‘সংবাদ’ শুধু একটি সংবাদপত্র নয়

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

সংবাদ-এর সঙ্গে আমার একটি হার্দিক সম্পর্ক আছে; আমরা সমবয়সী, এবং আমার লেখালেখির শুরু থেকেই সংবাদ ছিল আমার পৃষ্ঠপোষক। গত তিরিশাধিক বছর ধরে প্রতি সকালে প্রথমেই যে কাগজের পাতায় আমি চোখ রাখি, সে কাগজটি হচ্ছে সংবাদ। একটা সময় ছিল, যখন মাঝে মধ্যে আমি সংবাদ অফিসে যেতাম। এর সাহিত্য পাতায় আমি তখন “অলস দিনের হাওয়া” নামে নিয়মিত একটি কলাম লিখি, এবং এ পাতার সম্পাদক আবুল হাসনাত-কে নিজ হাতে কখনো কখনো লেখা পৌঁছে দিতাম। হাসনাত ভাই স্বল্পভাষী মানুষ, কিন্তু লেখালেখিতে তিনি সবসময় উৎসাহ যোগাতেন। একটা কিস্তি বাদ পড়লে ফোনে খবর নিতেন। পরবর্তীতে, কালি ও কলম-এর সম্পাদক হিসেবেও তিনি একইভাবে উৎসাহ যুগিয়েছেন। যাহোক, হাসনাত ভাই-এর কাছে গেলে কোনো কোনো দিন দেখা হতো সংবাদ সম্পাদক বজলুর রহমানের সঙ্গে, অথবা কথা হতো সন্তোষ গুপ্তের সঙ্গে। এ দুই নমস্য সাংবাদিক এখন প্রয়াত। সন্তোষ গুপ্ত আমাকে চিত্রকলা নিয়ে লিখতে উৎসাহ দিতেন। তিনি নিজেও ছিলেন একজন উঁচুদরের চিত্র সমালোচক। সংবাদ অফিসে আরো দেখা হতো সাবেক ভারপ্রাপ্ত মনিরুজ্জামান এবং সোহরাব হাসানের সঙ্গে, যিনি এখন প্রথম আলোয় কর্মরত। অনেক গল্প হতো তাদের সঙ্গে, কিন্তু পেছন দৃষ্টিতে এখন মনে হয়, আমি যে একসময় রাজনৈতিক কলাম লেখা শুরু করি, যদিও খুবই অনিয়মিত ভাবে, তার পেছনে হয়তো তাঁদের অনুপ্রেরণা ছিল। সংবাদ-এ গাছপাথর নামে নিয়মিত একটি রাজনৈতিক কলাম লিখতেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। এমন চিন্তাশীল এবং সুলিখিত কলাম পড়ার সৌভাগ্য এখন আর তেমন একটা হয় না। এই কাগজের সম্পাদকীয়তে, সংবাদ ও রাজনীতি বিশ্লেষণে, সাহিত্য পাতায়, বিভিন্ন ফিচারে যে বিষয়গুলি ঘুরেফিরে আসে সেগুলি হচ্ছে, দেশ, মাটি, সংস্কৃতি, জনমানুষ এবং রাজনীতি নিয়ে কিছু আদর্শ চিন্তা; মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি অগাধ বিশ্বাস, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা প্রান্তিক মানুষজনের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা এবং নারীর ক্ষমতায়ন, সংখ্যালঘু ও আদিবাসী গোষ্ঠীগুলির উন্নয়নের জন্য আপ্রাণ প্রয়াস। আমি আনন্দিত যে, এত বছর পরও সংবাদ তার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়নি। সংবাদ-এর ভাবনার কেন্দ্রে যে বিষয়টি একটি জায়গা করে নিয়েছে তা হচ্ছে একুশ শতকে বাঙালি সংস্কৃতির রূপ। এ নিয়েই আজকের নিবন্ধ।

২.

বছর কয়েক আগে বাংলা একাডেমিতে একটি সেমিনার হয়েছিল, যার বিষয়বস্তু ছিল একুশ শতকের সাহিত্য-ভাবনা। শতাব্দীর (এবং সহস্রাব্দের) শেষ প্রন্তে দাঁড়িয়ে আগামী শতাব্দীকে (এবং সহস্রাব্দকে) আমরা কীভাবে দেখব, বিশেষ করে বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্যের আলোকে- এ সম্পর্কে আমন্ত্রিত অতিথিদের বক্তব্য রাখার আহ্বান জানানো হয়েছিল। অতিথিদের মধ্যে ছিলেন মহাশ্বেতা দেবী। তিনি এই বিষয়টি নির্বাচন করায় বিরক্ত হয়েছিলেন। সেমিনারটি সাজানো হয়েছিল একটি কলোকুইয়ামের আদলে- অংশগ্রহণকারীরা নিজ নিজ বক্তব্য দিয়েছিলেন, একে অন্যকে প্রশ্ন করেছিলেন এবং প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন। সেমিনারটির সঞ্চালনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল আমাকে এবং এ দায়িত্ব নিয়ে আমি পড়েছিলাম বিপাকে। মহাশ্বেতা দেবী বলেছিলেন, দু’তিন বছরে সাহিত্যে এমন কী পালাবদল ঘটবে যে, মানুষকে মুখিয়ে থাকতে হবে একুশ শতকের জন্য। দশক-শতকের এই ব্যাপারটা অনেকটাই মনস্তাত্ত্বিক। বিষয়টি পছন্দ না হলেও মহাশ্বেতা দেবী সাহিত্যের আশা-আকাক্সক্ষা নিয়ে কিছু কথা বলেছিলেন, যদিও ভবিষ্যৎ-দর্শনে তাঁর অনীহা থেকে মূল বিষয়টিকে তিনি পাশ কাটিয়ে গিয়েছিলেন। মহাশ্বেতা দেবীর মতো আমিও বিশ্বাস করি, ‘শতাব্দী-শেষ’ বা শতাব্দী-শুরু’র ব্যাপারটা যতটা না ঘড়ি আর পঞ্জিকার সঙ্গে স¤পর্কিত, তার থেকে বেশি মনস্তত্ত্বের সঙ্গে।

এই যে নতুন সহস্রাব্দ নিয়ে মহা হৈ চৈ শুরু হয়ে গিয়েছিল, সেটিও মৌলিকভাবে মানসিক। একুশ শতকের উদয় হয়েছে সূর্যের মতো, ঘড়ির সময় মেনে। কিন্তু এতে নিশ্চয় সৃষ্টি ওলট-পালট হয়ে যাবে না; এসময় বদলে যাবে না পৃথিবীর অথবা মানুষের চেহারা। বস্তুত ক¤িপউটারের ‘ওয়াইটুকে’ সমস্যা ছাড়া আর কোনো বড় ঢেউ ওঠার কথা নয় সময়ের সরোবরে। ক¤িপউটার অচল হয়ে যেতে পারে তৃতীয় সহস্রাব্দের প্রথম প্রহরে-এরকম আশঙ্কার কথা একসময় খুব শুনেছি আমরা। এখন শুনছি সেই আশঙ্কাও অমূলক। অর্থাৎ সময় সরোবরে ওই একটা ঢেউও মিলিয়ে যাওয়ার পথে। তাহলে নতুন শতাব্দী সহস্রাব্দ নিয়ে এত উত্তেজনা, এত শঙ্কা প্রত্যাশা কেন ছিল, এখনো আছে? বাংলা একাডেমির ওই সেমিনারে আমার নিজের অবস্থানটি ব্যাখ্যা করার একটা সুযোগ এসেছিল সমাপনী বক্তব্য দেয়ার সময়। আমি বলেছিলাম, আগামী শতক নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা আর কাচের গোলকে ভবিষ্যৎ দেখাটা এক জিনিস নয়। আগামী শতাব্দীতে সাহিত্য কেমন হবে তার উত্তর জ্যেতিষীরা এরকম দেবেন, আর সাহিত্যিকও সহিত্যতাত্ত্বিকরা দেবেন অন্যভাবে। আগামী শতাব্দী বলতে আসলে কিছু নেই; যে সময় ভবিষ্যতের গর্ভে লুকিয়ে আছে, তার কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নেই। আমাদের শুধু আছে বর্তমান এবং অতীত। বর্তমানটা খুবই ক্ষণস্থায়ী। অতীতটা ক্রমাগত স্ফীত হয়ে খসে পড়ে বর্তমানকে ধারণ করতে করতে। কাজেই অতীত আর বর্তমানকে বিশ্লেষণ করে সাহিত্যের চিন্তাপ্রবণতাগুলো কী রূপ নিতে পারে দু-দশ বছর পর, এ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করাটা দোষের কিছু নয়। আমার মনে আছে, সত্তরের দশকের শেষদিকে বিনির্মাণবাদী দুই তাত্ত্বিক পল ডি ম্যান অর স্ট্যানলি ফিশের বক্তৃতা শোনার সুযোগ হয়েছিল। সাহিত্যতত্ত্বে তখন কাঠামোবাদী চিন্তা-ভাবনাকে সরিয়ে উক্ত-কাঠামোবাদী আর বিনির্মাণবাদী চিন্তা ঢুকে পড়েছে যদিও আমি ততটা অবহিত ছিলাম না এসব ব্যাপারে। আমরা যে সাহিত্য-সমালোচনা শিখেছি, তা প্রবলভাবে নিউ-ক্রিটিসিজম প্রভাবিত; যেসব নামকরা সাহিত্য-সমালোচকের বই আমরা পড়েছি, তারা প্রায় সবাই নিউ-ক্রিটিক। এই অবস্থায় কাঠামোবাদ পর্যন্ত কেবল পৌঁছানো গেছে। ডি ম্যান আর ফিশ এক লাফে বিনির্মাণবাদের বারান্দায় আমাদের তুলে দিতে চেয়েছেন।

ডি ম্যান এবং ফিশকে সেই সময় যত অপরিচিত এবং ভিনগ্রহীই মনে হয়ে থাক না কেন, তাদের কথার যুক্তিকে অস্বীকার করতে পারিনি। আমার সবচেয়ে অবাক লেগেছিল, আগামী ২০ বছরে সাহিত্যতত্ত্ব কী রূপ ধারণ করতে পারে, এই দু’জন-বিশেষ করে ফিশ তার একটি চমৎকার ছবি আমাদের সামনে তুলে ধরছিলেন। এই বিষয়টি আমি পরে অনেক সহিত্যতাত্ত্বিকের লেখায় পেয়েছি। মেশেল ফুকো তার ম্যাডনেস অ্যান্ড সিভিলাইজেশন (১৯৭০) গ্রন্থে পাগলামোর ইতিহাস বর্ণনা শুরু করেছেন মধ্যযুগ থেকে এবং বর্তমান ও আগামীতেও মানসিক বৈকল্যকে কী দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে এবং হবে, তার একটা স্বচ্ছ ধারণা দিয়েছেন। তারা কেউ কাঁচের গোলক বা ডেলফিক ওর‌্যাকল থেকে ধারণা নেননি। বর্তমানের প্রবণতাগুলো ভালোভাবে বুঝতে পারলে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ধারণা করাটা মোটেই কঠিন নয়, কারণ ভবিষ্যৎ বলতে যা বুঝি আমরা তা বর্তমানেরই শেষ মাথায় দাঁড়ানো একটা সময়চৌকাঠ মাত্র। তবে দুঃখজনক বিষয়টি হলো, ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলতে গেলে আমরা মাঝে মাঝেই জ্যোতিষী হয়ে যাই। এমনকি যুক্তি ও বিজ্ঞানভিত্তিক যে মার্কস্বাদ, তার চর্চা যারা করেছেন আমাদের দেশে, তারাও দেখি মাঝে মাঝে এরকম বক্তব্য দিয়ে তাদের সমাজ বিশ্লেষণমূলক লেখা শেষ করেছেন। এই কিছুদিন আগেও ‘এমন একদিন আসবে, যেদিন সর্বহারারা জেগে উঠবে’ ইত্যাদি। সর্বহারারা জাগছে কিনা সেটাই প্রশ্ন। এমনকি সর্বহারাদের ঘুম ভাঙার সামান্য শব্দ তাদের চৌকিতে, ভোরের রসায়নে, সুপ্তিতারল্যের সামান্য ক¤পন, এসবও যদি শুনি, তাহলে বলতে পারি, তারা জাগবে। কিন্তু সেই শব্দ, সেই চিহ্ন কোথায় আমাদের দেশে, কোথায় ছিল গর্বাচভের গ্লাসনস্তের আর পেরেস্পৈকার প্রবল ঝঞ্ঝার আগে? সর্বহারাদের ঘুমের ভেতরে পুঁজিবাদের ইথার যে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই অথবা তারো আগে থেকেই সে কথাটা মার্কসবাদী তাত্ত্বিক-প্রোফেটরা বুঝতেই কি পারেননি, নাকি গলদ ছিল তাদের সমকাল দর্শনে? কে জানে! সর্বহারারা জাগলে এই মনুষ্যত্ববিহীন দেশে একটা মনুষ্যত্বসমৃদ্ধ যুগের সূচনা হতো, ন্যায় ও শ্রেয়োবোধ উদ্ধার পেত; সেটা তো বুঝতে কারো কষ্ট হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তার সম্ভাবনা কতটুকু? এই কথাটা ভাবলে আফসোস হয়; কিন্তু এও তো জানি, পুঁজি আর পণ্যের প্রবল আক্রমণে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছে শ্রেয়োচিন্তা আর নীতিদর্শনের সূত্রগুলো। সংস্কৃতিও আক্রান্ত হচ্ছে পণ্যরোগে। আগামীতে কী হতে পারে সমাজ ও সংস্কৃতির রূপ, বর্তমানের এই লণ্ডভণ্ড অবস্থা দেখে তা কিছু আঁচ করা যায় বৈকি।

