দুর্ভিক্ষের পীড়া ও রবীন্দ্রনাথ

সাদ কামালী

সাধারণের তুলনায় শিল্পী সাহিত্যিক কবি অগ্রবর্তী মানুষ। সমকালের সঙ্কট ও সম্ভাবনার মধ্যে বাস করেও কালিক সীমা অতিক্রমী অগ্রসর চিন্তা, ভিন্ন নৈতিকতা ও মূল্যবোধের সঞ্চার করেন, সমাজকে এগিয়ে নেন। রবীন্দ্রনাথ শুধু দার্শনিক বোধে নয়, ভবিষ্যত সমাজের প্রয়োজন ও বস্তুগত সঙ্কটও গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। যে জন্য হুকুম আদেশ দিয়ে বর্তমান সমস্যার সমাধানের মধ্যে তিনি প্রকৃত সমাধান দেখতে পান না। সমস্যার মূল উৎস থেকে প্রতিকার চান। মানুষ যখন হৃদয় মন ও মগজে উন্নতি ও শ্রেয় বোধের সত্য উপলব্ধি করে সমাধান করতে এগিয়ে আসে তখন সেই সমস্যার প্রকৃত মীমাংসা সহজ হয়। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কবি রবীন্দ্রনাথ ভারতের সম্পদ স্থান ও খাদ্যের তুলনায় জনবৃদ্ধির অধিক হার নিয়ে বিচলিত ছিলেন। অধিকহারে জনবৃদ্ধি ক্ষুধা দারিদ্র্যের কারণ, উন্নয়নের পথে অন্তরায়। জনসংখ্যার অধিক হার তাঁকে প্রধানত বিব্রত করছে জনগণের জীবনে অভাবের আশঙ্কায়। নারীর শরীর স্বাস্থ্য এবং নারীর একান্ত ইচ্ছ তো আছেই। জীবন নির্বাহের প্রয়োজনীয় উপাদানের যোগান না ঘটলে গোটা জাতির ভাগ্যেই জোটে দারিদ্র্যের বিপর্যয়। আমেরিকার মিসেস মার্গারেট স্যাংগারের কাছে লেখা সেই চিঠি অভিমতেও শুধু নারীর শরীর স্বাস্থ্য নয় দেশের স্বাস্থ্যও রুগ্ন হয়ে পড়ে সেই বিষয়ে লেখেন বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে। জন্মনিয়ন্ত্রণ আন্দোলন ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ... “Not only because it will save women from enforced and undesirable maternity, but because it will help the cause of peace by lessening the number of surplus population of a country scrambling for food and space outside its own rightful limits.”

ভারতের উন্নয়ন ও ক্ষুধা দারিদ্র্য নিয়ে রবীন্দ্রনাথের চিন্তা ও বিচলিত মনের খোঁজ মিলে তাঁর যৌবনের প্রথমকালে বীরভূমের দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের মধ্যে সাহায্য প্রদান ও প্রার্থনার অনুষ্ঠানে তাঁর লিখিত ভাষণ পাঠে, গানে। তবে তার আগে পরিণত প্রাজ্ঞ রবীন্দ্রনাথের একটি বিশেষ চিঠি পাঠ অপরিহার্য। জনৈক নীলিমা দাসকে ২ নভেম্বার ১৯৩২-এ লেখা একটি চিঠি। অধিক প্রজননের সঙ্গে দারিদ্র্য, উন্নয়ন ও মুক্তির সম্পর্ক এই চিঠির মূলে। এবং প্রসঙ্গত প্রকাশ পেয়েছে গান্ধীজির কর্মবিধির প্রতি প্রায় প্রত্যক্ষ কটাক্ষ।

“কল্যাণীয়াষু,

অবাধ সন্তান জননের যে দুঃখ দৈন্য অপমান কত, আমাদের চারদিকেই তা দেখতে পাই, প্রমাণ সংগ্রহের জন্যে বেশি গবেষণার দরকার করে না। আমাদের মতো দেশে, যেখানে জীবিকার অন্ন নিতান্তই পরিমিত, সেখানে জীবিতের অতৃপ্ত ক্ষুধার দাবির পরিমাণ থাকবে না, এর চেয়ে নিষ্ঠুরতা আর নেই। উপদেষ্টারা সংযমের পরামর্শ দেন, প্রত্যক্ষ দুঃখও যাদের শিক্ষা দিতে পারে না, মুখের উপদেশে তাদের কী করতে পারে? এ সম্বন্ধে বিশেষভাবে মেয়েদের স্বাস্থ্য শান্তি আত্মসম্মানের প্রতি অনেক সময় কি রকম অসহ্য পীড়ন করা হয়, তার বিস্তর দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় এ সম্বন্ধে যাঁরা সন্ধান করেছেন তাঁদের গ্রন্থে।

এই তো গেল ব্যক্তিগত জীবনের কথা, রাষ্ট্র জাতিগত জীবনের সমস্যা আরো বড়, এই প্রসঙ্গে তাও আলোচ্য। আজকের দিনে পৃথিবীতে যত অশান্তি, যত যুদ্ধ, পররাষ্ট্রের প্রতি যত অন্যায়, তার মূল কারণ অতিপ্রজনন। জাপান মারামারি করে চীনের অধিকার থেকে ম্যাঞ্চুরিয়া কেড়ে নিচ্ছে। অন্যায়, সন্দেহ নেই, কিন্তু জাপানইবা করে কী? তার দ্বীপ কয়টির মধ্যে যতটুকু অন্নের ও বসতির সংস্থান আছে, তাতে জাপানের প্রজাদের আর কুলোয় না। যে সময়ে ইংলন্ডের বহিঃসাম্রাজ্য ছিল না, তার তুলনায় এখন তার অন্নের প্রয়োজন প্রভূত পরিমাণে বেড়ে গেছে। ন্যায়ের দোহাই দিয়ে হাঁক পাড়চি যে, ভারতবর্ষ ছাড়ো, কিন্তু পেটের দোহাই তার চেয়ে প্রবল। এক সময়ে ভারতবর্ষ যে অন্নবস্ত্র উৎপাদন করেছে তাতে তার সচ্ছলভাবে চলে গেল, এখন সেদিনের চেয়ে প্রজাবৃদ্ধি অনেক বেশি হয়েছে; সুতরাং সেদিনকার হিসাব এখন আর খাটে না। দুর্ভিক্ষের দ্বারা অনশনের দ্বারা প্রজাক্ষয় হয়ে সাম্যরক্ষা হবে, একথা বলে নিশ্চেষ্ট থাকা কি মানুষের মতো জীবের কর্তব্য? জন্ম দেবার দুঃখ, পালন করবার দুঃখকে কি অবসান করতে হবে অনশন অনারোগ্য অনাদর অপমানের মৃত্যুতে?

অপর পক্ষেও বলবার কথা আছে, কিন্তু এখন সে আলোচনা নিষ্ফল। যে কালে বৈজ্ঞানিক উপায় আবিষ্কৃত ও সহজলব্ধ হয়নি, সে কালে সকল দুঃখের উপরেও মানুষের প্রবৃত্তি প্রজননে সহায়তা করেছে। এখন যদি উপায় আবিষ্কৃত হয়ে থাকে, তবে মানুষ সহজেই আপন ইচ্ছার কর্তৃত্বের দ্বারাই প্রজনন নিয়ন্ত্রিত করবে। তাতে সংসারে যা কিছু পরিবর্তন আনবে তা অনিবার্য। আমরা শুভবুদ্ধির দোহাই দিই; সেই শুভবুদ্ধিকে তো নির্বাসন দিতে কেউ বলছে না। অর্থাৎ সন্তানজনন যখন প্রবৃত্তির অধীন ছিল তখনও শুভবুদ্ধির যথেষ্ট প্রয়োজন ছিল, সন্তান জনন যখন ইচ্ছাধীন হবে তখনো সেই শুভবুদ্ধির কাজ বন্ধ হয়ে যাবে একথা কেউ বলবে না। সকল অবস্থাতেই মানুষের বিচারবৃদ্ধিই হবে শেষ নিয়ামক। সেই বিচার-বুদ্ধির সাহায্যে সমাজ-সংস্থানকে মানুষ আজ গড়েচে, অবস্থার পরিবর্তন হলে তদনুসারে কালও গড়বে।

