বাংলাদেশের নারী

আহমেদ ফিরোজ

শতাব্দিকালের বাংলার নারী- জায়া-ভগ্নী-জননী হিসেবে সম্মান ও মর্যাদার আসনে সমাসীন আছেন। নারী একই সঙ্গে লক্ষ্মী ও সরস্বতী দুইরূপ পরিগ্রহ করে। পুরুষ রূপের নমনীয় ও কমনীয়তার সঙ্গে নারীর মাতৃত্বের অপরূপ প্রকাশের যোগসূত্র লক্ষণীয়। এছাড়া প্রেমিকা হিসেবে নারী, মা হিসেবে নারী অথবা বোন হিসেবে নারী, চিরকাল স্ত্রী রূপকে ছাড়িয়ে গেলেও, পুরুষের সঙ্গে তার মেলবন্ধন ও সন্তানের সঙ্গে তার নাড়ির টান- পৃথিবীর সব রূপকে একত্রে বহুরূপে প্রকাশ করে- যা ঈর্ষণীয়। সে-কারণে মানুষ হিসেবে নারী-পুরুষের অবস্থান পৃথিবীর নানা প্রান্তের মতোই বাংলাদেশেও এক শাশ^ত সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে ধারণ করে আছে এবং এর মধ্য দিয়ে সবুজ বাংলার রূপ দশদিকে ছড়িয়ে পড়ে, যোগ হয় প্রেম ও ভালোবাসার অপরূপ যোগাযোগ যাত্রা।

প্রাচীনকালের সব ধারণাকে পেছনে ফেলে বর্তমান বাংলাদেশে নারীদের মধ্যে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হওয়ার আকাক্সক্ষা প্রবলভাবে বেড়েছে। এর ফলে দিনে দিনে নারী-প্রধান পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, প্রতি ১০০টি পরিবারের মধ্যে ১৪টি পরিবারের প্রধান এখন নারী এবং গত ২০১৩ সাল থেকে এ-হার ক্রমশ বেড়েই চলেছে। ২০০৯ সালে এ-হার ছিল ১০.৩ শতাংশ। তার চেয়ে আরও বড় খবর হলো : অল্প বয়সী মেয়েরাই এখন পরিবারের হাল ধরছেন এবং গার্মেন্ট কর্মীর মতো অনেকেই এখন পরিবারের প্রধান আয়ের উৎস।

তবে, নারী-পুরুষের বৈষম্যের দিক দিয়ে অনেক বেশি অগ্রগতি হলেও, এখনি শান্তির বারতা মিলছে না। বিশ্বব্যাংকের বিচারে এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সার্বিক স্কোর ৪৯.৩৮ শতাংশ- যা সম্পত্তির অধিকার, যে কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি লাভের সুযোগ, বিয়ে করা বা সন্তান নেয়ার মতো ৮টি বিষয়ের বিবেচনায়। আর, বাংলাদেশ শিশু ও নারী মন্ত্রণালয় বলছে, নারীদের সার্বিক অবস্থানে আগের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রগতি হয়েছে, তবে পুরুষের সমান হতে পারেনি।

এ জন্য ধর্মীয় ও সামাজিক বাধাকে দায়ী করছেন অনেকে। বিশেষজ্ঞরাও এ-মতের সঙ্গে অনেকটাই একমত। কারণ, একসময় পুরো সমাজটাই পুরুষশাসিত ছিল এবং ধর্মের দোহাই দিয়ে গড়ে ওঠা সমাজে ছেলেশিশুদের সঙ্গে সঙ্গে মেয়েশিশুদের স্কুলে যাবার সমান সুযোগ ছিল না। তবে, বর্তমানে বাধার সকল দেয়াল ভাঙছে অথবা ভেঙে পড়েছে। শিক্ষা-দীক্ষায় মেয়েরা অনেক বেশি এগিয়ে গেছে এবং সরকারিভাবে বেসরকারি পর্যায়ে নারীদের চাকরি ৩৩% বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

