শিক্ষার বিবর্তন কিংবা বিবর্তনের শিক্ষা

সরকার আবদুল মান্নান

জাতীয় জীবনে শিক্ষার গুরুত্ব ও তাৎপর্য কতটা সে আর বলার অপেক্ষা রাখে না। জাপান, নিউজিল্যান্ড এবং ইউরোপের অনেকগুলো দেশের দিকে তাকালে আমরা স্পষ্টতই অনুধাবন করতে পারি যে, গুণগত শিক্ষা একটি জাতিকে কতটা উন্নত, সমৃদ্ধ, আদর্শনিষ্ট, মানবিক ও বহুত্ববাদী করে তুলতে পারে। বিষয়টি এমন নয় যে, এই সব জাতিগুলো হুট করে এ পর্যায়ে চলে এসেছে। শিক্ষা এমন কোনো উপঢৌকন নয়, যা হাতে করে নিয়ে এসে কেউ আমাদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়। শিক্ষা বিবর্তিত হয় এবং বিবর্তনের পথ ধরে শিক্ষা এগিয়ে চলে। শিক্ষার এই যে গতিপ্রকৃতি তা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে জনগোষ্ঠীর কর্ম ও জীবনাচরণের ভেতর দিয়ে; জাতিগত উন্নয়ন, সমৃদ্ধি ও মর্যাদাবোধের ভেতর দিয়ে।

স্বাধীন বাংলাদেশে আজকে আমরা শিক্ষার যে পরিস্থিতি লক্ষ্য করি তা আজকে তৈরি হয়নি, চলতে চলতে এ অবস্থায় এসেছে। এই চলাটা বহু বছরের পুরনো। বলা যায় হজার বছর পথ চলে শিক্ষা আজকের চেহরা লাভ করেছে। আর্যপূর্ব কালে মোহেনজোদাড়ো ও হরপ্পায় আমরা যে সভ্যতার পরিচয় পাই তার সঙ্গে শিক্ষার সম্পর্ক ছিল নিশ্চয়ই। কিন্তু সেই শিক্ষা কেমন ছিল তার কোনো পরিচয় পাওয়া যায় না। বৈদিক যুগের, রামায়ণ-মহাভরতের যুগের, বৌদ্ধযুগের এবং ব্রাহ্মণ্য যুগের শিক্ষার ও শিক্ষাব্যবস্থার কিছু পরিচয় পাওয়া যায়। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, প্রাচীন ইউরোপের মতো ওই শিক্ষা ছিল ধর্মভিত্তিক ও পারলৌকিক চেতনাসমৃদ্ধ। পূর্ব বাংলায়, বিশেষ করে নালন্দা, তক্ষশিলা, বিক্রমশীলা, উড্ডিয়ানা নামক বৌদ্ধ বিহারগুলোকে কেন্দ্র করে শিক্ষার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল।

বৌদ্ধ শিক্ষার লক্ষ্য ছিল জীবন ও জগৎ থেকে মুক্তি। কিন্তু এক্ষেত্রে বৈদিক ও বৌদ্ধদের মধ্যে পার্থক্য ছিল। বৈদিক মতে, মুক্তি আসবে জীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে পালনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু বৌদ্ধ শিক্ষার একমাত্র লক্ষ্য ছিল আদর্শ পরিনির্বাণ- যেখানে গার্হস্থ্যের কোনো গুরুত্বই ছিল না। সাধনা, নীতিজ্ঞান, নৈতিক জীবনযাপন, বন্ধনহীন সংঘ জীবনে নিয়মানুবর্তিতার শিক্ষা ও সেবা ধর্মই ছিল শিক্ষার লক্ষ্য। বাসনার অপনয়নই ছিল এই শিক্ষার উদ্দেশ্য।

বৌদ্ধ শিক্ষার লক্ষ্য ছিল ধর্ম ও তত্ত্ব সম্পর্কে শিক্ষার্থীকে শিক্ষা দেওয়া। প্রথম অবস্থায় বৌদ্ধ শিক্ষার পাঠক্রমে লৌকিক শিক্ষার কোনো স্থান ছিল না। ভিক্ষুদের জন্য সূত্র, ধর্ম ও বিনয় ছিল অবশ্যপাঠ্য। ব্যাকরণ, জ্যোতির্বিদ্যা প্রভৃতিও ক্রমে ক্রমে বৌদ্ধ পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থা শুধু ভিক্ষুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। গৃহী শিক্ষার্থীরা ধর্মতত্ত্ব শিক্ষার জন্য নির্ভর করতেন বিহারের ওপর। ধর্মনিরপেক্ষ সাধারণ শিক্ষার জন্য মঠের বাইরে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার ওপর নির্ভর করা হতো। ধর্মনিরপেক্ষ উচ্চশিক্ষায় চিকিৎসা, আইন, শিল্পকলা ইত্যাদি ক্ষেত্রে বৌদ্ধ শিক্ষা সমৃদ্ধ ছিল।