ইতি ২ নভেম্বর, ১৯৩২।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথ তখন আদি ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক। সময়টা বাংলা ১২৯১-এর শেষ অর্থাৎ চৈত্র মাস। পরপর দু-বৎসর অনাবৃষ্টির ফলে ১২৯১-র শেষ দিকে বাঁকুড়া বীরভূম ও বর্ধমান জেলার কিয়দংশ ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়। বরাবরের মতো সরকারের সাহায্য পীড়িত মানুষগুলোর ন্যূনতম প্রয়োজনের তুলনায়ও সামান্য। রবীন্দ্রনাথ ওই অঞ্চলের দরিদ্র জনগণের দুঃখ দুর্দশার খবর জানতে পেরে আদি ব্রাহ্মসমাজের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেন দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষগুলোকে সাহায্য করতে, অন্যদের প্রতিও সাহায্যের জন্য আকুল আবেদন করেন। রবীন্দ্রজীবনীকার প্রশান্তকুমার পাল জানাচ্ছেন “... এই অবস্থায় রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে আদি ব্রাহ্মসমাজও নিশ্চেষ্ট থাকে নি। ৩১ চৈত্র (১২৯১) আদি ব্রাহ্মসমাজগৃহে বর্ষশেষ উপাসনার দিনে ‘বীরভূম অঞ্চলে দুর্ভিক্ষপীড়িত লোকদিগকে সাহায্যার্থ’ দান সংগ্রহের জন্য একটি সভার আয়োজন করা হয়।” সভায় ‘দুর্ভিক্ষের সাহায্য প্রার্থী হইয়া’ শিরোনামে আবেগ ও আবেদনময় একটি বক্তব্য পাঠ করেন রবীন্দ্রনাথ। ঠাকুরবাড়ির পক্ষ থেকে রবীন্দ্রনাথ ৫০০ টাকা দান করেন। হৃদয়স্পর্শী ওই আবেদনময় রচনাটি এখনো রবীন্দ্ররচনাবলীতে সংকলিত হয় নি। প্রশান্তকুমার পালসহ গবেষক ও জীবনীকারগণ সম্পূর্ণ ভাষণটি উদ্ধারে সক্ষম হন। তবে রবীন্দ্রনাথ ভাষণটি পাঠের পাঁচ সপ্তাহ পর তত্ত্ব-কৌমুদীতে আংশিক প্রকাশিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তি ও সমাজের আপামর কাছে সহজ সরল ভাষায় সাহায্যের জন্য যে আবেদন করেন তা তাঁর সৃষ্টি সাহিত্যের ভাষণ ও ভঙ্গি থেকে অনেক স্বতন্ত্র, কারণ ওই ভাষণ গভীর আনন্দ ও রসদানের জন্য নয়, ক্ষুধার আর্তি তো সুসংস্কৃতি বা ব্রজবুলি বা রহস্যময় পরাভাষায় সম্ভব নয়। এই আবেদনের কিছু অংশ পড়ে দেখা যাক:

“অধিক দূরে নয়, তোমাদের দ্বারের নিকট ক্ষুধিতেরা দাঁড়াইয়া আছে। তোমরা দুই বেলা যে উচ্ছিষ্ট অন্ন কুক্কুর বিড়ালদের ফেলিয়া দিতেছ, তাহার প্রতি তাহারা কি কাতর দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিয়াছে। তোমাদের নবকুমারের জন্মোপলক্ষে গৃহে কত আনন্দ পড়িয়াছে; আহারাভাবে তাহাদের কোলের ছেলেটির কাঁদিবার শক্তিও নাই; তোমাদের গৃহে বিবাহের বাঁশি বাজিতেছে, কেবল একমুষ্টি অন্নের অভাবে তাহাদের গৃহে বিবাহ-বন্ধন চিরদিনের মতো বিচ্ছিন্ন হইয়া যাইতেছে; স্ত্রীর মুখে অন্ন দিয়া স্বামী তাহার শেষ কর্ত্তব্য সাধন করিতে পারিতেছে না। তোমরা গৃহে বসিয়া নিশ্চিন্তমনে কত কথা লইয়া আলাপ করিতেছ, কত হাস্য-পরিহাস করিতেছ, সংসারের কত শত কাজে মন দিতেছ; তাহাদের আর কোন কথা নাই, কোন ভাবনা নাই, কোন কাজ নাই; তাহাদের জীবনের সমস্ত চিন্তা তাহাদের হৃদয়ের সমস্ত আকাক্সক্ষা, তাহাদের দিনরাত্রির সমস্ত আশা কেবল একটি মুষ্টি অন্নের উপরে বদ্ধ রহিয়াছে। তাহাদের চক্ষে এক্ষণে সমস্ত জগতে একমুষ্টি অন্নের চেয়ে বাঞ্ছনীয় আর কিছুই নাই; একমুষ্টি অন্ন উপার্জনের চেয়ে আর মহত্তর উদ্দেশ্য নাই; এমনকি, সমস্ত জগতে অন্নের অতীত আর কোনো কিছুই নাই।

‘ক্ষুধা যে কী ভয়ানক বিপদ, তাহা আমরা অনেকে কল্পনা করিতে পারি না। অন্যান্য অনেক বিপদে মনুষ্যের মনুষ্যত্ব জাগাইয়া তুলে; কিন্তু ক্ষুধায় মনুষ্যত্ব দূর করিয়া দেয়। ক্ষুধার সময় মনুষ্য অত্যন্ত ক্ষুদ্র। আত্মরক্ষার জন্য যখন একমুষ্টি অন্নাভাবের সহিত মনুষ্যকে যুদ্ধ করিতে হয়, তখন মনুষ্য একটি পিপীলিকার সমতুল্য। সে যুদ্ধেও যখন মনুষ্যের পরাজয় হয়; একমুষ্টি ত-ুলের অভাবেও যখন মনুষ্যজীবনের শত সহস্র মহৎ আশা উদ্দেশ্য ধরাশায়ী হয়, তখন মনুষ্য জাতির দীনতা দেখিয়া হৃদয় হাহাকার করিতে থাকে। ক্ষুধার জ্বালায় বড় ভাই ছোট ভাইয়ের মুখ হইতে তাহার বহু কষ্টের গ্রাস কাড়িয়া লইতে সঙ্কুচিত হয় না; ক্ষুধায় মানুষ অত্যন্ত হীন, ক্ষুধায় কোন মহত্ত্ব নাই। এই ক্ষুধার হাত হইতে কাতরদিগকে পরিত্রাণ কর; এই ক্ষুধায় মানুষদের; আপনার ভাইদের মরিতে দিও না; সে মানুষের পক্ষে অত্যন্ত লজ্জার কথা।

‘তোমার যদি আপনার ভাই থাকে, তবে যাহার ভাই আজ অনাহারে মরিতেছে, তাহার প্রতি একবার মুখ তুলিয়া চাও; তোমার যদি আপনার মা থাকে, তবে অন্নাভাবে মরণাপন্ন মায়ের মুখের দিকে হতাশ হইয়া যে তাকাইয়া আছে, তাহাকে কিছু সাহায্য কর; তোমার যদি নিজের সন্তান থাকে তবে কোলের উপর বসাইয়া যাহার শিশু-সন্তান প্রতিমুহূর্ত্তে শীর্ণ হইয়া মরিতেছে, তোমার উদ্ধৃত [উদ্বৃত্ত] অন্নের কিছু অংশ তাহাকে দাও। সত্যসত্যই তোমার কি কিছুই নাই? যে আজ কয় দিন ধরিয়া কেবল তেঁতুল বীজের শস্য সিদ্ধ করিয়া খাইয়াছে, তাহার চেয়েও কি তুমি নিঃসম্বল? যে আজ তিন দিন ধরিয়া কেবল শুষ্ক ইক্ষুমূল জলে ভিজাইয়া অল্প অল্প চর্ব্বণ করিতেছে, তাহাকেও কি তুমি সাহায্য করিতে পার না? তুমি হয়ত মনে মনে বলিতেছ; “এত শত ধনী আছে তাহারাই যদি দুঃখিদের সাহায্য না করিল ত আমরা আর কি করিব!” এমন কথা বলিও না। যে নিষ্ঠুর সে আপনাকে আপনি বঞ্চিত করিতেছে। যে পাষাণ কোন বেদনাই অনুভব করে না সে নিজের জড়ত্বসুখ লইয়া স্বচ্ছন্দে থাকুক, তাই বলিয়া তাহার দেখাদেখি আপনাকে পাষাণ করিও না! বিলাসসুখ প্রতিদিবসের অন্নপানের ন্যায় যাহার অভ্যাস হইয়াছে যে নিজের সামান্য অনাবশ্যক সুখকে পরের অত্যাবশ্যক অভাবের চেয়ে গুরুতর জ্ঞান করে, সে দুঃখীর মুখের দিকে চায় নাই বলিয়া সকলেই যদি দুঃখীর প্রতি বিমুখ হয়, তবে ত মানবসমাজ রাক্ষসপুরী হইয়া উঠে। হৃদয়হীন বিলাসের ক্রোড়ে যে নিদ্রিত আছে, মহেশ্বরের বজ্রশব্দে যদি একদিন সে জাগিয়া উঠে তবেই তাহার চেতনা হইবে, নতুবা দুঃখী-অনাথের ক্রন্দন ধ্বনিতে তাহার নিদ্রা ভঙ্গ হইবে না।”

খরা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত দুর্ভোগ একটি আপৎকালীন সঙ্কট, এবং এই সঙ্কট মোকাবেলা ও পূর্ব থেকে সতর্কতা অবলম্বনে সরকার ও প্রশাসন সবসময়ই ব্যর্থ। এর পরিণতিতে কিছু মানুষ আর দারিদ্র্যের দশা ঘুচিয়ে উঠতে পারে না। রোগ জ্বরা অশিক্ষা কালে দরিদ্র গোষ্ঠিতে পরিণত করে। রবীন্দ্রনাথের আবেদন তাই সাধারণ মানুষের কাছে। তাদের হৃদয়ে ও বোধ অনুভূতিতে তিনি সাড়া জাগাতে চান। তরুণ বয়স ও অভিজ্ঞতার অপ্রতুলতায় তাঁর ভাষণ হয়তো বেশি আবেগ নির্ভরই ছিল।

