শিশুশিক্ষায় শিল্প-সাহিত্য-সংগীত

সরকার আবদুল মান্নান

স্যার ফিলিপ পুলম্যানকে (১৯শে অক্টোবর, ১৯৪৬, ইউকে) আমরা কথাসাহিত্যিক হিসেবে চিনি। বহু জনপ্রিয় উপন্যাসের রচয়িতা তিনি। কিন্তু শিশুশিক্ষা নিয়ে তাঁর ভাবনা আমাকে মুগ্ধ করেছে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই বিপ্লবের যুগে শিশুরা যেখানে চিন্তা ও মননের এক উদ্বাস্তু সময় অতিবাহিত করছে, সেখানে পুলম্যানের একটি লেখা খুবই সময়োপযোগী। ২০১২ সালে Astrid Lindgren Memorial Award-এর ১০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে তিনি বক্তৃতাটি দিয়েছিলেন এবং সেই লেখাটির প্রেরণা থেকে আমি এই নিবন্ধটি রচনা করেছি।

একটি উদ্ধৃতি দিই। ‘Children need art and stories and poems and music as much as they need love and food and fresh air and play.’ একজন শিশু যদি খাবার না পায়, পুষ্টিকর খাবার থেকে যদি সে বঞ্চিত হয়, তাহলে সে দুর্বল হয়ে পড়বে, রুগ্ণ হয়ে পড়বে। তার দৈহিক অবয়বে ক্রমেই সেই রুগ্ণতা দৃশ্যগ্রাহ্য হয়ে উঠবে। অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা বুঝতে পারব যে, শিশুটি খাদ্যাভাবে ও অপুষ্টিতে ভুগছে। শিশুরা যদি মুক্ত বায়ুতে খেলাধুলা করার সুযোগ না পায়, সেটাও এক সময় পরিলক্ষিত হবে। তবে রাতারাতি নয়। দীর্ঘদিন পরে সেই ক্ষতি লক্ষ করা যাবে এবং আমরা অনুভব করব যে, তার স্বাভাবিক ও আননন্দিত বিকাশ হয়নি। শিশুরা যদি যথাযথ যতœ ও ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়, তা হলে তার মননের জগতে যে ক্ষতি সাধিত হবে, তা হয়তো হুট করে চোখে পড়বে না, কিন্তু সেই ক্ষতি হবে স্থায়ী। এই ক্ষতির কোনো নিরাময় নেই।

প্রতিটি দেশেই শিক্ষার্থীরা একটি নির্দিষ্ট শিখন-শেখানো প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে শিক্ষা লাভ করে। সেই প্রক্রিয়াটি কেমন সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু সেই প্রক্রিয়ার ভিতরে শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির পাঠ আছে কি না, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাকে যদি শিল্পকলার চর্চর মধ্যে, গল্প-উপন্যাস পাঠের মধ্যে, কবিতা পাঠের মধ্যে এবং গান শোনার মধ্যে বড় হতে না দেওয়া হয়, তা হলে শিশুর সামগ্রিক বিকাশে যে ক্ষতি সাধিত হবে, চর্মচক্ষে তা দেখার কোনো সুযোগ নেই। এমনকি উদার, মানবিক ও সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ ছাড়া স্থ’ূল প্রকৃতির মানুষ কখনই এই ক্ষতি উপলব্ধি করতে পারবে না। আর এই ক্ষতি হলো তাদের বুদ্ধিবৃত্তির জগতের ক্ষতিÑ জীবনবোধ, জীবনোপলব্ধি ও জীবনতৃষ্ণার জগতে বিপুল ক্ষতি।