মুসলিম শাসনামলে মাদরাসা শিক্ষা শুরু হয়। সাধারণত মসজিদ ও মক্তব কেন্দ্রিক মাদরাসা শিক্ষার মূল বিষয় ছিল নামাজ পড়তে শেখার সঙ্গে সঙ্গে কোরআন-সুন্নাহর আলোকে একজন মুসলমানের জীবনাচরণ কেমন হবে তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। সঙ্গে সঙ্গে টোল ও চতুষ্পাঠীকে কেন্দ্র করে সাধারণ শিক্ষার একটি দেশজ ধারাও বহমান ছিল। এই ধারায় বাংলা ভাষায় লিখতে, পড়তে ও সাধারণ হিসাব-নিকাশ শেখানো হতো। শত শত বছর ধরে মূলত ধর্মভিত্তিক শিক্ষার যে ধারা ভারতবর্ষে প্রবহমান ছিল তার সঙ্গে শাসক শ্রেণির তেমন কোনো সম্পর্ক ছিল না। সরকারি কোনো বিধিবিধান, শাসন অনুশাসন কিংবা অনুধানের বিষয়ও ছিল না। শিক্ষা ছিল ব্যক্তিগত পারিবারিক ও সামাজিক বিষয়। এবং ছাত্র, শিক্ষক ও অভিভাবকের মধ্যে সম্পর্ক ছিল নিবিড়। অনেকটা পারিবারিক সদস্যদের মতো। বিশেষ করে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক ছিল গুরুশিষ্য সম্পর্ক। আর ছাত্রকে শাসন-নির্যাতন তো ছিলই।

মূলত ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনকে কেন্দ্র করে পাশ্চাত্য শিক্ষার অনুপ্রবেশ ঘটে। দেশজুড়ে টোল, চতুষ্পাঠী ও মাদরাসা শিক্ষার পাশাপাশি ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে স্কুল। আর এখান থেকেই শুরু হয় পারলৌকিক শিক্ষাদর্শন থেকে ইহলৌকিক শিক্ষার ধারা। শুরুটা হয়েছিল ইংরেজি ভাষা শিক্ষাকে কেন্দ্র করে কলকাতায় কোচিং সেন্টারের মতো স্কুল প্রতিষ্ঠা দিয়ে। ইংরেজদের অধীনে বয়-বেয়ারা ও কেরানির চাকরি পাওয়ার প্রত্যাশায় এবং কখনো বা ব্যবসা পাওয়ার জন্য এই শিক্ষা দ্রুত বিকশিত হতে থাকে। আর সেখান থেকেই শুরু হয় বর্তমান শিক্ষার গোড়াপত্তন।

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতীয়দের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের নৈতিক দায়িত্ব স্বীকার করেনি। এবং এ দেশে শিক্ষা বিস্তারের কোনো সুনির্দিষ্ট সরকারি নীতিমালাও ছিল না। তবুও এই সময় প্রতিষ্ঠিত ফোর্ট ইউলিয়াম কলেজ, আত্মীয়সভা, রামমোহনের স্কুল, হিন্দু কলেজ, ব্রাহ্মসমাজ ইত্যাকার প্রতিষ্ঠান কলকাতা কেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থায় আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ভেতর (অ্যাংলিসিস্ট ও ওরিয়েন্টালিস্ট) দিয়ে উত্তরণের পথ সৃষ্টি হয়। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানির সনদ নবায়নের সময় সনদে ভারতে শিক্ষা বিস্তার বিষয়ে শর্ত থাকে যে, ব্রিটিশ ভারতে সাহিত্যের পুনর্জীবন ও উন্নতি বিধান, পণ্ডিতদের উৎসাহদান এবং দেশীয়দের মধ্যে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রবর্তনের জন্য কোম্পানি অন্য সব রকম খরচ মিটিয়ে বছরে এক লক্ষ টাকা খরচ করবে। এটাই ভারতে সরকারিভাবে শিক্ষা বিস্তারের প্রথম পদক্ষেপ। ভারতে আধুনিক শিক্ষা বিস্তারে ১৮১৩ সালের সনদ আইনে শিক্ষা বিস্তার, শিক্ষানীতি নির্ধারণ ও শিক্ষার জন্য রাজকোষ থেকে অর্থ ব্যয়- এই তিনটি দায়িত্ব শাসক কর্তৃপক্ষ থেকে প্রথমবারের মতো স্বীকৃতি পায়। এবং এই শিক্ষার মূলে ছিল নেটিভদের দাপ্তরিক কাজে দক্ষ করে তোলা। প্রাচ্য শিক্ষার সঙ্গে পাশ্চাত্য শিক্ষার মেলবন্ধনও ছিল শুরুর দিকে। কিন্তু ইংরেজি সাহিত্য, বিজ্ঞান, গণিত ও সামাজিক বিজ্ঞানসমূহের যে পাঠ্যসূচি বিভিন্ন শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত রাখা হয়েছিল তাতে পাশ্চাত্য শিক্ষার চেতনা নয়, কাঠামোই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। সেই কাঠামোর ভেতরে থেকে, বক্সের ভেতরে থেকে ঊনবিংশ শতকে একদিকে যেমন একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবির্ভব ঘটে তেমনি বক্স থেকে বের হয়ে এসে প্রথাগত বিশ^াস এবং ধর্মকে কেন্দ্র করে যে সব অধর্ম বহুকাল ধরে সমাজে জারি ছিল তার বিরুদ্ধে একটি বিপ্লবী শ্রেণির উত্থানও ঘটে ওই সময়ে। শুধু তা-ই নয়, পরাধীনতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ক্ষীণ আলোকবর্তিকাও জ¦লে ওঠে ওই পাশ্চাত্য শিক্ষাকে কেন্দ্র করেই। এই ধারা ঊনবিংশ শতকের রেঁনেসা থেকে শুরু করে নানা রকম পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে মুসলমানেদের চিন্তার মুক্তি আন্দোলন, আমাদের ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন এবং পরবর্তী পর্যায়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলন পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।

