দৈনিক সংবাদ আমার প্রতিষ্ঠান

নাসিমুন আরা হক

দেশে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে দৈনিক সংবাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। গণতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সংবাদের ভূমিকা সংবাদকে এক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। সংবাদ এক ঐতিহ্য। সংবাদ এক প্রতিষ্ঠান। সংবাদ ছেড়ে এসেছি বহু বছর আগে তবু আজও সংবাদের সঙ্গে আত্মীয়তা অনুভব করি। কেন তা আমি জানি না। এখনও আমি সংবাদকে আমার নিজের প্রতিষ্ঠান বলেই মনে করি।

১৯৭৯ সালে দৈনিক সংবাদে পদ খালি হলে আমি সেখানে লিখিত পরীক্ষা দিই। পরীক্ষা ভাল হয়। আমি নিয়োগ পেয়ে ২১ জুলাই, ১৯৭৯ সংবাদের বার্তা বিভাগে যোগ দিই। আমি লিখিত পরীক্ষায় যে খবরটি অনুবাদ করেছিলাম পরদিনই তা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।

শুরু থেকেই আমি রাতের শিফ্টে কাজ করতে সম্মত হয়েছিলাম। তখন কোনো পত্রিকায় মেয়েরা রাতের শিফটে কাজ করতো না। মেয়েরা তখন সাংবাদিকতায় ছিল না বললেই চলে। সব মিলে মাত্র ১৫ জন। আমি ছাড়া নিনিও রাতের শিফ্টে কাজ করতো। আর কেউ করতো না।

আমি সংবাদে যোগ দিই ১৯৭৯ সালে। সংবাদে তখন আমরা ৫ জন নারী। আমার আগে থেকেই সেখানে ছিলেন মাসুমা খানম, নাসিমুন্নাহার নিনি, আখতার জাহান মালিক, রওশন আরা জলি। আমার কাছাকাছি সময়েই নারী পাতার দায়িত্বে যোগ দেন শামীম আখতার (পরে চলচ্চিত্র পরিচালক)।

সংবাদ অফিস তখন ২৬৩, বংশাল রোডে। মানসী সিনেমার উল্টো দিকে। সংবাদের তখন খুব সুনাম ও মর্যাদা। প্রাচীনতম দৈনিক। শুরুতে মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠিত হলেও ’৫২-র পরে এটি হাত বদল হয়। পরে এর মালিক হন আহমদুল কবির শুরু থেকেই এতে সাংবাদিকরা ছিলেন বামপন্থী। এখানে অনেকেই কমিউনিস্ট বা বাম ঘরানার। বাম আন্দোলনে যুক্ত বলে অনেকেই মাঝে মাঝে কারারুদ্ধ হতেন। কারাগার থেকে কখনও ছাড়া পেলে বেরিয়েই এরা চলে আসতেন সংবাদ অফিসেই।

সংবাদে সমাবেশ ঘটেছিল এক ঝাঁক জ্যোতিষ্কের। এদের মধ্যে ছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেন, শহীদুল্লা কায়সার, জহুর হোসেন চৌধুরী, সন্তোষ গুপ্ত, বজলুর রহমান প্রমুখ। দীর্ঘদিন উপ-সম্পাদকীয় লিখেছেন উপরোক্তরা ছাড়াও আবু জাফর শামসুদ্দিন, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, কবি শামসুর রাহমান, বদরুদ্দিন হুসাইন প্রমুখ।

১৯৫১ সালের ১৭ মে দৈনিক সংবাদ প্রকাশিত হয়। সেকালে সংবাদই প্রথম পত্রিকা যেটি বাংলা নাম নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। তার আগের পত্রিকা ছিল ইত্তেফাক, আজাদ, ইত্তেহাদ, মিল্লাত ইত্যাদি। সংবাদের মাস্টহেড করে দিয়েছিলেন প্রখ্যাত শিল্পী কামরুল হাসান।

ওপরে যাদের কথা বললাম, তাদের মধ্যে রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেন, শহীদুল্লা কায়সার, সন্তোষ গুপ্ত, বজলুর রহমান- ওঁদের কাছে অনেক স্নেহ পেয়েছি। তখনও অবশ্য আমি সংবাদে যোগ দিইনি। আর আমি যে সাংবাদিকতায় আসবো কোনোদিন তাও জানতাম না। তখন তো আমি আন্দোলন-সংগ্রাম নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। তখন প্রায়ই গিয়েছি কখনও ছাত্র ইউনিয়ন, কখনও মহিলা পরিষদের প্রেস রিলিজ পৌঁছাতে। তারও আগে গিয়েছি খেলাঘরের সভায় যোগ দিতে। সংবাদে আমার দীর্ঘ কবিতাও প্রকাশিত হয়েছে। তখন সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত। তিনি সবসময় আমাদের উৎসাহিত করেছেন। ওঁর ¯েœহ আমার কাছে খুবই মূল্যবান।