ধরা যাক একজন শিশু সুস্থ-সবল, স্বাস্থ্যবান। দৌড়ায়, লম্ফঝম্প দেয়, খেলাধুলা করে, হৈচৈ করে, সাঁতার কাটে এবং প্রচুর ক্ষুধা নিয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণ খায়। তার মানে, শিশুটি ঠিক আছে। ঠিকঠাক মতো চলছে সবই। কিন্তু কিছু একটা বাদ পড়ে যাচ্ছে। আর সেটা হলো শিল্প-সাহিত্যের চর্চা, সংগীতের চর্চা। আর এ সবের চর্চা যদি না হয়, তা হলে ক্ষতি কী! যদি আমাদের সমাজে অধিকাংশ মানুষের দিকে তাকাই, তা হলে কী দেখতে পাই? কোনো ধরনের শিল্প-স্থাপত্য-ভাস্কর্য নিয়ে তাদর কোনো আগ্রহ নেই। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তাদের ঘরে কোনো বই নেই, কোনো চিত্রকর্ম নেই, গান করা বা গান শোনার কোনো ব্যাপার নেই। তাদের কি কোনো সমস্যা আছে? পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রে চলতে তাদের কী কোনো রকম প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়? নিশ্চয়ই নয়। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, তারা সুখেই আছেন এবং পরিবারে, সমাজে, কর্মস্থলে আনন্দ-ফুর্তিতেই সময় অতিবাহিত করছেন। এবং তারা যে বইপুস্তক পড়েন না, শিল্প-সাহিত্যের চর্চা করেন না, গান করেন না বা শুনেন নাÑ এ সবের অভাবের জন্য কেউ তাদের প্রত্যাখ্যানও করছেন না। অর্থাৎ সব ঠিকঠাকই থাকে।

কিন্তু সবসময় সব ঠিকঠাক থাকে না। এদের অনেকের মধ্যে সুন্দর ও অসুন্দরের বোধ তৈরি হয় না। ন্যায়-অন্যায়ের সূক্ষ্ম পার্থক্যগুলো তারা অনুধাবন করতে পারেন না। কথায়-কাজে-অচরণে যে পরিশীলন ও সংস্কার থাকতে হয়- তাদের মধ্যে সেই বোধ কাজ করে না। এরা অবেগ সংবরণ ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। অনেক সময় এদের মধ্যে যৌক্তিকতা বোধও কাজ করে না। ফলে জীবনের বিচিত্র ক্ষেত্রে এরা অন্যের শান্তি নষ্টের কারণ হয়ে ওঠেন, কিংবা তার শান্তি নষ্ট হচ্ছে মনে করে অন্যের প্রতি অবিচার করেন।

কিন্তু এর চেয়েও ভয়াবহ ক্ষতির দিক আছে। আর তা হলো মৌলবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে জীবনকে দেখা। শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির পাঠ না থাকলে ধর্মীয় মৌলবাদে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। বাধভাঙ্গা পানি যেমন প্রচন্ড বেগে ভাঙ্গনের দিকে ছুটে চলে, তেমনি শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির ভিতর দিয়ে বিকাশের বিচিত্র পথ যাদের রুদ্ধ হয়ে যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের বিকাশ ঘটে বিকৃতির মধ্যে, অসুস্থতার মধ্যে। এর মধ্যে সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক হলো ধর্মীয় জঙ্গীবাদে বিশ্বাস স্থাপন করা। অর্থাৎ সাংস্কৃতিক সাক্ষরতা অর্জন না-করলে এবং শিল্প-সাহিত্য ও সংগীতে অনুরাগ সৃষ্টি না-হলে যুক্তিবোধ তৈরি হয় না। ফলে শিশু-কিশোরদের মধ্যে যে মনোগড়ন তৈরি হয় তা মোটেই স্বাস্থ্যকর নয়। আর এ হেন মনোগড়নের মানুষ ফেন্টাসিকে বাস্তব ও সত্য বলে জ্ঞান করে এবং নির্বোধের মতো নিষ্ঠুর পরিস্থিতি তৈরি করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না।