মুষ্টিমেয় মানুষের চেতনার জাগরণে পাশ্চাত্য শিক্ষার ধারা নিঃসন্দেহেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলছে। কিন্তু একটি সমৃদ্ধ জাতিগোষ্ঠী বিনির্মাণে বিবর্তনের পথ ধরে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, পরিবেশ-পরিস্থিতি ও মানুষের মনোগড়নের বিবর্তনের আলোকে এবং সর্বোপরি বৈশি^ক চাহিদার পটভূমিতে শিক্ষার যে পরিবর্তন সাধিত হওয়ার কথা ছিল তা কীভাবে কতটুকু হয়েছে সেই আলেখ্য বিবেচনা করা দরকার।

১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন দেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করেছিলেন শিক্ষার উপর। তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন যে, শিক্ষায় বিনিয়োগের চেয়ে উত্তম বিনিয়োগ আর নেই। এবং তিনি এও অনুধাবন করেছিলেন যে, ওই বিনিয়োগ করতে হবে একদম গোড়া থেকে অর্থাৎ প্রাথমিক শিক্ষা থেকে। এর সঙ্গে তিনি শিক্ষকদের জীবনমানের উন্নতির কথা গভীরভাবে চিন্তা করেছেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে অতি স্বল্প আর্থিক সামর্থ্যরে মধ্যেও তাৎক্ষণিকভাবে প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ এবং শিক্ষকদের বেতনাদি বৃদ্ধির মাধ্যমে তিনি যাত্রারম্ভ করেন এবং কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের মাধ্যমে শিক্ষার সামগ্রিক পরিবর্তনে বিশাল কর্মযজ্ঞ হাতে নিয়েছিলেন। কুদরাত-এ-খুদা কমিশনের প্রতিবেদনটিতে সংবিধানের চারটি মূলনীতি অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ভিত্তি করে শিক্ষার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, বিষয়ের উদ্দেশ্য, শিক্ষাক্রম, বিষয়বস্তু ও শিক্ষার্থী মূল্যায়ন পদ্ধতি প্রণয়ন করা হয়েছিল। তাছাড়া শিক্ষাক্রমে দেশের এক নম্বর সমস্যা জনসংখ্যাকে সবিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া বিজ্ঞানকে হাতে-কলমে কাজের বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক ও কারিগরি শিক্ষার প্রতি যে গুরুত্বারোপ করা হয় তা ছিল একটি সমৃদ্ধ রাষ্ট্র গঠনের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কিন্তু ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার-পরিজন ও রাজনৈতিক সহকর্মীদের হত্যার ভেতর দিয়ে কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট তো বটেই, অধিকন্তু মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, মূল্যবোধ ও চেতনাকে সম্পূর্ণ রূপে প্রত্যাখ্যান করা হয়।

’৭৫-এর জাতীয় ট্র্যাজেডি সংগঠনের পর অনেকগুলো কমিশন গঠিত হয়েছিল। সামরিক শাসিত ও ছদ্ম সামরিক শাসিত সরকারগুলো তাদের ক্ষমতার শেষ দিকে বাহবা নেওয়ার জন্য এক একটি কমিশন রিপোর্ট প্রকাশ করত। কিন্তু তা বাস্তবায়নের কোনো কর্মপরিকল্পনাই তারা গ্রহণ করেনি। নব্বইয়ের দশকে যখন যোগ্যতাভিত্তিক কারিকুলাম তৈরি হয়, তখন ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ যেহেতু সংবিধান থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে এবং সংবিধানে ‘আল্লাহর উপর বিশ্বাস’ যুক্ত হয়েছে তখন একটি অসাম্প্রদায়িক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করা সম্ভব হয়নি। সেই সময়ও যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষাবলম্বী শক্তি চেষ্টা করেনি তা নয়। কিন্তু তারা পারেননি। ‘সব ধর্মের মানুষের সমানাধিকার’ ও সমতার বিষয়কে পাঠ্য বিষয়বস্তুতে রাখার প্রচেষ্টা তখনো অব্যাহত ছিল।

’৭৫-এর পরে দিন যতই অতিবাহিত হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অপশক্তি ততই সংগঠিত হয়েছে এবং ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য ধর্মের আশ্রয় নিয়েছে। তারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আধুনিক ও মানবিক সংবিধানটিতে ধর্মীয় বিষয় যুক্ত করে করে সাম্প্রদায়িক করে তোলে। এই অপচেষ্টা যে শুধু গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে কঠিন করে তোলে তা-ই নয়, বরং শিক্ষা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, বাকস্বাধীনতা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা- সব কিছুকেই চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয়।