একুশ শতকের সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে পুঁজির সম্প্রসারণ ও পণ্যায়ন এবং প্রচলিত নীতিচিন্তা ও শ্রেয়োবোধের ক্ষয়ের কথাগুলো মনে রাখতে হবে। এই সঙ্গে মানুষের চিন্তার জগতে যেসব পরিবর্তন ঘটছে, কাল ও সমাজ-দর্শনে যেসব প্রবণতা প্রধান হচ্ছে, অথবা গুরুত্ব পাচ্ছে, সেগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে। সংস্কৃতি একটি সমাজের নান্দনিকের পরিচয় শুধু নয়; সমাজের কাঠামো, সমাজের অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি, ধর্ম এবং কল্পনার পরিশীলিত একটি রূপ হিসেবে দেখতে আমরা অভ্যস্ত, কিন্তু সংস্কৃতি অনেক সময় আড়াল করে রাখে সমাজের নানা অপব্যবস্থাকে। আফ্রিকায় বালিকা ও নারীদের যোনিচ্ছেদ সে সমাজের সংস্কৃতির অঙ্গ বাংলাদেশে পতিঅন্ত, সেবাপরায়ণ, সহনশীল নারীদের প্রশংসা গানে আর প্রবাদে মানুষের মুখে মুখে। নারীদের পুরুষের অধীনস্থ করে রাখার কৌশলে ব্যবহৃত হয়েছে সংস্কৃতি এবং সংস্কৃতির চর্চায় এই চিন্তা লাভ করেছে প্রবন্ধকার। সংস্কৃতির আর একটি দিক ও আছে- কর্তৃত্বের কাছে আত্মসমর্পণ, প্রান্তের ওপর কেন্দ্রের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা, প্রাতিষ্ঠানিক বিশ্বাস (যাতে অনেক অন্ধ ধর্মবিশ্বাসও অন্তর্ভুক্ত) ও প্রচলকে শাশ্বত বলে মান্য করা, এরকম বিষয়গুলো নির্বিচারে গ্রহণ করতে উৎসাহিত করে সেই অন্ধকার সংস্কৃতি। সংস্কৃতির একটি আদর্শিক রূপও আমরা মাঝে মাঝে তৈরি করে ফেলি, যাতে শুদ্ধ নান্দনিকতার একটা প্রকাশ দেখতে আগ্রহান্বিত হই আমরা। যে-সংস্কৃতি চর্চা ওই আদর্শিকতা থেকে দূরে থাকে অথবা এর সাথে আমরা প্রশ্ন করি না। যেমন, একটি মেয়ে তার ঘরে বসে একটি ছেলের জন্য এবং একটি ছেলে তার ঘরে বসে একটি মেয়ের জন্য অশ্রুপাত করলে সমাজের ক্ষতি হয় না। এই আচরণকে ‘সামাজিক’ বলে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু ছেলেটি একটি নির্জন জায়গায় মেয়েটিকে পাশে বসিয়ে কথা বললে কাজটি হয়ে যায় ‘অসামাজিক’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মাঝে মাঝেই সন্ধ্যা বেলায় এরকম ‘অসামাজিক’ কার্যক্রম বন্ধে উঠে পড়ে লাগেন, অথচ অস্ত্র পকেটে নিয়ে মাস্তানি করে বেড়ায় যেসব ক্যাডার তারা সবই ‘সামাজিক’। পত্রিকার পাতা খুলেও দেখা যায়, স্বামীকে খুন করেছে- এমন মেয়েদের বিদ্যুৎ বেগে পাকড়াও করে পুলিশ কিন্তু স্ত্রীকে মেরে দিব্যি পুলিশের নাকের ডগায় ঘুরে বেড়ায় স্বামী। তাকে কে ধরবে?

প্রভাবশালী মহলের মেয়েদের জন্য তদ্বির করে না, করে পুরুষদের জন্য। পুরুষ শাসিত সমাজ নারীর উত্থানে অরক্ষিত হয়ে পড়ে, অথবা অরক্ষিত হওয়ার ভয়ে ভীত হয়।

অথচ সমাজ বলছে একটি মেয়েকে- পড়, স্কুলে যাও, চাকরি কর। অর্থাৎ সবই কর, বিশেষ করে আয়-উপার্জন করো, কিন্তু ‘অসামাজিক’ হয়ো না। ‘অসামাজিক’ অর্থাৎ সমাজের ঋজু নর্মগুলো থেকে স্খলিত হলে চলবে না। আমাদের সংস্কৃতিও এই আনুগত্য প্রকাশকে সমর্থন করে। কিন্তু পুরুষ শাসিত সমাজ যেমন তার পূর্ণাধিপত্য হারাচ্ছে ধীর ধীরে- এর লক্ষণগুলো আমরা চিহ্নিত করতে পারি (সন্তান পালনে বাবার অধিকাংশ অংশগ্রহণ- স্ত্রীর আয়-উপার্জনে স্বামীর আস্থা জ্ঞাপন, নির্ভরতা এখনো ততটা না এলেও, ইত্যাদি), আমাদের সংস্কৃতিতেও এই আধিপত্যের বিষয়টি তরল হতে শুরু করেছে। এর একটি কারণ, সমাজের মৌল কাঠামোতে পরিবর্তন এবং শিক্ষাব্যবস্থার সার্বজনীনকরণ। কিন্তু অন্য একটি কারণ নিহিত রয়েছে ওই পণ্যের প্রসারে। পণ্য পুরুষ-নারী বিভাজনে যায় না। নারীকে সে প্রয়োজনে ব্যবহার করে, কিন্তু তা কোনো আদর্শ চিন্তা থেকে নয়, বরং উপযোগিতার চিন্তা থেকে। পণ্যের প্রসারের জন্য নারীর সহযোগিতা প্রয়োজন, সংস্কৃতির পণ্যায়নেও তাই নারীর একটি ভূমিকা থাকবে, আছেও। সেটি যে ভবিষ্যতে আরো প্রবল হবে, সে কথা একটুখানি ভাবলেই বলা যাবে। আধুনিকতা, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের সংস্কৃতিতে গতিশীল করেছে সন্দেহ নেই; আধুনিকতা একটি বিশ্লেষী এবং শেষ বিচারে বিমূর্তবাদী চেতনার নাম: এর প্রকাশ অনেক ক্ষেত্রেই অন্তর্মুখী। কিন্তু আধুনিকতার তুঙ্গ সময়ে, যাকে পশ্চিমে ‘হাই মডার্নিজম’ বলে আখ্যায়িত করা হয়, এই প্রবণতাগুলোই বেশ ঋজুতা নিয়ে দেখা দিয়েছিল। সাহিত্যে ও সংস্কৃতিতে একটি কেন্দ্রিকতার প্রয়াস দেখা গেছে; বিশ্লেষণ ভিত্তি খুঁজেছে তত্ত্বের। বিমূর্তায়ন একটা নর্ম হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছে এলিয়ট দি ওয়েস্ট ল্যান্ড’ লিখেছেন, কিন্তু কবিতাটি সাজিয়েছেন এক এপিকের কাঠামোয় (এপিকের মতোই কবিতার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রয়েছে একটি অন্বেষণ, নিছক অর্থে অনুসন্ধানী ভ্রমণ); এ কবিতারও একজন ‘নায়ক’ তৈরি হয়, এবং যত বিচ্ছিন্নতার হোক তার বয়ানটি একটা ‘গ্রান্ড’ ন্যারেটিভের আদলে অগ্রসর হতে থাকে। আধুনিক স্থপতিরা (লে কর্বুসিয়ের যাদের গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিনিধি) গ্রান্ড ন্যারেটিভের নমুনায় দালান বানিয়েছে- কাচও কংক্রিটের, বাক্সের আকৃতির, আকাশ ফুঁড়ে যে উঠেছে এবং পরিবেশকে শাসন করেছে। কর্বুসিয়েরের একটি স্লোগান ছিল এরকম, ‘নিয়মের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা আনো।’ সেন্ট লুইর একটি আবাসিক এলাকার স্থাপত্য পরিকল্পনাতেও কর্বুসিয়ের এই নিয়ম যুক্তিযুক্ততার প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। তার স্থাপত্য তাই মানুষের জন্য হলেও দাঁড়াল। ১৯৭২ সালের কোনো এক দিনে এই দালানগুলো গুঁড়িয়ে দেয়া হলো। বলা হলো, উত্তর-আধুনিকতার সূত্রপাত সেদিন থেকেই। এটি একটি কথার কথা মাত্র। কিন্তু হাই মডার্নিজম যে অন্তর্মুখিতার নামে অহঙ্কারী এবং বিশ্লেষীর আবরণে মতবাদপ্রচারী হয়ে দাঁড়িয়েছিল, এটি তো সত্য। উত্তর-আধুনিকতা এইসব ঋজুতা, কেন্দ্রিকতা, নির্দিষ্টতা এবং ইহাব হাসান কথিত hierarchy, mastery/logos-এর বিপরীতে স্থিতিস্থাপকতা, প্রান্তিকতা, অনির্দিষ্ট এবং exhaustion/silence গুরুত্ব দিয়েছে। একুশ শতকের শুরুতে এমনকি আমাদের সংস্কৃতিতেও, এর প্রকাশ দেখা দিচ্ছে।

একটি ছোট উদাহরণ দিয়ে শুরু করা যাক। বেশ কয়েক বছর আগে ‘ঢাকা’ নামের ব্যান্ড দলের প্রধান গায়ক মাকসুদ (আগে সে অন্য একটি দলে ছিল) রবীন্দ্রনাথের একটি গানের ‘বিকৃত পরিবেশনা’র দায়ে নিন্দিত হলো। নিন্দা যারা জানিয়েছেন, তারা সকলেই শুদ্ধবাদী; তারা বিশ্বাস করেন, রবীন্দ্রনাথের গানের সুর বিকৃত করা বা বিশ্বভারতী সঙ্গীত সমিতি অনুমোদিত সুরের বাইরে গিয়ে গান করাটা নিতান্ত অনুচিত। মাকসুদের পক্ষেও অনেকে লিখেছেন, তারা ‘বিদ্রোহ’কে সমর্থন করেছেন। তারা যুক্তি দেখিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথের গান ভিন্নভাবে গাইলে এর ভেতরে বৈচিত্র্যকেই তুলে ধরা হয়। রবীন্দ্রনাথকে ধরাছোঁয়া যাবে না- এই যুক্তি তারা মানতে রাজি নন। আমি উভয়পক্ষের যুক্তি মন দিয়ে পড়ে দেখেছি, কিন্তু যেহেতু সঙ্গীতে আমার বিন্দুমাত্র অধিকার নেই, সেজন্য এই বিতর্কে দর্শকের ভূমিকাই পালন করেছি। কিন্তু বিষয়টি উত্তর আধুনিকতার দৃষ্টিতে দেখলে একটি অনিবার্যতার সন্ধান তাতে পাওয়া যায়। মাকসুদ ভালো করেছে না মন্দ করেছে- সেই বিচারে না গিয়েও বলা যায়, মাকসুদের ‘ক্রিয়া’টি ছিল একটি ‘প্রতিক্রিয়া’। মাকসুদকে আমি চিনি, তার ভেতরে নতুন কিছু করার যে একটি তাগিদ আছে, আমি তা দেখেছি। হয়তো তার পরিবেশনাটা ভালো হয়নি, ঘাটতি ছিল সুরে এবং/অথবা সৌন্দর্যে। কিন্তু মাকসুদ যে একটি বার্তা দিচ্ছে আমাদের, তাকে কেন অস্বীকার করব? এই বার্তা নান্দনিক হয়নি বলে এর চিন্তাকে অবহেলা কেন করব? রবীন্দ্রসঙ্গীত আমাদের হাই মডার্নিস্টদের হাতে একটি রিচ্যুয়াল যে হয়ে দাঁড়িয়েছে, এ বিষয়টা আমি নিজেও দেখেছি। কুড়ি বছর আগে অক্সফোর্ডে নীরদ চন্দ্র চৌধুরীর সঙ্গে আমি দেখা করেছিলাম। কথা প্রসঙ্গে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ কতগুলো গান লিখেছেন? আমি চিন্তাভাবনা করে বলেছিলাম তা প্রায় হাজার চারেক। নীরদ চৌধুরী একটি স্কুলছাত্রের মতো দুষ্টুমিভরা হাসি হেসে বলেছিলাম, না ভুল বললেন। রবীন্দ্রনাথ গান লিখেছিলেন ২৯৬টি। বিশ্বাস না হলে বাজারে রবীন্দ্রসঙ্গীতের যত রেকর্ড-ক্যাসেট পাওয়া যায়, সেগুলো সংগ্রহ করে একটি তালিকা করুন। ওই ২৯৬টি হবে। এগুলোই সবাই গান, আগামীতেও গাইবেন। ২৯৭ নম্বর গান যেদিন বাজারে আসবে, আমাকে জানাবেন, আমি সানন্দে সংগ্রহ করব।