এই পরিস্থিতির জন্য শিশুকিশোরদের দায়ী করা যায় না। বরং তাদের বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ার মধ্যে ঘর ও বিদ্যায়তনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে যদি তাদের সম্ভাবনার ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করে কিংবা তাদের ভালো লাগার বিষয়গুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে মমত্বের সঙ্গে যত্ন নেওয়া যেতো, তা হলে তাদের এই বিপুল ক্ষতির মধ্যে পড়তে হতো না। এছাড়া একটি অনাধুনিক, অনুদার, অমানবিক ও সাম্প্রদায়িক সমাজ ও রাষ্ট্রের পশ্চাতেও থাকে বিপুল সংখ্যক এই ধরনের মানুষ যারা ভীষণভাবে রক্ষণশীল এবং শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার পরিপন্থী। এদের অধিকাংশই এক জীবনেও অনুধাবন করতে পারে না যে, উদার ও আনন্দিত জীবনের আস্বাদ কেমন। ন্যায়-অন্যায়ের বোধ খুব ক্ষীণ বলে এরা যে কোনো ধরনের অন্যায় ও অবিচার করতে দ্বিধা করে না। ফলে আমাদের দেশে অধিকাংশ মানুষ ধার্মিক হওয়া সত্ত্বেও এখানে অনেক বেশি অন্যায় ও অবিচার সংঘটিত হয়। মিথ্যা, প্রতাড়না এবং জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া; অন্যকে ঠকিয়ে অধিক লাভবান হওয়ার চেষ্টা; হিংসা, জিঘাংসা ও নিষ্ঠুরতার পথ বেছে নেওয়া ইত্যাদি আমাদের সমাজে যে পরিমাণে সংঘটিত হয় তার সঙ্গে ধর্মীয় মূল্যবোধের ধারণা কিছুতেই যায় না। তা হলে সমস্যা কোথায়? সমস্যা হলো শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতিগত মূল্যবোধের অভাব। এই বাস্তবতা অনেক বেশি প্রামাণিক হতো যদি এই ধরনের কোনো গবেষণা থাকত যে, যারা বিচিত্র ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত কিংবা যারা প্রগতিশীল সমাজব্যবস্থার অন্তরায়, তাদের কত ভাগ শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ, আর কত ভাগ ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতায় নিমজ্জিত অবিকশিত মানুষ।

জাতিগত ঐতিহ্যের হাজার বছরের যে বিপুল উত্তরাধিকার নিয়ে একজন মানুষের অস্তিত্ব, তারও বিকাশ সাধিত হয় শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার ভিতর দিয়ে। এর ফলে তাদের মধ্যে ধীরে ধীরে জন্ম নেয় জীবনের প্রতি মমত্ববোধ; জাতিগত ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি দৃঢ় আস্তা ও বিশ্বাস এবং সর্বোপরি দেশাত্মবোধ। কোনো গবেষণা নেই বলে আজ আমরা কেউই জানি না যে, ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা অংশগ্রহণ করেছিলেন, যারা জীবন উৎসর্গ করেছেন, যারা পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, তাদের কত ভাগ সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ আর কত ভাগ ফেনাটিক। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এদের সবাই ছিলেন বাংলার বিপুল ঐতিহ্যে লালিত চিরকালের অসাম্প্রদায়িক মানুষ। এদের মননে ছিল ফল্গুধারার মতো প্রবহমান সংস্কৃতি চেতনা। শৈশব থেকেই শিক্ষার ভিতর দিয়ে কিংবা পারিবারিক পরিমন্ডলে একটি অসাম্প্রদায়িক আবহের ভিতর দিয়ে এদের বেড়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে বলেই এরা দেশের জন্য জীবন উৎর্গ করার শক্তি ও সাহস পেয়েছিলেন। আবার এদের মধ্যে যারা এ দেশে জন্মগ্রহণ করেও এ দেশের হাজার বছরের ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন ও উদ্বাস্তু মানুষ তারা সেই মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এখন আমরা বুঝতে পারি যে, শিল্প-সাহিত্য ও সংগীতের চর্চা না থাকলে ক্ষতিটা কোথায় হয়। আমরা বুঝতে পারি যে, ব্যক্তির দৈহিক পঙ্গুত্ব মানুষ ও সমাজ-সভ্যতার জন্য ক্ষতিকর কিছু নয়। কিন্তু তার মননে যদি পঙ্গুত্ব সৃষ্টি হয়; বোধ-বুদ্ধি ও বিশ্বাসে যদি পঙ্গুত্ব বাসা বাধেঁ, তা হলে সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার কোনো উপায় থাকে না।

