বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু, বিজেপি-তৃণমূল উভয়ই ফলাফলে আশাবাদী

বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা ছাড়া ভবানীপুরের হাইভোল্টেজ নির্বাচন নির্বিঘেœ সম্পন্ন হয়েছে। সকাল ৭টা থেকে শুরু হয়ে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত একটানা এই ভোটদান অব্যাহত থাকলেও বেশ কয়েকটি বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটে। তারই মধ্যে শরৎ বোস রোডে বিজেপি নেতা কল্যাণ চৌবের গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। কল্যাণ চৌবে বলেন বাঁশ, পাথর দিয়ে তার গাড়িতে ভাঙচুর চালানো হয়। এ সময় কল্যাণের সঙ্গে থাকা এক বিজেপি কর্মীকে বেদম মারধর করার অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। ঘটনাস্থল থেকে ওই বিজেপি কর্মীকে পুলিশ তুলে নিয়ে গেলে সেখানে তুমুল উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। এ সময় প্রিয়াঙ্কা টিবরেওয়াল অভিযোগ তোলেন যারা ভুয়া ভোট দিচ্ছে তাদের পুলিশ গ্রেপ্তার করছে না। যারা অভিযোগ জানাচ্ছে তাদেরকে আটক করছে মমতার পুলিশ। এই বিষয়ে কুণাল ঘোষ বলেন, কল্যাণ চৌবে উল্টোডাঙার বাসিন্দা। ভবানীপুরে কল্যাণ চৌবে কেন গিয়েছিলেন? আমি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমর্থক। আমি তো ভোটের দিন ভবানীপুরে যাইনি। এই ধরনের ঘটনার দায় কে নেবে প্রশ্ন তোলেন কুণাল ঘোষ।

কেন্দ্র ভবানীপুর, প্রার্থী মমতা বন্দোপাধ্যায় ও বিজেপির প্রিয়াঙ্কা টিবরেয়াল। লড়াইটা ছিল জোরদার। সব মিলিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চাপে রাখতে কোন কৌশলই বাদ রাখনি গেরুয়া শিবির। তৃণমূল অবশ্য বিজেপিকে অধিক গুরুত্ব দিতে নারাজ। তাদের মতে, ভবানীপুরের ঘরের মেয়ে মমতা, নিশ্চিত জয়লাভ করবেন। একুশের বিধানসভাতেও ভবানীপুরে জয়লাভ করে তৃণমূল। তবে, একুশের নির্বাচনের সঙ্গে উপনির্বাচনের পার্থক্য আছে অনেক। এবারের নির্বাচন কেবল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখ্যমন্ত্রী পদ বজায় রাখতেই। ভবানীপুরের ভোটের পুরনো অঙ্কের কথা মাথায় রেখে মমতা নিজেও বুঝতে পেরেছে বিজেপি প্রার্থী এই নির্বাচনে বড় ফ্যাক্টর তার কাছে। তাই একের পর এক নতুন স্ট্র্যাটেজি নিয়ে এগুতে হয়েছে তাকে। এর অংশ হিসেবে প্রচারে যে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে- এই বিষয়টি মাথায় রেখে সেখানে আগের চেয়ে বেশি প্রচারের দিকটাতে গুরুত্ব দিয়েছেন মমতা। এর জন্য তৃণমূলের বড় নেতাদের পাশাপাশি ১২ জন ক্যাবিনেট মন্ত্রীকে সার্বক্ষণিক প্রচারে নামাতে হয়েছে। এমনকি মমতা বন্দোপাধ্যায় নিজেকেও ভবানীপুরের পাড়ায় পাড়ায় ভোটের জন্য ছুটে বেড়াতে হয়েছে। তারপরও সেখানে শেষ হাসি কে হাসেন, তা বোঝা যাবে ৩ অক্টোবর ফল প্রকাশের দিন।

