নয়া মাধ্যম: মিডিয়া ডায়েট ব্যক্তির স্বাধীনতা

আফরোজা সোমা

১.

একটা সময় ছিল, অধীর আগ্রহ নিয়ে সকলে টিভি অনুষ্ঠানের জন্য অপেক্ষা করতো। একটা সময় ছিল, সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরকে মনে হতো প্রায় বাইবেলের বাণীসম, যেনো ছাপার অক্ষরে লেখা বার্তা কিছুতেই অসত্য হবার নয়।

সেই সব ‘সোনালি দিন’ গত হয়েছে। নয়া মাধ্যম এসে পাল্টে দিয়েছে পুরানা হিসেব। ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে যেমনভাবে রোগীরা অপেক্ষায় থাকে, তেমনি ছিল মিডিয়া একসময়। বিটিভি আমলে সেই কবে শুক্রবার আসবে, কখন তিনটা বাজবে, কখন সিনেমা দেখাবে, কখন আসবে সপ্তাহের সেই নির্দিষ্ট বারের নির্দিষ্ট সময়, কখন দেখাবে ধারাবাহিক নাটকের এপিসোড- এইসব অপেক্ষা, টিভি অনুষ্ঠানের জন্য এইভাবে এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে বসে থাকার দিন ঘুচেছে।

এসেছে নতুন কাল। দর্শকের অপেক্ষার দিন ফুরিয়েছে।

এখন অনুষ্ঠানগুলোই দর্শকের জন্য অধীর হয়ে থাকে। অর্থাৎ এখন দর্শক-পাঠকের জন্য পত্রিকা, টিভি, রেডিও, ম্যাগাজিন মালিকদের প্রহর কাটে প্রতীক্ষায়। এই সুযোগেই বাজারে এসেছে ক্লিকবেইট জার্নালিজম। সেটি নিয়ে খানিক পরে বলছি। তার আগে, দর্শকের বদলে অনুষ্ঠানই কী করে অপেক্ষা করে সেই বিষয়টি খোলাসা করা দরকার।

গণমাধ্যমের এই বিবর্তনের বিষয়টি নিয়ে স্পষ্ট ধারণা পেতে হলে ‘নতুন মিডিয়া’ ও ‘পুরনো মিডিয়া’ নিয়ে দু’-চার কথা বলে নেয়া ভালো। মাধ্যমের এই পরিবর্তিত বাস্তবতা একদিনে ঘটেনি। ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের মতন প্রযুক্তির বদৌলতে শুধু বাংলাদেশ নয়, তামাম দুনিয়ার মানুষের মিডিয়া ডায়েটেই এসেছে বিরাট পরিবর্তন। সেই পরিবর্তনগুলোকেই চিহ্নিত করবে এই লেখা।

ঔপনিবেশিক ভারতে, ১৭৮০ সালে আত্মপ্রকাশ করে ভারতের প্রথম সংবাদপত্র। সেটি ছিল সাপ্তাহিক। তার নেতৃত্বের পুরোভাগে ছিলেন আইরিশম্যান জেমস অগাস্টস হিকি। পত্রিকার নাম ছিল ‘হিকিস বেঙ্গল গ্যাজেট’। চার পৃষ্ঠায় সজ্জিত হয়ে বেরোতো সেই আদি পত্রিকা। খানিকটা ট্যাবলয়েড পত্রিকার ধাঁচ আর খানিকটা স্যটায়ার বা ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপাত্মকতা ছিল ইংরেজি এই কাগজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

সেই ঘটনার পর তো গঙ্গায় কত জল বয়ে গেলো! ভারত ভেঙে প্রথমে দুই দেশ- ভারত, পাকিস্তান- হলো। কিন্তু এগারো শো মাইলের দুই পারে থাকা ভৌগোলিকভাবে দ্বিখণ্ডিত পাকিস্তান টিকলো না (টিকার কোনো কারণও ছিল না।)। পাকিস্তান ভেঙে জন্ম নিলো বাংলাদেশ। ১৯৭১ থেকে ২০২২। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে। এই অর্ধ শতকে পাল্টে গেছে পৃথিবীর তথ্য ও বিনোদন বাণিজ্যের খোল-নলচে।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সলে বাংলাদেশের জিডিপি ছিল ৬ হাজার ১শ ১২ ডলার। ১৯৭২ সালে দেয়া প্রথম বাজেট ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। ছোট্ট অর্থনীতির মতন তখন আমাদের পত্র-পত্রিকার সংখ্যাও ছিল অতি নগণ্য। কড়ে গুনলে এক আঙুলেই শেষ হয়ে যেতো পত্রিকার নাম। তখন ব্রডকাস্ট মিডিয়া বলতে ছিল শুধু বাংলাদেশ টেলিভিশন আর বাংলাদেশ বেতার।