রিচ্যুয়ালের সমস্যা এবং শক্তি হলো এর পৌনঃপুনিকতা। তাছাড়া দুই বাংলা রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভাষা ইতিমধ্যে একটি ঋজু রিচ্যুয়াল ভাষায় পরিণত হয়েছে, যা ভাবকেও রুদ্ধ করে। কিছুদিন আগে পশ্চিমবাংলার এক প্রতিষ্ঠিত গায়িকার গলায় ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে’ গানটি শুনলাম। শুনে মনে হলো, আজ আমাদের ছুটি হয়েছে যেন একটা কারাগার থেকে অন্য কারাগারে যাওয়ার জন্য, মাত্র পাঁচ মিনিট। গানটির ব্যাকরণ ঠিক আছে, স্বরলিপিও নিখুঁত। কিন্তু গানটির রিচ্যুয়ালাইজড হয়ে যাওয়ায় এর ভাবের রাজ্যে জমেছে জগতের কাঠিন্য। একটি খুশির অনুভূতি তাই পরিণত এক কষ্টকর, অনিশ্চিত অনুভূতিতে। মাকসুদের বিপক্ষে সমালোচনাতেও আমি লক্ষ করলাম অসহিষ্ণুতা এবং কেন্দ্রিকতা। মাকসুদের গানটি আমার ভালো লাগেনি, কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম, সে রবীন্দ্রসঙ্গীতের কোনো ক্ষতি করতে চাইছে না; শুধু চাইছে এর কেন্দ্রিকতা, এর রিচ্যুয়ালাইজেশন, এর hierarchical কাঠামো এবং ঋজুতার বিপরীতের ভিন্ন কিছু চিন্তার সমাবেশ ঘটাতে। এ বিষয়টি যারা রবীন্দ্রসঙ্গীতের নিয়মিত চর্চা করেন, তাদের জন্য একটি উপকারী বার্তা হতে পারে। এই বার্তা গ্রহণ করে গান গাইলে মেঘের কোলে রোদ সত্যি সত্যি হেসে উঠত। উল্লিখিত প্রবণতায় আমি দোষ-গুণের প্রকাশ দেখার পরিবর্তে এক ধরনের অনিবার্যতা দেখি। বিশ্বজুড়ে এমনটি ঘটছে। এমটিভিতে একালের জনপ্রিয় হিন্দি গানগুলোর রিমিক্স প্রচারে একটা হিড়িক পড়েছে দেখতে পাচ্ছি। শেক্সপিয়ারের রোমিও এন্ড জুলিয়েট নাটকটির এক সাম্প্রতিক চলচ্চিত্রায়নে দুই পরিবারকে দেখানো হয়েছে আমাদের সময়ের দুই মাফিয়া পরিবার হিসেবে, ডিউককে দেখানো হয়েছে কৃষ্ণকায় এক পুলিশ চিফ হিসেবে- যিনি হেলিকপ্টারে চড়ে সংঘর্ষে লিপ্ত দুই পরিবারের ভাড়া করা সশস্ত্র মাস্তানদের পাকড়াও করার অভিযানে নামেন। ছবিটি দেখে কোথাও মনে হয়নি, শেক্সপিয়ার ভূলুণ্ঠিত হচ্ছেন। এই আয়রনি, এই কৌতুক এবং আত্মবিশ্লেষী দৃষ্টিভঙ্গি, এই pastiche এসবই আমাদের সময়ের রবীন্দ্রনাথ ও শেক্সপিয়ারকে অথবা অন্য কোনো লেখক-শিল্পীকে এসবের পরিপ্রেক্ষিতে দেখা হবে। তাতে হাই মর্ডানিজম-নির্দিষ্ট মূল ধারাটি বিপর্যস্ত অথবা বাতিল হয়ে যাবে না। বরং ভিন্ন কিছু কোণ থেকে তাদের ওপর আলো ফেলার জন্য তাদের কিছুটা নতুন- অন্তরঙ্গভাবে চেনা যাবে। এখানে মাকসুদ অথবা রোমিও এন্ড জুলিয়েট-এর পরিচালক গুরুত্বপূর্ণ নন, গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নতুন করে দেখার দৃষ্টি। এটি সময়ের তৈরি। চিত্রকলা সিনেমা ফটোগ্রাফি এবং নৃত্যে এটি ঘটছে। এমনকি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতেও নুসরাত ফতেহ আলী খান উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সঙ্গে রক মিউজিক, এমনকি র‌্যাপের সংযোজন ঘটিয়ে যে বাজার মাত করেছিলেন, তাতে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হয়নি, বরং বিশাল এক তরুণ গোষ্ঠীর কাছে এর জনপ্রিয়তা নিশ্চিত হয়েছিল।

একুশ শতকের তৃতীয় দশকে দাঁড়িয়ে পেছন দৃষ্টিতে আমাদের সংস্কৃতিকে খুঁটিয়ে দেখলে এই কথাটি নিশ্চিত করে বলা যায়, এই শতাব্দীর অন্তত কিছুকাল হাই মর্ডানিজমের রিচ্যুয়াল থেকে উত্তর-আধুনিক আন্তরিকতার দিকে যাবে সংস্কৃতির অনেক ফর্ম। তাতে এক সময় এই ফর্মের প্রকাশেও রিচ্যুয়াল জমা হতে পারে- সেটাই স্বাভাবিক। তখন প্রতিক্রিয়া হিসেবে হয়তো রিচ্যুয়ালহীনতার ভিন্ন একটি প্রকাশ খুঁজে নেবে মানুষ এবং খুঁজতেই হাই মডার্নিজমের রিচ্যুয়ালকেও কিছুদিনের জন্য ভালো লেগে যেতে পারে তাদের। তবে এ কথাটা ঠিক যে সংস্কৃতির রক্ষণশীলতা আক্রান্ত হবে; যে-প্রকাশের অন্তর্নিহিত শক্তি আছে, যা মেকি নয় অথবা যা মানুষের সামষ্টিক অংশগ্রহণে উৎপাদিত, তা যদি আপাত-রক্ষণশীল বলে মনে হয়, তার বিপর্যয় ঘটবে না। কিন্তু এলিট কালচার নিজের প্রয়োজনে যাকে রক্ষণশীলতার আবরণে ঢেকে দেখেছে, তা আরক্ষিত হয়ে পড়বে। আমাদের ভাষায় প্রসঙ্গটি এখানে উত্থাপন করা যায়। এলিট ও সাবঅল্টার্নের দুই আলাদা ভাষা বাংলাদেশে। সাবঅল্টার্নের কোনো কণ্ঠস্বর নেই- এ রকম কথা গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের মতো মানুষেরা বললেও, এ বলার পেছনের প্যাট্রনসুলভ চিন্তাটি আসলে এলিটেরই মনের কথা। সাবঅল্টার্নের অবশ্যই ভাষা আছে, তবে তার বিন্যাস এবং এই সিমেওটিকস এলিটের ভাষা থেকে স্বতন্ত্র। এ রকম তাত্ত্বিক স্বাতন্ত্র্য ছাড়াও সাবঅল্টার্নের প্রতিদিনের যে ভাষা আছে, যাকে প্রয়োগিক ভাষা বলা যায়, তার বিকাশটি খুবই ঘটনাবহুল। এলিট চেয়েছে সাবঅল্টার্ন তার ভাষা ভুলে এলিটের আরোপিত ভাষায় কথা বলুক- সে ভাষায় একটি বালক-এলিটও ‘আপনি’ সম্বোধিত হয় এবং এ ভাষায় দেওয়া আদেশগুলো দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য হয়ে পড়ে। অতএব আদেশ-নির্দেশও সে ভাষায় বেশি। কিন্তু সাবঅল্টার্ন সে-ভাষা শিক্ষাকে একদিন এলিটের ওপর টেবিল উল্টে দিয়েছে, যেমন ক্যালিবান দিয়েছিল প্রসপেরোর ওপর, শেক্সপিয়রের দি টে¤েপস্ট নাটকে। প্রসপেরো ক্যালিবানকে তার নিজস্ব ভাষা ভুলিয়ে শিখিয়েছিল এলিট ভাষা। একসময় ক্যালিবান সে ভাষায় গাল দেয়, অভিশাপ দেয় প্রসপেরোকে। আমরা যে-বাংলা ভাষায় প্রতিদিন কথা বলি, সেটি সাবঅল্টার্ন ভাষা। আমাদের অবচেতনে সাবঅল্টার্নে সাংস্কৃতিক প্রকাশগুলো ধরতে চাই আমরা, কারণ নৃতাত্বিক ভৌগোলিক বিচারে আমরা মাত্র দুই/তিন প্রজন্মের আধা-পাকা এলিট মাত্র। শিকড় আমাদের গ্রামে। আমাদের ভাষা এই সাবঅল্টার্ন-বিলাসের একটা প্রকাশ। ‘যাবা-খাবা’ ভাষাটি এখন বড়ই মধুর। এই ভাষাটি আরো পরিব্যাপ্ত হবে আগামী শতাব্দীতে, হয়তো এটিই হয়ে দাঁড়াবে ‘প্রমিত ভাষা।’

কয়েকটি জিনিস একুশ শতকের সংস্কৃতিকে মৌলিকভাবে প্রভাবিত করবে- মিডিয়ার, বিশেষ করে ইলেকট্রনিকস মিডিয়ার (যাতে কমিপউটার/ওয়েব-ইন্টারনেট কালচার এবং স্যাটেলাইট যোগাযোগ অন্তভুক্ত) ব্যাপ্তি এবং সর্বগ্রাসিতা; পণ্যসংস্কৃতির প্রসার, যার ফলে নিশ্চিত হবে সংস্কৃতির পণ্যায়ন ও ভোক্তা-সংস্কৃতির বহুল প্রসার; শিক্ষার বিস্তার, বিশেষ করে ২০২৫ সাল নাগাদ অর্জিতব্য একশ ভাগ নারী শিক্ষার হার, গ্রাম ও শহরের সীমানার অবলুপ্তি; গণতন্ত্র ও গণতন্ত্রের গেট কিপারদের শক্তিবৃদ্ধি; সামাজিক অস্থিরতা, সংঘাত ও অন্যান্য অস্থিতিশীল কারী অবস্থার বুদ্ধি; কর্মক্ষেত্রে ব্যাপক হারে নারীর প্রবেশ; রক্ষণশীলতা ও উগ্রবাদের ধ্বজাধারীদের সমাবেশ। এর সঙ্গে আরো যুক্ত হবে বিদেশের সঙ্গে তাৎক্ষণিক যোগাযোগের ব্যাপক সুবিধা; সংস্কৃতি ও অর্থনীতির বিশ্বায়নের প্রভাব; পরিবেশের দ্রুত এবং অমেরুযোগ্য বিনাশ, নারী-পুরুষের বর্তমান ‘অসামাজিক, মেলামেশার সুযোগ বৃদ্ধি ইত্যাদি। সংস্কৃতি এসব সূচকের ওপর অনেকখানিই নির্ভরশীল, কাজেই আগামী শতাব্দীর সংস্কৃতিতে এগুলোর প্রভাবে নানাবিধ স্রোতের সৃষ্টি হবে, যার অনেকগুলো হতে পারে একে অন্যের বিপরীত।

