বিভাগোত্তর কালে দুই বাংলায় গণমাধ্যমের বিবর্তন

গৌতম রায়

উনিশশো সাতচল্লিশ সালে দেশভাগের পর দুই বাংলাতেই গণমাধ্যম পরিচালনার ক্ষেত্রে বেশ কিছুটা অদল-বদলের আভাস দেখতে পাওয়া যায়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমকে পরিচালিত করবার ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমের পরিচালকেরা যে ভূমিকা পালন করেছিলেন, দেশভাগের অব্যবহিত পরে পশ্চিমবঙ্গে বা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের গণমাধ্যমগুলির পরিচালকেরা তেমনটা আর থাকেন না, তাঁদের রণকৌশলের ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন আনেন।

কলকাতায় যে সমস্ত খবরের কাগজের মালিক জন্মসূত্রে বাঙালি মুসলমান ছিলেন, তাঁরা দেশভাগের পর সাত তাড়াতাড়ি পাততাড়ি গুটিয়ে কিন্তু তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে চলে যাননি। কলকাতা শহরে থেকে বা ঢাকায় অবস্থান করেও কলকাতা শহরকেন্দ্রিক গণমাধ্যম পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁরা কিন্তু তখনও পর্যন্ত যথেষ্ট যতœবান ছিলেন।

এই যে গণমাধ্যমের মালিকদের কথা বলা হলো, তাঁরা যে সকলেই খুব প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার মানুষ ছিলেন বা ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রশ্নে অত্যন্ত যত্নশীল ছিলেন, এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁরা ব্রিটিশের তল্পি হিসেবেও কাজ করেছিলেন। এমনকি প্রতিক্রিয়াশীলতা যাতে পশ্চিমবঙ্গ এবং সদ্য তৈরি হওয়া পূর্ব পাকিস্তানে খুব ভালোভাবে শিকড় বিস্তার করতে পারে, তার জন্য তাঁরা খুব ভালোভাবেই সক্রিয় ছিলেন। কিন্তু সংবাদ মাধ্যম পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁদের মধ্যে একটা আন্তরিকতা আর উৎসাহ ছিল।

যুগান্তর, অমৃতবাজার গোষ্ঠী অভিজাত, উচ্চবর্ণের হিন্দু স্বার্থ সংরক্ষণের প্রশ্নে দেশভাগ চেয়েছিল। আবার এঁরাই মুসলিম জাতীয়তাবাদের তত্ত্বে বিশ্বাসী, রীতিমতো প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মাওলানা আকরাম খাঁকে প্রেস বিক্রি করে তাঁর খবরের কাগজ কলকাতা শহর থেকে প্রকাশিত হওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছিল। ব্রিটিশ বিরোধিতার জায়গাটা সরে আসার সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তি মালিকানাধীন গণমাধ্যমগুলি যেমন পশ্চিমবঙ্গে, তেমনিই তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানেও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শাসকের তল্পিবাহক হয়ে ওঠে। আবার তার ব্যতিক্রম যথেষ্ট ছিল। উদাহরণ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের সংবাদ, কলকাতার দৈনিক বসুমতি ইত্যাদির নাম করা যায়।

তবে একথা অত্যন্ত জোরের সঙ্গেই বলতে হয় যে, ব্রিটিশ বিরোধিতার প্রশ্নে কলকাতা কেন্দ্রিক গণমাধ্যমগুলি যে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল, দেশভাগের অব্যবহিত পরে তাঁদের সেই ক্ষুরধার প্রতিবাদী অবস্থানটি আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খুঁজে পাইনি। একথা যেমন রাজনৈতিক সংবাদ মাধ্যমের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, আবার তেমনি সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রের সাময়িকীগুলোর ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, সাধারণভাবে প্রতিক্রিয়াশীল কাগজ হিসেবে পরিচিত ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকায় অদ্বৈত মল্লবর্মণের কালজয়ী উপন্যাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু তেমন কোনো উদাহরণ স্বাধীনতার আগে খুব একটা হিন্দু মালিকানাধীন সংবাদমাধ্যমে আমরা দেখতে পাই না।

সেই পরিস্থিতি কিন্তু দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গে বজায় থেকেছে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রগতিশীল আধুনিক চিন্তাভাবনার মানুষজন ধীরে ধীরে সংবাদ মাধ্যম পরিচালনার ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করবার পর সেখানকার সংবাদ জগতের ছবিটা বেশ একটু অন্য রকম হতে শুরু করে। এই প্রসঙ্গে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয় মানিক মিঞার নাম। পশ্চিমবঙ্গবাসীর কাছে এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়ে এই যে, মানিক মিঞার মতো মেরুদণ্ডসম্পন্ন, শাসকের সঙ্গে একবিন্দু আপোস না করা সংবাদমাধ্যমের স্তম্ভ এপার বাংলায় সেভাবে দেখতে পাওয়া যায়নি। বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়ের মতো হাতেগোনা দু’একজন ব্যক্তিত্ব এ প্রসঙ্গে অত্যন্ত ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করলেও স্বাধীনতার আগে, জাতীয় আন্দোলনের সময়কালে, আনন্দবাজার পত্রিকা ব্রিটিশ বিরোধিতার প্রশ্নে যে অবস্থান গ্রহণ করেছিল, সেই অবস্থান তাঁদের চারের দশকের মধ্যভাগ, যখন থেকে দেশভাগের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়, সেই সময়কাল থেকে অভিজাত বর্ণ হিন্দুদের স্বার্থের প্রশ্নে, মেরুদণ্ড শক্ত রেখে সংবাদ মাধ্যম পরিচালনার সেই ভূমিকা আর আমরা দেখতে পাই না।