এখনে বলা দরকার, আবুল হাসনাত ১৯৬৫ সাল থেকেই সংবাদে সাংবাদিকতা করেছে। ওর সঙ্গে ছাত্র ইউনিয়ন করার সুবাদে পরিচয় তো ছিলই। ইতোমধ্যে ১৯৭৪ সালে আমাদের বিয়ে হয়েছে। হাসনাত তখনও সংবাদেই কর্মরত সাহিত্য সম্পাদক হিসাবে। অবশেষে আমিও সংবাদে কাজ শুরু করলাম ১৯৭৯ সালের ২১ জুলাই। নিউজ ডেস্কে তখন ছিল তিনটি শিফ্ট। সকাল, দুপুর ও রাতের শিফ্ট। রাতের শিফ্ট ছিল ৬টা থেকে রাত ১২টা। ১৫ দিন করে ছিল এক একটি শিফ্ট। দুটি শিফ্ট পরই আমাকে রাতের শিফটে দেয়া হয়। সেই শুরু। সংবাদে ছিলাম ১৯৭৯ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত। ১৩ বছর। জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর বহু বছর সন্ধ্যা ৬টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত দেশে কার্ফ্যু বা সান্ধ্য আইন জারি ছিল। বছরের পর বছর তখন কার্ফ্যুর মধ্যে রাতে আমাদের বাড়ি ফিরতে হতো। পুরো রাস্তা সুনসান। কেউ কোথাও নেই। আমরা কয়েকজন মাত্র অফিসের ভাড়া করা অটোরিক্সায় বাড়ি ফিরতাম। অনেক সময় মিলিটারি রাস্তায় থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতো। তখন তারা নারী সাংবাদিক দেখেনি। নারীরা যে সাংবাদিকতা করতে পারে বিশ্বাস করতে পারতো না। তাই অনেক সময় ভুলভাল জেরা করতো। অনেক ঝুঁকি নিয়ে আমরা তখন সংবাদে কাজ করেছি। তবে ঝুঁকি যেমন ছিল, তেমনি কাজটা চ্যালেঞ্জিং বলে থ্রিলও ছিল।

তখন সম্পাদক আহমদুল কবির, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বজলুর রহমান, বার্তা সম্পাদক আবদুল আওয়াল খান। সন্তোষ গুপ্ত, তোহা খান প্রমুখ সম্পাদকীয় বিভাগে ছিল সহকারী সম্পাদক হিসবে। বার্তা বিভাগে শিফ্ট ইন চার্জ ছিলেন শহীদুল ইসলাম, মোজাম্মেল হোসেন মন্টু ও চপল বাশার। এখানেই আমার মূলধারার সংবাদপত্রের হাতেখড়ি। এপিএনে আমাদের কাছ ছিল বড় বড় নিবন্ধ অনুবাদ করা। মূলত ব্রেজনেভের বক্তৃতা ইত্যাদি অনুবাদ করা। সংবাদপত্রের কাজ আমি সংবাদেই শিখেছি। শিখেছি কাজ করতে করতে। সকলের সহযোগিতা পেয়েছি। আবার কখনও অসহযোগিতাও যে পাইনি তা বলবো না।

প্রতিকূলতাকে জয় করে করে এগিয়ে গিয়েছি। রাতের শিফ্ট ১২ টা পর্যন্ত হলেও প্রায়ই ১টা দেড়টা বেজে যেত। নিয়ম ছিল কাজ শেষ করা পর্যন্ত থাকতে হবে। প্রায়ই অধিক রাত পর্যন্ত থাকতে হতো। ’৭৯ সালেই ভারতের নির্বাচনের সময় আমরা রাত তিনটায় ফিরেছিলাম। ’৭৭-এ ইন্দিরা গান্ধী পরাজিত হবার পর ’৭৯তে পুনরায় জয়ী হয়ে সংসদে ফিরেছিলেন। সেটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

এরশাদের ক্ষমতা দখলের পর প্রথম দিকে ঢিলেঢালা হলেও পরে কঠিন সামরিক শাসন জারি হয়। সে সময় কার্ফ্যুর মধ্যে অফিস থেকে মাইক্রোবাসে পাঠিয়ে আমাদের আনা হয়। রাতের শিফ্ট ছিল। আমরা বিকাল ৬টায় অফিসে গিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত অফিসেই ছিলাম। মনে পড়ে, অফিস থেকে উল্টোদিকে চাঁদ মিয়ার হোটেলে আমাদের রাতের খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল।

একবার রাতে কাজ করছি। প্রচণ্ড ঝড় হলো। আমাদের কাজ শেষ করতে করতে ১টা দেড়টা হয়েছিল। ঝড়ের পর বিদ্যুত নেই। আমাদের সম্বল সেই ঝরঝরে বেবী ট্যাক্সি। রাস্তায় প্রচুর জল জমে গেছে। নওয়াবপুর দিয়ে গিয়ে গাড়ি আর যেতে পারলো না। গাড়ি ঘুরিয়ে টিপু সুলতান রোডে ঢুকলো। সেখানে হঠাৎ ছিনতাইকারীরা গাড়ি থামালো। আমরা ৫/৬ জন ছিলাম। দিল্ওয়ার, জি.এম ইয়াকুব ভাই ছিলেন। অন্যদের নাম মনে পড়ছে না। ওদের হতে বড় বড় চাপাতি। সবার হাতের ঘড়ি, টাকাপয়সা যা ছিল দিয়ে নিস্তার পাওয়া গেল। তারপর ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি ফেরা।

আমাদের সহকর্মীরা যারা লেট্ নাইট ডিউটি সেরে শেষ রাতে বাড়ি ফিরতেন তাদেরকে প্রায়ই রাস্তার কুকুরের তাড়া খেতে হতো। মন্টুদার কাছে এসব গল্প শুনতাম। আমাদের অবশ্য কুকুরের তাড়া খেতে হয়নি।