আজকের বাংলাদেশে রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, এমনকি ঝুঁকিপূর্ণ গণমাধ্যম পেশায়ও নিজেদের সরব উপস্থিতি জানান দিচ্ছেন নারীরা। ধাপে ধাপে নানা বাধা অতিক্রম করে প্রতিবছর উন্নয়ন সূচকে বিজয় নিশান উড়িয়ে দিচ্ছেন তারা। এর বড় উদাহরণ, দেশের বিচার ব্যবস্থায় নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ। উচ্চ আদালতে সংখ্যার দিক থেকে কম হলেও, নিম্ন আদালতে এখন নারী বিচারক উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বেড়েছে। আইন ব্যবসাতেও নারীর অংশগ্রহণ আশাব্যঞ্জক।

অগ্রযাত্রার এ-ধারাবাহিকতায় বর্তমানে গণমাধ্যমে নারীদের অংশগ্রহণ ব্যাপকভাবে বেড়েছে। তারা সাংবাদিকতাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে এগিয়ে আসছে এ পেশায়। এর ইতিবাচক ও উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে- সাংবাদিকতার মতো ঝুঁকিপূর্ণ ও দায়িত্বশীল পেশায় অংশগ্রহণ বাড়ছে। এই পেশায় আসতে নারীকে অনেক চড়াই-উতরাই পাড়ি দিতে হয়েছে। নারীরা তাদের অভিজ্ঞতা থেকে জানিয়েছেন, বাইরে কাজের ক্ষেত্রে সচরাচর নারীদের যেসব তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়, সাংবাদিকতার পেশায় তা আরও বেশি প্রকট। এছাড়া বর্তমানে আগের চেয়ে বেশি নারী সারা দেশে সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত থাকলেও, পেশার বৈষম্য, অংশগ্রহণে বাধা, মানসিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করার প্রবণতা ও অবদমনের মাত্রা আশানুরূপ কমেনি।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বিগত কয়েক দশকে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ নারীর ক্ষমতায়নে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। দেশটির উন্নতির ক্ষেত্রে মূলত রাজনীতি এবং কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। সেই সঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষায় মেয়েশিশুর অংশগ্রহণও বেড়েছে। নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে সশস্ত্রবাহিনীতেও। নারীরা বেছে নিচ্ছেন ঝুঁকিপূর্ণ পেশা। জীবন বাজি রেখে কাজ করছেন দেশের জন্য। নির্ভুল নিশানায় গুঁড়িয়ে দিচ্ছেন শত্রুপক্ষের মেরুদন্ড। আবার মমতাময়ী মায়ের মতো গড়ে তুলছেন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অবকাঠামো।

পরিবার, সমাজ, ধর্মীয় এবং অনেক সময় রাষ্ট্রীয় প্রতিবন্ধকতা পার করে কাজ করে চলেছেন নারীরা। নিজের শিক্ষা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা : নারীকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দিচ্ছে।

বিবিএসের সর্বশেষ ২০১৬ সালের জরিপ অনুযায়ী, দেশে ৫ কোটি ৩১ লাখ কর্মজীবীর মধ্যে ১ কোটি ৬২ লাখ নারী। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম খাত পোশাক শিল্পে ৫ হাজারেরও অধিক কারখানায় ১৫ লাখ শ্রমিক কর্মরত, যার ৮৫ শতাংশ নারী।

অন্যদিকে, আরেকটি বিষয় অস্বীকার করবার উপায় নেই : নারী-পুরুষের মধ্যে চলমান বৈষম্যের মতোই প্রকট আকার ধারণ করেছে শহুরে ও গ্রামীণ নারীদের বৈষম্য। শহুরে নারীদের প্রাতিষ্ঠানিক কাজ স্বীকৃতি পেলেও, গ্রামীণ নারীদের অর্থনৈতিক সংগ্রাম এখনো সঠিকভাবে মূল্যায়ন হচ্ছে না। এ জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, পর্যাপ্ত মূলধন ও সঠিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাব এবং নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, পারিবারিক অসহযোগিতা, নারীদের এই পিছিয়ে পড়ার জন্য অনেকাংশে দায়ী।