এদিন ভোটের ময়দানে শাসকদলের বিরুদ্ধে বাম প্রার্থী বিভিন্ন রকম অভিযোগ তুলেছিলেন। আজকেও বুথে বুথে ঘুরে শাসকদলের বিরুদ্ধে বিধি ভঙ্গের অভিযোগ তুলেছেন বামদল প্রার্থী শ্রিজীব বিশ্বাস। তুলেছেন ভোট রিগিংয়ের অভিযোগও। কিন্তু এত কিছুর পরও ভবানীপুরে উপনির্বাচনের দিন বামদের ক্যাম্পে ঢুকে চা খেতে দেখা গেল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভোটের প্রধান সেনাপতি ফিরহাদ হাকিমকে। সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী ছবি, ভবানীপুরে উপনির্বাচনের দিন দেখা গেল সৌজন্যের রাজনীতি। এ প্রসঙ্গে ফিরহাদ হাকিম বলেন, কেউ কংগ্রেস করতে পারে, কেউ সিপিএম করতে পারে। আমরা চেতলার ছেলে একই পাড়ার ছেলে। ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে খেলা করেছি। তাই এখানে বসে চা না খাওয়ার কিছু নেই। শুধু চা-ই নয়, আমাদের ক্যাম্পের খাবার ওদের দিয়ে ওদের ক্যাম্পের খাবার আমরা খাই। আমাদের মধ্যে কোন রেষারেষি নেই। রাজনীতি আমরা নিজের আদর্শে করি। স্থানীয় বাম কর্মীরা জানিয়েছেন ফিরহাদ হাকিমের সঙ্গে আমাদের অন্য রকম সম্পর্ক। আমরা একে-অপরকে খুব ভালোবাসি।

নানা ভাষা, নানা মতের ভবানীপুর। যাকে ইতোমধ্যেই মিনি ইন্ডিয়ার তকমা দিয়েছেন খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলাভাষী, অবাঙালি ও সংখ্যালঘু ভোটের সংমিশ্রণ ঘটেছে এই কেন্দ্রে। এই জনবিন্যাসই হতে চলেছে উপভোটের অন্যতম ফ্যাক্টর, এই অভিমত রাজনীতিবিদদের।

প্রতি নির্বাচনেই শহরের অন্যান্য কেন্দ্রের তুলনায় ভবানীপুরে ভোটদানের হার তুলনামূলকভাবে কম থাকে। ২০১১ সালে বাম ফ্রন্ট সরকারের পতন ঘটিয়ে তৃণমূল ক্ষমতা দখল করে যখন, সেই বছর ভবানীপুর বিধানসভা কেন্দ্রে প্রার্থী ছিলেন তৃণমূল নেতা সুব্রত বক্সী। ২০১১ সালে ভবানীপুরে ভোটদানের হার ছিল ৬৩.৭৮ শতাংশ এবং এর মধ্যে সুব্রত বক্সী পেয়েছিলেন ৮৭,৯০৩টি ভোট। দ্বিতীয় স্থানে থাকা বাম প্রার্থীর সঙ্গে তার ভোটের ফারাক ছিল ৩৬.৮ শতাংশ। সরকার গঠনের পরে ভবানীপুরে উপনির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু উপনির্বাচনে ভবানীপুরের আরও কম মানুষ বুথ-মুখী হন। উপনির্বাচনে ভোটদানের হার ছিল মাত্র ৪৪.৭৩ শতাংশ। কয়েকমাস আগে হয়ে যাওয়া বিধানসভা নির্বাচনের তুলনায় ১৯% কম মানুষ ভোট দেন ভবানীপুরের উপনির্বাচনে। যদিও এই ৪৪.৭৩ শতাংশ ভোটের সিংহভাগ অর্থাৎ প্রায় ৭৭.৪৬ শতাংশ ভোট পান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বামফ্রন্ট প্রার্থী নন্দিনী মুখার্জি পেয়েছিলেন ২০.৪৩ শতাংশ ভোট। কম সংখ্যক মানুষ ভোট দিলেও প্রায় ১২.৬৯ শতাংশ ভোট বৃদ্ধি পায় তৃণমূলের।