কালে প্রাজ্ঞ রবীন্দ্রনাথ সম্পদ ও এর মালিক, রাষ্ট্র ও সাম্রাজ্যবাদের অভিপ্রায় চরিত্র বুঝতে পেরেছেন রাজনীতিকদের চেয়ে আরও স্বচ্ছ ও স্বার্থহীন দৃষ্টিতে। ফলে দারিদ্র্যের ‘root cause’ হিসেবে রবীন্দ্রনাথ একমাত্র অধিক প্রজননকেই দায়ী করছেন না। সাম্রাজ্যবাদ, রাষ্ট্র ও পূজির মালিকের কায়েমি স্বার্থ ও বণিকচরিত্রের ভিতর দারিদ্র্যের প্রকৃত কারণ দেখতে পান। সম্পদের বণ্টনে চূড়ান্ত বৈষম্য তাঁকে পীড়িত করে। ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদ যখন ভারতের বিপুল জনবৃদ্ধিকে দারিদ্র্যের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করতে চায়, তখন কবি রবীন্দ্রনাথ তত্ত্ব ও তন্ত্রের রাজনীতি না করেও দারিদ্র্যের root cause শুধু যে জনসংখ্যা নয় ওই ইংরেজ ও তার এদেশীয় শাসক ও মালিক শ্রেণীর বৈষম্যমূলক আচরণ প্রধানত দায়ী এই সত্য প্রকাশ করতে বিলম্ব করেন না। রবীন্দ্রনাথের এই উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতা অনেকাংশেই আরও স্বচ্ছ রূপ পায় তাঁর রাশিয়া ভ্রমণ শেষে। ১৯৩০-এ ইউরোপ ভ্রমণের এক পর্যায়ে তিনি ১১ সেপ্টেম্বর থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মস্কোতে অবস্থান করে সোভিয়েত রাশিয়ার নানা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ কৃষিজমিও পরিদর্শন করেন। তাঁর সঙ্গী ছিলেন অমিয় চক্রবর্তী, কুমারী মাগর্ট আইনস্টাইন, হ্যারি টির্ম্বাস্, সোমেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং আরিয়াম উইলিয়ম্স্।

ইউরোপ ভ্রমণ এই প্রথম না হলেও রাশিয়া ভ্রমণ ছিল এটাই প্রথম। এবং রাশিয়া ভ্রমণের অভিজ্ঞতা, অভিঘাত রবীন্দ্রনাথের মনে ও চিন্তায় বিশেষ বদল আনে। রাষ্ট্র, সম্পদ, সমবায়, সমাজ, মানুষ ও দারিদ্র্য বিষয়ে তাঁর ভাবনা অব্যবহিত পরে আপনজনকে লিখিত চিঠিগুলোতে পরিষ্কারভাবে ধরা পড়ে। রথীন্দ্রনাথকে লেখা ১৪ অক্টোবর ১৯৩০-এর চিঠিতে আছে, “এবার রাশিয়ার অভিজ্ঞতায় আমাকে গভীরভাবে অনেক কথা ভাবিয়েছে। প্রচুর উপকরণের মধ্যে আত্মসম্মানের যে বিঘ্ন আছে সেটা বেশ স্পষ্ট চোখে দেখতে পেয়েছি।”

আবার ৩১ অক্টোবরেই রথীন্দ্রনাথকে লিখছেন, “জমিদারির অবস্থা লিখেছিস। যেরকম দিন আসছে তাতে জমিদারির উপরে কোনোদিন আর ভরসা রাখা চলবে না। ও জিনিসটার উপর অনেককাল থেকেই আমার মনে মনে ধিক্কার ছিল, এবার সেটা আরও পাকা হয়েছে। যে-সব কথা বহুকাল ভেবেছি এবার রাশিয়ায় তার চেহারা দেখে এলুম, তাই জমিদারি ব্যবসায়ে আমার লজ্জা বোধ হয়। আমার মন আজ উপরের তলার গদি ছেড়ে নিচে এসে বসেছে। দুঃখ এই যে, ছেলেবেলা থেকে পরজীবী হয়ে মানুষ হয়েছি।... জীবনযাত্রাকে গোড়া ঘেঁষে বদল করবার দিন এল, সেটা যেন অনায়াসে প্রসন্ন মনে করতে পারি।”

ইউরোপ ভ্রমণ কালেই তিনি এই চিঠি লিখছিলেন। এর আগে রাশিয়ার বিভিন্ন বিষয় যেমন রাশিয়ার লোকশিক্ষা, রাশিয়ার সব্যব্যাপী নির্ধনতা, রাশিয়ায় সকল মানুষের উন্নতির চেষ্টা, রাশিয়ার শিক্ষাবিধি, শিক্ষাব্যবস্থা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে ১৪টি চিঠি লেখেন রথীন্দ্রনাথ, রাণীচন্দ, প্রশান্ত চন্দ মহলানবিশ, সুরেন্দ্রনাথ কর, আশা অধিকারী, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, কালীমোহন ঘোষ এবং সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে। ২০ সেপ্টেম্বর থেকে ২৮ অক্টোবর সময়ে এই চিঠি নিবন্ধগুলি প্রবাসী অগ্রহায়ণ ১৩৩৭ থেকে চৈত্র ১৩৩৭ পর্যন্ত প্রতি সংখ্যায় প্রকাশ হয়। এর মধ্যে ৮ নম্বর চিঠিটি লিখেছিলেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে। সেই চিঠির সঙ্গে উপসংহার-এর বক্তব্য মিলিয়ে তিনি ‘রাশিয়ার চিঠি’ গ্রন্থের (২৬ বৈশাখ ১৩৩৮) দীর্ঘ ‘উপসংহার’ লেখেন। এই উপসংহারেই আমরা ভারতের দারিদ্র ও তার মূল কারণ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের জোরালো যুক্তি পাঠের সুযোগ পাই। লক্ষণীয়, দারিদ্র্যের root cause উনি কোথায় চিহ্নিত করছেন; ইংরেজ ও দেশীয় শাসকদের সঙ্গে জনমানুষের মধ্যে ‘মহালোভ’ আর ‘মহাসমুদ্রের ব্যবধান’, দুইপারে দারিদ্র্য আর ঐশ্বর্যের ব্যবধানে কি ওই ‘root নিহিত’, ‘রাশিয়ার চিঠি’র উপসংহারের এই উপলব্ধির কিছু অংশ রবীন্দ্রনাথের লেখাতেই পড়া যাক:

“টাইম্স্-এর সাহিত্যিক ক্রোড়পত্রে দেখা গেল ম্যাকি নামক এক লেখক বলেছেন যে, ভারতে দারিদ্র্যের root cause [বা] মূল কারণ হচ্ছে, এ দেশে নির্বিচার বিবাহের ফলে অতিপ্রজনন। কথাটার ভিতরকার ভাবটা এই যে, বাহির থেকে যে শোষণ চলছে তা দুঃসহ হত না যদি স্বল্প অন্ন নিয়ে স্বল্প লোকে হাঁড়ি চেঁচে-পুঁছে খেত। শুনতে পাই, ইংলন্ডে ১৮৭১ খৃষ্টাব্দ থেকে ১৯২১ খৃষ্টাব্দের মধ্যে শতকরা ৬৬ সংখ্যা হারে প্রজাবৃদ্ধি হয়েছে। ভারতবর্ষে পঞ্চাশ বৎসরের প্রজাবৃদ্ধির হার শতকরা ৩৩। তবে এক যাত্রায় পৃথক ফল হল কেন। অতএব দেখা যাচ্ছে root cause প্রজাবৃদ্ধি নয়, root cause অন্নসংস্থানের অভাব। তারও root কোথায়!

দেশ যারা শাসন করছে আর যে প্রজারা শাসিত হচ্ছে তাদের ভাগ্য যদি এককক্ষবর্তী হয় তা হলে অন্তত অন্নের দিক থেকে নালিশের কথা থাকে না, অর্থাৎ সুভিক্ষে দুর্ভিক্ষে উভয়ের ভাগ প্রায় সমান হয়ে থাকে। কিন্তু যেখানে কৃষ্ণপক্ষ ও শুক্লপক্ষের মাঝখানে মহালোভ ও মহাসমুদ্রের ব্যবধান সেখানে অমাবস্যার তরফে বিদ্যাস্বাস্থ্যসম্মানসম্পদের কৃপণতা ঘুচতে চায় না, অথচ নিশীথরাত্রির চৌকিদারদের হাতে বৃষচক্ষু লণ্ঠনের আয়োজন বেড়ে চলে। এ কথা হিসাব করে দেখতে স্ট্যাটিস্টিক্সের খুব বেশি খিটিমিটির দরকার হয় না, আজ একশো ষাট বৎসর ধরে ভারতের পক্ষে সর্ববিষয়ে দারিদ্র্য ও ব্রিটেনের পক্ষে সর্ববিষয়ে ঐশ্বর্য পিঠোপিঠি সংলগ্ন হয়ে আছে। এর যদি একটি সম্পূর্ণ ছবি আঁকতে চাই তবে বাংলাদেশের যে চাষী পাট উৎপন্ন করে আর সুদূর ডা-িতে যারা তার মুনফা ভোগ করে উভয়ের জীবনযাত্রার দৃশ্য পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে দেখতে হয়। উভয়ের মধ্যে যোগ আছে লোভের, বিচ্ছেদ আছে ভোগের; এই বিভাগ দেড়শো বছরে বাড়ল বৈ কমল না।