বর্তমান প্রবণতাগুলো লক্ষ্য করলে বলা যায়, যে সাবঅল্টার্ন সংস্কৃতির কথা বলা হয়েছে একটু আগে, তার অধিষ্ঠান যে ঘটবে ভবিষ্যতে, তা বলা সম্ভব মানুষের মনস্তত্ত্বের একটি সূত্র ধরে- তার নস্টালজিয়া এবং আর্কেডিয়া-চিন্তার কথা মনে রেখে। বাংলাদেশের মানুষ শহর গড়েছে দুই প্রজন্ম আগে; এখনো শহরগুলো বড় বড় গ্রাম মাত্র বাংলাদেশের এলিটও অতি ক্ষুদ্র একটি অনুদল। যতই প্রয়াস থাকুক এলিট অবস্থানের দিকে, নস্টালজিয়াকে আটকে রাখা যায় না। লোকজন ফর্মগুলো সংস্কৃতির ভেতরে শক্তি সঞ্চার করতে থাকবে এই কারণে। আর উত্তর-আধুনিক উপাদানগুলো আমাদের সংস্কৃতিতে কেউ ইচ্ছে করে আনেনি, সেটি সম্ভবও নয়। কেউ ইচ্ছে করলেই উত্তর-আধুনিক হতে পারে না; এটি কিছু প্রবণতার নাম যার অনেকগুলো আসে প্রতিক্রিয়া হিসেবে। আমাদের সংস্কৃতিতে এই প্রতিক্রিয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। হাসি ও কৌতুক এবং লঘুত্ব, রঙের প্রব্য, কেন্দ্রকে অস্বীকার করার প্রবণতা, আত্মকৌতুক ও বিদ্রুপ এসবের উপস্থিতি লক্ষণীয় আমাদের সংস্কৃতির নানা প্রকাশে। যখন সংস্কৃতির কোনো প্রকাশ ঋজু হয়ে যায়, তখন ভেতর থেকে প্রতিরোধ আসে। ঋজুতা যদি আসে গম্ভীর উদ্দেশ্যপরায়ণতা থেকে, তাহলে স্থিতিস্থাপকতা তৈরি হয় উদ্দেশ্যহীন লঘুত্ব থেকে। আমাদের ব্যান্ড সঙ্গীতের একটি অবসেসিভ বিষয় বস্তু আছে- প্রেম। কিন্তু এই প্রেম নিজে থেকেই লঘুত্বের দিকে গেছে। ব্যান্ড গানে প্রেমের কথা শুনে কেউ অশ্রু জল হয় না। ব্যান্ড গানের ফর্ম লঘুত্বকের বেছে নিয়েছে। তার বিষয় বস্তুতে পড়েছে লঘুত্বের ছায়া। অনিবার্যভাবে।

একুশ শতকে বাংলাদেশের সংস্কৃতি নিয়ে আমার কিছু প্রত্যাশা আছে। প্রথম প্রত্যাশাটি হচ্ছে এর গতিশীলতা নিয়ে। সর্বব্যাপ্ত মিডিয়ার যুগে পণ্যায়নের স্রোতে সংস্কৃতির বহিস্থ প্রকাশটি অনেকটা পাল্টে গেলেও এর মৌল গঠনটি সেই পরিবর্তনকে উপেক্ষা করতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস। বাংলাদেশের সংস্কৃতির বড় অংশটিই সাবঅল্টার্ন- শহুরে এবং শিক্ষিত সমাজ তাতে কিছুটা কসমেটিক সার্জারি করেছে মাত্র। আমাদের চিত্রকলার মুল শিকড় প্রোথিত জনজীবনে- সেখান থেকেই উঠে আসে রঙ, রেখা ও বিষয়বস্তু। এমনকি বিমূর্ত প্রকাশবাদী চিত্রেও বুদ্ধির পাশাপাশি যে ভাবটি সঞ্চারিত হয়, সেটি দেশজ এবং তাতে বাংলাদেশের মাটি, নির্মাণ এবং আকাশের ¯পর্শ আছে। যে বিমূর্ত প্রকাশবাদ পশ্চিমের ‘পরিশীলিত’ ফর্মকে আদর্শ মেনেছে, তার আবেদন আসলেই ফুরিয়েছে। নব্বইয়ে এসে আমরা যে শিখ ও ন্যারেশনের প্রতি নতুন আগ্রহ দেখি চিত্রকলায় তা সাবঅল্টার্ন দর্শনের একটি পরিচয়। আমার বিশ্বাস, মাটির মধ্যে জীবন ও কর্মের যে চঞ্চল্য থাকে আমাদের দেশে এবং কেজো মানুষের- খেটে খাওয়া মানুষের- জীবনের যে গতিশীলতা থাকে তা আরো পরিব্যাপ্ত হবে আমাদের সংস্কৃতিতে। এই গতির প্রয়োজন আছে- আমাদের চলচ্চিত্রে গতি নেই, রাজনীতিতে গতি নেই, যোগাযোগে গতি নেই- আছে গতির নামে কোলাহল এবং দুর্ঘটনার আয়োজন। সুস্থ গতি থাকলে চলচিচত্র জীবনমুখী হতো, রাজনীতি দেশমুখী হতো এবং যোগাযোগ গন্তব্যমুখী হতো। রাজনীতি ও যোগাযোগ সংস্কৃতির বলয়ে পড়ে। পড়তে হয়। অতএব রাজনীতি নিয়েও প্রত্যাশা আছে। রাজনীতি গণমুখী ও দেশমুখী হলে তাতে সুস্থতা এবং তারুণ্যের শক্তি সঞ্চারিত হবে।

একুশ শতকে সংস্কৃতির বিশ্বায়ন ঘটবে- এ কথা আমরা এখনি বলতে পারি। তবে পশ্চিম তার খোলা সংস্কৃতি পণ্যের ঝুড়ি নিয়ে ইতোমধ্যেই যে ঝাঁপিয়ে পড়ছে এবং আচ্ছন্ন করে দিচ্ছে আমাদের স্থানীয় সংস্কৃতিগুলোকে তার দাপট বেশিদিন থাকবে না। পশ্চিমা সংস্কৃতি এখনো একটা নতুনত্বের আকর্ষণ নিয়ে আছে- বিশেষ করে যে পারফরমেন্স-নির্ভর ভিডিওবাহিত সংস্কৃতি এখনো জমজমাট, তার আকর্ষণ (বেতারের মতো) পুরোনো হয়ে যাবে, তখন তরুণেরা দৃষ্টি ফেরাবে উৎপাদনের দিকে। সেই উৎপাদনে অনুকরণ এবং অনুসরণ থাকবে- এখন তো প্রচুর পরিমাণে আছে- কিন্তু এক সময় তা কমে যাবে অথবা একেবারে নতুন কিছু তৈরির তাগিদ আসবে। সেই ‘নতুন’ হবে দেশজ। ভিডিও সংস্কৃতির প্রসারে আমি শঙ্কিত নই। উত্তর-ঔপনিবেশী চিন্তায় যে writing back, †h appropriation এর কথা আছে, তার প্রয়োগ শিগ্গিরই ঘটবে- ভারতের ক্ষেত্রে, সেটি ঘটতে শুরু হয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। সংস্কৃতির দেশজ উপাদানত্ব কোনোদিনই বিচ্ছিন্ন বা অবহেলিত হবে না। তার সংযোজন, সমন্বয় ও প্রকাশের বিষয় কী চিত্রকলা, কী চলচ্চিত্র, কী সঙ্গীতে- একটা অবাক করার মতো নতুনত্বে হাজির হতে পারে। সেই সম্ভাবনাটাই বেশি দেখতে পাচ্ছি আমি।

একুশ শতকে প্রচুর মেধাবী তরুণ কাজে নামবে। এই সৃষ্টিশীল তারুণ্যেই হবে আমাদের বড় সহায়। এই তারুণ্য একদিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে, সংস্কৃতির নতুন দিগন্ত তাকে রাখবে কিন্তু পুরাতনের ঋজুতা, আধিপত্যবাদী কেন্দ্রিকতা এবং প্রাণহীন আচারসর্বস্বতাকে চ্যালেঞ্জ করবে, অন্যদিকে উগ্রবাদী-মৌলবাদী ডিসকোর্সকে অর্থহীন করার সংগ্রামে নামবে। উগ্রবাদী ডিসকোর্সের একটি সমস্যা এই যে, এটি কখনো বদলায় না- এর বিষয়-আশয় পরিবর্তনহীন। এজন্য এর আবেদন একুশ শতকেও সীমাবদ্ধ থাকবে। বস্তুত একুশ শতকে উগ্রপন্থায় প্রশিক্ষণরত একটি যুবকের চারদিকে মিডিয়ার প্রতিমুহূর্তে পরিবর্তনশীল ইমেজের যে জগৎটি থাকবে, তাকে সে অস্বীকার করতে পারবে না। যোগাযোগ- যাকে আমি সংস্কৃতির একটি প্রধান উপাদান হিসেবে দেখি- দ্রুত পরিব্যাপ্ত এবং কার্যকর হবে যে ওই যুবকটি যদি নিতান্ত যুদ্ধে নামার মনোবৃত্তি না দেখাতে পারে, তার জন্য অপরিবর্তনশীল, ধ্বংসাত্মক এবং আত্মঅবমাননাকারী একটি মতবাদের দীর্ঘ এবং অবিচলিত মনোসংযোগ ধরে রাখা কঠিন হবে।

সংস্কৃতির গতিশীলতার পাশাপাশি এর নানা উপাদানের পরিব্যাপ্ত ও আকীর্ণ প্রকাশ জীবনের সঙ্গে সংস্কৃতির স¤পৃক্ততাকে আবার তুলে ধরবে। মঙ্গলজনক হবে এই অর্থে যে, সংস্কৃতি বলতে বর্তমানে আমরা যে শুদ্ধ নান্দনিকতা বুঝি, যা জীবন থেকে দূরে বা ঊর্ধ্বে অবস্থিত, যেহেতু তা পরিশীলিত- এই চিন্তাটির অবসান হবে। সংস্কৃতির মূলে সংস্কার বা চর্চার ভূমিকাকে অবশ্যই বড় করে দেখতে হবে, কিন্তু সংস্কৃতি একটি জনগোষ্ঠীর সার্বিক স্টাইলের প্রকাশ। ব্যক্তির যেমন ব্যক্তিত্ব থাকে, জনগোষ্ঠীও তেমনি। এটিই সংস্কৃতি। তাতে কাজ আর অবকাশ আলাদা থাকে না; শিক্ষা ও বিনোদন দুই জিনিস হয় না।

আমি এখুনি দেখতে পাই, আমাদের তরুণদের মধ্যে ব্যক্তিত্বের পালা বদল ঘটছে। তার সাহসী, আত্মপ্রত্যয়ী, অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয় এবং প্রতিবাদী হচ্ছে- কিছু সংখ্যক বিকৃতি বা বিচ্যুতি বাদ দিলেও। আজকের এবং আগামীর বাঙালি সংস্কৃতি- যাতে সঙ্গীত থেকে নিয়ে শস্য বোনার কাজ, নৃত্য থেকে নিয়ে রাজনীতি, নাটক থেকে নিয়ে যোগাযোগ, নৃতত্ত্ব থেকে নিয়ে সমকাল চিন্তা, দর্শন থেকে নিয়ে আত্ম-কর্মসংস্থান সবই অন্তর্ভুক্ত- অত্মপ্রত্যয়ী এবং শক্তিশালী হবে; এই সংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব সচেতন হবে। বর্তমানের ধারা প্রবণতাগুলো তারই সাক্ষ্য দেয়।

৩.