পরবর্তীতে ৮০’র দশক, ৯০-এর দশক এবং এই একবিংশ শতকের গোড়ার দিকে অর্থনৈতিক বদল এসেছে। এই ২০২২ সালে জিডিপি পরিমাণ হতে যাচ্ছে ৪০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর ২০২২-এর বাজেটের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় পৌনে সাত লাখ কোটি টাকা। বিরাট অংকের এই দেশে, অর্থনৈতিক উল্লম্ফনের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পত্র-পত্রিকা, রেডিও ও টেলিভিশনের সংখ্যাও।

বিটিভি কেন্দ্রিক যে বিনোদন জগত ছিল তার পরিসর এখন বিস্তৃত ও কেন্দ্রবিমুখ। বেসরকারী মালিকদের অংশগ্রহণে বাজার বড় হয়েছে। তথ্য, সংবাদ ও বিনোদনমূলক কন্টেন্টের সরবরাহ বেড়েছে। এখন কয়েক ডজন টেলিভিশন চ্যানেল মিলে দৈনিক ২৪ ঘণ্টায় শত শত ঘণ্টার অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে। আর গনতে বসে একসময় হাতের কড়েতেই শেষ হয়ে যাওয়া জাতীয় পত্রিকার সংখ্যা তো ডজনের অধিক।

মাধ্যমের এই ব্যাপকতা দর্শক-পাঠককে দিয়েছে পছন্দের স্বাধীনতা। হড়েক রকম

স্বাদের অনুষ্ঠান এখন হচ্ছে। রাজনীতি, অর্থনীতি, সিনেমা, খবর, খেলা, নিখাঁদ বিনোদন, ব্যাবসা-বাণিজ্যের খুঁটিনাটি বা শিশুদের উপযোগী বয়সভিত্তিক বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান- যার যা চাই সব ছিল হাতের নাগালে। ফলে, এক চ্যানেলে অনুষ্ঠান ভালো না লাগলে মুহূর্তেই চ্যানেল পাল্টে অন্য অনুষ্ঠানে চলে যাবার সুযোগ রয়েছে। পাল্টে ফেলার এই সুযোগটাই দর্শককে ক্ষমতায়িত করেছে।

তবে, তারপরও দর্শককে নির্ভর করতে হতো টিভি চ্যানেলের নির্ধারিত টাইমিং-এর উপরেই। অর্থাৎ প্রচারকারী প্রতিষ্ঠান যখন যা দেখাবে, সেই টাইমিং ও রুচির চৌহদ্দির মধ্যেই দর্শককে নিজের তথ্য ও বিনোদন খুঁজতে হতো। আর ঠিক এই জায়গাটিতেই এসে কিস্তি মাত করে দিয়েছে নিউ মিডিয়া তথা ইন্টারনেট, সোশাল মিডিয়া ও স্মার্ট ফোন।

৩.

মাধ্যম হিসেবে রেডিও ও টিভিকে এককালে ডাকা হতো পুশ মিডিয়া। সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিনকে বলা হতো পুল মিডিয়া। ‘পুশ’ আর ‘পুল’-এর এই ধারণাটা খুব মজার। কোনো পরিচয়-ই যে আসলে স্ট্যাটিক বা স্থায়ী কিছু না সেই বিষয়টিকেই সামনে আনে এই পুশ ও পুল মিডিয়ার সমীকরণ।

যেহেতু টিভি ও রেডিওগুলোর প্রোগ্রাম কখন প্রচার হবে, কী প্রচার হবে এই বিষয়ের সকল সিদ্ধান্ত নিতো প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ। এই যে উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া সময়, যেখানে দর্শক ওই নির্ধারিত সময়ে ‘দেখলে দেখো, না দেখলে পরে আর দেখার উপায় নেই’ বাস্তবতায় বন্দি সেটিকেই বলা হয় পুশ মিডিয়া। এখানে সমস্ত কিছু দেয় স্বয়ং প্রতিষ্ঠান।

কিন্তু পুল মিডিয়া অনেক ফ্লেক্সিবল বা নমনীয়। ধরা যাক, একটি সংবাদপত্র। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দিনের যে কোনো সময়ই পত্রিকাটা পড়ার সুযোগ আছে। টিভির খবরের মতন ঠিক সন্ধ্যা সাতটাতেই দেখতে বসতে হবে না। এই যে, ফ্লেক্সিবিলিটি বা দর্শক-পাঠকের নিজের সুবিধাজনক সময়ে দেখা-পড়ার নমনীয়তা এটিকেই বলা হয় পুল মিডিয়া।

আরো মজার ব্যাপার হলো এই যে, এখন পুশ আর পুল মিডিয়ার সীমারেখাটাই ব্লার বা ঘোলা হয়ে গেছে।

টিভির খবর বলুন বা অনুষ্ঠান বলুন সবই এখন রেখে দেয়া হয় নির্ধারিত চ্যানেলের ইউটিউবে বা লিংকগুলো পোস্ট করে দেয়া হয় ফেসবুকের পাতায়। সেই অনুষ্ঠানগুলো দর্শক যে কোনোদিন নিজের সুবিধাজনক সময়ে দেখতে পারে। আর এভাবেই পুশ ও পুল মিডিয়া মিলমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে।