...কিন্তু ভারতের যে ধনে বিদেশী বণিক বা রাজপুরুষেরা ধনী তার ন্যূনতম উচ্ছিষ্টমাত্রই ভারতের ভাগে পড়ে। পাটের চাষীর শিক্ষার জন্যে, স্বাস্থের জন্যে সুগভীর অভাবগুলো অনাবৃষ্টির নালাডোবার মতো হাঁ করে রইল, বিদেশগামী মুনফা থেকে তার দিকে কিছুই ফিরল না। যা গেল তা নিঃশেষে গেল। পাটের মুনফা সম্ভবপর করবার জন্যে গ্রামের জলাশয়গুলি দূষিত হলো- এই অসহ্য জলকষ্ট নিবারণের উদ্দেশে বিদেশী মহাজনদের ভরা থলি থেকে এক পয়সা খসল না। যদি জলের ব্যবস্থা করতে হয় তবে তার সমস্ত ট্যাক্সের টান এই নিঃস্ব নিরন্নদের রক্তের উপরই পড়ে। সাধারণকে শিক্ষা দেবার জন্যে রাজকোষে টাকা নেই; কেন নেই। তার প্রধান কারণ, প্রভূত পরিমাণ টাকা ভারতবর্ষকে সম্পূর্ণই ত্যাগ করে চলে যায়; এ হল লোভের টাকা, যাতে করে আপন টাকা ষোলো-আনাই পর হয়ে যায়। অর্থাৎ জল উবে যায় এ পারের জলাশয়ে আর মেঘ হয়ে তার বর্ষণ হতে থাকে ও পারের দেশে। সে দেশের হাসপাতালে বিদ্যালয়ে এই হতভাগ্য অশিক্ষিত অসুস্থ মুমূর্ষু ভারতবর্ষ সুদীর্ঘকাল অপ্রত্যক্ষভাবে রসদ জুগিয়ে আসছে।

দেশের লোকের দৈহিক ও মানসিক অবস্থার চরম দুঃখদৃশ্য অনেককাল স্বচক্ষে দেখে আসছি। দারিদ্র্যে মানুষ কেবল যে মরে তা নয়, নিজেকে অবজ্ঞার যোগ্য করে তোলে। তাই স্যার জন সাইমন বললেন যে : ‘In our view the most formidable of the evils from which India is suffering have their roots in social and economic customs of longstanding which can only be remedied by the action of the Indian people themselves.’

এটা হলো অবজ্ঞার কথা। ভারতের প্রয়োজনকে তিনি যে আদর্শ থেকে বিচার করছেন সেটা তাঁদের নিজেদের আদর্শ নয়। প্রচুর ধন-উৎপাদনের জন্যে যে অবারিত শিক্ষা, যে সুযোগ, যে স্বাধীনতা তাঁদের নিজেদের আছে, যে-সমস্ত সুবিধা থাকাতে তাঁদের জীবনযাত্রার আদর্শ জ্ঞানে কর্মে ভোগে নানা দিক থেকে প্রভূত পরিমাণে পরিপুষ্ট হতে পেরেছে, জীর্ণবস্ত্র শীর্ণতনু, রোগক্লান্ত শিক্ষাবঞ্চিত ভারতের পক্ষে সে আদর্শ তারা কল্পনার মধ্যেই আনেন না।”

‘রাশিয়ার চিঠি’ সম্পর্কে একটি তথ্য এখানে উল্লেখ করতে হয়, রবীন্দ্রনাথের কোনো বাংলা গ্রন্থ বৃটিশ সরকার নিষিদ্ধ করেনি, যদিও নজরুল ইসলামের একাধিক এবং শরৎচন্দ্রের পথের দাবির মতো উপন্যাস নিষিদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু বৃটিশ সরকার ‘রাশিয়ার চিঠি’র প্রথম ইংরেজি কিস্তিটি ‘On Russia’ নামে ‘গModern Review’ পত্রিকায় ১৯৩৪ সালের জুন মাসে প্রকাশিত হওয়ার পরপরই ব্রিটিশ সরকার তার প্রকাশনা নিষিদ্ধ করে দেয়। বাংলা বা ভারতে এ নিয়ে তেমন প্রতিবাদ, আন্দোলন হয়নি, তবে যখন ইংল্যান্ডের ‘Times’ পত্রিকার ১৩ নভেম্বর ১৯৩৪ সংখ্যায় ‘On Russia’ নিষিদ্ধকরণ নিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেণ্ট যে প্রশ্নোত্তর হয় তা প্রকাশ হলে কলকাতার পত্রিকাগুলোতে তখনো ‘বিবৃতি’র অতি নগন্ন প্রতিবাদের বাইরে কোনো প্রতিবাদ চোখে পড়ল না। মজার ব্যাপার ১৯৩৭ থেকে ’৪১ সালের মধ্যে শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’সহ নজরুল এবং আরও কয়েকজন লেখকের বইয়ের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হলেও রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় ‘On Russia’ থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয় না। এবং ওই ১৯৩৭ সালে যখন কংগ্রেস ৬/৭টি প্রদেশের মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করে তখনও কংগ্রেস বা মহাত্মা গান্ধী ওই নিষেধাজ্ঞা তুলতে কোনো চেষ্টা করেনি। শেষ পর্যন্ত ১৯৬০ সালে প্রথম রাশিয়ার চিঠি গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ ‘Letters from Russia’ বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ থেকে প্রকাশিত হয়। এই খবরগুলো প্রথম নেপাল মজুমদারের ‘রবীন্দ্রনাথ: কয়েকটি রাজনীতিক প্রসঙ্গ’ গ্রন্থে (১৯৮৭) নানাভাবে ছড়িয়ে আছে।

রবীন্দ্রনাথের কৃষিভাবনা, শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠা, গবেষণা, রথীন্দ্রনাথকে আমেরিকা পাঠিয়ে কৃষি বিষয়ে পড়ানো সব কিছুর মূলেই নিহিত ছিল দরিদ্র কৃষক প্রজার দারিদ্র্যমুক্তি। কবি হয়তো কৃষি প্রকল্পে তেমন সফল হলেন না, কিন্তু কৃষি নিয়ে বিস্তর কর্মযজ্ঞে কবির খেয়াল বা কৌতূহল ছিল না, ছিল আসল প্রচেষ্টা, প্রকৃত বিনিয়োগ সময় ও অর্থের। কিশোর কবির মাথায় একদা কৌতূহল জন্মেছিল যেমন ফুলের রস দিয়ে কবিতা লিখবে। কবির আব্দার মতো ‘প্রধান সহায়’ নতুন দাদা (জ্যোতিরিন্দ্রনাথ) কল বসিয়ে ফুলের রস বের করে এনে বললেন, নেও এখন লেখ। লেখা হয় না ফুলের রসে, তার রঙ রসে তো গাঢ় হয়ে থাকে না। তাঁর কৃষি প্রচেষ্টা কোনো কৈশরিক হেঁয়ালি অবশ্য আর কেউ ভাবে না। দিনে দিনে এও ভাবতে শিখছে নিন্দুকেরা; এ কোনো জমিদারি ঠাঁটও ছিল না; এ ছিল মানুষ রবীন্দ্রনাথের অন্যের মানবেতর জীবন থেকে মুক্তি ঘটানোর চেষ্টা। তবে এই গ্রন্থে বহু আলোচিত তাঁর কৃষিভাবনা নিয়ে বিস্তর আলোচনা না করলেও চলবে। তাঁর আলু চাষ আর নতুন ধান নিয়ে অনেক লেখা আছে। বিলেতি সাহেব এলমহাস্টের কৃষি ও পল্লীসমাজ উন্নয়ন প্রকল্পে শারীরিক ও আর্থিক সাহায্য সহযোগিতার কথাও সেই সঙ্গে আছে। পূর্বে উল্লেখ এককালীন এক লক্ষ চুয়ান্ন হাজার টাকা সঙ্গে নিয়ে এলমহাস্ট শান্তি নিকেতনে এলেন, এরপরও আরও ২৫ বছর বছরে বছরে পঞ্চাশ হাজার টাকা করে এলমহাস্টের স্ত্রী ডরোথি স্ট্রেট শ্রীনিকেতনে প্রদান করেছেন।

image
আরও খবর
বাংলা নামের প্রথম দৈনিক
বাংলাদেশকেও সাবধানে পা ফেলতে হবে
নির্মলেন্দু গুণের কবিতা
সংবাদ এবং আমার শৈশব
আমার বাতিঘর
শিক্ষার বিবর্তন কিংবা বিবর্তনের শিক্ষা
নয়া মাধ্যম: মিডিয়া ডায়েট ব্যক্তির স্বাধীনতা
সংবাদ-এর ঐতিহ্যিক ধারাবাহিকতা
চলছে লড়াই, চলবে লড়াই
গণমাধ্যমের শক্তি ১৯৭১
সংবাদ ও রণেশ দাশগুপ্ত
আমার ‘সংবাদ’
দৈনিক সংবাদ আমার প্রতিষ্ঠান
বিভাগোত্তর কালে দুই বাংলায় গণমাধ্যমের বিবর্তন
সংবাদ ও অর্থনীতি
ভবিষ্যতের গণমাধ্যম গণমাধ্যমের ভবিষ্যৎ
মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতা
দুটি কবিতা : আহমদ সলীম
গোলাম কিবরিয়া পিনু
সাতচল্লিশ পরবর্তী বাংলা গানের বিবর্তন
নারীর মনোজগৎ: আমাদের বিভ্রম ও কল্পকাহিনী
নতুন সময়ের গণমাধ্যম
‘সংবাদ’ শুধু একটি সংবাদপত্র নয়
গৌরব এবং গর্বের সংবাদ
গণমাধ্যম কেবল আশার স্বপ্ন নয়
গণমানুষের নিজের পত্রিকা ‘সংবাদ’
মুক্তিযুদ্ধ ও সাংবাদিকতা
মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িকতা