মুসলিম জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে যাঁরা একত্রিত হয়ে, অভিজাত উচ্চবর্ণের মুসলমানদের স্বার্থে দেশভাগ চেয়েছিল, তাঁদের সেই চাওয়াকে পরিপূর্ণতা দেওয়ার ভেতর দিয়ে কলকাতাকা কেন্দ্রিক, অভিজাত বর্ণ হিন্দুদের স্বার্থ সংরক্ষণের প্রশ্নে এপার বাংলা সংবাদ মূল ধারার একটা বড় অংশই পরিচালিত হতে শুরু করে ’৪৭ উত্তর পর্বেও। উদ্দেশ্য, মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক অধিকার খর্ব করে বর্ণহিন্দু, অভিজাত হিন্দুদের এইক্ষেত্রে একাধিপত্য কায়েম করা।

এই সময়কালে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের নেতৃত্বে উদ্বাস্তু সমস্যা, খাদ্য সমস্যা, বেকারত্ব, শিক্ষার সংকট ইত্যাদি প্রশ্নে যে গণআন্দোলন হয়েছে, তার প্রকৃত স্বরূপ মানুষের কাছে তুলে ধরবার প্রশ্নে ব্যক্তি মালিকানাধীন সংবাদ মাধ্যমগুলির বেশিরভাগই নিজেদের সঠিক নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছিল। বিধানচন্দ্র রায়কে আইকন হিসেবে তুলে ধরে বাঙালি সমাজের সেই সময়ের যে জ্বলন্ত সমস্যা, তার থেকে মানুষের দৃষ্টিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে এপার বাংলায় ব্যক্তি মালিকানাধীন সংবাদ মাধ্যমগুলির বেশিরভাগই সেই সময় সচেষ্ট ছিল। এই কাজটা সম্পন্ন হয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে এইসব ব্যক্তি মালিকানাধীন সংবাদ মাধ্যমগুলির একটা বিশেষ রকমের সুসম্পর্ক থাকার দরুন।

শাসকের দৃষ্টিভঙ্গি এবং শ্রেণি চেতনা, সংবাদ মাধ্যমে, সংবাদ পরিবেশনার ক্ষেত্রে, সব থেকে বড় ভূমিকা পালন করত। বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি তখন সংবাদ মাধ্যম পরিচালনার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক দিক থেকে এতই কম জোরি ছিল যে, তাদের বক্তব্যগুলি খবরের কাগজের ভেতর দিয়ে মানুষের কাছে তুলে ধরার প্রশ্নে তাঁরা যথাযথভাবে সাফল্যের ধার কাছে পৌঁছোতে পারত না। ফলে ব্যক্তি মালিকানাধীন, শাসকঘনিষ্ঠ সংবাদ মাধ্যমগুলি তখন গোটা সংবাদপত্র জগত, গোটা গণমাধ্যমের জগতকে কব্জা করে রেখেছিল।

সেদিনের পশ্চিমবঙ্গের ব্যক্তি মালিকানাধীন সংবাদ মাধ্যমগুলি যতদিন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মতো চরম হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী ব্যক্তিত্ব জীবিত ছিলেন, ততদিন কংগ্রেসের শ্রেণি স্বার্থের দিকে তাকিয়ে কথা বলেছে। আবার তার পাশাপাশি হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শিবিরের রাজনৈতিক বার্তাগুলিকে মানুষের কাছে তুলে ধরবার প্রশ্নে একটা জোরদার ভূমিকা পালন করে গিয়েছে। শ্যামাপ্রসাদ, বিধান রায় প্রমুখের মৃত্যুর পরেও ছয়ের দশকের গোড়ার দিকে, কাশ্মীরের শ্রীনগর থেকে পবিত্র হজরত বাল চুরির গুজব ঘিরে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ফৌজি আশ্রিত শাসকদের প্ররোচনায় যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়, তাকে একটা বিকৃত উপায়ে পশ্চিমবঙ্গে তুলে ধরে, এখানকার ব্যক্তি মালিকানাধীন সংবাদ মাধ্যমগুলির একটা বড় অংশ, একদিকে হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তিকে প্রশ্রয় দিয়েছে, অপরদিকে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ভেতরেও প্ররোচনা তৈরি করবার জন্য পশ্চিমবঙ্গে চেষ্টা চালিয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের সেই সময়ে ব্যক্তি মালিকানাধীন সংবাদ মাধ্যমগুলির বেশিরভাগের যে ভূমিকা, তা পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা অহেতুক আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করেছে। তাঁদের দেশত্যাগের ঘটনা সেই কারণে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল তখন। যার ফলে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বস্তরে একটা বড় রকমের অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়। আর একটা বড় অংশের পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের ভেতরে মুসলমান সমাজ সম্পর্কে নতুন করে নেতিবাচক, বিভাজনমূলক আচার-আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে সেইসব কর্মকাণ্ডকে ঘিরে।