অধিকাংশ গ্রামীণ নারীর শ্রমই বিনা পারিশ্রমিকের ঘর-গৃহস্থালির আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়। গ্রামীণ নারীরা খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষি উৎপাদন, বিশেষ করে শস্য উৎপাদন, গবাদিপশু ও হাঁসমুরগি পালন, সবজি ও মৎস্য চাষ, বনায়ন ইত্যাদি কাজে পুরুষের পাশাপাশি সমান অবদান রেখে জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছেন। নারীদের এই অবদান অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখলেও, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রে এর বিশেষ কোন স্বীকৃতি নেই। তবে, দিন পাল্টাচ্ছে।

রাজনীতি, কৃষি, অর্থনীতি, বিজ্ঞান ও গবেষণা থেকে শুরু করে বর্তমানে প্রতিটি ক্ষেত্রে মেধার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন নারীরা। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নারীদের অংশগ্রহণে দৃশ্যপট পাল্টে যাচ্ছে। ত্বরান্বিত হচ্ছে জাতীয় উন্নয়ন।

লক্ষ্যণীয়, বাংলাদেশ ক্রিকেটের আন্তর্জাতিক প্রথম পুরস্কারটি এনেছে জাতীয় নারী ক্রিকেট দল। পথে ঘাটে নারী পুলিশ দেখে এখন আমরা এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছি, সেটি আর আলাদা করে চোখে পড়ে না।

সবচেয়ে বড় অর্জন : দেশে-বিদেশে নারী নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন রোল মডেল। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকার, শিক্ষামন্ত্রী থেকে শুরু করে সর্বত্র নারী রাজনৈতিক নেতৃত্বে জয়-জয়গার। বিরোধী দলেও উচ্চপদে নারী এবং সরকারের বাইরে প্রধান একটি দলের চেয়ারপারসনও নারী।

আশার কথা : গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় নারীদের কাজ করতে দেখে আমরা কিন্তু পুরুষ-নারীর বিভাজনটি অনেকটাই ভুলে যেতে শুরু করেছি। সবাইকেই মানুষ হিসেবে দেখতে স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করছি।

আন্তর্জাতিক নানা ধরনের জরিপেও দেখা যায়, বাংলাদেশে নারীরা যথেষ্ট এগিয়ে যাচ্ছে। সেগুলো দেখে কেউ যেন মনে না-করে দেশে নারীদের জন্যে যা কিছু করা সম্ভব তার সবকিছু করা হয়ে গেছে। এটি মোটেও সত্যি নয়। খবরের কাগজে মাঝে মাঝেই আমরা মেয়েদের ওপর ভয়ঙ্কর নির্যাতনের খবর দেখি। অনেক খবর সংবাদের আড়ালে থেকে যায়, পৌঁছে না সমাজের বধির কানে। কিন্তু একজন নারী যখন একজন পুরুষের সমান সমান কাজ করে কম বেতন পান- সেটিও যে এক ধরনের নির্যাতন, তা আমরা অনেক সময় ভুলে যাই। এর সঙ্গে সবচেয়ে ঘৃণার পথ তৈরি করে- কর্মজীবী, ছাত্রী ও যে নারীরা পথে-ঘাটে চলাচল করেন, বাসে-ট্রেনে যাতায়াত করেন, তাদের সবারই প্রায় নিয়মিতভাবে পুরুষের অশালীন ইঙ্গিত ও হাতের স্পর্শ সহ্য করতে হয়। ইভটিজিং এখন ভয়ঙ্কর এক আক্রমণের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।

