙে ফেলবে, আমরা ফের আসব সমাজের কেন্দ্রে, শেষ মানুষটি অব্দি তিক্ত শেষ অব্দি আমরা আসব...

তুমি খোলা দরজার ফাঁক দিয়ে দেখছিলে সচ্ছল সমাজের জন্য পৃথিবীর সকল সরকার কেমনভাবে তৈরি করে খবর কাগজের হেড লাইন। তুমি দেখছিলে আর ভাবছিলে যুদ্ধের পর যুদ্ধ, গোস্ত কাটার কাঠের টুকরোয় ফোঁটা ফোঁটা চোখের পানি, রকেট ঠেকানো রকেট, রুটির ঝুড়ি, শ্রেণী সংগ্রাম। তুমি ভাবছিলে সেই লিনডেন গাছের তলায় কখনো আর যাবে না। তুমি ভাবছিলে তোমার আর টমাসের শরীরে শরীর জুড়ে যে-নম্র কোমলতা তৈরি হয়েছে, সারারাত যা তোমরা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়েছÑ সে-সব আর আসবে না। কারণ টমাস দাঙ্গা বাধিয়েছে। আমূল আদিগন্ত সর্বগ্রাসী।

টমাস ফের চিৎকার শুরু করেছে ‘কমরেডরা ভদ্রলোকেরা সহ-কর্মীরা বন্ধুরা আপনারা কেউ কি কোথাও নেই। আপনারা কি জানেন না আপনাদের সমাজ আপনাদের বাদ দিয়ে কীভাবে তৈরি হয়!’

তোমার চোখ, তুমি বলেছিলে পরে আমাকে, তোমার মনে হয়েছে কে যেন মেশিনগানের সামনে মেলে ধরেছে। যেন ভয়ঙ্কর ধৈর্য তোমার মুখ, এক লৌহ-মুখোশ পরা।

বেশ কিছুদিন ধরে তোমার শরীর খারাপ যাচ্ছে। লাইব্রেরি থেকে ফিরে আসতে ক্লান্ত, ক্লান্ত হয়ে। এক উইক এন্ডে, শনিবার, ভোরে দেখি জানালা খুলে তুমি বাইরে তাকিয়ে। মনে হচ্ছে আবৃত্তি করছ:

এক ছাড়পত্রের মালিক তুমি

রাষ্ট্রপতির

রুপোলি স্বাক্ষর হলফ করে বলে

এই হলে তুমি

তোমার ছাড়পত্র আছে

পাহাড়ি দেশের পাখিরা

রবারের মোহরে বসে থাকে

যেন বসে আছে কোনো পাহাড়ের চুড়োয়

তারা পাহারা দিচ্ছে তোমার

তোমার আধ সের মাংস

ভয় পেয়ো না

তুমি হারিয়ে যাবে না

রাষ্ট্রপতি তোমার ওপর নজর রাখছেন

তোমার এক ছাড়পত্র আছে

এতএব তুমি আছ

আমি শুয়ে শুয়ে জিজ্ঞেস করেছি, আশ্চর্য সুন্দর কবিতা। কার লেখা?

তুমি বলেছ ইয়েশি হারাসিমোভিচের।

কোন দেশী?

পোলিশ!

তখন দেখি আরো কবিতার বই ছড়ানো বিছানার পাশে। লাইব্রেরি থেকে নিয়ে এসেছ।

তুমি বলেছ, শুনবে আর একটি কবিতা?

শোনাও, সিগারেট ধরিয়ে আমি বলেছি।

তুমি আস্তে আস্তে বলেছ, গাছের পাতায় যেমন করে কুয়াশা নামে তেমন বোধ হয়েছে তোমার গলা, কবিতাটির নাম : কার্ল হাইনরিখ মার্ক্স। একটু শোনাই :

আজ দেখি তুমি ফেঁসে গিয়েছ।

তোমারই চেলাদের কৃপায়

কেবল তোমার শত্রুরাই

রয়ে গেছে অবিকল যেমনকে তেমন।

আমি তখন বুঝতে পারি কবিতা পড়ে, কথাগুলি পড়ে, পাশাপাশি, ওপর-নিচ, পৌনঃপুনিক, প্রতিধ্বনিময় পড়ে পড়ে তুমি ধরতে চাচ্ছ টমাসকে, টমাস আর তোমার অভিজ্ঞতাকে; যেন আমি তোমাকে একটু সাহায্য করেছি তোমার অভিজ্ঞতা টিকিয়ে রাখতে।

আর জানালা দিয়ে তখন ভেসে ওঠে আমার শহর, যেখানে গণতন্ত্র ফের সামরিকতন্ত্র ফের পর্যায়ক্রমে গণতন্ত্র ফের সামরিকতন্ত্রের লেফট-রাইট লেফট-রাইট। বাড়িটা চুপচাপ, আমি উঠি, কিচেনে গিয়ে চায়ের কেটলি বসাই, রুটি কাটি। বাড়িটা চুপচাপ; ফ্লোরের ওপর তুমি উবু বসে আছ, তোমার চোখ আমার ওপর নিবদ্ধ; আর আমার চোখ তোমার ওপর।