ছয়ের দশকের সূচনা পর্বে একটি বিশেষ সংবাদপত্র এবং তার একজন বিশিষ্ট কর্মী, সাংবাদিক, যিনি সাহিত্যিক হিসেবেও সমকালে অত্যন্ত খ্যাতিমান ছিলেন, তিনি গোটা কলকাতা জুড়ে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটেছিল আইয়ুব খানের প্রত্যক্ষ মদদে, পশ্চিমবঙ্গে তার পুনরাবৃত্তি ঘটানোর চেষ্টা করেছিলেন মুসলমান সম্প্রদায়ের উপর একতরফাভাবে সমস্ত দোষারোপ চাপিয়ে দিয়ে।

একটা বড় অংশের সংবাদমাধ্যমের এই যে সাম্প্রদায়িক অভিমত সেটি ছয়, সাতের দশকে পরিচালিত হয় প্রধানত কমিউনিস্টদের ভারতবিরোধী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবার এক অদ্ভুত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে হাতিয়ার করে। কমিউনিস্টদের শেষ করবার জন্যই কমিউনিস্ট পার্টিগুলি থেকে বেরিয়ে গিয়ে, সংকীর্ণতাবাদকে আশ্রয় করে, একাংশের তথাকথিত রাজনীতিকরা এই সময় মেতে উঠেছিল। পশ্চিমবঙ্গের সেই সময় সংবাদ মাধ্যমের সিংহভাগ একদিকে যেমন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছিল, তেমনি অপরদিকে ভারতের বুক থেকে কমিউনিস্ট আন্দোলনকে শেষ করে দেওয়ার জন্য সংকীর্ণতাবাদীরা, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এবং ভারতের শাসক কংগ্রেসের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়, এক চরম অমানবিক আচার-আচরণ করে চলেছিল। বিশেষ করে ব্যক্তি হত্যার রাজনীতিকে এক বীভৎস জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছিল। সেই গোটা পরিস্থিতিকে সরাসরি সমর্থন না করলেও, সংকীর্ণতাবাদী আন্দোলনের প্রতি একটা প্রত্যক্ষ সহানুভূতি এবং সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের সম্পর্কে জনমানসে একটা আবেগের পরিবেশ তৈরি করবার জন্য জোরদার ভূমিকা পালন করতে শুরু করে একাংশের সংবাদমাধ্যম।

অপরপক্ষে এই সময়ে ইন্দিরা গান্ধী তাঁর নিজের দলে, নিজের একাধিকপত্য বজায় রাখবার জন্য, দলের সিন্ডিকেট পন্থীদের কোণঠাসা করে যেভাবে কংগ্রেস দলটিকে নিজের হাতের তালুর মধ্যে পুড়ে নিয়েছিলেন, সেই কর্মকাণ্ডে ইন্দিরাকে জয়ী হওয়ার লক্ষ্যে, ভারতের হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী সংগঠন বিজেপির পূর্বসূরি জনসংঘ এবং তাদের মস্তিষ্ক আরএসএস পরোক্ষভাবে যে সহযোগিতার পথ ধরে চলেছিল, বাংলার সংবাদ মাধ্যম কিন্তু সে সম্পর্কে কার্যত নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে গিয়েছিল।

জরুরি অবস্থার কালে শ্রীমতী গান্ধীর ভূমিকা, আধা ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাস, গণতন্ত্রের কণ্ঠ রোধের সমস্ত কিছুকে ঘিরেই ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের মতোই বাংলার সংবাদ মাধ্যম তখন সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে শাহাদাত বরণ করবার পর, সেখানকার সংবাদ মাধ্যম সর্বক্ষেত্রে যথাযথ ভূমিকা আর পালন করে উঠতে সক্ষম হচ্ছিল না। বঙ্গবন্ধুর জীবিত কালের শেষ পর্যায়ে তাঁর সম্বন্ধে সঠিক মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও কলকাতার বাংলা সংবাদ মাধ্যমগুলি যথাযথ ভূমিকা পালন করেনি। বিশেষ করে বলতে হয়, পশ্চিমবঙ্গের সংবাদ মাধ্যমের একটা বড় অংশের ভূমিকা বঙ্গবন্ধু শহিদ হওয়ার ঠিক পরের দিন কলকাতার ব্যক্তি মালিকানাধীন সংবাদমাধ্যমগুলি যে ধরনের সংবাদ পরিবেশন করেছিল, হানাদার পাক এবং তাদের সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আল শামসদের কর্মকাণ্ডকে, খুনি মেজরচক্র এবং তার সহযোগী অংশের অপকর্মকে আড়াল করার পক্ষেই ছিল।