১৯৭৫-এর পরে অনেকগুলো ব্যর্থ শিক্ষা কমিশনের পরে ২০১০ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে গঠিত কমিটির রিপোর্ট দল-মত নির্বিশেষে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে এবং সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত হয়। সেই ২০১০ সাল থেকেই শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ নামে পরিচিত রিপোর্টের “লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য” শিরোনামের অনুচ্ছেদে বলা হয়, “শিক্ষানীতি প্রণয়নে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে বিধৃত সংশ্লিষ্ট নির্দেশনাসমূহ বিবেচনায় রাখা হয়েছে। জাতিসংঘ শিশু অধিকার কনভেনশন, যেখানে প্রত্যেক সদস্য দেশে সকল শিশুর শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করার তাগিদ রয়েছে, সেটিও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। শিক্ষানীতির মূল উদ্দেশ্য মানবতার বিকাশ এবং জনমুখী উন্নয়ন ও প্রগতিতে নেতৃত্বদানের উপযোগী মননশীল, যুক্তিবাদী, নীতিবান, নিজের এবং অন্যান্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, কুসংস্কারমুক্ত, পরমতসহিষ্ণু, অসাম্প্রদায়িক, দেশপ্রেমিক এবং কর্মকুশল নাগরিক গড়ে তোলা। পাশাপাশি শিক্ষার মাধ্যমেই জাতিকে দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার বৈশিষ্ট্য ও দক্ষতা অর্জন করতে হবে। এই শিক্ষানীতি সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী দেশে গণমুখী, সুলভ, সুষম, সর্বজনীন, সুপরিকল্পিত, বিজ্ঞানমনষ্ক এবং মানসম্পন্ন শিক্ষাদানে সক্ষম শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার ভিত্তি ও রণকৌশল হিসেবে কাজ করবে।” এই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামনে রেখে যে শিক্ষাক্রম, পাঠ্যসূচি, মূল্যায়ন কৌশল নির্ধারণ করা হয় তার মধ্যে সরকারের দায়িত্ব অনেকাংশেই বাস্তবায়ন হতে দেখা যায়। শিক্ষাকে সহজলভ্য, অবৈতনিক ও গণমুখী করে তোলার জন্য প্রাক-প্রথমিক থেকে নবম-দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তক বছরের প্রথম দিনেই শিক্ষার্থীর হাতে পৌঁছে দেওয়া হয়। কোটি কোটি নতুন পাঠ্যপুস্তক যথা সময়ে শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার মতো পর্বতপ্রমাণ কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করে আসছে সরকার। প্রাথমিক শিক্ষা ও নারী শিক্ষাকে উৎসাহিত করার জন্য বিপুল পরিমাণ বৃত্তি-উপবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। কারিগরি শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে এবং গত এক যুগে এই শিক্ষা যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, বিনির্মাণ, সংস্কার ও সম্প্রসারণে সরকার যে পরিমাণ অর্থ ব্যায় করেছে তা বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। স্কুল-কলেজগুলোতে পর্যাপ্ত শিক্ষা উপকরণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মাদরাসা শিক্ষাকে ধর্ম শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ ও আধুনিক শিক্ষায় উন্নীত করার চেষ্টা করা হয়েছে। উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রেও নতুন নতুন কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয় স্থাপন করে শিক্ষা লাভের সুযোগ অবরারিত করা হয়েছে। ফলে গত একযুগে শিক্ষার পরিমাণগত পরিধি বিস্ময়করভাবে বিস্তৃত হয়েছে। অর্থাৎ “গণমুখী, সুলভ, সুষম, সর্বজনীন” শিক্ষা অনেকাংশেই নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু ওই যে বলা হয়েছে “মানবতার বিকাশ”, “নেতৃত্বদানের উপযোগী মননশীল, যুক্তিবাদী, নীতিবান, নিজের এবং অন্যান্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, কুসংস্কারমুক্ত, পরমতসহিষ্ণু, অসাম্প্রদায়িক, দেশপ্রেমিক” নাগরিক গড়ে তোলার কথা, তার জন্য শিক্ষাক্রমে নির্দেশনা থাকলেও মূল্যায়ন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এনে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। যে ধারাবাহিক মূল্যায়নের ভেতর দিয়ে, সহশিক্ষাক্রমিক কার্যক্রমের ভেতর দিয়ে, হাতে-কলমে কাজের ভেতর দিয়ে, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে, খেলাধুলার ভেতর দিয়ে, সৃষ্টিশীল কাজের ভেতর দিয়ে এবং এক কথায় সামষ্টিক মূল্যায়নের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিক মূল্যায়নের মাধ্যমে উল্লিখিত দক্ষতাগুলো অর্জন করার কথা ছিল, তা সম্ভব হয়নি। কারণ শিক্ষার ক্ষেত্রে অর্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দৃশ্যগ্রাহ্য ও পরিমাণগত বিষয়গুলো যত সহজে অর্জন করা সম্ভব হয় গুণগত বিষয়গুলো অর্জন করা তত সহজ নয়। শুধু খাতা-কলমে পরীক্ষার ভেতর দিয়ে ওইসব দক্ষতা অর্জন করা যায় না। এর জন্য দরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ধারাবাহিক মূল্যায়নের সংস্কৃতি তৈরি করা। একযুগ পরে নতুন শিক্ষাক্রম প্রণীত হয়েছে। ২০২৩ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে। আশা করা যায়, ওই শিক্ষাক্রম সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন হবে এবং একটি অসাম্প্রদায়িক, মানবিক, যুক্তিবাদী, দেশপ্রেমিক ও দক্ষ জনগোষ্ঠীর উত্থান ঘটিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজন্ম লালিত “সোনার বাংলা” বিনির্মাণে আমরা বহুদূর এগিয়ে যেতে পারব।

image
আরও খবর
বাংলা নামের প্রথম দৈনিক
বাংলাদেশকেও সাবধানে পা ফেলতে হবে
নির্মলেন্দু গুণের কবিতা
সংবাদ এবং আমার শৈশব
আমার বাতিঘর
নয়া মাধ্যম: মিডিয়া ডায়েট ব্যক্তির স্বাধীনতা
সংবাদ-এর ঐতিহ্যিক ধারাবাহিকতা
চলছে লড়াই, চলবে লড়াই
গণমাধ্যমের শক্তি ১৯৭১
সংবাদ ও রণেশ দাশগুপ্ত
আমার ‘সংবাদ’
দৈনিক সংবাদ আমার প্রতিষ্ঠান
বিভাগোত্তর কালে দুই বাংলায় গণমাধ্যমের বিবর্তন
দুর্ভিক্ষের পীড়া ও রবীন্দ্রনাথ
সংবাদ ও অর্থনীতি
ভবিষ্যতের গণমাধ্যম গণমাধ্যমের ভবিষ্যৎ
মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতা
দুটি কবিতা : আহমদ সলীম
গোলাম কিবরিয়া পিনু
সাতচল্লিশ পরবর্তী বাংলা গানের বিবর্তন
নারীর মনোজগৎ: আমাদের বিভ্রম ও কল্পকাহিনী
নতুন সময়ের গণমাধ্যম
‘সংবাদ’ শুধু একটি সংবাদপত্র নয়
গৌরব এবং গর্বের সংবাদ
গণমাধ্যম কেবল আশার স্বপ্ন নয়
গণমানুষের নিজের পত্রিকা ‘সংবাদ’
মুক্তিযুদ্ধ ও সাংবাদিকতা
মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িকতা