২৫ মার্চের পর ২৭ মার্চ সংবাদ অফিস আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। পাকিস্তানি আর্মি সংবাদ অফিসে আগুন দিয়েছিল। সংবাদ ভবনের সঙ্গে পুড়ে গিয়েছিলেন লেখক শহীদ সাবের। সংবাদ সব সময় গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা ও সমাজ প্রগতির পক্ষে ছিল তাই সংবাদের ওপর ওদের সব আক্রোশ। মুক্তিযুদ্ধের সাড়ে ৯ মাসে সংবাদ আর প্রকাশ হয়নি। বহু হুমকির মুখেও আহমদুল কবির সাহেব তখন পাকিস্তান সরকারের চাপে সংবাদ প্রকাশ করেননি। স্বাধীনতার পর সংবাদ আবার প্রকাশ করা হয়। তখন কোনো রকমে একটি টিনশেড তুলে কাজ শুরু করা হয়। আমি ঐ টিনশেডেই কাজে যোগ দিই। পাশে পুরানো দোতলার জায়গায় ভবন নির্মাণের কাজ চলছিল পরে নির্মীয়মান বহুতল ভবনের দোতলায় আমাদের আমাদের বার্তা বিভাগ ও সম্পাদকীয় বিভাগ স্থানান্তরিত হয়। পরে তিন তলাজুড়ে বড় লাইব্রেরি করা হয়। আহমদুল কবির সাহেবের অনেক সুন্দর সুন্দর পরিকল্পনা ছিল সংবাদকে ঘিরে; তার একটি হলো লাইব্রেরি। পরে অফিস স্থানান্তরের পরে স্থান সংকুলান না হওয়ায় লাইব্রেরিটি ক্রমে ছোট হয়ে যায়। ছোট হতে হতে একসময় বিলুপ্ত হয়ে যায়। এখন আর কিছু নেই। সংবাদের সকল কপি সুন্দর করে ফাইল করা ছিল।

সংবাদ তার বহুদিনের আবাস ২৬৩, বংশাল রোড ছেড়ে ৩৭, পুরানা পল্টনের দোতলায় স্থানান্তরিত হয়। নতুন ঝকঝকে এপার্টমেন্ট ফ্লোর। কবির সহেব আদেশ জারি করেছিলেন কেউ চা খেতে পারবে না। চা পড়ে দাগ লেগে দেয়াল, মেঝে নষ্ট হয়ে যাবে সেজন্য। চা খাওয়া অবশ্য চলতেই থাকলো। সেসব নিয়মের কড়াকড়ি আর ছিল না পরে, কারণ থাকা সম্ভব ছিল না। নিউজে কাজ করব আর চা খাবো না?

আরেকবার আহমদুল কবির সাহেব সংবাদে নোটিশ জারি করেছিলেন সংবাদে চাকরির ৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে কেউ বিয়ে করতে পারবে না। কেউ কেই তাই বিয়ের ব্যাপারটা অফিসে গোপন রেখেছিল। নোটিশ দিয়ে বিয়ে কি আর বন্ধ রাখা যায়? মজার ঘটনা হিসাবে এগুলো উল্লেখ করলাম।

তবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সম্পাদক হিসেবে আহমদুল কবিরের এবং সংবাদ পত্রিকার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এবং অসাম্প্রদায়িক সমাজ গড়ার আন্দোলনে আহমদুল কবির খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। এ তো ইতিহাসের অংশ। এসব কথা নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা উচিত।

এই আন্দোলনে দৈনিক সংবাদ অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। এই ভূমিকা বাংলাদেশের ইতিহাসে অমোচনীয়। সংবাদের একজন কর্মী ছিলাম বলে তাই আজও গৌরব বোধ করি। আহমদুল কবির ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কোষাধ্যক্ষ হিসাবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। রাজনীতিতেও তিনি ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও বাম ঘরানার সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৯৬৪-র দাঙ্গার সময় তিনি তার ব্যবসায়িক অফিস ছেড়ে দিয়েছিলেন দাঙ্গা দমনে নিয়োজিতদের জন্য। অনেককে নিজ বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন। দাঙ্গার সময় তিনি রণেশ দাশগুপ্ত, সন্তোষ গুপ্ত প্রমুখ বাম নেতাদের সব সময়ই খোঁজখবর রেখেছেন ও প্রভূত সহযোগিতা করেছেন বলেই জেনেছি।

তিনি সংবাদকে একটা মর্যাদার জায়গায় নিয়ে যেতে পেরেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, তিনি দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার পরে সংবাদ সে জায়গাটা পরে আর ধরে রাখতে পরেনি।

সংবাদ আহমদুল কবির স্মরণে কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন করে না। তার স্মৃতিকে ধরে রাখার কোনো উদ্যোগ নেই। সেই সঙ্গে জহুর হোসেন চৌধুরী, শহীদুল্লা কায়সার, রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেন, সন্তোষ গুপ্ত, বজলুর রহমান তাদের স্মরণেও কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন করে না এও অত্যন্ত দুঃখজনক।

আমি সংবাদে ছিলাম সংবাদের সবচাইতে উজ্জ্বল সময়ে। সংবাদের সার্কুলেশন তখন ভাল ছিল। কাজেই আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল। সাংবাদিকদের বেতন নিয়মিত ছিল। সংবাদে সাংবাদিকতার একটা মান বজায় রাখার দিকে সব সময়ই নজর দেওয়া হতো।

সংবাদে সাংবাদিক ইউনিয়ন তখন মোটামুটি শক্তিশালীই ছিল। আমি দুটি বড় আন্দোলন দেখেছি ইউনিয়নের উদ্যোগে। একটি বংশালে