২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রে প্রার্থী হন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১১ সালের তুলনায় এই কেন্দ্রে ভোটদানের হার ৩.০৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেলেও অন্যান্য কেন্দ্রের তুলনায় তা খুবই কম ছিল। ২০১৬ সালে ভবানীপুরে ভোটদানের হার ছিল ৬৬.৮৩ শতাংশ। এই নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৬৫,৫২০ যা মোট ভোটের ৪৮.৫ শতাংশ। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেসের দীপা দাশমুন্সি পেয়েছিলেন ৪০,২১৯টি ভোট। এই নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দীর প্রাপ্ত ভোটের পার্থক্য ছিল প্রায় ১৮.৭ শতাংশ।

২০২১ সালের নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভবানীপুর কেন্দ্রের পরিবর্তে নন্দীগ্রাম থেকে প্রার্থী হন। ভবানীপুরে তৃণমূলের প্রার্থী ছিলেন শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। এই নির্বাচনেও ভোটদানের হার আশানুরূপ ছিলনা। এই নির্বাচনে ভোটদানের হার ২০১১ সালের নির্বাচনের তুলনায় কমে দাঁড়ায় ৬১.৭২ শতাংশতে। এর মধ্যে ৫৮.৪ শতাংশ ভোট তৃণমূল পেলেও তৃণমূলের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপির রুদ্রনীল ঘোষ পান ৩৫.৬ শতাংশ ভোট। ২২.৮ শতাংশ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয় তৃণমূল।

ভবানীপুর কেন্দ্রে কলকাতা পৌরসভার আটটি ওয়ার্ড আছে। এর মধ্যে ২০২১ সালের ভোটের ফল অনুযায়ী ৭৪ এবং ৭০ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূলের তুলনায় এগিয়ে রয়েছে বিজেপি। ৭৪ নম্বর ওয়ার্ডে ৫৩১ ভোট এবং ৭০ নম্বর ওয়ার্ডে প্রায় ২০৯২ ভোটে এগিয়ে রয়েছে তারা। অন্যদিকে বিজেপির সঙ্গে তৃণমূলের ২৮,৭১৯ ভোটের যে ব্যবধানের তার মধ্যে প্রায় ২১,৭৭৯ ভোটে তারা এগিয়ে রয়েছে শুধু মাত্র ৭৭ নম্বর ওয়ার্ডে। অর্থাৎ বাকি পাঁচটি ওয়ার্ড মিলিয়ে মাত্র ৬,৯৪০ ভোট এগিয়ে রয়েছে তৃণমূল।

গত বিধান সভা নির্বাচনের দিকে তাকালে দেখা যায় শোভনদেব চট্রোপাধ্যায় বিজেপি প্রার্থীর চেয়ে ১২.৮ শতাংশ ভোট বেশি পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। ভবানীপুর কেন্দ্রে বিজেপির সঙ্গে ভোটঅঙ্কে কম মার্জিন থাকায় ভবানীপুরের উপনির্বাচন মমতা বন্দোপাদ্যায়ের জন্য বেশ ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায়।

ভবানীপুরে মোট ভোটার ২,০৬,৩৮৯ জন। এর মধ্যে ৯৫,১৪৩ জন মহিলা ভোটার। অর্থাৎ, মোট ভোটারের প্রায় ৪৬ শতাংশ মহিলা। ২০২১-এর নির্বাচনের হিসাবে মহিলারা বেশিমাত্রায় ভরসা রেখেছেন তৃণমূলের ওপরে। এছাড়া তৃণমূলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভোটব্যাঙ্ক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। ভবানীপুর কেন্দ্রের প্রায় ২০ শতাংশ ভোটার মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। এছাড়াও শিখ এবং অবাঙালি হিন্দু ভোটার মোট ভোটারের প্রায় ৩৪ শতাংশ। গত বিধানসভা ভোটে বিজেপিকে রুখতে তৃণমূলকেই বিকল্প হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন রাজ্যের সংখ্যালঘুরা। ভোটের ফলেই তা স্পষ্ট হয়েছে। এমনকি উত্তরবঙ্গেও কংগ্রেসের সংখ্যালঘু ভোটে ভাঙন ধরিয়েছে তৃনমূল। এই প্রবণতার ব্যতিক্রম হয়নি ভবানীপুরে।