বুধবার, ০৩ আগস্ট ২০২২

দুর্ভিক্ষের পীড়া ও রবীন্দ্রনাথ

সাদ কামালী

image

সাধারণের তুলনায় শিল্পী সাহিত্যিক কবি অগ্রবর্তী মানুষ। সমকালের সঙ্কট ও সম্ভাবনার মধ্যে বাস করেও কালিক সীমা অতিক্রমী অগ্রসর চিন্তা, ভিন্ন নৈতিকতা ও মূল্যবোধের সঞ্চার করেন, সমাজকে এগিয়ে নেন। রবীন্দ্রনাথ শুধু দার্শনিক বোধে নয়, ভবিষ্যত সমাজের প্রয়োজন ও বস্তুগত সঙ্কটও গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। যে জন্য হুকুম আদেশ দিয়ে বর্তমান সমস্যার সমাধানের মধ্যে তিনি প্রকৃত সমাধান দেখতে পান না। সমস্যার মূল উৎস থেকে প্রতিকার চান। মানুষ যখন হৃদয় মন ও মগজে উন্নতি ও শ্রেয় বোধের সত্য উপলব্ধি করে সমাধান করতে এগিয়ে আসে তখন সেই সমস্যার প্রকৃত মীমাংসা সহজ হয়। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কবি রবীন্দ্রনাথ ভারতের সম্পদ স্থান ও খাদ্যের তুলনায় জনবৃদ্ধির অধিক হার নিয়ে বিচলিত ছিলেন। অধিকহারে জনবৃদ্ধি ক্ষুধা দারিদ্র্যের কারণ, উন্নয়নের পথে অন্তরায়। জনসংখ্যার অধিক হার তাঁকে প্রধানত বিব্রত করছে জনগণের জীবনে অভাবের আশঙ্কায়। নারীর শরীর স্বাস্থ্য এবং নারীর একান্ত ইচ্ছ তো আছেই। জীবন নির্বাহের প্রয়োজনীয় উপাদানের যোগান না ঘটলে গোটা জাতির ভাগ্যেই জোটে দারিদ্র্যের বিপর্যয়। আমেরিকার মিসেস মার্গারেট স্যাংগারের কাছে লেখা সেই চিঠি অভিমতেও শুধু নারীর শরীর স্বাস্থ্য নয় দেশের স্বাস্থ্যও রুগ্ন হয়ে পড়ে সেই বিষয়ে লেখেন বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে। জন্মনিয়ন্ত্রণ আন্দোলন ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ... “Not only because it will save women from enforced and undesirable maternity, but because it will help the cause of peace by lessening the number of surplus population of a country scrambling for food and space outside its own rightful limits.”

ভারতের উন্নয়ন ও ক্ষুধা দারিদ্র্য নিয়ে রবীন্দ্রনাথের চিন্তা ও বিচলিত মনের খোঁজ মিলে তাঁর যৌবনের প্রথমকালে বীরভূমের দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের মধ্যে সাহায্য প্রদান ও প্রার্থনার অনুষ্ঠানে তাঁর লিখিত ভাষণ পাঠে, গানে। তবে তার আগে পরিণত প্রাজ্ঞ রবীন্দ্রনাথের একটি বিশেষ চিঠি পাঠ অপরিহার্য। জনৈক নীলিমা দাসকে ২ নভেম্বার ১৯৩২-এ লেখা একটি চিঠি। অধিক প্রজননের সঙ্গে দারিদ্র্য, উন্নয়ন ও মুক্তির সম্পর্ক এই চিঠির মূলে। এবং প্রসঙ্গত প্রকাশ পেয়েছে গান্ধীজির কর্মবিধির প্রতি প্রায় প্রত্যক্ষ কটাক্ষ।

“কল্যাণীয়াষু,

অবাধ সন্তান জননের যে দুঃখ দৈন্য অপমান কত, আমাদের চারদিকেই তা দেখতে পাই, প্রমাণ সংগ্রহের জন্যে বেশি গবেষণার দরকার করে না। আমাদের মতো দেশে, যেখানে জীবিকার অন্ন নিতান্তই পরিমিত, সেখানে জীবিতের অতৃপ্ত ক্ষুধার দাবির পরিমাণ থাকবে না, এর চেয়ে নিষ্ঠুরতা আর নেই। উপদেষ্টারা সংযমের পরামর্শ দেন, প্রত্যক্ষ দুঃখও যাদের শিক্ষা দিতে পারে না, মুখের উপদেশে তাদের কী করতে পারে? এ সম্বন্ধে বিশেষভাবে মেয়েদের স্বাস্থ্য শান্তি আত্মসম্মানের প্রতি অনেক সময় কি রকম অসহ্য পীড়ন করা হয়, তার বিস্তর দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় এ সম্বন্ধে যাঁরা সন্ধান করেছেন তাঁদের গ্রন্থে।

এই তো গেল ব্যক্তিগত জীবনের কথা, রাষ্ট্র জাতিগত জীবনের সমস্যা আরো বড়, এই প্রসঙ্গে তাও আলোচ্য। আজকের দিনে পৃথিবীতে যত অশান্তি, যত যুদ্ধ, পররাষ্ট্রের প্রতি যত অন্যায়, তার মূল কারণ অতিপ্রজনন। জাপান মারামারি করে চীনের অধিকার থেকে ম্যাঞ্চুরিয়া কেড়ে নিচ্ছে। অন্যায়, সন্দেহ নেই, কিন্তু জাপানইবা করে কী? তার দ্বীপ কয়টির মধ্যে যতটুকু অন্নের ও বসতির সংস্থান আছে, তাতে জাপানের প্রজাদের আর কুলোয় না। যে সময়ে ইংলন্ডের বহিঃসাম্রাজ্য ছিল না, তার তুলনায় এখন তার অন্নের প্রয়োজন প্রভূত পরিমাণে বেড়ে গেছে। ন্যায়ের দোহাই দিয়ে হাঁক পাড়চি যে, ভারতবর্ষ ছাড়ো, কিন্তু পেটের দোহাই তার চেয়ে প্রবল। এক সময়ে ভারতবর্ষ যে অন্নবস্ত্র উৎপাদন করেছে তাতে তার সচ্ছলভাবে চলে গেল, এখন সেদিনের চেয়ে প্রজাবৃদ্ধি অনেক বেশি হয়েছে; সুতরাং সেদিনকার হিসাব এখন আর খাটে না। দুর্ভিক্ষের দ্বারা অনশনের দ্বারা প্রজাক্ষয় হয়ে সাম্যরক্ষা হবে, একথা বলে নিশ্চেষ্ট থাকা কি মানুষের মতো জীবের কর্তব্য? জন্ম দেবার দুঃখ, পালন করবার দুঃখকে কি অবসান করতে হবে অনশন অনারোগ্য অনাদর অপমানের মৃত্যুতে?

অপর পক্ষেও বলবার কথা আছে, কিন্তু এখন সে আলোচনা নিষ্ফল। যে কালে বৈজ্ঞানিক উপায় আবিষ্কৃত ও সহজলব্ধ হয়নি, সে কালে সকল দুঃখের উপরেও মানুষের প্রবৃত্তি প্রজননে সহায়তা করেছে। এখন যদি উপায় আবিষ্কৃত হয়ে থাকে, তবে মানুষ সহজেই আপন ইচ্ছার কর্তৃত্বের দ্বারাই প্রজনন নিয়ন্ত্রিত করবে। তাতে সংসারে যা কিছু পরিবর্তন আনবে তা অনিবার্য। আমরা শুভবুদ্ধির দোহাই দিই; সেই শুভবুদ্ধিকে তো নির্বাসন দিতে কেউ বলছে না। অর্থাৎ সন্তানজনন যখন প্রবৃত্তির অধীন ছিল তখনও শুভবুদ্ধির যথেষ্ট প্রয়োজন ছিল, সন্তান জনন যখন ইচ্ছাধীন হবে তখনো সেই শুভবুদ্ধির কাজ বন্ধ হয়ে যাবে একথা কেউ বলবে না। সকল অবস্থাতেই মানুষের বিচারবৃদ্ধিই হবে শেষ নিয়ামক। সেই বিচার-বুদ্ধির সাহায্যে সমাজ-সংস্থানকে মানুষ আজ গড়েচে, অবস্থার পরিবর্তন হলে তদনুসারে কালও গড়বে।