চাঁদের যেমন অন্ধকার দিকটা আমরা কখই দেখতে পাই না, তেমনি যারা শিল্প-সাহিত্য, সংগীত ও সংস্কৃতি চর্চার বাইরে অবস্থান করেন তারাও জীবনের আলোকিত অধ্যায়টা কখনই দেখতে পান না। পৃথিবীর সমস্ত গল্প, উপন্যাস, নাটক, গান, কবিতা, শিল্প, স্থাপত্য, ভাস্কর্য যদি একদিন উধাও হয়ে যায় তা হলেও এই শ্রেণির মানুষদের কিছুই যায়-আসে না। হয়তো তারা জানবেই না যে পৃথিবী থেকে এই সব উদাও হয়ে গেছে। এ সবের কোনো মানে আছে বলেও তারা বিশ্বাস করতে পারেন না। তারা মনে করেন, এ সব শুধুই আবর্জনা।

শিল্প-সাহিত্য, সংগীত চর্চাহীন জীবনে এ হলো একটি মর্মান্তিক ক্ষতির দিক। আরও অসংখ্য দিক আছে যে সব ক্ষতি একসময় কেউ কেউ অনুধাবন করতে পারেন। সেই ক্ষতির বোধ তার মধ্যে জাগতে পারে শৈশবে, যৌবনে, প্রৌঢ়ে কিংবা বার্ধক্যে। তার মধ্যে তৃষ্ণা জগতে পারে সংগীতের প্রতি, শিল্পের প্রতি, সংস্কৃতির প্রতি। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে গভীর এক মনোবেদনা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। সুতরাং পুলম্যানের বক্তব্য দিয়েই এই ছোট লেখাটি শেষ করি। তিনি লিখেছেন :

We say, correctly, that every child has a right to food and shelter, to education, to medical treatment, and so on. We must understand that every child has a right to the experience of culture. We must fully understand that without stories and poems and pictures and music, children will starve.

image
আরও খবর
৬৯ বছরে সংবাদ
ভাষা থেকে ভূখন্ড
স্মৃতিময় সংবাদ-এর ৬৯ বছর
একটি রাজনৈতিক পাঠ
সংবাদ : কিছু কথা কিছু স্মৃতি
যুগে যুগে সংবাদপত্রের অগ্রযাত্রা
আলোর তৃষ্ণায় জাগো
ইতিহাস ঐতিহ্য ও আদর্শের স্মারক দৈনিক সংবাদ
কেন লিখি
সংবাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আত্মার
ঐতিহ্য আর মুক্তচিন্তার সংবাদ
আমার সংবাদ সংবাদের আমি
বিচিত্র জীবিকা বিচিত্র জীবন
ঋতুপর্ণ ঘোষের এলোমেলো দেশকাল
চীন ও বাংলাদেশ : প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সম্পর্ক
সংবাদের জলসাঘর
আমরা এখন শান্ত হয়ে আছি
মাটির মাধুর্য
কষ্টের ঢাকা স্বপ্নের বাংলাদেশ
তোমারে বধিবে যে...
বঙ্গবন্ধুর জনকল্যাণের অর্থনৈতিক নীতি কৌশল
শারহুল পটবসন্ত ও বজলুর রহমান
গণমাধ্যমের হাল-হকিকত
এবং বজলুর রহমান স্মৃতিপদক
দুর্নীতি, পেশাদারিত্ব ও উন্নয়ন
বাংলাদেশের থিয়েটার চর্চার ভবিষ্যৎ
চেতনায় নৈতিকতা মূল্যবোধ : বিরুদ্ধবাস্তবতা
সবার উপরে মানুষ সত্য
আহমদুল কবির শ্রদ্ধাঞ্জলি
কার্যকর সংসদ এবং সুশাসনের স্বপ্ন
‘সংবাদ’ আমারই ছিল আমারই আছে
আমাদের ‘সংবাদ’
নারীর অধিকার ও সচেতনতা
গণমাধ্যমে বিশ্বাস কমছে পাঠকের
নারী ও তার বিধাতা পুরুষ
বাংলাদেশের নারী
সংবাদের কাছে আমি ঋণী
বিস্মৃতিপ্রবণতা ও রাষ্ট্রের অক্ষমতা
যে দীপশিখা দিয়েছে আলো