অন্যদিকে ভবানীপুরে অবাঙালি ভোটারদের একটা বড় অংশ বিজেপির ভোটার। এবার তাদের প্রার্থী অবাঙালি প্রিয়াঙ্কা টিবরেওয়াল। যদিও তিনি নিজেকে ‘বাংলার মেয়ে’ বলেই পরিচয় দেন। গত বিধানসভা ভোটে ৭০ এবং ৭৪ নম্বর ওয়ার্ডে এগিয়েছিল বিজেপি। সেখানে অবাঙালি ভোটারের সংখ্যা বেশি। ফলে বিজেপির লক্ষ্য অবাঙালি ভোট যতটা বেশি সম্ভব তাদের ইভিএমে টানা। এক্ষেত্রে ভোটের হার বাড়লে উপভোট ও নির্বাচনের ফলের মধ্যেই অনেকটাই ফারাক হয়ে যেতে পারে বলে মতো রাজনৈতিক মহলের।

তাই ভোটের দিন দুপুর অবধি ভবানীপুরে ভোট কম পড়ায় দুপুর চিন্তার ভাজ পড়ে তৃনমূলে। ১টা পর্যন্ত ভোট পড়ে মাত্র ৩৫.৯৭ শতাংশ। ভোটদানের ট্রেন্ড দেখেই ফিরহাদ হাকিম টুইটে লেখেন, ‘সবাইকে ভোটদানের জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। উন্নয়ন ও সমানাধিকারের জন্য ভোট দিন।’ পাশপাশি ভবানীপুরসহ বাকি দুই কেন্দ্রের ভোটারদের উদ্দেশে টুইট করেন রাজ্যের মন্ত্রী সুব্রত মুখার্জি। ওই টুইটে সুব্রত লেখেন ‘ভবানীপুরসহ বাকি আসনে উপনির্বাচন হচ্ছে। আজ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন। আমাদের ভোটারদের দিদির পক্ষে ভোট দিতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে যে দিদি বিপুল ভোটে জয়ী হবেন।’

তাদের এই টুইটের বিরুদ্ধে ভোটারদের প্রভাবিত করার অভিযোগ এনে বিজেপি প্রার্থী প্রিয়াঙ্কা কমিশনে নালিশ জানিয়েছেন। কমিশনের ব্যাপারে রিপোর্ট তলব করেছে দায়িত্বরত মাইক্রো অবজারভারের কাছে।

ভবানীপুরে উপভোটে সন্দেহাতীত হেভিওয়েট প্রার্থী তৃণমূলের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। লড়াই কঠিন জেনেও ভোটপ্রচারে একটুকুও রেয়াত করেননি বিজেপি প্রার্থী প্রিয়াঙ্কা টিবরেওয়াল। বিজেপি-তৃণমূল ভোটযুদ্ধের মাঝে সিপিএম প্রার্থী শ্রীজীব বিশ্বাসও শেষ পর্যন্ত লড়াই করেছেন। কেননা, এক সময় বামফ্রন্টের দুর্গ ছিল ভবানীপুর। তাই এখানে সিপিএমের বেশ সমর্থক রয়েছে। সে যাই হোক ভোট ব্যালট গ্রাউন্ডে সিপিএম প্রার্থীর সঙ্গে মমতার সেনাপতি ফিরাহদ হাকিমের হঠাৎ সখ্যতাকে রাজনৈতিক মহল বাঁকা চোখে দেখছে। এ প্রসঙ্গে স্বভাবত তাদের প্রশ্ন, তবে কী বাম ‘ভোটার’ অঙ্কে অন্য সমীকরণ রয়েছে?