জরুরি অবস্থার সময় বাংলার সংবাদ মাধ্যমকে বহু কঠিন, কৃচ্ছ্র পথ অতিক্রম করতে হয়। তাই বলে জরুরি অবস্থা বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে জয়প্রকাশ নারায়ণ যেভাবে আরএসএসকে সংযুক্ত করে, আগামী দিনের জন্য একটি বিপদের সম্ভাবনাকে উন্মুক্ত করে দিচ্ছিলেন, সে সম্পর্কেও কিন্তু ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম তথা বাংলার সংবাদ মাধ্যমগুলি যথাযথ ভূমিকা পালন করেনি। এই প্রসঙ্গে বস্তুত আরএসএসকে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করে দেওয়ার লক্ষ্যে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলির একটা ভূমিকা আমরা কখনোই অস্বীকার করতে পারি না।

আজ বাংলাদেশে যেমন কিছু কিছু হাতেগোনা সংবাদ মাধ্যম সেদেশের গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোকে ভেঙে দিতে তৎপর, ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবেশকে বিনষ্ট করবার জন্য আদা-জল খেয়ে নেমে পড়েছে, এমনটা কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেও বারবার দেখতে পাওয়া যায়। বাংলাদেশের শেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে, গণতান্ত্রিক পরিবেশকে রুদ্ধ করবার ক্ষেত্রে সেখানকার বাছাই করা কয়েকটি সংবাদপত্রের যে নেতিবাচক ভূমিকা, সেনা মোতায়েনের মধ্যে দিয়ে হানাদার পাক বাহিনীর সমর্থক, রাজনৈতিক দলকে আবার ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করবার লক্ষ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে কর্ম পদ্ধতি, তাকে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষদের মধ্যে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে সেখানকার হাতেগোনা দুএকটি সংবাদপত্র অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল।

এই প্রবণতা কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ব্যক্তি মালিকানাধীন খবরের কাগজগুলি বা আজকের দিনে অত্যন্ত সক্রিয় বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমগুলির ভিতর অত্যন্ত বেশি পরিমাণে দেখতে পাওয়া যায়। সদ্য অতীতে যেমন তৎকালীন সময়ে ক্ষমতাসীন বামপন্থী সরকারকে উৎখাত করবার লক্ষ্যে এই সংবাদ মাধ্যমের একটা বড় অংশ গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল বলে অভিযোগ। সময়ের সাথে তাল রেখে বলতে হয় যে, সেই অভিযোগের যথার্থতা যেন এখন সাধারণ মানুষের চোখের সামনে ফুটে উঠতে শুরু করেছে।

পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীরা যখন ক্ষমতাসীন ছিল, তখন সেই মন্ত্রিসভার ভেতর কিছু কিছু রাজনৈতিক দল কেবলমাত্র কমিউনিস্টদের বিরোধিতা করবার প্রশ্নে, সিপিআই (এমে)র বিরোধিতা করবার প্রশ্নে, সেই সময়ের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিকে সাহায্য করতে প্রত্যক্ষভাবে আসরে নেমে পড়েছিল। এই প্রসঙ্গে একটি ঘোরতর কমিউনিস্ট বিরোধী সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠায় ফরোয়ার্ড ব্লকের প্রয়াত চিত্ত বসু, অশোক ঘোষদের ভূমিকার কথা এই প্রসঙ্গে বলতে হয়।

বাংলাদেশে শেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করার কৌশলে একাংশের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা ছিল বাংলাদেশের গরিষ্ঠ নাগরিকরা ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অপকর্ম সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরতে সেই সরকার থেকে নিজেদের দূরত্ব তৈরি করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, পশ্চিমবঙ্গে নাগরিক সমাজের একটা বড় অংশ, যাদের সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করবার একটা বড় রকমের ক্ষমতা রয়েছে বলে অনেকেরই বিশ্বাস, তাঁরা কিন্তু বিগত দশ এগারো বছর ধরে একটিবারের জন্যেও শাসকের অপকর্মগুলি জনগণের সামনে তুলে ধরবার প্রশ্নে যথাযথ ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করতে পারছে না।

এভাবে যদি গণতন্ত্রের মূল কাঠামোটিকে শাসক যুব কাষ্ঠে চড়িয়ে বসে, তাহলে তা অচিরেই গোটা ভারত শুধু নয়, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যে গণতান্ত্রিক সরকার পরিচালিত হচ্ছে, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উপরে নানা ধরনের আক্রমণ হচ্ছে, সেই সমস্ত কিছুতেই একটা বড় রকমের বিপদের সামনে এসে দাঁড়াবে।

image
আরও খবর
বাংলা নামের প্রথম দৈনিক
বাংলাদেশকেও সাবধানে পা ফেলতে হবে
নির্মলেন্দু গুণের কবিতা
সংবাদ এবং আমার শৈশব
আমার বাতিঘর
শিক্ষার বিবর্তন কিংবা বিবর্তনের শিক্ষা
নয়া মাধ্যম: মিডিয়া ডায়েট ব্যক্তির স্বাধীনতা
সংবাদ-এর ঐতিহ্যিক ধারাবাহিকতা
চলছে লড়াই, চলবে লড়াই
গণমাধ্যমের শক্তি ১৯৭১
সংবাদ ও রণেশ দাশগুপ্ত
আমার ‘সংবাদ’
দৈনিক সংবাদ আমার প্রতিষ্ঠান
দুর্ভিক্ষের পীড়া ও রবীন্দ্রনাথ
সংবাদ ও অর্থনীতি
ভবিষ্যতের গণমাধ্যম গণমাধ্যমের ভবিষ্যৎ
মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতা
দুটি কবিতা : আহমদ সলীম
গোলাম কিবরিয়া পিনু
সাতচল্লিশ পরবর্তী বাংলা গানের বিবর্তন
নারীর মনোজগৎ: আমাদের বিভ্রম ও কল্পকাহিনী
নতুন সময়ের গণমাধ্যম
‘সংবাদ’ শুধু একটি সংবাদপত্র নয়
গৌরব এবং গর্বের সংবাদ
গণমাধ্যম কেবল আশার স্বপ্ন নয়
গণমানুষের নিজের পত্রিকা ‘সংবাদ’
মুক্তিযুদ্ধ ও সাংবাদিকতা
মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িকতা