তোমার শরীর আরো খারাপ হয়ে গিয়েছে। কাজ থেকে ফিরে এলে পর তোমার নড়াচড়া করতে কষ্ট হয় দম ফুরিয়ে যায়। কোনো কিছু তোলার জন্য নিচু হলে তোমার সিধে দাঁড়াতে অসুবিধা হয়।

আমি জোর করে তোমাকে ডক্টরের কাছে নিয়ে গিয়েছি। সার্জারিতে লোক ভরতি। তোমার নম্বর দশ। তোমার ডাক এল। তোমার সঙ্গে আমিও গিয়েছি ভেতরে।

ডক্টর হাসিখুশি মুখ, চোখের চশমা মনে হয় দারুণ তেজে জ্বলছে।

কী হয়েছে তোমার?

আমি জবাব দিয়েছি, খুব ক্লান্ত ও। হাঁটতে কষ্ট হয়। কখনো কখনো রাত্রে দেখি হাঁটু মুড়ে বসে আছে। খুব তাড়াতাড়ি দম ফুরিয়ে যায়।

কখনো কি বাত-জ্বর হয়েছিল বাচ্চা বয়সে?

তুমি এবার জবাব দিয়েছ, না।

শুনি তোমার হৃদয়, যেন ঠাট্টা ডক্টর করছেন।

ডক্টর দেখলেন, বললেন, তেমন কিছু নয়। কবে এসেছ ইংল্যান্ডে?

বছর খানেক। পোল্যান্ড থেকে।

ওয়ার্স?

হ্যাঁ।

ডক্টর খসখস করে প্রেসক্রিপশন লিখলেন, লেখা থামিয়ে বললেন, সুন্দর শহর; আমি বার দুই গিয়েছি।

তুমি শুনে উজ্জ্বল হলে, সত্যি!

ডক্টর একটু থেমে বললেন, আমার বেশ কজন পোলিশ বন্ধু আছে। আশ্চর্য দেশ, আশ্চর্য আমার বন্ধুরা। দ্যাখোÑ ডক্টর ক্যাবিনেট খুলে একটা ফটোগ্রাফ দেখালেন। দুজন পুরুষ; একজন মহিলা। মহিলাটি টাইট স্কার্ট পরা, মাথায় একটি সিফন স্কার্ফ জড়ানো; একজন পুরুষের মুখে সিগারেট, অপরজনের হাতে একটি বই।

তুমি ফটোগ্রাফটির দিকে তাকিয়ে থাকলে। কোনো পটভূমি নেই। ডক্টর উঠে ক্যাবিনেটে ফটো রাখলেন, প্রেসক্রিপশন দিয়ে বললেন; তিনটে ট্যাবলেট ছ ঘণ্টা পরপর খাবে। সামনের সপ্তাহে একবার এসো।

আমরা উঠে দাঁড়িয়েছি। তুমি হঠাৎ বললে, ডক্টর আমি কি খুব বুড়ো হয়ে গিয়েছি? আমি কেন যৌন সুখ পাই না?

ডক্টর স্থির, আমি নিশ্চুপ; তুমি বক্তৃতার মতন বলে গেলে, দ্যাখো, এতদিন পরও আমার মনে আছে।

ডক্টর ওর সঙ্গে শুয়ে আমি আরাম পাই না। টমাসই আমাকে যৌন সুখ দিয়েছে। সুন্দর, এমন সুন্দর। আমাদের একসঙ্গে হতো। আমি টমাসকে সব দিতে পারতাম। আমার শরীর তৈরি থাকত। ডক্টর আগের মতন আর হয় না। ডক্টর কেন হয় না?

আমি তোমাকে নিয়ে বাসায় ফিরে এসেছি। বাসা মানে এক কোণে একটা বড়ো খাট, বেশ কটা কম্বল আর মেঝের ওপর আরো গোটা দুই। একটা চেস্ট অব ড্রয়ার, ওপরে একটা ঘড়ি আর একটা ট্রানজিস্টার। আর একটা ভাড়া করা টেলিভিশন। জানালায় ঘন আইভি আর কিচেনে গর্ত।

আমি তোমাকে আমাদের এই বাসায় নিয়ে এসেছি। কেন জানি মনে হয়েছে কোনো ভার নেই। আসলে তোমার আর আমার মধ্যে টমাস শুয়ে আছে, আমার ভূমিকা কেবল তোমাকে সাহায্য করাÑ যাতে তুমি তোমার অভিজ্ঞতা টিকিয়ে রাখতে পারো। টমাস ধরা পড়ে কই গিয়েছে তুমি জানো না। তোমাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে গিয়েছিল। তোমাকে তোমার বন্ধুরা স্মাগল করে সীমান্ত পার করিয়ে দিয়েছে। তুমি ট্রাফালগার স্কোয়ারে চিৎকার করেছ। রেড লায়ন স্কোয়ারে কিংবা ক্যামডেন টাউনে বক্তৃতা শুনতে গিয়েছ। তোমার পাশে আমি থেকেছি, তুমি আমাকে আদর করেছ, অন্যমনস্কভাবে। কিংবা আদর করেছ টমাস ভেবে।