উপরে আমি যে সম্ভাবনা ও প্রত্যাশার কথা বলেছি, তা সংবাদ-এরও। আমি দেখেছি, সংবাদ ক্রমাগত সংস্কৃতির সত্যগুলোর ওপর জোর দিচ্ছে, এর প্রকাশের পথটি সহজ করতে চেষ্টা করছে। সংবাদ শুধু একটি সংবাদপত্র নয় এটি সংস্কৃতির বিকাশে ক্রিয়াশীল একটি চিন্তাপত্রও।

image

শিল্পী : শতাব্দী জাহিদ

আরও খবর
বাংলা নামের প্রথম দৈনিক
বাংলাদেশকেও সাবধানে পা ফেলতে হবে
নির্মলেন্দু গুণের কবিতা
সংবাদ এবং আমার শৈশব
আমার বাতিঘর
শিক্ষার বিবর্তন কিংবা বিবর্তনের শিক্ষা
নয়া মাধ্যম: মিডিয়া ডায়েট ব্যক্তির স্বাধীনতা
সংবাদ-এর ঐতিহ্যিক ধারাবাহিকতা
চলছে লড়াই, চলবে লড়াই
গণমাধ্যমের শক্তি ১৯৭১
সংবাদ ও রণেশ দাশগুপ্ত
আমার ‘সংবাদ’
দৈনিক সংবাদ আমার প্রতিষ্ঠান
বিভাগোত্তর কালে দুই বাংলায় গণমাধ্যমের বিবর্তন
দুর্ভিক্ষের পীড়া ও রবীন্দ্রনাথ
সংবাদ ও অর্থনীতি
ভবিষ্যতের গণমাধ্যম গণমাধ্যমের ভবিষ্যৎ
মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতা
দুটি কবিতা : আহমদ সলীম
গোলাম কিবরিয়া পিনু
সাতচল্লিশ পরবর্তী বাংলা গানের বিবর্তন
নারীর মনোজগৎ: আমাদের বিভ্রম ও কল্পকাহিনী
নতুন সময়ের গণমাধ্যম
গৌরব এবং গর্বের সংবাদ
গণমাধ্যম কেবল আশার স্বপ্ন নয়
গণমানুষের নিজের পত্রিকা ‘সংবাদ’
মুক্তিযুদ্ধ ও সাংবাদিকতা
মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িকতা

বুধবার, ০৩ আগস্ট ২০২২

‘সংবাদ’ শুধু একটি সংবাদপত্র নয়

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

image

শিল্পী : শতাব্দী জাহিদ

সংবাদ-এর সঙ্গে আমার একটি হার্দিক সম্পর্ক আছে; আমরা সমবয়সী, এবং আমার লেখালেখির শুরু থেকেই সংবাদ ছিল আমার পৃষ্ঠপোষক। গত তিরিশাধিক বছর ধরে প্রতি সকালে প্রথমেই যে কাগজের পাতায় আমি চোখ রাখি, সে কাগজটি হচ্ছে সংবাদ। একটা সময় ছিল, যখন মাঝে মধ্যে আমি সংবাদ অফিসে যেতাম। এর সাহিত্য পাতায় আমি তখন “অলস দিনের হাওয়া” নামে নিয়মিত একটি কলাম লিখি, এবং এ পাতার সম্পাদক আবুল হাসনাত-কে নিজ হাতে কখনো কখনো লেখা পৌঁছে দিতাম। হাসনাত ভাই স্বল্পভাষী মানুষ, কিন্তু লেখালেখিতে তিনি সবসময় উৎসাহ যোগাতেন। একটা কিস্তি বাদ পড়লে ফোনে খবর নিতেন। পরবর্তীতে, কালি ও কলম-এর সম্পাদক হিসেবেও তিনি একইভাবে উৎসাহ যুগিয়েছেন। যাহোক, হাসনাত ভাই-এর কাছে গেলে কোনো কোনো দিন দেখা হতো সংবাদ সম্পাদক বজলুর রহমানের সঙ্গে, অথবা কথা হতো সন্তোষ গুপ্তের সঙ্গে। এ দুই নমস্য সাংবাদিক এখন প্রয়াত। সন্তোষ গুপ্ত আমাকে চিত্রকলা নিয়ে লিখতে উৎসাহ দিতেন। তিনি নিজেও ছিলেন একজন উঁচুদরের চিত্র সমালোচক। সংবাদ অফিসে আরো দেখা হতো সাবেক ভারপ্রাপ্ত মনিরুজ্জামান এবং সোহরাব হাসানের সঙ্গে, যিনি এখন প্রথম আলোয় কর্মরত। অনেক গল্প হতো তাদের সঙ্গে, কিন্তু পেছন দৃষ্টিতে এখন মনে হয়, আমি যে একসময় রাজনৈতিক কলাম লেখা শুরু করি, যদিও খুবই অনিয়মিত ভাবে, তার পেছনে হয়তো তাঁদের অনুপ্রেরণা ছিল। সংবাদ-এ গাছপাথর নামে নিয়মিত একটি রাজনৈতিক কলাম লিখতেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। এমন চিন্তাশীল এবং সুলিখিত কলাম পড়ার সৌভাগ্য এখন আর তেমন একটা হয় না। এই কাগজের সম্পাদকীয়তে, সংবাদ ও রাজনীতি বিশ্লেষণে, সাহিত্য পাতায়, বিভিন্ন ফিচারে যে বিষয়গুলি ঘুরেফিরে আসে সেগুলি হচ্ছে, দেশ, মাটি, সংস্কৃতি, জনমানুষ এবং রাজনীতি নিয়ে কিছু আদর্শ চিন্তা; মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি অগাধ বিশ্বাস, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা প্রান্তিক মানুষজনের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা এবং নারীর ক্ষমতায়ন, সংখ্যালঘু ও আদিবাসী গোষ্ঠীগুলির উন্নয়নের জন্য আপ্রাণ প্রয়াস। আমি আনন্দিত যে, এত বছর পরও সংবাদ তার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়নি। সংবাদ-এর ভাবনার কেন্দ্রে যে বিষয়টি একটি জায়গা করে নিয়েছে তা হচ্ছে একুশ শতকে বাঙালি সংস্কৃতির রূপ। এ নিয়েই আজকের নিবন্ধ।

২.

বছর কয়েক আগে বাংলা একাডেমিতে একটি সেমিনার হয়েছিল, যার বিষয়বস্তু ছিল একুশ শতকের সাহিত্য-ভাবনা। শতাব্দীর (এবং সহস্রাব্দের) শেষ প্রন্তে দাঁড়িয়ে আগামী শতাব্দীকে (এবং সহস্রাব্দকে) আমরা কীভাবে দেখব, বিশেষ করে বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্যের আলোকে- এ সম্পর্কে আমন্ত্রিত অতিথিদের বক্তব্য রাখার আহ্বান জানানো হয়েছিল। অতিথিদের মধ্যে ছিলেন মহাশ্বেতা দেবী। তিনি এই বিষয়টি নির্বাচন করায় বিরক্ত হয়েছিলেন। সেমিনারটি সাজানো হয়েছিল একটি কলোকুইয়ামের আদলে- অংশগ্রহণকারীরা নিজ নিজ বক্তব্য দিয়েছিলেন, একে অন্যকে প্রশ্ন করেছিলেন এবং প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন। সেমিনারটির সঞ্চালনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল আমাকে এবং এ দায়িত্ব নিয়ে আমি পড়েছিলাম বিপাকে। মহাশ্বেতা দেবী বলেছিলেন, দু’তিন বছরে সাহিত্যে এমন কী পালাবদল ঘটবে যে, মানুষকে মুখিয়ে থাকতে হবে একুশ শতকের জন্য। দশক-শতকের এই ব্যাপারটা অনেকটাই মনস্তাত্ত্বিক। বিষয়টি পছন্দ না হলেও মহাশ্বেতা দেবী সাহিত্যের আশা-আকাক্সক্ষা নিয়ে কিছু কথা বলেছিলেন, যদিও ভবিষ্যৎ-দর্শনে তাঁর অনীহা থেকে মূল বিষয়টিকে তিনি পাশ কাটিয়ে গিয়েছিলেন। মহাশ্বেতা দেবীর মতো আমিও বিশ্বাস করি, ‘শতাব্দী-শেষ’ বা শতাব্দী-শুরু’র ব্যাপারটা যতটা না ঘড়ি আর পঞ্জিকার সঙ্গে স¤পর্কিত, তার থেকে বেশি মনস্তত্ত্বের সঙ্গে।

এই যে নতুন সহস্রাব্দ নিয়ে মহা হৈ চৈ শুরু হয়ে গিয়েছিল, সেটিও মৌলিকভাবে মানসিক। একুশ শতকের উদয় হয়েছে সূর্যের মতো, ঘড়ির সময় মেনে। কিন্তু এতে নিশ্চয় সৃষ্টি ওলট-পালট হয়ে যাবে না; এসময় বদলে যাবে না পৃথিবীর অথবা মানুষের চেহারা। বস্তুত ক¤িপউটারের ‘ওয়াইটুকে’ সমস্যা ছাড়া আর কোনো বড় ঢেউ ওঠার কথা নয় সময়ের সরোবরে। ক¤িপউটার অচল হয়ে যেতে পারে তৃতীয় সহস্রাব্দের প্রথম প্রহরে-এরকম আশঙ্কার কথা একসময় খুব শুনেছি আমরা। এখন শুনছি সেই আশঙ্কাও অমূলক। অর্থাৎ সময় সরোবরে ওই একটা ঢেউও মিলিয়ে যাওয়ার পথে। তাহলে নতুন শতাব্দী সহস্রাব্দ নিয়ে এত উত্তেজনা, এত শঙ্কা প্রত্যাশা কেন ছিল, এখনো আছে? বাংলা একাডেমির ওই সেমিনারে আমার নিজের অবস্থানটি ব্যাখ্যা করার একটা সুযোগ এসেছিল সমাপনী বক্তব্য দেয়ার সময়। আমি বলেছিলাম, আগামী শতক নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা আর কাচের গোলকে ভবিষ্যৎ দেখাটা এক জিনিস নয়। আগামী শতাব্দীতে সাহিত্য কেমন হবে তার উত্তর জ্যেতিষীরা এরকম দেবেন, আর সাহিত্যিকও সহিত্যতাত্ত্বিকরা দেবেন অন্যভাবে। আগামী শতাব্দী বলতে আসলে কিছু নেই; যে সময় ভবিষ্যতের গর্ভে লুকিয়ে আছে, তার কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নেই। আমাদের শুধু আছে বর্তমান এবং অতীত। বর্তমানটা খুবই ক্ষণস্থায়ী। অতীতটা ক্রমাগত স্ফীত হয়ে খসে পড়ে বর্তমানকে ধারণ করতে করতে। কাজেই অতীত আর বর্তমানকে বিশ্লেষণ করে সাহিত্যের চিন্তাপ্রবণতাগুলো কী রূপ নিতে পারে দু-দশ বছর পর, এ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করাটা দোষের কিছু নয়। আমার মনে আছে, সত্তরের দশকের শেষদিকে বিনির্মাণবাদী দুই তাত্ত্বিক পল ডি ম্যান অর স্ট্যানলি ফিশের বক্তৃতা শোনার সুযোগ হয়েছিল। সাহিত্যতত্ত্বে তখন কাঠামোবাদী চিন্তা-ভাবনাকে সরিয়ে উক্ত-কাঠামোবাদী আর বিনির্মাণবাদী চিন্তা ঢুকে পড়েছে যদিও আমি ততটা অবহিত ছিলাম না এসব ব্যাপারে। আমরা যে সাহিত্য-সমালোচনা শিখেছি, তা প্রবলভাবে নিউ-ক্রিটিসিজম প্রভাবিত; যেসব নামকরা সাহিত্য-সমালোচকের বই আমরা পড়েছি, তারা প্রায় সবাই নিউ-ক্রিটিক। এই অবস্থায় কাঠামোবাদ পর্যন্ত কেবল পৌঁছানো গেছে। ডি ম্যান আর ফিশ এক লাফে বিনির্মাণবাদের বারান্দায় আমাদের তুলে দিতে চেয়েছেন।

ডি ম্যান এবং ফিশকে সেই সময় যত অপরিচিত এবং ভিনগ্রহীই মনে হয়ে থাক না কেন, তাদের কথার যুক্তিকে অস্বীকার করতে পারিনি। আমার সবচেয়ে অবাক লেগেছিল, আগামী ২০ বছরে সাহিত্যতত্ত্ব কী রূপ ধারণ করতে পারে, এই দু’জন-বিশেষ করে ফিশ তার একটি চমৎকার ছবি আমাদের সামনে তুলে ধরছিলেন। এই বিষয়টি আমি পরে অনেক সহিত্যতাত্ত্বিকের লেখায় পেয়েছি। মেশেল ফুকো তার ম্যাডনেস অ্যান্ড সিভিলাইজেশন (১৯৭০) গ্রন্থে পাগলামোর ইতিহাস বর্ণনা শুরু করেছেন মধ্যযুগ থেকে এবং বর্তমান ও আগামীতেও মানসিক বৈকল্যকে কী দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে এবং হবে, তার একটা স্বচ্ছ ধারণা দিয়েছেন। তারা কেউ কাঁচের গোলক বা ডেলফিক ওর‌্যাকল থেকে ধারণা নেননি। বর্তমানের প্রবণতাগুলো ভালোভাবে বুঝতে পারলে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ধারণা করাটা মোটেই কঠিন নয়, কারণ ভবিষ্যৎ বলতে যা বুঝি আমরা তা বর্তমানেরই শেষ মাথায় দাঁড়ানো একটা সময়চৌকাঠ মাত্র। তবে দুঃখজনক বিষয়টি হলো, ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলতে গেলে আমরা মাঝে মাঝেই জ্যোতিষী হয়ে যাই। এমনকি যুক্তি ও বিজ্ঞানভিত্তিক যে মার্কস্বাদ, তার চর্চা যারা করেছেন আমাদের দেশে, তারাও দেখি মাঝে মাঝে এরকম বক্তব্য দিয়ে তাদের সমাজ বিশ্লেষণমূলক লেখা শেষ করেছেন। এই কিছুদিন আগেও ‘এমন একদিন আসবে, যেদিন সর্বহারারা জেগে উঠবে’ ইত্যাদি। সর্বহারারা জাগছে কিনা সেটাই প্রশ্ন। এমনকি সর্বহারাদের ঘুম ভাঙার সামান্য শব্দ তাদের চৌকিতে, ভোরের রসায়নে, সুপ্তিতারল্যের সামান্য ক¤পন, এসবও যদি শুনি, তাহলে বলতে পারি, তারা জাগবে। কিন্তু সেই শব্দ, সেই চিহ্ন কোথায় আমাদের দেশে, কোথায় ছিল গর্বাচভের গ্লাসনস্তের আর পেরেস্পৈকার প্রবল ঝঞ্ঝার আগে? সর্বহারাদের ঘুমের ভেতরে পুঁজিবাদের ইথার যে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই অথবা তারো আগে থেকেই সে কথাটা মার্কসবাদী তাত্ত্বিক-প্রোফেটরা বুঝতেই কি পারেননি, নাকি গলদ ছিল তাদের সমকাল দর্শনে? কে জানে! সর্বহারারা জাগলে এই মনুষ্যত্ববিহীন দেশে একটা মনুষ্যত্বসমৃদ্ধ যুগের সূচনা হতো, ন্যায় ও শ্রেয়োবোধ উদ্ধার পেত; সেটা তো বুঝতে কারো কষ্ট হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তার সম্ভাবনা কতটুকু? এই কথাটা ভাবলে আফসোস হয়; কিন্তু এও তো জানি, পুঁজি আর পণ্যের প্রবল আক্রমণে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছে শ্রেয়োচিন্তা আর নীতিদর্শনের সূত্রগুলো। সংস্কৃতিও আক্রান্ত হচ্ছে পণ্যরোগে। আগামীতে কী হতে পারে সমাজ ও সংস্কৃতির রূপ, বর্তমানের এই লণ্ডভণ্ড অবস্থা দেখে তা কিছু আঁচ করা যায় বৈকি।