থাকার সময়। আরেকটি পুরানা পল্টনে আসার পরে। বংশালে আন্দোলন হয়েছিল ৬০% ডি.এ’র দাবিতে। পুরানা পল্টনে আসার পরের আন্দোলনটা হয়েছিল নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পদোন্নতির দাবিতে অনিয়মতান্ত্রিক পদোন্নতি দানের বিরুদ্ধে। সেই সঙ্গে আরও কতগুলো ন্যায্য দাবিদাওয়া ছিল। বিশুদ্ধ খাবার পানির দাবিও তার মধ্যে ছিল। এদুটিই আমার দেখা সংবাদে বড় আন্দোলন।

এই সব আন্দেলনকে ঘিরে মালিকপক্ষের ও সংবাদকর্মীদের অনেক ক্ষুদ্রতাও দেখেছি। সংবাদ জীবনে যেমন অনেক ভাল কিছু দেখেছি, আবার কখনও কখনও অনেক ক্ষুদ্রতাও দেখেছি। আসলে এগুলো বোধহয় জীবনেরই অঙ্গ। এই আন্দোলনের পর সংবাদের ভেতরে গ্রুপিং এত বেশি হয়ে গেল যে, সেখানে থাকা আমার অসহ্য লাগছিল। আর রাতের ডিউটি করতে করতেও ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। সব মিলিয়ে আমি একটু পরিবর্তন চাইছিলাম মরিয়াভাবে।

তখন সংবাদ ছাড়লাম। সংবাদ সম্পাদক তখন মিশু ভাই (আলতামাশ কবির)। তিনি অবশ্য আমাকে অনুরোধ করেছিলেন থেকে যাবার জন্য। বলেছিলেন, “আমি আপনার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছি না আপনি কাজ করুন।”

সংবাদ ছেড়ে ডানকান ব্রাদার্স বাংলাদেশ লিমিটেড ও পরে জনকণ্ঠে কাজ করেছি। প্রাণের টানে আবারও সংবাদে ফিরেছি। সংবাদ আমাকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানিয়েছে। এবারে কাজ করেছি সম্পাদকীয় বিভাগে সহকারী সম্পাদক এবং সম্পাদকীয় বিভাগের ইন চার্জ হিসাবে। সম্মানের সঙ্গে সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে কাজ করেছি। এখনও আমি নিজেকে সংবাদেরই একজন মনে করি।

সংবাদের সম্পাদকীয় পাতা ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ। বিশেষ করে সংবাদের সাহিত্য সাময়িকী বিভাগ ছিল অত্যন্ত রুচিশীল ও সমৃদ্ধ ও মানসম্পন্ন। আবুল হাসনাতের সুচারু সম্পাদনায় প্রতি বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হতো চার পাতার সাহিত্য সাময়িকী। আর কোনো পত্রিকা সাহিত্যের জন্য চারটি পাতা বরাদ্দ করেনি। এত সমৃদ্ধ সাহিত্য পাতাও আর কেউ বের করে না। অনেকে শুধু বৃহস্পতিবারের সাহিত্য সাময়িকীর জন্য সংবাদ রাখতো। মানের ব্যাপারে আবুল হাসনাত এতটাই আপোসহীন ছিলেন যে, আবুল হাসনাতের হাত দিয়ে কোনো কবিতা, গল্প বা প্রবন্ধ প্রকাশিত হলে লেখকরা মনে করতো তারা এখন ভাল লেখক হিসাবে বিবেচিত হবেন। সাহিত্য সম্পাদক হিসাবে আবুল হাসনাতও যেন এক মিথে পরিণত হন। বহু নামী লেখকের লেখা সংবাদে প্রকাশিত হয়েছে। সংবাদ অনেক লেখক তৈরিও করেছে। উৎসাহ দিয়ে, লেখা প্রকাশ করে আবুল হাসনাত লেখার জগতে অনেককে এগিয়ে দিয়েছেন।

মফস্বল সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিনও সংবাদেরই সৃষ্টি। চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিন তার কাজের মধ্য দিয়ে এক মিথে পরিণত হয়েছেন। আজও তার নাম গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হয় এবং হতেই থাকবে।

সংবাদ একটি ঐতিহ্য, একটি প্রতিষ্ঠান। সংবাদকে বলা হয় সাংবাদিকতা শিক্ষার সুতিকাগার। বহু নামী দামী সাংবাদিক এখান থেকে কাজ শিখে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছেন। কৃতী হয়েছেন। সংবাদের ইতিহাস অবশ্যই লিপিবদ্ধ করার উদ্যোগ নেয়া দরকার। সংবাদের ঐতিহ্য যেন হারিয়ে না যায়। কারণ সংবাদ বাংলাদেশের ইতিহাসের অঙ্গ।

image

সংবাদ-এর সাবেক প্রধান সম্পাদক প্রয়াত আহমদুল কবিরের জন্মদিনে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন সন্তোষ গুপ্ত ও বজলুর রহমান

আরও খবর
বাংলা নামের প্রথম দৈনিক
বাংলাদেশকেও সাবধানে পা ফেলতে হবে
নির্মলেন্দু গুণের কবিতা
সংবাদ এবং আমার শৈশব
আমার বাতিঘর
শিক্ষার বিবর্তন কিংবা বিবর্তনের শিক্ষা
নয়া মাধ্যম: মিডিয়া ডায়েট ব্যক্তির স্বাধীনতা
সংবাদ-এর ঐতিহ্যিক ধারাবাহিকতা
চলছে লড়াই, চলবে লড়াই
গণমাধ্যমের শক্তি ১৯৭১
সংবাদ ও রণেশ দাশগুপ্ত
আমার ‘সংবাদ’
বিভাগোত্তর কালে দুই বাংলায় গণমাধ্যমের বিবর্তন
দুর্ভিক্ষের পীড়া ও রবীন্দ্রনাথ
সংবাদ ও অর্থনীতি
ভবিষ্যতের গণমাধ্যম গণমাধ্যমের ভবিষ্যৎ
মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতা
দুটি কবিতা : আহমদ সলীম
গোলাম কিবরিয়া পিনু
সাতচল্লিশ পরবর্তী বাংলা গানের বিবর্তন
নারীর মনোজগৎ: আমাদের বিভ্রম ও কল্পকাহিনী
নতুন সময়ের গণমাধ্যম
‘সংবাদ’ শুধু একটি সংবাদপত্র নয়
গৌরব এবং গর্বের সংবাদ
গণমাধ্যম কেবল আশার স্বপ্ন নয়
গণমানুষের নিজের পত্রিকা ‘সংবাদ’
মুক্তিযুদ্ধ ও সাংবাদিকতা
মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িকতা