একটু আগে আলাপের শুরুতেই বলেছিলাম মিডিয়া ডায়েটের কথা। নিউ মিডিয়ার কল্যাণে দর্শক যত ক্ষমতায়িত হয়েছে তার পছন্দের স্বাধীনতা তত বেড়েছে। আর এই পছন্দের স্বাধীনতার সাথেই ওতপ্রোতভাবে জড়িত মিডিয়া ডায়েট।

ধরা যাক, আপনার বাসায় ৫ জন সদস্য। মিডিয়া ব্যবহারের ক্ষেত্রে দেখবেন, একেকজনের একেক রকম পছন্দ-অপছন্দ। আপনার মা হয়তো স্মার্টফোনেই ইউটিউবে পল্লীগীতি শোনেন। আপনার বাবা হয়তো নিজের ফোনে দেখেন এবং শোনেন শুধু ওয়াজ ও ধর্মীয় বয়ান। আপনার বাসায় ৫ বছর বয়সী যেই শিশুটি আছে সে দেখে শুধু কার্টুন। আপনি নিজে হয়তো দেখেন শুধু নিউজ আর টক শো। আর আপনার স্বামী হয়তো দেখেন প্রধানত স্পোর্টস।

এক বাসায় থাকা ৫ জন মানুষের মিডিয়া ডায়েটে কোনো মিল নেই। বুফে সিস্টেমে সাজানো খাবার থেকে যে যার ইচ্ছে মতন যেমন প্লেটে খাবার তুলে নেয়, তথ্য ও বিনোদনের ক্ষেত্রেও বিষয়টা একইরকম। একজনের মিডিয়া ডায়েটের সাথে আরেকজনের মিল নেই। পছন্দের এই স্বাধীনতাই দর্শককে মুক্তি দিয়েছে ‘এপয়েন্টমেন্ট টিভি’র বিড়ম্বনা থেকে। মানে দর্শককে এখন আর ‘লিনিয়ার টাইম’ মেইনটেইন করে সারা জাতীর সাথে নির্ধারিত সময়ে বসে শুক্রবার বিকেলের সিনেমা দেখতে হয় না। সিনেমা এখন ইউটিউব থেকে নন-লিনিয়ার টাইমে সে তার সুবিধা ও রুচি মতন দেখে নয়।

এই বাস্তবতাটা দর্শকের জন্য সুবিধার। কিন্তু তথ্য-বিনোদন বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের জন্য খুব সুখকর নয়। কারণ, বাছাই করার এই স্বাধীনতাই দর্শককে পরিণত করেছে ‘ফ্র্যাগমেন্টেড অডিয়েন্স’-এ। অর্থাৎ এক অনুষ্ঠান দিয়ে দিয়ে সব্বাইকে খুশি করার আর সুযোগ নেই। দর্শকেরা এখন রুচি মোতাবেক আগেই ভাগ ভাগ হয়ে নিজের পছন্দের কন্টেন্ট দেখেন।

৪.

ফ্র্যাগমেন্টেড বা বিভাজিত দর্শক-পাঠকের চাপ এসে পড়েছে গণমাধ্যমের ব্যবসায়। যেই প্ল্যাটফর্ম বা মিডিয়া আউটলেটের পাঠক-দর্শক যত বেশি, সেই প্রতিষ্ঠান সাধারণত বিজ্ঞাপনও বেশি পায়। যত বেশি বিজ্ঞাপন তত বেশি আয়-রোজগার।

অনলাইন নিউজপেপার ও সোশাল মিডিয়ার এই যুগে ক্লিকের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই, নিজেদের ওয়েব সাইটে বা পেজে বেশি-বেশি দর্শক-পাঠক টানতে প্রতিষ্ঠানগুলো মরিয়া হয়ে থাকে। এই মরিয়া প্রচেষ্টার অংশ হিসেবেই নিউজের শিরোনামে কখনো যোগ করা হয় চমক-লাগানো উদ্ভট শব্দ এবং যৌন সুড়সুড়ি দেয়া শব্দ ও ছবি। অর্থাৎ এটা অনেকটা যেনো দর্শক-পাঠক টানার ফাঁদ। আর এই বাস্তবতাটিকেই ডাকা হয় ‘ক্লিকবেইট জার্নালিজম’।

ক্লিকবেইট জার্নিলিজমের কারণে সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতা অনেকক্ষেত্রেই রক্ষিত হচ্ছে না। আর এই ধরনের চর্চা দেখে প্রথাগত গণমাধ্যম যেমন টিভি, রেডিও, নিউজপেপারের অনলাইন সংবাদে মানুষের আস্থা কমে। ফলে, খবর পাবার জন্য অনেক ক্ষেত্রেই ফেসবুকের উপরে মানুষ নির্ভরশীল হচ্ছে। এই সুযোগে সমাজে গুজব বা অর্ধসত্য ছড়ানোর ঝুঁকি বাড়ছে।