একুশ শতকের সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে পুঁজির সম্প্রসারণ ও পণ্যায়ন এবং প্রচলিত নীতিচিন্তা ও শ্রেয়োবোধের ক্ষয়ের কথাগুলো মনে রাখতে হবে। এই সঙ্গে মানুষের চিন্তার জগতে যেসব পরিবর্তন ঘটছে, কাল ও সমাজ-দর্শনে যেসব প্রবণতা প্রধান হচ্ছে, অথবা গুরুত্ব পাচ্ছে, সেগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে। সংস্কৃতি একটি সমাজের নান্দনিকের পরিচয় শুধু নয়; সমাজের কাঠামো, সমাজের অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি, ধর্ম এবং কল্পনার পরিশীলিত একটি রূপ হিসেবে দেখতে আমরা অভ্যস্ত, কিন্তু সংস্কৃতি অনেক সময় আড়াল করে রাখে সমাজের নানা অপব্যবস্থাকে। আফ্রিকায় বালিকা ও নারীদের যোনিচ্ছেদ সে সমাজের সংস্কৃতির অঙ্গ বাংলাদেশে পতিঅন্ত, সেবাপরায়ণ, সহনশীল নারীদের প্রশংসা গানে আর প্রবাদে মানুষের মুখে মুখে। নারীদের পুরুষের অধীনস্থ করে রাখার কৌশলে ব্যবহৃত হয়েছে সংস্কৃতি এবং সংস্কৃতির চর্চায় এই চিন্তা লাভ করেছে প্রবন্ধকার। সংস্কৃতির আর একটি দিক ও আছে- কর্তৃত্বের কাছে আত্মসমর্পণ, প্রান্তের ওপর কেন্দ্রের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা, প্রাতিষ্ঠানিক বিশ্বাস (যাতে অনেক অন্ধ ধর্মবিশ্বাসও অন্তর্ভুক্ত) ও প্রচলকে শাশ্বত বলে মান্য করা, এরকম বিষয়গুলো নির্বিচারে গ্রহণ করতে উৎসাহিত করে সেই অন্ধকার সংস্কৃতি। সংস্কৃতির একটি আদর্শিক রূপও আমরা মাঝে মাঝে তৈরি করে ফেলি, যাতে শুদ্ধ নান্দনিকতার একটা প্রকাশ দেখতে আগ্রহান্বিত হই আমরা। যে-সংস্কৃতি চর্চা ওই আদর্শিকতা থেকে দূরে থাকে অথবা এর সাথে আমরা প্রশ্ন করি না। যেমন, একটি মেয়ে তার ঘরে বসে একটি ছেলের জন্য এবং একটি ছেলে তার ঘরে বসে একটি মেয়ের জন্য অশ্রুপাত করলে সমাজের ক্ষতি হয় না। এই আচরণকে ‘সামাজিক’ বলে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু ছেলেটি একটি নির্জন জায়গায় মেয়েটিকে পাশে বসিয়ে কথা বললে কাজটি হয়ে যায় ‘অসামাজিক’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মাঝে মাঝেই সন্ধ্যা বেলায় এরকম ‘অসামাজিক’ কার্যক্রম বন্ধে উঠে পড়ে লাগেন, অথচ অস্ত্র পকেটে নিয়ে মাস্তানি করে বেড়ায় যেসব ক্যাডার তারা সবই ‘সামাজিক’। পত্রিকার পাতা খুলেও দেখা যায়, স্বামীকে খুন করেছে- এমন মেয়েদের বিদ্যুৎ বেগে পাকড়াও করে পুলিশ কিন্তু স্ত্রীকে মেরে দিব্যি পুলিশের নাকের ডগায় ঘুরে বেড়ায় স্বামী। তাকে কে ধরবে?

প্রভাবশালী মহলের মেয়েদের জন্য তদ্বির করে না, করে পুরুষদের জন্য। পুরুষ শাসিত সমাজ নারীর উত্থানে অরক্ষিত হয়ে পড়ে, অথবা অরক্ষিত হওয়ার ভয়ে ভীত হয়।

অথচ সমাজ বলছে একটি মেয়েকে- পড়, স্কুলে যাও, চাকরি কর। অর্থাৎ সবই কর, বিশেষ করে আয়-উপার্জন করো, কিন্তু ‘অসামাজিক’ হয়ো না। ‘অসামাজিক’ অর্থাৎ সমাজের ঋজু নর্মগুলো থেকে স্খলিত হলে চলবে না। আমাদের সংস্কৃতিও এই আনুগত্য প্রকাশকে সমর্থন করে। কিন্তু পুরুষ শাসিত সমাজ যেমন তার পূর্ণাধিপত্য হারাচ্ছে ধীর ধীরে- এর লক্ষণগুলো আমরা চিহ্নিত করতে পারি (সন্তান পালনে বাবার অধিকাংশ অংশগ্রহণ- স্ত্রীর আয়-উপার্জনে স্বামীর আস্থা জ্ঞাপন, নির্ভরতা এখনো ততটা না এলেও, ইত্যাদি), আমাদের সংস্কৃতিতেও এই আধিপত্যের বিষয়টি তরল হতে শুরু করেছে। এর একটি কারণ, সমাজের মৌল কাঠামোতে পরিবর্তন এবং শিক্ষাব্যবস্থার সার্বজনীনকরণ। কিন্তু অন্য একটি কারণ নিহিত রয়েছে ওই পণ্যের প্রসারে। পণ্য পুরুষ-নারী বিভাজনে যায় না। নারীকে সে প্রয়োজনে ব্যবহার করে, কিন্তু তা কোনো আদর্শ চিন্তা থেকে নয়, বরং উপযোগিতার চিন্তা থেকে। পণ্যের প্রসারের জন্য নারীর সহযোগিতা প্রয়োজন, সংস্কৃতির পণ্যায়নেও তাই নারীর একটি ভূমিকা থাকবে, আছেও। সেটি যে ভবিষ্যতে আরো প্রবল হবে, সে কথা একটুখানি ভাবলেই বলা যাবে। আধুনিকতা, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের সংস্কৃতিতে গতিশীল করেছে সন্দেহ নেই; আধুনিকতা একটি বিশ্লেষী এবং শেষ বিচারে বিমূর্তবাদী চেতনার নাম: এর প্রকাশ অনেক ক্ষেত্রেই অন্তর্মুখী। কিন্তু আধুনিকতার তুঙ্গ সময়ে, যাকে পশ্চিমে ‘হাই মডার্নিজম’ বলে আখ্যায়িত করা হয়, এই প্রবণতাগুলোই বেশ ঋজুতা নিয়ে দেখা দিয়েছিল। সাহিত্যে ও সংস্কৃতিতে একটি কেন্দ্রিকতার প্রয়াস দেখা গেছে; বিশ্লেষণ ভিত্তি খুঁজেছে তত্ত্বের। বিমূর্তায়ন একটা নর্ম হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছে এলিয়ট দি ওয়েস্ট ল্যান্ড’ লিখেছেন, কিন্তু কবিতাটি সাজিয়েছেন এক এপিকের কাঠামোয় (এপিকের মতোই কবিতার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রয়েছে একটি অন্বেষণ, নিছক অর্থে অনুসন্ধানী ভ্রমণ); এ কবিতারও একজন ‘নায়ক’ তৈরি হয়, এবং যত বিচ্ছিন্নতার হোক তার বয়ানটি একটা ‘গ্রান্ড’ ন্যারেটিভের আদলে অগ্রসর হতে থাকে। আধুনিক স্থপতিরা (লে কর্বুসিয়ের যাদের গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিনিধি) গ্রান্ড ন্যারেটিভের নমুনায় দালান বানিয়েছে- কাচও কংক্রিটের, বাক্সের আকৃতির, আকাশ ফুঁড়ে যে উঠেছে এবং পরিবেশকে শাসন করেছে। কর্বুসিয়েরের একটি স্লোগান ছিল এরকম, ‘নিয়মের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা আনো।’ সেন্ট লুইর একটি আবাসিক এলাকার স্থাপত্য পরিকল্পনাতেও কর্বুসিয়ের এই নিয়ম যুক্তিযুক্ততার প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। তার স্থাপত্য তাই মানুষের জন্য হলেও দাঁড়াল। ১৯৭২ সালের কোনো এক দিনে এই দালানগুলো গুঁড়িয়ে দেয়া হলো। বলা হলো, উত্তর-আধুনিকতার সূত্রপাত সেদিন থেকেই। এটি একটি কথার কথা মাত্র। কিন্তু হাই মডার্নিজম যে অন্তর্মুখিতার নামে অহঙ্কারী এবং বিশ্লেষীর আবরণে মতবাদপ্রচারী হয়ে দাঁড়িয়েছিল, এটি তো সত্য। উত্তর-আধুনিকতা এইসব ঋজুতা, কেন্দ্রিকতা, নির্দিষ্টতা এবং ইহাব হাসান কথিত hierarchy, mastery/logos-এর বিপরীতে স্থিতিস্থাপকতা, প্রান্তিকতা, অনির্দিষ্ট এবং exhaustion/silence গুরুত্ব দিয়েছে। একুশ শতকের শুরুতে এমনকি আমাদের সংস্কৃতিতেও, এর প্রকাশ দেখা দিচ্ছে।