বুধবার, ০৩ আগস্ট ২০২২

দৈনিক সংবাদ আমার প্রতিষ্ঠান

নাসিমুন আরা হক

image

সংবাদ-এর সাবেক প্রধান সম্পাদক প্রয়াত আহমদুল কবিরের জন্মদিনে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন সন্তোষ গুপ্ত ও বজলুর রহমান

দেশে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে দৈনিক সংবাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। গণতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সংবাদের ভূমিকা সংবাদকে এক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। সংবাদ এক ঐতিহ্য। সংবাদ এক প্রতিষ্ঠান। সংবাদ ছেড়ে এসেছি বহু বছর আগে তবু আজও সংবাদের সঙ্গে আত্মীয়তা অনুভব করি। কেন তা আমি জানি না। এখনও আমি সংবাদকে আমার নিজের প্রতিষ্ঠান বলেই মনে করি।

১৯৭৯ সালে দৈনিক সংবাদে পদ খালি হলে আমি সেখানে লিখিত পরীক্ষা দিই। পরীক্ষা ভাল হয়। আমি নিয়োগ পেয়ে ২১ জুলাই, ১৯৭৯ সংবাদের বার্তা বিভাগে যোগ দিই। আমি লিখিত পরীক্ষায় যে খবরটি অনুবাদ করেছিলাম পরদিনই তা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।

শুরু থেকেই আমি রাতের শিফ্টে কাজ করতে সম্মত হয়েছিলাম। তখন কোনো পত্রিকায় মেয়েরা রাতের শিফটে কাজ করতো না। মেয়েরা তখন সাংবাদিকতায় ছিল না বললেই চলে। সব মিলে মাত্র ১৫ জন। আমি ছাড়া নিনিও রাতের শিফ্টে কাজ করতো। আর কেউ করতো না।

আমি সংবাদে যোগ দিই ১৯৭৯ সালে। সংবাদে তখন আমরা ৫ জন নারী। আমার আগে থেকেই সেখানে ছিলেন মাসুমা খানম, নাসিমুন্নাহার নিনি, আখতার জাহান মালিক, রওশন আরা জলি। আমার কাছাকাছি সময়েই নারী পাতার দায়িত্বে যোগ দেন শামীম আখতার (পরে চলচ্চিত্র পরিচালক)।

সংবাদ অফিস তখন ২৬৩, বংশাল রোডে। মানসী সিনেমার উল্টো দিকে। সংবাদের তখন খুব সুনাম ও মর্যাদা। প্রাচীনতম দৈনিক। শুরুতে মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠিত হলেও ’৫২-র পরে এটি হাত বদল হয়। পরে এর মালিক হন আহমদুল কবির শুরু থেকেই এতে সাংবাদিকরা ছিলেন বামপন্থী। এখানে অনেকেই কমিউনিস্ট বা বাম ঘরানার। বাম আন্দোলনে যুক্ত বলে অনেকেই মাঝে মাঝে কারারুদ্ধ হতেন। কারাগার থেকে কখনও ছাড়া পেলে বেরিয়েই এরা চলে আসতেন সংবাদ অফিসেই।

সংবাদে সমাবেশ ঘটেছিল এক ঝাঁক জ্যোতিষ্কের। এদের মধ্যে ছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেন, শহীদুল্লা কায়সার, জহুর হোসেন চৌধুরী, সন্তোষ গুপ্ত, বজলুর রহমান প্রমুখ। দীর্ঘদিন উপ-সম্পাদকীয় লিখেছেন উপরোক্তরা ছাড়াও আবু জাফর শামসুদ্দিন, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, কবি শামসুর রাহমান, বদরুদ্দিন হুসাইন প্রমুখ।

১৯৫১ সালের ১৭ মে দৈনিক সংবাদ প্রকাশিত হয়। সেকালে সংবাদই প্রথম পত্রিকা যেটি বাংলা নাম নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। তার আগের পত্রিকা ছিল ইত্তেফাক, আজাদ, ইত্তেহাদ, মিল্লাত ইত্যাদি। সংবাদের মাস্টহেড করে দিয়েছিলেন প্রখ্যাত শিল্পী কামরুল হাসান।

ওপরে যাদের কথা বললাম, তাদের মধ্যে রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেন, শহীদুল্লা কায়সার, সন্তোষ গুপ্ত, বজলুর রহমান- ওঁদের কাছে অনেক স্নেহ পেয়েছি। তখনও অবশ্য আমি সংবাদে যোগ দিইনি। আর আমি যে সাংবাদিকতায় আসবো কোনোদিন তাও জানতাম না। তখন তো আমি আন্দোলন-সংগ্রাম নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। তখন প্রায়ই গিয়েছি কখনও ছাত্র ইউনিয়ন, কখনও মহিলা পরিষদের প্রেস রিলিজ পৌঁছাতে। তারও আগে গিয়েছি খেলাঘরের সভায় যোগ দিতে। সংবাদে আমার দীর্ঘ কবিতাও প্রকাশিত হয়েছে। তখন সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত। তিনি সবসময় আমাদের উৎসাহিত করেছেন। ওঁর ¯েœহ আমার কাছে খুবই মূল্যবান।