পাল্টে যাওয়া এই বাস্তবতা শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা পৃথিবীর জন্যই সত্য। ইউরোপ-অমেরিকাসহ সব উন্নত দেশই ‘মিসইনফরমেশান’- অনিচ্ছাকৃত ভুল বা অসত্য তথ্য, ‘ডিজইনফরমেশন’- উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে অসত্য, মিথ্যা বা অস্পষ্ট তথ্য ছড়িয়ে দেয়া এবং ‘গুজব’ বন্ধে লড়ছে। ট্র্যাডিশনাল বা সনাতনী গণমাধ্যম যেমন টিভি, রেডিও, নিউজপেপার পৃথিবীব্যাপীই অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে। দিকে দিকে এখন অনলাইন ও সোশাল মিডিয়ারই জয় জয়কার।

সারা পৃথিবীতেই ছাপা পত্রিকার সংখ্যা অকল্পনীয় দ্রুততায় কমছে। যারা বেঁচে আছে তাদেরকেও বাঁচার জন্য রপ্ত করতে হচ্ছে নতুন নতুন টেকনিক। তাদেরকেও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে আসতে হচ্ছে, ফেসবুক পেজ খুলতে হচ্ছে, ইউটিউব চ্যানেলে কন্টেন্ট আপলোড করতে হচ্ছে। এভাবেই ফ্র্যাগমেন্টেড অডিয়েন্স বা বিভাজিত দর্শক-পাঠকের কাছে পৌঁছাতে চাইছে গণমাধ্যমগুলো।

৫.

ইংরেজি ‘ম্যাস মিডিয়া’কে বাংলায় নাম দেয়া হয়েছে ‘গণমাধ্যম’। কিন্তু চরিত্রের দিক থেকে আমাদের গণমাধ্যম ‘গণ’কে কতখানি ধারণ করে, ‘গণ’-এর কথা কতখানি বলে? আমাদের মাধ্যম কি চরিত্রগতভাবে এখন কেবলি ‘প্রচার মাধ্যমে’ পরিণত হয়েছে? এই গণমাধ্যম কি মোটাদাগে কেবলি ‘পুঁজির পাহারাদার’? কেবলি রাষ্ট্র ও সমাজের প্রথাগত মতাদর্শ পুনরুৎপাদন-যন্ত্র হিসেবেই কাজ করে যাচ্ছে? যদি তাই হয়, তাহলে সমাজের আম-পাব্লিকের দুঃখ-বঞ্চনার কথাগুলো আমাদের গণমাধ্যমে উহ্য থেকে যাচ্ছে? এগুলোও জরুরি প্রশ্ন।

মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশ শুধু ধনীদের হবার কথা ছিল না। স্বাধীন দেশে গণমানুষের অধিকার নিশ্চিত করবার অঙ্গীকার করা হয়েছিল। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর, এই রাষ্ট্র কি তার সেই গণমুখী চরিত্রকে আদৌ আর ধারণ করছে? এটি জরুরি প্রশ্ন। কিন্তু যে গণমাধ্যম এই প্রশ্ন করার কথা সেটির গণমুখী চরিত্র কি আদৌ বজায় আছে? আমাদের গণমাধ্যমের বিবর্তনকে জানতে হলে শুধু এর আঙ্গিক পরিবর্তন নিয়ে কথা বললেই হবে না। এর চরিত্রগত বদলের বিষয়গুলোকেও চিহ্নিত করতে হবে এবং কথা বলতে হবে।

প্রশ্নকারী ও সমালোচনাকরী হিসেবে আপনার এইসব কথা যদি সাবেকী মিডিয়া প্রকাশ না করে তো সোশাল মিডিয়া তো রয়েছেই। ফেসবুকের একেকটি একাউন্টই এখন একেকটি টেলিভিশন চ্যানেল। ব্যক্তির চ্যানেলই এখন ম্যাস মিডিয়া। তাই, নয়া মাধ্যমের যুগে ব্যক্তির টুঁটি চেপে ধরা কঠিন।

image
আরও খবর
বাংলা নামের প্রথম দৈনিক
বাংলাদেশকেও সাবধানে পা ফেলতে হবে
নির্মলেন্দু গুণের কবিতা
সংবাদ এবং আমার শৈশব
আমার বাতিঘর
শিক্ষার বিবর্তন কিংবা বিবর্তনের শিক্ষা
সংবাদ-এর ঐতিহ্যিক ধারাবাহিকতা
চলছে লড়াই, চলবে লড়াই
গণমাধ্যমের শক্তি ১৯৭১
সংবাদ ও রণেশ দাশগুপ্ত
আমার ‘সংবাদ’
দৈনিক সংবাদ আমার প্রতিষ্ঠান
বিভাগোত্তর কালে দুই বাংলায় গণমাধ্যমের বিবর্তন
দুর্ভিক্ষের পীড়া ও রবীন্দ্রনাথ
সংবাদ ও অর্থনীতি
ভবিষ্যতের গণমাধ্যম গণমাধ্যমের ভবিষ্যৎ
মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতা
দুটি কবিতা : আহমদ সলীম
গোলাম কিবরিয়া পিনু
সাতচল্লিশ পরবর্তী বাংলা গানের বিবর্তন
নারীর মনোজগৎ: আমাদের বিভ্রম ও কল্পকাহিনী
নতুন সময়ের গণমাধ্যম
‘সংবাদ’ শুধু একটি সংবাদপত্র নয়
গৌরব এবং গর্বের সংবাদ
গণমাধ্যম কেবল আশার স্বপ্ন নয়
গণমানুষের নিজের পত্রিকা ‘সংবাদ’
মুক্তিযুদ্ধ ও সাংবাদিকতা
মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িকতা