ইতি ২ নভেম্বর, ১৯৩২।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথ তখন আদি ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক। সময়টা বাংলা ১২৯১-এর শেষ অর্থাৎ চৈত্র মাস। পরপর দু-বৎসর অনাবৃষ্টির ফলে ১২৯১-র শেষ দিকে বাঁকুড়া বীরভূম ও বর্ধমান জেলার কিয়দংশ ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়। বরাবরের মতো সরকারের সাহায্য পীড়িত মানুষগুলোর ন্যূনতম প্রয়োজনের তুলনায়ও সামান্য। রবীন্দ্রনাথ ওই অঞ্চলের দরিদ্র জনগণের দুঃখ দুর্দশার খবর জানতে পেরে আদি ব্রাহ্মসমাজের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেন দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষগুলোকে সাহায্য করতে, অন্যদের প্রতিও সাহায্যের জন্য আকুল আবেদন করেন। রবীন্দ্রজীবনীকার প্রশান্তকুমার পাল জানাচ্ছেন “... এই অবস্থায় রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে আদি ব্রাহ্মসমাজও নিশ্চেষ্ট থাকে নি। ৩১ চৈত্র (১২৯১) আদি ব্রাহ্মসমাজগৃহে বর্ষশেষ উপাসনার দিনে ‘বীরভূম অঞ্চলে দুর্ভিক্ষপীড়িত লোকদিগকে সাহায্যার্থ’ দান সংগ্রহের জন্য একটি সভার আয়োজন করা হয়।” সভায় ‘দুর্ভিক্ষের সাহায্য প্রার্থী হইয়া’ শিরোনামে আবেগ ও আবেদনময় একটি বক্তব্য পাঠ করেন রবীন্দ্রনাথ। ঠাকুরবাড়ির পক্ষ থেকে রবীন্দ্রনাথ ৫০০ টাকা দান করেন। হৃদয়স্পর্শী ওই আবেদনময় রচনাটি এখনো রবীন্দ্ররচনাবলীতে সংকলিত হয় নি। প্রশান্তকুমার পালসহ গবেষক ও জীবনীকারগণ সম্পূর্ণ ভাষণটি উদ্ধারে সক্ষম হন। তবে রবীন্দ্রনাথ ভাষণটি পাঠের পাঁচ সপ্তাহ পর তত্ত্ব-কৌমুদীতে আংশিক প্রকাশিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তি ও সমাজের আপামর কাছে সহজ সরল ভাষায় সাহায্যের জন্য যে আবেদন করেন তা তাঁর সৃষ্টি সাহিত্যের ভাষণ ও ভঙ্গি থেকে অনেক স্বতন্ত্র, কারণ ওই ভাষণ গভীর আনন্দ ও রসদানের জন্য নয়, ক্ষুধার আর্তি তো সুসংস্কৃতি বা ব্রজবুলি বা রহস্যময় পরাভাষায় সম্ভব নয়। এই আবেদনের কিছু অংশ পড়ে দেখা যাক:

“অধিক দূরে নয়, তোমাদের দ্বারের নিকট ক্ষুধিতেরা দাঁড়াইয়া আছে। তোমরা দুই বেলা যে উচ্ছিষ্ট অন্ন কুক্কুর বিড়ালদের ফেলিয়া দিতেছ, তাহার প্রতি তাহারা কি কাতর দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিয়াছে। তোমাদের নবকুমারের জন্মোপলক্ষে গৃহে কত আনন্দ পড়িয়াছে; আহারাভাবে তাহাদের কোলের ছেলেটির কাঁদিবার শক্তিও নাই; তোমাদের গৃহে বিবাহের বাঁশি বাজিতেছে, কেবল একমুষ্টি অন্নের অভাবে তাহাদের গৃহে বিবাহ-বন্ধন চিরদিনের মতো বিচ্ছিন্ন হইয়া যাইতেছে; স্ত্রীর মুখে অন্ন দিয়া স্বামী তাহার শেষ কর্ত্তব্য সাধন করিতে পারিতেছে না। তোমরা গৃহে বসিয়া নিশ্চিন্তমনে কত কথা লইয়া আলাপ করিতেছ, কত হাস্য-পরিহাস করিতেছ, সংসারের কত শত কাজে মন দিতেছ; তাহাদের আর কোন কথা নাই, কোন ভাবনা নাই, কোন কাজ নাই; তাহাদের জীবনের সমস্ত চিন্তা তাহাদের হৃদয়ের সমস্ত আকাক্সক্ষা, তাহাদের দিনরাত্রির সমস্ত আশা কেবল একটি মুষ্টি অন্নের উপরে বদ্ধ রহিয়াছে। তাহাদের চক্ষে এক্ষণে সমস্ত জগতে একমুষ্টি অন্নের চেয়ে বাঞ্ছনীয় আর কিছুই নাই; একমুষ্টি অন্ন উপার্জনের চেয়ে আর মহত্তর উদ্দেশ্য নাই; এমনকি, সমস্ত জগতে অন্নের অতীত আর কোনো কিছুই নাই।

‘ক্ষুধা যে কী ভয়ানক বিপদ, তাহা আমরা অনেকে কল্পনা করিতে পারি না। অন্যান্য অনেক বিপদে মনুষ্যের মনুষ্যত্ব জাগাইয়া তুলে; কিন্তু ক্ষুধায় মনুষ্যত্ব দূর করিয়া দেয়। ক্ষুধার সময় মনুষ্য অত্যন্ত ক্ষুদ্র। আত্মরক্ষার জন্য যখন একমুষ্টি অন্নাভাবের সহিত মনুষ্যকে যুদ্ধ করিতে হয়, তখন মনুষ্য একটি পিপীলিকার সমতুল্য। সে যুদ্ধেও যখন মনুষ্যের পরাজয় হয়; একমুষ্টি ত-ুলের অভাবেও যখন মনুষ্যজীবনের শত সহস্র মহৎ আশা উদ্দেশ্য ধরাশায়ী হয়, তখন মনুষ্য জাতির দীনতা দেখিয়া হৃদয় হাহাকার করিতে থাকে। ক্ষুধার জ্বালায় বড় ভাই ছোট ভাইয়ের মুখ হইতে তাহার বহু কষ্টের গ্রাস কাড়িয়া লইতে সঙ্কুচিত হয় না; ক্ষুধায় মানুষ অত্যন্ত হীন, ক্ষুধায় কোন মহত্ত্ব নাই। এই ক্ষুধার হাত হইতে কাতরদিগকে পরিত্রাণ কর; এই ক্ষুধায় মানুষদের; আপনার ভাইদের মরিতে দিও না; সে মানুষের পক্ষে অত্যন্ত লজ্জার কথা।

‘তোমার যদি আপনার ভাই থাকে, তবে যাহার ভাই আজ অনাহারে মরিতেছে, তাহার প্রতি একবার মুখ তুলিয়া চাও; তোমার যদি আপনার মা থাকে, তবে অন্নাভাবে মরণাপন্ন মায়ের মুখের দিকে হতাশ হইয়া যে তাকাইয়া আছে, তাহাকে কিছু সাহায্য কর; তোমার যদি নিজের সন্তান থাকে তবে কোলের উপর বসাইয়া যাহার শিশু-সন্তান প্রতিমুহূর্ত্তে শীর্ণ হইয়া মরিতেছে, তোমার উদ্ধৃত [উদ্বৃত্ত] অন্নের কিছু অংশ তাহাকে দাও। সত্যসত্যই তোমার কি কিছুই নাই? যে আজ কয় দিন ধরিয়া কেবল তেঁতুল বীজের শস্য সিদ্ধ করিয়া খাইয়াছে, তাহার চেয়েও কি তুমি নিঃসম্বল? যে আজ তিন দিন ধরিয়া কেবল শুষ্ক ইক্ষুমূল জলে ভিজাইয়া অল্প অল্প চর্ব্বণ করিতেছে, তাহাকেও কি তুমি সাহায্য করিতে পার না? তুমি হয়ত মনে মনে বলিতেছ; “এত শত ধনী আছে তাহারাই যদি দুঃখিদের সাহায্য না করিল ত আমরা আর কি করিব!” এমন কথা বলিও না। যে নিষ্ঠুর সে আপনাকে আপনি বঞ্চিত করিতেছে। যে পাষাণ কোন বেদনাই অনুভব করে না সে নিজের জড়ত্বসুখ লইয়া স্বচ্ছন্দে থাকুক, তাই বলিয়া তাহার দেখাদেখি আপনাকে পাষাণ করিও না! বিলাসসুখ প্রতিদিবসের অন্নপানের ন্যায় যাহার অভ্যাস হইয়াছে যে নিজের সামান্য অনাবশ্যক সুখকে পরের অত্যাবশ্যক অভাবের চেয়ে গুরুতর জ্ঞান করে, সে দুঃখীর মুখের দিকে চায় নাই বলিয়া সকলেই যদি দুঃখীর প্রতি বিমুখ হয়, তবে ত মানবসমাজ রাক্ষসপুরী হইয়া উঠে। হৃদয়হীন বিলাসের ক্রোড়ে যে নিদ্রিত আছে, মহেশ্বরের বজ্রশব্দে যদি একদিন সে জাগিয়া উঠে তবেই তাহার চেতনা হইবে, নতুবা দুঃখী-অনাথের ক্রন্দন ধ্বনিতে তাহার নিদ্রা ভঙ্গ হইবে না।”