একটি ছোট উদাহরণ দিয়ে শুরু করা যাক। বেশ কয়েক বছর আগে ‘ঢাকা’ নামের ব্যান্ড দলের প্রধান গায়ক মাকসুদ (আগে সে অন্য একটি দলে ছিল) রবীন্দ্রনাথের একটি গানের ‘বিকৃত পরিবেশনা’র দায়ে নিন্দিত হলো। নিন্দা যারা জানিয়েছেন, তারা সকলেই শুদ্ধবাদী; তারা বিশ্বাস করেন, রবীন্দ্রনাথের গানের সুর বিকৃত করা বা বিশ্বভারতী সঙ্গীত সমিতি অনুমোদিত সুরের বাইরে গিয়ে গান করাটা নিতান্ত অনুচিত। মাকসুদের পক্ষেও অনেকে লিখেছেন, তারা ‘বিদ্রোহ’কে সমর্থন করেছেন। তারা যুক্তি দেখিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথের গান ভিন্নভাবে গাইলে এর ভেতরে বৈচিত্র্যকেই তুলে ধরা হয়। রবীন্দ্রনাথকে ধরাছোঁয়া যাবে না- এই যুক্তি তারা মানতে রাজি নন। আমি উভয়পক্ষের যুক্তি মন দিয়ে পড়ে দেখেছি, কিন্তু যেহেতু সঙ্গীতে আমার বিন্দুমাত্র অধিকার নেই, সেজন্য এই বিতর্কে দর্শকের ভূমিকাই পালন করেছি। কিন্তু বিষয়টি উত্তর আধুনিকতার দৃষ্টিতে দেখলে একটি অনিবার্যতার সন্ধান তাতে পাওয়া যায়। মাকসুদ ভালো করেছে না মন্দ করেছে- সেই বিচারে না গিয়েও বলা যায়, মাকসুদের ‘ক্রিয়া’টি ছিল একটি ‘প্রতিক্রিয়া’। মাকসুদকে আমি চিনি, তার ভেতরে নতুন কিছু করার যে একটি তাগিদ আছে, আমি তা দেখেছি। হয়তো তার পরিবেশনাটা ভালো হয়নি, ঘাটতি ছিল সুরে এবং/অথবা সৌন্দর্যে। কিন্তু মাকসুদ যে একটি বার্তা দিচ্ছে আমাদের, তাকে কেন অস্বীকার করব? এই বার্তা নান্দনিক হয়নি বলে এর চিন্তাকে অবহেলা কেন করব? রবীন্দ্রসঙ্গীত আমাদের হাই মডার্নিস্টদের হাতে একটি রিচ্যুয়াল যে হয়ে দাঁড়িয়েছে, এ বিষয়টা আমি নিজেও দেখেছি। কুড়ি বছর আগে অক্সফোর্ডে নীরদ চন্দ্র চৌধুরীর সঙ্গে আমি দেখা করেছিলাম। কথা প্রসঙ্গে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ কতগুলো গান লিখেছেন? আমি চিন্তাভাবনা করে বলেছিলাম তা প্রায় হাজার চারেক। নীরদ চৌধুরী একটি স্কুলছাত্রের মতো দুষ্টুমিভরা হাসি হেসে বলেছিলাম, না ভুল বললেন। রবীন্দ্রনাথ গান লিখেছিলেন ২৯৬টি। বিশ্বাস না হলে বাজারে রবীন্দ্রসঙ্গীতের যত রেকর্ড-ক্যাসেট পাওয়া যায়, সেগুলো সংগ্রহ করে একটি তালিকা করুন। ওই ২৯৬টি হবে। এগুলোই সবাই গান, আগামীতেও গাইবেন। ২৯৭ নম্বর গান যেদিন বাজারে আসবে, আমাকে জানাবেন, আমি সানন্দে সংগ্রহ করব।

রিচ্যুয়ালের সমস্যা এবং শক্তি হলো এর পৌনঃপুনিকতা। তাছাড়া দুই বাংলা রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভাষা ইতিমধ্যে একটি ঋজু রিচ্যুয়াল ভাষায় পরিণত হয়েছে, যা ভাবকেও রুদ্ধ করে। কিছুদিন আগে পশ্চিমবাংলার এক প্রতিষ্ঠিত গায়িকার গলায় ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে’ গানটি শুনলাম। শুনে মনে হলো, আজ আমাদের ছুটি হয়েছে যেন একটা কারাগার থেকে অন্য কারাগারে যাওয়ার জন্য, মাত্র পাঁচ মিনিট। গানটির ব্যাকরণ ঠিক আছে, স্বরলিপিও নিখুঁত। কিন্তু গানটির রিচ্যুয়ালাইজড হয়ে যাওয়ায় এর ভাবের রাজ্যে জমেছে জগতের কাঠিন্য। একটি খুশির অনুভূতি তাই পরিণত এক কষ্টকর, অনিশ্চিত অনুভূতিতে। মাকসুদের বিপক্ষে সমালোচনাতেও আমি লক্ষ করলাম অসহিষ্ণুতা এবং কেন্দ্রিকতা। মাকসুদের গানটি আমার ভালো লাগেনি, কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম, সে রবীন্দ্রসঙ্গীতের কোনো ক্ষতি করতে চাইছে না; শুধু চাইছে এর কেন্দ্রিকতা, এর রিচ্যুয়ালাইজেশন, এর hierarchical কাঠামো এবং ঋজুতার বিপরীতের ভিন্ন কিছু চিন্তার সমাবেশ ঘটাতে। এ বিষয়টি যারা রবীন্দ্রসঙ্গীতের নিয়মিত চর্চা করেন, তাদের জন্য একটি উপকারী বার্তা হতে পারে। এই বার্তা গ্রহণ করে গান গাইলে মেঘের কোলে রোদ সত্যি সত্যি হেসে উঠত। উল্লিখিত প্রবণতায় আমি দোষ-গুণের প্রকাশ দেখার পরিবর্তে এক ধরনের অনিবার্যতা দেখি। বিশ্বজুড়ে এমনটি ঘটছে। এমটিভিতে একালের জনপ্রিয় হিন্দি গানগুলোর রিমিক্স প্রচারে একটা হিড়িক পড়েছে দেখতে পাচ্ছি। শেক্সপিয়ারের রোমিও এন্ড জুলিয়েট নাটকটির এক সাম্প্রতিক চলচ্চিত্রায়নে দুই পরিবারকে দেখানো হয়েছে আমাদের সময়ের দুই মাফিয়া পরিবার হিসেবে, ডিউককে দেখানো হয়েছে কৃষ্ণকায় এক পুলিশ চিফ হিসেবে- যিনি হেলিকপ্টারে চড়ে সংঘর্ষে লিপ্ত দুই পরিবারের ভাড়া করা সশস্ত্র মাস্তানদের পাকড়াও করার অভিযানে নামেন। ছবিটি দেখে কোথাও মনে হয়নি, শেক্সপিয়ার ভূলুণ্ঠিত হচ্ছেন। এই আয়রনি, এই কৌতুক এবং আত্মবিশ্লেষী দৃষ্টিভঙ্গি, এই pastiche এসবই আমাদের সময়ের রবীন্দ্রনাথ ও শেক্সপিয়ারকে অথবা অন্য কোনো লেখক-শিল্পীকে এসবের পরিপ্রেক্ষিতে দেখা হবে। তাতে হাই মর্ডানিজম-নির্দিষ্ট মূল ধারাটি বিপর্যস্ত অথবা বাতিল হয়ে যাবে না। বরং ভিন্ন কিছু কোণ থেকে তাদের ওপর আলো ফেলার জন্য তাদের কিছুটা নতুন- অন্তরঙ্গভাবে চেনা যাবে। এখানে মাকসুদ অথবা রোমিও এন্ড জুলিয়েট-এর পরিচালক গুরুত্বপূর্ণ নন, গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নতুন করে দেখার দৃষ্টি। এটি সময়ের তৈরি। চিত্রকলা সিনেমা ফটোগ্রাফি এবং নৃত্যে এটি ঘটছে। এমনকি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতেও নুসরাত ফতেহ আলী খান উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সঙ্গে রক মিউজিক, এমনকি র‌্যাপের সংযোজন ঘটিয়ে যে বাজার মাত করেছিলেন, তাতে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হয়নি, বরং বিশাল এক তরুণ গোষ্ঠীর কাছে এর জনপ্রিয়তা নিশ্চিত হয়েছিল।

একুশ শতকের তৃতীয় দশকে দাঁড়িয়ে পেছন দৃষ্টিতে আমাদের সংস্কৃতিকে খুঁটিয়ে দেখলে এই কথাটি নিশ্চিত করে বলা যায়, এই শতাব্দীর অন্তত কিছুকাল হাই মর্ডানিজমের রিচ্যুয়াল থেকে উত্তর-আধুনিক আন্তরিকতার দিকে যাবে সংস্কৃতির অনেক ফর্ম। তাতে এক সময় এই ফর্মের প্রকাশেও রিচ্যুয়াল জমা হতে পারে- সেটাই স্বাভাবিক। তখন প্রতিক্রিয়া হিসেবে হয়তো রিচ্যুয়ালহীনতার ভিন্ন একটি প্রকাশ খুঁজে নেবে মানুষ এবং খুঁজতেই হাই মডার্নিজমের রিচ্যুয়ালকেও কিছুদিনের জন্য ভালো লেগে যেতে পারে তাদের। তবে এ কথাটা ঠিক যে সংস্কৃতির রক্ষণশীলতা আক্রান্ত হবে; যে-প্রকাশের অন্তর্নিহিত শক্তি আছে, যা মেকি নয় অথবা যা মানুষের সামষ্টিক অংশগ্রহণে উৎপাদিত, তা যদি আপাত-রক্ষণশীল বলে মনে হয়, তার বিপর্যয় ঘটবে না। কিন্তু এলিট কালচার নিজের প্রয়োজনে যাকে রক্ষণশীলতার আবরণে ঢেকে দেখেছে, তা আরক্ষিত হয়ে পড়বে। আমাদের ভাষায় প্রসঙ্গটি এখানে উত্থাপন করা যায়। এলিট ও সাবঅল্টার্নের দুই আলাদা ভাষা বাংলাদেশে। সাবঅল্টার্নের কোনো কণ্ঠস্বর নেই- এ রকম কথা গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের মতো মানুষেরা বললেও, এ বলার পেছনের প্যাট্রনসুলভ চিন্তাটি আসলে এলিটেরই মনের কথা। সাবঅল্টার্নের অবশ্যই ভাষা আছে, তবে তার বিন্যাস এবং এই সিমেওটিকস এলিটের ভাষা থেকে স্বতন্ত্র। এ রকম তাত্ত্বিক স্বাতন্ত্র্য ছাড়াও সাবঅল্টার্নের প্রতিদিনের যে ভাষা আছে, যাকে প্রয়োগিক ভাষা বলা যায়, তার বিকাশটি খুবই ঘটনাবহুল। এলিট চেয়েছে সাবঅল্টার্ন তার ভাষা ভুলে এলিটের আরোপিত ভাষায় কথা বলুক- সে ভাষায় একটি বালক-এলিটও ‘আপনি’ সম্বোধিত হয় এবং এ ভাষায় দেওয়া আদেশগুলো দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য হয়ে পড়ে। অতএব আদেশ-নির্দেশও সে ভাষায় বেশি। কিন্তু সাবঅল্টার্ন সে-ভাষা শিক্ষাকে একদিন এলিটের ওপর টেবিল উল্টে দিয়েছে, যেমন ক্যালিবান দিয়েছিল প্রসপেরোর ওপর, শেক্সপিয়রের দি টে¤েপস্ট নাটকে। প্রসপেরো ক্যালিবানকে তার নিজস্ব ভাষা ভুলিয়ে শিখিয়েছিল এলিট ভাষা। একসময় ক্যালিবান সে ভাষায় গাল দেয়, অভিশাপ দেয় প্রসপেরোকে। আমরা যে-বাংলা ভাষায় প্রতিদিন কথা বলি, সেটি সাবঅল্টার্ন ভাষা। আমাদের অবচেতনে সাবঅল্টার্নে সাংস্কৃতিক প্রকাশগুলো ধরতে চাই আমরা, কারণ নৃতাত্বিক ভৌগোলিক বিচারে আমরা মাত্র দুই/তিন প্রজন্মের আধা-পাকা এলিট মাত্র। শিকড় আমাদের গ্রামে। আমাদের ভাষা এই সাবঅল্টার্ন-বিলাসের একটা প্রকাশ। ‘যাবা-খাবা’ ভাষাটি এখন বড়ই মধুর। এই ভাষাটি আরো পরিব্যাপ্ত হবে আগামী শতাব্দীতে, হয়তো এটিই হয়ে দাঁড়াবে ‘প্রমিত ভাষা।’

কয়েকটি জিনিস একুশ শতকের সংস্কৃতিকে মৌলিকভাবে প্রভাবিত করবে- মিডিয়ার, বিশেষ করে ইলেকট্রনিকস মিডিয়ার (যাতে কমিপউটার/ওয়েব-ইন্টারনেট কালচার এবং স্যাটেলাইট যোগাযোগ অন্তভুক্ত) ব্যাপ্তি এবং সর্বগ্রাসিতা; পণ্যসংস্কৃতির প্রসার, যার ফলে নিশ্চিত হবে সংস্কৃতির পণ্যায়ন ও ভোক্তা-সংস্কৃতির বহুল প্রসার; শিক্ষার বিস্তার, বিশেষ করে ২০২৫ সাল নাগাদ অর্জিতব্য একশ ভাগ নারী শিক্ষার হার, গ্রাম ও শহরের সীমানার অবলুপ্তি; গণতন্ত্র ও গণতন্ত্রের গেট কিপারদের শক্তিবৃদ্ধি; সামাজিক অস্থিরতা, সংঘাত ও অন্যান্য অস্থিতিশীল কারী অবস্থার বুদ্ধি; কর্মক্ষেত্রে ব্যাপক হারে নারীর প্রবেশ; রক্ষণশীলতা ও উগ্রবাদের ধ্বজাধারীদের সমাবেশ। এর সঙ্গে আরো যুক্ত হবে বিদেশের সঙ্গে তাৎক্ষণিক যোগাযোগের ব্যাপক সুবিধা; সংস্কৃতি ও অর্থনীতির বিশ্বায়নের প্রভাব; পরিবেশের দ্রুত এবং অমেরুযোগ্য বিনাশ, নারী-পুরুষের বর্তমান ‘অসামাজিক, মেলামেশার সুযোগ বৃদ্ধি ইত্যাদি। সংস্কৃতি এসব সূচকের ওপর অনেকখানিই নির্ভরশীল, কাজেই আগামী শতাব্দীর সংস্কৃতিতে এগুলোর প্রভাবে নানাবিধ স্রোতের সৃষ্টি হবে, যার অনেকগুলো হতে পারে একে অন্যের বিপরীত।