বুধবার, ০৩ আগস্ট ২০২২

নয়া মাধ্যম: মিডিয়া ডায়েট ব্যক্তির স্বাধীনতা

আফরোজা সোমা

image

১.

একটা সময় ছিল, অধীর আগ্রহ নিয়ে সকলে টিভি অনুষ্ঠানের জন্য অপেক্ষা করতো। একটা সময় ছিল, সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরকে মনে হতো প্রায় বাইবেলের বাণীসম, যেনো ছাপার অক্ষরে লেখা বার্তা কিছুতেই অসত্য হবার নয়।

সেই সব ‘সোনালি দিন’ গত হয়েছে। নয়া মাধ্যম এসে পাল্টে দিয়েছে পুরানা হিসেব। ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে যেমনভাবে রোগীরা অপেক্ষায় থাকে, তেমনি ছিল মিডিয়া একসময়। বিটিভি আমলে সেই কবে শুক্রবার আসবে, কখন তিনটা বাজবে, কখন সিনেমা দেখাবে, কখন আসবে সপ্তাহের সেই নির্দিষ্ট বারের নির্দিষ্ট সময়, কখন দেখাবে ধারাবাহিক নাটকের এপিসোড- এইসব অপেক্ষা, টিভি অনুষ্ঠানের জন্য এইভাবে এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে বসে থাকার দিন ঘুচেছে।

এসেছে নতুন কাল। দর্শকের অপেক্ষার দিন ফুরিয়েছে।

এখন অনুষ্ঠানগুলোই দর্শকের জন্য অধীর হয়ে থাকে। অর্থাৎ এখন দর্শক-পাঠকের জন্য পত্রিকা, টিভি, রেডিও, ম্যাগাজিন মালিকদের প্রহর কাটে প্রতীক্ষায়। এই সুযোগেই বাজারে এসেছে ক্লিকবেইট জার্নালিজম। সেটি নিয়ে খানিক পরে বলছি। তার আগে, দর্শকের বদলে অনুষ্ঠানই কী করে অপেক্ষা করে সেই বিষয়টি খোলাসা করা দরকার।

গণমাধ্যমের এই বিবর্তনের বিষয়টি নিয়ে স্পষ্ট ধারণা পেতে হলে ‘নতুন মিডিয়া’ ও ‘পুরনো মিডিয়া’ নিয়ে দু’-চার কথা বলে নেয়া ভালো। মাধ্যমের এই পরিবর্তিত বাস্তবতা একদিনে ঘটেনি। ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের মতন প্রযুক্তির বদৌলতে শুধু বাংলাদেশ নয়, তামাম দুনিয়ার মানুষের মিডিয়া ডায়েটেই এসেছে বিরাট পরিবর্তন। সেই পরিবর্তনগুলোকেই চিহ্নিত করবে এই লেখা।

ঔপনিবেশিক ভারতে, ১৭৮০ সালে আত্মপ্রকাশ করে ভারতের প্রথম সংবাদপত্র। সেটি ছিল সাপ্তাহিক। তার নেতৃত্বের পুরোভাগে ছিলেন আইরিশম্যান জেমস অগাস্টস হিকি। পত্রিকার নাম ছিল ‘হিকিস বেঙ্গল গ্যাজেট’। চার পৃষ্ঠায় সজ্জিত হয়ে বেরোতো সেই আদি পত্রিকা। খানিকটা ট্যাবলয়েড পত্রিকার ধাঁচ আর খানিকটা স্যটায়ার বা ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপাত্মকতা ছিল ইংরেজি এই কাগজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