বুধবার, ০৩ আগস্ট ২০২২

শিক্ষার বিবর্তন কিংবা বিবর্তনের শিক্ষা

সরকার আবদুল মান্নান

image

জাতীয় জীবনে শিক্ষার গুরুত্ব ও তাৎপর্য কতটা সে আর বলার অপেক্ষা রাখে না। জাপান, নিউজিল্যান্ড এবং ইউরোপের অনেকগুলো দেশের দিকে তাকালে আমরা স্পষ্টতই অনুধাবন করতে পারি যে, গুণগত শিক্ষা একটি জাতিকে কতটা উন্নত, সমৃদ্ধ, আদর্শনিষ্ট, মানবিক ও বহুত্ববাদী করে তুলতে পারে। বিষয়টি এমন নয় যে, এই সব জাতিগুলো হুট করে এ পর্যায়ে চলে এসেছে। শিক্ষা এমন কোনো উপঢৌকন নয়, যা হাতে করে নিয়ে এসে কেউ আমাদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়। শিক্ষা বিবর্তিত হয় এবং বিবর্তনের পথ ধরে শিক্ষা এগিয়ে চলে। শিক্ষার এই যে গতিপ্রকৃতি তা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে জনগোষ্ঠীর কর্ম ও জীবনাচরণের ভেতর দিয়ে; জাতিগত উন্নয়ন, সমৃদ্ধি ও মর্যাদাবোধের ভেতর দিয়ে।

স্বাধীন বাংলাদেশে আজকে আমরা শিক্ষার যে পরিস্থিতি লক্ষ্য করি তা আজকে তৈরি হয়নি, চলতে চলতে এ অবস্থায় এসেছে। এই চলাটা বহু বছরের পুরনো। বলা যায় হজার বছর পথ চলে শিক্ষা আজকের চেহরা লাভ করেছে। আর্যপূর্ব কালে মোহেনজোদাড়ো ও হরপ্পায় আমরা যে সভ্যতার পরিচয় পাই তার সঙ্গে শিক্ষার সম্পর্ক ছিল নিশ্চয়ই। কিন্তু সেই শিক্ষা কেমন ছিল তার কোনো পরিচয় পাওয়া যায় না। বৈদিক যুগের, রামায়ণ-মহাভরতের যুগের, বৌদ্ধযুগের এবং ব্রাহ্মণ্য যুগের শিক্ষার ও শিক্ষাব্যবস্থার কিছু পরিচয় পাওয়া যায়। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, প্রাচীন ইউরোপের মতো ওই শিক্ষা ছিল ধর্মভিত্তিক ও পারলৌকিক চেতনাসমৃদ্ধ। পূর্ব বাংলায়, বিশেষ করে নালন্দা, তক্ষশিলা, বিক্রমশীলা, উড্ডিয়ানা নামক বৌদ্ধ বিহারগুলোকে কেন্দ্র করে শিক্ষার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল।

বৌদ্ধ শিক্ষার লক্ষ্য ছিল জীবন ও জগৎ থেকে মুক্তি। কিন্তু এক্ষেত্রে বৈদিক ও বৌদ্ধদের মধ্যে পার্থক্য ছিল। বৈদিক মতে, মুক্তি আসবে জীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে পালনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু বৌদ্ধ শিক্ষার একমাত্র লক্ষ্য ছিল আদর্শ পরিনির্বাণ- যেখানে গার্হস্থ্যের কোনো গুরুত্বই ছিল না। সাধনা, নীতিজ্ঞান, নৈতিক জীবনযাপন, বন্ধনহীন সংঘ জীবনে নিয়মানুবর্তিতার শিক্ষা ও সেবা ধর্মই ছিল শিক্ষার লক্ষ্য। বাসনার অপনয়নই ছিল এই শিক্ষার উদ্দেশ্য।

বৌদ্ধ শিক্ষার লক্ষ্য ছিল ধর্ম ও তত্ত্ব সম্পর্কে শিক্ষার্থীকে শিক্ষা দেওয়া। প্রথম অবস্থায় বৌদ্ধ শিক্ষার পাঠক্রমে লৌকিক শিক্ষার কোনো স্থান ছিল না। ভিক্ষুদের জন্য সূত্র, ধর্ম ও বিনয় ছিল অবশ্যপাঠ্য। ব্যাকরণ, জ্যোতির্বিদ্যা প্রভৃতিও ক্রমে ক্রমে বৌদ্ধ পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থা শুধু ভিক্ষুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। গৃহী শিক্ষার্থীরা ধর্মতত্ত্ব শিক্ষার জন্য নির্ভর করতেন বিহারের ওপর। ধর্মনিরপেক্ষ সাধারণ শিক্ষার জন্য মঠের বাইরে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার ওপর নির্ভর করা হতো। ধর্মনিরপেক্ষ উচ্চশিক্ষায় চিকিৎসা, আইন, শিল্পকলা ইত্যাদি ক্ষেত্রে বৌদ্ধ শিক্ষা সমৃদ্ধ ছিল।