বর্তমান প্রবণতাগুলো লক্ষ্য করলে বলা যায়, যে সাবঅল্টার্ন সংস্কৃতির কথা বলা হয়েছে একটু আগে, তার অধিষ্ঠান যে ঘটবে ভবিষ্যতে, তা বলা সম্ভব মানুষের মনস্তত্ত্বের একটি সূত্র ধরে- তার নস্টালজিয়া এবং আর্কেডিয়া-চিন্তার কথা মনে রেখে। বাংলাদেশের মানুষ শহর গড়েছে দুই প্রজন্ম আগে; এখনো শহরগুলো বড় বড় গ্রাম মাত্র বাংলাদেশের এলিটও অতি ক্ষুদ্র একটি অনুদল। যতই প্রয়াস থাকুক এলিট অবস্থানের দিকে, নস্টালজিয়াকে আটকে রাখা যায় না। লোকজন ফর্মগুলো সংস্কৃতির ভেতরে শক্তি সঞ্চার করতে থাকবে এই কারণে। আর উত্তর-আধুনিক উপাদানগুলো আমাদের সংস্কৃতিতে কেউ ইচ্ছে করে আনেনি, সেটি সম্ভবও নয়। কেউ ইচ্ছে করলেই উত্তর-আধুনিক হতে পারে না; এটি কিছু প্রবণতার নাম যার অনেকগুলো আসে প্রতিক্রিয়া হিসেবে। আমাদের সংস্কৃতিতে এই প্রতিক্রিয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। হাসি ও কৌতুক এবং লঘুত্ব, রঙের প্রব্য, কেন্দ্রকে অস্বীকার করার প্রবণতা, আত্মকৌতুক ও বিদ্রুপ এসবের উপস্থিতি লক্ষণীয় আমাদের সংস্কৃতির নানা প্রকাশে। যখন সংস্কৃতির কোনো প্রকাশ ঋজু হয়ে যায়, তখন ভেতর থেকে প্রতিরোধ আসে। ঋজুতা যদি আসে গম্ভীর উদ্দেশ্যপরায়ণতা থেকে, তাহলে স্থিতিস্থাপকতা তৈরি হয় উদ্দেশ্যহীন লঘুত্ব থেকে। আমাদের ব্যান্ড সঙ্গীতের একটি অবসেসিভ বিষয় বস্তু আছে- প্রেম। কিন্তু এই প্রেম নিজে থেকেই লঘুত্বের দিকে গেছে। ব্যান্ড গানে প্রেমের কথা শুনে কেউ অশ্রু জল হয় না। ব্যান্ড গানের ফর্ম লঘুত্বকের বেছে নিয়েছে। তার বিষয় বস্তুতে পড়েছে লঘুত্বের ছায়া। অনিবার্যভাবে।

একুশ শতকে বাংলাদেশের সংস্কৃতি নিয়ে আমার কিছু প্রত্যাশা আছে। প্রথম প্রত্যাশাটি হচ্ছে এর গতিশীলতা নিয়ে। সর্বব্যাপ্ত মিডিয়ার যুগে পণ্যায়নের স্রোতে সংস্কৃতির বহিস্থ প্রকাশটি অনেকটা পাল্টে গেলেও এর মৌল গঠনটি সেই পরিবর্তনকে উপেক্ষা করতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস। বাংলাদেশের সংস্কৃতির বড় অংশটিই সাবঅল্টার্ন- শহুরে এবং শিক্ষিত সমাজ তাতে কিছুটা কসমেটিক সার্জারি করেছে মাত্র। আমাদের চিত্রকলার মুল শিকড় প্রোথিত জনজীবনে- সেখান থেকেই উঠে আসে রঙ, রেখা ও বিষয়বস্তু। এমনকি বিমূর্ত প্রকাশবাদী চিত্রেও বুদ্ধির পাশাপাশি যে ভাবটি সঞ্চারিত হয়, সেটি দেশজ এবং তাতে বাংলাদেশের মাটি, নির্মাণ এবং আকাশের ¯পর্শ আছে। যে বিমূর্ত প্রকাশবাদ পশ্চিমের ‘পরিশীলিত’ ফর্মকে আদর্শ মেনেছে, তার আবেদন আসলেই ফুরিয়েছে। নব্বইয়ে এসে আমরা যে শিখ ও ন্যারেশনের প্রতি নতুন আগ্রহ দেখি চিত্রকলায় তা সাবঅল্টার্ন দর্শনের একটি পরিচয়। আমার বিশ্বাস, মাটির মধ্যে জীবন ও কর্মের যে চঞ্চল্য থাকে আমাদের দেশে এবং কেজো মানুষের- খেটে খাওয়া মানুষের- জীবনের যে গতিশীলতা থাকে তা আরো পরিব্যাপ্ত হবে আমাদের সংস্কৃতিতে। এই গতির প্রয়োজন আছে- আমাদের চলচ্চিত্রে গতি নেই, রাজনীতিতে গতি নেই, যোগাযোগে গতি নেই- আছে গতির নামে কোলাহল এবং দুর্ঘটনার আয়োজন। সুস্থ গতি থাকলে চলচিচত্র জীবনমুখী হতো, রাজনীতি দেশমুখী হতো এবং যোগাযোগ গন্তব্যমুখী হতো। রাজনীতি ও যোগাযোগ সংস্কৃতির বলয়ে পড়ে। পড়তে হয়। অতএব রাজনীতি নিয়েও প্রত্যাশা আছে। রাজনীতি গণমুখী ও দেশমুখী হলে তাতে সুস্থতা এবং তারুণ্যের শক্তি সঞ্চারিত হবে।

একুশ শতকে সংস্কৃতির বিশ্বায়ন ঘটবে- এ কথা আমরা এখনি বলতে পারি। তবে পশ্চিম তার খোলা সংস্কৃতি পণ্যের ঝুড়ি নিয়ে ইতোমধ্যেই যে ঝাঁপিয়ে পড়ছে এবং আচ্ছন্ন করে দিচ্ছে আমাদের স্থানীয় সংস্কৃতিগুলোকে তার দাপট বেশিদিন থাকবে না। পশ্চিমা সংস্কৃতি এখনো একটা নতুনত্বের আকর্ষণ নিয়ে আছে- বিশেষ করে যে পারফরমেন্স-নির্ভর ভিডিওবাহিত সংস্কৃতি এখনো জমজমাট, তার আকর্ষণ (বেতারের মতো) পুরোনো হয়ে যাবে, তখন তরুণেরা দৃষ্টি ফেরাবে উৎপাদনের দিকে। সেই উৎপাদনে অনুকরণ এবং অনুসরণ থাকবে- এখন তো প্রচুর পরিমাণে আছে- কিন্তু এক সময় তা কমে যাবে অথবা একেবারে নতুন কিছু তৈরির তাগিদ আসবে। সেই ‘নতুন’ হবে দেশজ। ভিডিও সংস্কৃতির প্রসারে আমি শঙ্কিত নই। উত্তর-ঔপনিবেশী চিন্তায় যে writing back, †h appropriation এর কথা আছে, তার প্রয়োগ শিগ্গিরই ঘটবে- ভারতের ক্ষেত্রে, সেটি ঘটতে শুরু হয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। সংস্কৃতির দেশজ উপাদানত্ব কোনোদিনই বিচ্ছিন্ন বা অবহেলিত হবে না। তার সংযোজন, সমন্বয় ও প্রকাশের বিষয় কী চিত্রকলা, কী চলচ্চিত্র, কী সঙ্গীতে- একটা অবাক করার মতো নতুনত্বে হাজির হতে পারে। সেই সম্ভাবনাটাই বেশি দেখতে পাচ্ছি আমি।

একুশ শতকে প্রচুর মেধাবী তরুণ কাজে নামবে। এই সৃষ্টিশীল তারুণ্যেই হবে আমাদের বড় সহায়। এই তারুণ্য একদিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে, সংস্কৃতির নতুন দিগন্ত তাকে রাখবে কিন্তু পুরাতনের ঋজুতা, আধিপত্যবাদী কেন্দ্রিকতা এবং প্রাণহীন আচারসর্বস্বতাকে চ্যালেঞ্জ করবে, অন্যদিকে উগ্রবাদী-মৌলবাদী ডিসকোর্সকে অর্থহীন করার সংগ্রামে নামবে। উগ্রবাদী ডিসকোর্সের একটি সমস্যা এই যে, এটি কখনো বদলায় না- এর বিষয়-আশয় পরিবর্তনহীন। এজন্য এর আবেদন একুশ শতকেও সীমাবদ্ধ থাকবে। বস্তুত একুশ শতকে উগ্রপন্থায় প্রশিক্ষণরত একটি যুবকের চারদিকে মিডিয়ার প্রতিমুহূর্তে পরিবর্তনশীল ইমেজের যে জগৎটি থাকবে, তাকে সে অস্বীকার করতে পারবে না। যোগাযোগ- যাকে আমি সংস্কৃতির একটি প্রধান উপাদান হিসেবে দেখি- দ্রুত পরিব্যাপ্ত এবং কার্যকর হবে যে ওই যুবকটি যদি নিতান্ত যুদ্ধে নামার মনোবৃত্তি না দেখাতে পারে, তার জন্য অপরিবর্তনশীল, ধ্বংসাত্মক এবং আত্মঅবমাননাকারী একটি মতবাদের দীর্ঘ এবং অবিচলিত মনোসংযোগ ধরে রাখা কঠিন হবে।

সংস্কৃতির গতিশীলতার পাশাপাশি এর নানা উপাদানের পরিব্যাপ্ত ও আকীর্ণ প্রকাশ জীবনের সঙ্গে সংস্কৃতির স¤পৃক্ততাকে আবার তুলে ধরবে। মঙ্গলজনক হবে এই অর্থে যে, সংস্কৃতি বলতে বর্তমানে আমরা যে শুদ্ধ নান্দনিকতা বুঝি, যা জীবন থেকে দূরে বা ঊর্ধ্বে অবস্থিত, যেহেতু তা পরিশীলিত- এই চিন্তাটির অবসান হবে। সংস্কৃতির মূলে সংস্কার বা চর্চার ভূমিকাকে অবশ্যই বড় করে দেখতে হবে, কিন্তু সংস্কৃতি একটি জনগোষ্ঠীর সার্বিক স্টাইলের প্রকাশ। ব্যক্তির যেমন ব্যক্তিত্ব থাকে, জনগোষ্ঠীও তেমনি। এটিই সংস্কৃতি। তাতে কাজ আর অবকাশ আলাদা থাকে না; শিক্ষা ও বিনোদন দুই জিনিস হয় না।

আমি এখুনি দেখতে পাই, আমাদের তরুণদের মধ্যে ব্যক্তিত্বের পালা বদল ঘটছে। তার সাহসী, আত্মপ্রত্যয়ী, অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয় এবং প্রতিবাদী হচ্ছে- কিছু সংখ্যক বিকৃতি বা বিচ্যুতি বাদ দিলেও। আজকের এবং আগামীর বাঙালি সংস্কৃতি- যাতে সঙ্গীত থেকে নিয়ে শস্য বোনার কাজ, নৃত্য থেকে নিয়ে রাজনীতি, নাটক থেকে নিয়ে যোগাযোগ, নৃতত্ত্ব থেকে নিয়ে সমকাল চিন্তা, দর্শন থেকে নিয়ে আত্ম-কর্মসংস্থান সবই অন্তর্ভুক্ত- অত্মপ্রত্যয়ী এবং শক্তিশালী হবে; এই সংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব সচেতন হবে। বর্তমানের ধারা প্রবণতাগুলো তারই সাক্ষ্য দেয়।

৩.

উপরে আমি যে সম্ভাবনা ও প্রত্যাশার কথা বলেছি, তা সংবাদ-এরও। আমি দেখেছি, সংবাদ ক্রমাগত সংস্কৃতির সত্যগুলোর ওপর জোর দিচ্ছে, এর প্রকাশের পথটি সহজ করতে চেষ্টা করছে। সংবাদ শুধু একটি সংবাদপত্র নয় এটি সংস্কৃতির বিকাশে ক্রিয়াশীল একটি চিন্তাপত্রও।