সেই ঘটনার পর তো গঙ্গায় কত জল বয়ে গেলো! ভারত ভেঙে প্রথমে দুই দেশ- ভারত, পাকিস্তান- হলো। কিন্তু এগারো শো মাইলের দুই পারে থাকা ভৌগোলিকভাবে দ্বিখণ্ডিত পাকিস্তান টিকলো না (টিকার কোনো কারণও ছিল না।)। পাকিস্তান ভেঙে জন্ম নিলো বাংলাদেশ। ১৯৭১ থেকে ২০২২। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে। এই অর্ধ শতকে পাল্টে গেছে পৃথিবীর তথ্য ও বিনোদন বাণিজ্যের খোল-নলচে।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সলে বাংলাদেশের জিডিপি ছিল ৬ হাজার ১শ ১২ ডলার। ১৯৭২ সালে দেয়া প্রথম বাজেট ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। ছোট্ট অর্থনীতির মতন তখন আমাদের পত্র-পত্রিকার সংখ্যাও ছিল অতি নগণ্য। কড়ে গুনলে এক আঙুলেই শেষ হয়ে যেতো পত্রিকার নাম। তখন ব্রডকাস্ট মিডিয়া বলতে ছিল শুধু বাংলাদেশ টেলিভিশন আর বাংলাদেশ বেতার।

পরবর্তীতে ৮০’র দশক, ৯০-এর দশক এবং এই একবিংশ শতকের গোড়ার দিকে অর্থনৈতিক বদল এসেছে। এই ২০২২ সালে জিডিপি পরিমাণ হতে যাচ্ছে ৪০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর ২০২২-এর বাজেটের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় পৌনে সাত লাখ কোটি টাকা। বিরাট অংকের এই দেশে, অর্থনৈতিক উল্লম্ফনের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পত্র-পত্রিকা, রেডিও ও টেলিভিশনের সংখ্যাও।

বিটিভি কেন্দ্রিক যে বিনোদন জগত ছিল তার পরিসর এখন বিস্তৃত ও কেন্দ্রবিমুখ। বেসরকারী মালিকদের অংশগ্রহণে বাজার বড় হয়েছে। তথ্য, সংবাদ ও বিনোদনমূলক কন্টেন্টের সরবরাহ বেড়েছে। এখন কয়েক ডজন টেলিভিশন চ্যানেল মিলে দৈনিক ২৪ ঘণ্টায় শত শত ঘণ্টার অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে। আর গনতে বসে একসময় হাতের কড়েতেই শেষ হয়ে যাওয়া জাতীয় পত্রিকার সংখ্যা তো ডজনের অধিক।

মাধ্যমের এই ব্যাপকতা দর্শক-পাঠককে দিয়েছে পছন্দের স্বাধীনতা। হড়েক রকম

স্বাদের অনুষ্ঠান এখন হচ্ছে। রাজনীতি, অর্থনীতি, সিনেমা, খবর, খেলা, নিখাঁদ বিনোদন, ব্যাবসা-বাণিজ্যের খুঁটিনাটি বা শিশুদের উপযোগী বয়সভিত্তিক বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান- যার যা চাই সব ছিল হাতের নাগালে। ফলে, এক চ্যানেলে অনুষ্ঠান ভালো না লাগলে মুহূর্তেই চ্যানেল পাল্টে অন্য অনুষ্ঠানে চলে যাবার সুযোগ রয়েছে। পাল্টে ফেলার এই সুযোগটাই দর্শককে ক্ষমতায়িত করেছে।

তবে, তারপরও দর্শককে নির্ভর করতে হতো টিভি চ্যানেলের নির্ধারিত টাইমিং-এর উপরেই। অর্থাৎ প্রচারকারী প্রতিষ্ঠান যখন যা দেখাবে, সেই টাইমিং ও রুচির চৌহদ্দির মধ্যেই দর্শককে নিজের তথ্য ও বিনোদন খুঁজতে হতো। আর ঠিক এই জায়গাটিতেই এসে কিস্তি মাত করে দিয়েছে নিউ মিডিয়া তথা ইন্টারনেট, সোশাল মিডিয়া ও স্মার্ট ফোন।

৩.

মাধ্যম হিসেবে রেডিও ও টিভিকে এককালে ডাকা হতো পুশ মিডিয়া। সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিনকে বলা হতো পুল মিডিয়া। ‘পুশ’ আর ‘পুল’-এর এই ধারণাটা খুব মজার। কোনো পরিচয়-ই যে আসলে স্ট্যাটিক বা স্থায়ী কিছু না সেই বিষয়টিকেই সামনে আনে এই পুশ ও পুল মিডিয়ার সমীকরণ।

যেহেতু টিভি ও রেডিওগুলোর প্রোগ্রাম কখন প্রচার হবে, কী প্রচার হবে এই বিষয়ের সকল সিদ্ধান্ত নিতো প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ। এই যে উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া সময়, যেখানে দর্শক ওই নির্ধারিত সময়ে ‘দেখলে দেখো, না দেখলে পরে আর দেখার উপায় নেই’ বাস্তবতায় বন্দি সেটিকেই বলা হয় পুশ মিডিয়া। এখানে সমস্ত কিছু দেয় স্বয়ং প্রতিষ্ঠান।