মুসলিম শাসনামলে মাদরাসা শিক্ষা শুরু হয়। সাধারণত মসজিদ ও মক্তব কেন্দ্রিক মাদরাসা শিক্ষার মূল বিষয় ছিল নামাজ পড়তে শেখার সঙ্গে সঙ্গে কোরআন-সুন্নাহর আলোকে একজন মুসলমানের জীবনাচরণ কেমন হবে তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। সঙ্গে সঙ্গে টোল ও চতুষ্পাঠীকে কেন্দ্র করে সাধারণ শিক্ষার একটি দেশজ ধারাও বহমান ছিল। এই ধারায় বাংলা ভাষায় লিখতে, পড়তে ও সাধারণ হিসাব-নিকাশ শেখানো হতো। শত শত বছর ধরে মূলত ধর্মভিত্তিক শিক্ষার যে ধারা ভারতবর্ষে প্রবহমান ছিল তার সঙ্গে শাসক শ্রেণির তেমন কোনো সম্পর্ক ছিল না। সরকারি কোনো বিধিবিধান, শাসন অনুশাসন কিংবা অনুধানের বিষয়ও ছিল না। শিক্ষা ছিল ব্যক্তিগত পারিবারিক ও সামাজিক বিষয়। এবং ছাত্র, শিক্ষক ও অভিভাবকের মধ্যে সম্পর্ক ছিল নিবিড়। অনেকটা পারিবারিক সদস্যদের মতো। বিশেষ করে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক ছিল গুরুশিষ্য সম্পর্ক। আর ছাত্রকে শাসন-নির্যাতন তো ছিলই।

মূলত ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনকে কেন্দ্র করে পাশ্চাত্য শিক্ষার অনুপ্রবেশ ঘটে। দেশজুড়ে টোল, চতুষ্পাঠী ও মাদরাসা শিক্ষার পাশাপাশি ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে স্কুল। আর এখান থেকেই শুরু হয় পারলৌকিক শিক্ষাদর্শন থেকে ইহলৌকিক শিক্ষার ধারা। শুরুটা হয়েছিল ইংরেজি ভাষা শিক্ষাকে কেন্দ্র করে কলকাতায় কোচিং সেন্টারের মতো স্কুল প্রতিষ্ঠা দিয়ে। ইংরেজদের অধীনে বয়-বেয়ারা ও কেরানির চাকরি পাওয়ার প্রত্যাশায় এবং কখনো বা ব্যবসা পাওয়ার জন্য এই শিক্ষা দ্রুত বিকশিত হতে থাকে। আর সেখান থেকেই শুরু হয় বর্তমান শিক্ষার গোড়াপত্তন।

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতীয়দের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের নৈতিক দায়িত্ব স্বীকার করেনি। এবং এ দেশে শিক্ষা বিস্তারের কোনো সুনির্দিষ্ট সরকারি নীতিমালাও ছিল না। তবুও এই সময় প্রতিষ্ঠিত ফোর্ট ইউলিয়াম কলেজ, আত্মীয়সভা, রামমোহনের স্কুল, হিন্দু কলেজ, ব্রাহ্মসমাজ ইত্যাকার প্রতিষ্ঠান কলকাতা কেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থায় আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ভেতর (অ্যাংলিসিস্ট ও ওরিয়েন্টালিস্ট) দিয়ে উত্তরণের পথ সৃষ্টি হয়। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানির সনদ নবায়নের সময় সনদে ভারতে শিক্ষা বিস্তার বিষয়ে শর্ত থাকে যে, ব্রিটিশ ভারতে সাহিত্যের পুনর্জীবন ও উন্নতি বিধান, পণ্ডিতদের উৎসাহদান এবং দেশীয়দের মধ্যে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রবর্তনের জন্য কোম্পানি অন্য সব রকম খরচ মিটিয়ে বছরে এক লক্ষ টাকা খরচ করবে। এটাই ভারতে সরকারিভাবে শিক্ষা বিস্তারের প্রথম পদক্ষেপ। ভারতে আধুনিক শিক্ষা বিস্তারে ১৮১৩ সালের সনদ আইনে শিক্ষা বিস্তার, শিক্ষানীতি নির্ধারণ ও শিক্ষার জন্য রাজকোষ থেকে অর্থ ব্যয়- এই তিনটি দায়িত্ব শাসক কর্তৃপক্ষ থেকে প্রথমবারের মতো স্বীকৃতি পায়। এবং এই শিক্ষার মূলে ছিল নেটিভদের দাপ্তরিক কাজে দক্ষ করে তোলা। প্রাচ্য শিক্ষার সঙ্গে পাশ্চাত্য শিক্ষার মেলবন্ধনও ছিল শুরুর দিকে। কিন্তু ইংরেজি সাহিত্য, বিজ্ঞান, গণিত ও সামাজিক বিজ্ঞানসমূহের যে পাঠ্যসূচি বিভিন্ন শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত রাখা হয়েছিল তাতে পাশ্চাত্য শিক্ষার চেতনা নয়, কাঠামোই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। সেই কাঠামোর ভেতরে থেকে, বক্সের ভেতরে থেকে ঊনবিংশ শতকে একদিকে যেমন একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবির্ভব ঘটে তেমনি বক্স থেকে বের হয়ে এসে প্রথাগত বিশ^াস এবং ধর্মকে কেন্দ্র করে যে সব অধর্ম বহুকাল ধরে সমাজে জারি ছিল তার বিরুদ্ধে একটি বিপ্লবী শ্রেণির উত্থানও ঘটে ওই সময়ে। শুধু তা-ই নয়, পরাধীনতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ক্ষীণ আলোকবর্তিকাও জ¦লে ওঠে ওই পাশ্চাত্য শিক্ষাকে কেন্দ্র করেই। এই ধারা ঊনবিংশ শতকের রেঁনেসা থেকে শুরু করে নানা রকম পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে মুসলমানেদের চিন্তার মুক্তি আন্দোলন, আমাদের ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন এবং পরবর্তী পর্যায়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলন পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।