বুধবার, ১০ জুলাই ২০১৯ , ২৬ আষাঢ় ১৪২৫, ৬ জ্বিলকদ ১৪৪০

শিশুশিক্ষায় শিল্প-সাহিত্য-সংগীত

সরকার আবদুল মান্নান

image

স্যার ফিলিপ পুলম্যানকে (১৯শে অক্টোবর, ১৯৪৬, ইউকে) আমরা কথাসাহিত্যিক হিসেবে চিনি। বহু জনপ্রিয় উপন্যাসের রচয়িতা তিনি। কিন্তু শিশুশিক্ষা নিয়ে তাঁর ভাবনা আমাকে মুগ্ধ করেছে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই বিপ্লবের যুগে শিশুরা যেখানে চিন্তা ও মননের এক উদ্বাস্তু সময় অতিবাহিত করছে, সেখানে পুলম্যানের একটি লেখা খুবই সময়োপযোগী। ২০১২ সালে Astrid Lindgren Memorial Award-এর ১০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে তিনি বক্তৃতাটি দিয়েছিলেন এবং সেই লেখাটির প্রেরণা থেকে আমি এই নিবন্ধটি রচনা করেছি।

একটি উদ্ধৃতি দিই। ‘Children need art and stories and poems and music as much as they need love and food and fresh air and play.’ একজন শিশু যদি খাবার না পায়, পুষ্টিকর খাবার থেকে যদি সে বঞ্চিত হয়, তাহলে সে দুর্বল হয়ে পড়বে, রুগ্ণ হয়ে পড়বে। তার দৈহিক অবয়বে ক্রমেই সেই রুগ্ণতা দৃশ্যগ্রাহ্য হয়ে উঠবে। অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা বুঝতে পারব যে, শিশুটি খাদ্যাভাবে ও অপুষ্টিতে ভুগছে। শিশুরা যদি মুক্ত বায়ুতে খেলাধুলা করার সুযোগ না পায়, সেটাও এক সময় পরিলক্ষিত হবে। তবে রাতারাতি নয়। দীর্ঘদিন পরে সেই ক্ষতি লক্ষ করা যাবে এবং আমরা অনুভব করব যে, তার স্বাভাবিক ও আননন্দিত বিকাশ হয়নি। শিশুরা যদি যথাযথ যতœ ও ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়, তা হলে তার মননের জগতে যে ক্ষতি সাধিত হবে, তা হয়তো হুট করে চোখে পড়বে না, কিন্তু সেই ক্ষতি হবে স্থায়ী। এই ক্ষতির কোনো নিরাময় নেই।