কিন্তু পুল মিডিয়া অনেক ফ্লেক্সিবল বা নমনীয়। ধরা যাক, একটি সংবাদপত্র। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দিনের যে কোনো সময়ই পত্রিকাটা পড়ার সুযোগ আছে। টিভির খবরের মতন ঠিক সন্ধ্যা সাতটাতেই দেখতে বসতে হবে না। এই যে, ফ্লেক্সিবিলিটি বা দর্শক-পাঠকের নিজের সুবিধাজনক সময়ে দেখা-পড়ার নমনীয়তা এটিকেই বলা হয় পুল মিডিয়া।

আরো মজার ব্যাপার হলো এই যে, এখন পুশ আর পুল মিডিয়ার সীমারেখাটাই ব্লার বা ঘোলা হয়ে গেছে।

টিভির খবর বলুন বা অনুষ্ঠান বলুন সবই এখন রেখে দেয়া হয় নির্ধারিত চ্যানেলের ইউটিউবে বা লিংকগুলো পোস্ট করে দেয়া হয় ফেসবুকের পাতায়। সেই অনুষ্ঠানগুলো দর্শক যে কোনোদিন নিজের সুবিধাজনক সময়ে দেখতে পারে। আর এভাবেই পুশ ও পুল মিডিয়া মিলমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে।

একটু আগে আলাপের শুরুতেই বলেছিলাম মিডিয়া ডায়েটের কথা। নিউ মিডিয়ার কল্যাণে দর্শক যত ক্ষমতায়িত হয়েছে তার পছন্দের স্বাধীনতা তত বেড়েছে। আর এই পছন্দের স্বাধীনতার সাথেই ওতপ্রোতভাবে জড়িত মিডিয়া ডায়েট।

ধরা যাক, আপনার বাসায় ৫ জন সদস্য। মিডিয়া ব্যবহারের ক্ষেত্রে দেখবেন, একেকজনের একেক রকম পছন্দ-অপছন্দ। আপনার মা হয়তো স্মার্টফোনেই ইউটিউবে পল্লীগীতি শোনেন। আপনার বাবা হয়তো নিজের ফোনে দেখেন এবং শোনেন শুধু ওয়াজ ও ধর্মীয় বয়ান। আপনার বাসায় ৫ বছর বয়সী যেই শিশুটি আছে সে দেখে শুধু কার্টুন। আপনি নিজে হয়তো দেখেন শুধু নিউজ আর টক শো। আর আপনার স্বামী হয়তো দেখেন প্রধানত স্পোর্টস।

এক বাসায় থাকা ৫ জন মানুষের মিডিয়া ডায়েটে কোনো মিল নেই। বুফে সিস্টেমে সাজানো খাবার থেকে যে যার ইচ্ছে মতন যেমন প্লেটে খাবার তুলে নেয়, তথ্য ও বিনোদনের ক্ষেত্রেও বিষয়টা একইরকম। একজনের মিডিয়া ডায়েটের সাথে আরেকজনের মিল নেই। পছন্দের এই স্বাধীনতাই দর্শককে মুক্তি দিয়েছে ‘এপয়েন্টমেন্ট টিভি’র বিড়ম্বনা থেকে। মানে দর্শককে এখন আর ‘লিনিয়ার টাইম’ মেইনটেইন করে সারা জাতীর সাথে নির্ধারিত সময়ে বসে শুক্রবার বিকেলের সিনেমা দেখতে হয় না। সিনেমা এখন ইউটিউব থেকে নন-লিনিয়ার টাইমে সে তার সুবিধা ও রুচি মতন দেখে নয়।

এই বাস্তবতাটা দর্শকের জন্য সুবিধার। কিন্তু তথ্য-বিনোদন বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের জন্য খুব সুখকর নয়। কারণ, বাছাই করার এই স্বাধীনতাই দর্শককে পরিণত করেছে ‘ফ্র্যাগমেন্টেড অডিয়েন্স’-এ। অর্থাৎ এক অনুষ্ঠান দিয়ে দিয়ে সব্বাইকে খুশি করার আর সুযোগ নেই। দর্শকেরা এখন রুচি মোতাবেক আগেই ভাগ ভাগ হয়ে নিজের পছন্দের কন্টেন্ট দেখেন।

৪.

ফ্র্যাগমেন্টেড বা বিভাজিত দর্শক-পাঠকের চাপ এসে পড়েছে গণমাধ্যমের ব্যবসায়। যেই প্ল্যাটফর্ম বা মিডিয়া আউটলেটের পাঠক-দর্শক যত বেশি, সেই প্রতিষ্ঠান সাধারণত বিজ্ঞাপনও বেশি পায়। যত বেশি বিজ্ঞাপন তত বেশি আয়-রোজগার।

অনলাইন নিউজপেপার ও সোশাল মিডিয়ার এই যুগে ক্লিকের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই, নিজেদের ওয়েব সাইটে বা পেজে বেশি-বেশি দর্শক-পাঠক টানতে প্রতিষ্ঠানগুলো মরিয়া হয়ে থাকে। এই মরিয়া প্রচেষ্টার অংশ হিসেবেই নিউজের শিরোনামে কখনো যোগ করা হয় চমক-লাগানো উদ্ভট শব্দ এবং যৌন সুড়সুড়ি দেয়া শব্দ ও ছবি। অর্থাৎ এটা অনেকটা যেনো দর্শক-পাঠক টানার ফাঁদ। আর এই বাস্তবতাটিকেই ডাকা হয় ‘ক্লিকবেইট জার্নালিজম’।