মুষ্টিমেয় মানুষের চেতনার জাগরণে পাশ্চাত্য শিক্ষার ধারা নিঃসন্দেহেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলছে। কিন্তু একটি সমৃদ্ধ জাতিগোষ্ঠী বিনির্মাণে বিবর্তনের পথ ধরে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, পরিবেশ-পরিস্থিতি ও মানুষের মনোগড়নের বিবর্তনের আলোকে এবং সর্বোপরি বৈশি^ক চাহিদার পটভূমিতে শিক্ষার যে পরিবর্তন সাধিত হওয়ার কথা ছিল তা কীভাবে কতটুকু হয়েছে সেই আলেখ্য বিবেচনা করা দরকার।

১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন দেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করেছিলেন শিক্ষার উপর। তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন যে, শিক্ষায় বিনিয়োগের চেয়ে উত্তম বিনিয়োগ আর নেই। এবং তিনি এও অনুধাবন করেছিলেন যে, ওই বিনিয়োগ করতে হবে একদম গোড়া থেকে অর্থাৎ প্রাথমিক শিক্ষা থেকে। এর সঙ্গে তিনি শিক্ষকদের জীবনমানের উন্নতির কথা গভীরভাবে চিন্তা করেছেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে অতি স্বল্প আর্থিক সামর্থ্যরে মধ্যেও তাৎক্ষণিকভাবে প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ এবং শিক্ষকদের বেতনাদি বৃদ্ধির মাধ্যমে তিনি যাত্রারম্ভ করেন এবং কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের মাধ্যমে শিক্ষার সামগ্রিক পরিবর্তনে বিশাল কর্মযজ্ঞ হাতে নিয়েছিলেন। কুদরাত-এ-খুদা কমিশনের প্রতিবেদনটিতে সংবিধানের চারটি মূলনীতি অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ভিত্তি করে শিক্ষার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, বিষয়ের উদ্দেশ্য, শিক্ষাক্রম, বিষয়বস্তু ও শিক্ষার্থী মূল্যায়ন পদ্ধতি প্রণয়ন করা হয়েছিল। তাছাড়া শিক্ষাক্রমে দেশের এক নম্বর সমস্যা জনসংখ্যাকে সবিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া বিজ্ঞানকে হাতে-কলমে কাজের বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক ও কারিগরি শিক্ষার প্রতি যে গুরুত্বারোপ করা হয় তা ছিল একটি সমৃদ্ধ রাষ্ট্র গঠনের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কিন্তু ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার-পরিজন ও রাজনৈতিক সহকর্মীদের হত্যার ভেতর দিয়ে কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট তো বটেই, অধিকন্তু মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, মূল্যবোধ ও চেতনাকে সম্পূর্ণ রূপে প্রত্যাখ্যান করা হয়।

’৭৫-এর জাতীয় ট্র্যাজেডি সংগঠনের পর অনেকগুলো কমিশন গঠিত হয়েছিল। সামরিক শাসিত ও ছদ্ম সামরিক শাসিত সরকারগুলো তাদের ক্ষমতার শেষ দিকে বাহবা নেওয়ার জন্য এক একটি কমিশন রিপোর্ট প্রকাশ করত। কিন্তু তা বাস্তবায়নের কোনো কর্মপরিকল্পনাই তারা গ্রহণ করেনি। নব্বইয়ের দশকে যখন যোগ্যতাভিত্তিক কারিকুলাম তৈরি হয়, তখন ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ যেহেতু সংবিধান থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে এবং সংবিধানে ‘আল্লাহর উপর বিশ্বাস’ যুক্ত হয়েছে তখন একটি অসাম্প্রদায়িক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করা সম্ভব হয়নি। সেই সময়ও যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষাবলম্বী শক্তি চেষ্টা করেনি তা নয়। কিন্তু তারা পারেননি। ‘সব ধর্মের মানুষের সমানাধিকার’ ও সমতার বিষয়কে পাঠ্য বিষয়বস্তুতে রাখার প্রচেষ্টা তখনো অব্যাহত ছিল।

’৭৫-এর পরে দিন যতই অতিবাহিত হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অপশক্তি ততই সংগঠিত হয়েছে এবং ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য ধর্মের আশ্রয় নিয়েছে। তারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আধুনিক ও মানবিক সংবিধানটিতে ধর্মীয় বিষয় যুক্ত করে করে সাম্প্রদায়িক করে তোলে। এই অপচেষ্টা যে শুধু গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে কঠিন করে তোলে তা-ই নয়, বরং শিক্ষা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, বাকস্বাধীনতা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা- সব কিছুকেই চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয়।