বুধবার, ০৩ আগস্ট ২০২২

বিভাগোত্তর কালে দুই বাংলায় গণমাধ্যমের বিবর্তন

গৌতম রায়

image

উনিশশো সাতচল্লিশ সালে দেশভাগের পর দুই বাংলাতেই গণমাধ্যম পরিচালনার ক্ষেত্রে বেশ কিছুটা অদল-বদলের আভাস দেখতে পাওয়া যায়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমকে পরিচালিত করবার ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমের পরিচালকেরা যে ভূমিকা পালন করেছিলেন, দেশভাগের অব্যবহিত পরে পশ্চিমবঙ্গে বা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের গণমাধ্যমগুলির পরিচালকেরা তেমনটা আর থাকেন না, তাঁদের রণকৌশলের ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন আনেন।

কলকাতায় যে সমস্ত খবরের কাগজের মালিক জন্মসূত্রে বাঙালি মুসলমান ছিলেন, তাঁরা দেশভাগের পর সাত তাড়াতাড়ি পাততাড়ি গুটিয়ে কিন্তু তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে চলে যাননি। কলকাতা শহরে থেকে বা ঢাকায় অবস্থান করেও কলকাতা শহরকেন্দ্রিক গণমাধ্যম পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁরা কিন্তু তখনও পর্যন্ত যথেষ্ট যতœবান ছিলেন।

এই যে গণমাধ্যমের মালিকদের কথা বলা হলো, তাঁরা যে সকলেই খুব প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার মানুষ ছিলেন বা ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রশ্নে অত্যন্ত যত্নশীল ছিলেন, এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁরা ব্রিটিশের তল্পি হিসেবেও কাজ করেছিলেন। এমনকি প্রতিক্রিয়াশীলতা যাতে পশ্চিমবঙ্গ এবং সদ্য তৈরি হওয়া পূর্ব পাকিস্তানে খুব ভালোভাবে শিকড় বিস্তার করতে পারে, তার জন্য তাঁরা খুব ভালোভাবেই সক্রিয় ছিলেন। কিন্তু সংবাদ মাধ্যম পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁদের মধ্যে একটা আন্তরিকতা আর উৎসাহ ছিল।

যুগান্তর, অমৃতবাজার গোষ্ঠী অভিজাত, উচ্চবর্ণের হিন্দু স্বার্থ সংরক্ষণের প্রশ্নে দেশভাগ চেয়েছিল। আবার এঁরাই মুসলিম জাতীয়তাবাদের তত্ত্বে বিশ্বাসী, রীতিমতো প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মাওলানা আকরাম খাঁকে প্রেস বিক্রি করে তাঁর খবরের কাগজ কলকাতা শহর থেকে প্রকাশিত হওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছিল। ব্রিটিশ বিরোধিতার জায়গাটা সরে আসার সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তি মালিকানাধীন গণমাধ্যমগুলি যেমন পশ্চিমবঙ্গে, তেমনিই তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানেও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শাসকের তল্পিবাহক হয়ে ওঠে। আবার তার ব্যতিক্রম যথেষ্ট ছিল। উদাহরণ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের সংবাদ, কলকাতার দৈনিক বসুমতি ইত্যাদির নাম করা যায়।

তবে একথা অত্যন্ত জোরের সঙ্গেই বলতে হয় যে, ব্রিটিশ বিরোধিতার প্রশ্নে কলকাতা কেন্দ্রিক গণমাধ্যমগুলি যে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল, দেশভাগের অব্যবহিত পরে তাঁদের সেই ক্ষুরধার প্রতিবাদী অবস্থানটি আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খুঁজে পাইনি। একথা যেমন রাজনৈতিক সংবাদ মাধ্যমের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, আবার তেমনি সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রের সাময়িকীগুলোর ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, সাধারণভাবে প্রতিক্রিয়াশীল কাগজ হিসেবে পরিচিত ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকায় অদ্বৈত মল্লবর্মণের কালজয়ী উপন্যাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু তেমন কোনো উদাহরণ স্বাধীনতার আগে খুব একটা হিন্দু মালিকানাধীন সংবাদমাধ্যমে আমরা দেখতে পাই না।