শুক্রবার, ০১ অক্টোবর ২০২১ , ১৬ আশ্বিন ১৪২৮ ২২ সফর ১৪৪৩

ভবানীপুর উপনির্বাচন

বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু, বিজেপি-তৃণমূল উভয়ই ফলাফলে আশাবাদী

দীপক মুখার্জী, কলকাতা

বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা ছাড়া ভবানীপুরের হাইভোল্টেজ নির্বাচন নির্বিঘেœ সম্পন্ন হয়েছে। সকাল ৭টা থেকে শুরু হয়ে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত একটানা এই ভোটদান অব্যাহত থাকলেও বেশ কয়েকটি বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটে। তারই মধ্যে শরৎ বোস রোডে বিজেপি নেতা কল্যাণ চৌবের গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। কল্যাণ চৌবে বলেন বাঁশ, পাথর দিয়ে তার গাড়িতে ভাঙচুর চালানো হয়। এ সময় কল্যাণের সঙ্গে থাকা এক বিজেপি কর্মীকে বেদম মারধর করার অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। ঘটনাস্থল থেকে ওই বিজেপি কর্মীকে পুলিশ তুলে নিয়ে গেলে সেখানে তুমুল উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। এ সময় প্রিয়াঙ্কা টিবরেওয়াল অভিযোগ তোলেন যারা ভুয়া ভোট দিচ্ছে তাদের পুলিশ গ্রেপ্তার করছে না। যারা অভিযোগ জানাচ্ছে তাদেরকে আটক করছে মমতার পুলিশ। এই বিষয়ে কুণাল ঘোষ বলেন, কল্যাণ চৌবে উল্টোডাঙার বাসিন্দা। ভবানীপুরে কল্যাণ চৌবে কেন গিয়েছিলেন? আমি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমর্থক। আমি তো ভোটের দিন ভবানীপুরে যাইনি। এই ধরনের ঘটনার দায় কে নেবে প্রশ্ন তোলেন কুণাল ঘোষ।

কেন্দ্র ভবানীপুর, প্রার্থী মমতা বন্দোপাধ্যায় ও বিজেপির প্রিয়াঙ্কা টিবরেয়াল। লড়াইটা ছিল জোরদার। সব মিলিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চাপে রাখতে কোন কৌশলই বাদ রাখনি গেরুয়া শিবির। তৃণমূল অবশ্য বিজেপিকে অধিক গুরুত্ব দিতে নারাজ। তাদের মতে, ভবানীপুরের ঘরের মেয়ে মমতা, নিশ্চিত জয়লাভ করবেন। একুশের বিধানসভাতেও ভবানীপুরে জয়লাভ করে তৃণমূল। তবে, একুশের নির্বাচনের সঙ্গে উপনির্বাচনের পার্থক্য আছে অনেক। এবারের নির্বাচন কেবল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখ্যমন্ত্রী পদ বজায় রাখতেই। ভবানীপুরের ভোটের পুরনো অঙ্কের কথা মাথায় রেখে মমতা নিজেও বুঝতে পেরেছে বিজেপি প্রার্থী এই নির্বাচনে বড় ফ্যাক্টর তার কাছে। তাই একের পর এক নতুন স্ট্র্যাটেজি নিয়ে এগুতে হয়েছে তাকে। এর অংশ হিসেবে প্রচারে যে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে- এই বিষয়টি মাথায় রেখে সেখানে আগের চেয়ে বেশি প্রচারের দিকটাতে গুরুত্ব দিয়েছেন মমতা। এর জন্য তৃণমূলের বড় নেতাদের পাশাপাশি ১২ জন ক্যাবিনেট মন্ত্রীকে সার্বক্ষণিক প্রচারে নামাতে হয়েছে। এমনকি মমতা বন্দোপাধ্যায় নিজেকেও ভবানীপুরের পাড়ায় পাড়ায় ভোটের জন্য ছুটে বেড়াতে হয়েছে। তারপরও সেখানে শেষ হাসি কে হাসেন, তা বোঝা যাবে ৩ অক্টোবর ফল প্রকাশের দিন।