১৯৭৫-এর পরে অনেকগুলো ব্যর্থ শিক্ষা কমিশনের পরে ২০১০ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে গঠিত কমিটির রিপোর্ট দল-মত নির্বিশেষে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে এবং সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত হয়। সেই ২০১০ সাল থেকেই শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ নামে পরিচিত রিপোর্টের “লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য” শিরোনামের অনুচ্ছেদে বলা হয়, “শিক্ষানীতি প্রণয়নে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে বিধৃত সংশ্লিষ্ট নির্দেশনাসমূহ বিবেচনায় রাখা হয়েছে। জাতিসংঘ শিশু অধিকার কনভেনশন, যেখানে প্রত্যেক সদস্য দেশে সকল শিশুর শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করার তাগিদ রয়েছে, সেটিও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। শিক্ষানীতির মূল উদ্দেশ্য মানবতার বিকাশ এবং জনমুখী উন্নয়ন ও প্রগতিতে নেতৃত্বদানের উপযোগী মননশীল, যুক্তিবাদী, নীতিবান, নিজের এবং অন্যান্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, কুসংস্কারমুক্ত, পরমতসহিষ্ণু, অসাম্প্রদায়িক, দেশপ্রেমিক এবং কর্মকুশল নাগরিক গড়ে তোলা। পাশাপাশি শিক্ষার মাধ্যমেই জাতিকে দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার বৈশিষ্ট্য ও দক্ষতা অর্জন করতে হবে। এই শিক্ষানীতি সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী দেশে গণমুখী, সুলভ, সুষম, সর্বজনীন, সুপরিকল্পিত, বিজ্ঞানমনষ্ক এবং মানসম্পন্ন শিক্ষাদানে সক্ষম শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার ভিত্তি ও রণকৌশল হিসেবে কাজ করবে।” এই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামনে রেখে যে শিক্ষাক্রম, পাঠ্যসূচি, মূল্যায়ন কৌশল নির্ধারণ করা হয় তার মধ্যে সরকারের দায়িত্ব অনেকাংশেই বাস্তবায়ন হতে দেখা যায়। শিক্ষাকে সহজলভ্য, অবৈতনিক ও গণমুখী করে তোলার জন্য প্রাক-প্রথমিক থেকে নবম-দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তক বছরের প্রথম দিনেই শিক্ষার্থীর হাতে পৌঁছে দেওয়া হয়। কোটি কোটি নতুন পাঠ্যপুস্তক যথা সময়ে শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার মতো পর্বতপ্রমাণ কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করে আসছে সরকার। প্রাথমিক শিক্ষা ও নারী শিক্ষাকে উৎসাহিত করার জন্য বিপুল পরিমাণ বৃত্তি-উপবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। কারিগরি শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে এবং গত এক যুগে এই শিক্ষা যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, বিনির্মাণ, সংস্কার ও সম্প্রসারণে সরকার যে পরিমাণ অর্থ ব্যায় করেছে তা বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। স্কুল-কলেজগুলোতে পর্যাপ্ত শিক্ষা উপকরণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মাদরাসা শিক্ষাকে ধর্ম শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ ও আধুনিক শিক্ষায় উন্নীত করার চেষ্টা করা হয়েছে। উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রেও নতুন নতুন কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয় স্থাপন করে শিক্ষা লাভের সুযোগ অবরারিত করা হয়েছে। ফলে গত একযুগে শিক্ষার পরিমাণগত পরিধি বিস্ময়করভাবে বিস্তৃত হয়েছে। অর্থাৎ “গণমুখী, সুলভ, সুষম, সর্বজনীন” শিক্ষা অনেকাংশেই নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু ওই যে বলা হয়েছে “মানবতার বিকাশ”, “নেতৃত্বদানের উপযোগী মননশীল, যুক্তিবাদী, নীতিবান, নিজের এবং অন্যান্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, কুসংস্কারমুক্ত, পরমতসহিষ্ণু, অসাম্প্রদায়িক, দেশপ্রেমিক” নাগরিক গড়ে তোলার কথা, তার জন্য শিক্ষাক্রমে নির্দেশনা থাকলেও মূল্যায়ন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এনে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। যে ধারাবাহিক মূল্যায়নের ভেতর দিয়ে, সহশিক্ষাক্রমিক কার্যক্রমের ভেতর দিয়ে, হাতে-কলমে কাজের ভেতর দিয়ে, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে, খেলাধুলার ভেতর দিয়ে, সৃষ্টিশীল কাজের ভেতর দিয়ে এবং এক কথায় সামষ্টিক মূল্যায়নের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিক মূল্যায়নের মাধ্যমে উল্লিখিত দক্ষতাগুলো অর্জন করার কথা ছিল, তা সম্ভব হয়নি। কারণ শিক্ষার ক্ষেত্রে অর্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দৃশ্যগ্রাহ্য ও পরিমাণগত বিষয়গুলো যত সহজে অর্জন করা সম্ভব হয় গুণগত বিষয়গুলো অর্জন করা তত সহজ নয়। শুধু খাতা-কলমে পরীক্ষার ভেতর দিয়ে ওইসব দক্ষতা অর্জন করা যায় না। এর জন্য দরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ধারাবাহিক মূল্যায়নের সংস্কৃতি তৈরি করা। একযুগ পরে নতুন শিক্ষাক্রম প্রণীত হয়েছে। ২০২৩ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে। আশা করা যায়, ওই শিক্ষাক্রম সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন হবে এবং একটি অসাম্প্রদায়িক, মানবিক, যুক্তিবাদী, দেশপ্রেমিক ও দক্ষ জনগোষ্ঠীর উত্থান ঘটিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজন্ম লালিত “সোনার বাংলা” বিনির্মাণে আমরা বহুদূর এগিয়ে যেতে পারব।