সেই পরিস্থিতি কিন্তু দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গে বজায় থেকেছে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রগতিশীল আধুনিক চিন্তাভাবনার মানুষজন ধীরে ধীরে সংবাদ মাধ্যম পরিচালনার ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করবার পর সেখানকার সংবাদ জগতের ছবিটা বেশ একটু অন্য রকম হতে শুরু করে। এই প্রসঙ্গে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয় মানিক মিঞার নাম। পশ্চিমবঙ্গবাসীর কাছে এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়ে এই যে, মানিক মিঞার মতো মেরুদণ্ডসম্পন্ন, শাসকের সঙ্গে একবিন্দু আপোস না করা সংবাদমাধ্যমের স্তম্ভ এপার বাংলায় সেভাবে দেখতে পাওয়া যায়নি। বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়ের মতো হাতেগোনা দু’একজন ব্যক্তিত্ব এ প্রসঙ্গে অত্যন্ত ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করলেও স্বাধীনতার আগে, জাতীয় আন্দোলনের সময়কালে, আনন্দবাজার পত্রিকা ব্রিটিশ বিরোধিতার প্রশ্নে যে অবস্থান গ্রহণ করেছিল, সেই অবস্থান তাঁদের চারের দশকের মধ্যভাগ, যখন থেকে দেশভাগের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়, সেই সময়কাল থেকে অভিজাত বর্ণ হিন্দুদের স্বার্থের প্রশ্নে, মেরুদণ্ড শক্ত রেখে সংবাদ মাধ্যম পরিচালনার সেই ভূমিকা আর আমরা দেখতে পাই না।

মুসলিম জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে যাঁরা একত্রিত হয়ে, অভিজাত উচ্চবর্ণের মুসলমানদের স্বার্থে দেশভাগ চেয়েছিল, তাঁদের সেই চাওয়াকে পরিপূর্ণতা দেওয়ার ভেতর দিয়ে কলকাতাকা কেন্দ্রিক, অভিজাত বর্ণ হিন্দুদের স্বার্থ সংরক্ষণের প্রশ্নে এপার বাংলা সংবাদ মূল ধারার একটা বড় অংশই পরিচালিত হতে শুরু করে ’৪৭ উত্তর পর্বেও। উদ্দেশ্য, মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক অধিকার খর্ব করে বর্ণহিন্দু, অভিজাত হিন্দুদের এইক্ষেত্রে একাধিপত্য কায়েম করা।

এই সময়কালে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের নেতৃত্বে উদ্বাস্তু সমস্যা, খাদ্য সমস্যা, বেকারত্ব, শিক্ষার সংকট ইত্যাদি প্রশ্নে যে গণআন্দোলন হয়েছে, তার প্রকৃত স্বরূপ মানুষের কাছে তুলে ধরবার প্রশ্নে ব্যক্তি মালিকানাধীন সংবাদ মাধ্যমগুলির বেশিরভাগই নিজেদের সঠিক নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছিল। বিধানচন্দ্র রায়কে আইকন হিসেবে তুলে ধরে বাঙালি সমাজের সেই সময়ের যে জ্বলন্ত সমস্যা, তার থেকে মানুষের দৃষ্টিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে এপার বাংলায় ব্যক্তি মালিকানাধীন সংবাদ মাধ্যমগুলির বেশিরভাগই সেই সময় সচেষ্ট ছিল। এই কাজটা সম্পন্ন হয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে এইসব ব্যক্তি মালিকানাধীন সংবাদ মাধ্যমগুলির একটা বিশেষ রকমের সুসম্পর্ক থাকার দরুন।

শাসকের দৃষ্টিভঙ্গি এবং শ্রেণি চেতনা, সংবাদ মাধ্যমে, সংবাদ পরিবেশনার ক্ষেত্রে, সব থেকে বড় ভূমিকা পালন করত। বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি তখন সংবাদ মাধ্যম পরিচালনার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক দিক থেকে এতই কম জোরি ছিল যে, তাদের বক্তব্যগুলি খবরের কাগজের ভেতর দিয়ে মানুষের কাছে তুলে ধরার প্রশ্নে তাঁরা যথাযথভাবে সাফল্যের ধার কাছে পৌঁছোতে পারত না। ফলে ব্যক্তি মালিকানাধীন, শাসকঘনিষ্ঠ সংবাদ মাধ্যমগুলি তখন গোটা সংবাদপত্র জগত, গোটা গণমাধ্যমের জগতকে কব্জা করে রেখেছিল।