প্রতিটি দেশেই শিক্ষার্থীরা একটি নির্দিষ্ট শিখন-শেখানো প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে শিক্ষা লাভ করে। সেই প্রক্রিয়াটি কেমন সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু সেই প্রক্রিয়ার ভিতরে শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির পাঠ আছে কি না, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাকে যদি শিল্পকলার চর্চর মধ্যে, গল্প-উপন্যাস পাঠের মধ্যে, কবিতা পাঠের মধ্যে এবং গান শোনার মধ্যে বড় হতে না দেওয়া হয়, তা হলে শিশুর সামগ্রিক বিকাশে যে ক্ষতি সাধিত হবে, চর্মচক্ষে তা দেখার কোনো সুযোগ নেই। এমনকি উদার, মানবিক ও সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ ছাড়া স্থ’ূল প্রকৃতির মানুষ কখনই এই ক্ষতি উপলব্ধি করতে পারবে না। আর এই ক্ষতি হলো তাদের বুদ্ধিবৃত্তির জগতের ক্ষতিÑ জীবনবোধ, জীবনোপলব্ধি ও জীবনতৃষ্ণার জগতে বিপুল ক্ষতি।

ধরা যাক একজন শিশু সুস্থ-সবল, স্বাস্থ্যবান। দৌড়ায়, লম্ফঝম্প দেয়, খেলাধুলা করে, হৈচৈ করে, সাঁতার কাটে এবং প্রচুর ক্ষুধা নিয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণ খায়। তার মানে, শিশুটি ঠিক আছে। ঠিকঠাক মতো চলছে সবই। কিন্তু কিছু একটা বাদ পড়ে যাচ্ছে। আর সেটা হলো শিল্প-সাহিত্যের চর্চা, সংগীতের চর্চা। আর এ সবের চর্চা যদি না হয়, তা হলে ক্ষতি কী! যদি আমাদের সমাজে অধিকাংশ মানুষের দিকে তাকাই, তা হলে কী দেখতে পাই? কোনো ধরনের শিল্প-স্থাপত্য-ভাস্কর্য নিয়ে তাদর কোনো আগ্রহ নেই। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তাদের ঘরে কোনো বই নেই, কোনো চিত্রকর্ম নেই, গান করা বা গান শোনার কোনো ব্যাপার নেই। তাদের কি কোনো সমস্যা আছে? পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রে চলতে তাদের কী কোনো রকম প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়? নিশ্চয়ই নয়। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, তারা সুখেই আছেন এবং পরিবারে, সমাজে, কর্মস্থলে আনন্দ-ফুর্তিতেই সময় অতিবাহিত করছেন। এবং তারা যে বইপুস্তক পড়েন না, শিল্প-সাহিত্যের চর্চা করেন না, গান করেন না বা শুনেন নাÑ এ সবের অভাবের জন্য কেউ তাদের প্রত্যাখ্যানও করছেন না। অর্থাৎ সব ঠিকঠাকই থাকে।

কিন্তু সবসময় সব ঠিকঠাক থাকে না। এদের অনেকের মধ্যে সুন্দর ও অসুন্দরের বোধ তৈরি হয় না। ন্যায়-অন্যায়ের সূক্ষ্ম পার্থক্যগুলো তারা অনুধাবন করতে পারেন না। কথায়-কাজে-অচরণে যে পরিশীলন ও সংস্কার থাকতে হয়- তাদের মধ্যে সেই বোধ কাজ করে না। এরা অবেগ সংবরণ ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। অনেক সময় এদের মধ্যে যৌক্তিকতা বোধও কাজ করে না। ফলে জীবনের বিচিত্র ক্ষেত্রে এরা অন্যের শান্তি নষ্টের কারণ হয়ে ওঠেন, কিংবা তার শান্তি নষ্ট হচ্ছে মনে করে অন্যের প্রতি অবিচার করেন।