এদিন ভোটের ময়দানে শাসকদলের বিরুদ্ধে বাম প্রার্থী বিভিন্ন রকম অভিযোগ তুলেছিলেন। আজকেও বুথে বুথে ঘুরে শাসকদলের বিরুদ্ধে বিধি ভঙ্গের অভিযোগ তুলেছেন বামদল প্রার্থী শ্রিজীব বিশ্বাস। তুলেছেন ভোট রিগিংয়ের অভিযোগও। কিন্তু এত কিছুর পরও ভবানীপুরে উপনির্বাচনের দিন বামদের ক্যাম্পে ঢুকে চা খেতে দেখা গেল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভোটের প্রধান সেনাপতি ফিরহাদ হাকিমকে। সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী ছবি, ভবানীপুরে উপনির্বাচনের দিন দেখা গেল সৌজন্যের রাজনীতি। এ প্রসঙ্গে ফিরহাদ হাকিম বলেন, কেউ কংগ্রেস করতে পারে, কেউ সিপিএম করতে পারে। আমরা চেতলার ছেলে একই পাড়ার ছেলে। ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে খেলা করেছি। তাই এখানে বসে চা না খাওয়ার কিছু নেই। শুধু চা-ই নয়, আমাদের ক্যাম্পের খাবার ওদের দিয়ে ওদের ক্যাম্পের খাবার আমরা খাই। আমাদের মধ্যে কোন রেষারেষি নেই। রাজনীতি আমরা নিজের আদর্শে করি। স্থানীয় বাম কর্মীরা জানিয়েছেন ফিরহাদ হাকিমের সঙ্গে আমাদের অন্য রকম সম্পর্ক। আমরা একে-অপরকে খুব ভালোবাসি।

নানা ভাষা, নানা মতের ভবানীপুর। যাকে ইতোমধ্যেই মিনি ইন্ডিয়ার তকমা দিয়েছেন খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলাভাষী, অবাঙালি ও সংখ্যালঘু ভোটের সংমিশ্রণ ঘটেছে এই কেন্দ্রে। এই জনবিন্যাসই হতে চলেছে উপভোটের অন্যতম ফ্যাক্টর, এই অভিমত রাজনীতিবিদদের।

প্রতি নির্বাচনেই শহরের অন্যান্য কেন্দ্রের তুলনায় ভবানীপুরে ভোটদানের হার তুলনামূলকভাবে কম থাকে। ২০১১ সালে বাম ফ্রন্ট সরকারের পতন ঘটিয়ে তৃণমূল ক্ষমতা দখল করে যখন, সেই বছর ভবানীপুর বিধানসভা কেন্দ্রে প্রার্থী ছিলেন তৃণমূল নেতা সুব্রত বক্সী। ২০১১ সালে ভবানীপুরে ভোটদানের হার ছিল ৬৩.৭৮ শতাংশ এবং এর মধ্যে সুব্রত বক্সী পেয়েছিলেন ৮৭,৯০৩টি ভোট। দ্বিতীয় স্থানে থাকা বাম প্রার্থীর সঙ্গে তার ভোটের ফারাক ছিল ৩৬.৮ শতাংশ। সরকার গঠনের পরে ভবানীপুরে উপনির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু উপনির্বাচনে ভবানীপুরের আরও কম মানুষ বুথ-মুখী হন। উপনির্বাচনে ভোটদানের হার ছিল মাত্র ৪৪.৭৩ শতাংশ। কয়েকমাস আগে হয়ে যাওয়া বিধানসভা নির্বাচনের তুলনায় ১৯% কম মানুষ ভোট দেন ভবানীপুরের উপনির্বাচনে। যদিও এই ৪৪.৭৩ শতাংশ ভোটের সিংহভাগ অর্থাৎ প্রায় ৭৭.৪৬ শতাংশ ভোট পান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বামফ্রন্ট প্রার্থী নন্দিনী মুখার্জি পেয়েছিলেন ২০.৪৩ শতাংশ ভোট। কম সংখ্যক মানুষ ভোট দিলেও প্রায় ১২.৬৯ শতাংশ ভোট বৃদ্ধি পায় তৃণমূলের।