সেদিনের পশ্চিমবঙ্গের ব্যক্তি মালিকানাধীন সংবাদ মাধ্যমগুলি যতদিন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মতো চরম হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী ব্যক্তিত্ব জীবিত ছিলেন, ততদিন কংগ্রেসের শ্রেণি স্বার্থের দিকে তাকিয়ে কথা বলেছে। আবার তার পাশাপাশি হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শিবিরের রাজনৈতিক বার্তাগুলিকে মানুষের কাছে তুলে ধরবার প্রশ্নে একটা জোরদার ভূমিকা পালন করে গিয়েছে। শ্যামাপ্রসাদ, বিধান রায় প্রমুখের মৃত্যুর পরেও ছয়ের দশকের গোড়ার দিকে, কাশ্মীরের শ্রীনগর থেকে পবিত্র হজরত বাল চুরির গুজব ঘিরে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ফৌজি আশ্রিত শাসকদের প্ররোচনায় যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়, তাকে একটা বিকৃত উপায়ে পশ্চিমবঙ্গে তুলে ধরে, এখানকার ব্যক্তি মালিকানাধীন সংবাদ মাধ্যমগুলির একটা বড় অংশ, একদিকে হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তিকে প্রশ্রয় দিয়েছে, অপরদিকে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ভেতরেও প্ররোচনা তৈরি করবার জন্য পশ্চিমবঙ্গে চেষ্টা চালিয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের সেই সময়ে ব্যক্তি মালিকানাধীন সংবাদ মাধ্যমগুলির বেশিরভাগের যে ভূমিকা, তা পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা অহেতুক আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করেছে। তাঁদের দেশত্যাগের ঘটনা সেই কারণে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল তখন। যার ফলে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বস্তরে একটা বড় রকমের অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়। আর একটা বড় অংশের পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের ভেতরে মুসলমান সমাজ সম্পর্কে নতুন করে নেতিবাচক, বিভাজনমূলক আচার-আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে সেইসব কর্মকাণ্ডকে ঘিরে।

ছয়ের দশকের সূচনা পর্বে একটি বিশেষ সংবাদপত্র এবং তার একজন বিশিষ্ট কর্মী, সাংবাদিক, যিনি সাহিত্যিক হিসেবেও সমকালে অত্যন্ত খ্যাতিমান ছিলেন, তিনি গোটা কলকাতা জুড়ে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটেছিল আইয়ুব খানের প্রত্যক্ষ মদদে, পশ্চিমবঙ্গে তার পুনরাবৃত্তি ঘটানোর চেষ্টা করেছিলেন মুসলমান সম্প্রদায়ের উপর একতরফাভাবে সমস্ত দোষারোপ চাপিয়ে দিয়ে।

একটা বড় অংশের সংবাদমাধ্যমের এই যে সাম্প্রদায়িক অভিমত সেটি ছয়, সাতের দশকে পরিচালিত হয় প্রধানত কমিউনিস্টদের ভারতবিরোধী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবার এক অদ্ভুত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে হাতিয়ার করে। কমিউনিস্টদের শেষ করবার জন্যই কমিউনিস্ট পার্টিগুলি থেকে বেরিয়ে গিয়ে, সংকীর্ণতাবাদকে আশ্রয় করে, একাংশের তথাকথিত রাজনীতিকরা এই সময় মেতে উঠেছিল। পশ্চিমবঙ্গের সেই সময় সংবাদ মাধ্যমের সিংহভাগ একদিকে যেমন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছিল, তেমনি অপরদিকে ভারতের বুক থেকে কমিউনিস্ট আন্দোলনকে শেষ করে দেওয়ার জন্য সংকীর্ণতাবাদীরা, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এবং ভারতের শাসক কংগ্রেসের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়, এক চরম অমানবিক আচার-আচরণ করে চলেছিল। বিশেষ করে ব্যক্তি হত্যার রাজনীতিকে এক বীভৎস জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছিল। সেই গোটা পরিস্থিতিকে সরাসরি সমর্থন না করলেও, সংকীর্ণতাবাদী আন্দোলনের প্রতি একটা প্রত্যক্ষ সহানুভূতি এবং সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের সম্পর্কে জনমানসে একটা আবেগের পরিবেশ তৈরি করবার জন্য জোরদার ভূমিকা পালন করতে শুরু করে একাংশের সংবাদমাধ্যম।

অপরপক্ষে এই সময়ে ইন্দিরা গান্ধী তাঁর নিজের দলে, নিজের একাধিকপত্য বজায় রাখবার জন্য, দলের সিন্ডিকেট পন্থীদের কোণঠাসা করে যেভাবে কংগ্রেস দলটিকে নিজের হাতের তালুর মধ্যে পুড়ে নিয়েছিলেন, সেই কর্মকাণ্ডে ইন্দিরাকে জয়ী হওয়ার লক্ষ্যে, ভারতের হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী সংগঠন বিজেপির পূর্বসূরি জনসংঘ এবং তাদের মস্তিষ্ক আরএসএস পরোক্ষভাবে যে সহযোগিতার পথ ধরে চলেছিল, বাংলার সংবাদ মাধ্যম কিন্তু সে সম্পর্কে কার্যত নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে গিয়েছিল।

জরুরি অবস্থার কালে শ্রীমতী গান্ধীর ভূমিকা, আধা ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাস, গণতন্ত্রের কণ্ঠ রোধের সমস্ত কিছুকে ঘিরেই ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের মতোই বাংলার সংবাদ মাধ্যম তখন সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে শাহাদাত বরণ করবার পর, সেখানকার সংবাদ মাধ্যম সর্বক্ষেত্রে যথাযথ ভূমিকা আর পালন করে উঠতে সক্ষম হচ্ছিল না। বঙ্গবন্ধুর জীবিত কালের শেষ পর্যায়ে তাঁর সম্বন্ধে সঠিক মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও কলকাতার বাংলা সংবাদ মাধ্যমগুলি যথাযথ ভূমিকা পালন করেনি। বিশেষ করে বলতে হয়, পশ্চিমবঙ্গের সংবাদ মাধ্যমের একটা বড় অংশের ভূমিকা বঙ্গবন্ধু শহিদ হওয়ার ঠিক পরের দিন কলকাতার ব্যক্তি মালিকানাধীন সংবাদমাধ্যমগুলি যে ধরনের সংবাদ পরিবেশন করেছিল, হানাদার পাক এবং তাদের সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আল শামসদের কর্মকাণ্ডকে, খুনি মেজরচক্র এবং তার সহযোগী অংশের অপকর্মকে আড়াল করার পক্ষেই ছিল।