খরা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত দুর্ভোগ একটি আপৎকালীন সঙ্কট, এবং এই সঙ্কট মোকাবেলা ও পূর্ব থেকে সতর্কতা অবলম্বনে সরকার ও প্রশাসন সবসময়ই ব্যর্থ। এর পরিণতিতে কিছু মানুষ আর দারিদ্র্যের দশা ঘুচিয়ে উঠতে পারে না। রোগ জ্বরা অশিক্ষা কালে দরিদ্র গোষ্ঠিতে পরিণত করে। রবীন্দ্রনাথের আবেদন তাই সাধারণ মানুষের কাছে। তাদের হৃদয়ে ও বোধ অনুভূতিতে তিনি সাড়া জাগাতে চান। তরুণ বয়স ও অভিজ্ঞতার অপ্রতুলতায় তাঁর ভাষণ হয়তো বেশি আবেগ নির্ভরই ছিল।

কালে প্রাজ্ঞ রবীন্দ্রনাথ সম্পদ ও এর মালিক, রাষ্ট্র ও সাম্রাজ্যবাদের অভিপ্রায় চরিত্র বুঝতে পেরেছেন রাজনীতিকদের চেয়ে আরও স্বচ্ছ ও স্বার্থহীন দৃষ্টিতে। ফলে দারিদ্র্যের ‘root cause’ হিসেবে রবীন্দ্রনাথ একমাত্র অধিক প্রজননকেই দায়ী করছেন না। সাম্রাজ্যবাদ, রাষ্ট্র ও পূজির মালিকের কায়েমি স্বার্থ ও বণিকচরিত্রের ভিতর দারিদ্র্যের প্রকৃত কারণ দেখতে পান। সম্পদের বণ্টনে চূড়ান্ত বৈষম্য তাঁকে পীড়িত করে। ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদ যখন ভারতের বিপুল জনবৃদ্ধিকে দারিদ্র্যের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করতে চায়, তখন কবি রবীন্দ্রনাথ তত্ত্ব ও তন্ত্রের রাজনীতি না করেও দারিদ্র্যের root cause শুধু যে জনসংখ্যা নয় ওই ইংরেজ ও তার এদেশীয় শাসক ও মালিক শ্রেণীর বৈষম্যমূলক আচরণ প্রধানত দায়ী এই সত্য প্রকাশ করতে বিলম্ব করেন না। রবীন্দ্রনাথের এই উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতা অনেকাংশেই আরও স্বচ্ছ রূপ পায় তাঁর রাশিয়া ভ্রমণ শেষে। ১৯৩০-এ ইউরোপ ভ্রমণের এক পর্যায়ে তিনি ১১ সেপ্টেম্বর থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মস্কোতে অবস্থান করে সোভিয়েত রাশিয়ার নানা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ কৃষিজমিও পরিদর্শন করেন। তাঁর সঙ্গী ছিলেন অমিয় চক্রবর্তী, কুমারী মাগর্ট আইনস্টাইন, হ্যারি টির্ম্বাস্, সোমেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং আরিয়াম উইলিয়ম্স্।

ইউরোপ ভ্রমণ এই প্রথম না হলেও রাশিয়া ভ্রমণ ছিল এটাই প্রথম। এবং রাশিয়া ভ্রমণের অভিজ্ঞতা, অভিঘাত রবীন্দ্রনাথের মনে ও চিন্তায় বিশেষ বদল আনে। রাষ্ট্র, সম্পদ, সমবায়, সমাজ, মানুষ ও দারিদ্র্য বিষয়ে তাঁর ভাবনা অব্যবহিত পরে আপনজনকে লিখিত চিঠিগুলোতে পরিষ্কারভাবে ধরা পড়ে। রথীন্দ্রনাথকে লেখা ১৪ অক্টোবর ১৯৩০-এর চিঠিতে আছে, “এবার রাশিয়ার অভিজ্ঞতায় আমাকে গভীরভাবে অনেক কথা ভাবিয়েছে। প্রচুর উপকরণের মধ্যে আত্মসম্মানের যে বিঘ্ন আছে সেটা বেশ স্পষ্ট চোখে দেখতে পেয়েছি।”

আবার ৩১ অক্টোবরেই রথীন্দ্রনাথকে লিখছেন, “জমিদারির অবস্থা লিখেছিস। যেরকম দিন আসছে তাতে জমিদারির উপরে কোনোদিন আর ভরসা রাখা চলবে না। ও জিনিসটার উপর অনেককাল থেকেই আমার মনে মনে ধিক্কার ছিল, এবার সেটা আরও পাকা হয়েছে। যে-সব কথা বহুকাল ভেবেছি এবার রাশিয়ায় তার চেহারা দেখে এলুম, তাই জমিদারি ব্যবসায়ে আমার লজ্জা বোধ হয়। আমার মন আজ উপরের তলার গদি ছেড়ে নিচে এসে বসেছে। দুঃখ এই যে, ছেলেবেলা থেকে পরজীবী হয়ে মানুষ হয়েছি।... জীবনযাত্রাকে গোড়া ঘেঁষে বদল করবার দিন এল, সেটা যেন অনায়াসে প্রসন্ন মনে করতে পারি।”

ইউরোপ ভ্রমণ কালেই তিনি এই চিঠি লিখছিলেন। এর আগে রাশিয়ার বিভিন্ন বিষয় যেমন রাশিয়ার লোকশিক্ষা, রাশিয়ার সব্যব্যাপী নির্ধনতা, রাশিয়ায় সকল মানুষের উন্নতির চেষ্টা, রাশিয়ার শিক্ষাবিধি, শিক্ষাব্যবস্থা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে ১৪টি চিঠি লেখেন রথীন্দ্রনাথ, রাণীচন্দ, প্রশান্ত চন্দ মহলানবিশ, সুরেন্দ্রনাথ কর, আশা অধিকারী, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, কালীমোহন ঘোষ এবং সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে। ২০ সেপ্টেম্বর থেকে ২৮ অক্টোবর সময়ে এই চিঠি নিবন্ধগুলি প্রবাসী অগ্রহায়ণ ১৩৩৭ থেকে চৈত্র ১৩৩৭ পর্যন্ত প্রতি সংখ্যায় প্রকাশ হয়। এর মধ্যে ৮ নম্বর চিঠিটি লিখেছিলেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে। সেই চিঠির সঙ্গে উপসংহার-এর বক্তব্য মিলিয়ে তিনি ‘রাশিয়ার চিঠি’ গ্রন্থের (২৬ বৈশাখ ১৩৩৮) দীর্ঘ ‘উপসংহার’ লেখেন। এই উপসংহারেই আমরা ভারতের দারিদ্র ও তার মূল কারণ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের জোরালো যুক্তি পাঠের সুযোগ পাই। লক্ষণীয়, দারিদ্র্যের root cause উনি কোথায় চিহ্নিত করছেন; ইংরেজ ও দেশীয় শাসকদের সঙ্গে জনমানুষের মধ্যে ‘মহালোভ’ আর ‘মহাসমুদ্রের ব্যবধান’, দুইপারে দারিদ্র্য আর ঐশ্বর্যের ব্যবধানে কি ওই ‘root নিহিত’, ‘রাশিয়ার চিঠি’র উপসংহারের এই উপলব্ধির কিছু অংশ রবীন্দ্রনাথের লেখাতেই পড়া যাক:

“টাইম্স্-এর সাহিত্যিক ক্রোড়পত্রে দেখা গেল ম্যাকি নামক এক লেখক বলেছেন যে, ভারতে দারিদ্র্যের root cause [বা] মূল কারণ হচ্ছে, এ দেশে নির্বিচার বিবাহের ফলে অতিপ্রজনন। কথাটার ভিতরকার ভাবটা এই যে, বাহির থেকে যে শোষণ চলছে তা দুঃসহ হত না যদি স্বল্প অন্ন নিয়ে স্বল্প লোকে হাঁড়ি চেঁচে-পুঁছে খেত। শুনতে পাই, ইংলন্ডে ১৮৭১ খৃষ্টাব্দ থেকে ১৯২১ খৃষ্টাব্দের মধ্যে শতকরা ৬৬ সংখ্যা হারে প্রজাবৃদ্ধি হয়েছে। ভারতবর্ষে পঞ্চাশ বৎসরের প্রজাবৃদ্ধির হার শতকরা ৩৩। তবে এক যাত্রায় পৃথক ফল হল কেন। অতএব দেখা যাচ্ছে root cause প্রজাবৃদ্ধি নয়, root cause অন্নসংস্থানের অভাব। তারও root কোথায়!