অন্যদিকে, একজন পুরুষ যখন তার নিজের ক্যারিয়ার গড়ে তোলায় ব্যস্ত, ঠিক সেই সময় অধিকাংশ নারীকে সন্তান জন্ম দিতে হয়, তাকে বুকে আগলে বড় করতে হয়। কাজেই গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে নারীদের সংখ্যা এখনও অনেক কম। নারীরা যেন পুরুষের পাশাপাশি সব জায়গায় আসতে পারে তার প্রক্রিয়াটা শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু নারীদের সব জায়গায় সমান সমান পাওয়ার জন্য আমাদের আরও বহু পথ অতিক্রম করে যেতে হবে।

image
আরও খবর
৬৯ বছরে সংবাদ
ভাষা থেকে ভূখন্ড
স্মৃতিময় সংবাদ-এর ৬৯ বছর
একটি রাজনৈতিক পাঠ
সংবাদ : কিছু কথা কিছু স্মৃতি
যুগে যুগে সংবাদপত্রের অগ্রযাত্রা
আলোর তৃষ্ণায় জাগো
ইতিহাস ঐতিহ্য ও আদর্শের স্মারক দৈনিক সংবাদ
কেন লিখি
সংবাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আত্মার
ঐতিহ্য আর মুক্তচিন্তার সংবাদ
আমার সংবাদ সংবাদের আমি
বিচিত্র জীবিকা বিচিত্র জীবন
ঋতুপর্ণ ঘোষের এলোমেলো দেশকাল
চীন ও বাংলাদেশ : প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সম্পর্ক
সংবাদের জলসাঘর
আমরা এখন শান্ত হয়ে আছি
মাটির মাধুর্য
কষ্টের ঢাকা স্বপ্নের বাংলাদেশ
তোমারে বধিবে যে...
বঙ্গবন্ধুর জনকল্যাণের অর্থনৈতিক নীতি কৌশল
শারহুল পটবসন্ত ও বজলুর রহমান
শিশুশিক্ষায় শিল্প-সাহিত্য-সংগীত
গণমাধ্যমের হাল-হকিকত
এবং বজলুর রহমান স্মৃতিপদক
দুর্নীতি, পেশাদারিত্ব ও উন্নয়ন
বাংলাদেশের থিয়েটার চর্চার ভবিষ্যৎ
চেতনায় নৈতিকতা মূল্যবোধ : বিরুদ্ধবাস্তবতা
সবার উপরে মানুষ সত্য
আহমদুল কবির শ্রদ্ধাঞ্জলি
কার্যকর সংসদ এবং সুশাসনের স্বপ্ন
‘সংবাদ’ আমারই ছিল আমারই আছে
আমাদের ‘সংবাদ’
নারীর অধিকার ও সচেতনতা
গণমাধ্যমে বিশ্বাস কমছে পাঠকের
নারী ও তার বিধাতা পুরুষ
সংবাদের কাছে আমি ঋণী
বিস্মৃতিপ্রবণতা ও রাষ্ট্রের অক্ষমতা
যে দীপশিখা দিয়েছে আলো