কিন্তু এর চেয়েও ভয়াবহ ক্ষতির দিক আছে। আর তা হলো মৌলবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে জীবনকে দেখা। শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির পাঠ না থাকলে ধর্মীয় মৌলবাদে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। বাধভাঙ্গা পানি যেমন প্রচন্ড বেগে ভাঙ্গনের দিকে ছুটে চলে, তেমনি শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির ভিতর দিয়ে বিকাশের বিচিত্র পথ যাদের রুদ্ধ হয়ে যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের বিকাশ ঘটে বিকৃতির মধ্যে, অসুস্থতার মধ্যে। এর মধ্যে সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক হলো ধর্মীয় জঙ্গীবাদে বিশ্বাস স্থাপন করা। অর্থাৎ সাংস্কৃতিক সাক্ষরতা অর্জন না-করলে এবং শিল্প-সাহিত্য ও সংগীতে অনুরাগ সৃষ্টি না-হলে যুক্তিবোধ তৈরি হয় না। ফলে শিশু-কিশোরদের মধ্যে যে মনোগড়ন তৈরি হয় তা মোটেই স্বাস্থ্যকর নয়। আর এ হেন মনোগড়নের মানুষ ফেন্টাসিকে বাস্তব ও সত্য বলে জ্ঞান করে এবং নির্বোধের মতো নিষ্ঠুর পরিস্থিতি তৈরি করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না।

এই পরিস্থিতির জন্য শিশুকিশোরদের দায়ী করা যায় না। বরং তাদের বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ার মধ্যে ঘর ও বিদ্যায়তনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে যদি তাদের সম্ভাবনার ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করে কিংবা তাদের ভালো লাগার বিষয়গুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে মমত্বের সঙ্গে যত্ন নেওয়া যেতো, তা হলে তাদের এই বিপুল ক্ষতির মধ্যে পড়তে হতো না। এছাড়া একটি অনাধুনিক, অনুদার, অমানবিক ও সাম্প্রদায়িক সমাজ ও রাষ্ট্রের পশ্চাতেও থাকে বিপুল সংখ্যক এই ধরনের মানুষ যারা ভীষণভাবে রক্ষণশীল এবং শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার পরিপন্থী। এদের অধিকাংশই এক জীবনেও অনুধাবন করতে পারে না যে, উদার ও আনন্দিত জীবনের আস্বাদ কেমন। ন্যায়-অন্যায়ের বোধ খুব ক্ষীণ বলে এরা যে কোনো ধরনের অন্যায় ও অবিচার করতে দ্বিধা করে না। ফলে আমাদের দেশে অধিকাংশ মানুষ ধার্মিক হওয়া সত্ত্বেও এখানে অনেক বেশি অন্যায় ও অবিচার সংঘটিত হয়। মিথ্যা, প্রতাড়না এবং জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া; অন্যকে ঠকিয়ে অধিক লাভবান হওয়ার চেষ্টা; হিংসা, জিঘাংসা ও নিষ্ঠুরতার পথ বেছে নেওয়া ইত্যাদি আমাদের সমাজে যে পরিমাণে সংঘটিত হয় তার সঙ্গে ধর্মীয় মূল্যবোধের ধারণা কিছুতেই যায় না। তা হলে সমস্যা কোথায়? সমস্যা হলো শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতিগত মূল্যবোধের অভাব। এই বাস্তবতা অনেক বেশি প্রামাণিক হতো যদি এই ধরনের কোনো গবেষণা থাকত যে, যারা বিচিত্র ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত কিংবা যারা প্রগতিশীল সমাজব্যবস্থার অন্তরায়, তাদের কত ভাগ শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ, আর কত ভাগ ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতায় নিমজ্জিত অবিকশিত মানুষ।