ক্লিকবেইট জার্নিলিজমের কারণে সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতা অনেকক্ষেত্রেই রক্ষিত হচ্ছে না। আর এই ধরনের চর্চা দেখে প্রথাগত গণমাধ্যম যেমন টিভি, রেডিও, নিউজপেপারের অনলাইন সংবাদে মানুষের আস্থা কমে। ফলে, খবর পাবার জন্য অনেক ক্ষেত্রেই ফেসবুকের উপরে মানুষ নির্ভরশীল হচ্ছে। এই সুযোগে সমাজে গুজব বা অর্ধসত্য ছড়ানোর ঝুঁকি বাড়ছে।

পাল্টে যাওয়া এই বাস্তবতা শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা পৃথিবীর জন্যই সত্য। ইউরোপ-অমেরিকাসহ সব উন্নত দেশই ‘মিসইনফরমেশান’- অনিচ্ছাকৃত ভুল বা অসত্য তথ্য, ‘ডিজইনফরমেশন’- উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে অসত্য, মিথ্যা বা অস্পষ্ট তথ্য ছড়িয়ে দেয়া এবং ‘গুজব’ বন্ধে লড়ছে। ট্র্যাডিশনাল বা সনাতনী গণমাধ্যম যেমন টিভি, রেডিও, নিউজপেপার পৃথিবীব্যাপীই অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে। দিকে দিকে এখন অনলাইন ও সোশাল মিডিয়ারই জয় জয়কার।

সারা পৃথিবীতেই ছাপা পত্রিকার সংখ্যা অকল্পনীয় দ্রুততায় কমছে। যারা বেঁচে আছে তাদেরকেও বাঁচার জন্য রপ্ত করতে হচ্ছে নতুন নতুন টেকনিক। তাদেরকেও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে আসতে হচ্ছে, ফেসবুক পেজ খুলতে হচ্ছে, ইউটিউব চ্যানেলে কন্টেন্ট আপলোড করতে হচ্ছে। এভাবেই ফ্র্যাগমেন্টেড অডিয়েন্স বা বিভাজিত দর্শক-পাঠকের কাছে পৌঁছাতে চাইছে গণমাধ্যমগুলো।

৫.

ইংরেজি ‘ম্যাস মিডিয়া’কে বাংলায় নাম দেয়া হয়েছে ‘গণমাধ্যম’। কিন্তু চরিত্রের দিক থেকে আমাদের গণমাধ্যম ‘গণ’কে কতখানি ধারণ করে, ‘গণ’-এর কথা কতখানি বলে? আমাদের মাধ্যম কি চরিত্রগতভাবে এখন কেবলি ‘প্রচার মাধ্যমে’ পরিণত হয়েছে? এই গণমাধ্যম কি মোটাদাগে কেবলি ‘পুঁজির পাহারাদার’? কেবলি রাষ্ট্র ও সমাজের প্রথাগত মতাদর্শ পুনরুৎপাদন-যন্ত্র হিসেবেই কাজ করে যাচ্ছে? যদি তাই হয়, তাহলে সমাজের আম-পাব্লিকের দুঃখ-বঞ্চনার কথাগুলো আমাদের গণমাধ্যমে উহ্য থেকে যাচ্ছে? এগুলোও জরুরি প্রশ্ন।

মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশ শুধু ধনীদের হবার কথা ছিল না। স্বাধীন দেশে গণমানুষের অধিকার নিশ্চিত করবার অঙ্গীকার করা হয়েছিল। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর, এই রাষ্ট্র কি তার সেই গণমুখী চরিত্রকে আদৌ আর ধারণ করছে? এটি জরুরি প্রশ্ন। কিন্তু যে গণমাধ্যম এই প্রশ্ন করার কথা সেটির গণমুখী চরিত্র কি আদৌ বজায় আছে? আমাদের গণমাধ্যমের বিবর্তনকে জানতে হলে শুধু এর আঙ্গিক পরিবর্তন নিয়ে কথা বললেই হবে না। এর চরিত্রগত বদলের বিষয়গুলোকেও চিহ্নিত করতে হবে এবং কথা বলতে হবে।

প্রশ্নকারী ও সমালোচনাকরী হিসেবে আপনার এইসব কথা যদি সাবেকী মিডিয়া প্রকাশ না করে তো সোশাল মিডিয়া তো রয়েছেই। ফেসবুকের একেকটি একাউন্টই এখন একেকটি টেলিভিশন চ্যানেল। ব্যক্তির চ্যানেলই এখন ম্যাস মিডিয়া। তাই, নয়া মাধ্যমের যুগে ব্যক্তির টুঁটি চেপে ধরা কঠিন।