বুধবার, ১০ জুলাই ২০১৯ , ২৬ আষাঢ় ১৪২৫, ৬ জ্বিলকদ ১৪৪০

বাংলাদেশের নারী

আহমেদ ফিরোজ

image

শতাব্দিকালের বাংলার নারী- জায়া-ভগ্নী-জননী হিসেবে সম্মান ও মর্যাদার আসনে সমাসীন আছেন। নারী একই সঙ্গে লক্ষ্মী ও সরস্বতী দুইরূপ পরিগ্রহ করে। পুরুষ রূপের নমনীয় ও কমনীয়তার সঙ্গে নারীর মাতৃত্বের অপরূপ প্রকাশের যোগসূত্র লক্ষণীয়। এছাড়া প্রেমিকা হিসেবে নারী, মা হিসেবে নারী অথবা বোন হিসেবে নারী, চিরকাল স্ত্রী রূপকে ছাড়িয়ে গেলেও, পুরুষের সঙ্গে তার মেলবন্ধন ও সন্তানের সঙ্গে তার নাড়ির টান- পৃথিবীর সব রূপকে একত্রে বহুরূপে প্রকাশ করে- যা ঈর্ষণীয়। সে-কারণে মানুষ হিসেবে নারী-পুরুষের অবস্থান পৃথিবীর নানা প্রান্তের মতোই বাংলাদেশেও এক শাশ^ত সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে ধারণ করে আছে এবং এর মধ্য দিয়ে সবুজ বাংলার রূপ দশদিকে ছড়িয়ে পড়ে, যোগ হয় প্রেম ও ভালোবাসার অপরূপ যোগাযোগ যাত্রা।

প্রাচীনকালের সব ধারণাকে পেছনে ফেলে বর্তমান বাংলাদেশে নারীদের মধ্যে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হওয়ার আকাক্সক্ষা প্রবলভাবে বেড়েছে। এর ফলে দিনে দিনে নারী-প্রধান পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, প্রতি ১০০টি পরিবারের মধ্যে ১৪টি পরিবারের প্রধান এখন নারী এবং গত ২০১৩ সাল থেকে এ-হার ক্রমশ বেড়েই চলেছে। ২০০৯ সালে এ-হার ছিল ১০.৩ শতাংশ। তার চেয়ে আরও বড় খবর হলো : অল্প বয়সী মেয়েরাই এখন পরিবারের হাল ধরছেন এবং গার্মেন্ট কর্মীর মতো অনেকেই এখন পরিবারের প্রধান আয়ের উৎস।

তবে, নারী-পুরুষের বৈষম্যের দিক দিয়ে অনেক বেশি অগ্রগতি হলেও, এখনি শান্তির বারতা মিলছে না। বিশ্বব্যাংকের বিচারে এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সার্বিক স্কোর ৪৯.৩৮ শতাংশ- যা সম্পত্তির অধিকার, যে কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি লাভের সুযোগ, বিয়ে করা বা সন্তান নেয়ার মতো ৮টি বিষয়ের বিবেচনায়। আর, বাংলাদেশ শিশু ও নারী মন্ত্রণালয় বলছে, নারীদের সার্বিক অবস্থানে আগের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রগতি হয়েছে, তবে পুরুষের সমান হতে পারেনি।

এ জন্য ধর্মীয় ও সামাজিক বাধাকে দায়ী করছেন অনেকে। বিশেষজ্ঞরাও এ-মতের সঙ্গে অনেকটাই একমত। কারণ, একসময় পুরো সমাজটাই পুরুষশাসিত ছিল এবং ধর্মের দোহাই দিয়ে গড়ে ওঠা সমাজে ছেলেশিশুদের সঙ্গে সঙ্গে মেয়েশিশুদের স্কুলে যাবার সমান সুযোগ ছিল না। তবে, বর্তমানে বাধার সকল দেয়াল ভাঙছে অথবা ভেঙে পড়েছে। শিক্ষা-দীক্ষায় মেয়েরা অনেক বেশি এগিয়ে গেছে এবং সরকারিভাবে বেসরকারি পর্যায়ে নারীদের চাকরি ৩৩% বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

আজকের বাংলাদেশে রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, এমনকি ঝুঁকিপূর্ণ গণমাধ্যম পেশায়ও নিজেদের সরব উপস্থিতি জানান দিচ্ছেন নারীরা। ধাপে ধাপে নানা বাধা অতিক্রম করে প্রতিবছর উন্নয়ন সূচকে বিজয় নিশান উড়িয়ে দিচ্ছেন তারা। এর বড় উদাহরণ, দেশের বিচার ব্যবস্থায় নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ। উচ্চ আদালতে সংখ্যার দিক থেকে কম হলেও, নিম্ন আদালতে এখন নারী বিচারক উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বেড়েছে। আইন ব্যবসাতেও নারীর অংশগ্রহণ আশাব্যঞ্জক।