দেশ যারা শাসন করছে আর যে প্রজারা শাসিত হচ্ছে তাদের ভাগ্য যদি এককক্ষবর্তী হয় তা হলে অন্তত অন্নের দিক থেকে নালিশের কথা থাকে না, অর্থাৎ সুভিক্ষে দুর্ভিক্ষে উভয়ের ভাগ প্রায় সমান হয়ে থাকে। কিন্তু যেখানে কৃষ্ণপক্ষ ও শুক্লপক্ষের মাঝখানে মহালোভ ও মহাসমুদ্রের ব্যবধান সেখানে অমাবস্যার তরফে বিদ্যাস্বাস্থ্যসম্মানসম্পদের কৃপণতা ঘুচতে চায় না, অথচ নিশীথরাত্রির চৌকিদারদের হাতে বৃষচক্ষু লণ্ঠনের আয়োজন বেড়ে চলে। এ কথা হিসাব করে দেখতে স্ট্যাটিস্টিক্সের খুব বেশি খিটিমিটির দরকার হয় না, আজ একশো ষাট বৎসর ধরে ভারতের পক্ষে সর্ববিষয়ে দারিদ্র্য ও ব্রিটেনের পক্ষে সর্ববিষয়ে ঐশ্বর্য পিঠোপিঠি সংলগ্ন হয়ে আছে। এর যদি একটি সম্পূর্ণ ছবি আঁকতে চাই তবে বাংলাদেশের যে চাষী পাট উৎপন্ন করে আর সুদূর ডা-িতে যারা তার মুনফা ভোগ করে উভয়ের জীবনযাত্রার দৃশ্য পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে দেখতে হয়। উভয়ের মধ্যে যোগ আছে লোভের, বিচ্ছেদ আছে ভোগের; এই বিভাগ দেড়শো বছরে বাড়ল বৈ কমল না।

...কিন্তু ভারতের যে ধনে বিদেশী বণিক বা রাজপুরুষেরা ধনী তার ন্যূনতম উচ্ছিষ্টমাত্রই ভারতের ভাগে পড়ে। পাটের চাষীর শিক্ষার জন্যে, স্বাস্থের জন্যে সুগভীর অভাবগুলো অনাবৃষ্টির নালাডোবার মতো হাঁ করে রইল, বিদেশগামী মুনফা থেকে তার দিকে কিছুই ফিরল না। যা গেল তা নিঃশেষে গেল। পাটের মুনফা সম্ভবপর করবার জন্যে গ্রামের জলাশয়গুলি দূষিত হলো- এই অসহ্য জলকষ্ট নিবারণের উদ্দেশে বিদেশী মহাজনদের ভরা থলি থেকে এক পয়সা খসল না। যদি জলের ব্যবস্থা করতে হয় তবে তার সমস্ত ট্যাক্সের টান এই নিঃস্ব নিরন্নদের রক্তের উপরই পড়ে। সাধারণকে শিক্ষা দেবার জন্যে রাজকোষে টাকা নেই; কেন নেই। তার প্রধান কারণ, প্রভূত পরিমাণ টাকা ভারতবর্ষকে সম্পূর্ণই ত্যাগ করে চলে যায়; এ হল লোভের টাকা, যাতে করে আপন টাকা ষোলো-আনাই পর হয়ে যায়। অর্থাৎ জল উবে যায় এ পারের জলাশয়ে আর মেঘ হয়ে তার বর্ষণ হতে থাকে ও পারের দেশে। সে দেশের হাসপাতালে বিদ্যালয়ে এই হতভাগ্য অশিক্ষিত অসুস্থ মুমূর্ষু ভারতবর্ষ সুদীর্ঘকাল অপ্রত্যক্ষভাবে রসদ জুগিয়ে আসছে।

দেশের লোকের দৈহিক ও মানসিক অবস্থার চরম দুঃখদৃশ্য অনেককাল স্বচক্ষে দেখে আসছি। দারিদ্র্যে মানুষ কেবল যে মরে তা নয়, নিজেকে অবজ্ঞার যোগ্য করে তোলে। তাই স্যার জন সাইমন বললেন যে : ‘In our view the most formidable of the evils from which India is suffering have their roots in social and economic customs of longstanding which can only be remedied by the action of the Indian people themselves.’

এটা হলো অবজ্ঞার কথা। ভারতের প্রয়োজনকে তিনি যে আদর্শ থেকে বিচার করছেন সেটা তাঁদের নিজেদের আদর্শ নয়। প্রচুর ধন-উৎপাদনের জন্যে যে অবারিত শিক্ষা, যে সুযোগ, যে স্বাধীনতা তাঁদের নিজেদের আছে, যে-সমস্ত সুবিধা থাকাতে তাঁদের জীবনযাত্রার আদর্শ জ্ঞানে কর্মে ভোগে নানা দিক থেকে প্রভূত পরিমাণে পরিপুষ্ট হতে পেরেছে, জীর্ণবস্ত্র শীর্ণতনু, রোগক্লান্ত শিক্ষাবঞ্চিত ভারতের পক্ষে সে আদর্শ তারা কল্পনার মধ্যেই আনেন না।”

‘রাশিয়ার চিঠি’ সম্পর্কে একটি তথ্য এখানে উল্লেখ করতে হয়, রবীন্দ্রনাথের কোনো বাংলা গ্রন্থ বৃটিশ সরকার নিষিদ্ধ করেনি, যদিও নজরুল ইসলামের একাধিক এবং শরৎচন্দ্রের পথের দাবির মতো উপন্যাস নিষিদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু বৃটিশ সরকার ‘রাশিয়ার চিঠি’র প্রথম ইংরেজি কিস্তিটি ‘On Russia’ নামে ‘গModern Review’ পত্রিকায় ১৯৩৪ সালের জুন মাসে প্রকাশিত হওয়ার পরপরই ব্রিটিশ সরকার তার প্রকাশনা নিষিদ্ধ করে দেয়। বাংলা বা ভারতে এ নিয়ে তেমন প্রতিবাদ, আন্দোলন হয়নি, তবে যখন ইংল্যান্ডের ‘Times’ পত্রিকার ১৩ নভেম্বর ১৯৩৪ সংখ্যায় ‘On Russia’ নিষিদ্ধকরণ নিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেণ্ট যে প্রশ্নোত্তর হয় তা প্রকাশ হলে কলকাতার পত্রিকাগুলোতে তখনো ‘বিবৃতি’র অতি নগন্ন প্রতিবাদের বাইরে কোনো প্রতিবাদ চোখে পড়ল না। মজার ব্যাপার ১৯৩৭ থেকে ’৪১ সালের মধ্যে শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’সহ নজরুল এবং আরও কয়েকজন লেখকের বইয়ের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হলেও রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় ‘On Russia’ থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয় না। এবং ওই ১৯৩৭ সালে যখন কংগ্রেস ৬/৭টি প্রদেশের মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করে তখনও কংগ্রেস বা মহাত্মা গান্ধী ওই নিষেধাজ্ঞা তুলতে কোনো চেষ্টা করেনি। শেষ পর্যন্ত ১৯৬০ সালে প্রথম রাশিয়ার চিঠি গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ ‘Letters from Russia’ বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ থেকে প্রকাশিত হয়। এই খবরগুলো প্রথম নেপাল মজুমদারের ‘রবীন্দ্রনাথ: কয়েকটি রাজনীতিক প্রসঙ্গ’ গ্রন্থে (১৯৮৭) নানাভাবে ছড়িয়ে আছে।

রবীন্দ্রনাথের কৃষিভাবনা, শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠা, গবেষণা, রথীন্দ্রনাথকে আমেরিকা পাঠিয়ে কৃষি বিষয়ে পড়ানো সব কিছুর মূলেই নিহিত ছিল দরিদ্র কৃষক প্রজার দারিদ্র্যমুক্তি। কবি হয়তো কৃষি প্রকল্পে তেমন সফল হলেন না, কিন্তু কৃষি নিয়ে বিস্তর কর্মযজ্ঞে কবির খেয়াল বা কৌতূহল ছিল না, ছিল আসল প্রচেষ্টা, প্রকৃত বিনিয়োগ সময় ও অর্থের। কিশোর কবির মাথায় একদা কৌতূহল জন্মেছিল যেমন ফুলের রস দিয়ে কবিতা লিখবে। কবির আব্দার মতো ‘প্রধান সহায়’ নতুন দাদা (জ্যোতিরিন্দ্রনাথ) কল বসিয়ে ফুলের রস বের করে এনে বললেন, নেও এখন লেখ। লেখা হয় না ফুলের রসে, তার রঙ রসে তো গাঢ় হয়ে থাকে না। তাঁর কৃষি প্রচেষ্টা কোনো কৈশরিক হেঁয়ালি অবশ্য আর কেউ ভাবে না। দিনে দিনে এও ভাবতে শিখছে নিন্দুকেরা; এ কোনো জমিদারি ঠাঁটও ছিল না; এ ছিল মানুষ রবীন্দ্রনাথের অন্যের মানবেতর জীবন থেকে মুক্তি ঘটানোর চেষ্টা। তবে এই গ্রন্থে বহু আলোচিত তাঁর কৃষিভাবনা নিয়ে বিস্তর আলোচনা না করলেও চলবে। তাঁর আলু চাষ আর নতুন ধান নিয়ে অনেক লেখা আছে। বিলেতি সাহেব এলমহাস্টের কৃষি ও পল্লীসমাজ উন্নয়ন প্রকল্পে শারীরিক ও আর্থিক সাহায্য সহযোগিতার কথাও সেই সঙ্গে আছে। পূর্বে উল্লেখ এককালীন এক লক্ষ চুয়ান্ন হাজার টাকা সঙ্গে নিয়ে এলমহাস্ট শান্তি নিকেতনে এলেন, এরপরও আরও ২৫ বছর বছরে বছরে পঞ্চাশ হাজার টাকা করে এলমহাস্টের স্ত্রী ডরোথি স্ট্রেট শ্রীনিকেতনে প্রদান করেছেন।