জরুরি অবস্থার সময় বাংলার সংবাদ মাধ্যমকে বহু কঠিন, কৃচ্ছ্র পথ অতিক্রম করতে হয়। তাই বলে জরুরি অবস্থা বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে জয়প্রকাশ নারায়ণ যেভাবে আরএসএসকে সংযুক্ত করে, আগামী দিনের জন্য একটি বিপদের সম্ভাবনাকে উন্মুক্ত করে দিচ্ছিলেন, সে সম্পর্কেও কিন্তু ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম তথা বাংলার সংবাদ মাধ্যমগুলি যথাযথ ভূমিকা পালন করেনি। এই প্রসঙ্গে বস্তুত আরএসএসকে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করে দেওয়ার লক্ষ্যে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলির একটা ভূমিকা আমরা কখনোই অস্বীকার করতে পারি না।

আজ বাংলাদেশে যেমন কিছু কিছু হাতেগোনা সংবাদ মাধ্যম সেদেশের গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোকে ভেঙে দিতে তৎপর, ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবেশকে বিনষ্ট করবার জন্য আদা-জল খেয়ে নেমে পড়েছে, এমনটা কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেও বারবার দেখতে পাওয়া যায়। বাংলাদেশের শেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে, গণতান্ত্রিক পরিবেশকে রুদ্ধ করবার ক্ষেত্রে সেখানকার বাছাই করা কয়েকটি সংবাদপত্রের যে নেতিবাচক ভূমিকা, সেনা মোতায়েনের মধ্যে দিয়ে হানাদার পাক বাহিনীর সমর্থক, রাজনৈতিক দলকে আবার ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করবার লক্ষ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে কর্ম পদ্ধতি, তাকে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষদের মধ্যে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে সেখানকার হাতেগোনা দুএকটি সংবাদপত্র অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল।

এই প্রবণতা কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ব্যক্তি মালিকানাধীন খবরের কাগজগুলি বা আজকের দিনে অত্যন্ত সক্রিয় বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমগুলির ভিতর অত্যন্ত বেশি পরিমাণে দেখতে পাওয়া যায়। সদ্য অতীতে যেমন তৎকালীন সময়ে ক্ষমতাসীন বামপন্থী সরকারকে উৎখাত করবার লক্ষ্যে এই সংবাদ মাধ্যমের একটা বড় অংশ গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল বলে অভিযোগ। সময়ের সাথে তাল রেখে বলতে হয় যে, সেই অভিযোগের যথার্থতা যেন এখন সাধারণ মানুষের চোখের সামনে ফুটে উঠতে শুরু করেছে।

পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীরা যখন ক্ষমতাসীন ছিল, তখন সেই মন্ত্রিসভার ভেতর কিছু কিছু রাজনৈতিক দল কেবলমাত্র কমিউনিস্টদের বিরোধিতা করবার প্রশ্নে, সিপিআই (এমে)র বিরোধিতা করবার প্রশ্নে, সেই সময়ের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিকে সাহায্য করতে প্রত্যক্ষভাবে আসরে নেমে পড়েছিল। এই প্রসঙ্গে একটি ঘোরতর কমিউনিস্ট বিরোধী সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠায় ফরোয়ার্ড ব্লকের প্রয়াত চিত্ত বসু, অশোক ঘোষদের ভূমিকার কথা এই প্রসঙ্গে বলতে হয়।

বাংলাদেশে শেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করার কৌশলে একাংশের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা ছিল বাংলাদেশের গরিষ্ঠ নাগরিকরা ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অপকর্ম সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরতে সেই সরকার থেকে নিজেদের দূরত্ব তৈরি করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, পশ্চিমবঙ্গে নাগরিক সমাজের একটা বড় অংশ, যাদের সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করবার একটা বড় রকমের ক্ষমতা রয়েছে বলে অনেকেরই বিশ্বাস, তাঁরা কিন্তু বিগত দশ এগারো বছর ধরে একটিবারের জন্যেও শাসকের অপকর্মগুলি জনগণের সামনে তুলে ধরবার প্রশ্নে যথাযথ ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করতে পারছে না।

এভাবে যদি গণতন্ত্রের মূল কাঠামোটিকে শাসক যুব কাষ্ঠে চড়িয়ে বসে, তাহলে তা অচিরেই গোটা ভারত শুধু নয়, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যে গণতান্ত্রিক সরকার পরিচালিত হচ্ছে, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উপরে নানা ধরনের আক্রমণ হচ্ছে, সেই সমস্ত কিছুতেই একটা বড় রকমের বিপদের সামনে এসে দাঁড়াবে।