অগ্রযাত্রার এ-ধারাবাহিকতায় বর্তমানে গণমাধ্যমে নারীদের অংশগ্রহণ ব্যাপকভাবে বেড়েছে। তারা সাংবাদিকতাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে এগিয়ে আসছে এ পেশায়। এর ইতিবাচক ও উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে- সাংবাদিকতার মতো ঝুঁকিপূর্ণ ও দায়িত্বশীল পেশায় অংশগ্রহণ বাড়ছে। এই পেশায় আসতে নারীকে অনেক চড়াই-উতরাই পাড়ি দিতে হয়েছে। নারীরা তাদের অভিজ্ঞতা থেকে জানিয়েছেন, বাইরে কাজের ক্ষেত্রে সচরাচর নারীদের যেসব তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়, সাংবাদিকতার পেশায় তা আরও বেশি প্রকট। এছাড়া বর্তমানে আগের চেয়ে বেশি নারী সারা দেশে সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত থাকলেও, পেশার বৈষম্য, অংশগ্রহণে বাধা, মানসিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করার প্রবণতা ও অবদমনের মাত্রা আশানুরূপ কমেনি।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বিগত কয়েক দশকে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ নারীর ক্ষমতায়নে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। দেশটির উন্নতির ক্ষেত্রে মূলত রাজনীতি এবং কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। সেই সঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষায় মেয়েশিশুর অংশগ্রহণও বেড়েছে। নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে সশস্ত্রবাহিনীতেও। নারীরা বেছে নিচ্ছেন ঝুঁকিপূর্ণ পেশা। জীবন বাজি রেখে কাজ করছেন দেশের জন্য। নির্ভুল নিশানায় গুঁড়িয়ে দিচ্ছেন শত্রুপক্ষের মেরুদন্ড। আবার মমতাময়ী মায়ের মতো গড়ে তুলছেন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অবকাঠামো।

পরিবার, সমাজ, ধর্মীয় এবং অনেক সময় রাষ্ট্রীয় প্রতিবন্ধকতা পার করে কাজ করে চলেছেন নারীরা। নিজের শিক্ষা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা : নারীকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দিচ্ছে।

বিবিএসের সর্বশেষ ২০১৬ সালের জরিপ অনুযায়ী, দেশে ৫ কোটি ৩১ লাখ কর্মজীবীর মধ্যে ১ কোটি ৬২ লাখ নারী। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম খাত পোশাক শিল্পে ৫ হাজারেরও অধিক কারখানায় ১৫ লাখ শ্রমিক কর্মরত, যার ৮৫ শতাংশ নারী।

অন্যদিকে, আরেকটি বিষয় অস্বীকার করবার উপায় নেই : নারী-পুরুষের মধ্যে চলমান বৈষম্যের মতোই প্রকট আকার ধারণ করেছে শহুরে ও গ্রামীণ নারীদের বৈষম্য। শহুরে নারীদের প্রাতিষ্ঠানিক কাজ স্বীকৃতি পেলেও, গ্রামীণ নারীদের অর্থনৈতিক সংগ্রাম এখনো সঠিকভাবে মূল্যায়ন হচ্ছে না। এ জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, পর্যাপ্ত মূলধন ও সঠিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাব এবং নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, পারিবারিক অসহযোগিতা, নারীদের এই পিছিয়ে পড়ার জন্য অনেকাংশে দায়ী।