এর মধ্যে আমাদের এক বন্ধু হয়েছে। এক পোল, বিশ বছর লন্ডনের বাসিন্দা। জনের একটা এন্টিকশপ আছে, আর আছে একটা ভ্যান। আমরা ঠাট্টা করে বলি : জাঙ্কশপ। হঠাৎ হঠাৎ হাজির হয়, টেনে নিয়ে চলে দূরে, কখনো কিংস্টনে, কখনো সেন্ট আইভসে।

জন কোনো কিছু নিয়ে ভাবে না, পোল্যান্ড না, লেবানন না, আণবিক যুদ্ধ না।

জন বোধহয় তোমাকে পছন্দ করে। জন এলে তুমি খুশি হতে। জনের অভিজ্ঞতা আমাদের দুজন থেকে পৃথক। আমাদের অতীত জুড়ে গর্ত আর গর্ত। জন তো সমস্তক্ষণ বর্তমানেই আছে।

জন বলত, সামারে কই যাবে?

তুমি বলতে, জানি না।

আমি বলতাম, জানি না।

জন বলত, রোমে যাব। তুমিও যাবে, তোমরাও।

যেন নিশ্চিত, আমরা তিনজন মিলে যাব; যাবই, এই সামারে রোমে, পরের সামারে বুদাপেস্টে, তারপরের সামারে প্রাগে।

আমি ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। তুমি টের পাচ্ছিলে। তোমার চোখ থেকে কোথাও পালাবার জো ছিল না, যতই আমাদের মধ্যে টমাস থাকুক না কেন। আমার ব্যথা বেড়ে যাচ্ছিল, আমার পিঠের ব্যথা।

জন এলেই তুমি বলতে, জানো ওর পিঠের ব্যথা বেড়েছে। বোধহয় স্লিপ ডিস্ক। ওকে ডক্টরের কাছে নিয়ে যেতেই হবে।

জন দুদিন বাদে ফের এসেছে।

তুমি বলেছ, দুদিন ধরে ও বিছানায় শুয়ে। ওর শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ভাবছি কাজ থেকে ছুটি নেব।

জন কিছু বলছে না দেখে তুমি বলে উঠেছ, জন তুমি এসেছ বলে আমি খুশি। আর তো কেউ নেই। ওর শরীর ভেঙে পড়েছে। ঘুমের ঘোরে ও খালি নিজের দেশের কথা বলে। ওর ঘুমুতে খুব কষ্ট হয়। আমি ঘুমোই আর জাগি, জাগি আর ঘুমোই- ওর যে ঘুম হয় না।

জন যাবে বলে উঠেছে। তুমি বলেছ, আমরা দুজন বাদে আমাদের কেউ নেই।

আমি তোমার কথা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যাই।

আমি ক্রমে ভালো হয়ে উঠি। তুমি আবার ঠিকঠাক অফিস যেতে শুরু কর। আমি ফিরে যাই আমার ভাবনায় যেখানে গণতন্ত্র ফের সামরিকতন্ত্র ফের পর্যায়ক্রমে গণতন্ত্র ফের সামরিকতন্ত্রের লেফট-রাইট লেফট-রাইট। তুমি ফের ভাবতে শুরু কর টমাসকে নিয়ে, তোমার ও টমাসের মিলিত অভিজ্ঞতা নিয়ে। এইভাবে আরো কিছু দিন। আমরা মধ্যে মধ্যে কাপড়ের তলায় টের পাই আমাদের শরীরটা।

একদিন তুমি কাজ থেকে ফিরে এলে না। দু দিন বাদে তোমার চিঠি পেলাম : আমি ওয়ার্স ফিরে যাচ্ছি। আমি চিঠিটা পড়লাম একবার দুবার তিনবার। কিচেনে গিয়ে চা বানালাম। বাড়িটা চুপচাপ, বাতাস পর্যন্ত নেই। তুমি সারাজীবন লড়েছ একটা জিনিসের জন্য দাঁতে-নখে; দাঁতে দাঁত চেপে; একা কিংবা একসঙ্গে। এক ধরনের শান্তি পেয়েছ, মরে গেলে তোমার হাড়গোড়-ও পাবে।

আমার সাহস নেই। আমি থেকে গিয়েছি এখানে। আমি বোধহয় নির্জীব ব্যক্তি, শুধু ভয় পাই, রাত্রে ভালো ঘুম হয় না; কখনো-কখনো তাবৎ দুনিয়ার ইশতেহার পড়ি, আর ঘৃণা করি ডিকটেটরদের, ফ্যাসিস্টদের, চটকদার কেশ বিন্যাস করা মেয়েদের, টিভির স্টারদের, চাটুকারদের। আমার হাড়গোড় মরে গেলে হয়তো শান্তি পাব না।

পাহাড়ের স্তব্ধতার মধ্যে আমরা এখন শান্ত হয়ে আছি।