২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রে প্রার্থী হন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১১ সালের তুলনায় এই কেন্দ্রে ভোটদানের হার ৩.০৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেলেও অন্যান্য কেন্দ্রের তুলনায় তা খুবই কম ছিল। ২০১৬ সালে ভবানীপুরে ভোটদানের হার ছিল ৬৬.৮৩ শতাংশ। এই নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৬৫,৫২০ যা মোট ভোটের ৪৮.৫ শতাংশ। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেসের দীপা দাশমুন্সি পেয়েছিলেন ৪০,২১৯টি ভোট। এই নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দীর প্রাপ্ত ভোটের পার্থক্য ছিল প্রায় ১৮.৭ শতাংশ।

২০২১ সালের নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভবানীপুর কেন্দ্রের পরিবর্তে নন্দীগ্রাম থেকে প্রার্থী হন। ভবানীপুরে তৃণমূলের প্রার্থী ছিলেন শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। এই নির্বাচনেও ভোটদানের হার আশানুরূপ ছিলনা। এই নির্বাচনে ভোটদানের হার ২০১১ সালের নির্বাচনের তুলনায় কমে দাঁড়ায় ৬১.৭২ শতাংশতে। এর মধ্যে ৫৮.৪ শতাংশ ভোট তৃণমূল পেলেও তৃণমূলের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপির রুদ্রনীল ঘোষ পান ৩৫.৬ শতাংশ ভোট। ২২.৮ শতাংশ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয় তৃণমূল।

ভবানীপুর কেন্দ্রে কলকাতা পৌরসভার আটটি ওয়ার্ড আছে। এর মধ্যে ২০২১ সালের ভোটের ফল অনুযায়ী ৭৪ এবং ৭০ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূলের তুলনায় এগিয়ে রয়েছে বিজেপি। ৭৪ নম্বর ওয়ার্ডে ৫৩১ ভোট এবং ৭০ নম্বর ওয়ার্ডে প্রায় ২০৯২ ভোটে এগিয়ে রয়েছে তারা। অন্যদিকে বিজেপির সঙ্গে তৃণমূলের ২৮,৭১৯ ভোটের যে ব্যবধানের তার মধ্যে প্রায় ২১,৭৭৯ ভোটে তারা এগিয়ে রয়েছে শুধু মাত্র ৭৭ নম্বর ওয়ার্ডে। অর্থাৎ বাকি পাঁচটি ওয়ার্ড মিলিয়ে মাত্র ৬,৯৪০ ভোট এগিয়ে রয়েছে তৃণমূল।

গত বিধান সভা নির্বাচনের দিকে তাকালে দেখা যায় শোভনদেব চট্রোপাধ্যায় বিজেপি প্রার্থীর চেয়ে ১২.৮ শতাংশ ভোট বেশি পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। ভবানীপুর কেন্দ্রে বিজেপির সঙ্গে ভোটঅঙ্কে কম মার্জিন থাকায় ভবানীপুরের উপনির্বাচন মমতা বন্দোপাদ্যায়ের জন্য বেশ ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায়।

ভবানীপুরে মোট ভোটার ২,০৬,৩৮৯ জন। এর মধ্যে ৯৫,১৪৩ জন মহিলা ভোটার। অর্থাৎ, মোট ভোটারের প্রায় ৪৬ শতাংশ মহিলা। ২০২১-এর নির্বাচনের হিসাবে মহিলারা বেশিমাত্রায় ভরসা রেখেছেন তৃণমূলের ওপরে। এছাড়া তৃণমূলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভোটব্যাঙ্ক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। ভবানীপুর কেন্দ্রের প্রায় ২০ শতাংশ ভোটার মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। এছাড়াও শিখ এবং অবাঙালি হিন্দু ভোটার মোট ভোটারের প্রায় ৩৪ শতাংশ। গত বিধানসভা ভোটে বিজেপিকে রুখতে তৃণমূলকেই বিকল্প হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন রাজ্যের সংখ্যালঘুরা। ভোটের ফলেই তা স্পষ্ট হয়েছে। এমনকি উত্তরবঙ্গেও কংগ্রেসের সংখ্যালঘু ভোটে ভাঙন ধরিয়েছে তৃনমূল। এই প্রবণতার ব্যতিক্রম হয়নি ভবানীপুরে।