অধিকাংশ গ্রামীণ নারীর শ্রমই বিনা পারিশ্রমিকের ঘর-গৃহস্থালির আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়। গ্রামীণ নারীরা খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষি উৎপাদন, বিশেষ করে শস্য উৎপাদন, গবাদিপশু ও হাঁসমুরগি পালন, সবজি ও মৎস্য চাষ, বনায়ন ইত্যাদি কাজে পুরুষের পাশাপাশি সমান অবদান রেখে জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছেন। নারীদের এই অবদান অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখলেও, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রে এর বিশেষ কোন স্বীকৃতি নেই। তবে, দিন পাল্টাচ্ছে।

রাজনীতি, কৃষি, অর্থনীতি, বিজ্ঞান ও গবেষণা থেকে শুরু করে বর্তমানে প্রতিটি ক্ষেত্রে মেধার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন নারীরা। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নারীদের অংশগ্রহণে দৃশ্যপট পাল্টে যাচ্ছে। ত্বরান্বিত হচ্ছে জাতীয় উন্নয়ন।

লক্ষ্যণীয়, বাংলাদেশ ক্রিকেটের আন্তর্জাতিক প্রথম পুরস্কারটি এনেছে জাতীয় নারী ক্রিকেট দল। পথে ঘাটে নারী পুলিশ দেখে এখন আমরা এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছি, সেটি আর আলাদা করে চোখে পড়ে না।

সবচেয়ে বড় অর্জন : দেশে-বিদেশে নারী নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন রোল মডেল। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকার, শিক্ষামন্ত্রী থেকে শুরু করে সর্বত্র নারী রাজনৈতিক নেতৃত্বে জয়-জয়গার। বিরোধী দলেও উচ্চপদে নারী এবং সরকারের বাইরে প্রধান একটি দলের চেয়ারপারসনও নারী।

আশার কথা : গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় নারীদের কাজ করতে দেখে আমরা কিন্তু পুরুষ-নারীর বিভাজনটি অনেকটাই ভুলে যেতে শুরু করেছি। সবাইকেই মানুষ হিসেবে দেখতে স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করছি।

আন্তর্জাতিক নানা ধরনের জরিপেও দেখা যায়, বাংলাদেশে নারীরা যথেষ্ট এগিয়ে যাচ্ছে। সেগুলো দেখে কেউ যেন মনে না-করে দেশে নারীদের জন্যে যা কিছু করা সম্ভব তার সবকিছু করা হয়ে গেছে। এটি মোটেও সত্যি নয়। খবরের কাগজে মাঝে মাঝেই আমরা মেয়েদের ওপর ভয়ঙ্কর নির্যাতনের খবর দেখি। অনেক খবর সংবাদের আড়ালে থেকে যায়, পৌঁছে না সমাজের বধির কানে। কিন্তু একজন নারী যখন একজন পুরুষের সমান সমান কাজ করে কম বেতন পান- সেটিও যে এক ধরনের নির্যাতন, তা আমরা অনেক সময় ভুলে যাই। এর সঙ্গে সবচেয়ে ঘৃণার পথ তৈরি করে- কর্মজীবী, ছাত্রী ও যে নারীরা পথে-ঘাটে চলাচল করেন, বাসে-ট্রেনে যাতায়াত করেন, তাদের সবারই প্রায় নিয়মিতভাবে পুরুষের অশালীন ইঙ্গিত ও হাতের স্পর্শ সহ্য করতে হয়। ইভটিজিং এখন ভয়ঙ্কর এক আক্রমণের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।

অন্যদিকে, একজন পুরুষ যখন তার নিজের ক্যারিয়ার গড়ে তোলায় ব্যস্ত, ঠিক সেই সময় অধিকাংশ নারীকে সন্তান জন্ম দিতে হয়, তাকে বুকে আগলে বড় করতে হয়। কাজেই গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে নারীদের সংখ্যা এখনও অনেক কম। নারীরা যেন পুরুষের পাশাপাশি সব জায়গায় আসতে পারে তার প্রক্রিয়াটা শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু নারীদের সব জায়গায় সমান সমান পাওয়ার জন্য আমাদের আরও বহু পথ অতিক্রম করে যেতে হবে।