এখনে বলা দরকার, আবুল হাসনাত ১৯৬৫ সাল থেকেই সংবাদে সাংবাদিকতা করেছে। ওর সঙ্গে ছাত্র ইউনিয়ন করার সুবাদে পরিচয় তো ছিলই। ইতোমধ্যে ১৯৭৪ সালে আমাদের বিয়ে হয়েছে। হাসনাত তখনও সংবাদেই কর্মরত সাহিত্য সম্পাদক হিসাবে। অবশেষে আমিও সংবাদে কাজ শুরু করলাম ১৯৭৯ সালের ২১ জুলাই। নিউজ ডেস্কে তখন ছিল তিনটি শিফ্ট। সকাল, দুপুর ও রাতের শিফ্ট। রাতের শিফ্ট ছিল ৬টা থেকে রাত ১২টা। ১৫ দিন করে ছিল এক একটি শিফ্ট। দুটি শিফ্ট পরই আমাকে রাতের শিফটে দেয়া হয়। সেই শুরু। সংবাদে ছিলাম ১৯৭৯ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত। ১৩ বছর। জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর বহু বছর সন্ধ্যা ৬টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত দেশে কার্ফ্যু বা সান্ধ্য আইন জারি ছিল। বছরের পর বছর তখন কার্ফ্যুর মধ্যে রাতে আমাদের বাড়ি ফিরতে হতো। পুরো রাস্তা সুনসান। কেউ কোথাও নেই। আমরা কয়েকজন মাত্র অফিসের ভাড়া করা অটোরিক্সায় বাড়ি ফিরতাম। অনেক সময় মিলিটারি রাস্তায় থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতো। তখন তারা নারী সাংবাদিক দেখেনি। নারীরা যে সাংবাদিকতা করতে পারে বিশ্বাস করতে পারতো না। তাই অনেক সময় ভুলভাল জেরা করতো। অনেক ঝুঁকি নিয়ে আমরা তখন সংবাদে কাজ করেছি। তবে ঝুঁকি যেমন ছিল, তেমনি কাজটা চ্যালেঞ্জিং বলে থ্রিলও ছিল।

তখন সম্পাদক আহমদুল কবির, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বজলুর রহমান, বার্তা সম্পাদক আবদুল আওয়াল খান। সন্তোষ গুপ্ত, তোহা খান প্রমুখ সম্পাদকীয় বিভাগে ছিল সহকারী সম্পাদক হিসবে। বার্তা বিভাগে শিফ্ট ইন চার্জ ছিলেন শহীদুল ইসলাম, মোজাম্মেল হোসেন মন্টু ও চপল বাশার। এখানেই আমার মূলধারার সংবাদপত্রের হাতেখড়ি। এপিএনে আমাদের কাছ ছিল বড় বড় নিবন্ধ অনুবাদ করা। মূলত ব্রেজনেভের বক্তৃতা ইত্যাদি অনুবাদ করা। সংবাদপত্রের কাজ আমি সংবাদেই শিখেছি। শিখেছি কাজ করতে করতে। সকলের সহযোগিতা পেয়েছি। আবার কখনও অসহযোগিতাও যে পাইনি তা বলবো না।

প্রতিকূলতাকে জয় করে করে এগিয়ে গিয়েছি। রাতের শিফ্ট ১২ টা পর্যন্ত হলেও প্রায়ই ১টা দেড়টা বেজে যেত। নিয়ম ছিল কাজ শেষ করা পর্যন্ত থাকতে হবে। প্রায়ই অধিক রাত পর্যন্ত থাকতে হতো। ’৭৯ সালেই ভারতের নির্বাচনের সময় আমরা রাত তিনটায় ফিরেছিলাম। ’৭৭-এ ইন্দিরা গান্ধী পরাজিত হবার পর ’৭৯তে পুনরায় জয়ী হয়ে সংসদে ফিরেছিলেন। সেটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

এরশাদের ক্ষমতা দখলের পর প্রথম দিকে ঢিলেঢালা হলেও পরে কঠিন সামরিক শাসন জারি হয়। সে সময় কার্ফ্যুর মধ্যে অফিস থেকে মাইক্রোবাসে পাঠিয়ে আমাদের আনা হয়। রাতের শিফ্ট ছিল। আমরা বিকাল ৬টায় অফিসে গিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত অফিসেই ছিলাম। মনে পড়ে, অফিস থেকে উল্টোদিকে চাঁদ মিয়ার হোটেলে আমাদের রাতের খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল।

একবার রাতে কাজ করছি। প্রচণ্ড ঝড় হলো। আমাদের কাজ শেষ করতে করতে ১টা দেড়টা হয়েছিল। ঝড়ের পর বিদ্যুত নেই। আমাদের সম্বল সেই ঝরঝরে বেবী ট্যাক্সি। রাস্তায় প্রচুর জল জমে গেছে। নওয়াবপুর দিয়ে গিয়ে গাড়ি আর যেতে পারলো না। গাড়ি ঘুরিয়ে টিপু সুলতান রোডে ঢুকলো। সেখানে হঠাৎ ছিনতাইকারীরা গাড়ি থামালো। আমরা ৫/৬ জন ছিলাম। দিল্ওয়ার, জি.এম ইয়াকুব ভাই ছিলেন। অন্যদের নাম মনে পড়ছে না। ওদের হতে বড় বড় চাপাতি। সবার হাতের ঘড়ি, টাকাপয়সা যা ছিল দিয়ে নিস্তার পাওয়া গেল। তারপর ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি ফেরা।