জাতিগত ঐতিহ্যের হাজার বছরের যে বিপুল উত্তরাধিকার নিয়ে একজন মানুষের অস্তিত্ব, তারও বিকাশ সাধিত হয় শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার ভিতর দিয়ে। এর ফলে তাদের মধ্যে ধীরে ধীরে জন্ম নেয় জীবনের প্রতি মমত্ববোধ; জাতিগত ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি দৃঢ় আস্তা ও বিশ্বাস এবং সর্বোপরি দেশাত্মবোধ। কোনো গবেষণা নেই বলে আজ আমরা কেউই জানি না যে, ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা অংশগ্রহণ করেছিলেন, যারা জীবন উৎসর্গ করেছেন, যারা পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, তাদের কত ভাগ সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ আর কত ভাগ ফেনাটিক। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এদের সবাই ছিলেন বাংলার বিপুল ঐতিহ্যে লালিত চিরকালের অসাম্প্রদায়িক মানুষ। এদের মননে ছিল ফল্গুধারার মতো প্রবহমান সংস্কৃতি চেতনা। শৈশব থেকেই শিক্ষার ভিতর দিয়ে কিংবা পারিবারিক পরিমন্ডলে একটি অসাম্প্রদায়িক আবহের ভিতর দিয়ে এদের বেড়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে বলেই এরা দেশের জন্য জীবন উৎর্গ করার শক্তি ও সাহস পেয়েছিলেন। আবার এদের মধ্যে যারা এ দেশে জন্মগ্রহণ করেও এ দেশের হাজার বছরের ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন ও উদ্বাস্তু মানুষ তারা সেই মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এখন আমরা বুঝতে পারি যে, শিল্প-সাহিত্য ও সংগীতের চর্চা না থাকলে ক্ষতিটা কোথায় হয়। আমরা বুঝতে পারি যে, ব্যক্তির দৈহিক পঙ্গুত্ব মানুষ ও সমাজ-সভ্যতার জন্য ক্ষতিকর কিছু নয়। কিন্তু তার মননে যদি পঙ্গুত্ব সৃষ্টি হয়; বোধ-বুদ্ধি ও বিশ্বাসে যদি পঙ্গুত্ব বাসা বাধেঁ, তা হলে সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার কোনো উপায় থাকে না।

চাঁদের যেমন অন্ধকার দিকটা আমরা কখই দেখতে পাই না, তেমনি যারা শিল্প-সাহিত্য, সংগীত ও সংস্কৃতি চর্চার বাইরে অবস্থান করেন তারাও জীবনের আলোকিত অধ্যায়টা কখনই দেখতে পান না। পৃথিবীর সমস্ত গল্প, উপন্যাস, নাটক, গান, কবিতা, শিল্প, স্থাপত্য, ভাস্কর্য যদি একদিন উধাও হয়ে যায় তা হলেও এই শ্রেণির মানুষদের কিছুই যায়-আসে না। হয়তো তারা জানবেই না যে পৃথিবী থেকে এই সব উদাও হয়ে গেছে। এ সবের কোনো মানে আছে বলেও তারা বিশ্বাস করতে পারেন না। তারা মনে করেন, এ সব শুধুই আবর্জনা।

শিল্প-সাহিত্য, সংগীত চর্চাহীন জীবনে এ হলো একটি মর্মান্তিক ক্ষতির দিক। আরও অসংখ্য দিক আছে যে সব ক্ষতি একসময় কেউ কেউ অনুধাবন করতে পারেন। সেই ক্ষতির বোধ তার মধ্যে জাগতে পারে শৈশবে, যৌবনে, প্রৌঢ়ে কিংবা বার্ধক্যে। তার মধ্যে তৃষ্ণা জগতে পারে সংগীতের প্রতি, শিল্পের প্রতি, সংস্কৃতির প্রতি। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে গভীর এক মনোবেদনা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। সুতরাং পুলম্যানের বক্তব্য দিয়েই এই ছোট লেখাটি শেষ করি। তিনি লিখেছেন :

We say, correctly, that every child has a right to food and shelter, to education, to medical treatment, and so on. We must understand that every child has a right to the experience of culture. We must fully understand that without stories and poems and pictures and music, children will starve.