অন্যদিকে ভবানীপুরে অবাঙালি ভোটারদের একটা বড় অংশ বিজেপির ভোটার। এবার তাদের প্রার্থী অবাঙালি প্রিয়াঙ্কা টিবরেওয়াল। যদিও তিনি নিজেকে ‘বাংলার মেয়ে’ বলেই পরিচয় দেন। গত বিধানসভা ভোটে ৭০ এবং ৭৪ নম্বর ওয়ার্ডে এগিয়েছিল বিজেপি। সেখানে অবাঙালি ভোটারের সংখ্যা বেশি। ফলে বিজেপির লক্ষ্য অবাঙালি ভোট যতটা বেশি সম্ভব তাদের ইভিএমে টানা। এক্ষেত্রে ভোটের হার বাড়লে উপভোট ও নির্বাচনের ফলের মধ্যেই অনেকটাই ফারাক হয়ে যেতে পারে বলে মতো রাজনৈতিক মহলের।

তাই ভোটের দিন দুপুর অবধি ভবানীপুরে ভোট কম পড়ায় দুপুর চিন্তার ভাজ পড়ে তৃনমূলে। ১টা পর্যন্ত ভোট পড়ে মাত্র ৩৫.৯৭ শতাংশ। ভোটদানের ট্রেন্ড দেখেই ফিরহাদ হাকিম টুইটে লেখেন, ‘সবাইকে ভোটদানের জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। উন্নয়ন ও সমানাধিকারের জন্য ভোট দিন।’ পাশপাশি ভবানীপুরসহ বাকি দুই কেন্দ্রের ভোটারদের উদ্দেশে টুইট করেন রাজ্যের মন্ত্রী সুব্রত মুখার্জি। ওই টুইটে সুব্রত লেখেন ‘ভবানীপুরসহ বাকি আসনে উপনির্বাচন হচ্ছে। আজ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন। আমাদের ভোটারদের দিদির পক্ষে ভোট দিতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে যে দিদি বিপুল ভোটে জয়ী হবেন।’

তাদের এই টুইটের বিরুদ্ধে ভোটারদের প্রভাবিত করার অভিযোগ এনে বিজেপি প্রার্থী প্রিয়াঙ্কা কমিশনে নালিশ জানিয়েছেন। কমিশনের ব্যাপারে রিপোর্ট তলব করেছে দায়িত্বরত মাইক্রো অবজারভারের কাছে।

ভবানীপুরে উপভোটে সন্দেহাতীত হেভিওয়েট প্রার্থী তৃণমূলের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। লড়াই কঠিন জেনেও ভোটপ্রচারে একটুকুও রেয়াত করেননি বিজেপি প্রার্থী প্রিয়াঙ্কা টিবরেওয়াল। বিজেপি-তৃণমূল ভোটযুদ্ধের মাঝে সিপিএম প্রার্থী শ্রীজীব বিশ্বাসও শেষ পর্যন্ত লড়াই করেছেন। কেননা, এক সময় বামফ্রন্টের দুর্গ ছিল ভবানীপুর। তাই এখানে সিপিএমের বেশ সমর্থক রয়েছে। সে যাই হোক ভোট ব্যালট গ্রাউন্ডে সিপিএম প্রার্থীর সঙ্গে মমতার সেনাপতি ফিরাহদ হাকিমের হঠাৎ সখ্যতাকে রাজনৈতিক মহল বাঁকা চোখে দেখছে। এ প্রসঙ্গে স্বভাবত তাদের প্রশ্ন, তবে কী বাম ‘ভোটার’ অঙ্কে অন্য সমীকরণ রয়েছে?