আমাদের সহকর্মীরা যারা লেট্ নাইট ডিউটি সেরে শেষ রাতে বাড়ি ফিরতেন তাদেরকে প্রায়ই রাস্তার কুকুরের তাড়া খেতে হতো। মন্টুদার কাছে এসব গল্প শুনতাম। আমাদের অবশ্য কুকুরের তাড়া খেতে হয়নি।

২৫ মার্চের পর ২৭ মার্চ সংবাদ অফিস আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। পাকিস্তানি আর্মি সংবাদ অফিসে আগুন দিয়েছিল। সংবাদ ভবনের সঙ্গে পুড়ে গিয়েছিলেন লেখক শহীদ সাবের। সংবাদ সব সময় গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা ও সমাজ প্রগতির পক্ষে ছিল তাই সংবাদের ওপর ওদের সব আক্রোশ। মুক্তিযুদ্ধের সাড়ে ৯ মাসে সংবাদ আর প্রকাশ হয়নি। বহু হুমকির মুখেও আহমদুল কবির সাহেব তখন পাকিস্তান সরকারের চাপে সংবাদ প্রকাশ করেননি। স্বাধীনতার পর সংবাদ আবার প্রকাশ করা হয়। তখন কোনো রকমে একটি টিনশেড তুলে কাজ শুরু করা হয়। আমি ঐ টিনশেডেই কাজে যোগ দিই। পাশে পুরানো দোতলার জায়গায় ভবন নির্মাণের কাজ চলছিল পরে নির্মীয়মান বহুতল ভবনের দোতলায় আমাদের আমাদের বার্তা বিভাগ ও সম্পাদকীয় বিভাগ স্থানান্তরিত হয়। পরে তিন তলাজুড়ে বড় লাইব্রেরি করা হয়। আহমদুল কবির সাহেবের অনেক সুন্দর সুন্দর পরিকল্পনা ছিল সংবাদকে ঘিরে; তার একটি হলো লাইব্রেরি। পরে অফিস স্থানান্তরের পরে স্থান সংকুলান না হওয়ায় লাইব্রেরিটি ক্রমে ছোট হয়ে যায়। ছোট হতে হতে একসময় বিলুপ্ত হয়ে যায়। এখন আর কিছু নেই। সংবাদের সকল কপি সুন্দর করে ফাইল করা ছিল।

সংবাদ তার বহুদিনের আবাস ২৬৩, বংশাল রোড ছেড়ে ৩৭, পুরানা পল্টনের দোতলায় স্থানান্তরিত হয়। নতুন ঝকঝকে এপার্টমেন্ট ফ্লোর। কবির সহেব আদেশ জারি করেছিলেন কেউ চা খেতে পারবে না। চা পড়ে দাগ লেগে দেয়াল, মেঝে নষ্ট হয়ে যাবে সেজন্য। চা খাওয়া অবশ্য চলতেই থাকলো। সেসব নিয়মের কড়াকড়ি আর ছিল না পরে, কারণ থাকা সম্ভব ছিল না। নিউজে কাজ করব আর চা খাবো না?

আরেকবার আহমদুল কবির সাহেব সংবাদে নোটিশ জারি করেছিলেন সংবাদে চাকরির ৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে কেউ বিয়ে করতে পারবে না। কেউ কেই তাই বিয়ের ব্যাপারটা অফিসে গোপন রেখেছিল। নোটিশ দিয়ে বিয়ে কি আর বন্ধ রাখা যায়? মজার ঘটনা হিসাবে এগুলো উল্লেখ করলাম।

তবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সম্পাদক হিসেবে আহমদুল কবিরের এবং সংবাদ পত্রিকার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এবং অসাম্প্রদায়িক সমাজ গড়ার আন্দোলনে আহমদুল কবির খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। এ তো ইতিহাসের অংশ। এসব কথা নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা উচিত।

এই আন্দোলনে দৈনিক সংবাদ অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। এই ভূমিকা বাংলাদেশের ইতিহাসে অমোচনীয়। সংবাদের একজন কর্মী ছিলাম বলে তাই আজও গৌরব বোধ করি। আহমদুল কবির ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কোষাধ্যক্ষ হিসাবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। রাজনীতিতেও তিনি ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও বাম ঘরানার সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৯৬৪-র দাঙ্গার সময় তিনি তার ব্যবসায়িক অফিস ছেড়ে দিয়েছিলেন দাঙ্গা দমনে নিয়োজিতদের জন্য। অনেককে নিজ বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন। দাঙ্গার সময় তিনি রণেশ দাশগুপ্ত, সন্তোষ গুপ্ত প্রমুখ বাম নেতাদের সব সময়ই খোঁজখবর রেখেছেন ও প্রভূত সহযোগিতা করেছেন বলেই জেনেছি।

তিনি সংবাদকে একটা মর্যাদার জায়গায় নিয়ে যেতে পেরেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, তিনি দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার পরে সংবাদ সে জায়গাটা পরে আর ধরে রাখতে পরেনি।

সংবাদ আহমদুল কবির স্মরণে কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন করে না। তার স্মৃতিকে ধরে রাখার কোনো উদ্যোগ নেই। সেই সঙ্গে জহুর হোসেন চৌধুরী, শহীদুল্লা কায়সার, রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেন, সন্তোষ গুপ্ত, বজলুর রহমান তাদের স্মরণেও কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন করে না এও অত্যন্ত দুঃখজনক।

আমি সংবাদে ছিলাম সংবাদের সবচাইতে উজ্জ্বল সময়ে। সংবাদের সার্কুলেশন তখন ভাল ছিল। কাজেই আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল। সাংবাদিকদের বেতন নিয়মিত ছিল। সংবাদে সাংবাদিকতার একটা মান বজায় রাখার দিকে সব সময়ই নজর দেওয়া হতো।

সংবাদে সাংবাদিক ইউনিয়ন তখন মোটামুটি শক্তিশালীই ছিল। আমি দুটি বড় আন্দোলন দেখেছি ইউনিয়নের উদ্যোগে। একটি বংশালে

থাকার সময়। আরেকটি পুরানা পল্টনে আসার পরে। বংশালে আন্দোলন হয়েছিল ৬০% ডি.এ’র দাবিতে। পুরানা পল্টনে আসার পরের আন্দোলনটা হয়েছিল নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পদোন্নতির দাবিতে অনিয়মতান্ত্রিক পদোন্নতি দানের বিরুদ্ধে। সেই সঙ্গে আরও কতগুলো ন্যায্য দাবিদাওয়া ছিল। বিশুদ্ধ খাবার পানির দাবিও তার মধ্যে ছিল। এদুটিই আমার দেখা সংবাদে বড় আন্দোলন।

এই সব আন্দেলনকে ঘিরে মালিকপক্ষের ও সংবাদকর্মীদের অনেক ক্ষুদ্রতাও দেখেছি। সংবাদ জীবনে যেমন অনেক ভাল কিছু দেখেছি, আবার কখনও কখনও অনেক ক্ষুদ্রতাও দেখেছি। আসলে এগুলো বোধহয় জীবনেরই অঙ্গ। এই আন্দোলনের পর সংবাদের ভেতরে গ্রুপিং এত বেশি হয়ে গেল যে, সেখানে থাকা আমার অসহ্য লাগছিল। আর রাতের ডিউটি করতে করতেও ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। সব মিলিয়ে আমি একটু পরিবর্তন চাইছিলাম মরিয়াভাবে।

তখন সংবাদ ছাড়লাম। সংবাদ সম্পাদক তখন মিশু ভাই (আলতামাশ কবির)। তিনি অবশ্য আমাকে অনুরোধ করেছিলেন থেকে যাবার জন্য। বলেছিলেন, “আমি আপনার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছি না আপনি কাজ করুন।”

সংবাদ ছেড়ে ডানকান ব্রাদার্স বাংলাদেশ লিমিটেড ও পরে জনকণ্ঠে কাজ করেছি। প্রাণের টানে আবারও সংবাদে ফিরেছি। সংবাদ আমাকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানিয়েছে। এবারে কাজ করেছি সম্পাদকীয় বিভাগে সহকারী সম্পাদক এবং সম্পাদকীয় বিভাগের ইন চার্জ হিসাবে। সম্মানের সঙ্গে সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে কাজ করেছি। এখনও আমি নিজেকে সংবাদেরই একজন মনে করি।

সংবাদের সম্পাদকীয় পাতা ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ। বিশেষ করে সংবাদের সাহিত্য সাময়িকী বিভাগ ছিল অত্যন্ত রুচিশীল ও সমৃদ্ধ ও মানসম্পন্ন। আবুল হাসনাতের সুচারু সম্পাদনায় প্রতি বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হতো চার পাতার সাহিত্য সাময়িকী। আর কোনো পত্রিকা সাহিত্যের জন্য চারটি পাতা বরাদ্দ করেনি। এত সমৃদ্ধ সাহিত্য পাতাও আর কেউ বের করে না। অনেকে শুধু বৃহস্পতিবারের সাহিত্য সাময়িকীর জন্য সংবাদ রাখতো। মানের ব্যাপারে আবুল হাসনাত এতটাই আপোসহীন ছিলেন যে, আবুল হাসনাতের হাত দিয়ে কোনো কবিতা, গল্প বা প্রবন্ধ প্রকাশিত হলে লেখকরা মনে করতো তারা এখন ভাল লেখক হিসাবে বিবেচিত হবেন। সাহিত্য সম্পাদক হিসাবে আবুল হাসনাতও যেন এক মিথে পরিণত হন। বহু নামী লেখকের লেখা সংবাদে প্রকাশিত হয়েছে। সংবাদ অনেক লেখক তৈরিও করেছে। উৎসাহ দিয়ে, লেখা প্রকাশ করে আবুল হাসনাত লেখার জগতে অনেককে এগিয়ে দিয়েছেন।

মফস্বল সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিনও সংবাদেরই সৃষ্টি। চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিন তার কাজের মধ্য দিয়ে এক মিথে পরিণত হয়েছেন। আজও তার নাম গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হয় এবং হতেই থাকবে।

সংবাদ একটি ঐতিহ্য, একটি প্রতিষ্ঠান। সংবাদকে বলা হয় সাংবাদিকতা শিক্ষার সুতিকাগার। বহু নামী দামী সাংবাদিক এখান থেকে কাজ শিখে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছেন। কৃতী হয়েছেন। সংবাদের ইতিহাস অবশ্যই লিপিবদ্ধ করার উদ্যোগ নেয়া দরকার। সংবাদের ঐতিহ্য যেন হারিয়ে না যায়। কারণ সংবাদ বাংলাদেশের ইতিহাসের অঙ্গ।